পিপলপানির বাঘ
ও জন্মেছে পাহাড়ের পাদদেশের গভীরে চলে যাওয়া এক নালার মধ্যে আর তিনজনের এক পরিবারের ও অন্যতম-এর বাইরে ওর ছোটবেলার কথা আর কিছুই আমার জানা নেই।
এক নভেম্বরের সকালে একটা চিতলের ডাকে আকৃষ্ট হয়ে বেরিয়ে একটি ছোট্ট ঝরনা, যার স্থানীয় নাম পিপলপানি তারই ধারে বালির চড়ার ওপর ওর থাবার ছাপ দেখি। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো মার যত্নের আশ্রয় ছেড়ে পালিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু যখন সপ্তাহের পর সপ্তাহ জঙ্গলে জন্তু জানোয়ারের চলার পথে ওর একারই থাবার ছাপ দেখতে লাগলাম তখন সিদ্ধান্তে এলাম যে সঙ্গমের সময় এগিয়ে আসছে, আর সেইটাই বাঘটির একা থাকার কারণ।
জঙ্গলের জীবদের জীবনটাই এইরকম। একদিন কঠিন পাহারায় সুরক্ষিত–দরকার হলে মা হয়তো প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবে বাচ্চাকে আবার পরদিনই সে সম্পূর্ণ একা। বংশরক্ষার ব্যাপারটা যাতে পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেইজন্যেই বোধহয় প্রকৃতির এই বিধান।
সে শীতটা ও কাটাল ময়ুর, কাকার, ছোট শুয়োর আর কখনও কখনও চিতল খেয়ে। ও বাসা বানিয়েছিল জঙ্গলে এক দৈত্যের মত বিশাল পড়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ির মধ্যে। গুঁড়িটার ভেতরটা গরম এবং শজারুর দৌলতে ছিল সম্পূর্ণ ফাঁপা। গাছটা কেন যে পড়েছে তা বোঝা কঠিন। ওর অধিকাংশ শিকারই ও নিয়ে আসত ওখানে। শীতকালে গাছটার মসৃণ গুঁড়ির ওপর বসে ও রোদ পোয়াত–ওর আগে অনেক চিতাই ওই একই জায়গায় বসে আরাম করে রোদ পুইয়েছে।
বাঘটাকে আমি কাছাকাছি থেকে দেখেছিলাম জানুয়ারি মাস বেশ খানিকটা গড়িয়ে যাওয়ার পর। একদিন সন্ধেবেলা এমনিই বেরিয়েছিলাম, আমার নির্দিষ্ট কিছুই করার ছিল না। হঠাৎ আমি দেখলাম একটা কাক মাটি থেকে উঠে ঠোঁট মুছতে মুছতে একটা গাছের ডালে বসল। জঙ্গলে কাক, শকুন আর ম্যাগপাই সম্বন্ধে আমার চিরদিনই খুব উৎসাহের কারণ এই পাখিগুলির সাহায্যে আমি ভারতবর্ষ ও আফ্রিকাতে বহু মড়ির সন্ধান পেয়েছি। এখন কাকটি আমাকে নিয়ে গেল গতরাতের এক বিয়োগান্ত ঘটনার দৃশ্যে। একটা চিতলকে মেরে কিছুটা অংশ খাওয়া হয়েছে। একদল লোক প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরের একটা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। তারাও বোধহয় আমারই মতুন কোন কিছুতে আকৃষ্ট হয়ে জায়গাটিতে আসে এবং চিতলের বাকি অংশটুকু কেটে নিয়ে যায়। সেখানে পড়েছিল শুধু চিতলের কয়েকটা হাড় আর কিছুটা জমাট রক্ত। কাকটা কিছুক্ষণ আগে এই রক্ত দিয়েই তার খাওয়া সেরেছে। আশপাশে কোনো ঘন ঝোপঝাড় নেই, রাস্তাটাও বেশ কাছে। বোঝা গেল, চিতল মেরেছে যে জানোয়ারটি, সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সে লক্ষ করে নি। তার মানেই জানোয়ারটি যথা সময়ে ফিরে আসবে। আমি বসে অপেক্ষা করাই স্থির করলাম। একটা কাঁটাভরা কুল গাছের ডালে যতটা সম্ভব আরামে বসা যায় বসলাম।
