পিশাচের রাত – ১০

দশ

চিকুর কাছে সব শোনার পর প্রিয়াংকা ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। ও বলল, ‘আমি আর বাংলা কোচিং-এ পড়তে যাব না।’

চিকু বলল, ‘আমি যতটুকু বুঝেছি, পূর্ণিমার রাত ছাড়া স্যারকে ভয়ের কোনও কারণ নেই। কিন্তু আমার সঙ্গে আজ যেরকম কথাকাটাকাটি হয়ে গেল তাতে আমার আর বাংলা কোচিং-এ যাওয়া হবে না। বাড়িতে মা-বাবাকে কী বলব তাই ভাবছি…।’

‘তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই প্রুফ চাইবে। বলবে, এ হতে পারে না—ইমপসিবল।’

প্রিয়াংকার কথাগুলো চিকু কিছুক্ষণ চিন্তা করল। ওর মনে হল, প্রিয়াংকা ঠিকই বলেছে। হরিহরবাবুর মতো ধার্মিক সাত্ত্বিক মানুষকে কেউ রক্তপিশাচ বলে ভাবতে পারবে না। তা ছাড়া সবাই হয়তো জানতে চাইবে, হঠাৎ করে মানুষটা এরকম হয়ে গেল কেমন করে। উনি জাঙ্গিকুলে বহুবছর ধরে আছেন—এতদিন তো পূর্ণিমার রাতে কোনও খুন হয়নি! তা হলে চার-পাঁচমাস আগে হঠাৎ এমন কী হল যে, মানুষটা অমানুষ হয়ে গেল!

চিকু এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। প্রমাণের কথা ভাবতে-ভাবতে ওর মাথার ভেতরটা কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। সত্যিই তো, ওর মুখের কথা কেউ একবর্ণও বিশ্বাস করতে চাইবে না! তা ছাড়া চিকু নিজেও হরিহরবাবুকে নৃশংস ভয়ঙ্কর একটা অমানুষ বলে ভাবতে পারছিল না।

সুতরাং, অকাট্য একটা প্রমাণ চাই। আর তার জন্য বোধহয় আগামী পূর্ণিমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

কিন্তু পূর্ণিমা আসতে তো এখনও অনেক দিন বাকি! এতগুলো দিন কি স্রেফ হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়? ঠিক তখনই চিকুর মাথায় বুদ্ধিটা এল।

ও প্রিয়াংকাকে বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ সবাই প্রমাণ চাইবে। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার মনে আর কোনও সন্দেহ নেই। অবশ্য আমার মুখের কথা সবাই মানবে কেন। ধরো, স্যার নিজে যদি সব স্বীকার করেন?’

‘স্যার হঠাৎ কনফেস করতে যাবেন কেন?

‘কারণ আমি আর তুমি স্যারকে ফোন করে করে পাগল করে মারব।’

‘ওরে বাবা!’ প্রিয়াংকা ভয়ে আঁতকে উঠল।

চিকু ওকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘কোনও ভয় নেই। আমি তোমাকে সব শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি রোজ একবার ফোন করবে—আর আমি একবার। তাতেই আশা করি অ্যাকশন হবে।’

আরও মিনিট পনেরো আলোচনার পর চিকু বাড়িতে ফিরে এল। রাতে শোওয়ার আগে ও মাকে বলল, বাংলা কোচিং-এ ঠিকমতো পড়া হচ্ছে না। ও অন্য বাংলা স্যারের কোচিং-এ ভরতি হবে।

মা খানিকটা অবাক হলেও রাতে আর কথা বাড়াল না। পরদিন সকালে বাবা অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর চিকু হরিহরবাবুর বাড়িতে ফোন করল।

কাকিমা ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই ও খুব মোলায়েম গলায় বলল, ‘স্যার আছেন?’

‘ধরো, দিচ্ছি—।’

কাকিমা চিকুর গলা চিনতে পারেননি। অবশ্য পারার কথাও নয়। কারণ, চিকু এর আগে স্যারের বাড়িতে মাত্র একদিন ফোন করেছে।

‘হ্যালো’ হরিহরবাবুর গলা শুনতে পেল চিকু।

ও রিসিভারের খুব কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, ‘তোমার পাপের বোঝা তোমাকে শেষ করে দেবে…।’

‘কে? কে?’

‘আমি সব জানি।’ ধীরে-ধীরে ফিসফিস করে চিকু বলল, ‘গত চারটে পূর্ণিমায় তুমি চারজন মানুষকে নৃশংসভাবে খুন করেছ। আর একজনকে খুন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পারোনি।’

‘কে, চিকু?’ চাপা গলায় জানতে চাইলেন হরিহরবাবু।

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চিকু বলে চলল, ‘আমি সব দেখেছি। সব জানি। সামনের পূর্ণিমায় কাউকে আমি খুন হতে দেব না।’

‘চিকু, তুই আমাকে মিছিমিছি সন্দেহ করছিস। আমি কোনও পাপ করিনি। তুই খুব ভালো ছেলে। মিছিমিছি আমাকে ভুল বুঝিস না…।’

‘অন্য কাউকে খুন করার চেয়ে নিজেকে খুন করা অনেক সহজ। তোমার সুইসাইড করা উচিত। তোমার মতো পাপীরা আত্মহত্যা করলে সেটা মহাপাপ হয় না। সামনের পূর্ণিমায় তুমি নিজেকে খুন করো—সেটা সবার পক্ষে ভালো হবে।’

ও-পাশ থেকে আবেগে থরথর গলা শোনা গেল, ‘তুই ভুল করছিস। আমি পাপী নই। আমি কোনও পাপ করিনি।’

