পাথরের সিনেমা

পাথরের সিনেমা*

আরও অনেক ডাকাডাকির পরেও জয়ন্তের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না৷

ততক্ষণে গোলমাল শুনে অমলবাবুর দ্বারবান হাতি সিং ও দলের অন্যান্য চাকরবাকররাও এসে পড়েছে৷ সন্ধ্যার আবির্ভাবেও অন্ধকার সেখানে গাঢ় হতে পারলে না, কারণ কয়েকটা পেট্রলের লন্ঠনের প্রখর আলোকে চারিদিক সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ কিন্তু বনজঙ্গল ঠেঙিয়েও শত্রু বা মিত্র জনপ্রাণীরও সঙ্গে সাক্ষাৎ হল না৷

সুন্দরবাবু হতাশভাবে কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘হায় হায় মগের মুল্লুকে এসে জয়ন্ত শেষটা প্রাণ হারাল!’

মানিক মাথা নেড়ে বললে, ‘আমার বন্ধু এত সহজে কাবু হবার ছেলে নয়৷ জয়ন্ত হয়তো এখনি ফিরে আসবে!’

অমলবাবু বললেন, ‘আমার তা মন হয় না৷ দু-দু-বার বন্দুকের আওয়াজ হল কেন? ওখানে রক্তে মাটি ভিজে কেন?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! ওখানে জয়ন্তের টুপিটা গড়াগড়ি যাচ্ছে কেন?’

মানিক বললে, ‘দেখা যাক, জয়ন্তের পদ্ধতিতেই কোনো রহস্য আবিষ্কার করা যায় কি না!’

যেখানে টুপিটা পড়েছিল সেইখানে গিয়ে সে আগে টুপিটা তুলে নিলে৷

পরীক্ষা করতে গিয়ে প্রথমেই সভয়ে দেখলে, টুপির দু-দিকে দুটো ফুটো-বন্দুকের গুলি একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে এবং টুপির ভিতরেও রক্তের দাগ! সেখানকার মাটির উপরেও রক্তের দাগ দেখা গেল!

মানিক নিরাশ কন্ঠে বললে, ‘আর কিছু পরীক্ষা করা মিছে! জয়ন্তের মাথায় লেগেছে শত্রুর গুলি৷’

অমলবাবু বললেন, ‘তাহলে গুলি খেয়ে জয়ন্তবাবু কি পালিয়ে গিয়েছেন?’

-‘জয়ন্তের মতন সাহসী লোক খুব কম দেখা যায়৷ সে পালাবে বলে মনে হয় না৷’

অমলবাবু বললেন, ‘দশ জন সশস্ত্র লোক এক জনকে যখন হঠাৎ আক্রমন করে, তখন যে পালাতে রাজি হয় না তাকে সাহসী না বলে নির্বোধ আর গোঁয়ার বলাই উচিত৷ জয়ন্তবাবু নিশ্চয়ই এ শ্রেণির লোক নন৷’

-‘সেকথা সত্যি৷ কিন্তু তাহলেও এতক্ষণে সে ফিরে আসত৷’

-‘এখানে জয়ন্তবাবুও নেই, শত্রুরাও নেই৷ যদি তারা তাঁর পিছনে পিছনে ছুটে থাকে?’

-‘অসম্ভব নয়৷ কিন্তু জয়ন্তকে ধরেও শত্রুরা বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারবে না৷ কারণ সেই সোনার চাকতিখানা তার কাছে আছে বটে, কিন্তু চাবিকাঠি আছে আমার কাছে৷ জয়ন্তের পরামর্শেই এই ব্যবস্থা হয়েছে৷ একজন ধরা পড়লে একসঙ্গে দুটো জিনিস চুরি যাবে না৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এখানে রয়েছে জয়ন্তের রক্তমাখা টুপি, মাটির উপরেও রক্তের দাগ! কিন্তু ওখানে অত দূরেও মাটির উপরে রক্তের ঢেউ বইছে! আমার কি ভয় হচ্ছে জানো মানিক?’

