পিছনে পায়ের শব্দ – ১৫

১৫.

বিজয়ের সঙ্গে রাণুর সম্পর্ক ভাল ছিল না, কর্নেল জানেন। রাণু তেজী মেয়ে। এদিকে ঘরজামাই বিজয়েন্দুও তেমনই গোঁয়ার এবং জংলি স্বভাবের মানুষ। কর্নেলের মনে হত বন্দুকবাজ বিজয়ে নিজের জীবনকে এক অলীক বাঘের খোঁজে লেলিয়ে দিয়েছে, যে বাঘটি প্রকৃতির খুব গভীরে থেকে গর্জন করে সাড়া দেয়। একমাত্র ছেলে যতীন্দ্রের মৃত্যুর পর অরীন্দ্র পৌত্রীর জন্য এক বন্দুকবাজ যুকে বেছে নিয়েছিলেন, তার গুঢ় কারণ সম্পত্তির তদারকি। বিহার মুলুকের দেহাতে এটাই রেওয়াজ। কিন্তু অরীন্দ্রের কাজে আসেনি বিজয়েন্দু। খনিগুলো একে একে হাতছাড়া হয়ে যায়। জমিজিরেতও রাগ করে বেচে দেন অরীন্দ্র। কোম্পানি আর সরকারি ঋণপত্রে লগ্নী করেন টাকাকড়ি। একমাত্র মেয়ে সুরঞ্জনার বিয়ে কলকাতার এক মোটামুটি সচ্ছল পরিবারে দিয়েছিলেন। প্রিয়গোপালের বাবা জয়গোপাল ছিলেন সরকারি অফিসার। অমায়িক সাদাসিধে মানুষ। অরীন্দ্রের মুখে তার জামাইয়ের খুব প্রশংসা শুনেছেন কর্নেল।

একের পর এক মৃত্যু অরীন্দ্রকে ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে যেন আরও শক্ত মানুষ করে তুলেছে কালক্রমে। কর্নেলকে বলেছিলেন, ওদের আয়ু নিয়েই বেঁচে আছি। ছেলে, বউমা, জামাই, মেয়ে, শেষে নাতজামাই বিজয়েন্দু–ক্রমাগত মৃত্যু। এই বৃদ্ধের মুখ দেখে বোঝা যায় না, কতগুলো ক্ষতচিহ্ন বুকের ভেতর রয়ে গেছে।

বছর তিনেক আগে কুরুডি বনবাংলোয় থাকার সময় বিজয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কর্নেলের। বিজয়েন্দু তাকে নিয়ে আসে এ বাড়িতে। অরীন্দ্রের সঙ্গে ভাব জমে ওঠে কর্নেলের। বন্ধুত্ব হতে দেরি হয়নি। তবে বিজয়েন্দু ছিল অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। জঙ্গলে সবসময় সে বাঘ দেখত এবং ব্যাপারটা তার একটা অবসেসনে পরিণত হয়েছিল। একবার একটা ভালুককে বাঘ ভেবে গুলি করল একেবারে দিনদুপুরে। কর্নেল যখন বললেন, কুরুডি জঙ্গলের বাঘগুলো কালো রঙের কি না, বিজয়ে চিন্তিতমুখে বলল, কিছু বলা যায় না। এবং তারপর মরা ভালুকটাকে দেখে খুব অবাক হয়ে বলল, আমি তো এটাকে বাঘই দেখছিলুম! কেন এটা ভালুক হয়ে গেল বলুন তো?

পরে ঘটনাটা শুনে অরীন্দ্র হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ওর মগজে বাঘ ঢুকে সবসময় হালুম হালুম করছে।

