উপন্যাস
গল্প

পাথরের চোখ – ৮

।। আট ।।

সারাটা পথ বৈশালী অস্বাভাবিক গম্ভীর।

স্টিয়ারিং সুজিতের হাতে। সিটে হেলান দিয়ে বৈশালী নিস্পন্দ নির্বাক। তার এ চেহারার সঙ্গে সুজিতের পরিচয় আছে। সে বুঝতে পারল বৈশালীর মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় উঠেছে। অনেকগুলো বিপরীতমুখী তরঙ্গের সংঘাত। এসবের মাঝখান থেকে সে সমাধানের সূত্র খুঁজছে।

বর্ধমান এসে বৈশালী নিজেই কথা বলল। এসো সুজিত, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক।

খাওয়ার টেবিলেও বৈশালী বেশ চিন্তামগ্ন।

একসময়ে বলল, তুমি এখন কাজে যোগ দিয়ো না। তিন দিন পরে আমরা আবার শিলাগড়ে ফিরে আসব।

তিন দিন?

হ্যাঁ, দু-দিনও হতে পারে।

বৈশালী থেমে গেল। আর কোনও কথা হল না।

সুজিতকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে শুধু বলল, আমি তোমায় ফোন করব।

পরের দুটো দিন বৈশালী ভীষণভাবে ব্যস্ত রইল। খুব সকালে বের হয়ে যেত, ফিরত প্রায় দুটো-আড়াইটেয়। তারপর আবার বের হত। রাত দশটার আগে ফিরতে পারত না।

.

তিন দিনের দিন বৈশালী সুজিতকে ফোন করল—সুজিত, তুমি এর মধ্যে ফোন করেছিলে?

না, তুমি ব্যস্ত থাকবে ভেবে আর করিনি।

ভালোই করেছ। শোনো, দু-ঘণ্টার মধ্যে তৈরি থাকতে পারবে?

সুজিত বলল, আমি এখনই তৈরি আছি।

বৈশালী হেসে ফেলল। বা, এইরকম না হলে আমার সহকারী। এখন বেলা ন-টা, এগারোটায় তোমাকে তুলে নেব।

কোথায়? শিলাগড় তো?

ইচ্ছা তো তা-ই। রাখছি। বৈশালী ফোন রেখে দিল।

বাইরে যাবার জন্য বৈশালীর একটা স্যুটকেস গোছানো থাকে।

বৈশালী স্নান আর ভারী রকমের প্রাতরাশ সেরে নিল।

.

মোটরে সুজিত জিজ্ঞাসা করল, শিলাগড়ের রহস্যের কিনারা হয়ে গেছে?

আজ রাত্রে অপারেশন।

কিছুক্ষণ পরে বৈশালী বলল, শোনো, আর-একটা কথা—।

সুজিত ফিরে দেখল।

এবার আর অতিথি-কুটিরে উঠব না।

তবে?

শিলাগড়ে ঘোরবার সময় একটা মারোয়াড়ি ধর্মশালা দেখে রেখেছিলাম। সেন্ট্রাল রোডে। নাম বোধহয় রামবিলাস ধর্মশালা।

সুজিত সন্দেহ করল, থাকতে পারবে সেখানে?

বৈশালী হাসল।

মনে আছে, আগ্রায় গাছতলায় দু-রাত কাটিয়েছিলাম।

রাস্তায় আর কোনও কথা হল না।

সদর রাস্তা ছেড়ে মোটর ঘুরপথে সেন্ট্রাল রোড ধরল, যাতে ভুবন-নিবাসের সামনে না পড়তে হয়।

রামবিলাস ধর্মশালা।

ব্যবস্থা খারাপ নয়। শুধু মাছ, মাংস আর ডিম চলবে না।

বৈশালী আর সুজিত ঠিক করল এখানে থাকবে, কিন্তু খাওয়াদাওয়া বাইরেই সেরে নেবে।

সুজিত জিজ্ঞাসা করব, শুধু একটা রাত তো?