-‘কী ভয় হচ্ছে?’

-‘আমরা দু-বার বন্দুকের আওয়াজ শুনেছি৷ ধরো, জয়ন্ত জানতে পারবার আগেই শত্রুর প্রথম গুলিতে আহত হয়ে এইখানে পড়ে যায় আর তার টুপিটা যায় মাথা থেকে খুলে৷ কিন্তু আহত হয়েও সে তাড়াতাড়ি আবার উঠে ওইদিক দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে, তাই এখানে রক্তের দাগ এত কম৷ সে যখন ওইখানে গিয়ে পৌঁছেচে তখন শত্রুদের দ্বিতীয় গুলি আবার তাকে মাটির উপরে পেড়ে ফেলে, আর তার রক্তের ধারায় মাটি যায় ভিজে৷ তারপর হয় সে অজ্ঞান হয়ে গেছে, নয়-ভগবান না করুন-মারা পড়েছে! কারুর দেহ থেকে অত বেশি রক্ত বেরুলে তার পক্ষে বাঁচা অসম্ভব, দীর্ঘকাল পুলিশে কাজ করে এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে! মানিক, খুব সম্ভব আমাদের বন্ধু আর বেঁচে নেই!’-গভীর দুঃখে সুন্দরবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাঁর চোখ দু-টি ছলছল করতে লাগল!

অমলবাবু আকুল কন্ঠে বললেন, ‘কিন্তু জয়ন্তবাবুর দেহ কোথায় গেল?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘নিজেদের বিরুদ্ধ প্রমাণ লুকোবার জন্যে শত্রুরা জয়ন্তের দেহ সরিয়ে ফেলেছে৷’

ওঙ্কারধামের মন্দির চূড়াকে তখন রহস্যময় আকাশের বিরাট পটে কালি দিয়ে আঁকা ছবির মতন দেখাচ্ছে এবং জঙ্গলের বোবা অন্ধকারের মুখে ভাষা দিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে নৈশ জীবদের নানারকম কলরব, গাছে গাছে পাতায় পাতায় বাতাসের নিশ্বাস-উচ্ছ্বাস৷

মানিক খানিকক্ষণ স্তব্ধ মূর্তির মতো বসে থেকে হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘প্রতিশোধ-প্রতিশোধ-আমি প্রতিশোধ চাই!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম! আমারও ওই কথা! এখন আর পদ্মরাগ বুদ্ধের খোঁজ নয়, আগে খুঁজে বার করতে হবে জয়ন্তের হত্যাকারীদের!’

অমলবাবু বললেন, ‘কিন্তু কোথায় তারা?’

মানিক বললে, ‘অমলবাবু, যে ভাঙা মন্দিরের ভিতর থেকে আপনি বুদ্ধমূর্তিটা এনেছিলেন, সেখানে যাবার পথ আপনার মনে আছে তো?’

-‘নিশ্চয়ই আছে!’

-‘তাহলে তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে এখনি চলুন সেইদিকে!’

-‘তবে কি এখন হত্যাকারীদের সন্ধান করা হবে না?’

-‘অমলবাবু, হত্যাকারীরা যদিও চাবিটা পায়নি, কিন্তু চাকতির নকশা তো পেয়েছে! তারা এখন সেই মন্দিরের দিকেই যাবে৷ ওইদিকে গেলেই তাদের খোঁজ পাব৷’

-‘কিন্তু আমরা যখন সেখানে গিয়েছিলুম তখন চ্যান আর ইনকে তো সঙ্গে নিয়ে যাইনি, মন্দিরে যাবার পথ হয়তো তারা জানে না৷’

