প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড

পাওয়ালগড়ের কুঁয়ারসাব

পাওয়ালগড়ের কুঁয়ারসাব

০১.

আমাদের শীতাবাসের তিন মাইল দূরে, জঙ্গলের গভীরে, প্রায় চারশো গজ লম্বা ও তার প্রায় অর্ধেক চওড়া এক মুক্ত প্রান্তর। তা পান্না সবুজ ঘাসে ঢাকা এবং .. বেতসলতার জালে জড়ানো বিচ্ছিন্ন গাছে ঘেরা। সৌন্দর্যে এর জোড়া নেই আর এই ঘাসজমিতে আমি প্রথম দেখি সেই বাঘকে, যে সমগ্র যুক্তপ্রদেশে ‘পাওয়ালগড়ের কুয়ারসাব’ নামে পরিচিত ছিল। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল অবধি বাঘটাকে মেরে নাম কেনার জন্যে শিকারীরা হন্নে হয়ে ঘুরেছে।

এক শীতের সকালে সূর্য সবে উঠেছে, তখন আমি ঘেসো জমির মুখোমুখি ভাঙা জমিটি টপকে পেরোলাম। দূরের দিকে এক স্ফটিকস্বচ্ছ স্রোতস্বিনীর দু তীরের শুকনো পাতার মধ্যে কুড়িটা লাল বনমোরগ আঁচড়াচ্ছিল এবং শিশিরে ঝলমল মরকত-সবুজ ঘাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পঞ্চাশটি কি তারও বেশি চিতল ঘাস খাচ্ছিল। একটি গাছের কাটা গোড়ায় বসে ধূমপান করতে করতে আমি এ দৃশ্য কিছুক্ষণ ধরে দেখছি, এমন সময়ে আমার সবচেয়ে কাছের হরিণীটি মাথা তুলল, আমার পানে ফিরল ও ডেকে উঠল। এক মুহূর্ত বাদে আমার নিচের ঘন ঝোঁপ থেকে ফাঁকায় বেরিয়ে এল কুঁয়ারসাব।

দীর্ঘ এক মিনিট কাল ও এ দৃশ্য দেখতে থাকল দাঁড়িয়ে, মাথা উঁচুতে তুলে তারপর, আস্তে, ধীর পা ফেলে ঘেসোজমিটি পার হতে শুরু করল। শীতঋতুতে জাঁকালো চামড়া ওর, নবোদিত সূর্য তা দীপ্তোজ্জ্বল করে তুলছে, মাথা এখন ডাইনে ঘুরিয়ে, বাঁয়ে ঘুরিয়ে, হরিণরা ওকে যে চওড়া পথ ছেড়ে দিল তা ধরে ও যখন হাঁটছিল, তখন সে এক রাজকীয় দৃশ্য। নদীর কাছে গিয়ে বাঘটা গুঁড়ি মেরে বসল, পিপাসা মেটাল, লাফিয়ে পেরোল নদীটি এবং ওপারের ঘন গাছ-জঙ্গলে ঢুকতে ঢুকতে, জঙ্গলের প্রাণীরা ওকে যে কুর্নিশ পেশ করল তার স্বীকৃতিতে ডেকে উঠল তিনবার। কেন না যখন থেকে ও ঘেসো জমিতে পা রেখেছে, প্রতিটি চিতল ডেকেছিল, প্রতিটি বনমোরগ কোঁর-কে করেছিল এবং গাছের একদল বানরের প্রত্যেকে কিচিরমিচির করেছিল। সে সকালে বড় দূরে চলে এসেছিল কুঁয়ারসাব, কেন না ওর বাসা ছ মাইল দূরে এক গিরিখাতে। যে অঞ্চলে হাতির সহায়তায় অধিকাংশ বাঘ শিকার করা হয়, সেখানে বাস করে ও বাসা বেছেছিল বুদ্ধিমানের মত। নিচের গিরিমালা অবধি চলে যাওয়া গিরিখাতটি আধ মাইল লম্বা, তার দু দিকে খাড়াই পাহাড় হাজার ফুট অব্দি উঠে গেছে। গিরিখাতটির উঁচু দিকের কিনারে প্রায় বিশ ফুট উঁচু এক জলপ্রপাত এবং লালমাটি কেটে যেখান দিয়ে জল বয়ে গেছে, সেই নিচের কিনারে গিরিখাতটি সরু হয়ে চার ফুট হয়েছে। তাই কুঁয়ারসাব যখন নিজের মহলে তখন তার সঙ্গে হিসেব মেটাতে ইচ্ছুক যে কোনো শিকারীকেই বাধ্য হয়ে সে কাজ করতে হবে পায়ে হেঁটে। একদিকে এই নিরাপদ আশ্রয়, অন্যদিকে রাত্রিতে শিকার করা সরকারী আইন বিরুদ্ধ–এর ফলেই শিকারীর কবল থেকে কুঁয়ার সাহেবের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছিল।

মোষের জ্যান্তটোপের সহায়তায় ওকে শিকার করবার বহু চেষ্টা বারবার করা হয়। তা সত্ত্বেও কুঁয়ারসাব কখনো গুলি খায় নি। যদিও, আমি জানি বাঘটা দু বার কোনোমতে মৃত্যুর হাত এড়িয়ে বেঁচেছে। প্রথমবার, নিখুঁত এক জঙ্গল হাঁকানির পর, যে মোটা রশিতে মাচানটি টাঙানো ছিল, তা দরকারের সময় ফ্রেড অ্যান্ডারসনের রাইফেলের গতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। আর দ্বিতীয়বার, হাঁকানি শুরু হবার আগেই কুঁয়ারসাব মাচানের কাছে পৌঁছে যায় এবং হুইশ এডিকে পাইপে তামাক ভরতে দেখে। দুবারই মাত্র কয়েক ফুট পাল্লার মধ্যে ওকে দেখা যায়। অ্যান্ডারসন ওকে এক শেটল্যান্ড টার্টুর মত বড় বলে বর্ণনা করেন, এডি বলেছেন ও একটা গাধার মত বড়।