পিউ বলছিল, রাণুদির নামে স্ক্যান্ডাল রটেছিল। রটতেই পারে। বনচর এবং প্রায়-জংলি স্বামীর সঙ্গে তার মনের মিল থাকা সহজ ব্যাপার নয়। কর্নেল লক্ষ করতেন, বাড়ি ফিরে যতক্ষণ বাড়িতে থাকত বিজয়েন্দু, ততক্ষণ সে তার ট্রফিতে ঠাসা ঘরটাতে কাটাত। ঘরভর্তি স্টাফড় জন্তু-জানোয়ার। আলমারিতে কয়েকটা রাইফেল আর শটগান। নতুন ধরনের কোনও রাইফেলের খবর পেলেই সে কলকাতা চলে যেত। শিকারি হিসেবে খ্যাতি থাকায় আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে তার অসুবিধে ছিল না। তা ছাড়া বিহার মুলুকে আগ্নেয়াস্ত্রের ছড়াছড়ি লাইসেন্সের তোয়াক্কা করে না কেউ। বিজয়েন্দুর অত আগ্নেয়াস্ত্রের সবগুলোই লাইসেন্স করা কি না, সেটা বলা কঠিন। অরীন্দ্র বসু এলাকায় ‘বোসসায়েব’ এবং পয়সাওয়ালা মানুষ বলে পরিচিত। পুলিশ তার বাড়ি সার্চ করেনি। শুধু সাবর্ণীকে জেরা করে চলে গেছে। কিন্তু এবার নাকি সি আই ডি তদন্তে নেমেছে। অরীন্দ্রকে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। যদি বিজয়ের কোনও চোরা আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, উটকো ঝামেলা বাধবে। অবশ্য অরীন্দ্র বিচক্ষণ মানুষ।…..

আমিনগঞ্জে পৌঁছুতে প্রায় একঘণ্টা লাগল। বাসটা সারাপথ থামতে থামতে এসেছে। তার ওপর ভিড়। কর্নেল ঘড়ি দেখলেন, তিনটে বাজে। সাইকেল রিকশো করে বাঙালি পাড়ায় অনেক খুঁজে বাড়িটায় পৌঁছুলেন। এক প্রৌঢ়া। মহিলা কর্নেলকে দেখে একটু ভড়কে গেলেন প্রথমে। তারপর কর্নেলের অমায়িক ভাবভঙ্গি দেখে একটু আশ্বস্ত হলেন। তাকে বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। বললেন, আপনি কোথা থেকে আসছেন?

 কর্নেল তাকে নিজের নেমকার্ড দিলেন। বললেন, আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। আপনি কি কেয়ার মা?

অমনি ভদ্রমহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। সে কান্না আর থামতেই চায় না। কর্নেল অপ্রস্তুত।

শেষে অনেক সান্ত্বনাবাণী আওড়ে তাকে একটু শান্ত করলেন কর্নেল। ভদ্রমহিলা চোখ মুছে ভাঙা গলায় বললেন, আমি কেয়ার পিসিমা। ছোটবেলায় ওর বাবা-মা মারা যায়। আমরা ওকে কলকাতা থেকে এখানে এনে মানুষ করেছিলুম। ওর পিসেমশাই যে-কোম্পানিতে কাজ করেন, সেই কোম্পানিতে চাকরিও জুটিয়ে দিলেন। তারপর হঠাৎ আশাপুরায় বদলি করল। পুজোর ক’দিন আগে খবর এল অ্যাকসিডেন্ট করেছে কেয়া।

অ্যাকসিডেন্ট?

হ্যাঁ। পুলিশ তাই বলেছিল। ক্লিফটনগঞ্জে একটা পুরনো কুঠিবাড়ি আছে। সেখানে কার সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল। ছাদ থেকে পা হড়কে নীচের খাদে পড়ে যায়। ওর পিসেমশাই গিয়েছিলেন। কেয়ার পিসিমা কার্ডটা ফের খুঁটিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি মিলিটারি থেকে আসছেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

আমি একজন রিটায়ার্ড কর্নেল। কেয়াকে আমি চিনতুম।

চিনবেন বৈকি। খুব আলাপী মেয়ে ছিল। কিন্তু..

কর্নেল দ্রুত বললেন, আশাপুরায় আলাপ হয়েছিল। গতকাল কলকাতা থেকে এসে খবরটা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। তাই খোঁজ নিতে এলুম। কর্নেল মুখে দুঃখের ছাপ এনে বললেন, কিন্তু আমি তো শুনে এলুম কেয়া নাকি সুইসাইড করেছিল?

কেয়ার পিসিমা একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, কত কথা রটে! মানুষের মুখ। পুলিশও প্রথমে বলেছিল সুইসাইড। শেষে বলল, না। আকসিডেন্ট। সুইসাইড করলে কিছু লিখে রেখে যেত। তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।

আপনারা গিয়েছিলেন নিশ্চয়?