মড়ির ওপর বসে শিকার দেখা নীতিসম্মত কিনা এটা বহু বিতর্কিত বিষয়। এটা নিয়ে পাঠকের সঙ্গে যদি আমার মতানৈক্য থাকে তাহলে আমার দিক থেকে কিছু করার নেই। আমার সবচেয়ে মধুর শিকার স্মৃতিগুলি জড়িয়ে আছে সূর্যাস্তের ঠিক দুএক ঘণ্টা আগের সময়টির সঙ্গে যখন আমি নিচে মড়ি রেখে গাছের ওপর সময় কাটিয়েছি। এ অভিজ্ঞতা আমার আজকের নয়। যখন আমি গাদা বন্দুক, যার ফাটা নলটি ভেঙে যাতে না যায় সেইজন্যে তামার তার দিয়ে জড়ানো নিয়ে চিতায় খাওয়া হনুমানের মড়ির ওপর বসেছি তখন থেকে আরম্ভ করে এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত যখন হাঁটুর ওপর সর্বাধুনিক রাইফেলটি রেখে আমি বাঘিনী আর তার দুই পূর্ণ বয়স্ক বাচ্চাকে, তাদের মারা একটা সম্বর খেতে দেখেছি–এই দীর্ঘলব্ধ অভিজ্ঞতার দরুণই একথা আমি বলছি। আমি যে গুলি চালিয়ে বিজয়ীর পুরস্কার পাই নি তাতে আমার বিন্দুমাত্র খেদ নেই।
এটা ঠিকই যে এই মুহূর্তে আমার নিচে কোনো মড়ি নেই। কিন্তু নিন্মোক্ত কারণগুলির জন্য সেটা আমার গুলি চালানোর কোনো প্রতিবন্ধক হবে না। রক্তে ভেজা মাটির গন্ধ জঙ্গলের জানোয়ারদের আকর্ষণ করে। প্রমাণস্বরূপ দেখাতে পারি ধূসর গোঁফওয়ালা বুনো শুয়োরটিকে। শুয়োরটা প্রায় দশ মিনিট ধরে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করছিল হঠাৎ হাওয়ায় রক্তের গন্ধ নাকে আসতেই শুয়োরটা থমকে দাঁড়াল। শুধু নাকটা শূন্যে তুলে ও যা বুঝল আমি পদচিহ্নহীন জমি পরখ করেও তা বুঝতে পারি নি। নাকের এরকম সদ্ব্যবহার করা শুয়োরদেরই সম্ভব। ও একটু ডান দিকে বেঁকে গেল তারপরেই ফিরে এল হাওয়া বরাবার তারপর বাঁ দিকে ঘুরে আবার হাওয়ার লাইনে। এর থেকেই বোঝা যায় চিতলটাকে বাঘে মেরেছে। শুয়োরটা শেষবারের মত আর একবার দেখে নিল খাওয়ার মত আর কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা তারপর দৌড়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
এরপর দেখা গেল দুটো চিতল হরিণ, দুটোরই শিং যেন মখমলে মোড়া। হাওয়ার দিক থেকে যেভাবে তারা সোজা রক্তে ভেজা জায়গাটার দিকে এগোচ্ছিল তাতে, বোঝা গেল গতরাতের মর্মান্তিক ঘটনার তারা সাক্ষী ছিল। তারা পালা করে মাটির গন্ধ শুকছিল অথবা থমকে দাঁড়াচ্ছিল। তাদের প্রতিটি মাংসপেশী তখন নিমেষের মধ্যে দৌড়ে পালাবার জন্যে তৈরি। এইভাবে কৌতূহল চরিতার্থ করতে তারা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সেই রাস্তা দিয়েই ফিরে গেল।
কৌতূহল জিনিসটা মানুষের একচেটিয়া নয়। কৌতূহলের দরুণ বহু জন্তু জানোয়ারকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। কুকুরটা বারান্দা থেকে ছুটল একটা ছায়ার দিকে ঘেউঘেউ করে অথবা হরিণটা দল ছেড়ে দেখতে গেল ঘাসের ঝোপটা হাওয়ায় নড়ছে না কেন–ব্য ঘাপটি মেরে থাকা চিতাটার খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। হঠাৎ সামনে ডান দিকে একটা নড়াচড়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমার গাছ থেকে প্রায় তিরিশ গজ দূরে, আগাছার ঝোপটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে দুটো ঝোপের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়েছে একটা জানোয়ার।