।। ছয় ।।
কম্পাসের কাঁটার উত্তরদিকে দেখানোর মতন, দীপালিদেবী আর মং শান দুজনেরই লক্ষ্য যেন অতীন বাজপেয়ি।
বৈশালী বলল, চলো, আমরাও বেরিয়ে আসি।
কোথায়? সুজিতের জিজ্ঞাসা।
জায়গাটা ঘুরেফিরে একবার দেখে আসি।
মিনিট পনেরোর মধ্যে বৈশালী মোটর নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পাশে সুজিত।
খুব ছোটো জায়গা। শিলার প্রাচুর্য আছে, তবে গড় কেন তা বোঝা গেল না। মাঝে মাঝে ব্লাস্টিং-এর শব্দও ভেসে আসছে। মারোয়াড়ি আছে, তার ওপর বাঙালি, বিহারি।
মোটর রাস্তার ওপর রেখে দুজনে একটা কাপড়ের দোকানে গিয়ে বসল।
মারোয়াড়ি দোকানের মালিক কাপড় দেখাতে দেখাতে প্রশ্ন করল, আপনাদের এখানে নতুন দেখছি।
সুজিত বলল, হ্যাঁ, আমরা ভুবন বাজপেয়ির কাছে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছি।
আপনারা কি ভুবনবাবুর আত্মীয়?
না, তাঁর সঙ্গে আমাদের পাথরের ব্যাবসার লেনদেন ছিল।
মালিক বিজ্ঞের মতন ঘাড় নাড়ল।
ওঁর কয়লা আর মাইকার ব্যাবসায় মন্দা পড়াতে ইদানীং স্টোনের ব্যাবসার দিকে ঝুঁকেছিলেন।
বড়ো আপশোসের ব্যাপার। এইভাবে ওঁর আকস্মিক মৃত্যু!
মালিক বৈশালীর কথায় সায় দিল।
বড়ো ধার্মিক লোক ছিলেন। অনেককালের বাসিন্দা। তাঁর সব সওদা এখান থেকেই করতেন।
দুটো বিছানার চাদর কিনে বৈশালী আর সুজিত উঠে পড়ল।
মোটর উঠে সুজিত জিজ্ঞাসা করল, এরপর?
এরপর ভুবন-নিবাস। দীপালিদেবী আমাদের ভুবনবাবুর শোবার ঘর দেখাবেন।
অতিথি-কুটিরের সামনে এসেই দেখল, একজন ভৃত্য দাঁড়িয়ে আছে।
মা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
চলো, যাচ্ছি।
মুখ-হাত ধুয়ে পোশাক বদলে দুজনে ভুবন-নিবাসে চলে এল।
দোতলার বারান্দার কাছে দীপালি দাঁড়িয়েছিল।
আসুন, আসুন। বেরিয়েছিলেন বুঝি?
সমস্ত দিন আটকে আছি, তাই একটু এদিক-ওদিক ঘুরে এলাম।
আসুন, ওঁর ঘরটা দেখিয়ে আনি।
একদিকে খাট। কোণের দিকে একটা সিন্দুক। তাতে সিঁদুরের দাগ। দেয়ালে ভুবন বাজপেয়ির ফোটো। মোটা বেল ফুলের মালা দুলছে।
মাঝখানে কাচে ঢাকা সেন্টার টেবিল ঘিরে গোটা দুয়েক চেয়ার।
আপনি কোথায় থাকেন?
বৈশালীর প্রশ্নে দীপালি একটু বুঝি আরক্তিম হল, মৃদুকণ্ঠে বলল, পাশের ঘরে।
ময়ূরটা এই সিন্দুকেই ছিল?
দীপালি মাথা নাড়ল। সম্মতিসূচক।
আপনি কোনওদিন সিন্দুক খুলেছেন? ভুবনবাবুর অনুপস্থিতিতে?
না, তার প্রয়োজন হয়নি। আমার চাবি দিয়ে অনেকবার খুলেছি, তবে ওঁর সামনে।
আপনার গয়নাগাটি কি এই সিন্দুকে থাকে?
না, ব্যাঙ্কে থাকে। প্রয়োজনমতো আমি আনিয়ে নিই।
ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করে বৈশালী জিজ্ঞাসা করল, অতীনবাবু কোথায় থাকেন?
দোতলায় পিছনদিকে।
আচ্ছা, ভুবনবাবুর সঙ্গে অতীনবাবুর যে বচসা হয়েছিল সেটার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন?
বাংলার শুরু হলেও দুজনে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন।
ইংরেজি ঠিক ঠিক বুঝতে আপনার কোনও অসুবিধা হয়নি?
একটু চুপ করে থেকে দীপালি উত্তর দিল, আমি গ্র্যাজুয়েট।
ও, ওঁরা কি সম্পত্তি সম্বন্ধে কথা বলছিলেন?
