পিশাচের রাত – ১

এক

শীত চলে যাচ্ছিল। তাই বসন্তও এসে হাজির হয়েছিল দরজায়। কিন্তু প্রকৃতির কী খেয়াল, শীত আবার ঘুরে দাঁড়াল। সেই সঙ্গে নিয়ে এল বর্ষা। ফলে বসন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

গতকাল সকাল থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফিকে হয়ে আসা শীত একটু-একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। কাল রাতে শোওয়ার সময় আপনমনে গজগজ করতে-করতে চিকুর মা আলমারি খুলে আবার লেপ-কম্বল বের করে ফেলেছে।

‘এভাবে শীত চলে গিয়ে আবার ফিরে আসার কোনও মানে হয়!’ চিকুর বাবা একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে খবরের কাগজটা খুঁটিয়ে পড়ছিল, চিকুর মায়ের কথায় হেসে ফেলল : ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুব বিচ্ছিরি। এতে খুব অসুবিধে হয়। ওই যে সেদিন আমি অফিসে বেরিয়ে গেলাম—তারপর চশমাটা ভুলে ফেলে গেছি বলে ফিরে এলাম—তাতে চিকুর খুব অসুবিধে হয়ে গিয়েছিল…।’

চিকু ওয়াকম্যানের হেডফোন কানে লাগিয়ে সবে হিন্দি গান শোনার তোড়জোড় করছিল, বাবার কথায় অনুযোগ করে উঠল, ‘কী হচ্ছে, বাবা!’

ব্যাপারটা গত সপ্তাহের। বাবা সকাল দশটা নাগাদ অফিসে রওনা হতেই ও একটা রবারের বল নিয়ে ঘরের মধ্যে ফুটবল খেলতে শুরু করেছিল। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাবা আচমকা ফিরে আসায় কী কেলেঙ্কারি! কারণ, সামান্য জ্বর মতন হয়েছে বলে সেদিন ও স্কুলে যাবে না ঠিক করেছিল। বাবা ওর কথায় সায় দেওয়ায় মা শত জেদ করেও ওকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি। এখন মায়ের চেঁচামেচি গ্ৰাহ্য না করে ও ফুটবল প্র্যাকটিস করছিল। সামনের রবিবার জামতলার তরুণ সঙ্ঘের সঙ্গে ম্যাচ। ম্যাচ তো নয়—একেবারে প্রেস্টিজ ফাইট। তাই…।

বাবা কোনও সময় চিকুকে বকাবকি করে না। চশমা নিতে এসে। ওকে খেলতে দেখে শুধু বলেছিল, ‘বল খেললেই দেখবি তোর জ্বর সেরে যাবে।’

তারপর হেসে চলে গিয়েছিল।

চিকু তাতে ভীষণ লজ্জা পেয়ে তিনদিন এমন পড়াশোনা করেছিল যেন ওর মাধ্যমিক পরীক্ষা একেবারে কাছে এসে গেছে। অথচ ও এখন সবে ক্লাস নাইনে পড়ে—টেন-এ উঠবে।

আজ সকালের খবরে চিকু শুনেছে উষ্ণতা এক ধাক্কায় চার ডিগ্রি কমে গেছে। সুতরাং ওর হাতকাটা সোয়েটার আর মাফলার আলমারির তাক থেকে আবার বেরিয়ে এসেছে।

সন্ধে ছ’টার সময় হরিহরবাবুর কোচিং-এ চিকু বাংলা পড়তে যায়। হরিহরবাবু চিকুদের জাঙ্গিকুল হাই-স্কুলের বাংলা স্যার ছিলেন। বছরদুয়েক হল রিটায়ার করেছেন। বাংলা দারুণ পড়ান—তাই ওঁর কোচিং-এ খুব ভিড়। তা ছাড়া ভীষণ পণ্ডিত মানুষ—নানান বিষয়ে অনেক জানেন।

চিকু যখন সাইকেল নিয়ে বেরোল তখন বৃষ্টি পড়ছে কি পড়ছে না। তবে আকাশের এখানে ওখানে বেশ মেঘ জমে রয়েছে।

মা চায়ের কাপে চুমুক দিতে-দিতে কেব্‌ল টিভিতে সিনেমা দেখছিল। চিকুকে বেরোতে দেখে বলল, ‘অ্যাই, ছাতা নিয়ে বেরোবি—।’

চিকু আবদারের গলায় বলল, ‘বৃষ্টি তো পড়ছে না!’

‘একটু পরেই পড়বে।’

বিরক্তভাবে মায়ের ফোল্ডিং ছাতাটা ব্যাগে ভরে নিল চিকু। তারপর সিঁড়ির নিচ থেকে সাইকেলটা বের করে রাস্তায় চলে এল।

হরিহরবাবুর কোচিং সাইকেলে বড়জোর পাঁচ-সাত মিনিট। ঘণ্টি বাজিয়ে জোরে প্যাডেল করতে শুরু করল চিকু। বৃষ্টি জোরে নামার আগেই ওকে কোচিং-এ পৌঁছতে হবে। ছাতা মাথায় দিয়ে সাইকেল চালানো এক ঝকমারি।

সরু পিচের রাস্তা ভাঙাচোরা কয়েকবছর ধরেই। এই দু-দিনের বৃষ্টি সেটাকে একেবারে বেহাল করে দিয়েছে। রাস্তায় লোকজন কম। যে-ক’জন চোখে পড়ল সকলেই সোয়েটার, মাফলার কিংবা চাদরমুড়ি।

নাটোর মোড়ের কাছে শ্যামাপদদার তেলেভাজার দোকান পেরিয়ে গেল চিকু। সেখানে বেশ ভিড়। সাইকেল-রিকশাগুলো প্যাকপ্যাক হর্ন বাজিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে।

ডানদিকে ঘুরে শিবতলার হর-পার্বতীর মন্দির পেরোতেই চিকু দেখল দেশপ্রিয় সুইটস-এর পাশে বেঞ্চি পেতে রোহনদারা বসে আছে।

