০৭.
অস্বস্তি হচ্ছে? কেন? কর্নেল নীলাদ্রি সরকার টেবিলল্যাম্পের সুইচ টিপে ড্রয়ার থেকে একটা আতস কাচ বের করলেন। টেবিলে তাসের মতো সাজানো কয়েকটা রঙিন পোস্টকার্ড সাইজ ছবি। একটা ছবি আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।
বরুণ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, আপনি আমার কথা মন দিয়ে শুনছেন না।
শুনছি। কোম্পানি আপনাকে আমিনগঞ্জে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে যেতে আপনার অস্বস্তি হচ্ছে।
আহা! আমি বলতে চাইছি…
জাস্ট আ মিনিট! কর্নেল ব্যস্তভাবে উঠে বুকশেলফের কাছে গেলেন। একটা বই খুঁজতে খুঁজতে বললেন, আমিনগঞ্জে আমি গেছি। পুরনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউন। কাছেই খনি এলাকা। সচরাচর এ ধরনের জায়গা সত্যিই অনেকের পক্ষে অস্বস্তিকর। বিশেষ করে যাঁরা কেতাদুরস্ত ছিমছাম জীবনযাপন করেন। তা ছাড়া আজকাল ট্রেড ইউনিয়নে দলাদলি হাঙ্গামা লেগেই আছে। অ্যান্ড সো-কড় মাফিয়া লিডারস!
কর্নেল একটা প্রকাণ্ড বই টেনে বের করলেন। একটু হেসে ফের বললেন, একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখুন। নেচারের মধ্যেও মাফিয়া লিডার আছে। টেবিলে যে ছবিগুলো দেখছেন, সেগুলো তাদেরই। নিরীহ ভদ্র প্রজাপতিরা রঙবেরঙের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। আর এরা তাদের মেরে সেই মধু আত্মসাৎ করে। তবে খুব রেয়ার স্পেসিস্। গত অক্টোবরে ক্লিফটনগঞ্জে গিয়ে অন্তত একটাকেও নেটে আটকানোর জন্য কত ফন্দিফিকির করেছিলুম বলার নয়। ভীষণ ধূর্ত। অগত্যা ক্যামেরায় আটকে সন্তুষ্ট থাকতে হল। তা-ও টেলিলেন্সে। পাঁচ সাতমিটার দূর থেকে এরা যেন মানুষের গন্ধ পায়। ভাবতে পারেন?
কর্নেল টেবিলে ফিরে বইটার পাতা ওল্টাতে থাকলেন। বরুণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি ক্লিফটনগঞ্জ গিয়েছিলেন? তা হলে তো জায়গাটা চেনেন।
হ্যাঁ। ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। কর্নেল বইয়ের একটা ছবির সঙ্গে তার ভোলা ছবি মিলিয়ে দেখে বললেন, আমি ভুল করিনি। একই স্পেসিস্। বড়ো রহস্যময় এদের গতিবিধি। আসলে ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জ এলাকাটাই রহস্যময়। গঙ্গার ধারে পুরনো গঞ্জ ছিল। এখন সবাই নতুন টাউনশিপে গিয়ে ভিড় করেছে। ফলে পুরনো বসতি এলাকা সবসময় নিরিবিলি সুনশান। আর ওই কুঠিবাড়ি! আপনি আমিনগঞ্জ থেকে আশাপুরা জংশন টাউনে নিশ্চয় যাবেন। আমিনগঞ্জে আপনার কোম্পানির ফ্যাক্টরি বললেন। আশাপুরায় কী যেন? যাই হোক, পথে ক্লিফটন সায়েবের কুঠিবাড়ির ছাদটা একবার দেখে যাবেন। ছাদে ওঠা যায়। কিন্তু সাবধান! নীচের দিকে বেশি ঝুঁকবেন না। মাথা ঘুরে যেতে পারে।
বরুণ হতাশভাবে বলল, প্রিয় বলেছিল, আপনি নাকি ট্রাবলশুটার?
কর্নেল বই বন্ধ করে বললেন, প্রিয়? কোন প্রিয়?