হ্যাঁ, অতীন বলছিল, বিষয়ের অংশ তাকে ভাগ করে দিতে হবে।
আর-একটা কথা—।
কী বলুন?
ভুবনবাবুর কোনও উইল আছে?
যতদূর জানি, নেই।
থাকলে এই সময় নিশ্চয় আপনি জানতে পারতেন।
পারতাম। আমাদের অ্যাটর্নি মিস্টার মজুমদারের কাছে খোঁজ নিয়েছিলাম। তিনি বললেন, কোনও উইল নেই।
আশ্চর্য!
কেন, আশ্চর্য কেন?
যতদূর জানতাম, ভুবনবাবু বিচক্ষণ ব্যক্তি। এসব কাজ তাঁর সম্পূর্ণ করে রাখাই উচিত ছিল। কাল থেকে তো আপনারা খুব ব্যস্ত থাকবেন?
হ্যাঁ, তা থাকব। সন্ধ্যার সময় ভালো কীর্তন আছে। যদি এ বিষয়ে আগ্রহ থাকে, আসরে আসবেন।
কলকাতা থেকে কেউ আসছেন?
কীর্তন-বিশারদ হিমাংশু ভট্টাচার্য আসবেন।
ঠিক আছে, থাকব।
দীপালির নির্দেশে ভৃত্য দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল।
অতীনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন? দীপালি বলল।
মোটামুটি।
দু-একদিনের মধ্যে তো সে বর্মায় ফিরে যাবে।
প্রয়োজন হলে ফিরে যাওয়া আমরা বন্ধ করে দেব।
মনে হল দীপালির চোখে-মুখে চাপা আনন্দের আভাস।
একেবারে হঠাৎ বৈশালী প্রশ্ন করল, আচ্ছা, মং শান লোকটি কেমন?
দীপালি ভ্রূ কুঞ্চিত করল।
অতীনের শাগরেদ আর কত ভালো হবে। তবে ওর সঙ্গে ভিতরের বাড়ির কোনও যোগাযোগ নেই। যখন আসে বাইরের ঘরেই থাকে। ভুবনবাবুর সঙ্গে পাথরের কেনা-বেচায় ওর যোগাযোগ ছিল। তবে এমন কিছু নয়। প্রথমদিকে কয়েকটা পান্না কেনার ব্যাপারে সাহায্য করেছিল।
থেমে গিয়ে দীপালি বলল, আমি চলি, ঠাকুরঘরে বাতি দিতে হবে।
বৈশালী আর সুজিত সামনের বাগানে এসে দাঁড়াল।
মণ্ডপ তৈরি শেষ। একটা বেদির ওপর ভুবনবাবুর ফোটো রাখা হয়েছে। কাল পুষ্পভূষিত করা হবে।
সকাল থেকে অনুষ্ঠান শুরু। অতীন মণ্ডপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তদারক করছে।
বৈশালীদের দেখে অতীন এগিয়ে এল।
কী, কাল আছেন তো?
হ্যাঁ, কালকের দিনটা থাকব। দীপালিদেবী থাকবার জন্য বিশেষ করে অনুরোধ করেছেন। একজন বিখ্যাত কীর্তনীয়া আসছেন।
বাবার হত্যাকাণ্ডের কোনও সুরাহা হল?
কই আর হল? ওসব তো পুলিশের কাজ।
আপনার কী কাজ?
বৈশালী হাসল। বলল, ময়ূর উদ্ধার করা।
তার কিছু হল?
এখনও কাজের ভার নিইনি। কথা ছিল, শিলাগড় দেখে তবে কাজটা নেব কি না বলব।
ময়ূর উদ্ধারের চেয়েও আমি কিন্তু বাবার হত্যাকারীর হদিশ পেতে বেশি ইচ্ছুক।
স্বাভাবিক। আপনি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
দেখি।
ডেকরেটরের একটা লোকের দিকে অতীন এগিয়ে গেল।
.
রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর বেতের চেয়ারে দুজন বসে ছিল। বৈশালী আর সুজিত।
সুজিত হেসে বলল, কী গোয়েন্দা সাহেবা, কেসের কোনও কিনারা হল?
কই আর হল? আর এত সহজে কি হয়?
কীরকম?
সস্তা গোয়েন্দা কাহিনি পড়োনি? এতক্ষণে গোয়েন্দার কানের পাশ দিয়ে গোটা তিনেক বুলেট ছুটত। চায়ে চুমুক দিয়ে একজন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত। সেসব তো কিছুই হল না। একেবারে নিরামিষ ব্যাপার। আরে!
বৈশালী একটা হাত বাড়িয়ে সুজিতের হাত টিপে দিল।
সুজিত চাপা গলায় প্রশ্ন করল, কী?