এ-এলাকা রোহনদের কথায় চলে। কোথাও কোনও গোলমাল হলে রোহনরা সবার আগে সেখানে ছুটে যায়। রাতবিরেতে বিপদ-আপদ হলে রোহনরা একডাকে হাজির। গত পুজোর আগে সমীর মিত্রদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। ওদের কাজের লোক কোনওরকমে পালিয়ে এসে রোহনের বাড়িতে খবর দিয়েছিল। রোহন সঙ্গে সঙ্গে দলবল জুটিয়ে মিত্রদের বাড়িতে গিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। গুলি-বোমা নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর দুজন ডাকাত ধরা পড়েছিল, আর তিনজন পালিয়ে গিয়েছিল। কষে গণধোলাই দেওয়ার পর আধমরা ডাকাতদুটোকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।

চিকুকে দেখে রোহন হাত নাড়ল, চেঁচিয়ে বলল, ‘কোচিং যাচ্ছিস?’

সাইকেল না থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চিকু জবাব দিল, ‘হ্যাঁ—বাংলা।’

রোহন হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় একবার ফেল করার পর আর লেখাপড়া করেনি। ওর বাবার সিমেন্ট-বালি-ইটের দোকান আছে—সেখানে মাঝে-মাঝে বসে। চিকুর সঙ্গে যখনই কথা হয় তখনই লেখাপড়া করতে পারেনি বলে দুঃখ করে। চিকুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, ‘তুই লেখাপড়ায় ফার্স্টক্লাস। ঠিকমতো চালিয়ে যা।’

জলাপুকুরের পাড় দিয়ে সাইকেল প্যাডেল করে যেতে-যেতে চিকুর এসব কথা মনে পড়ছিল। পুকুরের অন্ধকার জলে রাস্তার দু-চারটে টিমটিমে বালবের ছায়া পড়েছে। গ্যাঙর-গ্যাঙ ব্যাঙের দল ব্রিগেডের মিটিং শুরু করে দিয়েছে। কোথায় যেন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল ওরা! বৃষ্টি হতে-না-হতেই লুকনো আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে এসে শোরগোল হইচই করে দুনিয়া মাথায় তুলেছে।

জলাপুকুরের নামটা কেন যে এরকম অদ্ভুত কেউ জানে না। মাপে প্রকাণ্ড হলে কী হবে, শ্যাওলা আর কচুরিপানায় প্রায় পুরোটাই ঢাকা। পুকুরের দু-কোণে ইট-পাথর পেতে সবাই ঘাটের মতো করে নিয়েছে। সেখানেই বাসনমাজা আর স্নানের কাজ চলে।

জায়গাটা বেশ নির্জন, আর শীতও যেন বেশি। চিকুর এখন হয়তো ভয়-ভয় করত, কিন্তু ব্যাঙের দল ওকে সাহস দিল। ও তাড়াতাড়ি প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করল।

জলাপুকুর পেরিয়েই বিশাল এক আমবাগান। চিকু শুনেছে, এককালে এখানে শুধুই আমগাছ ছিল। কিন্তু এখন তারই মাঝে কাঁঠাল, শিমুল, তেঁতুল এসব গাছ গজিয়ে জায়গাটা ঝুপসি হয়ে গেছে। তবে জায়গাটার নাম এখনও সেই আমবাগান।

গাছগাছড়ার মধ্যে দিয়ে পায়ে চলা কাঁচা পথ। এখন বৃষ্টিতে কাদা-কাদা হয়ে গেছে। চিকু সাবধানে সাইকেল চালাতে লাগল। সাইকেলের হেডলাইট ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

আমবাগান পেরিয়ে রাজবাড়ি। তবে বাড়ির এখন যা অবস্থা তাতে পোড়োবাড়ি বলতেও কোনও অসুবিধে নেই। ভাঙাচোরা দোতলা বাড়িটা প্রকাণ্ড এক কালো কচ্ছপের মতো মাঠের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এককালের রাজার দুই নাতি না পুতি তাদের পরিবার নিয়ে একতলার একপাশের দুটো ঘরে এখন বাস করে। তাই বাড়ির সেদিকটায় দু-চারটে জানলায় রাতে টিমটিম করে আলো জ্বলে।

বাড়িটার নানা জায়গা থেকে বট আর অশ্বত্থের চারা গজিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটাতো রীতিমতো গাছের চেহারা নিয়েছে। এখন অন্ধকারে সেটা ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না। তবে মেঘ সরে গিয়ে আকাশে একটা ছোট্ট জানলা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর সেই জানলা দিয়ে থালার মতো চাঁদটা উঁকি মারতেই চিকুর মনে পড়ে গেল আজ পূর্ণিমা। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় রাজবাড়ির ভাঙা ছাদটা অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ছিল, আর সেইসঙ্গে গোটা তিন-চারেক বট কিংবা অশ্বত্থ গাছকে চেনা যাচ্ছিল।

রাজবাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়েই বাঁদিকে একটা সরু গলি ঢুকে গেছে। সেই গলিতেই হরিহরবাবুর ছোট্ট দোতলা বাড়ি। একতলাটা থাকার মতো হলেও দোতলাটা এখনও ইট-কাঠ বের করা। বোধহয় টাকার অভাবে শেষ করা যায়নি। বাড়ির লাগোয়া জমিতে দুটো সুপুরি আর একটা চাঁপা গাছ। সুপুরিগাছ দুটো দেখলেই চিকুর হরিহরবাবুর পান খাওয়ার নেশার কথা মনে পড়ে যায়।

দরজার কাছে একটা বাল্‌ব জ্বলছিল। সেই আলোয় চিকু দেখল গ্রিলের গেটের ওপাশে পাঁচ-ছ’টা সাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে নিজের সাইকেলটা রেখে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল চিকু।