তা-ই তো মনে হচ্ছে। অবশ্য এসব ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না।

থানার সামনেই ও.সি.-কে পাওয়া গেল।

বৈশালীকে অভ্যর্থনার বহর দেখে বৈশালী বুঝতে পারল, ইতিমধ্যে সত্যেন রায়ের ফোন এসে পৌঁছেছে।

অতীনবাবু ঠিকমতো থানায় হাজিরা দিচ্ছেন তো?

ও.সি. হাসল। হ্যাঁ, একেবারে নিয়ম করে। এবার অ্যারেস্ট করি তাকে?

না, এখন নয়। যখন প্রয়োজন হবে বলব।

একটু থেমে বৈশালী বলল, আজ রাত বারোটায় আমার গোটা চারেক পুলিশ দরকার। আর্মড। আপনি তো সঙ্গে থাকবেনই।

ও.সি. উত্তর দিল, ডি.সি. ফোনে আমাদের সবকিছু বলেছেন। আমরা এগারোটার মধ্যে তৈরি থাকব।

ঠিক এগারোটার একটু পরেই এখানে আসব। আর দড়ির মই চাই একটা।

সে কথাও স্যার বলেছেন। ঠিক আছে।

চিল, ঠিক সময়ে আসব। ভালোই হয়েছে। আজ রাতটা অন্ধকার।

আমাদের আলো আর অন্ধকার—সবই এক।

.

বৈশালীর পোশাক দেখে সুজিত অবাক।

পরনে কালো শার্ট আর আঁটো প্যান্ট। প্যান্টের রংও কালো। কোমরে অটোমেটিক।

কী ব্যাপার, রণাঙ্গনে নাকি?

প্রায় তা-ই।

আমি কী পরব?

তুমিও টাইট কিছু পরে নাও।

কেন, ছুটতে হবে নাকি?

সম্ভবত।

দুজনেই হেসে উঠল।

বৈশালী আর সুজিত যখন থানার সামনে এসে হাজির হল তখন জিপ নিয়ে ও.সি. তৈরি।

আমাকে অনুসরণ করুন।

জিপ খুব সাবধানে বৈশালীর মোটরের পিছন পিছন চলতে শুরু করল।

পিচকালো অন্ধকার। সূচিভেদ্য। এক হাত দূরের কিছু দেখবার উপায় নেই। আকাশে গোটাকয়েক নক্ষত্র আছে বটে, কিন্তু তাদের ক্ষীণ জ্যোতি পৃথিবীতে এসে পৌঁছাচ্ছে না।

একটা গাছের নীচে জিপ আর মোটর দাঁড়াল। সবাই নেমে এল।

বৈশালী তার রেডিয়াম ঘড়ির দিকে দেখল। এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ।

বৈশালী ও.সি.-কে একপাশে ডাকল। অনেকক্ষণ ধরে চাপা গলায় কথা হল। তারপর একসময়ে বৈশালী বলল, চলুন আমরা এগোই।

ভুবন-নিবাসের পিছনের পাঁচিলের এপাশে এসে সকলে দাঁড়াল।

নিশাচর দু-একটা পাখির ডাক। মাঝে মাঝে ব্লাস্টিং-এর শব্দ। এ ছাড়া শিলাগড় যেন ঘুমে নিথর।

বারোটা বাজতে যখন দশ, তখন বৈশালী ইঙ্গিত করল।

ও.সি. দড়ির মইটা পাঁচিলের ওপর ছুড়ে দিল।

প্রথমে ও.সি., তারপরে বৈশালী আর সুজিত খুব সাবধানে পাঁচিলের ওপর উঠল।

গাছপালার জন্য এদিকটা যেন আরও অন্ধকার। দু-একটা জোনাকির ক্ষীণ দীপ্তি।

এক-এক করে পুলিশরাও উঠল। তারপর গাছের ডাল আঁকড়ে এদিকে নামল।

বৈশালী পুলিশদের দিকে ফিরে বলল, তোমরা এখানে অপেক্ষা করো। হুইসলের শব্দ শুনলেই ছুটে যাবে।