ভুবন-নিবাসের দোতলায় দেখো।
সুজিত চোখ তুলে দেখল।
অন্ধকার রাত। দু-একটা নক্ষত্রের ম্লান দীপ্তি। দোতলার পিছনদিকের বারান্দায় অন্ধকার মূর্তি।
তার হাতে একটা টর্চ। মনে হচ্ছে টর্চ নেড়ে সে যেন ইশারা করছে।
বৈশালী উঠে বাগানের ধারে গেল।
বাগানের সীমানার বাইরে উঁচু-নিচু জমি। কয়লার খাদের কাছাকাছি এলাকা যেমন হয়। পিছনে টিলা।
ছোটো একটা ঢিপির পাশ থেকে আর-একটা টর্চের আলো দেখা গেল। একবার জ্বলছে, আর-একবার নিভছে।
এদিকের ইশারার উত্তর।
মিনিট পনেরো। তারপর সব চুপ। বারান্দার লোকটা সরে গেল। বাইরের টর্চের আলোও আর জ্বলল না।
বৈশালী চেয়ারে ফিরে এল।
কী বুঝলে?
আলোর সংকেত বলে মনে হল।
আরে সে তো অন্ধও বলতে পারো। বারান্দার লোকটি কে?
অন্ধকারে আর দেখতে পেলাম কোথায়?
না, সহকারী হিসাবে তুমি একটা অপদার্থ।
বেশ, গোয়েন্দা হিসাবে তুমিই বলো?
বৈশালী হাসল। চরণ আসুক, তারপর বলব।
চরণ একটু পরেই এল, কুঁজোয় ঠান্ডা জল ভরতে।
বৈশালী জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা চরণ, ওই পিছনদিকের ঘরে কে থাকেন? ওই যে বারান্দা দেখা যাচ্ছে।
চরণ একবার চোখ তুলে দেখে বলল, দাদাবাবু। ওটা দাদাবাবুর ঘর।
চরণ চলে গেলে সুজিত বলল, আর দেরি নয় বৈশালী, অতীনবাবুর ঘরটা সার্চ করা যাক?
রহু ধৈর্যং। অত তাড়াহুড়ো কোরো না।
পরের দিন সকালে বৈশালী চা-পানের আগেই ভুবন-নিবাসে এসে হাজির হল।
সোজা দোতলায় উঠে সামনে একটা ভৃত্যকে দেখে বলল, আমি অতীনবাবুর সঙ্গে দেখা করব।
দাদাবাবু এখনও ওঠেননি।
তুমি ওঠাও। বলো জরুরি দরকার।
ভৃত্য আর কিছু বলল না। এগিয়ে গেল।
বৈশালী তাকে অনুসরণ করল।
বেশ কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দেবার পর ভিতর থেকে জড়ানো গলার শব্দ শোনা গেল।
কে?
বৈশালী উত্তর দিল। দরজাটা দয়া করে খুলবেন। খুব দরকার।
দরজা খুলে গেল।
চৌকাঠের ওপারে রাত্রিবাস পরিহিত অতীন। দুটো চোখ বেশ লাল। দৃষ্টি কিঞ্চিৎ উদ্ভ্রান্ত।
দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বৈশালী ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
আপনার সঙ্গে কতকগুলো কথা আছে।
আমাকে ডেকে পাঠালেই পারতেন।
বৈশালী চোখ বুলিয়ে ঘরের অবস্থাটা দেখে নিল। কোণের দিকে গোল টেবিলে একটা মদের বোতল। পাশে গ্লাস। দুটোই শূন্য।
একটু বাইরে আসবেন?
কোথায়?
বারান্দায়।
অতীন পিছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তার সামনে বৈশালী।
কাল একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম।
কী?
আপনি একটু দাঁড়ান এইখানে।
বৈশালীর নির্দেশমতো অতীন দরজার পাশে দেয়ালের ধারে দাঁড়াল।
ওই যে উঁচু-নিচু ঢিপি দেখছেন, কাল রাতে ওখান থেকে কে যেন টর্চের আলো ফেলছিল।
ফেলতে পারে। টর্চ হাতে লোকেরা আনাগোনা করে, তাদের হাতের আলো এদিক-ওদিক পড়তে পারে।
না, আনাগোনার আলো নয়। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যেন আলোর সংকেত করছিল।
ক-টার সময়?
রাত সাড়ে দশটা।
সাড়ে দশটা? জানি না, আমি তখন বাড়ি ফিরিনি।
তাহলে ভুলই দেখেছি হয়তো। সাতসকালে আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
মুখে অতীন না বললেও, তাকে দেখে এটুকু বোঝা গেল, ভোরবেলা অযথা ঘুমটা ভাঙিয়ে দেওয়াতে সে মোটেই খুশি হয়নি।
বৈশালী নেমে এল।