কিন্তু পড়ার ঘরটায় ঢুকেই ও বেশ অবাক হয়ে গেল।

কৌশিক, প্রিয়াংকা, তিতুন, সুকান্ত আর প্রদীপ্ত গোল হয়ে বসে তেল-মুড়ি খাচ্ছে। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজের টুকরো আর চানাচুর। ঘরে স্যার নেই। চিকুরা একসঙ্গে আটজন বাংলা পড়ে। তবে আজ বোধহয় বৃষ্টি আর শীতের জন্য শ্রাবণী আর উত্তম আসেনি।

চিকু ঘরে ঢুকতেই কৌশিক আর তিতুন সরে গিয়ে শতরঞ্চিতে ওকে বসার জায়গা করে দিল। সুকান্ত বলল, ‘নে, মুড়ি-চানাচুর খা। আজ স্যারের শরীর ভালো নেই—পড়াবেন না।’

প্রদীপ্ত চাপা গলায় বলল, ‘কাকিমা মুড়ি মেখে খেতে দিলেন।’

কাকিমা মানে হরিহরবাবুর স্ত্রী। ওদের সবাইকে খুব ভালোবাসেন। গোলগাল হাসিখুশি চেহারা। প্রায়ই ওদের নানান জিনিস খাওয়ান।

শতরঞ্চির মাঝখানটায় খবরের কাগজ পাতা—তার ওপরে মুড়ির পাহাড়। চিকু বসেই ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়াল মুড়ির দিকে। পরপর দু-মুঠো মুড়ি মুখে গুঁজে দিয়ে জড়ানো গলায় বলল, ‘আমরা কি তা হলে আবার সামনের বুধবার আসব?’

প্রিয়াংকা কপাল থেকে চুল সরিয়ে বলল, ‘কাকিমা তো তাই বললেন।’

এমন সময় হরিহরবাবুর স্ত্রী ঘরে এসে ঢুকলেন।

চিকুকে দেখেই আপনজনের মতো একগাল হেসে বললেন, ‘চিকু শুনেছ তো, আজকে পড়া হবে না। তোমাদের স্যারের শরীরটা ভালো নেই—জ্বর-জ্বর মতন হয়েছে। আগে থেকে খবরটা দিতে পারলে ভালো হত। এই বিচ্ছিরি ওয়েদারের মধ্যে এসে শুধু শুধু তোমাদের ফিরে যেতে হল।’

‘তাতে কী হয়েছে, কাকিমা। আমরা পরের বুধবার আসব।’

‘নাও, মুড়ি-চানাচুর খাও। তোমরা কেউ চা খাবে?’

ওরা সবাই মাথা নাড়ল। না, খাবে না। হরিহরবাবু বলেন, ‘নেশার বশ হবি না কখ্‌খনও। পোষ যদি মানতে হয় তো সে শুধু ভগবান কি মহাজনের কাছে। দ্যাখ না, কত চেষ্টা করেও আমার পানের নেশাটা ছাড়তে পারছি না।’

সুতরাং, ওরা কেউ-কেউ চা খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও মুখে ‘না’ বলল।

মুড়ি-চানাচুর শেষ করে ওরা কাকিমাকে বলে বেরিয়ে পড়ল। প্রিয়াংকা চিকুকে বলল, ‘তোমাকে “মোহাব্বতে”-র ক্যাসেটটা দেব বলেছিলাম, এখন আমার সঙ্গে গিয়ে নিয়ে আসতে পারো। আর আমাদের ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমে একবার শুনেও নিতে পারো—কী দারুণ আওয়াজ… ফ্যানট্যাসটিক।’

‘চলো। তবে আমাদের টেপ রেকর্ডারটা অর্ডিনারি টু-ইন-ওয়ান। ওতে খুব একটা ভালো শোনাবে না মনে হয়…।’

এ-ওকে ‘টা টা’ করে ওরা সাইকেল নিয়ে যে-যার পথে ছড়িয়ে গেল। শুধু প্রিয়াংকা আর চিকুর সাইকেল দুটো একই পথ ধরে সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলল।

প্রিয়াংকাদের বাড়িটা চিকুদের বাড়ির উলটোপথে অনেকটা দূরে। ওদের বাড়ি থেকে রেল স্টেশনটা কাছে। সেখানে বেশ কয়েকটা সুন্দর-সুন্দর বাড়ি আছে। ঠিক যেন জলরঙে আঁকা ছবি। চিকু এর আগে দু-চারবার প্রিয়াংকাদের বাড়ি গেছে। ওদের বাড়িতে গেলে কোথা দিয়ে সময় কেটে যায় খেয়াল থাকে না। আজ অবশ্য দেরি হওয়ার কোনও ভয় নেই, মা-বাবা চিন্তাও করবে না। ওরা জানে চিকু বাংলা কোচিং-এ পড়ছে।

অন্ধকার পথ ধরে সাইকেল চালাতে চালাতে চিকু জিগ্যেস করল, ‘এই পথ দিয়ে একা-একা ফিরতে তোমার ভয় করে না?’

প্রিয়াংকা শব্দ করে হাসল : ‘অন্য দিন করে…আজ করছে না।’

ওদের সাইকেলের চাকা ঘুরতে লাগল।

দুই

বাড়ির দিকে ফেরার সময় রাজবাড়ির কাছাকাছি এসে চিকু প্রথম বিপদের গন্ধ পেল। পরিস্থিতি আর পরিবেশ কেমন যেন অন্যরকম মনে হল ওর। আর সেইজন্যই একটা আশঙ্কা তৈরি হল। সবকিছুই ঠিক আছে, অথচ যেন ঠিক নেই। কিন্তু গণ্ডগোলটা যে ঠিক কোথায় সেটাই ও ধরতে পারছিল না।

যতটা জোরে পারা যায় ততটা জোরেই সাইকেল চালাচ্ছিল চিকু। আর একইসঙ্গে ওর মনের ভেতরে উথালপাথাল চলছিল, একটাই প্রশ্নের উত্তর ও হাতড়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল : গণ্ডগোলটা কোথায়?

