উপন্যাস
গল্প

পাথরের চোখ – ৭

।। সাত।।

সুজিত সবে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের দিকে রওনা হচ্ছে, সামনে বৈশালীকে দেখে বলল, কী ব্যাপার, এত সকালে কোথায় গিয়েছিলে?

মর্নিং ওয়াক করে এলাম।

একলাই?

তোমরা যেমন মাঝে মাঝে নারীসঙ্গ বর্জনীয় মনে করো, আমরাও তেমনই কখনো কখনো তোমাদের পরিহার করে চলতে চাই, বুঝলে?

সুজিত কিছু বলল না। বাথরুমে ঢুকে গেল।

এরপর একসময়ে অতীন এসে দাঁড়াল। হাতে কার্ড।

বড্ড দেরি হয়ে গেল। আরও আগে নিমন্ত্রণ করা উচিত ছিল, কিন্তু আগে আর আপনাদের পাব কোথায়? দয়া করে অনুষ্ঠানে আসবেন। সকাল থেকে কীর্তনের আসর বসবে। অবশ্য রাত্রেই জমজমাট হবে আসর।

বৈশালী বলল, দিনের বেলা আমাদের একটু কাজ আছে। সন্ধ্যাবেলা আসরে আমরা উপস্থিত থাকব।

খাওয়াদাওয়ার পর বৈশালী বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে সুজিত। বৈশালীর হাতে স্টিয়ারিং।

সুজিত জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবে?

আশপাশটা একটু ঘুরে দেখব—আলোর খেলা কোথা থেকে হচ্ছিল।

তোমার কী ধারণা, যারা এসব করছিল তারা দিনের বেলাতেও ওখানে বসে থাকবে?

বৈশালী হাসল। বলল, তা কখনো থাকে না। মানুষ থাকে না, কিন্তু চিহ্ন রেখে যায়। হাত-পায়ের ছাপ কিংবা ব্যবহার-করা কোনও জিনিস।

তা সত্যি। তা না হলে তোমাদের মতন গোয়েন্দাদের অন্ন যাবে যে। চলো।

মোটর একটু দূরে রেখে দুজনে হাঁটল।

উঁচু-নিচু ঢিপির পাশে কাঁটাগাছের ঝোপ। বৃষ্টি হয়নি। শুকনো, খটখটে মাটি। পায়ের ছাপ পড়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।

বৈশালী নিচু হয়ে ঝোপগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজল। হঠাৎ কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

এই দেখো।

সুজিত এগিয়ে এল।

কী?

একটা খাম। কারো পকেট থেকে পড়ে গেছে।

বৈশালী খামটা এগিয়ে দিল।

সুজিত দেখল। পুরোনো খাম। একটা ঠিকানা লেখা। স্পষ্ট নয়, কিন্তু পড়া যায়।

অতীন বাজপেয়ি। ফোর্থ স্ট্রিট। কেমেনডাইন। রেঙ্গুন। লোয়ার বার্মা।

এটা এখানে এল কী করে?

বৈশালীকে খুব চিন্তিত মনে হল। আস্তে আস্তে বলল, কারো পকেট থেকে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক।

সুজিত বলল, পড়লে অতীনবাবুর পকেট থেকেই পড়েছে, কারণ তাঁকে লেখা খাম।

বৈশালী এ কথার কোনও উত্তর দিল না। শুধু বলল, দাও খামটা।

খামটা নিয়ে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিল। তারপর হেঁটে একটু দূরে গিয়ে আবার ফিরে দেখল।

কী দেখছ?

কাল রাতে ওই জায়গা থেকেই কিন্তু আলোটা দেখা গিয়েছিল। আমি ওই উঁচু ঢিপিটা নিশানা রেখেছিলাম। রাতের বেলা ঢিপিটা দেখা যায়নি, শুধু একটা অন্ধকার স্তূপ।

তোমার বক্তব্যটা কী?

কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার হিসাবে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

কীরকম?

আর কিছুদিন আমাকে সময় দাও। যদি সম্ভব হয়, আশা করি, সব বলতে পারব।

তা ভালো, কিন্তু এবার কোনদিকে?

একবার থানায় যাব।

হঠাৎ?

