পার্লামেন্টের ঘড়ি

বিলাতের যে শাসন-সভা, যেখানে সে দেশের খরচপত্র আইনকানুন ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতি নানা ব্যাপারের আলোচনা ও ব্যবস্থা করা হয়—তার নাম পার্লামেন্ট। পার্লামেন্টের বাড়ির দুই মাথায় দুই চূড়া— তারই একটার গায়ে মাটি হইতে প্রায় ১২৫ হাত উঁচুতে পার্লামেন্টের ঘড়ি বসান। ঘড়িটা এত বড় যে রাস্তার লোকে এক মাইল দূর হইতে সেই ঘড়ি দেখিয়া অনায়াসে সময় ঠিক করিতে পারে।
রাস্তা হইতেই প্রকাণ্ড ঘড়িটা চোখে পড়ে, কিন্তু বাস্তবিক ঘড়িটা যে কত বড় তাহা বুঝিতে হইলে একটিবার তাহার ভিতরে ঢোকা দরকার। একটি লোহার প্যাঁচান সিঁড়ি ঘুরিয়া ঘড়ির কামরায় ঢুকিতে হয়। ঘড়ির চারিদিকে চারিটি মুখ, এক একটি মুখে এক একটি ঘর, তাতে দোতালা বাড়ির মতো উঁচু ঘষা কাচের জানালা। জানালার বাহিরে ঘড়ির কাঁটা—এক একটা সাড়ে সাত হাত লম্বা। রাত্রে সেই ঘরগুলির মধ্যে জানালার পিছনে অনেকগুলি বড় বড় গ্যাসের পাতি জ্বলাইয়া রাখে, তাহাতে ঘড়ির সমস্ত মুখটা আলো হইয়া উঠে। কিন্তু এই ঘরের মধ্যে ঘড়ির কল-কব্জা কিছুই দেখা যায় না। ঘড়ির যে ঘণ্টা বাজে তাহাও এখান হইতে দেখিবার যো নাই—সে সমস্ত ভিতরের আর-একটা ঘরের মধ্যে। ঘণ্টাটি একটি দেখিবার জিনিস। গম্বুজের মতো প্রকাণ্ড কাঁসার ঘণ্টা, তার ওজন সাড়ে তিনশত মণেরও বেশি। প্রথম যখন ঘণ্টাটি তৈয়ারি হইয়াছিল তখন কিছুকাল ব্যবহারের পর সেটা ফাটিয়া যায়; তখন সেটাকে আবার ঢালাই করিয়া নূতন করিয়া গড়া হইল। কিছুদিন পরে নূতন ঘণ্টাতেও ফাটল দেখা দিল। তারপর বছর তিনেক ঘণ্টা বাজান বন্ধ ছিল; পরে হাতুড়িটা বদলাইয়া একটা হালকা, অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ মণ ওজনের হাতুড়ি দেওয়ায় আর ফাটল বাড়িতে পারে নাই। এই বড় ঘণ্টাটি ছাড়া আরও চারিটি ছোট ছোট ঘণ্টা আছে, সেগুলি পনের মিনিট অন্তর টুং টাং করিয়া বাজে। ‘ছোট’ বলিলাম বটে কিন্তু এগুলির এক একটির ওজন ৩০ হইতে ১০০ মণ। ঘড়ির পেন্ডুলামটি প্রায় সাড়ে আট হাত লম্বা, দোলকটির ওজন প্রায় ৪ মণ।
ঘড়িতে দম দেওয়া এক প্রকাণ্ড ব্যাপার। প্রতি সোম বুধ ও শুক্রবার দুইজন লোককে ক্রমাগত কয় ঘণ্টা পরিশ্রম করিয়া এই কাজটি করিতে হয়। ছোট ছোট ঘণ্টাগুলি যতক্ষণ বাজিতে থাকে, সেই ফাঁকে তাহারা একটু বিশ্রাম করিয়া নেয়, আবার মিনিট পনের চাবি ঘুরায়—এইরকম করিয়া সারাটা বিকাল ধরিয়া দম দেওয়া হয়। এই সমস্ত কলকারখানার উপরে, একেবারে চূড়ার আগায় একটা প্রকাণ্ড বাতি। এই বাতি যখন দপ্‌ করিয়া জ্বলিয়া উঠে তখন লোকে বুঝিতে পারে, পার্লামেন্টের সভা বসিয়াছে। চূড়ার কাছে উঠিলে আর একটা আশ্চর্য জিনিস দেখা যায়—ঘড়ির কল-কব্জার অনেক নিচে একটা জায়গায় দিনরাত একটা প্রকাণ্ড চুল্লি জ্বলিতেছে। চুল্লির আঁচে ঘড়ির ভিতরটা সকল সময় সমানভাবে গরম থাকে; কোথাও এলোমেলো ঠাণ্ডা লাগিয়া কলকব্জা বিগড়াইতে পারে না।
এত বড় ঘড়ি, ইহার জন্য খরচও হইয়াছে কম নয়। ঘড়ির চারটি মুখের জানালায় লেখা কাঁটা ইত্যাদি শুদ্ধ প্রায় আশি হাজার টাকা লাগিয়াছে। ঘণ্টাগুলির দাম প্রায় লক্ষ টাকা—কলকব্জায় প্রায় ষাট হাজার টাকা। সমস্ত ঘড়িটার দাম প্রায় সওয়া তিন লক্ষ টাকা।