চিকুর হাতে ঘড়ি নেই, তবে রাত বোধহয় সওয়া ন’টা কি সাড়ে ন’টা হবে। এতটা রাত না করলেই হত। বৃষ্টি এখন নেই। আকাশ বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। পূর্ণিমার চাঁদ উজ্জ্বল চোখে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাস বেশ ঠান্ডা।

চিকুর সোয়েটার ভেদ করে শীত ঢুকে পড়ছে ভেতরে। আজ রাতে মনে হয় লেপ গায়ে দিতে হবে।

রাজবাড়ি পেরিয়ে আমবাগানের কাছাকাছি এসে গণ্ডগোলটা খেয়াল করল চিকু।

এই পথে যাওয়ার সময় পথের আশপাশ থেকে দু-পাঁচটা ব্যাঙের ডাক ওর কানে এসেছিল। হয়তো রাস্তার পাশের নালায় বা জমে থাকা জলে কয়েকটা ব্যাঙ আস্তানা গেড়েছিল।

কিন্তু এখন ওরা আর কেউ ডাকছে না। কেউ যেন ভয় দেখিয়ে ওদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে।

ঠিক তখনই ও খেয়াল করল জলাপুকুরের দিক থেকেও ব্যাঙের কোরাস আর শোনা যাচ্ছে না। চারপাশটা কেমন যেন থমথম করছে। শুধু গাছের পাতার খসখস শব্দ।

জোরে প্যাডেল করে আমবাগানটা পেরিয়ে যেতে চাইল চিকু। ওর কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল।

আমবাগান শেষ হওয়ার মুখে একটা চাপা গর্জন ওর কানে এল। প্রচণ্ড রাগে কোনও পশু গরগর করছে। তার চাপা গোঙানির মধ্যেই হিংস্র ভাব টের পাওয়া যাচ্ছে।

একইসঙ্গে জান্তব একটা গন্ধও নাকে এল।

আতঙ্কে বেপরোয়া গতিতে সাইকেল ছোটাল চিকু। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা পাথর বা ইটের টুকরোয় হোঁচট খেয়ে ওর সাইকেল শূন্যে লাট খেয়ে পথের ওপরে ছিটকে পড়ল।

চিকু একদিকে, ওর ব্যাগ একদিকে, আর সাইকেল আর-একদিকে। সাইকেলের একটা চাকা তখনও ঘুরছে। হেডলাইটটা কাত হয়ে তেরছাভাবে আলোর বর্শা ছুড়ে দিয়েছে। আলোটা ক্রমেই মিটমিটে হয়ে নিভে আসছে।

চিকুর সারা শরীরে কাদা মাখামাখি। কনুইয়ে একটু চোটও লেগেছে। কিন্তু ভয় বড় আশ্চর্য জিনিস। পঙ্গুকে দিয়ে গিরি লঙ্ঘন করিয়ে নেয়। ফলে তখন ভয় আর ভগবানে কোনও তফাত থাকে না।

চিকু চটপট নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে পড়ল। দু-পা ফেলে এগিয়ে গেল ব্যাগের কাছে। ব্যাগটা এক ঝটকায় তুলে নিয়ে সাইকেলের দিকে এগোতেই জিনিসটা ওর চোখে পড়ল।

সাইকেলের আলো ততক্ষণে ক্ষয়ে এসেছে। কিন্তু পূর্ণিমার আলোয় ক্ষয় ধরেনি। তাই চিকুর দেখতে খুব একটা অসুবিধে হল না।

ও পায়ে পায়ে জিনিসটার কাছে এগিয়ে গেল। সেটা চিনতে পারামাত্রই একটা আতঙ্কের চিৎকার ওর গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে গেল। কিছুতেই গলা দিয়ে বেরোতে পারছিল না।

একটা মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে রয়েছে বৃষ্টি-ভেজা মাটিতে। মাথাটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে হাঁ করে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। হাত-পাগুলো এলোমেলোভাবে এদিক-ওদিক ছড়ানো। চাঁদের আলোয় রক্তের রং বোঝা যাচ্ছিল না। ফলে মনে হচ্ছিল, বৃষ্টির জমে থাকা কালো জলের ওপরে ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানুষটা পড়ে আছে।

চিকুর মাথা কাজ করছিল না। তবে অন্ধ ভয় ওকে দিয়ে যান্ত্রিকভাবে কাজ করিয়ে নিচ্ছিল। ও ছুটে গিয়ে সাইকেলটা তুলল। আর সঙ্গে সঙ্গে কানে এল ভয়ঙ্কর এক গর্জন। এবার গর্জনটা এসেছে জলাপুকুরের দিক থেকে।

এটা কি বাঘের গর্জন? কোথাও থেকে একটা বাঘ কি এসে ঢুকে পড়েছে আমবাগানে?

সাইকেল পাশে নিয়ে কয়েক পা ছুটেই লাফিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ল চিকু। তারপর প্রাণপণে সাইকেল চালাতে শুরু করল। আর ঠিক তখনই শুনতে পেল জলাপুকুরে কেউ যেন ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

চিকুর সবকিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল।

এই শীতের রাতে বাঘ হঠাৎ জলে ঝাঁপ দেবে কেন?