ভয় নেই, ভিতরে নয়—বাইরে থেকে থানার অবস্থানটা দেখে আসব।

চলো।

দুজনে আবার মোটরে উঠল।

সদর রাস্তার ওপরই থানা। ভুবন-নিবাস থেকে বেশি দূরে নয়।

সুজিত বলল, ও.সি.-র সঙ্গে একবার আলাপ করে এলে হত না?

দরকার হলে পরে যাব। সত্যেন রায়ের চিঠি সঙ্গে আছে, তাতেই কাজ হবে।

একটু এদিক-ওদিক ঘুরে দুজনে যখন ফিরে এল, তখন জোর কীর্তন চলছে। খুব বেশি লোক নেই। বাড়ির লোকেরা রয়েছে। কিন্তু কীর্তনীয়া দরদ দিয়ে গাইছে।

চলতে চলতেই চোখ ফিরিয়ে বৈশালী দেখল, মঞ্চের একপাশে সাদা কাপড় জড়িয়ে দীপালি চুপচাপ বসে আছে। একমুঠো রজনিগন্ধা ফুলের মতন।

কী-ই বা বয়স। এই বয়সে জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখে জলাঞ্জলি দিতে হল। পৃথিবীর সব রং মুছে গেল।

.

সন্ধ্যার সময়ে বৈশালী আর সুজিত দুজনে এসে আসরে বসল।

এখানকার আসর জমজমাট। পুরুষ আর মহিলাদের আলাদা অবস্থা। সুজিত একদিকে বসল। বৈশালী অন্যদিকে।

এবারের আকর্ষণের কারণ আছে।

মঞ্চে হিমাংশু ভট্টাচার্য, তাকে ঘিরে অনেকগুলো মেয়ে। হিমাংশু ভট্টাচার্য গাইছে, আর মেয়েরা কোরাসে অনুসরণ করছে।

বৃন্দাবনের জীবন। শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে গেছেন। তাঁর বিরহে বৃন্দাবনের গাছপালা, পশুপক্ষী বেদনায় মুহ্যমান। গোপিনীরা উন্মত্তপ্রায়।

সেই বেদনা সংগীতের কথায়-সুরে মূর্ত হয়ে উঠেছে।

বৈশালী এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখল।

পুরুষদের জায়গায় একেবারে কোণের দিকে মং শান বসে। একমনে গান শুনছে। কী বুঝছে কে জানে।

বৈশালী পাশে বসা মহিলাদের দিকেও দেখল।

বেশির ভাগই গ্রাম্য বধূ আর মেয়ে। তারাও গানে তন্ময়।

বৈশালী আস্তে আস্তে উঠল। কেউ লক্ষ করছে না। একটু দাঁড়িয়ে আসর থেকে বেরিয়ে এল।

চাকরবাকর কেউ ধারেকাছে নেই।…

বৈশালী সিঁড়ি দিয়ে উঠল। সামনেই মং শানের ঘর। দরজা ভেজানো।

হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। ঘর অন্ধকার।

একবার পিছনদিকে দেখে বৈশালী ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

অন্ধকার চোখে সহ্য হতে আরও এগিয়ে গেল সে।

ব্লাউজের মধ্যে থেকে পেনসিল টর্চ বের করল।

প্রথমে টেবিলের ওপর, তারপর আলমারির দিকে আলোর রেখা ঘুরতে লাগল। ড্রয়ার টেনে দেখল, বন্ধ।

দেওয়ালের তাকে হাত বোলাতে বোলাতে হাতে কতকগুলো কাগজ উঠে গেল। টর্চের আলোয় সেগুলোর ওপর নজর বুলিয়েই ব্লাউজের মধ্যে সেগুলো রেখে দিল।

তারপর হাত বাড়িয়ে তাকের ওপর আরও জিনিসের খোঁজ করতে যাবার আগেই বাইরে জোর পায়ের শব্দ।

দরজা খুলে গেল। বাইরের আলোর রেখার কিছুটা ঘরের মধ্যে এসে পড়ল।

বৈশালী ত্বরিত পায়ের কোণের দিকের পরদার আড়ালে আত্মগোপন করল।

ভাগ্য ভালো বৈশালীর। মং শান বেশিক্ষণ ঘরের মধ্যে রইল না। টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

বৈশালী এতক্ষণ নিশ্বাস রোধ করে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা হাত কোমরে। যেখানে আগ্নেয়াস্ত্রটা আটকানো।

কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে যখন পরদার আড়াল থেকে বাইরে এসে দাঁড়াল, তখন তার সারা দেহ ঘামে সিক্ত। খুব সন্তর্পণে ঘরের বাইরে এল। আর কীর্তনের আসরে নয়, বৈশালী অতিথি-কুটিরে চলে এল।

সুজিত আসরে বসে রয়েছে।

বৈশালী প্রথমে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল। তারপর টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে কাগজগুলো নিয়ে বসল।

গোটা পাঁচ-ছয় কাগজ। একটা লন্ড্রির বিল, একটা শার্টের ক্যাশ মেমো আর একটা চামড়ার ছোটো ওয়ালেট। কাগজের সঙ্গে চলে এসেছে।

ওয়ালেটে একটা ঠিকানা—ধর্মতলা স্ট্রিটের কোনও এক হামিদ আলির। আর একটা খাম। ওপরে কোনও নাম নেই।

ছোটো ছোটো ভাঁজ করা অনেকগুলো কাগজ। সবগুলো ইংরেজিতে লেখা।

পড়তে পড়তে বৈশালীর দুটি ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে এল। দৃঢ়সংবদ্ধ ঠোঁট। চিঠিগুলো রেখে ওয়ালেটটা ঝাড়ল। যদি কিছু আটকে থাকে।

শুকনো একটা ফল পড়ল বৈশালীর কোলের ওপর।

সাবধানে ফলটা তুলে ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা শিশি বের করে তার মধ্যে রেখে দিল।

আর-একটা কাজ বাকি।

একটা চিঠি সরিয়ে রেখে অন্য কাগজগুলো ওয়ালেটের মধ্যে ভরে নিল।

এখন এই ওয়ালেটটা মং শানের ঘরে রেখে আসতে হবে। যেমন করে পারে।

দরজা বন্ধ করে বৈশালী বাইরে বেরিয়ে এল।

আসরে এসে দেখল, মং শান একভাবে বসে আছে। সুজিত নেই।

চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখল, অতীনও নেই।

অথচ সুজিতকে এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন।

মঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখল। হাত জোড় করে দীপালি চুপচাপ বসে আছে।

বৈশালী যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, তখন দেখল, গেট দিয়ে সুজিত আর অতীন ঢুকছে।

বৈশালী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গিয়েছিলে?

সুজিত হাসল।

দুজনেরই গান ভালো লাগে না, তাই বেড়াতে বেরিয়েছিলাম।

অতীনের দিকে ফিরে বৈশালী গম্ভীরকণ্ঠে বলল, আপনি গান ভালোবাসেন না? শেকসপিয়র বলেছেন, যারা গান ভালোবাসে না, তারা মানুষ খুন করতে পারে।

অতীন কিছুক্ষণ বৈশালীকে জরিপ করল, তারপর বলল, আশা করি রহস্য করছেন।

বৈশালী এ কথার উত্তর দিল না। সুজিতকে বলল, একটা কথা আছে।

অতীন ইঙ্গিতটা বুঝল। আসরের মধ্যে গিয়ে বসল।

সুজিত, একটা কাজ করতে হবে।

কী বলো?

মং শানকে কথায় কথায় আটকে রাখতে পারো?

কেন?

ওর ঘরে আমার যাওয়া দরকার।

সর্বনাশ, ওসব করতে যেয়ো না, বিপদে পড়বে।

কিছু হবে না। শীঘ্র যাও। সময় নেই।

সুজিত মং শানের দিকে এগিয়ে গেল।

মং শানের পাশের চেয়ারে বসে বলল, আচ্ছা, আপনি তো বাংলা বোঝেন না।

উঁ, না।

তবে কী শুনছেন?

সুরটা আমার খুব ভালো লাগছে।

আপনাদের দেশে গানবাজনার চল আছে?

আছে বই কী। পোয়ে নাচ আছে। তার সঙ্গে গানও হয়।

যাক, আসল কথাটা আপনাকে বলি।

বলুন।

আপনাকে এই সময় বিরক্ত করছি বলে কিছু মনে করবেন না।

না, না, বলুন কী কথা?