‘পূর্ণিমার রাতে তুমি কী করো জাঙ্গিকুলের সবাইকে আমি জানিয়ে দেব। রাস্তা-ঘাটে লোকে তোমাকে দেখলে “ছি-ছি” করবে, তোমার গায়ে থুতু দেবে। সুইসাইড করা ছাড়া তোমার আর কোনও পথ নেই…।’

রিসিভার নামিয়ে রাখল চিকু। ওর বুকের ভেতর টিপটিপ করে শব্দ হচ্ছিল। বড়-বড় নিঃশ্বাস পড়ছিল। আবার কাল সকালে ও স্যারকে ফোন করবে।

কিন্তু এভাবে ফোন করলে কি কাজ হবে? স্যার কি পুলিশের কাছে নিজের দোষ স্বীকার করবেন? তা ছাড়া এ রকম ভয়ঙ্কর অলৌকিক ঘটনা পুলিশ কি বিশ্বাস করবে?

এইসব নানান কথা ভাবতে-ভাবতে স্কুলের জন্য তৈরি হতে লাগল চিকু। আজ জনতা কেবিনের সামনে প্রিয়াংকার সঙ্গে ও দেখা করবে। বলবে, টেলিফোনে স্যারের সঙ্গে ওর কী ধরনের কথাবার্তা হয়েছে। তা হলে প্রিয়াংকার ফোন করার কাজে খানিকটা সুবিধে হতে পারে।

সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে দেশপ্রিয় সুইটস-এর কাছে রোহনকে দেখতে পেল চিকু—সঙ্গে দু-চারজন বন্ধুবান্ধব দাঁড়িয়ে আছে। চিকু রোহনের কাছে গিয়ে সাইকেল থামাল।

‘রোহনদা, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে—’ উত্তরে রোহন পকেট থেকে রুদ্রাক্ষের একটা দানা বের করল: ‘এই বিষয়ে?’

মাথা নাড়ল চিকু : ‘হ্যাঁ।’

‘এখন বলবি?’

‘না, স্কুলের দেরি হয়ে যাবে। সন্ধেবেলা তোমার সঙ্গে আলাদা করে কথা বলব।’

সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল চিকু।

সন্ধেবেলা ওর কাছে সব কথা শুনে রোহন একেবারে তাজ্জব হয়ে গেল। ও আপনমনেই বলল, ‘এ-কথা তো কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না!’

‘হ্যাঁ—প্রিয়াংকাও তাই বলছিল। বলছিল, প্রমাণ চাই।’ দেশপ্রিয় সুইটস-এর কাছে একটা শিরীষ গাছের পাশে দাঁড়িয়ে রোহন আর চিকু কথা বলছিল। বিকেলের দিকে একটা কালবৈশাখী হয়ে দু-পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই রাস্তায় কাদা আর জল। স্কুটার বা গাড়ি গেলে কাদা-জল ছিটকে আসছে। তাই পথচারীরা এবড়োখেবড়ো রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে।

রাস্তার দিকে চোখ রেখে চিন্তা করতে-করতে রোহন বলল, ‘হু প্রমাণ চাই। রুদ্রাক্ষের মালা আর মুখের পোড়া দাগ তো ঠিক প্রমাণ নয়…।’

‘সেইজন্যেই তো আমি আর প্রিয়াংকা উড়ো ফোন করে স্যারকে কনফেস করতে বলছি!’

‘তাতে কী লাভ! ধর ফোনে হরিহরবাবু সব স্বীকার করলেন—তাতে তো আর ওঁকে অ্যারেস্ট করা যাচ্ছে না! যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে এরকম আজগুবি ব্যাপার কে বিশ্বাস করবে!’

‘কেন, লাস্ট পূর্ণিমার রাতে সেই অমানুষটার ফেরোশাস গর্জন অনেকেই তো শুনেছিল!’

‘শোনা এক জিনিস, আর চোখে দেখা এক জিনিস…’ রোহন আনমনাভাবে বলল।

রোহনের কথাটা চিকুর মনে বারবার প্রতিধ্বনি তুলতে লাগল। শোনা এক জিনিস, আর চোখে দেখা এক জিনিস…শোনা এক জিনিস, আর…।

কিছুক্ষণ পর চিকু বলল, ‘টেলিফোনে কাজটা ক’দিন চালিয়ে যাই…দেখি, মাথায় আর কোনও আইডিয়া আসে কি না। তুমিও ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভেবে দ্যাখো…তবে এখনই কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, কী বলো?’

‘মাথা খারাপ! তুই তোর অপারেশান চালিয়ে যা। কোনও আইডিয়া এলে আমাকে বলিস।’

রোহনের কথায় ঘাড় নেড়ে বাড়ির দিকে ফিরে চলল চিকু। প্রমাণ চাই—প্রমাণ।

রাতে বিছানায় শুয়ে চিকু ছটফট করতে লাগল। কিছুতেই ওর ঘুম আসছিল না। ওর ভয় হচ্ছিল যে, ঘুমিয়ে পড়লেই ও হয়তো হরিহরবাবুকে স্বপ্নে দেখবে। দেখবে সৌম্যকান্তি মানুষটা ধীরে-ধীরে কীভাবে বদলে যাচ্ছে অমানুষে। তারপর এগিয়ে আসছে চিকুর দিকে। সামনে দুটো হাত বাড়ানো। সেই হাতের দশ আঙুলে লম্বা-লম্বা বাঁকানো নখ।

চিকু টের পাচ্ছিল, প্রিয়াংকা ওকে হাত ধরে প্রাণপণে টানছে আর চিৎকার করছে, ‘পালাও, চিকু, পালাও!’