কেয়ার পিসেমশাই গিয়েছিলেন। আমার তখন প্রচণ্ড জ্বর। সে যা দিন গেছে। বলার নয়।

উনি কি এখন অফিসে?

হ্যাঁ। ওঁর কাছে গেলে সব শুনতে পাবেন। বলে কেয়ার পিসিমা হঠাৎ ব্যস্ত হলেন। কিন্তু উনি তো এখন কারখানার ভেতরে। দেখা করতে কি দেবে? খুব কড়া নিয়ম ওঁদের। বরং আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। গরিবের বাড়ি পায়ের ধুলো দিয়েছেন আপনার মতো মিলিটারি অফিসার। একটু চাফা করে দিই। চারটের মধ্যে উনি এসে যাবেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, নাহ্। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি আপনার কাছে একটা কথা জানতে চাই। কেয়ার কি সুইসাইড করার কোনও কারণ ছিল? জাস্ট কথার কথা। জানতে ইচ্ছে করছে।

কেয়ার পিসিমা মাথা নাড়লেন। অসম্ভব কথা। কেন সুইসাইড করবে? হাসিখুশি মেয়ে। ভাল মাইনে পেত। এক পয়সা বাজে খরচ করত না। তেমন শৌখিন মেয়ে তো ছিল না। সাদাসিধে থাকত। আপনি তো দেখেছেন। আপনিই বলুন কর্নেল সায়েব! জানেন? ওর এক দূর সম্পর্কের দাদা সিনেমা করে। সে ওকে সিনেমায় নামাতে চেয়েছিল। নামেনি। বলত, সিনেমায় নামলে নষ্ট হয়ে যাবে। তা হলেই বুঝুন!

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন, আচ্ছা, কেয়ার কোনও নোটবই, ডায়েরি বা চিঠি কিছু কি আছে? আমার দেখতে ইচ্ছে করছে। আহা, বড় ভাল মেয়ে ছিল। অন্তত স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ওর একটা কিছু নিয়ে যেতে চাই। জানেন? আমার এই একটা সেন্টিমেন্ট আছে। খুলেই বলি, আমার ঠিক কেয়ার মতোই একটি মেয়ে ছিল। সে-ও অকালে ঝরে গেছে। কেয়াকে দেখেই মনে হয়েছিল, সে-ই যেন পুনর্জন্মে কেয়া হয়ে ফিরে এসেছে।…বলে কর্নেল একটা আবেগে ঠাসা কাহিনী বুনলেন। এতে কাজ হল।

কেয়ার পিসিমা সমবেদনা জানিয়ে একটু ইতস্তত করার পর বললেন, দেখাচ্ছি। বলে তখনই ভেতরে চলে গেলেন। একটু পরে একটা কিটব্যাগ নিয়ে। এলেন। বললেন, দেখুন আপনি। আমি চা করে আনি। কত ভাগ্যে আপনার মতো একজন মানুষ এসেছেন।

