উপন্যাস
গল্প

পাথরের চোখ – ৪

।। চার।।

দীপালি ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পরও একটা দামি সুরভি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। শোকাচ্ছন্ন পরিবেশে এ ধরনের উগ্র গন্ধসার কিছু পরিমাণে অস্বাভাবিক।

বৈশালী জানলায় গিয়ে দাঁড়াল।

রাস্তার ওপর হালকা নীল অ্যাম্বাসাডর। উর্দি-পরা এক ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে।

দীপালি মোটরে উঠল।

মোটর রওনা হয়ে যেতে বৈশালী কৌচে ফিরে এল। এখন আর কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। বৈশালী চুপচাপ বসে রইল।…

আসতে পারি ম্যাডাম?

কণ্ঠস্বরেই চেনা গেল, তবু বৈশালী মাথাটা ঘুরিয়ে দেখল।

আরে এসো, এসো, তোমার কথাই ভাবছিলাম।

সুশ্রী, গৌরবর্ণ দীর্ঘ চেহারার একটি যুবক ঢুকল।

পরনে সাদা টেরিলিনের শার্ট, চকোলেট রঙের টেরিকটের প্যান্ট। উজ্জ্বল দুটি চোখ, ঠোঁটের গড়নে হাসি মাখানো।

সুজিত। বিদেশি একটা ফার্মের কেমিস্ট। বৈশালীর সঙ্গে আলাপ বিলাতে।

এসো কেমিস্ট, তোমার কথাই ভাবছিলাম।

কী ভাগ্য আমার!

সুজিত এসে বৈশালীর পাশে বসল।

একটা মুশকিলে পড়েছি। বৈশালী বলল।

তোমার কাজই তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

শিলাগড়ের কেসটা শুনেছ?

দোহাই তোমার। আমাকে ওয়াটসন তৈরি কোরো না। আমি নিজের কাজ নিয়ে যথেষ্ট বিব্রত আছি।

কী খাবে বলো?

আপাতত এক কাপ চা দিয়ে তো শুরু করো।

বৈশালীকে উঠতে দেখে সুজিত বলল, আহা, তুমি উঠছ কেন? বাহাদুরকে বলে দাও-না।

কিন্তু বৈশালীকে উঠতেই হল। টেলিফোনটা ঝংকার তুলে চলেছে।

বৈশালী ফোন তুলে চুপ করে কী শুনল, তারপর বলল, সে কী, ডাক্তার কী বলে?

তারের ওপার থেকে কী উত্তর এল শোনা গেল না।

বৈশালীর মুখ রীতিমতো করুণ ঠেকল।

একটু পরে বৈশালী কৌচে ফিরে এল।

সুজিত কিছুক্ষণ তাকে জরিপ করে বলল, খারাপ খবর?

হুঁ। শিলাগড়ের ভুবন বাজপেয়ি কিছুদিন আগে নিহত হয়েছেন। আজ সত্যেনবাবু বললেন, তাঁর ড্রাইভারটিও মারা গেছে।

সে-ও কি গুলিতে নাকি?

না, কী একটা নারকোটিক প্রয়োগে তাকে প্রায় বোবা করে রাখা হয়েছিল। সেই অবস্থাতেই হাসপাতালে মারা গেছে।

যাক, তোমার একটা সুবিধা হল। সুজিত বলল।

কী সুবিধা?

সম্ভাব্য অপরাধীর সংখ্যা একজন কমল।

কমল?

তা ছাড়া আর কী! তোমরা তো থিয়োরি অব এলিমিনেশন নীতি অনুসরণ করো। কতকগুলো সম্ভাব্য অপরাধীর তালিকা ঠিক করো, তারপর বাদ দিতে দিতে মারাত্মক এক অবস্থায় উপনীত হও।

কী মারাত্মক অবস্থা?

শেষ পর্যন্ত দেখা যায় শুধু গোয়েন্দাই বাকি আছে।

কথা শেষ হতে দুজনেই হেসে উঠল।

বৈশালী বলল, এক কাজ করো।

কী?

আজ রাতে এখানে খেয়ে যাও।

আপত্তি নেই। তবে মা-কে একবার ফোন করে দিতে হবে।

ঠিক আছে। মাসিমাকে আমি বলে দিচ্ছি।

বৈশালী উঠে গিয়ে ফোন করে এল।

তারপর ফিরে এসে কৌচের ওপর ভালোভাবে বসে বলল, সুজিত, অফিস থেকে ক-দিন ছুটি নিতে পারবে?