প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে গাছের আড়ালে বৈশালী, সুজিত, তারপর ও.সি. এগিয়ে যেতে লাগল।

অতিথি-কুটিরের পিছন দিয়ে একটা কাঁঠালচাঁপা ঝোপের পাশে তিনজন বসল।

এক-এক মুহূর্ত এক-এক প্রহর বলে মনে হচ্ছে।

নিজেদের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন যেন বাইরের কোনও শব্দ।

হঠাৎ বৈশালী ও.সি.-র হাতে চাপ দিল।

দূরে একটা টর্চের আলো। একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল।

তিনজন আরও একটু এগিয়ে গেল।

একটা ছোটো ঝোপ। কাঁটার খোঁচা থেকে মনে হচ্ছে বোধহয় গোলাপের ঝাড়। এখানে সাদা গোলাপের গাছ ছিল।

বৈশালী লক্ষ করেছে, এর কাছেই বকুল গাছ।

আরও একবার টর্চের আলো দেখা গেল। মৃদু পায়ের শব্দ অনুভূত হল।

তিনজনই কোমর থেকে অটোমেটিক নিয়ে তৈরি।

বৈশালীর চোখের যেন পলকও পড়ছে না।

পায়ের শব্দ থামল। কিছুক্ষণ। তারপর টর্চের আলো ডানদিকে। খুব চাপাকণ্ঠের আওয়াজ।

মাটিতে শব্দ হল ধুপ, ধুপ, ধুপ।

মিনিটকয়েক। তারপরই বৈশালী, সুজিত আর ও.সি. ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনদিক থেকে।

লোক দুজন। একজনকে বৈশালী অনায়াসেই কায়দা করতে পারল। বাকি লোকটিকে নিয়ে সুজিত আর ও.সি. কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার সময় রাত্রির আকাশ কাঁপিয়ে খুব জোরে আওয়াজ হল।

সঙ্গে সঙ্গে সজোরে হুইসল বেজে উঠল।

অনেকগুলো জোরালো টর্চের আলোয় দেখা গেল, হাত পিছনদিকে করা অবস্থায় মং শান। তার পাশে বৈশালীর কবলে অবনতমুখে দীপালি।

ধস্তাধস্তির সময় মং শানের রিভলভার থেকে গুলি বের হয়ে গিয়েছিল।

ও.সি. পুলিশের হাত থেকে হাতকড়া নিয়ে মং শানের হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল, ভুবন বাজপেয়ি আর তার ড্রাইভারকে হত্যা করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল।

তারপর দীপালির দিকে ফিরে বলল, সেই হত্যার প্ররোচনা ও মূল্যবান রত্ন অপহরণের অভিযোগে আপনাকেও গ্রেপ্তার করলাম দীপালিদেবী। আমাদের সঙ্গে আপনাদের যেতে হবে।

গুলির শব্দে, লোকজনের গোলমালে ভুবন-নিবাসের বাসিন্দারা সবাই এসে জড়ো হয়েছিল।

তার মধ্যে অতীনও ছিল।

বৈশালী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনাকে হয়রানি করার জন্য আমি খুব দুঃখিত অতীনবাবু। এটুকুর প্রয়োজন ছিল।

এবার তাহলে আমি বর্মায় ফিরে যেতে পারি? আমার কারবারের ক্ষতি হচ্ছে। আর কোনও দেখবার লোক নেই।

কাল আপনাকে বলব।

.

