০৮.
এক্সকিউজ মি। আর ইউ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?
উ? হুঁ। বাট ফানি! বাইনোকুলারে আকাশে হাঁসের ঝাঁক দেখতে দেখতে ক্লিফটনগঞ্জ স্টেশনে প্ল্যাটফর্মের শেষ দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কর্নেল। পিঠে আটকানো মোটাসোটা কিটব্যাগ। বুকের ওপর একটা ক্যামেরা ঝুলছে। হাঁসের গতিপথের দিকে ঘুরতেই কামড়ানো চুরুট থেকে ইঞ্চিটাক ছাই খসে পড়ল শাদা দাড়িতে। ক্রিসক্ৰস….জিগজ্যাগ…বাঃ। ক্রিসমাস গেম।
এক্সকিউজ মি। আপনি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?
লো অ্যান্ড বিহোল্ড! আট আট আট আট…ক্রিসমাস গেম, ডার্লিং! লুক, লুক!
মুখ একটু বেশি তুলতে গিয়ে ছাইরঙা টুপিটা পিঠের কিটব্যাগে আটকে গেল। তারপর পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। বিকেলের রোদে টাক ঝলমলিয়ে উঠেছিল। পিউ বিরক্ত হয়ে বলল, এক্সকিউজ মি। আপনার টুপি।
কর্নেল একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। অগত্যা পিউ টুপিটি কুড়িয়ে ওঁর হাতে গুঁজে দিল। টুপি পরে বাইনোকুলার চোখ থেকে নামিয়ে কর্নেল উজ্জ্বল মুখে ঘুরলেন। বললেন, থ্যাঙ্কস। তারপর ভুরু কুঁচকে তাকালেন। দময়ন্তী! রাইট?
পিউ একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, আপনি আমায় চেনেন?
তুমি আমায় চেন?
আপনার চেহারার ডেসক্রিপশান শুনেছি।
আমিও তোমার সম্পর্কে শুনেছি।
পিউ একটু হাসল। দাদামশাইয়ের কাছে তো? ওঁর অবশ্য সব কিছুকে ভীষণ কালারফুল করার অভ্যাস আছে। কিন্তু স্টেশনে আপনাকে আমার রিসিভ করতে আসার কথা ছিল না।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে বললেন, যার ছিল, সে ব্রুস লি-র ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
পিউ স্টেশনঘরের দিকে তাকাল। সাত্যকি, কোমরে দু’হাত রেখে সত্যিই একটা পোস্টার দেখছে। একেবারে পাথরের মূর্তি। পিউ কর্নেলের দিকে ঘুরে চাপাস্বরে বলল, সরি! ভুলে গিয়েছিলুম আপনি ডিটেকটিভ।
ডিটেকটিভ? কর্নেল হাসলেন। ডিটেকটিভ গল্পের বইয়ে থাকে। তা ছাড়া তুমি কি জান কথাটা একটা গালাগাল?
পিউ অবাক হয়ে বলল, গালাগাল হবে কেন? রাণুদি বলছিলেন আপনি ডিটেকটিভ। দাদামশাই তাই আপনাকে আনতে কলকাতা গিয়েছিলেন। জামাইবাবু যে সত্যি আনুদাকে মাডার করেনি……
ওয়েট, ওয়েট! তুমি কি জান বাংলায় টিকটিকি কথাটা একট স্ল্যাং? কথাটা এসেছে ডিটেকডিভ থেকে। যাই হোক, আমি ডিটেকটিভ নই। তোমার দাদামশাইয়ের বন্ধু।
কর্নেলের মুখে চাপা কৌতুক ছিল। কিন্তু পিউ সিরিয়াস হয়ে বলল, বুঝেছি। ব্যাপারটা আপনি গোপন রাখতে চান।
তার মানে তুমি নিশ্চয় ভাবছ আমার এই দাড়ি নকল দাড়ি? কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন। তাই বলে আমি তোমায় দাড়ি টেনে দেখার অনুমতি দেব না।
পিউ হেসে ফেলল। ভ্যাট! বুড়োদা আমায় বলেছেন সান্তাক্লস আসছেন। ক্লিফটনগঞ্জে। তবে অন দা ইভ অব অ্যান আনহাপি ক্রিসমাস। এক মিনিট! আমি ওকে ডেকে আনি।
উঁহু। এস আমরা চুপিচুপি কেটে পড়ি।
কিন্তু ও আমাকে খুঁজবে!