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার দিকে ঝোঁপটি ফাঁক করে ফাঁকা জায়গাটায় বেরিয়ে এল। বাঘের বাচ্চাটা। ডাইনে বাঁয়ে না তাকিয়ে ও সোজা চলে গেল ওর শিকার যেখানে পড়ে আছে সেখানে। গিয়ে যখন দেখল ওর এত কষ্ট করে শিকার করা চিতলটার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই তখন ওর সব আশা হতাশায় পর্যবসিত হল। হয়তো ঘন্টার। পর ঘণ্টা ওকে নিঃশব্দে অনুসরণ করতে হয়েছে হরিণটাকে। হাড়ের টুকরো, জমা রক্ত কিছুই ওর মনঃপূত হল না, ও আকৃষ্ট হল একটা কসাইয়ের ব্যবহার করা কাঠের দিকে যার ওপর তখনও কয়েক টুকরো মাংস লেগে রয়েছে। এ জঙ্গলে বন্দুক নিয়ে শুধু আমি আসি না, আরো অনেকেই আসে। বাচ্চাটাকে যদি পূর্ণবয়স্ক বাঘ হয়ে। বেড়ে উঠতে হয় তাহলে ওকে শিখিয়ে দিতে হবে দিনের আলোয় অসতর্কভাবে মড়ির কাছে এগনো কত বিপজ্জনক। একটা ছররা বন্দুক আর ধুলো ওড়ানো একটা গুলিতেই আমার কাজ ভাল হত কিন্তু এ যাত্রায় উপায় নেই। রাইফেল দিয়েই কাজ সারতে হবে। ও যেই কসাইয়ের কাঠটা শোঁকার জন্যে মাথা তুলেছে আমার বুলেট গিয়ে লাগল কাঠটার গায়ে–ঠিক ওর নাকের এক ইঞ্চি ওপরে। এরপরে যে বছরগুলি এল গেল তার মধ্যে বাঘটি শুধু একবারই আজকের এই শিক্ষা ভুলে গিয়েছিল।
এর পরের শীতে আমি বাচ্চাটাকে কয়েকবার দেখেছিলাম। ওর কানগুলো এখন আর এত বড় বড় দেখাচ্ছে না, শিশু বয়সের লোমগুলির জায়গায় এখন সোনালী লাল লোমের ওপর পরিস্কার ভোরা কাটা দাগ। কঁপা গাছের গুঁড়িটা ফিরে গেছে ওটার আসল মালিক এক জোড়া চিতার কাছে-বাঘটা এখন আশ্রয় নিয়েছে পাহাড়ের সানুদেশ জোড়া এক ঘন আগাছার জঙ্গলে আর এখন সম্বর হরিণও ওর খাদ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে।
প্রতিবছরের মত পরের শীতেও পাহাড় থেকে নেমে এলাম। এবার জন্তু জানোয়ারদের চলার পথে বা জল খাওয়ার জায়গাগুলোর আশপাশে আমার বহু পরিচিত পায়ের দাগগুলি সপ্তাহের পর সপ্তাহ না দেখতে পেয়ে আমি ভাবলাম বাচ্চাটা নিশ্চয়ই পুরনো ঘাঁটিগুলি ছেড়ে আরও দূরে চলে গেছে। তারপর একদিন সকালে ওর অনুপস্থিতির কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল কারণ ওর থারার ছাপের পাশাপাশিই দেখলাম আরেকটি আকারে ছোট, লম্বাটে থাবার ছাপ। যে সঙ্গিনীকে খুঁজতে বেরিয়েছিল তারই থাবার ছাপ ওটা। আমি একবারই মাত্র বাঘদুটিকে একসঙ্গে দেখেছিলাম–বাচ্চাটা এতদিনে পুরোপুরি বাঘ হয়ে উঠেছে। আমি একটা সেরাও (পাহাড়ী ছাগল) মারতে বেরিয়েছিলাম ভোরের আলো ফোঁটার আগেই। সেটা থাকত পাহাড়ের পাদদেশে। ঘাস পোড়া পথ দিয়ে ফেরার সময় শাল গাছের ওপর বসা একটা শকুন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
পাখিটা আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে তাকিয়েছিল একটা ছোট্ট আগাছার ঝোপের দিকে। ঝোপটার পরেই ঘন জঙ্গলের বিস্তার। তখনও ঘাসে শিশির জমে আছে, আমি নিঃশব্দে গাছটার কাছে গিয়ে উঁকি মারলাম। একটা মৃত সম্বর হরিণের লতানো পাতানো শিং নিচু ঝোপগুলোর ওপর দিয়ে উঠে আছে। মৃত বললাম কারণ কোনো জীবিত হরিণ ঠিক ওইভাবে শুয়ে থাকতে পারে না। আমার রবার সোলের জুতো পরা পা নিঃশব্দে ও নিরাপদে রাখার মত