প্রিয়গোপাল মজুমদার। আপনি আমার কথা একেবারে মন দিয়ে শুনছেন না।
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি কোথায়? তারপর টুপি খুলে টেবিলে রাখলেন। টাক ঝলমলিয়ে উঠল। টেবিলল্যাম্পের সুইচ অফ করে বললেন, হুঁ, আপনি বলছিলেন প্রিয়কে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। কারণ সে নাকি আপনার এক বন্ধুকে খুন করেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এ ব্যাপারে আপনি একজন ট্রাবলশুটার খুঁজতে বেরিয়েছেন কেন?
প্রিয় আমাকে আপনার কথা বলেছিল। আপনার ঠিকানা দিয়েছিল।
কেন? কর্নেল তাঁর শাদা দাড়ি থেকে একটা পোকা বের করে জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন। পোকাটা হঠাৎ ডানা মেলে ফরফর করে উড়ে ঘরে ফিরে এল। কর্নেল দেখলেন, পোকাটা উড়ে গিয়ে দেওয়ালের একটা ছবিতে বসল। তাকিয়ে রইলেন সেদিকে।
বরুণ ঘড়ি দেখে বলল, সরি! আমি হয়তো আপনাকে সব কথা গুছিয়ে বলতে পারিনি। প্রিয় আমাকে বলেছিল, সে কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে গেলে আপনাকে যেন খবর দিই। অফিসে খবরটা শোনার পর তত গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু পরে যখন শুনলাম আনুকে মার্ডার করার চার্জে ওকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে, তখন একটু খটকা লাগল। বাড়ি ফেরার পর মনে পড়ল, প্রিয় আপনার কথা বলেছিল।
কিন্তু আপনি বলছিলেন, আমিনগঞ্জ যেতে আপনার অস্বস্তি হচ্ছে।
আমি আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। মানে, আমার খালি মনে হচ্ছে কী একটা গণ্ডগোল আছে।
ষষ্ঠীচরণ ট্রেতে কফি রেখে গেল। কর্নেল বললেন, কফি খেয়ে নিন। কফি ঝিমিয়ে পড়া নার্ভকে চাঙ্গা করে। নার্ভ চাঙ্গা না হলে মনের কথা গুছিয়ে বলা যায় না। কফির পেয়ালা তিনি বরুণের হাতে তুলে দিলেন।
বরুণ কফিতে চুমুক দিয়ে আড়ষ্টভাবে একটু হাসল। আসলে আমি পড়েছি একটা টাস্ অব ওয়ারের মধ্যে। প্রিয় এবং আনু দুজনেই আমার বন্ধু। মহিলাঘটিত ব্যাপারে দুজনের মধ্যে শত্রুতা ছিল। পরে প্রিয় সেই মহিলাকে বিয়ে করেছে। আনু তারপর কিন্তু কোনও ঝামেলা করতে যায়নি। এদিকে প্রিয় নিরীহ, ভিতু। অবশ্য কোনও-কোনও ব্যাপারে সে অসাধারণ চতুর। কিন্তু মানুষ খুন করা তার পক্ষে অসম্ভব।
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, হুঁ। প্রিয়কে আমি চিনি। তবে একটু-আধটু। ক্লিফটনগঞ্জে তার দাদামশাইয়ের বাড়ি এবং তিনিই আমার বন্ধু। অক্টোবরে কোম্পানির কাজে প্রিয় ওই এলাকায় গিয়েছিল। দাদামশাইয়ের বাড়িতে একরাত্তির ছিল। তখনই আলাপ হয়। কিন্তু সে আমাকে ট্রাবলশুটার বলেছে?
বরুণ মাথাটা একটু নাড়ল।
কর্নেল প্রায় একটা অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, যাই হোক, প্রিয়র ট্রাবল বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনার ট্রাবলটা কী?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্রিয় আনুকে খুন করতেই পারে না। তা ছাড়া..
হুঁ, বলুন! এবার আমি মন দিয়েই শুনছি।
ফিল্মমেকার গণনাথ সেনের কথা আপনাকে বলেছি।
বলেছেন। তিনি লোকেশন দেখতে গিয়ে ছবির শুটিংও শুরু করতে চান। এই তো?