ডার্লিং! তোমার সঙ্গীর জন্য শীতের বিকেলে একটু রহস্য রেখে যাও।
পিউ অনিচ্ছাসত্ত্বেও কর্নেলের সঙ্গ নিল। সাত্যকি তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। তাকে এড়িয়ে স্টেশনঘরের গেটের কাছে পৌঁছে পিউ বলল, কিন্তু প্রব্লেম কী, জানেন? বুড়োদা ফান বোঝে না। মোল্লার দৌড় মসজিদ। সোজা থানায় গিয়ে উঠবে। সে-ই তো থানা-থানা করে কেলেঙ্কারিটা বাধাল।
ওয়েটিং হলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু দেহাতি মানুষজন কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে আছে। চায়ের স্টলে ছোট্ট একটা নিস্পন্দ ভিড়। শেষ বেলার কনকনে ঠাণ্ডা সব কিছু চুপ করিয়ে রেখেছে। নীচের চত্বরে যাত্রী না পাওয়া একটা এক্কা গাড়ি, কয়েকটা সাইকেল-রিকশো, আর একটা জিপ। কর্নেলকে দেখে কেউ নড়ল না। শুধু জিপের ড্রাইভার আড়ষ্ট গলায় বাঁধা গৎ আওড়াল, কুরুডি ফরেস্ট? ওনলি ফিফটি রুপিজ। হাফ অ্যান আওয়ার। ওয়াটারড্যাম ঔর ভি চিড়িয়া-সেংচুয়েরি টেয়েন্টি রুপিজ। পিরাইভিট লজ ভি হ্যায়। ফিল্মেকি স্যুটিং দেখনে ভি মওকা মিলেগা!
পিউ সাইকেল-রিকশো ডাকতে যাচ্ছিল কর্নেল বললেন, নাক বরাবর শর্টকার্ট করব। চলে এস।
পেট্রল পাম্পের পিছনে একটা টিলা। কর্নেলকে সেদিকে যেতে দেখে পিউ বলল, ওদিকে রাস্তা কোথায়?
তুমি যেখানে পা ফেলে হাঁটবে, সেটাই তোমার রাস্তা।
আমি কিন্তু কিছু চিনি না।
কর্নেল চুরুটটা জুতোর তলায় ঘসটে নিভিয়ে বললেন, জিল্স শার্ট জ্যাকেট পরা নিশ্চয় তোমার ফ্যাশন নয়?
পিউ ফুঁসে উঠল। আই অ্যাম আ পার্সন। দিস ইজ মাই ড্রেস।
কর্নেল হাসলেন। আসলে আমি বলতে চাইছি তোমার এই পোশাক তোমার কাছে অ্যাডভেঞ্চারের স্পিরিট দাবি করে।
পিউ একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু এখানে দেখেছি খুব শিগগির সন্ধ্যা হয়ে যায়। পথ হারিয়ে ফেললে কেলেঙ্কারি।
সেটাই অ্যাডভেঞ্চার। এস।
টিলার ওপাশে একটা বস্তি। বাঁদিকে ঝোপঝাড় আর ছোট-বড় নানা গড়নের পাথরে ভরা অসমতল একটা মাঠ। ফিকে সোনালি রোদ কাছে ও দূরে নীল কুয়াশার তলায় নেতিয়ে পড়ে আছে। কর্নেল বইনোকুলার তুলে বললেন, অক্টোবরে এই মাঠে অনেক লালঘুঘু দেখেছিলুম। ঝোপগুলোর পাতার রঙ বদলেছে। ওদের ক্যামোফ্লাজের বড়ো অসুবিধে। জাস্ট আ মিনিট! জাস্ট আ মিনিট।
পিউ দেখল, কর্নেল পিঠের কিটব্যাগের কোনা থেকে কী একটা টেনে বের করলেন। সেটা কী করে হঠাৎ ছাতার বাঁটের মতো লম্বা হয়ে গেল এবং নিঃশব্দে ফিকে হলুদ রঙের একটা সূক্ষ্ম জাল ছাতার মতোই বেরিয়ে পড়ল। কর্নেল পা টিপে টিপে একটু কুঁজো হয়ে একটা বড় পাথরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, যাঃ।
পিউ অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার?