তা পারি। কেন, দার্জিলিং যাবে?

না, শিলাগড়।

কপট আক্ষেপে সুজিত নিজের কপাল চাপড়াল।

হা হতোস্মি। আমি ভাবলাম, দারুণ অগ্নিবাণে রে, আমাকে নিয়ে শৈলবাসে যাবার বাসনা, তা নয়, সেই শিলাগড়। তোমার ঘটনাস্থলে।

চলোই-না। রহস্যটা দেখে আসা যাক।

তথাস্তু।

.

দিনকয়েক পরে বৈশালীর মোটর শহরের বিখ্যাত জুয়েলার্স রতনরাম রাজঘরিয়ার দোকানের সামনে থামল।

বৈশালী নামতেই কর্মচারীরা এগিয়ে এল।

বৈশালী জিজ্ঞেস করল, পুনমচাঁদ আছেন?

হ্যাঁ, আছেন।

বৈশালী তার নামের কার্ড এগিয়ে দিল।

এটা দিয়ে দেবেন।

কার্ড পাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রোপ্রাইটার পুনমচাঁদ বেরিয়ে এল।

আসুন বৈশালীদেবী, গরিবের দোকানে কী মনে করে?

পুনমচাঁদের পিছন পিছন বৈশালী তার কামরায় ঢুকল।

সারি সারি লোহার সিন্দুক। সামনে কাচে ঢাকা টেবিল। তার ওপর গোটা তিনেক আতশকাচ।

কী খাবেন বলুন? একটা কোকাকোলা আনাই?

কিছু লাগবে না। আপনার কাছে একটা কথা জানতে এলাম।

বলুন, বলুন।

আপনাদের কারবার তো বহুদিনের।

হ্যাঁ, আমার ঠাকুরদা এর পত্তন করেন। এখন তো আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে একরকম চলছে। লন্ডনেও আমাদের ব্রাঞ্চ আছে। তবে একটা কথা, রাজরাজড়াদের যুগ শেষ হয়ে যাবার পর তেমন দরাজ-দিল খরিদ্দার নেই। মনে আছে, বাবা গায়কোয়াড়কে একটা হিরা বিক্রি করেছিলেন এক লক্ষ সাঁইত্রিশ হাজার টাকায়। এখন আর সেসব লোক কোথায়?

আচ্ছা চুনি কোন দেশের সবচেয়ে ভালো?

চুনি? বর্মার চুনিরই নাম খুব বেশি। ওখানকার মোগক মাইন বিখ্যাত।

সবচেয়ে মূল্যবান চুনি কত টাকায় বিক্রি হয়েছে বলতে পারেন?

এক মিনিট। আমাকে বই দেখে বলতে হবে।

পুনমচাঁদ ড্রয়ার খুলে কালো মোটা একটা বই বের করল।

হিন্দিতে ‘রত্নদর্পণ’ বলে একটা পত্রিকা প্রকাশিত হত, তার বেশ কয়েক বছরের সংখ্যা একত্রে বাঁধানো। কিছুক্ষণ ধরে পাতা ওলটাতে ওলটাতে পুণমচাঁদ এক জায়গায় থামল।

বলল, এই যে এখানে রয়েছে। চুনির দাম নিরূপিত হয় তার ঘন রক্তাভা আর গঠনসৌকর্যের ওপর। সবচেয়ে মূল্যবান চুনি ছিল সুপিয়ালার ব্রোচে। বর্মার শেষ স্বাধীন রাজা থিব। তাঁর পত্নী রানি সুপিয়ালা। বর্মার পতনের পর এক জেনারেল বিলাতে লেডি ব্রুমফিল্ডের কাছে এই চুনিটা বিক্রি করে ত্রিশ হাজার টাকায়। তবে এ কথাও এখানে লেখা আছে, সব দিক বিবেচনা করে দেখলে এর দাম পনেরো হাজারের বেশি হওয়া অনুচিত।

তাহলে জহুরিদের মতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো চুনির মূল্য পনেরো হাজারের বেশি নয়?

তা-ই তো লিখেছে।

আচ্ছা চলি।

উঠবেন? আপনার শরীর ভালো আছে?