বরুণ নড়ে বসল। ঠিক এখানেই আমার অস্বস্তি হচ্ছে। সত্যি বলতে কি, আনুকে গণাবাবু কতকটা বডিগার্ড হিসেবেই সঙ্গে রাখেন। সেই আনু মারা পড়ল। অথচ উনি ছবির কাজ শুরু করতে চলেছেন। আমার কোম্পানি ওঁর ছবির ফাইন্যান্সার! ভেবে দেখুন ব্যাপারটা।
কর্নেল কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, হয় তো নতুন বডিগার্ড জোগাড় করেছেন। কিন্তু এতে আপনার অস্বস্তির কারণ কী?
বরুণ একটু ইতস্তত করে বলল, সামথিং রং এনিহোয়্যার। বাট আই কান্ট এক্সপ্লেন ইট।
কর্নেল চুরুটকেস থেকে একটি চুরুট বের করে লাইটার জ্বেলে ধরালেন। তখন বরুণ বলল, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড! আমি একটা সিগারেট খেতে চাই।
স্বচ্ছন্দে। কর্নেল চুরুট কেস এগিয়ে দিয়ে বললেন, ইচ্ছে হলে একটা নিতে পারেন। তবে একটু কড়া।
থ্যাংস্। বলে বরুণ নিজের সিগারেট ধরাল। আমাকে আপনি তুমি বললে খুশি হব।
হুঁ, তুমি বললে দূরত্ব কমে যায় এবং অনেক স্পষ্টতা আসে। বলো!
একটা ব্যাপার দেখে আমার অবাক লাগছে, জানেন? বরুণ চাপাস্বরে বলল। প্রিয় কোম্পানির অনেক উপকার করেছে। অনেক সিক্রেট ইনফরমেশন প্রিয়র হাতে আছে। অথচ কোম্পানি এই কেসে তাকে ডিফেন্ড করতে চায় না। ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহনলালজি বললেন, ক্লিফটনগঞ্জে ওর আত্মীয় আছে। তারা দেখবে।
হুঁ। প্রিয়র দাদামশাই অরীন্দ্র বসু পাকা লোক। আমার চেয়ে বয়সে বড়। জীবনে অনেক বেশি পোড় খেয়েছেন। ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। অরীন্দ্রবাবু নাতির ট্রাবলশুটার। আমি নই।
কিন্তু আমি আবার বলছি, সামথিং রং এনিহোয়্যার।
কর্নেল চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। একটু পরে বললেন, আপনাদের আমিনগঞ্জ ফ্যাক্টরিতে কী তৈরি হয়?
বাইসিকল পার্টস্। কোম্পানি দুবাই থেকে আবার আড়াই লাখ পার্টসের অর্ডার পেয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আশাপুরা জংশনে লোডিং করাতেই হবে। না পারলে সব ওয়াগনের বুকিং ক্যান্সেল হয়ে যাবে। আজকাল রেলের ওয়াগন পাওয়াই সমস্যা।
বাই রোড নয় কেন?
ট্রান্সপোর্ট খরচ বেশি পড়বে। মাল যাবে বোম্বেতে। সেখানে দুবাইয়ের এজেন্ট সব মাল চেক করবে। কাজেই ঠিক সময়ে বোম্বেতে পৌঁছুনো দরকার। গত জুন মাসে এজেন্ট চেক করা সত্ত্বেও দুবাই থেকে মাল ফেরত এসেছিল। বিলো দা গ্রেড় বলে নাকি ডেলিভারি নেয়নি ওরা। তাই এবার কোম্পানি খুব সতর্ক।
এজেন্ট চেক করা সত্ত্বেও….কর্নেল চোখ খুললেন। হুঁ, তখনও প্রিয় কি কনসাইনমেন্টের চার্জে ছিল?
ছিল। বরুণ একটু হাসল। কেম্পানির মালিকদের চরিত্র বোঝা যায় না। প্রিয়র চাকরি যাবে ভেলেছিলুম। উল্টে প্রমোশন হল।
রিজেক্টেড মাল কি লোকাল মার্কেটে বিক্রি করা হয়েছিল?
হ্যাঁ, আমি কোম্পানির সেলস প্রমোশন অফিসার। আমিই ট্যাক্টফুলি ওই, রদ্দি জিনিস বেচতে পেরেছিলাম। কিন্তু দেখুন, আমার বেলায় প্রমোশন কেন, একটা এক্সট্রা ইনক্রিমেন্টও জোটেনি।
এবার প্রমোশন হল তোমার।
বরুণ তেতোমুখে বলল, কোথায় প্রমোশন? অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছি। মনে হচ্ছে, একটা অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়াই উচিত ছিল।
কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, না। তুমি ধরে নাও এটা একটা চ্যালেঞ্জ।
আই রিপিট, সামথিং রং এনিহোয়্যার।
তোমার বন্ধুর খুনের ব্যাপারে?