প্রজাপতি। কর্নেল বিরসমুখে জাল এবং স্টিক গুটিয়ে কিটব্যাগে চালান করে দিলেন। পা বাড়িয়ে বললেন, রেয়ার স্পেসিস না হলেও একটু বৈশিষ্ট্য আছে। শীতের সময় ডানার রঙ ফিকে হয়ে যায়। আবার শীত ফুরোলে জেল্লা বাড়ে। প্রকৃতিতে যত সৌন্দর্য, তত রহস্য। তবে তার চেয়ে জরুরি কথাটা হল, প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে মানুষ কেমন যেন হয়ে যায়। এই যে আমরা হাঁটছি, কোন মুহূর্তে কল্পনাতীত কিছু ঘটে যেতে পারে। সেজন্য নিয়ম হল, রেডি স্টেডি-গো পজিশনে থাকতে হয়। প্রতিটি মুহূর্ত রেসের মুহূর্ত।
কিছুক্ষণ চুপচাপ চলার পর পিউ বলল, আপনি প্রজাপতি ধরেন কেন?
তুমি জিনস শার্ট জ্যাকেট পরেছ কেন?
পিউ একটু চটে গেল। কী কথায় কী! আপনার আউটলুকটা বড্ড সেকেলে। বলে সে এদিক-ওদিক দেখে নিল। সন্দিগ্ধভাবে বলল, আমরা ঠিক যাচ্ছি তো?
আমরা ক্লিফটনসায়েবের কুঠিবাড়ির কাছাকাছি পৌঁছেছি। তো আমাদের ঝগড়ার পয়েন্টনটা পিক আপ করা যাক।
নাহ্। মেল শোভিনিস্টদের সঙ্গে আমার ঝগড়ার ইচ্ছে নেই।
কর্নেল একটা অট্টহাসি হাসলেন। দময়ন্তী, এই ঠাণ্ডায় ঝগড়া কিছুটা তাপ দেবে।
পিউ গলার ভেতর বলল, আমার নাম পিউ। দময়ন্তী আমি পছন্দ করি না।
ওয়েল! পিউ, মেল শোভিনিস্টদের সঙ্গে ফিমেল শোভিনিস্টদের ঝগড়াটা সব সময় বেশ উচ্চাঙ্গের হয় জান কি? ইতিহাস সমাজতত্ত্ব শাস্ত্র-টাস্ত্র। আমাদের সূত্র সামান্য একটা প্রজাপতি।
পিউ ঘুরে তাকাল শুধু। কিছু বলল না।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, নাহ। সামান্য কী বলছি! বিয়ের কার্ডে একসময় প্রজাপতির ছবি মাস্ট ছিল। একবার এক ভদ্রলোক আমার কাছে হাজির। তাঁর মেয়ের বিয়ে। তিনি জানতে চাইলেন, আমি অন্তত শ’পাঁচেক প্রজাপতি ওঁকে সাপ্লাই করতে পারব কিনা। মেয়ের বিয়ের কার্ডে উনি সত্যিকার প্রজাপতি সেঁটে দেবেন। স্টাড় প্রজাপতি! জাস্ট ইমাজিন!