কিটব্যাগটা দামী এবং বিদেশী। ভেতরে এলোমেলো ঠাসা কয়েকটা ইংরেজি পত্রিকা, খবরের কাগজও। দুটো ডায়রি বই। দুটোই মোহনলাল গণেশলাল। অ্যান্ড কোম্পানির তলায় কয়েকটা বিদেশী প্রসাধনের কৌটো। বাহ্, কেয়া সাদাসিধে ছিল বলা যাবে না। কিন্তু এই প্রসাধনীগুলো কি তার কোনও প্রেমিকের উপহার? একটা ডায়রি বইয়ে কোনও আঁচড় পড়েনি। অন্যটাতে রোজির মতোই টাকাকড়ির হিসেব লেখা। কিন্তু টাকার অঙ্কটা রোজির তুলনায় বেশি। এ থেকে কোনও সূত্র পাওয়া কঠিন, যে-সূত্র খুঁজছেন। রোজির মতো কোনও রহস্যময় চিঠি নেই কারও। কিংবা আছে–অন্য কোথাও? বেশি এগোনোয় ঝুঁকি আছে। আপাতত কেয়ার চরিত্রের একটা আভাস তার দরকার। কিটব্যাগের একদিকের চেন খুললে একতাড়া চিঠি বেরুল। ডাকে আসা চিঠি। বেশিরভাগই পিসিমা-পিসেমশাইয়ের লেখা। একটা চিঠিতে কেয়াকে টাকা পাঠানোর তাড়া দিয়েছেন পিসেমশাই। বাড়ি মেরামতের টাকা পাঠাতে দেরি হচ্ছে কেন? দ্রুত চিঠিগুলো দেখে নিলেন কর্নেল। কোনও প্রেমপত্র নেই কারও। মনে পড়ল, বরুণ বলেছিল, ব্যর্থ প্রেমের জন্য কেয়া সেন নাকি আত্মহত্যা করেছিল–অন্তত এটাই বরুণ শুনেছিল। কিন্তু সেই প্রেমের কোনও সূত্র রেখে যায়নি কেয়া। নাকি নষ্ট করা হয়েছে? তবে তার চরিত্রের আভাস ফুটে উঠল কর্নেলের সামনে। বিলাসী, কিন্তু হিসেবি স্বভাবের মেয়ে ছিল কেয়া সেন। একটা সুন্দর গার্হস্থ্য জীবনের স্বপ্নও যেন ছিল। কর্নেল আবার চিঠিগুলো একটার পর একটা দেখতে থাকলেন। হঠাৎ একটা চিঠি দেখে একটু অবাক হলেন। সেটা জ্যাকেটের ভেতর চালান করে নিলেন। সত্য জিনিসটা সত্যিই বাজে জিনিসের মধ্যে লুকিয়ে থাকে।

ভাঁজ করা খবরের কাগজগুলো খুলে বিজ্ঞাপনে ডটপেনের চিহ্ন দেখে বুঝতে পারলেন, কেয়া অন্যত্র চাকরি খুঁজছিল। কেন? কাগজগুলোর তারিখ গত সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরের। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তার মৃত্যু। আত্মহত্যা, দুর্ঘটনা, অথবা অরীন্দ্রের বিশ্বাস অনুযায়ী হত্যা। কোনটা সত্য? সত্যকে জানতে হলে নানাদিক থেকে বাজিয়ে দেখতে হয়।

একটু অন্যমনস্ক হলেন কর্নেল। হত্যা ধরে নিয়েই তো তিনি সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছেন। রোজিকে কেউ টাকা দেওয়ার ছলে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল, তা যদি সত্য হয়, তাহলে রোজির জায়গায় কোম্পানির পরবর্তী স্টেনো-টাইপিস্ট কেয়ার একইভাবে মৃত্যু হত্যা নয় কেন? এর পরের প্রশ্নটা হল, সব হত্যার পেছনে একটা মোটিভ থাকে। এখানে মোটিভটা কী? চিঠিটা কি কোনও মোটিভের আভাস দিচ্ছে?

কেয়ার পিসিমা এলেন একটা ট্রে নিয়ে। সুন্দর কাপ-প্লেট, একটা প্লেটে সন্দেশ, আর একটায় চানাচুর। ধরা গলায় বললেন, কেয়ার পছন্দ করে কেনা কাপ-প্লেট, কর্নেল সায়েব!

কর্নেল রুমাল বের করে চোখ মোছার ভঙ্গি করলেন এবং ফোঁস করে একটি দীর্ঘশ্বাসও ছাড়লেন। তিনি চা-খাওয়া পছন্দ করেন না। কফিই তার প্রিয় পানীয়। কিন্তু এ মুহূর্তে উষ্ণ কোনও পানীয়ের দরকার ছিল। সন্দেশ সবিনয়ে সরিয়ে রেখে কয়েকটা চানাচুর আলতো হাতে তুলে নিলেন। চিবুতে চিবুতে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, আশাপুরায় কেয়ার অফিসের ম্যানেজার শর্মাজিকে আপনি চেনেন?

কেয়ার পিসেমশাই চিনতে পারেন। আপনি কিন্তু সন্দেশ খেলেন না কর্নেল সায়েব!