হ্যাঁ, খুনের ব্যাপারে তো বটেই, অন্য কোথাও কী একটা গণ্ডগোল আছে যেন।
কিন্তু তুমি সেটা ধরতে পারছ না। তাই তো?
ঠিক তা-ই।
তুমি কবে যাচ্ছ আমিনগঞ্জ?
প্রথমে যাচ্ছি ক্লিফটনগঞ্জ। আগামীকাল ভোর ছটায় গণনাথ সেনের ফিল্ম ইউনিটের সঙ্গে রওনা হব। দুটো ভ্যান না লিমুজিন, কী যাচ্ছে ওদের। একসঙ্গে যাওয়াই ভাল। কোম্পানি একগাদা টাকা পৌঁছে দিতে বলেছে গণনাথবাবুকে। উনি আছেন ইরিগেশন বাংলোয়। ওঁকে টাকা দিয়ে বাসে আমিনগঞ্জ চলে যাব।
আমিনগঞ্জ ফ্যাক্টরির ম্যানেজার কে?
বনোয়ারিলাল নামে এক ভদ্রলোক। কোম্পানির মালিকদেরই আত্মীয়।
জুন মাসে রদ্দি মাল তৈরির দায়িত্বে উনিই তো ছিলেন?
ছিলেন। আমি ভদ্রলোককে চিনি। একেবারে গোমুখটাইপ। আপনি বিশ্বাস করবেন না। বাইসিলে কোন পার্ট কোথাকার, একেবারে জানেন না বনোয়ারিবাবু। অথচ ভীষণ ফোঁপরদালাল।
প্রোডাকশান-ম্যানেজার আছেন নিশ্চয়?
আছেন। গিরিধারীলাল।
কর্নেল হাসলেন। বড্ড বেশি লাল!
গিরিধারীবাবু কিন্তু হাইলি কোয়ালিফায়েড বাইসিলের ব্যাপারে। বনোয়ারিবাবুর সঙ্গে ওঁর বনিবনা নেই। বনোয়ারিবাবু প্রায়ই ওঁর বিরুদ্ধে হেড অফিসে খারাপ রিপোর্ট পাঠান। বলে বরুণ আবার ঘড়ি দেখল। আটটা বাজে। আমাকে ভোরে উঠতে হবে। গোছগাছের তাড়া আছে। প্রায় দুসপ্তাহ ওই এরিয়ায় থাকতে হবে।
উইশ ইউ গুড লাক।
বরুণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, প্রিয় আপনাকে জানাতে বলেছিল। জানালুম।
তোমার অস্বস্তির কথাও জানালে।
হ্যাঁ। সামথিং রং এনিহোয়্যার। বলে বরুণ দরজার দিকে এগোল।
কর্নেল বললেন, এক মিনিট! আশাপুরায় তো তোমাদের কোম্পানির অফিস আছে?
বরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আছে। গোডাউন, সেলস কাউন্টার, শো-রুমও আছে। ওখান থেকে সারা নর্থ ইন্ডিয়ায় মাল যায় বিভিন্ন মার্কেটে।
বাই এনি চান্স, তুমি কেয়া সেন নামে কোনও মেয়েকে চেনো?
বরুণ তাকাল। একটু পরে আস্তে বলল, এক কেয়া সেনকে চিনতুম।
তোমাদের আশাপুরা অফিসে কেয়া সেন নামে কোনও স্টেনোটাইপিস্ট ছিল কি?
ছিল। ওকে সেপ্টেম্বরে আমিনগঞ্জ থেকে আশাপুরায় বদলি করা হয়েছিল। তারপর নাকি সুইসাইড করে। ব্যক্তিগত ব্যাপার বলেই শুনেছি। প্রেমঘটিত বার্থতা। আপনি কি তার কথাই বলছেন?
সম্ভবত।
বরুণ একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি তাকে চিনতেন নাকি?