চিকুর ঘুম ভেঙে গেল। নানান কথা ভাবতে ভাবতে কখন ওর তন্দ্রা মতন এসে গিয়েছিল কে জানে! প্রিয়াংকার কথা মনে পড়ল ওর। রাত আটটা নাগাদ প্রিয়াংকাকে ও ফোন করেছিল। তখনই প্রিয়াংকা ওর উড়ো ফোনের কথাবার্তা চিকুকে জানিয়েছে। কথাগুলো চিকুর মনে ভেসে উঠল আবার।

ও-প্রান্তে ফোন বেজে উঠতেই হরিহরবাবুর স্ত্রী ফোন ধরেছেন। ‘হ্যালো।’

‘স্যার আছেন?’ প্রিয়াংকা স্বাভাবিক গলায় জিগ্যেস করেছে। ‘ধরো—দেখছি…।’

একটু পরেই ফোন ধরে স্যার ‘হ্যালো’ বলতেই প্রিয়াংকা চিকুর পরামর্শ মতো বলে উঠেছে, ‘ “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।” ’

‘কে? কে কথা বলছ?’ হতচকিত হয়ে হরিহরবাবু জিগ্যেস করলেন।

ফিসফিস করে প্রিয়াংকা বলল, ‘সামনের পূর্ণিমায় তুমি বাড়ি ছেড়ে বেরোবে না। বেরোলেই তোমাকে খতম করে দেওয়া হবে।’

‘আমি…আমি…আমার কোনও দোষ নেই। এটা…এটা…আমার অসুখ। অসুখের ওপর আমার কোনও হাত নেই…।’

‘তুমি শিক্ষকদের কলঙ্ক। জাঙ্গিকুলের কলঙ্ক…।’

‘না-না, না, আমি কোনও অন্যায় করিনি…কোনও পাপ করিনি। আমার আত্মা পবিত্র।’

‘তোমার আত্মা বলে কিছু নেই। তুমি প্রেতাত্মা।’

হরিহরবাবু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললেন, ‘বিশ্বাস করো, আমার কোনও দোষ নেই! একটা শয়তান ছল করে আমাকে দিয়ে কীসব করিয়ে নেয়। আমার তখন জ্ঞান থাকে না।’

‘আর কাউকে খুন করার চেয়ে নিজেকে খুন করা অনেক সহজ। তোমার সুইসাইড করা উচিত…তোমার সুইসাইড করা উচিত…।’

‘তুমি কে?’ আচমকা প্রশ্ন করলেন হরিহরবাবু। তাঁর গলার স্বর দিব্যি স্পষ্ট। কান্নার কোনও ছোঁওয়া সেখানে নেই।

তা হলে কি স্যার এতক্ষণ অভিনয় করছিলেন? প্রিয়াংকা মনে মনে ভাবল।

‘তুমি কে? চিকুর বন্ধু?’ কিছুক্ষণ ও-প্রান্ত চুপচাপ। তারপর : ‘তুমি কি প্রিয়াংকা?’ সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়াংকা ভয় পেয়ে রিসিভার নামিয়ে রেখেছে। ওর হাত থরথর করে কাঁপছিল।

সত্যিই কি এটা স্যারের অসুখ? চিকু নিজেকে যেন প্রশ্ন করল।

এই অসুখের ওপরে কি স্যারের কোনও হাত নেই? সত্যিই কি একটা শয়তান ছল করে স্যারকে দিয়ে প্রতি পূর্ণিমায় জঘন্য কাজ করিয়ে নেয়?

এইসব ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল চিকু।

কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই চিন্তাগুলো আবার চিকুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

একইসঙ্গে ওর মনে পড়ে গেল, স্যারকে আবার ফোন করতে হবে।

এগারো

হরিহরবাবুর কাছ থেকে নেমন্তন্নটা এল একেবারে আচমকা। এরকম ভয়ঙ্কর নেমন্তন্ন চিকু জীবনে কখনও পায়নি। পূর্ণিমার রাতে স্যার ওকে বাড়িতে আসতে বললেন। সঙ্গে প্রিয়াংকাকেও নিয়ে আসতে বললেন।

উড়ো টেলিফোনের ব্যাপারটা তিন-চারদিন চলার পরই নেমন্তন্নটা পেল চিকু।

রোজকার মতো সেদিন সকালে স্যারের বাড়িতে ফোন করেছিল চিকু। রিং বেজে ওঠামাত্র স্যার নিজেই ফোন ধরলেন।

‘হ্যালো, চিকু?’

চিকুর মনে হল, স্যার বোধহয় ওর টেলিফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। চিকু ফিসফিসে গলায় বলল, ‘সামনের পূর্ণিমায় কোনও মানুষ যেন খুন না হয়।’

‘না, না, আর কেউ খুন হবে না, আর কেউ খুন হবে না।’

স্যারকে বাধা দিয়ে চিকু বলল, ‘কিন্তু একটা সুইসাইড যেন হয়।’

‘সুইসাইড!’

‘হ্যাঁ। একটা নরপিশাচ যেন আত্মহত্যা করে। এ-আত্মহত্যায় কোনও পাপ নেই।’

টেলিফোনের ও-প্রান্তে হরিহরবাবু ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তারপর কান্না-ভাঙা গলায় বললেন, ‘নিজেকে খুন করতে আমি পারব না। তা হলে তোদের কাকিমাকে কে দেখবে! ওকেও হয়তো আমার সঙ্গে সহমরণে যেতে হবে। আর সেটা তো সম্ভব নয়! এটা যে কী কষ্ট তা তুই বুঝবি না। এ-অসুখের জ্বালা আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছে…।’

চিকু স্যারের কান্নায় নরম হল না। কোথা থেকে যেন এক দুর্জয় সাহস ওর ভেতরে তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। ও বলল, ‘যাদের তুমি খুন করেছ তাদের আত্মীয়স্বজন তোমার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছে। তোমাকে আত্মহত্যা করতেই হবে!’