-‘এটা আপনার ভুল বিশ্বাস৷ পদ্মরাগ বুদ্ধের কথা আর মন্দিরের পথ হয়তো তারা আপনার আগে থাকতেই জানত-জানত না কেবল পদ্মরাগ বুদ্ধের ঠিকানা৷ চাকতির নকশা পেয়ে তারা এখন সদলবলে সেইদিকেই ছুটে চলেছে!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘মানিকের কথাই যুক্তিসংগত বলে মনে হচ্ছে৷ চলো, চলো-আর দেরি করা নয়, যত দেরি করব শত্রুরা ততই এগিয়ে যাবে! আগে প্রতিহিংসা, তারপর শোক-দুঃখের কথা! তাড়াতাড়ি পেটে ছাইভস্ম কিছু পুরে আমাদের এখনি যাত্রা করতে হবে!’

সবাই যখন শত্রুদের সন্ধানে যাত্রা শুরু করলে, আকাশে তখন অপরিপূর্ণ চন্দ্র জেগে চারিদিকে যেন ছায়ামাখা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে! ডাকবাংলোর ছাদে একটা প্যাঁচা বসেছিল, হঠাৎ এতগুলো লোক দেখে ভয়ে চ্যাঁ-চ্যাঁ করে চেঁচিয়ে শূন্যে ঝটপট ডানা বাজিয়ে উড়ে পালাল৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম-পথে পা বাড়াতে-না-বাড়াতেই প্যাঁচার ডাক! দুর্গা, দুর্গা!’

মানিক দুঃখিত স্বরে বললে, ‘জয়ন্তকে যখন হারিয়েছি, তুচ্ছ প্যাঁচার ডাকে আমাদের আর কী অনিষ্ট হবে সুন্দরবাবু?’

-‘যা বলেছ মানিক! জয়ন্ত যে আমাদের কতখানি ছিল এখন সেটা বুঝতে পারছি! আজ আমরা তাকে হারিয়ে চলেছি যেন নাবিকহীন জাহাজের মতো! কপালে এও ছিল-হুম!’

এবারে আর ঝাপসা আকাশপটে নয়, চাঁদের ছটা পিছনে রেখে ওঙ্কারধামের পঞ্চচূড়া অন্ধকারে গড়া পঞ্চ স্তম্ভের মতো মহাশূন্যের বুক বিদীর্ণ করছে! এখন তাকে কী অবাস্তবই দেখাচ্ছে! অতীতের একটা বিলুপ্ত জাতির সমস্ত সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশার সমাধি-মন্দির এই ওঙ্কারধাম৷ তার বিপুল ছায়ার তলায় লক্ষ লক্ষ মানুষের দেহ মৃত্তিকায় পরিণত হয়ে আজও বিদ্যমান রয়েছে-তারই উপর দিয়ে লন্ঠনের আলোতে চলন্ত ও সুদীর্ঘ কৃষ্ণচ্ছায়ার সৃষ্টি করে হেঁটে যাচ্ছে আজ বিংশ শতাব্দীর কয়েকটি প্রাণী! একদিন এইখান দিয়ে হেঁটে বা রথে বা গজপৃষ্ঠে বা অশ্বারোহণে বীরদর্পে ধনুক-বর্ষা-তরবারি হাতে করে দলে দলে হাজারে হাজারে এগিয়ে গিয়েছিল যে স্বাধীন ভারতের ছেলেরা, তাদের সঙ্গে তুলনা করলে তাদের স্বগোত্র এই লোকগুলিকে কত অসহায়, কত ক্ষুদ্র, কত তুচ্ছ বলেই মনে হয়!

দূর গ্রামে কাদের সব দামামা বাজছে এবং তাদের প্রতিধ্বনি ফিরে আসছে ওঙ্কারধামের গগনস্পর্শ শিখরে প্রতিহত হয়ে৷

সকলে তখন একটি পাথরে গড়া প্রকাণ্ড চত্বরের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল!