একটা শ্যাওলা ঢাকা পাথর কাছেই ছিল। তারই ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতেই সম্বর হরিণটা পুরোপুরি আমার নজরে এল। ওটার পেছন দিকটা খাওয়া হয়ে গিয়েছে আর হরিণটার দুপাশে শুয়ে আছে বাঘ আর বাঘিনী। বাঘটা হরিণটার ওপাশে-ওর শুধু পেছনের পা দুটোই দেখা যাচ্ছে। দুটি বাঘই এখন ঘুমোচ্ছে। একটা শুকনো ডাল এড়াবার জন্য আমাকে যেতে হবে সোজা দশ ফুট এগিয়ে–তারপর বাঁ দিকে ফুট তিরিশেক গেলেই আমি বাঘটার গলায় গুলি করতে পারব। কিন্তু এত সব চিন্তা করার সময় আমি আমার নীরব দর্শকের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে শকুনটা আমায় দেখতে পাচ্ছিল না কিন্তু প্রথম দশ ফুট পেরনোর আগেই আমি পুরো ওর নজরে এসে গেলাম। আমায় অত কাছাকাছি দেখে ভয় পেয়ে ও ডাল থেকে উড়ে পালাবার চেষ্টা করল কিন্তু ওর ওপরের ডাল থেকে ঝুলন্ত একটা লতা ও খেয়াল করে নি। তারই সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিচিত্র ভঙ্গীতে শকুনটা পড়ল মাটিতে। মুহূর্তের মধ্যে বাঘিনীটা মড়ি আর ওর সঙ্গীকে একলাফে পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল-বাঘটাও কালবিলম্ব না করে ওর সঙ্গিনীর পথ ধরল। গুলি হয়তো করা যেত কিন্তু আহত হয়ে বাঘ সামনের গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিলে ওরই সুবেধ হত বেশি। যাঁরা কখনও চেষ্টা করেন নি তাদের আমি অনুরোধ করব মড়ির কাছ বরাবর চিতা বা বাঘের গতিবিধি অনুসরণ করতে। এর থেকে আনন্দের শিকার খুব কমই আছে। কিন্তু এ ধরনের শিকারে গুলিটা করা দরকার খুব সতর্কতা আর সাবধানতার সঙ্গে কারণ জানোয়ারটা এক গুলিতেই মারা না গেলে বা চলশক্তিহীন না হলে বিপদ আসতে বাধ্য।
এক সপ্তাহ পরেই বাঘটা আবার ফিরে এল তার একক জীবনে। ওর স্বভাবেও এল কিছু পরিবর্তন। এর আগে আমি যখন ওর মড়ির কাছে গিয়েছি ওর দিক থেকে কোনো বাধা আসে নি কিন্তু ওর সঙ্গিনী চলে যাওয়ার পরে প্রথমবার ওকে অনুসরণ করার সময়েই ও আমাকে বুঝিয়ে দিল যে ভবিষ্যতে আর ওর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা আমি যেন না করি। খুব কাছ থেকে কোনো ক্রুদ্ধ বাঘের চাপা গর্জনের মত ভয়াবহ আওয়াজ জঙ্গলে খুব কমই আছে। না শুনলে এটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না।
মার্চের গোড়ার দিকেই বাঘটা ওর প্রথম পূর্ণ বয়স্ক মোষ মারল। একদিন সন্ধেবেলা আমি আছি পাহাড়টার পাদদেশে। হঠাৎ একটা মোষের ভয়ার্ত হাম্বা হাম্বা আওয়াজ একটা বাঘের ক্রুদ্ধ গর্জনের সঙ্গে মিশে সারা জঙ্গলটা কাঁপয়ে তুলল। আমি একটা আন্দাজ করে নিলাম–আওয়াজটা আসছে প্রায় ছশো গজ দূরের একটা নালার দিক থেকে। ওদিকে যাওয়ার পথটা বন্ধুর, আলগা পাথর আর কাঁটাঝোপে ভর্তি। আমি একটা খাড়া পাথরে হামাগুড়ি দিয়ে উঠলাম যেখান থেকে নালাটা পরিষ্কার দেখা যায়। ততক্ষণে মোষটার সব প্রতিরোধ শেষ হয়ে গেছে আর কোথাও বাঘটার চিহ্নমাত্র নেই। আমি প্রায় এক ঘণ্টা রাইফেলের ঘোড়ায় আঙুল রেখে উপুড় হয়ে অপেক্ষা করলাম কিন্তু বাঘটার দেখা পেলাম না। পরদিন সকালে আবার আমি পাথরটা বেয়ে উঠলাম। নরম জমিতে খুরের দাগ আর