‘চিকু, চিকু—শোন—শোন—।’

‘কী?’

‘সামনের গুরুপূর্ণিমায় তুই আমার বাড়িতে আয়। তোকে সব খুলে বলব। তখন তুই আমার অসুখের ব্যাপারটা বুঝতে পারবি…।’

আগামী পূর্ণিমায় স্যার ওঁর বাড়িতে যেতে বলছেন! চিকু বেশ অবাক হল। তা হলে কি সামনের পূর্ণিমায় কেউ খুন হওয়ার ভয় নেই?

‘…সন্ধের পর তুই আসিস…’ স্যার তখনও কথা বলে যাচ্ছিলেন, ‘…আর প্রিয়াংকাকেও সঙ্গে নিয়ে আসিস…।’

কেন, প্রিয়াংকা কেন!

প্রিয়াংকার নাম শুনে চিকু যেন ইলেকট্রিক শক খেল। স্যার কি তা হলে ওদের দুজনের গলাই ধরে ফেলেছেন।

সুতরাং আর লুকোচুরি করে কোনও লাভ নেই। তাই চিকু এবার স্বাভাবিক গলায় কথা বলল, ‘প্রিয়াংকাকে সঙ্গে নিয়ে আসব কেন?’

উত্তরে স্যার হাসলেন : ‘তুই সেদিন সন্ধেবেলায় আমার সঙ্গে যখন তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছিলি, প্রিয়াংকা তখন তোর সঙ্গে ছিল। ওর মনে হয়তো নানারকম কৌতূহল হচ্ছে। হয়তো তোরই মতো ও আমাকে শয়তান, পিশাচ, কিংবা অমানুষ বলে ভাবছে। আর তুই তো জানিস, তোরা দুজন আমার সবচেয়ে প্রিয় স্টুডেন্ট। তোদের মনে কোনও ব্যথা দিতে আমি চাই না।’

চিকু কেমন যেন দোটানায় পড়ে গেল। ওর চিন্তাগুলো মনের ভেতরে তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল।

হরিহরবাবু একটানা কথা বলে যাচ্ছিলেন। ওঁর কথায় সাপ-খেলানো বাঁশির মতো সুর। সেই সুর চেতনাকে অবশ করে দিতে চাইছে। চিকুর মাথা ঝিমঝিম করছিল।

‘…চোখের সামনে যদি সব দেখিস, তবে তোরা ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝতে পারবি। বুঝতে পারবি, আমার আসলে কোনও দোষ নেই। সবই নিয়তি…।’

শেষ পর্যন্ত চিকু রাজি হল। কারণ, জলজ্যান্ত প্রমাণ চাইলে এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই। তবে রোহনদাকে ও সঙ্গে নিয়ে যাবে। যদি সত্যি-সত্যি কোনও বিপদ হয় তা হলে রোহনদা বাঁচাবে। সুতরাং, রোহনকে নেমন্তন্নের খবরটা জানাল চিকু।

‘কী করি বলো তো, রোহনদা? যাব?’

‘নিশ্চয়ই যাবি! তা না হলে কেসটা প্রমাণ হবে কী করে!’

‘যদি স্যারের বাড়িতে সাঙ্ঘাতিক কিছু হয়?’

খদ্দরের পাঞ্জাবির তলায় হাত ঢোকাল রোহন। তারপর একটা দোনলা-শাটগান বের করে চিকুকে দেখাল : ‘এই দ্যাখ, নলকাটা দোনলা মেশিন। দেশি, তবে কাজে বিদেশিকে টেক্কা দেবে। কিছুদিন ধরে শুনছিস না, পাশের নলডাঙ্গায় খুব ডাকাতি হচ্ছে! তাই গত মাসে এটা কিনেছি। এটা কাছ থেকে ফায়ার করলে বডি ফুটো করে একজোড়া গুলি বেরিয়ে যাবে।’ চিকুর কাঁধে হাত রাখল রোহন। মন-কেমন-করা গলায় বলল, ‘তুই, প্রিয়াংকা, তোরা পড়াশোনায় এ ক্লাস। আমাদের দেশের ফিউচার। আর আমার কাজ কী জানিস? যে শয়তানের বাচ্চারা তোদের মতো ব্রাইট ছেলেমেয়েদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে, তাদের খতম করা। হয় জানে, নয় মানে, খতম করে দেব।’ শটগানটা উঁচিয়ে ধরল রোহন, আকাশের চাঁদের দিকে তাকাল : ‘তোর কোনও ভয় নেই। চাঁদটা পুরোপুরি গোল হতে দে, তারপর দেখবি…জাঙ্গিকুলের সব গোলমাল ভসকে দেব।’

চিকু অবাক হয়ে রোহনকে দেখছিল। বিশুদার দোকানের বালবের আলোয় রোহনের চোখ চকচক করছিল। মন্দকে খতম করার জন্যই ও মন্দ হয়েছে।

পূর্ণিমার দিন কীভাবে ওরা যাবে, কখন যাবে, সেসব চাপা গলায় আলোচনা করে নিল রোহন আর চিকু। চিকু বলল, প্রিয়াংকার সঙ্গে ও এ-ব্যাপারে কথা বলে নেবে। তারপর ওরা পূর্ণিমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