কর্নেল একটু হাসলেন। এ বয়সে সন্দেশ খাওয়া মানা। চা-ও মানা। তবে কেয়ার কেনা কাপে চা দিয়েছেন। খাচ্ছি। তো দেখুন, আমার একটু তাড়া আছে। চারটের বাস ধরে ক্লিফটনগঞ্জ ফিরতে হবে। আমার অনুরোধ, আমার মেয়ের একটা স্মৃতিচিহ্ন যদি নিয়ে যেতে দেন, খুশি হব।

নিন না। আর কী হবে ওসব নিয়ে? আপনার যেটা ইচ্ছে, নিন।

কর্নেল হিসেব লেখা ডায়রিটা নিয়ে বললেন, কেয়ার আর কোনও জিনিস ছিল না?

ছিল। সুটকেস, জামাকাপড়, বিছানাপত্তর। আশাপুরা থেকে উনি কিছু কিছু জিনিস নিয়ে এসেছিলেন। সেগুলো আমরা রাখিনি। গরিব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিয়েছি।

স্যুটকেসটাও?

কেয়ার পিসিমা শুধু বললেন, হুঁউ। কিন্তু মুখ দেখে কর্নেলের মনে হল, কথাটা সত্য নয়। তবে এর বেশি এগোনো ঠিক নয়। নিজের চেহারা, হাবভাব এবং নেমকার্ড দিয়ে সাদাসিধে এক মহিলাকে যথেষ্ট করায়ত্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু স্যুটকেসে কি কোনও সূত্র ছিল, এটাই প্রশ্ন।

কর্নেল উঠে পড়লেন। বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। দেখি, যদি সুযোগ পাই, কেয়ার পিসেমশাইকে মিট করে যাব। ওঁর কোম্পানির অফিসটা কি বেশি দূরে?

কেয়ার পিসিমা কর্নেলকে বিদায় দিতে বেরিয়ে বললেন, তা একটু দূরে। আপনি আর একটু বসলে ওঁর দেখা পেতেন। বসলেন না। তবে একটা অটোরিকশো করে নেবেন বরং। আপনার মতো মানুষকে দেখা করতে দেবে না? আপনি মিলিটারি অফিসার। কার্ড দেখালেই দেবে।…

বড় রাস্তার মোড়ে একটা অটোরিকশা পাওয়া গেল। মোহনলাল গণেশলাল অ্যান্ড কোম্পানির সাইকেল কারখানাটি বেশ বড়। গেটে তাগড়াই চেহারার সিকিউরিটি গার্ড আছে দুজন। গেটের লাগোয়া সিকিউরিটি অফিস। কর্নেল তার নেমকার্ড দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, ম্যানেজার মিঃ বনোয়ারিলালের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

সিকিউরিটি অফিসার প্রাক্তন ডিফেন্সকর্মী ঝটপট সেলাম ঠুকে ফেললেন এবং ফোনে কথা বললেন। এরপর বনোয়ারিলালের সঙ্গে দেখা করতে অসুবিধে হল না। কারখানাটি ভেতর দিকে। সামনে একতলা কয়েকটা ঘরের আড়াল। এগুলো অফিস ঘর এবং সুদৃশ্য, ছিমছাম। কিন্তু কিছু সেকেলে আদলও চোখে পড়ে। বনোয়ারিলাল সম্পর্কে বরুণের কাছে যেমনটি শুনেছিলেন, তেমনটি নন। মোটাসোটা, টাই-স্যুট পরা অমায়িক চেহারার ভদ্রলোক। যেন কত দিনের পরিচিত, এমন ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। দিব্যি ইংরেজিতে কথাবার্তাও বলতে পারেন। কর্নেলকে বসিয়ে জানতে চাইলেন, হট না কোল্ড? তারপর বিদেশী সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন।

ধন্যবাদ মিঃ লাল! কর্নেল চুরুট বের করে ধরালেন।

 বনোয়ারি বললেন, বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

আমার শ’তিনেক রেসের সাইকেল দরকার। আমার একটা খেলাধুলোর ক্লাব আছে। তাই…

বনোয়ারিলাল হাসলেন। এটা কারখানা। দুঃখিত কর্নেল সরকার। এখান থেকে সরাসরি আমরা কোনও অর্ডার নিই না। এজন্য আপনাকে কষ্ট করে আশাপুরায় যেতে হবে। ওখানে আমাদের সেলস কাউন্টার। ঠিক আছে। আমি ওখানে ফোনে বলে দিচ্ছি। আপনার অসুবিধে হবে না।

দেখুন, আপনার কাছে আসার উদ্দেশ্য, এক্সপোর্ট কোয়ালিটির সাইকেল মানে, যেগুলো বিদেশে বাতিল হয়ে ফিরে আসে…আমি শুনেছি, সেগুলো আপনারা বিক্রি করেন!