এবড়োখেবড়ো পথ ধরে যেতে-যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে জলাপুকুরের দিকে তাকাল ও। জলে কী একটা নড়ছে যেন! কেউ যেন প্রবল উল্লাসে জল ঘেঁটে দাপাদাপি করে স্নান করছে।

কৌতূহল বড় আশ্চর্য জিনিস। কখনও-কখনও ভয়কেও ছাপিয়ে যায়। চিকুর বেলায়ও তাই হল। জলাপুকুরের পাড়ে ব্রেক কষে সাইকেল দাঁড় করিয়ে দিল ও। তবে প্যাডেলে পা চেপে তৈরি থাকল। ওর হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জলের শব্দ থামল। কিছু একটা উঠে আসতে লাগল জল থেকে।

প্রাণীটাকে জ্যোৎস্নার আলোয় দেখা গেল। তবে ওটার মাথায় কচুরিপানা আর শ্যাওলা বোঝাই হয়ে থাকায় মুখটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। লোমশ হাত দিয়ে সেগুলো সরাতে চেষ্টা করছিল। হাতটা মানুষের মতো হলেও আঙুলের ডগায় লম্বা-লম্বা সাদা বাঁকানো নখ। সামনে ঝুঁকে পড়ে কুঁজো হয়ে প্রাণীটা জল থেকে উঠে আসছিল। হাঁটু দুটো সামান্য ভাঁজ করে জলের মধ্যে পা ফেলছে। যেন কোনও চারপেয়ে জন্তু দু-পায়ে হাঁটার চেষ্টা করছে।

একটা হিংস্র গর্জন বেরিয়ে এল প্রাণীটার মুখ থেকে।

চিকুর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। আর সঙ্গে-সঙ্গে এতক্ষণ দলা পাকিয়ে আটকে থাকা চিৎকারটা ওর গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।

একটানা চিৎকার করতে-করতে পাগলের মতো সাইকেল ছুটিয়ে দিল চিকু।

ও যখন বাড়ি এসে পৌঁছল তখনও ওর চিৎকার থামেনি। মা-বাবা ছুটে বেরিয়ে এল দরজায়। দেখল চিকুর জামাকাপড় রক্ত আর কাদায় মাখামাখি।

মা ছুটে গিয়ে ওকে জাপটে ধরে আকুলভাবে জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে রে, কী হয়েছে?’ চিৎকার করতে-করতেই চিকু আচমকা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

তিন

পরদিন সকালে বেলা দশটার মধ্যেই পাশবিক খুনের এই ঘটনাটা জাঙ্গিকুলের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল। খুব ভোরে কেউ একজন পথের ওপরে পড়ে থাকা বীভৎস মৃতদেহটা আবিষ্কার করে। তারপর সেই ভয়ঙ্কর খবরটা ছোট এলাকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

বেশ কয়েকবছর ধরে এই আধা-টাউনে খুনের মতো কোনও রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটেনি। তাই এই খুনটাকে কেন্দ্র করে গোটা অঞ্চল একেবারে তেতে উঠল। পুলিশও তাদের নিয়মমাফিক তদন্ত শুরু করে দিল।

যে-লোকটি খুন হয়েছে সে একজন ভবঘুরে ভিখারি। তাকে খুন করার কোনও উদ্দেশ্য খুঁজে বের করাটাই বেশ মুশকিলের। তা ছাড়া খুনটা কোনও মানুষের কাজ, না কি কোনও হিংস্র জন্তুর, সেটা নিয়েও চায়ের দোকানে, সেলুনে, বাজারে, বেশ তর্ক বেধে গেল। কেউ-কেউ খোঁজ করতে লাগলেন এ-এলাকার দু-চার মাইলের মধ্যে কোনও সার্কাস পার্টি এসে ঘাঁটি গেড়েছে কি না। আর তাদের দলে বাঘ কিংবা সিংহের মতো হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আছে কি না।

তবে বেশিরভাগ মানুষেরই মত হল, মৃতদেহটার যে-ছিন্নভিন্ন বীভৎস অবস্থা দেখা গেছে তাতে এ-কাজ কোনও মানুষের হতে পারে না।

তা হলে এর পরের প্রশ্ন হল, যদি এটা হিংস্র কোনও পশুর কাজ হয় তো সেই পশুটা কী? বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, হায়েনা—নাকি অন্য কিছু?

পরদিন চিকু বাড়ি থেকে আর বেরোয়নি। মা-বাবা দুজনেই ওকে স্কুলে যেতে দেয়নি।

কাল রাত থেকে চিকুর বাড়াবাড়িরকম অবস্থা চলেছে। বারবার ও কেঁপে উঠেছে ভয়ে। মা ওর পাশটিতে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর ঘুম আসেনি। কখনও-কখনও তন্দ্রায় ওর চোখ বুজে এসেছে। আবার তারই মধ্যে গোঙানির শব্দ করে চমকে জেগে উঠেছে। তখন মা আধখানা ঘুমের ট্যাবলেট চিকুকে খাইয়ে দিয়েছে।

বাবা ডাক্তার ডাকার কথা বলেছিল, কিন্তু মা রাজি হয়নি। বলেছে, ওর তো জ্বর-টর কিছু হয়নি! মনে হয় ভীষণ ভয় পেয়েছে। আজ রাতটা বিশ্রাম নিক—কাল সকালে যা হয় করা যাবে।

চিকুর শেষ পর্যন্ত ঘুম এসেছিল অনেক রাতে। ফলে ওর ঘুম ভেঙেছে বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ। তারপর থেকে শুধুই বিশ্রাম, আর জানলা দিয়ে মেঘলা আকাশ, গাছপালা, আর রাস্তা দেখা। আজও বেশ শীত। তবে বৃষ্টি থেমে গেছে।

একা-একা বিছানার লাগোয়া জানলার পাশে বসে চিকু ভাবছিল, কাল রাতে ও যা দেখেছে তা সত্যি কি না। এখনও পর্যন্ত মা-বাবাকে ও কোনও কথা বলেনি। বললে ওরা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। আচ্ছা, ব্যাপারটা একটা বাজে দুঃস্বপ্ন নয় তো!