পূর্ণিমার তখনও ষোলো দিন বাকি ছিল। চিকুরা ষোলো, পনেরো, চোদ্দো করে দিন গুনতে লাগল।

বারো

পূর্ণিমা এসে পড়ার দু-চারদিন আগেই বর্ষা জাঙ্গিকুলে উকিঝুঁকি মারতে শুরু করল। জলাপুকুরের জল বেড়ে উঠল। আগাছার ঝোপঝাড়গুলো প্রকৃতির আশকারা পেয়ে আবার মাথাচাড়া দিতে লাগল। পথঘাটে খানাখন্দে ঘোলা জল জমতে লাগল।

বর্ষার সময় সবুজ গাছপালা থেকে এক অদ্ভুত গন্ধ পায় চিকু। সেই গন্ধে আকাশ-বাতাস ছেয়ে গেল। বাঁশপাতি, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, মাছরাঙা পাখিগুলো ঝকঝকে রং নিয়ে এখানে-সেখানে উড়ে বেড়াতে লাগল।

গুরুপূর্ণিমার দিন সন্ধে সাতটা নাগাদ চিকু আর প্রিয়াংকা যখন সাইকেল চালিয়ে হরিহরবাবুর বাড়িতে এসে পৌঁছল, তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে। আশপাশ থেকে ব্যাঙের গ্যাঙোর-গ্যাঙ ডাক কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।

গ্রিলের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল চিকু আর প্রিয়াংকা। সাইকেল দুটো একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে ওরা ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর পিছন ফিরে রাস্তার দিকে তাকাল।

একে বৃষ্টি, তার ওপরে রাস্তার আলো টিমটিম করে জ্বলছে। তা সত্ত্বেও ওরা রোহন আর ছোটকুকে দেখতে পেল। একটা আমগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে হাত নাড়ল। তারপর তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হরিহরবাবুর বাড়ির কাছে চলে এল। ভেতরে ঢুকে পড়ল। রোহন একটা বর্ষাতি পরে এসেছে। আর ছোটকুর মাথায় নীল রঙের পলিথিন শিটের ঘোমটা। তার ওপরে বৃষ্টি পড়ে চড়বড় চড়বড় শব্দ হচ্ছে।

রোহনের ইশারায় ছোটকু সুপুরিগাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল। চিকু আর প্রিয়াংকার খুব কাছে এসে রোহন চাপা গলায় বলল, ‘তোরা ভেতরে যা। আমি আর ছোটকু দরজার কাছেই আছি। কান পেতে সব শোনার চেষ্টা করছি। কেস ডেঞ্জারাস হয়ে উঠলেই আমাকে ডাকবি—।’

কথাগুলো বলে রোহন আর ছোটকু আড়ালে সরে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে চিকু কলিংবেল বাজাল।

কাকিমা এসে দরজা খুলে দিলেন। স্নেহের গলায় বললেন, ‘ইস! অনেকটা ভিজে গেছ দেখছি! ভেতরে চলো, তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে নেবে।’

কাকিমার পিছন পিছন ওরা দুজনে পড়ার ঘরে গিয়ে ঢুকল। আর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে পাথর হয়ে গেল।

হরিহরবাবু মেঝেতে বেশ আয়েস করে বসে আছেন। খুব ধীরে-ধীরে পান চিবোচ্ছেন। চোখে শান্ত নিশ্চিন্ত দৃষ্টি। যেন শিকার খুব কাছাকাছি, একেবারে আওতার মধ্যে চলে এসেছে।

স্যারকে দেখামাত্রই চিকু আর প্রিয়াংকার সব সাহস উবে গেল। সাঙ্ঘাতিকভাবে মনে পড়ে গেল, আজ পূর্ণিমা—যদিও আকাশে মেঘ থাকায় চাঁদ চোখে পড়েনি। তাতে হরিহরবাবুর কি কোনও অসুবিধে হবে? বোধহয় না। আকাশে গোল চাঁদ কোথাও একটা থাকলেই হল। তা হলেই অমানুষিক অসুখটা মাথাচাড়া দিতে পারবে।

ওর দুজনে কুলকুল করে ঘামছিল আর ফ্যালফেলে চোখে হরিহরবাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল।

‘আয়, আয়—বোস।’ একগাল হেসে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন হরিহরবাবু, ‘বসে একটু জিরিয়ে নে। তারপর সব বলছি। তোরা যা-যা জানতে চাস, জিগ্যেস করবি, আমি তোদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেব।’

শতরঞ্চি পাতাই ছিল। ওরা স্যারের কাছ থেকে একটু দূরত্ব রেখে জড়োসড়ো হয়ে বসল। কাকিমা একটা তোয়ালে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন : ‘এই নাও, এটা দিয়ে গা-মাথা একটু মুছে না—ও’ তোয়ালেটা প্রিয়াংকার হাতে দিলেন কাকিমা, আড়চোখে একবার স্বামীর দিকে দেখলেন : ‘আজ আর কেউ পড়তে আসবে না?’