নাহ্! কর্নেল চুরুট কামড়ে ধরে বললেন, কাগজে পড়েছিলুম।
আচ্ছা, চলি।
বরুণ চলে গেলে কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! দরজা বন্ধ করে দে।
তারপর আবার টেবিলল্যাম্প জ্বেলে ছবির দিকে ঝুঁকে পড়লেন। ক্লিফটনগঞ্জে অক্টোবরে বেড়াতে গিয়ে এই রাক্ষুসে প্রজাপতি আবিষ্কার করেছিলেন কর্নেল। ক্লিফটনগঞ্জের প্রকৃতিতে অনেক রহস্য আছে। প্রতিবার গিয়ে একেকটি রহস্যের মুখোমুখি হন।
অরীন্দ্রের নাতজামাই বিজয়েন্দু ছিলেন দক্ষ শিকারী। কিন্তু বড় গোঁয়ার মানুষ। সরকারি নিষেধাজ্ঞার পরোয়া করতেন না। বাধা না দিলে দুর্লভ উড্ডাক পাখিটাকে গুলি করে বসতেন। গোঁয়ার্তুমি করে পায়ে হেঁটে মানুষখেকো বাঘ শিকারে গিয়ে মারা পড়েছিলেন বিজয়েন্দু। কুরুডি ফরেস্ট থেকে এসে বাঘটা হানা দিচ্ছিল ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জে। কুঠিবাড়ির জঙ্গলে সে লুকিয়ে থাকত এবং গঙ্গার ঘাটে একলা মানুষ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। আশ্চর্য, সেই মানুষখেকো বাঘ অবশেষে মানুষের তাড়া খেয়ে কুঠিবাড়ির ছাদে উঠেছিল এবং ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল নীচের গভীর দহে। আত্মহত্যাই বলা যায়। দহের জলে। কুঠিবাড়ির দেয়াল ভেঙে অজস্র পাথরের চাই পড়েছে। সেই পাথরের আঘাতেই সম্ভবত বাঘটা মারা পড়েছিল। কিন্তু স্থানীয় লোকে বলে, দহের পেত্নীর সঙ্গে বাঘটার নাকি দেখার মতো একটা লড়াই হয়েছিল। মোহনলাল গণেশলাল অ্যান্ড কোম্পানির আশাপুরা অফিসের স্টেনোটাইপিস্ট কেয়া সেনের শরীর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঘটনার কয়েকদিন পরে কর্নেল ক্লিফটনগঞ্জে গিয়েছিলেন। খাদ বা দহটা নিয়ে এলাকায় অজস্র ভুতুড়ে গল্প চালু আছে। আরও কয়েকটা ক্ষতবিক্ষত শরীরও পাওয়া গেছে অতীতে। একটা মৃত্যুর ফাঁদ যেন। কেয়া সেনের আগে রোজি জেভিয়ার নামে একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েও নাকি ওই ফাঁদে পড়ে জীবন হারায়।
ফাঁদ! চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন কর্নেল। ছবি থেকে মন সরে গেছে ক্লিফটনগঞ্জে। আজ একুশে ডিসেম্বর। এবারকার ক্রিসমাসটা ওখানে গিয়ে কাটালে মন্দ হয় না। অরীন্দ্রের পৌত্রী রানুকে বলে এসেছিলেন, রাক্ষুসে প্রজাপতিটা ধরার প্রোগ্রাম নিয়ে কোনও এক সময়ে হঠাৎ গিয়ে পড়তেও পারেন। তবে আরও দুটো দিন কলকাতায় তাঁর থাকা দরকার। হাথিয়াগড় থেকে আনা অর্কিডটার ফুল ফুটেছে আজ। এই অর্কিডের ফুল শীতে ফোটে। উজ্জ্বল নীল পাপড়ি। পরাগ ঝকঝকে শাদা। অর্কিডটাকে এ সময়ে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। অথচ ওই ফাঁদটা…কালো গভীর অতল মরণফাঁদ তাকেও টানছে। একটু শিউরে উঠলেন কর্নেল।…
পরদিন সকালে কর্নেল তাঁর ছাদের বাগানে ফুলগুলো আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন এবং কাগজে নোট করছেন প্রতিটি রেখা ও রঙের বৈশিষ্ট্য, পিছনে ষষ্ঠীচরণ খুক করে কাশল। কোনও সাক্ষাৎপ্রার্থীর খবর থাকে এই ছোট্ট কাশিতে। ঘুরে চোখ কটমটিয়ে বললেন, আমি ব্যস্ত।
ষষ্ঠী বেজায় গম্ভীর হয়ে বলল, হাতে কালো রঙের একটা কি আছে। লাঠি বলব, না ছড়ি বলব ভেবে পাচ্ছি না। পেল্লায় গোঁফ। নাল চোখ। বললুম, বাবামশাইয়ের নামতে দেরি হবে। হুম হাম করে বললেন, বলো গে, আরেক বাবামশাই এয়েছেন।
তোর ন-ল নিয়ে আপত্তি করলেন না?