অমলবাবু যেন আপন মনেই বললেন, ‘রাজা ইন্দ্রবর্মণের পুত্র যশোবর্মণ ছিলেন একজন মহামানুষ! তাঁর দেহ ছিল দানবের মতন প্রকাণ্ড, জনতার অনেক উচ্চে জেগে থাকত তাঁর গর্বিত মাথা! আর তাঁর বলবীর্যও ছিল অসাধারণ! তিনি নাকি নিরস্ত্র হয়েও খালি হাতে হস্তী ও ব্যাঘ্র সংহার করেছিলেন!

‘তাঁর কীর্তিও তেমনি অতুলনীয়! সিংহাসনে আরোহণ করে মাত্র এগারো বৎসরের ভিতরেই তিনি এখানকার বিরাট নগর গড়ে সম্পূর্ণ করে ফেলেছিলেন, বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগেও যা অসম্ভব বলেই মনে হয়!

‘আমরা এখন যেখান দিয়ে যাচ্ছি, এইখানেই মহারাজ যশোবর্মন যে-বীরত্ব আর অসমসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা অমানুষিক বললেও চলে৷

‘ওঙ্কারধামের বয়স তখন পুরো এক বৎসরও হয়নি৷ ভারত রাহু সম্বুদ্ধি নামে এক রাজা বিদ্রোহী হয়ে হঠাৎ একরাত্রে সসৈন্যে প্রাসাদ আক্রমণ করলেন৷

‘প্রাসাদের বাহিরে যেসব প্রহরী ছিল তারা সকলেই মারা পড়ল৷ বিদ্রোহীরা সিংহদ্বার দিয়ে ভিতরে ঢুকতে লাগল পঙ্গপালের মতো দলে দলে৷ ভিতরের প্রহরীরা প্রাণভয়ে কে কোথায় সরে পড়ল তার কোনো সন্ধানই মিলল না৷

‘বিদ্রোহীদের জয়ধ্বনিতে মহারাজ যশোবর্মনের ঘুম ভেঙে গেল৷ তিনি তাড়াতাড়ি উলঙ্গ তরবারি নিয়ে প্রাসাদে ঢোকবার সংকীর্ণ এক পথের উপরে এসে দাঁড়ালেন৷ তাঁর পাশে রইল দুই জন মাত্র সাহসী যোদ্ধা৷

‘বিদ্রোহীরা দলে খুব পুরু ছিল বটে, কিন্তু একসঙ্গে দুই-তিন জনের বেশি লোকের পক্ষে সেই সংকীর্ণ পথে প্রবেশ করা সম্ভবপর ছিল না৷ মহারাজ যশোবর্মণ বিপুলবপু নিয়ে সেই পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে নিজের প্রাণ ও রাজ্য রক্ষার জন্যে উন্মত্তের মতো অসিচালনা করতে লাগলেন -বিদ্রোহীরা এগিয়ে আসছে আর গোড়াকাটা কলা গাছের মতো মাটির উপরে লুটিয়ে পড়ছে!

‘যশোবর্মণের দুই সঙ্গী রাজার জন্যে প্রাণ দিলে, কিন্তু মহারাজের সতর্ক তরবারি এড়িয়ে তবু কেউ ভিতরে ঢুকতে পারলে না৷

‘বিদ্রোহীদের নেতা ভারত তখন মহাবিক্রমে যশোবর্মণকে আক্রমণ করলেন-দুই বীরের মুক্ত তরবারি বারবার পরস্পরের আলিঙ্গন ধরা পড়তে লাগল৷

‘যুদ্ধ যখন শেষ হল তখন দেখা গেল, বিদ্রোহী ভারতের মৃতদেহের উপরে সগর্বে দাঁড়িয়ে, শূন্যে রক্তাক্ত তরবারিতে বিদ্যুৎ খেলিয়ে মহারাজ যশোবর্মণ সিংহনাদ করছেন! বাকি বিদ্রোহীরা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল!’