নখের আঁচড় দেখেই বোঝা যাচ্ছে কি ভয়ানক লড়াই হয়ে গেছে জায়গাটায়। একমাত্র মোষটার ঘাড় ভেঙে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় বাঘটা ওকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে পারে। লড়াইটা চলেছিল অন্তত দশ থেকে পনের মিনিট। বাঘটার থাবার ছাপ নালা পার হয়ে গিয়েছে সেই ছাপ ধরে এগোতে দেখি একটা পাথরের ওপর একছোপ রক্তের দাগ–তার প্রায় একশো গজ দূরে একটা পড়ে থাকা গাছের ওপরেও কিছুটা রক্ত লেগে রয়েছে। মোষের শিংএ বাঘটা এত জোর চোট খেয়েছে মাথায় যে ওর আর মড়ি সম্বন্ধে কোনো উৎসাহ নেই। ও মড়ির কাছে আর ফিরেই এল না।
তিন বছর বাদে বাঘটা ওর বাচ্চা অবস্থার শিক্ষা অগ্রাহ্য করে (ওর যুক্তি হতে পারে যে সে সময়টা বাঘ মারার মরসুম শেষ হয়ে আসছিল), অসতর্কভাবে একটা মড়ির কাছে ফিরে যায়। সে মড়ির ওপর বসেছিল এক জমিদার তার প্রজাদের নিয়ে। তাদের গুলিতে বাঘের কাঁধের হাড় ভেঙে যায়। ওকে অনুসরণ করার কোনো চেষ্টা করা হয় নি। প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা পরে ঘাড় ভর্তি ভনভনে মাছি নিয়ে ও ইন্সপেকশন বাংলোর হাতা হয়ে একটা সাঁকো পেরোয়। সাঁকোটার ওধারে দুই সারি ভাড়া বাড়ি। সেসব বাড়ির বাসিন্দারা দরজায় দাঁড়িয়ে ওর যাওয়া দেখে! বাঘটা পাঁচিল ঘেরা একটা হাতার মধ্যে ঢুকে একটা খালি গুদামে আশ্রয় নেয়। আশপাশের গ্রামের লোকেরা ভিড় করে আসে ওকে দেখার জন্যে। সম্ভবত তাদের দেখেই খাবড়ে গিয়ে বাঘটা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিল সেই রাস্তা দিয়েই হাতাটা পেরিয়ে, আমাদের গেটের সামনে দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে গ্রামের নিচু অংশটার দিকে চলে যায়। আমাদের এক প্রজার একটা ষাঁড় তার আগের রাতে মারা গিয়েছিল আর সেটার মৃতদেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গ্রামেরই প্রান্তে একটা কাটা ঝোপের মধ্যে। বাঘটা এটা খুঁজে পায় আর কিছুদিন কাটায় ওই ঝোপের মধ্যেই তেষ্টা পেলে ও জল খেতে যেত একটা জলসেচের খালে।
আমরা যখন দুমাস বাদে পাহাড় থেকে নেমে আসি তখন বাঘটা গ্রামের আশপাশ থেকে ধরা ছোটখাট জন্তু জানোয়ার (বাছুর, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি) খেয়েই বাঁচত। মার্চ নাগাদ ওর কাঁধের ঘাটা সেরে গিয়েছিল কিন্তু ওর ডান পাটা ঘুরে ভেতর দিকে চলে গিয়েছিল। যে জঙ্গলে বাঘটা গুলি খায় পরে সেই জঙ্গলেই সে ফিরে গিয়েছিল আর তার দৌরাত্ম্য আরম্ভ হয়েছিল পাশের গ্রামের গরু মোষের ওপর। নিরাপত্তার জন্যে ও একবারে একটা জানোয়ার মেরে খাওয়ার জন্যে নিয়ে যেত- তার ফলে স্বাভাবিক অবস্থায় ও যা গরু মোষ মারত, এখন মারছিল তার পাঁচগুণ বেশি। যে জমিদার ওকে গুলি করেছিল তারই দুর্ভাগ্য ছিল সব থেকে বেশি কারণ তার গরু মোষও ছিল প্রায় চারশো।
এর পরের কয়েক বছর ও আকারেও যেমন বাড়ল ওর খ্যাতিও বাড়ল সেই অনুপাতে। বহু শিকারী ওকে মারার নানারকম প্রচেষ্টা করেছিলেন।