বারান্দায় সুজিত আর বৈশালী চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছে। সুজিতদের বাড়ি।

সুজিত বলল, গোয়েন্দা সাহেবা, এবার একটু আলোকপাত করো। আমি যে অন্ধকারেই রয়ে গেলাম।

ঠিক আছে, একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করেছি।

ভুবনবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারটা দেখে এটুকু বোঝা যায় যে, কোনও পরিচিত লোকের দ্বারাই হত্যা সংঘটিত হয়েছিল। কোনও ধস্তাধস্তির চিহ্ন নেই, ভুবনবাবু বা ড্রাইভারের কোনও চিৎকারের শব্দও কেউই শোনেনি। খুব সম্ভব, যে হত্যাকারী সে ভুবনবাবুর সঙ্গে মোটরেই ছিল, যখন তিনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন তখনও মোটরে অপেক্ষা করছিল। দেহরক্ষী হিসাবে। কিংবা হয়তো মাঝপথ থেকে মোটরে উঠেছিল। চেনা লোক বলে কেউ সন্দেহ করেনি।

লোকটা প্রথমে খুব কাছ থেকে সাইলেন্সার-লাগানো রিভলভার দিয়ে ভুবনবাবুকে হত্যা করে, তারপর ড্রাইভারকে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দিয়ে অনড় করে দেয়।

ড্রাইভার হয়তো পিছন ফিরে ব্যাপারটা দেখে ফেলেছিল কিংবা সামনের আয়নার সাহায্যে পিছনের দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল।

হত্যাকারী এত পরিচিত ব্যক্তি যে, ড্রাইভারকে সাময়িকভাবে নির্বাক করে দিয়েও সে নিশ্চিন্ত হতে পারেনি, যাতে ড্রাইভার চিরদিনের জন্য নির্বাক হয়ে যায় তার ব্যবস্থাই করেছিল।

কিন্তু সে বিষক্রিয়াটি কী? পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তার স্বরূপ ধরা পড়েনি?

যথাসময়ে বলব। এখন কাহিনিটা শোনো।

দীপালিদেবী আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শোকের মূর্ত প্রতিমূর্তি। আমি প্রথমে খুব বিচলিত হয়েছিলাম। তিনি প্রথম থেকেই অতীনবাবুর ওপর দোষারোপ করতে লাগলেন। আমার সন্দেহ যাতে অতীনবাবুর ওপর হয় তার জন্য দীপালিদেবীর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। পিতা-পুত্রের বচসার কথা বললেন। সম্পত্তির অংশ নিয়ে, তারও উল্লেখ করলেন। বচসা যে হয়েছে সে কথা অতীনবাবু অস্বীকার করেননি, কিন্তু বলেছেন, তার কারণ ভিন্ন।

পুলিশের খাতায় ভুবন বাজপেয়ির নাম আছে চোরাকারবারের অংশীদার হিসাবে যদিও তাঁকে অভিযুক্ত করা সম্ভব হয়নি। দিল্লি থেকে একই রিপোর্ট পাঠিয়েছে।

তারপর সেই আলোর সংকেতের কথা তোমার মনে আছে। আমার চোখে ধুলো দেবার দীপালিদেবীর আর-এক প্রয়াস। অতীনবাবু যে ঘরে থাকেন তারই বারান্দা থেকে আলোর ইশারা চলেছিল। বাইরে টিলার পাশ থেকে তার উত্তরও এসেছিল।

ব্যাপারটা মারাত্মক কিছু নয়, তবু এটা অতীনবাবুকে জড়াবার একটা ফন্দি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, অতীনবাবু কোনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন।

আমার এটাও মনে হয় যে, বাইরের লনে আমরা বসে আছি, আমাদের চোখে পড়বে, তা জেনেই ওভাবে আলোর সংকেত শুরু করা হয়েছিল।

তাহলে ওসব কি দীপালিদেবীই করছিলেন?