হাতি সিং ও আর চার জন অনুচর প্রত্যেকেই এক-একটা পেট্রলের লন্ঠন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, এবং সেই প্রচণ্ড আলোকের তীব্রতায় ভয় পেয়ে দূরে সরে সরে যাচ্ছে ছায়াময় অন্ধকার৷

সেই আলোতে কোথাও স্পষ্ট এবং কোথাও অস্পষ্ট ভাবে দেখা গেল, বিরাট সব দানবের প্রস্তরমূর্তি বহুমুণ্ড সর্পদের ধরে পাশাপাশি বসে আছে! উপবিষ্ট অবস্থাতেই প্রত্যেক দানবের উচ্চতা আট ফিটের কম হবে না৷ কোনো কোনো দানব শতাব্দী ধরে প্রকাণ্ড শিলাসর্পের গুরুভার আর বইতে না পেরে যেন শ্রান্ত হয়েই নীচের খালের ভিতরে গড়িয়ে পড়ে গেছে!

অমলবাবু বললেন, ‘আগে এমনি পাঁচ-শো চল্লিশটি দানব এখানকার পাঁচটি সিংহদ্বারের কাছে পাহারায় নিযুক্ত থাকত৷ এখানে কোথাও ক্ষুদ্রতা কি অপ্রাচুর্য নেই! যা দেখবে সবই বিরাট! ওঙ্কারধামের প্রধান মন্দির চূড়ার উচ্চতা হচ্ছে দু-শো পঞ্চাশ ফুট-অর্থাৎ কলকাতার গড়ের মাঠের মনুমেন্টের চেয়ে তা দু-গুণ বেশি উঁচু! আর তার অন্য চারটি শিখরও বড়ো কম যায় না, কারণ তাদের প্রত্যেকের উচ্চতা হচ্ছে দেড়-শো ফুট করে! আর চারিদিক ঘিরে ওই যে খাল চলে গেছে, তাও চওড়ায় দু-শো ত্রিশ ফুট!’

 সর্পমূর্তি চোখে পড়ে চতুর্দিকেই৷ এর দুই কারণ থাকতে পারে৷ প্রথম, সাপ হচ্ছে শিবের প্রিয় জীব এবং ওঙ্কারধাম হচ্ছে আসলে শিবেরই লীলানিকেতন৷ দ্বিতীয়, ওঙ্কারধামের প্রথম রাজা কম্ভু বিবাহ করেছিলেন নাগরাজের কন্যাকেই৷ এবং এ স্থানটা হচ্ছে নাগরাজ্যেরই অংশবিশেষ৷

যেখানেই ভারত শিল্পীর বাটালি পড়েছে সেখানেই জন্মলাভ করেছে অসংখ্য হাতির মূর্তি৷ এখানেও তাই৷ সর্বত্রই এত হাতি যে দেখলে অবাক হতে হয় এবং অধিকাংশ মূর্তিই জীবন্ত হাতির মতোই মস্ত বড়ো! এমন বৃহৎ সব মূর্তি এত অজস্র পরিমাণে গড়তে যে কত যুগের দরকার হয়েছিল তা ভাবলেও অবাক হতে হয়! কিন্তু ভারতের শিল্পী হয়তো পরিশ্রম ও কালের হিসাব রাখতে জানত না-তাদের ধৈর্যের পরমায়ু ছিল অক্ষয়! যেন তারা জন্মজন্মান্তর ধরে মূর্তি বা মন্দির গড়তেও নারাজ ছিল না! এবং কঠিন পাথর ছিল তাদের হাতে যেন নরম ভিজে বেলেমাটির মতো! তাদের হাতের মায়া-ছোঁয়া পেলে পাথর যেন বেঁকে-নুঁয়ে-দুমড়ে অতি সহজেই শিল্পীর ইচ্ছামতো যেকোনো আকার ধারণ করতে বাধ্য হত! এ বিষয়ে ভারত শিল্পের কাছে পৃথিবীর আর সব দেশের শিল্পই ম্লান হয়ে যাবে!