বনোয়ারিলালের হা হা হাসিতে কর্নেল থেমে গেলেন। বনোয়ারিলাল বললেন, শুনেছেন। তবে সঠিক শোনেননি। হাজার-হাজার সাইকেলের মধ্যে বড় জোর বিশ-পঁচিশটা কখনও-কখনও বাতিল করে বিদেশি কোম্পানি। এটা সব রফতানিতেই ঘটে থাকে। বোম্বেতে ওদের এজেন্ট কোয়ালিটি টেস্ট করে পাস করল। কিন্তু তাতে কী? মাল যখন পৌঁছুল, তখন হ্যান্ডলিঙে কিছু মালের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে দেখা গেল। স্বাভাবিক ব্যাপার। সেগুলো ফেরত আসে এবং স্থানীয় বাজারে আমরা বেচি।

শুনলুম, কয়েক মাস আগে অনেক এক্সপোর্ট কোয়ালিটির সাইকেল আপনারা বিক্রি করেছেন?

মাত্র শ’খানেক। হ্যান্ডলিঙে একটু-আধটু ড্যামেজ হয়েছিল, এই মাত্র!

 সেগুলো তো মেরামত করেই বেচতে হয়েছে?

হ্যাঁ। আবার কারখানায় এনে পার্ট বাই পার্ট খুলে মেরামত করে তবে বেচেছি।

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, আপনাদের স্থানীয় বাজারে বিক্রির সাইকেল আমি দেখেছি। আমাদের পক্ষে তত কাজের হবে না। রেসের সাইকেল…।

বনোয়ারিলাল তার কথার ওপর বললেন, হ্যাঁ। স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য রেসের সাইকেলও আমরা তৈরি করি। আপনি আশাপুরায় পেয়ে যাবেন। দরদামে সুবিধে করেই দেওয়া হবে।

কিন্তু আপনাদের এক্সপোর্ট কোয়ালিটির সাইকেল সত্যি ভাল। আমরা সেজন্য অপেক্ষা করতে রাজি আছি।

বনোয়ারিলাল ফের তুমুল হেসে বললেন, তা হলে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই। এবার আমরা দুবাই থেকে অর্ডার পেয়েছি। শেখরা বড্ড খুঁতখুঁতে। তাই আমরা এবার খুব সতর্ক। লোডিং আনলোডিংয়ের জন্য নতুন কোম্পানির সঙ্গে কনট্র্যাক্ট করেছি। সরকারের রফতানিমুখী নীতি যথেষ্ট উদার। আমরা চাই না, ভারতের ভাবমূর্তি বিদেশে ক্ষুণ্ণ হোক।

বনোয়ারিলালের বক্তৃতার মাঝামাঝি কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বরুণের দুর্ঘটনার কথা বলতে গিয়ে সংযত হলেন। বললেন, আপনাদের আশাপুরা সেলস অফিসে একটি বাঙালি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কেয়া সেন। তার কাছেই খবর পেয়েছিলুম…

সে তো দুর্ঘটনায় মারা গেছে। খুব দুঃখের ব্যাপার।

 মারা গেছে? সেকি!

বনোয়ারি দুঃখিতভাবে বললেন, বন্ধুদের সঙ্গে ক্লিফটনগঞ্জে পিকনিক করতে এসেছিল গত অক্টোবরে। ওখানে একটা পুরনো বাড়ি আছে গঙ্গার ধারে। পাথরের বাড়ি। তার নীচে খাদ। ছাদ থেকে পা হড়কে নীচে পড়ে যায়।

শুনে দুঃখিত হলুম। কর্নেল একটু ইতস্তত করে বললেন, তার কোনও আত্মীয় আপনার এই কারখানায় চাকরি করেন শুনেছিলুম?