‘না। আজ ওদের দুজনকে স্পেশাল ক্লাস করাব বলে ডেকেছি।’

কাকিমা বললেন, ‘তোমরা পড়ো। আমি পেঁয়াজি আর বেগুনি ভাজছি—খেয়ে যাবে।’

কাকিমা আড়ালে চলে যেতেই হরিহরবাবু নড়েচড়ে বসলেন। বললেন, ‘তোদের আজ খোলাখুলি সব বলব। আমার একটা মারাত্মক অসুখ হয়েছে। এমন অসুখ যে, সবাইকে এটার কথা খোলাখুলি বলা যায় না। তা সত্ত্বেও আমি অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। তাঁদেরকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অসুখটার আভাস দিয়েছি। তাঁরা ওষুধ দিয়েছেন…কিন্তু সেসব ওষুধে কোনও কাজ হয়নি…।’

চিকু আর প্রিয়াংকা দম বন্ধ করে শুনছিল। ওদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

বাইরে থেকে বৃষ্টির শব্দ ভেসে আসছিল। সেই সঙ্গে ব্যাঙের ডাকও। সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় চিকুর কেমন শীত-শীত করছিল।

আনমনা চোখে একটা বন্ধ জানলার দিকে তাকিয়ে হরিহরবাবু বলে চললেন, ‘অসুখটা আমার আগে ছিল না। গতবছর পুজোর সময় আমি আর তোদের কাকিমা—আমরা দুজনে মিলে হিমাচল প্রদেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কুলু-মানালি ওইসব আর কী! সেখানে একদিন এক পাহাড়ি পথে একজন ট্রাইবালের সঙ্গে—মানে, উপজাতির লোকের সঙ্গে—আমাদের আলাপ হয়। লোকটা পথের ধারে একটা ছোট্ট ঝুপড়িতে বসে উলকি কাটার কাজ করছিল। আমি আর তোদের কাকিমা সেখানে দাঁড়িয়ে লোকটির কাজ দেখছিলাম। লোকটা ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে আমাকে বলল, “বাবুজি, আপনারা উলকি কেটে গায়ে ছবি এঁকে নিন। আমার কাছে নানান ধরনের ছবি আছে। এমন ছবিও আছে যার মধ্যে অনেক ক্ষমতা আছে—মানুষকে তেজি করে দেয়। সব মুশকিল আসান করে দেয়। এইসব উলকি মন্ত্র-তন্ত্র করে আঁকতে হয়। মাত্র একশো টাকা দিলেই এঁকে দেব।”

‘কী যে হল আমাদের! লোকটার কথায় রাজি হয়ে গেলাম।’ কথা বলতে-বলতে পাঞ্জাবির বোতামগুলো খুলে ফেললেন হরিহরবাবু। ওটার গলার কাছটা ধরে বাঁদিকে টেনে নামলেন।

‘এই দ্যাখ—।’

ঘরের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল, স্যারের বাঁ বাহুতে একটা লোমশ পশুর ছবি আঁকা। পশুটা কেমন যেন কুঁজো হয়ে রয়েছে—যেন এক্ষুনি শিকার লক্ষ্য করে লাফ দেবে।

পাঞ্জাবিটা আবার ঠিকঠাক করে নিলেন স্যার।

‘…তারপর থেকেই আমার ক্লান্তি ক্রমশ কমতে লাগল। সবসময় শরীরের ভেতরে একটা চনমনে ভাব টের পেতে লাগলাম। বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে কিছু একটা করার নেশায় একেবারে খেপে উঠতে লাগলাম। সেইসঙ্গে কেমন জ্বর-জ্বর লাগত।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ নিচু করলেন হরিহরবাবু : ‘বেশ মনে আছে, গত ডিসেম্বরের পূর্ণিমায় আমি প্রথম খুন করেছি। না, না, মানুষ নয়—একটা ছাগলকে মেরেছিলাম। তারপর…ধীরে-ধীরে অসুখের তেজটা বাড়তে লাগল। আর…আর…গত ফেব্রুয়ারিতে প্রথম একজন ভবঘুরে ভিখিরিকে খুন করলাম।

‘তোরা হয়তো বলবি আমি মহাপাতক, পাপী। কিন্তু আমি বলব, আমি নির্দোষ। আমার একটা অসুখ হয়েছে—যে-অসুখটা ডাক্তাররা সারাতে পারছে না। তোরা আমাকে ভুল বুঝিস না। মাঝে-মাঝে মনে হয় আমি অপরাধী। মনে হয়, আত্মহত্যা করে এই নোংরা জীবনটাকে শেষ করে দিই। কিন্তু তারপরই আবার মনে হয়, আমার তো কোনও দোষ নেই।’ মুখ তুললেন হরিহরবাবু। ওঁর চোখে জল। কান্না-ধরা গলায় তিনি বললেন, ‘আসলে এই অসুখটা আমার নিয়তি…।’

কথা বলতে-বলতে হরিহরবাবুর গলাটা কর্কশ হয়ে যাচ্ছিল।

‘…আমার ভবিতব্য…আমার নিয়তি…তোদেরও বোধহয় নিয়তি…।’ তারপরই সব অর্থহীন কর্কশ জড়ানো শব্দ বেরিয়ে আসতে লাগল ওঁর মুখ দিয়ে। এবং ভয়ঙ্কর পরিবর্তনটা শুরু হয়ে গেল।

চিকু আর প্রিয়াংকা এত ভয় পেয়ে গেল যে, ভয় বোধটাই ওদের মন থেকে উবে গেল। ওরা হাঁ করে স্যারের পালটে যাওয়া দেখতে লাগল। যেন মুগ্ধ হয়ে কোনও হরার সিনেমা দেখছে।

স্যারের দেহটা ফুলতে লাগল। চোয়াল লম্বা হয়ে গেল। ঠোঁট ফাঁক হয়ে পান-চিবোনো ছিবড়ে বেরিয়ে এল। দাঁতগুলো হয়ে গেল ধারালো আর লম্বা।

ফুলে ওঠা শরীরের চাপে পাঞ্জাবি ফেটে গিয়ে কাপড়ের টুকরোগুলো এখান ওখান থেকে ঝুলে রয়েছে। সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় সেগুলো পতাকার মতো উড়ছে।