আমার একটা পাথর দরকার।

এতক্ষণ পরে মং শানের চোখে-মুখে আগ্রহ ফুটে উঠল।

আমাকে জ্যোতিষী বলেছেন, ক্যাট’স আই ব্যবহার করতে।

মং শানের চোখে একটু যেন অবিশ্বাসের রেখা।

কলকাতা শহরে ক্যাট’স আই পাচ্ছেন না?

পাচ্ছি, কিন্তু কিনতে সাহস হচ্ছে না।

কেন?

যদি ঠকি!

বেশ, আপনার ঠিকানা দিন, আমি দেখা করব।

সুজিত পকেট থেকে কলম বের করে একটা কাগজে খসখস করে ঠিকানা লিখে দিল।

মং শান ঠিকানাটা রেখে দিল।

সুজিত একসময় আড়চোখে তাকিয়ে দেখল বৈশালী আসরের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

সে উঠে দাঁড়াল।

মং শানকে বলল, ধন্যবাদ। দিন সাতেক পরে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন।

সুজিত বৈশালীর সামনে এসে দাঁড়াল। চাপাকণ্ঠে বলল, হয়ে গেছে?

হুঁ। শোনো, এদিকে এসো।

সুজিত বৈশালীর দিকে সরে এল।

আজ রাত্রেই আমরা রওনা হব।

আজই রাত্রে?

হ্যাঁ। চলো, তৈরি হয়ে নিই।

এঁরা কী ভাববেন?

কিছু একটা বলে গেলেই হবে। তুমি যাও, আমি আসছি।

সুজিত চলে যেতে, বৈশালী দীপালির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।

দীপালি ফিরে দেখল।

কিছু বলবেন?

একটু কথা ছিল।

দীপালি উঠে এল।

আমরা আজ রাত্রেই কলকাতায় ফিরে যাব।

সে কী? আজই?

হ্যাঁ, জরুরি দরকার। যেতেই হবে।

আমাদের কেসের কী হবে?

আমি দিন সাতেক পরে আবার আসছি।

তার আগে তো অতীন পালাবে।

তিনি যাতে না পালাতে পারেন তার ব্যবস্থা করে যাব।

আপনাকে আগাম কিছু টাকা দেবার কথা ছিল।

আমি সাত দিন পরে এসে নেব।

রাত্রে আহার করে যাবেন।

আমরা পথে খেয়ে নেব। আপনি কিছু মনে করবেন না। আতিথেয়তার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

বৈশালী দুটো হাত যুক্ত করে নমস্কার করল।

আধ ঘণ্টার মধ্যে বৈশালী আর সুজিত বেরিয়ে পড়ল।

বৈশালী থানায় একবার নেমে ও.সি.-র সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নিল।

কিছুক্ষণ পরেই ও.সি. দুটি পুলিশ সঙ্গে নিয়ে ভুবন-নিবাসে ঢুকল।

তখন আসর শেষ। লোকেরা উঠতে আরম্ভ করছে।

ও.সি. অতীনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আপনি অতীন বাজপেয়ি?

সামনে পুলিশ দেখে অতীন একটু বিব্রত হল।

বলল, হ্যাঁ।

আপনি দশ দিন সকাল-বিকাল থানায় হাজিরা দেবেন।

সে কী? আমাকে যে বর্মায় ফিরে যেতে হবে।

আপনার ফিরে যাওয়া এখন সম্ভব নয়। আইনের প্রয়োজনে আপনাকে থাকতে হবে।

আমার অপরাধ?

যথাসময়ে জানতে পারবেন।

অতীন এবার রীতিমতো বিরক্ত হল।

আপনাদের এ অন্যায় আদেশ আমি মানি না।

ও.সি.-র কণ্ঠস্বর যথেষ্ট গম্ভীর।

আমাদের আদেশ আমরা জানিয়ে গেলাম। এরপর আমি যা করবেন নিজের দায়িত্বে। তার ফল কী হবে, নিশ্চয় বোঝবার মতন বুদ্ধি আপনার আছে।

পুলিশ নিয়ে ও.সি. চলে যাবার পর অতীন নিষ্ফল গর্জন শুরু করল। বৈশালীর বাপান্ত।

মং শানকে দেখতে পেয়ে বলল, দেখলে ঝামেলা। কাজকর্ম ফেলে দু-বেলা থানায় হাজিরা দাও। কেন, আমি কি চুরির দায়ে ধরা পড়েছি!

মং শান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কোনও উত্তর দিল না।