দেয়ালের গায়ে গায়ে পাথরে খোদা ছবিই বা কত! সেই ছবির পর ছবির সারি মাপলে নিশ্চয়ই এক মাইলের কম হবে না৷ কোথাও মস্ত হস্তীরা ধেয়ে চলেছে, কোথাও দেবতা, দানব, মানবের জনতা, কোথাও রামায়ণের দৃশ্যের পর দৃশ্য, কোথাও গম্ভীর অরণ্যে বন্য জন্তুরা বিচরণ করছে, কোথাও সাগরে সামুদ্রিক জীবরা সাঁতার কাটছে, কোথাও রন্ধনশালায় রান্না হচ্ছে, বাজারে নানা জিনিসের বিকিকিনি চলছে, বাজিকররা হরেকরকম খেলা দেখাচ্ছে এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ঘোড়ায় চড়ে পোলোর মতন কী এক খেলায় নিযুক্ত হয়ে আছেন! রাজা-প্রজা, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, দেবদাসী, রাজকুমারী, সুয়োরানি-দুয়োরানি, সখীর দল, বাঁদি ও তীর্থযাত্রী-কিছুরই অভাব নেই! দ্বন্দ্বযুদ্ধ, স্থলযুদ্ধ, জলযুদ্ধ, রাজসভা, কুচকাওয়াজ শোভাযাত্রা, উৎসব, পূজা, নাচ, ঘরসংসার,-শিল্পীর বাটালি কোনো কিছুরই প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ করেনি! মহাকালের অদৃশ্য হস্ত কত শতাব্দীর রহস্যময় যবনিকা হঠাৎ এখানে সরিয়ে দিয়েছে, তাই হাজার বছর পরেও এখানে এসে বিংশ শতাব্দী বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে দেখছে সেকালের সমস্ত সুখ-দুঃখমাখা বিচিত্র জীবনযাত্রার চিত্র৷ প্রথম দর্শনে সন্দেহ হয় এক মুহূর্ত পূর্বেও এরা সবাই জীবন্ত গতির লীলায় চঞ্চল হয়ে অতীত নাট্যলীলার পুনরাভিনয় করছিল, বর্তমানের ক্ষুদ্র মানুষদের পদশব্দ পেয়ে এখন স্তম্ভিত হয়ে গেছে আচম্বিতে!

আসলে কিন্তু সমস্তই অতীত! যোদ্ধাদের ধনুকগুলো নুয়ে আছে, কিন্তু তির আর ছুটবে না! মায়ের কোলে শুয়ে পাথুরে শিশুরা স্তন্যপান করছে, কিন্তু তারা বালক বা যুবক হতে পারবে না! শিলাহস্তীর দল তাদের যে-সব পা শূন্যে তুলেছে, সেগুলো আর কখনো মাটিতে পড়বে না! সৈন্যদল যুদ্ধযাত্রায় বেরিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে, সেই বিদেশি শত্রুদের সঙ্গে তাদের আর কোনোদিন দেখা হবে না, রাজসভার জনতার মধ্যে সিংহাসনের উপরে ছত্রের তলায় মহারাজ বসেছেন বিচারে, কিন্তু তাঁর মুখ আর কথা কইবে না! এরা এখন সবাই আড়ষ্ট, সবাই চির বোবা! আরও কত যুগ আসবে, আবার চলে যাবে, কিন্তু সেই মৃত জাতির লুপ্ত সভ্যতার এই কালজয়ী স্মৃতি তখনও এমনি স্তম্ভিত ও আড়ষ্ট হয়েই এখানে বিরাজ করবে৷

সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘হুম! এ যে পাথরের সিনেমা! কত গল্পের ছবিই এখানে রয়েছে!’

