পাতালপুরী

পাতাল দেশটা কোথায় তাহা আমি জানি না। অনেকে বলেন আমেরিকার নামই পাতাল। সে যাহাই হউক, মোটের উপর পাতাল বলিতে আমরা বুঝি যে, আমাদের নিচে একটা কোন জায়গা—আমরা এই যে মাটির উপর দাঁড়াইয়া আছি, তার উপরে যেন স্বর্গ আর নিচে যেন পাতাল!
এখানে যে জায়গার কথা বলিতেছি সেটাকে পাতালপুরী বলা হইল এইজন্য যে সেটা মাটির নিচে। মাটির নিচে ঘরবাড়ি, মাটির নিচে রেলগাড়ি, মাটির নিচে হোটেল সরাই গির্জা—সমস্ত সহরটাই মাটির নিচে। সহরটা কিসের তৈয়ারি জান? নুনের! আসলে সেটা একটা নুনের খনি। অস্ট্রিয়ার কাছে—মাটির নিচে এই অদ্ভুত সহর। হাজার হাজার বৎসর লোকে এই খনিতে খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া লবণ তুলিয়াছে। এখনও প্রতি বৎসর এই খনি হইতে প্রায় বিশ লক্ষ মণ লবণ বাহির হয়—কিন্তু তবু লবণ ফুরাইবার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। মাটির নিচে পঁচিশ মাইল চওড়া ৫০০ মাইল লম্বা লবণের মাঠ। খুঁড়িয়া দেখা গিয়াছে এক হাজার ফুটের নিচেও লবণ।
খনির মধ্যে খানিকটা জায়গায় বড় সুরঙ্গ কাটিয়া পথঘাট কর হইয়াছে তাহার মাঝে মাঝে এক-একটা বড় ঘরের মতো। খনিটা ঠিক যেন একটা সাততালা পুরী, তার নিচের চারতালায় কুলিরা কাজ করে, উপরের তিনতালায় লবণ ফুরাইয়া আসিয়াছে—সেখানে এখন লোকে তামাসা দেখিতে আসে।
খনির মুখে ঢুকিলেই লবণের সিঁড়ি; সেই সিঁড়ি বাহিয়া লোকে নিচে নামে—কিংবা যদি ইচ্ছা হয় নিচে নামিবার যে কল আছে সেখানে পয়সা দিলেই কল চড়িয়া নিচে নামা যায়। প্রথমতালায় অর্থাৎ উপরের তালায়, একটা প্রকাণ্ড সভাঘর। চারিদিকে লবণের দেয়াল, লবণের থাম, লবণের কারিকুরি, তার মধ্যে লবণের ঝাড়লণ্ঠন। এই ঘর দেড়শত বৎসর আগে তৈয়ারি হইয়াছিল। কত বড় বড় লোকে, রাজা-রাজড়া পর্যন্ত, এই সভায় বসিয়া আমোদ-আহ্লাদ করিয়া গিয়াছেন। সভার এক মাথায় একটা সিংহাসন। একখানা আস্ত লবণের টুকরা হইতে এই সিংহাসন কাটা হইয়াছে। ঘরের মধ্যে যখন আলো জ্বালান হয়, তখন সমস্ত ঘরটি স্ফটিকের মতো জ্বলিতে থাকে। লাল নীল সাদা কতরকম রঙের খেলায় চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দেয়। লবণ জিনিসটা যে কতদূর সুন্দর হইতে পারে শুধু খানিকটা নুনের গুঁড়া বা কর্‌কচের টুকরা দেখিয়া তাহার ধারণাই করা যায় না।
সভাঘরের খুব কাছেই সেন্ট আন্টনির মন্দির। মন্দিরের মধ্যে আলো বেশি নাই, লবণের থামগুলি আধা-আলো আধা-ছায়ায় আর স্ফটিকের মতো ঝক্‌ঝক্‌ করে না; এক-এক জায়গায় সাদা মার্বেল পাথরের মতো দেখায়। মন্দিরের ভিতরটায় জাঁকজমক বেশি নাই। চারিদিক নিস্তব্ধ—সভাঘরের হৈ চৈ গোলমাল এখানে একেবারেই পৌঁছয় না।
এখান হইতে দ্বিতীয় তালায় নামিবার জন্য আবার সিঁড়ি—সিঁড়িটা একটা প্রকাণ্ড ঘরের মধ্যে নামিয়াছে। ঘরের ছাদটা একটা গম্বুজের মতো। চারিদিকে বড় বড় কাঠের ঠেকা দেওয়া হইয়াছে তা না হইলে ছাদ ভাঙিয়া পড়িতে পারে। ঘরটা এত উঁচু যে তাহার মধ্যে আমাদের গড়ের মাঠের মনুমেন্টটিকে অনায়াসে খাড়া করিয়া বসান যায়। ঘরের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড লবণের ঝাড়লণ্ঠন, তাহার মধ্যে তিনশত মোমবাতি জ্বালান হয়—কিন্তু তাতেও এত বড় ঘরের অন্ধকার দূর হয় না।
দেড় শত বৎসর আগে এই ঘরেই খনির আড্ডা ছিল। লবণ খুঁড়িতে খুঁড়িতে খনিতে বড় বড় ফাঁক হইয়া যায়। এই ঘরটিও সেইরকম একটি ফাঁক মাত্র। লোকে উপর হইতে লবণ তুলিতে আরম্ভ করে—ক্রমে যতই লবণ ফুরাইয়া আসিতে থাকে তাহারা একতালা দোতালা করিয়া ততই নিচে নামিতে থাকে।
তৃতীয় তালায় নামিয়া কতগুলি ছোটখাট ঘর ও নানা লোকের কীর্তিস্তম্ভ দেখিয়া লবণের পোল পার হইতে হয়। তার পরেই হোটেল রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদি। সেগুলিও দেখিবার মতো জিনিস। মাটির সাত শত ফিট নিচে একটা লোনা হ্রদ আছে, এমন লোনা জল বোধহয় আর কোথাও নাই। অন্ধকার গুহা, তার মধ্যে ঠাণ্ডা কালো জল—কোথাও একটু কিছু শব্দ হইলে চারিদিকে গম্‌গম্‌ করিয়া প্রতিধ্বনি হইতে থাকে। সে জলের উপর লোকে যখন নৌকা চালায় তখন জলের ছপ্‌ছপ্‌ শব্দ চারিদিক হইতে অন্ধকারে ফিস্‌ফিস্‌ করিতে থাকে—যেন পাতালপুরীর হাজার ভূতে কানে কানে কথা বলে।