পিউ আমননে বলল, পৃথিবীটা যত সব অদ্ভুত-অদ্ভুত লোকে ভর্তি।
তার চেয়ে অদ্ভুত, কোনও মেয়ের কাছ ঘেঁসে প্রজাপতি গেলেই নাকি অবধারিত গায়ে হলুদ।
আমি জানি না। শুনিনি।
প্রজাপতিটা তোমার মাথার স্কার্ফ ছুঁয়ে গেছে।
সো হোয়াট? পিউ কাঁধ নেড়ে একটা ভঙ্গি করল।
ডার্লিং! প্রজাপতি সব কিছুকে সুন্দর করে। মিনিংফুল করে। দ্যাটস দা পয়েন্ট।
পিউ বাঁকা হাসল। আপনার এই ডার্লিং বলাটা কি গোয়েন্দাদের ট্যাকটিস্? বুড়োদা বলছিল, আপনি নাকি ওকেও ডার্লিং বলেন।
তুমি এটাকে মেল শোভিনিজম বলতে চাও কি? কর্নেল তার কাছাকাছি এলেন। বললেন, সাত্যকি প্রথম-প্রথম চটে যেত। তখন ওকে ডিকশনারি দেখতে বললুম। দেখে এস বলল, ইউ আর কারেক্ট।
পিউ একটু চুপ করে থাকার পর ছোট্ট এ.; শ্বাস ছেড়ে বলল, বুড়োদার সঙ্গ ধরেছিলুম আপনাকে আগাম কিছু সিক্রেট ইনফরমেশন দেব বলে। আপনি আমার মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছেন।
চিয়ার আপ ডার্লিং! চিয়ার আপ!
ভ্যাট! বিচ্ছিরি বনবাদাড়। আপনি অ্যাডভেঞ্চার করুন। আমি রাস্তায় যাচ্ছি।
এখান থেকে সোজাসুজি রাস্তায় যেতে হলে একটা নালা পেরুতে হবে।
পেরুব।
গভীর জল আছে।
পিউ জেদ করে এগিয়ে গেল। তারপর থমকে দাঁড়াল। বলল, কোনও মানে হয়?
চলে এস ডার্লিং! কুরুডি ফরেস্ট থেকে কোনও-কোনও ছিটগ্রস্ত ভালুক বিকেলে এখানে বেড়াতে আসে। ওই দেখ, নালার ওপারে একটা ঝোপ কেমন নড়ছে।
পিউ দ্রুত কর্নেলের সঙ্গ ধরল। বলল, কিন্তু এদিকটায় তো বড্ড বেশি জঙ্গল।
এই শালবনটা পেরুলেই ক্লিফটনসায়েবের কুঠি। সেখান থেকে পাখি ওড়া পথে চারুভবন। বলে কর্নেল শালবনে ঢুকলেন। শুকনো পাতা ছড়িয়ে আছে সবখানে। কুঠি বাড়ির ভাঙা ফটকটা আবছা দেখা যাচ্ছিল। কর্নেল একটু হাসলেন। সিক্রেট ইনফরমেশন দেওয়ার উপযুক্ত জায়গা! পিউ, এবার স্বচ্ছন্দে তুমি তা আমাকে উপহার দিতে পার।
পিউকে চুপচাপ দেখে ফের বললেন, কী হল ডার্লিং?
পিউ আস্তে বলল, রাস্তা দিয়ে গেলে জায়গাটা আপনাকে দেখাতুম।
কোন জায়গাটা?
যেখানে জামাইবাবুর গাড়ি ব্রেক ফেল করেছিল।
বলেই সে পিছু ফিরল। কর্নেল বললেন, কেউ আড়ি পেতে আছে নাকি দেখছ?
নাহ্। কী একটা শব্দ। পিউ চমকানো গলায় বলল, ওই শুনুন!