ভালোই আছে। ধন্যবাদ।

বৈশালী মোটরে উঠল।

বাড়ি ফিরল না। সোজা গেল ন্যাশনাল লাইব্রেরি। সেখানে বই খুলে কিছু নোট নিল।

পুনমচাঁদ ঠিকই বলেছে, চুনির দাম খুব বেশি নয়।

সবচেয়ে মহার্ঘ চুনির যদি এই মূল্য হয় তাহলে ময়ূরের রুবির চোখের কত দাম হবে? একটা পাথর খুব বেশি হলে পাঁচ হাজার। তার বেশি নয়।

আসল ময়ূরটা থাকলে জহুরিদের কাছে যাচাই করে নেওয়া যেত। এখন আর সেটা সম্ভব নয়।

এই সামান্য টাকার জন্য এত বড়ো হত্যাকাণ্ড। দুটো প্রাণ বিনষ্ট হল।

বৈশালীর মনে হল, এর মধ্যে আর কোনও রহস্য আছে। গূঢ়তর কিছু।

দিন দুয়েক পরেই ট্রাঙ্ককল এল। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি।

বৈশালীর ঘুম খুব সজাগ। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল।

শিলাগড় থেকে দীপালি বাজপেয়ি।

বলুন, আমি বৈশালী কথা বলছি।

অতীন কাল এসেছে। আমার স্বামীর কাজ মঙ্গলবার। আপনি আজ আসতে পারবেন?

আজ পারব না। কাল ভোরে রওনা হব। ঘণ্টা পাঁচেক লাগবে বোধহয়।

ওইরকম।

আমার সঙ্গে একটি ভদ্রলোক থাকবেন।

ঠিক আছে। শুনুন, বলে দিই, আসানসোল পার হবার পর সোজা রাস্তাটা গেছে ধানবাদের দিকে। আপনি বাঁদিকের রাস্তাটা ধরবেন। শিলাগড়ে পৌঁছে ভুবন-নিবাসের নাম করলেই সবাই দেখিয়ে দেবে। তাহলে কাল আসছেন?

হ্যাঁ।

দীপালি লাইন ছেড়ে দিল।

বেলা আটটা নাগাদ বৈশালী দুটো ফোন করল।

একটা সুজিতকে। কাল রওনা হবার কথা জানাল। ভোর পাঁচটায় বৈশালী রওনা হবে। সুজিতকে বাড়ি থেকে তুলে নেবে। সে যেন তৈরি থাকে।

দ্বিতীয় ফোন করল সত্যেন রায়কে। কুশল প্রশ্নের পর খোঁজ নিল, ভুবন বাজপেয়ির খুনের কোনও কিনারা হল? কই আর হল? দুজনকে সন্দেহক্রমে ধরা হয়েছে। পুলিশ তাদের ধোলাই দিয়েছে।

আর কিছু?

কতকগুলো জহুরির দোকানে খানাতল্লাশি করা হয়েছে। এরাই সব চোরাই পাথর কেনা-বেচা করে, কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি। তুমি কিছু কিনারা করতে পারলে?

না, কাল আমি শিলাগড় যাচ্ছি।

পুলিশের সাহায্য দরকার?

পুলিশের সাহায্য?

মানে, সাদা পোশাকে বডিগার্ড?

না, না। সেসবের দরকার নেই। সুজিত যাচ্ছে আমার সঙ্গে।

পরের দিন ভোর চারটে থেকে বৈশালী তৈরি হতে লাগল। পোশাক পরা শেষ হতে কোমরের চামড়ার বন্ধনীর সঙ্গে ছোটো রিভলভার আটকে নিল। এটা বিদেশ থেকে কেনা। এ ধরনের কাজে বৈশালীর সঙ্গে সঙ্গে থাকে। তবে এ পর্যন্ত ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়নি।

সুজিতের বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখল, গেটের সামনে সুজিত দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে তার মা।

বৈশালী মোটর থেকে নেমে সুজিতের মা-কে প্রণাম করল।

আপনি আবার এত ভোরে উঠেছেন কেন মাসিমা?

সুজিতের মা হাসল।

ও মা, উঠব না। তুমি জয়যাত্রায় চলেছ। খুব সাবধান মা। চারদিকে চোখ-কান সজাগ রেখে চলাফেরা করবে।