না, দীপালিদেবী অত কাঁচা মেয়ে নন। পরের দিন ভোরে আমি অতীনবাবুর ঘরে গিয়ে উঠি। গত রাতের আলোর ইশারার কথা বলে তাঁকে কৌশলে বারান্দার কাছে দাঁড় করলাম। আগের রাতে যে মানুষের কাঠামো দেখেছিলাম, সে আরও লম্বা। বুঝলাম অতীনবাবুর অনুপস্থিতির সুযোগে অন্য কাউকে সেখানে দাঁড় করানো হয়েছিল। খুব সম্ভব মং শানকে।

তারপর মনে আছে, কোথা থেকে আলোর রেখা আসছিল সেটা দেখবার জন্য আমরা দুজনে বের হলাম?

মনে আছে বই কী। তুমি একটা খাম কুড়িয়ে পেলে।

হ্যাঁ, খামটা ঝোপের ধারে এমনভাবে ফেলে রাখা হয়েছিল, যাতে সহজেই চোখে পড়ে। অতীনবাবুর নাম-লেখা খাম, যেটা স্বাভাবিকভাবেই অতীনবাবু ফেলে দিয়ে থাকবেন। যে-কোনও লোকের পক্ষে সেটা সংগ্রহ করা সহজ। এ ধরনের কেসকে আমরা বলি ‘প্ল্যান্টেড’ অর্থাৎ আরোপিত। এখানেও অতীনবাবুকে জড়াবার চেষ্টা। কিন্তু খামটার গন্ধতেই আমার সন্দেহ হয়েছিল।

খামের গন্ধ?

দীপালিদেবী যখন আমার কাছে এসেছিলেন, তখন তাঁর শরীর থেকে দামি একটা সুগন্ধ পেয়েছিলাম। প্যারির খুব নামকরা সুবাস। খামেও সেই গন্ধ।

বলে যাও।

মং শানকে দেখলাম। দিব্যকান্তি, আকর্ষণ করার মতন চেহারা। তাঁরও কথাবার্তায় একই ইঙ্গিত। অতীনবাবুর প্রতি দোষারোপ। মোট কথা, লোকটাকে আমার ভালো লাগেনি। যেরাতে আসরে কীর্তন হচ্ছিল, সেরাতে সাহস করে মং শানের ঘরে ঢুকে পড়লাম। এধার-ওধার খুঁজতে খুঁজতে কতকগুলো কাগজ হাতে এসে গেল। মোক্ষম দলিল। নিজের সম্বন্ধে মং শান এতটা সুনিশ্চিত ছিল যে, এসব কাগজগুলো গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেনি।

কিন্তু কাগজগুলো তুমি তো আবার রেখে এলে।

হ্যাঁ, কাগজগুলো হারালে মং শান সন্দেহ করত। তাহলে প্ল্যান বানচাল হয়ে যেত। তাই একটা কাগজ ছাড়া আর সব কাগজ রেখে দিয়ে এলাম। একবার প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলাম, তাই তোমাকে বললাম কোনওরকমে মং শানকে কথা বলে আটকে রাখতে।

রেখেছিলাম তো।

অজস্র ধন্যবাদ। তোমার মতন সহকারী দুর্লভ।

যাক, যে কাগজটা নিজের কাছে রেখে দিলে সেই দুর্লভ দলিলটা কী?

একটা পত্র।

পত্র?

হ্যাঁ, আসল পত্রটি পুলিশের হেপাজতে আমিই দিয়েছি। নকলটা পড়ো।

বৈশালী সুজিতের দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দিল।

সুজিত পড়ল। ইংরেজিতে লেখা—

ডাউন তোমার বাবার কাছে চালান করে দিয়েছি।

নীচে লেখা ধন্যবাদ।

সুজিত অসহায়ভাবে বৈশালীর দিকে তাকাল।

অর্থোদ্ধার করতে পারলাম না।

শোনো, চিঠিটা মং শান লিখছে দীপালিদেবীকে। ডাউন বর্মি ভাষা। মানে ময়ূর। ওই চিঠির ওপরে দীপালিদেবী ধন্যবাদ লিখে ফেরত দিয়েছেন। আর-একটা জিনিসও আমি মং শানের ঘরে রেখে আসিনি।

কী সেটা?