বর্ষায় আগাছা গজিয়ে ওঠার মতো স্যারের সারা শরীরে বড়-বড় লোম গজিয়ে উঠল। হাত-পায়ের নখগুলো মাপে লম্বা হয়ে বাঁকানো ছুরির ফলা হয়ে গেল।

চোখের সামনে হরিহরবাবু মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে গেলেন। প্রিয়াংকা ভয়ে থরথর করে কাপতে কাপতে উঠে দাঁড়াল। চিকুর হাত ধরে প্রচণ্ড এক টান মারল।

চিকু অনেকক্ষণ ধরে একটা চিৎকার খুঁজে বেড়াচ্ছিল। স্বপ্নের মধ্যে যেমন দৌড়তে চাইলেও দৌড়নো যায় না, এই মুহূর্তে চিৎকারটাও চিকুকে নিয়ে সেইরকম খেলা খেলছিল।

ভয়ঙ্কর অমানুষটা উঠে দাঁড়িয়ে সজোরে মাথা ঝাকাল। লালা ছিটকে পড়ল ওটার মুখ থেকে। তারপর চাপা গর্জন করে চিকুদের দিকে এক পা এগিয়ে এল। কোমরের কাছে ধুতিটা এলোমেলোভাবে জড়িয়ে থাকায় প্রাণীটাকে ভারি অদ্ভুত দেখাচ্ছিল।

হঠাৎই চিকুকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়াংকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল। যে-প্রমাণ ওরা এতদিন ধরে খুঁজছিল, সেই প্রমাণ এখন ওদের চোখের সামনে। কী ভয়ঙ্কর প্রমাণ!

‘…চোখের সামনে যদি সব দেখিস তবে তোরা ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝতে পারবি। বুঝতে পারবি আমার আসলে কোনও দোষ নেই। সবই নিয়তি…।’ টেলিফোনে শোনা স্যারের কথাগুলো মনে পড়ে গেল চিকুর।

এই অমানুষটাকেই ও জলাপুকুর থেকে শ্যাওলা আর কচুরিপানা মাথায় নিয়ে উঠে আসতে দেখেছিল।

অমানুষটা এক হিংস্র গর্জন করে উঠল।

আর সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে কড় কড় কড়াৎ করে বাজ পড়ার শব্দ হল।

তারপরই চিকুরা শুনতে পেল দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কার আওয়াজ। কাকিমা ভেতর থেকে পড়িমরি করে ছুটে এলেন পড়ার ঘরে।

অমানুষটার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালেন। সঙ্গে-সঙ্গে বাইরের দরজার ছিটকিনি ভাঙার আওয়াজ শোনা গেল।

হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল রোহন আর ছোটকু। ওদের সারা শরীর জলে ভেজা। বড় বড় শ্বাস ফেলে হাঁফাচ্ছে। ওদের গায়ে বর্ষাতি বা পলিথিন শিট নেই। বোধহয় বাইরে কোথাও খুলে এসেছে।

ওদের দেখেই কাকিমার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

কোনওরকমে তিনি বললেন, ‘কে—কে তোমরা?’

উত্তরে রোহন শটগানটা বের করে উঁচিয়ে ধরল।

চিকু আর প্রিয়াংকা তখন ঘরের এক কোণে দেওয়ালে মিশে যেতে চাইছে। এ ওকে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছে।

বিশাল চেহারার অমানুষটার ছায়া ঘরটাকে অন্ধকার করে দিয়েছে। ওটার হলদেটে সবুজ চোখ রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ির মতো ধকধক করে জ্বলছে। ওটা কী বুঝল কে জানে। চিকুদের দিক থেকে ঘুরে তাকাল রোহনদের দিকে।

ছোটকুর চোখ যেন ছিটকে বাইরে বেরিয়ে আসবে। ওর মুখ হাঁ করা। সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। কিন্তু রোহনের চোখে ঠান্ডা দৃষ্টি। ও যেন আগে থেকেই জানত এইরকম কিছু একটা হবে। রোহন আর দেরি করল না। প্রাণীটার মুখের দিকে শটগান তাক করে ঠান্ডা বলায় বলল, ‘তোমার আত্মাকে মুক্তি দিলাম।’

তারপর ফায়ার করল।

শব্দটা বদ্ধ ঘরে তেমন জোরালো শোনাল না। তবে দুটো গুলিই প্রাণীটার মুখে গিয়ে লাগল : একটা বাঁ চোখে, একটা কপালে।

এক বুক কাঁপানো গর্জন করে বিশাল অমানুষটা ভূমিকম্পে ধসে পড়া বহুতল বাড়ির মতো মেঝেতে পড়ে গেল। ওটার হাত কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছিল। কাকিমার শাড়ির ভাঁজে ওটার বাঁকানো নখ আটকে গেল। ফলে সেই টানে কাকিমাও পড়ে গেলেন মেঝেতে। ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন।

শটগানে নতুন গুলি ভরে নিল রোহন। তারপর সতর্ক পায়ে প্রাণীটার কাছে এগিয়ে এল।

চিকু আর প্রিয়াংকাও নিজেদের সামলে নিয়ে প্রাণীটার দিকে কৌতূহলের নজরে দেখতে লাগল।

আর কাকিমা সেই ভয়ঙ্কর লোমশ শরীরটাকে আঁকড়ে ধরে বিলাপ শুরু করলেন। সদ্যবিধবার সেই বুকফাটা কান্না পাথরকেও গলিয়ে দিতে পারে।

প্রাণীটার মুখের খানিকটা অংশ শটগানের গুলির দাপটে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেছে। মুখ আর কপাল রক্তে মাখামাখি। সারা শরীর নিথর।