অমলবাবু বললেন, ‘সত্যিই তাই! সেকালের অধিকাংশ লোকই তো পড়তে জানত না, প্রাচীন শিল্পীরা তাই মন্দিরের গায়ে সমস্ত বিখ্যাত কাব্যের আর ইতিহাসের ছবি খুদে রাখতেন৷ নিরক্ষর লোকরাও সেগুলো দেখে শিক্ষালাভ করত৷’

মানিকও এই শিলাময় নতুন জগতে এসে বিস্মিত হয়েছিল, কারণ ভারত শিল্পীর এই নতুন স্বদেশে এসে বিস্মিত না হয়ে থাকতে পারে কে? কিন্তু সে বিস্ময় তাকে বেশিক্ষণ অভিভূত করে রাখতে পারেনি৷ তার মাথায় ঘুরছে কেবল জয়ন্তের কথা এবং তার মন ক্রমাগত হা-হা করে উঠছে!

অমলবাবুর কোনো উক্তিই ভালো করে তার কানে ঢুকছিল না, শূন্য দৃষ্টিতে চারিদিকের শিল্পকাজের দিকে তাকাতে তাকাতে সে হনহন করে এগিয়ে চলল,-লন্ঠনের আলোকরেখাগুলো যে তার পিছনে অনেক দূরে পড়ে রইল, সে খেয়ালও তার রইল না!

একজায়গায় মোড় ফিরে সে যেখানে এসে দাঁড়াল সেখানে কেবল চাঁদের আধফোটা আলোতে চারিদিক থমথম করছে৷ অস্পষ্টভাবে দেখা গেল মস্ত মস্ত পাথরের হাতির পর হাতি সার গেঁথে কোথায় কতদূরে নিবিড় তিমিরের ভিতর হারিয়ে গিয়েছে, তার কোনো ঠিকঠিকানাই নেই!

হঠাৎ তার হুঁশ হল, এর পরে কোনদিকে যেতে হবে তা সে জানে না এবং ভুল পথে গেলে সঙ্গীদের সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না৷ মানিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে সঙ্গীদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল৷

তারা-ছড়ানো আকাশ তখন যেন তন্দ্রাময়৷ খানিক তফাতে অরণ্যের কালিময় বুকের তলা থেকে ভেসে আসছে যেন রাত্রি-দানবীর ফিসফিস কানাকানি! জীবন্ত জগতের আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না৷

চতুর্দিকের নিস্তব্ধতা আচম্বিতে, আর যেন চুপ করে থাকতে না পেরে, পাগল হয়ে গর্জন করে উঠল-গুড়ুম, গুড়ুম!

চমকে উঠে মানিক ফিরে দাঁড়াল বিদ্যুতের মতো!

পিছনে অনেক লোকের গোলমাল! আবার দু-বার বন্দুকের শব্দ, তারপরই দূর থেকে সুন্দরবাবু চিৎকার শোনা গেল-‘মানিক! মানিক!’

মানিক ফিরে দৌড়োবার উপক্রম করছে, হঠাৎ বৃহৎ একটা গুরুভার তার পিঠের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কোনো কিছু বোঝবার আগেই বিষম এক ধাক্কায় সে একেবারে মাটির উপরে উপুড় হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল!

তারপরই কে তার পিঠের উপরে চেপে বসল এবং দু-খানা বড়ো বড়ো চ্যাটালো হাতে প্রাণপণে তাঁর গলা চেপে ধরল!

সেই অজ্ঞাত শত্রুকে পিঠ থেকে ঠেলে ফেলে দেবার জন্যে মানিক তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল, কিন্তু কিছুই করতে পারল না! দশটা লোহার মতন কঠিন আঙুলের চাপে তার সমস্ত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল৷

* ওঙ্কারধাম সম্বন্ধে এ উপন্যাসের আগে বা পরে যা বলা হয়েছে ও বলা হবে, তা লেখকের কপোলকল্পিত নয়৷ অধিকাংশই প্রমাণিত ঐতিহাসিক সত্য৷ -ইতি লেখক