নভেম্বর মাসের এক সন্ধেবেলা একজন গ্রামের নোক একটা একনলা গাদা বন্দুক নিয়ে শুয়োর শিকারের চেষ্টায় বেরিয়েছিল। ভাঙাচোরা জমিতে একটা বিশগজ মত চওড়া রোখার মধ্যে (শুকিয়ে যাওয়া ঝরনা) একটা আলগা ঝোপে সে তার মাচা বেঁধেছিল। এই জমিটা ছিল চতুর্ভুজাকার তার চওড়া দিকটায় চাষের ক্ষেত, অন্যদিকে একটা পায়ে চলার পথ। এইদিকে একটা দশ ফুট চওড়া নালা আমাদের চাষের জমি আর জঙ্গলের মধ্যে সীমারেখা ছিল। লোকটার সামনে একটা চার ফুট উঁচু আল, তার ওপর দিয়ে ছাগলের পায়ে চলার পথ–আর পেছন দিকে ঘন ঝোপঝাড়। রাত ৮টা নাগাদ এই পথটার ওপর এসে দাঁড়াল এক জানোয়ার। লোকটা সাধ্যমত তাক করে গুলি ছুঁড়ল। গুলি খেয়ে জানোয়ারটা আল থেকে পড়ে গেল তারপর লোকটার কয়েক ফুটের মধ্যে দিয়েই গোঁ গোঁ করতে করতে ছুটে বেরিয়ে গেল পেছনের ঝোপের মধ্যে। পায়ের কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লোকটা দুশোগজ দূরে তার কুঁড়েঘরের দিকে দৌড় দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকজন জড়ো হয়ে গেল। লোকটার বর্ণনা শুনে ওরা ধরে নিল যে শুয়োরটা বেশ ভালই জখম হয়েছে। ওরা স্থির করল শুয়োরটাকে হায়না আর শেয়ালের খাওয়ার জন্যে ফেলে রাখা ঠিক হবে না। একটা লণ্ঠন জ্বালানো হল তারপর ছয়জন সাহসী লোকের একটা দল যখন শিকার উঠিয়ে নিয়ে আসার জন্য তৈরি তখন আমারই এক প্রজা বলল একটা বন্দুকে গুলি ভরে নিয়ে যাওয়া দরকার। এই প্রজাটি নৈশ অভিযানে যোগ দিতে রাজী হয় নি কারণ সে আমাকে পরে বলেছিল যে, রাতে ঘন ঝোঁপ ঝাড়ের মধ্যে আহত শুয়োর খুঁজে বেড়ানোটা ওর পক্ষে মনঃপূত নয়।
অভিযাত্রী দল ওর পরামর্শ মেনে নিল। প্রচুর বারুদের গুঁড়ো ভরা হল বন্দুকের নলে– তারপর কাঠ দিয়ে খুঁচিয়ে বারুদ ভরার সময়ে কাঠের টুকরোটা ভেতরে আটকে ভেঙে গেল। ঘটনা হিসেবে এটা কিছুই নয় কিন্তু এর জন্যেই ওই ছয় জনের প্রাণ বেঁচেছিল। ভাঙা কাঠের টুকরোটা বহু কষ্টে বার করে বন্দুকে বারুদ ভরে দলটি বেরিয়ে পড়ল।
জানোয়ারটা যেখানে ঝোপের মধ্যে ঢুকেছিল সে জায়গাটা খুব ভালভাবে খোঁজা হল। রক্তের দাগ দেখার পর শুয়োরটাকে খুঁজে বার করার উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। সমস্ত জায়গাটা তন্নতন্ন করে খোঁজার পরে ওরা সে রাতের মত ক্ষান্ত দিল। পরদিন সকালে আবার খোঁজাখুঁজি আরম্ভ হল। এবার দলের সঙ্গে যোগ দিল আমার সেই সংবাদদাতা প্রজাটি। জঙ্গলের ঘেচি ঘাঁচ সে অন্য সকলের থেকে ভাল জানে। একটা ঝোপের নিচে জমিতে অনেকটা রক্ত জমেছিল–ওই মাটিটা পরখ করে ও কয়েকটা রক্তমাখা লোম আমার কাছে নিয়ে এল। আমি দেখেই বুঝলাম নোমগুলি বাঘের। আমার একজন শিকারী সঙ্গী সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন, তাঁকে নিয়ে জমিটা দেখতে বেরোলাম।
মাটির চিহ্ন দেখে জঙ্গলের কোনো ঘটনা মনে মনে পুনর্গঠনের কাজটা আমার চিরদিনই খুব ভাল লাগে। একথা ঠিকই এ কাজে কোনো কোনো অনুমান পরে ভুল প্রমাণিত হয় কিন্তু কিছু কিছু অনুমান ঠিকও হয়। এভাবে আমি ঠিকই ধরেছিলাম যে বাঘটা চোট খেয়েছে সামনের ডান পায়ের ভেতর দিকটায়, কিন্তু বাঘটার পা ভেঙে গেছে বা বাঘটার বয়েস কম আর এ অঞ্চলে নবাগত–আমার এ ধারণা পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল।