কোথাও ঝোপের আড়ালে শুকনো পাতায় মচ মচ শব্দ হচ্ছিল। শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। কর্নেল বললেন, ছিটগ্রস্ত কোনও ভালুক নয় এটুকু বলতে পারি। পাখিটাখি হবে। চলো!
পিউ কর্নেলের কাছ ঘেঁসে হাঁটতে থাকল। চাপাস্বরে বলল, দিদি আমাকে বলতে বারণ করেছে। তবু বলছি। আপনার জেনে রাখা দরকার। যে রাতে আনুদা মাডার হয়,…সে আবার পিছু ফিরল। কর্নেল! কেউ আমাদের ফলো করছে। আবার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না?
পাচ্ছি।
পিউ শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে বলল, নিশ্চয় ঝোপের আড়ালে কেউ আমাদের ফলো করছে।
করুক। তুমি কী বলছিলে, বলো।
আপনি জানেন, ব্রেক ফেল করার পর গাড়ি রেখে জামাইবাবু যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন পিছনে পায়ের শব্দ শুনেছিল। কেউ ওকে ফলো করেছিল। এবার দেখুন, আমাদেরও ফলো করছে। ব্যাপারটা থ্রিলিং!
কর্নেল হাসলেন। তা হলে দেখ, এভাবে এলুম বলে আমরাও থ্রিলটা পাচ্ছি!
আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আচ্ছা, আপনার কাছে ফায়ারআর্মস নেই?
থাকলেও কাজে লাগানোর মতো কিছু ঘটছে না।
ওই শব্দটা!
শব্দটা থেমে গেছে।
পিউ কান করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করল তারপর শ্বাস ছেড়ে বলল, মিসটিরিয়াস।
তোমাকে বলেছিলুম ডার্লিং, প্রকৃতিতে প্রচুর রহস্য আছে।
শালবন শেষ হওয়া পর্যন্ত পিউ কোনও কথা বলল না। এবার সংকীর্ণ একফালি এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা পড়ল সামনে। রাস্তাটা বাঁদিকে কুঠিবাড়ির ফটকে পৌঁছেছে। ভাঙা ফটকের কাছে একট বিশাল মহুয়া গাছ দেখা যাচ্ছে। রাস্তায় পৌঁছে পিউ বলল, যে রাতে আনুদা মাডার হয়, জামাইবাবু বাড়ি ফেরার পর আবার বেরিয়েছিল। গাড়িতে নাকি কী একটা ইমপর্ট্যান্ট জিনিস ফেলে এসেছে। জিনিসটা কী জানেন? চোখে না দেখলে আমিও বিশ্বাস করতুম না যে, জামাইবাবুর ফায়ার আর্মস আছে। রিভলভার না পিস্তল, জানি না। এইটুকু, ছোট্ট। দিদি ওটা লুকিয়ে রেখেছে। দম নিয়ে পিউ ফের বলল, জামাইবাবুকে দেখলেই বুঝতেন, একেবারে ভীতু গোবেচারা মানুষ। সে সঙ্গে ফায়ার আর্মস রাখে; ভাবা যায় না! কিন্তু সেটা কোনও ব্যাপার নয়। আনুদার বুকে স্ট্যাব করা হয়েছিল। আমি বডি দেখে এসেছিলুম। জামাইবাবুর সঙ্গে ওর যদি মারামারি হত, উল্টে জামাইবাবুই মারা পড়ত। তা ছাড়া আনুদারও ফায়ারআর্মস ছিল, আমি দেখেছি।
কোথায় দেখেছ?
কেন? গণাদার সঙ্গে আমাদের ফ্ল্যাটে প্রায়ই আসত। আনুদা ছিল গণাদার বডিগার্ড, জানেন তো?
ফিল্ম ডাইরেক্টার গণনাথ সেন? তাঁর কেন বডিগার্ড দরকার হত জান তুমি?