চিকুর শরীরটা ভালো নয় দেখে ওর বাবা আজ অফিসে বেরোয়নি। তাই হাতে সময় পেয়ে বাজার-দোকান সেরে নিচ্ছিল। বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ রাস্তা থেকে ফিরে বাবা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। মায়ের সঙ্গে চাপা গলায় কীসব কথা বলতে লাগল।

চিকু বুঝতে পারল, ওকে আড়াল করে বাবা-মা কোনও আলোচনা করছে। ওর হঠাৎ করেই মনে হল, আলোচনার বিষয়টা ওর বোধহয় জানা।

একটু পরে মা চিকুকে স্নানের গরম জল দিল। স্নান হয়ে যাওয়ার পর তোয়ালে নিয়ে যত্ন করে মাথা মুছিয়ে দিল। তারপর খেতে দিল।

মায়ের ভাবভঙ্গিগুলো এমন যেন চিকু এখনও সেই পাঁচ-ছ’বছরের ছোট খোকাটিই আছে।

খেয়েদেয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই ঘুম এসে ওর দু-চোখ জড়িয়ে ধরল। চিকু ঘুমের জগতে ডুবে গেল একেবারে।

ঘুম ভাঙল সেই চারটের পর। মেঘ ফিকে হয়ে আকাশটা এখন বেশ আলো-আলো লাগছে। তবে রাস্তা এখন ভিজে। দুপুরে বোধহয় আর-এক দফা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেছে।

মা চা তৈরি করে বাবাকে দিল, নিজে নিল—তারপর চিকুকেও একটু সাধল : ‘দুটো বিস্কুট খেয়ে চায়ে চুমুক দে, শরীরটা বেশ তাজা লাগবে।’

বাবা আড়চোখে কেমন যেন খুঁটিয়ে-দেখা চোখে চিকুকে দেখছিল। চিকু চুপচাপ বসে চা-বিস্কুট খেতে লাগল।

চিকুর চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই টেলিফোন বেজে উঠল। বাবা তাড়াতাড়ি এসে রিসিভার তুলল। তারপর ‘হ্যালো’ বলেই রিসিভারটা এগিয়ে ধরল চিকুর দিকে : ‘তোর ফোন। কথা বলতে পারবি?’

চিকু ঘাড় নেড়ে নেমে এল বিছানা থেকে। বাবার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে ‘হ্যালো—’ বলল।

প্রিয়াংকা।

‘আজ স্কুলে যাওনি? আমরা স্কুলে যাওয়ার সময় জনতা কেবিনের সামনে তোমাদের দেখলাম না, তাই ভাবলাম হয়তো শরীর-টরির খারাপ হয়েছে—।

রোজ স্কুলে যাওয়ার সময় চিকু একটা বাঁকের মুখে ওর আরও দু-বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে। সেখানে ‘জনতা কেবিন’ নামে একটা ভাতের হোটেল আছে। হোটেলের সামনে তিনজন জড়ো হওয়ার পর ওরা দল বেঁধে স্কুলে যায়। মোটামুটি সেই সময়টায় প্রিয়াংকাও কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে একজোট হয়ে স্কুলের পথে হেঁটে যায়। বেশিরভাগ দিনই ওদের দেখা হয়।

চিকু বলল, ‘না, আজ স্কুলে যাইনি…শরীরটা ভালো নেই…ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।’

‘“মোহাব্বতে”-র ক্যাসেটটা শুনেছ?’

‘না, এখনও শোনা হয়নি। আজ সন্ধেবেলা শুনব।’

‘কাল তোমার ফেরার সময় কোনও প্রবলেম হয়নি তো?’

একটু ভেবে নিয়ে চিকু ছোট্ট করে বলল, ‘নাঃ…।’

‘আসলে কাল জলাপুকুরের কাছে একটা মার্ডার হয়েছে। ব্রুটাল মার্ডার। সবাই বলছে কোনও ডেঞ্জারাস অ্যানিম্যালের কাজ। সেইজন্যেই চিন্তা হচ্ছিল। ভাবছিলাম তুমি কাল ঠিকমতো বাড়ি ফিরেছ কি না। আমি স্কুল থেকে বাড়িতে এসেই তোমাকে ফোন করছি…।’

চিকু সারাদিনে বাবা কিংবা মায়ের মুখে খুনের কোনও খবর শোনেনি। যদিও ও জানে, এই ছোট্ট আধা-টাউন এলাকায় খবরটা এর মধ্যে সবাই জেনে গেছে। বাবা-মা হয়তো চিকুর ভালোর জন্যই খবরটা ওকে জানায়নি। ওরা তো আর জানে না, চিকুর খবর জানার কোনও প্রয়োজন নেই—কারণ, ‘খবর’টা ও কাল রাতে নিজের চোখে দেখেছে!

কাল রাতের দৃশ্যটা মনে পড়তেই চিকু একবার শিউরে উঠল। এখনও পর্যন্ত মা-বাবা কাউকে ও কিছু বলেনি। কাল মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা বহুবার জিগ্যেস করেছে, ‘কী রে, ভয় পেয়েছিস? কী হয়েছে বল—আমাকে বল—।’

কিন্তু চিকু কোনও কথা বলেনি। ওর মনটা কেমন অসাড় হয়ে গিয়েছিল।

অবশ্য এখন অনেক ভালো লাগছে। মন আর শরীরের দুর্বল ভাবটা মোটামুটি কেটে গেছে। কিন্তু কাল রাতে খুন হওয়া মানুষটা কে?

সে-কথাই ও প্রিয়াংকাকে জিগ্যেস করল, ‘কাল রাতে কে মার্ডার হয়েছে জানো?’

‘সবাই বলছে একজন ভ্যাগাবন্ড—ভিখারিগোছের লোক।’

‘ও–।’

‘নেক্সট উইকে বাংলা পড়তে যাচ্ছ তো?’

‘হ্যাঁ—যাব।’

প্রিয়াংকার সঙ্গে একমাত্র বাংলা কোচিংটাই ওর কমন। অন্যান্য সাবজেক্টের টিচাররা প্রিয়াংকাকে বাড়িতে এসে পড়ান। হরিহরবাবু কারও বাড়িতে গিয়ে পড়ান না—তাই প্রিয়াংকা ওঁর কোচিং-এ এসে পড়ে।

কথা শেষ করে চিকু রিসিভার নামিয়ে রাখল।

মুখ ফেরাতেই চিকু খেয়াল করল মা আর বাবা কেমন অদ্ভুত চোখে ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

বাবা অবাক হয়ে বলল, ‘তুই মার্ডারের ব্যাপারটা জানিস! খবর পেলি কী করে?’