ষষ্ঠী হেসে ফেলল। নক্ষ করেননি।
কর্নেল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চাপাস্বরে বললেন, ওই দ্যাখ, তোকে নক্ষ করছেন। কড়া কফি। শিগগির!
ষষ্ঠী চিলেকোঠার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আরেক বাবামশাই’কে দেখতে পেল। সসমে না হোক, সভয়ে একটু তফাতে সরে গেল। কর্নেল বললেন, গত রাত্তিরে সবে ঘুমের টান এসেছে, হঠাৎ দেখলুম আপনি ট্রেনে। নাহ্! বাংকে শুয়ে নয়, সিটে বসে আছেন। রিজার্ভেশন পাননি। তবে ট্রেন লেট করেনি, এটাই আশ্চর্য। যষ্ঠী! কফি!
কফি খাব কী! মাথায় আগুন জ্বলছে। ক্লিফটন ব্যাটাচ্ছেলের সর্বনেশে মরণফাঁদে বডি পড়ে জানা কথা। গভমেন্ট ছাদে ওঠা বন্ধ করে দিক। তা না করে খামোখা…
বোসসায়েবের নাতিকে ধরে টানাটানি।
অরীন্দ্র থমকে দাঁড়ালেন। বুড়ো ট্রাঙ্ককল করেছে তাহলে? আমি ওকে বারণ করেছিলুম। বলেছিলুম, আমি তো যাচ্ছি। প্রিয় ওর হেড অফিসে আর্জেন্ট খবর পাঠাতে বলেছে। কিন্তু বুড়ো তো একটা গবেট। ওকে পাঠানো মানে আবার একটা কেলো। আপনি জানেন? বুড়োই পুলিশকে রক্ত পড়ে থাকার কথা বলে প্রিয়র বিপদটা ডেকে আনল! প্রিয়র শ্যালিকা দময়ন্তীও রক্ত দেখেছিল। সে বলেনি কিছু। হতচ্ছাড়া নির্বোধ মাথামোটা। খালি জানে বালির বস্তায় ঘুসি চালাতে।
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, বুড়ো ট্রাঙ্ককল করেনি। চলুন, নীচে গিয়ে বসা যাক। সত্যি বলতে কী, আই ওয়াজ এক্সপেক্টিং ইউ।
অরীন্দ্র সঙ্গ ধরে বললেন, আপনার সোর্স অব ইনফরমেশন নিশ্চয় নিউজপেপার? ওরা তো তিলকে তাল করতে ওস্তাদ। আমার ফ্যামিলির স্ক্যান্ডাল! খামোকা! তবে ইউ উইল বি ইন্টারেস্টেড। একটা মিস্টিরিয়াস ব্যাপার আমার চোখে পড়েছে। সেজন্যই আপনাকে খবরটা দিতে আসা। গত অক্টোবরে যে মেয়েটির ওই খাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সুইসাইড করা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলুম, সে প্রিয়র কোম্পানির আশাপুরা অফিসে কাজ করত। তার আগে বেলিংটনসায়েবের মেয়ে একইভাবে সুইসাইড় করে। আশ্চর্য ব্যাপার সে-ও আশাপুরায় একই পোস্টে কাজ করত। আবার এই লোকটার সঙ্গেও প্রিয়র কোম্পানির সম্পর্ক ছিল। আমাকে প্রিয় বলেছে তার কোম্পানি ফিল্ম ডাইরেক্টার গণনাথবাবুর বডিগার্ডের মাইনে জোগাত। সেই বডিগার্ড এই লোকটা–অনির্বাণ সোম, যার ডেডবডি পাওয়া গেছে খাদের জলে।
.