যেখানে লোমগুলি পাওয়া গিয়েছে তার বাইরে আর রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। কঠিন জমির ওপর অনুসরণ করা অসম্ভব সেই জন্যে আমি নালাটা পেরিয়ে ওপারে গেলাম যেখানে গরু ছাগলের পায়ে চলার পথটা বালির চড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। এর ওপর থাবার ছাপ দেখে আমি বুঝলাম বাঘটা মোটেই কম বয়সী নয়–এ আমার সেই বহু পরিচিত পিপলপানির বাঘ। ঘুর পথ এড়াবার জন্যে গ্রামের মধ্যে দিয়ে আসার সময় অন্ধকারে লোকটি ওকে শুয়োর বলে ভুল করে।
এর আগেও একবার জখম হওয়ার পর বাঘটা জনবসতির মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে কিন্তু কোনো মানুষ বা জন্তুর কোনো ক্ষতি করে নি। কিন্তু এখন বাঘটার বয়স অনেক বেড়েছে। ব্যথায় বা ক্ষিধেতে মরিয়া হয়ে অনেক ক্ষতিই করতে পারে ও। দুশ্চিন্তার কথাই বটে, কারণ এ অঞ্চলটায় জনবসতি খুব ঘন। আমাকেও চলে যেতে হবে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই কারণ এমন একটা কাজ আছে যেটা পেছিয়ে দেওয়া যাবে না।
তিনদিন ধরে জঙ্গলটার প্রায় চার বর্গমাইল জায়গা, নালাটা থেকে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত আমি তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। কিন্তু বাঘটার কোনো চিহ্ন পেলাম না। চতুর্থ দিন বিকেলবেলা আবার যখন আমি খুঁজতে বেরোচ্ছি তখন দেখা হল একটি বৃদ্ধা ও তার ছেলের সঙ্গে। ওরা তাড়াতাড়ি জঙ্গল ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ওদের কাছেই শুনলাম যে পাহাড়ের পাদদেশের কাছে বাঘটার গর্জন শোনা যাচ্ছে আর জঙ্গলের গরু মোয়দের মধ্যে পালাবার জন্যে হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছে। রাইফেল সঙ্গে থাকলে সব সময় আমি একা বেরোই কারণ কোনো জানোয়ারের সঙ্গে আচমকা মোলাকাত হলে রাইফেলই নিরাপদ–আর রাইফেল নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ নিঃশব্দে চলাও যায়। যাই হক এ যাত্রায় কিন্তু আমি নিয়মের ব্যতিক্রম করলাম। ছেলেটিকেও সঙ্গে নিলাম কারণ ও কোথায় বাঘের ডাক শুনেছে সে জায়গাটা আমাকে দেখাতে খুব উৎসুক।
পাদদেশে পৌঁছে ছেলেটা আঙুল তুলে একটা ঘন ঝোঁপ দেখিয়ে দিল। ঝোপটার ওপাশে সেই ঘাস পোড়া পথ যার উল্লেখ আমি আগেই করেছি আর এদিকে পিপলপানি ঝরনা। ঝরনাটার সমান্তরালভাবে প্রায় একশো গজ দূরে একটা কুড়ি ফুট মত চওড়া গর্ত। গর্তটার এদিকটা ভোলামেলা শুধু ঝরনার কাছাকাছি জায়গাটায় কিছু ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল। ঝরনাটার ওদিকটায় বহু ব্যবহৃত একটা পায়ে চলার পথ। পথটার কুড়ি গজ মত দূরে গর্তটার খোলা দিকটায় একটা ছোট গাছ। বাঘটা যদি এই পথ দিয়ে আসে তাহলে ঝোপঝাড়গুলি পেরিয়ে নিশ্চয়ই একবার দাঁড়াবে। তখন আমি গুলি করার সুযোগ পাব। আমি ঠিক করলাম এখানেই দাঁড়াব। ছেলেটাকে গাছে তুলে দিলাম, ওর পাটা ঝুলতে লাগল ঠিক আমার মাথার ওপর। ওকে বলে দিলাম ওপর থেকে বাঘটাকে ও যদি আগে দেখতে পায় তাহলে যেন গোড়ালি দিয়ে সংকেত করে। তারপর গাছে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আমি বাঘের ডাক নকল করে ডাকলাম। আপনি যদি আমারই মত দীর্ঘকাল জঙ্গলে কাটিয়ে থাকেন, তাহলে বাঘিনী যখন তার সঙ্গিনীকে ডাকে, সে ডাকের বর্ণনা আপনাকে দেওয়ার প্রয়োজন নেই আর যাঁদের অভিজ্ঞতা কম তারা জেনে রাখুন এ ডাক ঠিক ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এ ডাক শেখার জন্যে খুব লক্ষ করে শুনতে হয় আর কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতে হয় পুরো মাত্রায়।