চিকু আঙুলের নখ খুঁটল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি সব জানি। সব আমি নিজের চোখে দেখেছি। সেইজন্যেই কাল রাতে অমন ভয় পেয়েছিলাম।’

ঘরে যেন বাজ পড়ল।

মা প্রায় ছুটে এল চিকুর কাছে : ‘কী দেখেছিস কাল রাতে!’

একটু সময় নিল চিকু। তারপর নিচু গলায় ধীরে-ধীরে সব ঘটনা বলে গেল।

মা আর বাবা ফ্যাকাসে মুখে চুপচাপ শুনতে লাগল। চিকুর কথা শেষ হলে মা-বাবা দুজনেই ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করল। চিকুও সেগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করল। তারপর ওরা দুজনে কেমন গুম হয়ে গেল। স্থির চোখে চিকুকে দেখতে লাগল।

ওরা মনে-মনে কী ভাবছে সেটা চিকু খানিকটা আঁচ করতে পারছিল। তবে বাবা এরপর একটা প্রশ্ন করতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল।

‘তুই…তুই ভুল দেখিসনি তো!’

চিকু একটু বিরক্ত গলায় বলল, ‘না, ভুল দেখিনি। বানিয়ে-বানিয়ে এরকম গল্প তৈরি করে আমার কী লাভ!’

একটু চিন্তা করে বাবা বলল, ‘যাকগে, এসব কথা আর কাউকে বলিস না। শেষকালে পাঁচকান হতে-হতে পুলিশের কানে গেলেই মুশকিল।’

মা চিন্তার গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, তখন আবার টানাহ্যাঁচড়া শুরু হবে, হাজারটা প্রশ্ন করবে। না, না, এসব কথা তুই কাউকে বলিস না।’

‘ঠিক আছে, বলব না।’

চিকু কথাটা বলল বটে, তবে ওর সবাইকে বলতে ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছে করছিল জলাপুকুরের কাছে গিয়ে দিনের আলোয় খুনের জায়গাটা একবারে দেখে আসতে। ওখানে গেলে কি প্রাণীটার পায়ের ছাপ পাওয়া যাবে? অথবা গায়ের লোম?

চিকুর মধ্যে একটা গোয়েন্দা জেগে উঠতে চাইছিল।

ও আর কোনও কথা না বলে পড়ার টেবিলে গিয়ে পড়তে বসল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পড়ায় মন বসাতে পারল না। বারবার কাল রাতের ঘটনাগুলো ওর মাথায় ঢুকে পড়ছিল।

হঠাৎই ওর চোখ গেল টেবিলের এক প্রান্তে পড়ে থাকা ‘মোহাব্বতে’-র ক্যাসেটটার দিকে। কী ভেবে চিকু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। বিছানার কাছে গিয়ে বালিশের পাশ থেকে ওয়াকম্যানটা তুলে নিয়ে এল।

তারপর হেডফোন কানে লাগিয়ে ‘মোহাব্বতেঁ’-র ক্যাসেটটা শুনতে শুরু করল। জানলার বাইরে তখন অন্ধকার পা টিপে টিপে নেমে আসছে।

চার

শেষ পর্যন্ত চিকুর ব্যাপারটা আর পুরোপুরি গোপন রইল না। এরকম একটা মারাত্মক ব্যাপার ও নিজের চোখে দেখেছে, এটা কাউকে না বলতে পারলে ও কিছুতেই যেন শান্তি পাচ্ছিল না। সবাই এ-কথা জানতে পারলে চিকুকে ঘিরে কত হইচই হত, ওর সাহসকে কত লোক প্রশংসা করত, একই গল্প ওকে কতবার না শোনাতে হত!

ভেতরের এই সাঙ্ঘাতিক টেনশান চিকু অতিকষ্টে তিনদিন সামলে রাখতে পারল। তারপর একদিন খবরটা ও ভাঙল প্রিয়াংকার কাছে। সেদিন ও ‘মোহাব্বতে’র ক্যাসেটটা ফেরত দিতে প্রিয়াংকাদের বাড়িতে গিয়েছিল। খবরটা শুনে প্রিয়াংকা তো একেবারে বোবা হয়ে গেল। ও অবাক হয়ে চিকুকে দেখতে লাগল।

‘মাই গুডনেস! কী ডেঞ্জারাস! এতবড় একটা ব্যাপার তুমি আমাকে বলোনি।’

‘কাউকে এসব কথা বোলো না। মা-বাবা কাউকে বলতে বারণ করেছে।’

প্রিয়াংকা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে অনেক প্রশ্ন করল চিকুকে। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চিকু মনে-মনে পূর্ণিমার সেই ভয়ঙ্কর রাতটায় ফিরে যাচ্ছিল।

সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতেই প্রিয়াংকা একরকম জোর করে চিকুকে বাড়ি রওনা করে দিল।

প্রিয়াংকার পর স্কুলের বন্ধু সোহনের কাছে গোপনে মুখ খুলল চিকু। স্কুল থেকে ফেরার পথে সোহনকে জলাপুকুরের গল্পটা শোনাল ও।

এরপর কানাকানি আর জানাজানির ব্যাপারটা নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মতো ক্রমে বাড়তে শুরু করল। এবং দশ-বারোদিনের মধ্যেই জাঙ্গিকুলের প্রায় সকলেই জেনে গেল পূর্ণিমার রাতে জলাপুকুরের কাছে চিকু কী দেখেছে।