ওয়ালেট ঝেড়ে শুকনো একটা ফল পেয়েছিলাম। সেটা প্রফেসর বসাকের কাছে দিয়ে এসেছিলাম। যিনি টক্সিন নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বললেন, ফলটার নাম বুনলুনদি। অত্যন্ত বিষাক্ত ফল। বর্মায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এর নির্যাস কাউকে ইঞ্জেকশন দিলে বেহুঁশ হয়ে যায়, মাত্রা বেশি হলে মৃত্যু। ড্রাইভারের মৃত্যুর কারণ যে এরই ইঞ্জেকশন, তাতে সন্দেহ করার কোনও হেতু নেই।

ময়ূরটির সন্ধান পাওয়া গেছে?

হ্যাঁ, সেখানকার পুলিশ দীপালিদেবীর বাবা জহুরি সুরজমল খেত্রীর বাড়ি খানাতল্লাশি করে ময়ূর উদ্ধার করেছে।

ময়ূরের রুবির চোখ?

ভুবনবাবু ময়ূরের একটা রুবির চোখের জন্য উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন, কিন্তু গোটা ময়ূরের দাম ছিল অনেক বেশি।

কেন, তুমি না বলেছিলে ময়ূরটা ব্রোঞ্জের তৈরি?

ময়ূরের বুকের কাছে একটা জায়গা টিপলে ফাঁক হয়ে যায়, আর সেই গোপন গহ্বরে একটি কাগজ, তাতে ঠিক কোন জায়গায় ভুবনবাবুর কালোবাজারের টাকা লুকোনো, তার হদিশ ছিল। মং শানের ঘর থেকে যে কাগজগুলো এনেছিলাম, তাতে একটি কাগজ ছিল, লেখা— আগামী তেরোই রাত বারোটায় বকুলতলায় খুঁড়ব। সেখানেই মালিকের সব টাকা আছে। তুমি ঠিক এসো।

এই কাগজটা আমি মং শানের ঘরে আবার রেখে এসেছি।

কিন্তু ওগুলো কালোবাজারের টাকা কী করে বুঝলে?

বৈশালী হাসল।

সাধারণভাবে অর্জিত টাকা লোকে ব্যাঙ্কে রাখে, কিংবা সিন্দুকে, মাটির তলায় নয়।

কিন্তু আমার আরও একটা প্রশ্ন রয়ে গেল।

কী?

ময়ূরের রুবির একটা চোখ বদলে কে ঝুটো কাচ বসিয়ে দিল?

সম্ভবত দীপালিদেবী। তাঁর বাপকে দিয়ে এ কাজটি করিয়েছিলেন। তখন বোধহয় ময়ূরের পেটের কাগজের রহস্যের কথা তাঁর জানা ছিল না। ভুবনবাবু নিজেই দ্বিতীয় পক্ষের এই পরমাসুন্দরী স্ত্রী-র কাছে কথাটা বলে থাকবেন, তারপর থেকেই ষড়যন্ত্রের জাল বোনা শুরু হয়। মং শানের সাহায্য নিয়ে ভুবনবাবুকে সরিয়ে দেওয়া এবং কোনওরকমে অতীনবাবুকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারলেই পথ পরিষ্কার।

কিন্তু তোমাকে ডাকার কী অর্থ?

সাবধান, এবার মানহানির মামলা ঠুকে দেব। বোধহয় দীপালিদেবীর ধারণা, মেয়ে গোয়েন্দাদের যাহোক একটা কিছু বুঝিয়ে দেওয়া যাবে।

কিন্তু আর-একটা কথা—।

না, আর কোনও কথা নয়। ক-টা বেজেছে খেয়াল আছে? আমি চলি। অনেকদিন পর একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোব এবারে।

***