আমার সব উৎকণ্ঠা শেষ করে দিয়ে প্রায় পাঁচশো গজ মত দূর থেকে বাঘটার সাড়া এল। আমার মনের অবস্থাটা বুঝতেই পারছেন–তিনদিন রাইফেলের ঘোড়ায় আঙুল রেখে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এরপরে প্রায় আধঘণ্টা একটু কম হতে পারে তবে সময়টা তখন খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছিল, আমার ডাক আর তার সাড়া চলতে থাকল। একদিকে রাজার গুরুগম্ভীর আদেশ, অন্যদিকে তার প্রণয়িনীর সলজ্জ উত্তর। ছেলেটি এর মধ্যে বার দুয়েক সংকেত করেছিল কিন্তু তখনও আমি বাঘটিকে দেখতে পাই নি। অস্তগামী সূর্যের সোনালী আলো যখন জঙ্গলটাকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে তখন সেই পথ ধরে বাঘটা খুব দ্রুতগতিতে এল। ঝোপটা পেরনোর পরেও কিন্তু একমুহূর্তও দাঁড়ায় নি ও। ও যখন গর্তটা আধাআধি পেরিয়েছে আর আমিও রাইফেল তুলছি তখন ও হঠাৎ ডানদিকে বেঁকে সোজা আমার দিকে এগিয়ে এল।
আমি যখন দাঁড়াবার জায়গাটা বেছে নিই তখন এ সম্ভাবনার কথা আমার খেয়াল ছিল না, বাঘটাকে এত কাছে আসতে দিতে আমি চাই নি। এখন বাঘটাকে গুলি করা চলে একমাত্র মাথায়, কিন্তু এত কাছ থেকে তা করতে আমি রাজী নই। বহুদিন আগে শেখা আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে কাজ দেয় এমন একটা কৌশল করে বাঘটাকে দাঁড় করিয়ে দিলাম–কোনো বিপদের আভাস ও পায় নি। একটা থাবা তুলে ও আস্তে আস্তে মাথাটা ওঠাল-ওর বুক আর গলা তখন খোলা। ভারি বুলেটের ধাক্কায় ও কোনোরকমে পায়ের ওপর উঠে দাঁড়াল, অন্ধের মত জঙ্গল ভেদ করে তীব্রগতিতে কিছুটা ছুটে গেল তারপর আছড়ে পড়ল সেই জায়গাটারই কয়েক গজ দূরে যেখানে কোন এক নভেম্বরে সকালে একটা চিতল হরিণের ডাক শুনে গিয়ে আমি প্রথম তার থাবার ছাপ দেখি।
তারপরেই আমি বুঝতে পারলাম বাঘটাকে একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মারা হয়েছে। যে ক্ষতটা আমি ভেবেছিলাম, ওকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে সেটা পরখ করে দেখলাম প্রায় শুকিয়ে এসেছে। ক্ষতটা হয়েছিল একটা সীসের ছররায় ওর সামনের ডান পায়ের একটা শিরা কেটে যাওয়ায়।
এই শিকারে সাফল্য আমাকে আনন্দ দিয়েছিল প্রচুর কারণ বাঘটা লম্বায় প্রায় দশ ফুট তিন ইঞ্চি আর ওর শীতকালীন চামড়াও ছিল চমৎকার অবস্থায়। কিন্তু একটা দুঃখও ছায়া ফেলেছিল এই আনন্দের ওপর। আর কোনোদিন আমি গ্রামবাসীদের সঙ্গে রুদ্ধশ্বাসে পাহাড়ের পাদদেশ কাঁপানো ওর গুরুগম্ভীর গলার গর্জন শুনতে পাব না, আর কোনোদিন জন্তুজানোয়ারদের চলার পথে দেখতে পাব না ওর বহু পরিচিত থাবার ছাপ–যে পথ ধরে আমাদের দুজনেরই দীর্ঘ পনের বছরের আনাগোনা।