বোঝাই যাচ্ছিল, পূর্ণিমার রাতে জাঙ্গিকুলে আর কখনও কেউ খুন হবে না।

হঠাৎই একটা অবাক কাণ্ড ওদের চোখে পড়ল। প্রাণীটার দেহের লোমগুলো শরীরের মধ্যে ধীরে-ধীরে ঢুকে পড়ছে। বাঁকানো লম্বা নখ আবার ঢুকে যাচ্ছে আঙুলের ভিতরে। দাঁতগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়ায় ঠোঁটজোড়া টান-টান অবস্থা থেকে ক্রমশ ঢিলে হচ্ছে, আবার ঢেকে দিতে পারছে দাঁতের পাটিকে।

ধীরে ধীরে মৃতদেহটা বদলে গেল। অমানুষ থেকে আবার মানুষ হয়ে গেল।

ওদের চোখের সামনে এখন পড়ে রয়েছে হরিহরবাবুর মৃতদেহ। সেই মৃতদেহ আঁকড়ে ধরে তাঁর বিধবা স্ত্রী হাউহাউ করে কাঁদছেন। চিকু আর প্রিয়াংকা কাছে এগিয়ে গেল। অস্বস্তি হলেও কাকিমাকে ওরা সান্ত্বনা দিতে চাইল।

‘কাকিমা, কাঁদবেন না। স্যারের শরীরে পিশাচ ভর করেছিল। স্যারের আত্মা এবার শান্তি পাবে।’ চিকু নরম গলায় বলল।

উত্তরে কাকিমা স্বামীর মৃতদেহ থেকে মুখ তুললেন। ঘুরে তাকালেন চিকু আর প্রিয়াংকার দিকে।

‘কিন্তু আমাকে শান্তি দেবে কে? আমিও তো হাতে উলকি কেটে ছবি এঁকেছি!’

চিকু অবাক হয়ে দেখল কাকিমার দু-চোখের মণিতে দু-টুকরো লাল আগুন জ্বলছে। আর ঠোঁটের বাইরে বেরিয়ে এসেছে দুটো লম্বা শ্বদন্ত। খলখল করে হেসে কাকিমা উঠে দাঁড়ালেন।

প্রিয়াংকা চিৎকার করে উঠল।

‘আমরা দুজনে বেশ ছিলাম। পিশাচ বর, আর পিশাচ বউ। ও শিকার করে রক্ত খেয়ে আসত। আর আমি ওর শরীর থেকে রক্ত খেতাম। এমনই ছিল আমাদের রক্তের সম্পর্ক। এখন কী হবে! একা-একা আমি বাঁচব কী করে!’

রোহন হতবাক হয়ে গিয়েছিল। চিকু, প্রিয়াংকা, ছোটকুরও একই দশা। এরকম একটা আশ্চর্য ঘটনার জন্য ওরা কেউই তৈরি ছিল না।

কাকিমা আচমকা বনবেড়ালের মতো লাফ দিলেন। ওঁর লক্ষ্য ছিল রোহন। কিন্তু ছোটকু পলকে ছিটকে এসে রোহনকে আগলে দাঁড়াল।

ফলে রাগে শোকে অন্ধ পিশাচী খ্যাঁক করে কামড়ে ধরল ছোটকুর গলা। ওর ধারালো দাঁতে ছোটকুর গলার নলি ছিঁড়ে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। সেইসঙ্গে চাপা ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল।

সম্মোহনের ঘোর কাটিয়ে রোহন শটগান তুলে ধরল। ছোটকুর ওপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা কাকিমার ঘাড়ে শটগানের নল ঠেকিয়ে ফায়ার করল।

ছোটকু আর কাকিমা দুজনেই জড়াজড়ি করে খসে পড়ল মেঝেতে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ছোটকুর রক্তমাখা দেহ ছেড়ে আহত কেউটের মতো রোহনকে ছোবল মারতে চাইলেন কাকিমা। শরীরটাকে দু-পাক গড়িয়ে ধারালো দাঁতে রোহনের পা কামড়ে ধরলেন।

রোহন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। সেই চিৎকারে সকলের কানে তালা লেগে গেল।

বাইরে বিকট শব্দে বাজ পড়ল।

আর রোহন অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে শটগানের বাঁট হাতুড়ির মতো বসিয়ে দিল কাকিমার মাথায়।

ও পাগলের মতো চিৎকার করছিল আর রাগে অন্ধ হয়ে শটগানের বাঁট দিয়ে উন্মাদ পিশাচীর মাথাটা থেঁতো করছিল।

একসময় কাকিমার দেহটা অসাড় হয়ে গেল। থেঁতলানো মাথাটা চুলে রক্তে মাখামাখি। আর হরিহরবাবুর মতোই কাকিমার শ্বদন্ত মাপে ছোট হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। চোখের মণির লাল বিন্দু দুটোও মিলিয়ে গেল।

রক্তে ভেসে যাওয়া ঘরে তিনটে মৃতদেহ পড়ে রইল।

রোহন ছোটকুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছিল। ওর পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল।

প্রিয়াংকা রোহনের পিঠে হাত রেখে ওকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিল। তারপর খেয়াল হতেই একটা রুমাল নিয়ে রোহনের পায়ের কাটা জায়গাটা বাঁধতে লাগল।

চিকু কোনওরকমে টলতে টলতে ভেতরের ঘরের দিকে এগোল। ফোন করে সবাইকে খবর দিতে হবে। ফাঁড়িতেও একটা খবর দেওয়া দরকার।

বাইরে বৃষ্টির তেজ হঠাৎই আরও বেড়ে গেল।

কান-ফাটানো শব্দে বাজ পড়ল আবার।

-সমাপ্ত-