জামাইবাবুর কাছে শুনেছি, কোন ফাইন্যান্সারকে ফাঁসিয়েছিল। গণাদা যা কেলো করে না!
গণনাথবাবু শ্যুটিং করছেন শুনেছি?
হুঁ। ওয়াটারড্যামের ওখানে। এত কাণ্ডের পর পারেও বাবা! পিউ মুখ তেতো করে বলল। আমার একটা ব্যাপারে অবাক লাগছে। দাদামশাই প্রথমে জামাইবাবুর কোম্পানির আমিনগঞ্জ ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিলেন। ডিফেন্সের ব্যাপারে যদি কোনও হেল্প পাওয়া যায়। ওরা বলেছে, কিছু করার নেই। তারপর তো দাদামশাই কলকাতা গেলেন। আপনার কাছ থেকে জামাইবাবুর কোম্পানির অফিসে গিয়েছিলেন। রাণুদি বলছিল, হেড অফিসেও কোনও রেসপন্স পাননি দাদামশাই। এদিকে নন-বেলেল ওয়ারেন্ট। আজ আশাপুরা জজকোর্টে বেল অ্যাপ্লিকেশনের হিয়ারিং ছিল। ফিরে গিয়ে কী শুনব কে জানে? কর্নেল! আপনি কি কুঠিবাড়িতে ঢুকবেন?
না। দেয়ালের পাশ দিয়ে যাব।
কুঠিবাড়ির ছাদটা কিন্তু অসাধারণ!
নীচের খাদটা দেখেছ?
হুঁউ। ওই খাদের জলেই তো আনুদার বডি পড়েছিল! জেলেরা দেখতে পায়।
খাদে একটা পেত্নী থাকে জান তো? পিউ হাসল।
লোকাল লোকেরা কী যেন বলে। ভেরি পিকিউলিয়ার ওয়র্ড।
কিচনি।
হ্যাঁ, কিচনি। ও! আপনাকে বলা উচিত, আনুদা যে রাতে মাডার হয়, কিচনির ডাক শুনেছিল জামাইবাবু। টেরিফিক ক্র্যাকড ভয়েস। ইরিগেশন বাংলোর চৌকিদার বলেছিল, সেও শুনেছে। কিচনি ডাকলেই নাকি ওই খাদে বডি পাওয়া যায়। তবে জামাইবাবু ভীষণ ভয় পেয়েছিল। আপনি কখনও শুনেছেন কিচনির ডাক?
অক্টোবরে এসেছিলুম। তখন শুনেছিলুম। সত্যিই টেরিফিক ক্র্যাক্ড় ভয়েস।
আমার ধারণা কোনও জন্তুটন্তু হবে। পিউ একটু চঞ্চল হল। জামাইবাবুর গাড়ির কাছে খানিকটা ব্লাড দেখেছিলুম। বুড়োদাও দেখেছিল। আচ্ছা কর্নেল, এমন তো হতে পারে, ওই জন্তুটাই আনুদাকে…..
সে থেমে গেল। কুঠিবাড়ির দিক থেকে আচমকা একটা চিৎকার শোনা গেল। তীক্ষ্ণ জান্তব চিৎকার। কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। পিউ দ্রুত তাঁর পিঠের কাছে সরে এল। তারপর কাছাকাছি কোথাও কেউ চেরা গলায় আর্তনাদ করে উঠল হে! হে! হে!
কর্নেল কুঠিবাড়ির ফটকের দিকে এগিয়ে গেলেন। পিউ একটু ইতস্তত করে তাঁকে অনুসরণ করল। তারপর দম আটকানো গলায় বলল, কর্নেল! এভাবে যাবেন না। প্লি-ই-জ! জামাইবাবু ঠিক এমনি টেরিফিক ক্র্যাকড় ভয়েস শুনেছিল।
কর্নেল কান করলেন না। সোজা এগিয়ে গেলেন …..
.