একদিন সন্ধেবেলা দেশপ্রিয় সুইটস থেকে মিষ্টি কিনে ফিরছিল চিকু। হঠাৎই শুনতে পেল কে যেন ওকে নাম ধরে ডাকছে। সাইকেল থামিয়ে ঘাড় ঘোরাতেই চিকু রোহনদাকে দেখতে পেল। বিশুদার চায়ের দোকানে বসে আছে।

শিবতলার উলটোদিকেই বিশুদার চায়ের দোকান। রাস্তার একপাশে বাঁশের খুঁটি আর দরমা দিয়ে তৈরি। দোকানের মাথায় টালির ছাউনি। আর আলো বলতে হুক করে জ্বালানো একটা ষাট পাওয়ারের বাল্‌ব।

বিশুদা একা মানুষ। দোকানের পিছনদিকটায় থাকার মতো একটুখানি জায়গা করে নিয়েছে। আর দোকানের সামনে আধ-ফালা বাঁশ পেরেক দিয়ে ঠুকে খদ্দেরদের বসার জন্য একটা বেঞ্চি মতন তৈরি করে দিয়েছে।

বিশুদার দোকানটা নামে চায়ের দোকান হলেও ডিম-পাঁউরুটি, বিস্কুট, সিগারেট, হজমিগুলি, পান-পরাগের প্যাকেট আর বাচ্চাদের খেলার প্লাস্টিকের বলও পাওয়া যায়।

দোকানের সামনের বেঞ্চিতে রোহন আর ছোটকু বসে ছিল। ছোটকু রোহনের সব সময়ের সাথী। কালো, রোগাপটকা চেহারা, চোখগুলো বড়-বড়, মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল।

সাইকেল থেকে নেমে পড়েছিল চিকু। সাইকেলটা পাশে-পাশে হাঁটিয়ে ও চলে এল রোহনের সামনে।

রোহন বলল, ‘বোস, কথা আছে। বিশুদা, তিনটে ছোট চা বানাও তো!’

চায়ে আপত্তি করল না চিকু। সাইকেলটা স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে রোহনের পাশে বসে পড়ল ও।

‘অ্যাই, তুই নাকি জলাপুকুরের মার্ডারটা হতে দেখেছিস? জাঙ্গিকুলে পুরো চাউর হয়ে গেছে—।’

চিকু আবার বলতে শুরু করল। এ-ক’দিনে গল্পটা বলে-বলে ও বেশ রপ্ত হয়ে উঠেছিল। ফলে ব্যাপারটা খুঁটিনাটিসমেত বলতে ওর কোনও অসুবিধে হল না, একবারের জন্যও হোঁচট খেল না।

গল্প শেষ হতেই ছোটকু চোখ বড়-বড় করে বলে উঠল, ‘আরিব্বাস! কী ডেঞ্জারাস কেস, বস!’

বিশুদা হাঁ করে চিকুর গল্প শুনছিল। গরম চা উথলে পাতা উনুনে পড়তেই ‘ছ্যাঁক’ শব্দ হল। বিশুদা চমকে উঠে উনুনের কাছে গেল। তিনটে কাপে চা ঢালতে লাগল।

রোহন চোখ ছোট করে ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবছিল।

অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর ও জিগ্যেস করল, ‘মার্ডারারের গায়ে লোম ছিল? না কি ওভারকোট পরে ছিল?’

বিশুদা ওদের চা এগিয়ে দিল।

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চিকু বলল, ‘না, কোট বলে মনে হয়নি। তা ছাড়া কোট পরে ওই রাতে কি কেউ জলে ঝাঁপ দেয়!’

চায়ে চুমুক দিয়ে ‘হুম’ করে ছোট্ট একটা শব্দ করল রোহন। তারপর : তুই কি লোকটার মুখ দেখতে পেয়েছিলি?’

‘না, শ্যাওলা আর কচুরিপানায় মুখটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তবে হাতের আঙুলে লম্বা-লম্বা বাঁকানো নখ ছিল। আমি স্পষ্ট দেখেছি।’

‘পুরো ব্যাপারটা ছদ্মবেশ হতে পারে, বুঝলি। ফাঁড়ির বড়বাবুকে আমি গতকাল সেটাই বলেছি। কিন্তু প্রবলেমটা কোথায় জানিস? মার্ডারের মোটিভটাই কেউ বুঝতে পারছে না। একটা ভিখিরির কাছে আর কী-ই বা টাকাপয়সা থাকবে।’

‘সুড়ৎ’ শব্দ করে চা শেষ করল ছোটকু। তারপর হাত-পা নেড়ে রোহনকে বলল, ‘বস, এমন কেস নয়তো যে, লোকটা রাত্তিরবেলা খুন করা প্র্যাকটিস করছিল?’

রোহন বিরক্তভাবে হাতের ইশারায় ছোটকুকে থামতে বলল। তারপর অনেকটা যেন আপনমনেই বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার এলাকায় মার্ডার করে সটকে পড়বে…এত বড় বুকের পাটা কার?’

চিকু রোহনকে দেখছিল।

লম্বা চওড়া ব্যায়াম করা চেহারা। গায়ের রং মাজা। মাথায় ছোট-ছোট করে ছাঁটা চুল। চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। চোয়াল শক্ত। জামার নিচে বুকের মাসল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

চায়ের কাপটা ‘ঠকাস’ করে নামিয়ে রেখে রোহন বলল, ‘তুই এ-ব্যাপারে আর কোনও খবর পেলে বা কিছু দেখলে আমাকে জানাবি।’

চিকু ঘাড় কাত করে ‘হ্যাঁ’ বলল। তারপর শেষ হয়ে-যাওয়া চায়ের কাপটা বিশুদার হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

সত্যিই তো! রোহনদা ঠিকই বলেছে। খুনের উদ্দেশ্যটাই তো কেউ বুঝতে পারছে না! তা হলে কি এ কোনও পাগল খুনির কাজ? অনেক সিনেমায় যেমন দেখায়!

এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে বাড়ি ফিরে এল চিকু।