হ্যাঁ। নগেনবাবু।

তাকে এখন কোথায় পাব বলতে পারেন? একটু সমবেদনা জানিয়ে যেতে চাই। কেয়া আমাকে দাদু বলে ডাকত। একটা স্নেহের সম্পর্ক ছিল ওর সঙ্গে।

ঘড়ি দেখে বনোয়ারিলাল বললেন, তিনটেয় শিফট ডিউটি শেষ। চলে গেছেন। এখন ওঁকে বাড়িতে পেতে পারেন। এক মিনিট ঠিকানা দিচ্ছি।

রাস্তায় একটু দাঁড়িয়ে কর্নেল ভাবলেন নগেনবাবুর বাড়ি আবার যাবেন কি না। কিন্তু আর গিয়ে নতুন কিছু জানার চান্স কতটুকু? তা ছাড়া লোকটি কেমন এবং কীভাবে তাকে নেবেন, বলা যায় না। একটা বড়ো ব্যাপার জানা হয়ে গেছে। আপাতত এটাই যথেষ্ট। কর্নেল বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার জন্য একটা অটোরিকশোর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

সন্ধ্যার মুখে বাসে আর তত ভিড় নেই। আজ শীতটা বেড়ে গেছে। সাড়ে পাঁচটায় গাঢ় ধূসরতা চারদিকে। টাউনশিপ থেকে সাইকেল রিকশো করে ওল্ড ক্লিফটনগঞ্জের দিকে আসছেন, রাস্তায় বেলিংটন জেভিয়ারকে দেখতে পেলেন। রিকশা থামিয়ে সেখানেই নামলেন। ডাকলেন, মিঃ জেভিয়ার!

জেভিয়ার তাঁকে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, আই মাস্ট নট টক টু ইউ। গো অ্যাওয়ে! তারপর রাস্তার ধারে ঝোপের দিকে এগিয়ে গেলেন। হাতে সেই কাটারি।

কর্নেল বললেন, নাও দিস ইজ অ্যাবাউট মিস কেয়া সেন, মিঃ জেভিয়ার।

 গো অ্যাওয়ে! কিচনি হামকো মানা কিয়ি। আই মাস্ট নট টক টু ইউ।

 কেয়া সেন ওয়াজ অলসো মার্ডার্ড অ্যান্ড দা মার্ডারার ওয়াজ দা সেম ম্যান। মিঃ জেভিয়ার, রোজি অ্যান্ড কেয়া, বোথ অব দেম নিউ অ্যাবাউট সাম সিক্রেট ডিল অব দেয়ার কোম্পানি।

জেভিয়ার মুখ ঘোরালেন। হিংস্র জন্তুর মতো মুখ। হিসহিস শব্দে বললেন, অ্যান্ড নাও ইওর টার্ম, ম্যান! কিচনি হমকো বোলি।

বেলিংটন জেভিয়ার ঝোপের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কর্নেল একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর হাঁটতে থাকলেন। জেভিয়ার এখনও টের পাননি, রোজির ঘরে চোর ঢুকেছিল।

চারুভবন এ-সন্ধ্যায় প্রচণ্ড স্তব্ধ। সাত্যকির ঘর থেকে মিউজিক বা টিভির কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ভগীরথের কাছে জানা গেল, অরীন্দ্র এখনও ফেরেননি আশাপুরা থেকে। রাণুর শরীর খারাপ। শুয়ে আছে। সাত্যকি পিয়ালিদের বাড়ি গেছে। সুশীলার কাছে কর্নেলের ঘরের চাবি। খবর পেয়ে সে ছুটে এল। তার মুখও গম্ভীর। বলল, আভি কফি লেকে আতি কর্নিলসাব। রাণুদিদির বুখার হয়েছে। রোজ-রোজ বিহানমে গঙ্গা আস্নান!

সে চলে যাওয়ার একটু পরে পিউ এল। বলল, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? থাকলে পরে এদের কীর্তিকলাপ স্বচক্ষে দেখতেন যত্তো সব ওয়াইল্ড অ্যানিমাল! বুড়োদা নিজের দিদিকে ঘুসি মারল! হরিবল! আমি আর পিয়ালি ওকে আটকাতে পারছিলুম না। শেষে ভগীরথদা এসে ট্যাকল করল। আই হেট সাত্যকি! হি ইজ আ ব্রুট।

কর্নেল আস্তে বললেন, ঝগড়াটা কী নিয়ে?

পিউ নাকের ডগা কুঁচকে বলল, কে জানে! দেয়ার ইজ সামথিং মিস্টিরিয়াস।….

.