এই সকল, এবং অন্যান্য বিফল প্রচেষ্টার পরের শীতে–আমাদের কমিশনার, উইন্ডহ্যাম, ভারতের যে কোনো লোকের চেয়ে তিনি বাঘের বিষয়ে বেশি জানেন–তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, যে গিরিখাতে কুঁয়ারসাব বাস করে, তার উঁচু দিকের কিনার ঘেরা এক ঝুম্ রাস্তায় (ঝুম্ রাস্তা; জঙ্গলে আগুন লাগার ফলে জঙ্গল জ্বলে সৃষ্ট রাস্তা)। ওই পথে সেদিন সকালে বাঘটির থাবার যে টাটকা ছাপ দেখেছি, তাই ওঁকে দেখাতে। উইন্ডহ্যামের সঙ্গে ছিলেন ওঁর অভিজ্ঞতম শিকারীদের দুজন, এবং ওঁরা তিনজন থাবার ছাপগুলি সযত্নে পরিমাপ ও পরীক্ষা করার পর উইন্ডহ্যাম বলেন, তাঁর মতে, বাঘটির ‘বিটুইন দ্য পেগস’ (মৃত বাঘকে চিত করে শুইয়ে লেজটি টান করে নাকের ডগা, ও লেজের ডগায় কাটি পুঁতে বাঘ সরিয়ে নিয়ে কাঠি দুটির মধ্যবর্তী মাপ হল বিটুইন দ্য পেগস মাপ, এটিই বিজ্ঞানসম্মত পরিমাপ পদ্ধতি।-সম্পাদিকা) মাপ হল দশ ফুট; এবং এক শিকারী বলেন বাগটির ‘ওভার দ্য কার্ভস (একইভাবে বাঘটি রেখে, নাকের ডগা থেকে লেজের ডগা অব্দি মাপের ফিতেয় মাপলে তা হয় ওভার দ্য কার্ভস পদ্ধতিতে মাপ।-সম্পাদিকা) মাপ ১০ ফুট ৫ ইঞ্চি, অপর জন বলেন তা ১০ ফুট ৬ ইঞ্চি বা বেশি হবে। তিনজনই স্বীকার করেন, এর চেয়ে বড় কোনো বাঘের থাবার ছাপ ওঁরা কখনো দেখেন নি।

কুঁয়ারসাবের ঘর ঘিরে যে অঞ্চল, সেখানে বন-বিভাগ ব্যাপকভাবে গাছ কাটতে শুরু করে ১৯৩০ সালে এবং এই গণ্ডগোলে বিরক্ত হয়ে সে বাসস্থান বদল করে। বাঘটিকে শিকারের উদ্দেশ্যে যে দুজন শিকারী শিকার-পাস নেন তাঁদের কাছে আমি এ কথা শুনি। প্রতি মাসে পনের দিনের জন্যে শিকার পাস দেওয়া হয় এবং সে শীতকালে একটির পর একটি শিকারী দল বাঘটির হদিস করতে অসমর্থ হয়।

এক বুড়ো ডাক-রানার, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সাত মাইল দৌড় পথে এক পাহাড়ী গ্রামে যেতে প্রতি সকালে ও সন্ধ্যায় আমাদের গেট পেরিয়ে যায়। এক সন্ধ্যায় ও আমার কাছে এসে বলল, সে সকালে উজান পথে ও ওর ত্রিশ বছরের চাকরি জীবনের দেখার মধ্যে সব চেয়ে বড় একটি বাঘের থাবার ছাপ দেখেছে। ও বলল, বাঘটি এসেছে পশ্চিম থেকে এবং রাস্তা ধরে দুশো গজ এগোবার পর, একটি বাদাম গাছের কাছে শুরু হওয়া এক পথ ধরে পুবে গেছে। আমাদের বাড়ি থেকে আন্দাজ দু মাইল দূরে গাছটি। এটি একটি সুবিদিত জমি-নিশানী। বাঘটি যে পথ ধরেছে একটি চওড়া নালা পেরোবার আগে তা গিয়েছে অতি নিবিড় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, তারপর মিলেছে একটি গো-পথে। বাঘের প্রিয় জায়গা একটি বনে ঢাকা গভীর উপত্যকা। সেটিতে ঢোকার আগে গো-পথটি পাহাড়ের পায়ের কাছটা ঘিরে চলে গেছে।

পরদিন সকালে ভোর ভোর রবিনকে পেছন পেছন নিয়ে আমি খোঁজে বেরোলাম। যেখানে গো-পথটি ঢুকছে উপত্যকায় আমার উদ্দেশ্যে সেই জায়গাটি। কেন-না উপত্যকায় যত জানোয়ার ঢোকে ও বেরোয়, তাদের পদরেখা দেখা যায় ওইখানটিতে। যখন থেকে আমরা বেরোই মনে হল রবিন বুঝেছে আমাদের হাতে এখন বিশেষ এক কাজ আছে। এবং যে বনমোরগকে আমরা ব্যাঘাত ঘটালাম, সে কাকার (কুত্তা-হরিণ) তার কাছে আমাদের যেতে দিল, এবং যে দুটি সম্বর দাঁড়িয়ে পড়ে আমাদের উদ্দেশে ডাকল, তাদের দিকে ও বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিল না।

যেখানে গো-পথটি উপত্যকায় ঢুকেছে, জমিটি কঠিন ও পাথুরে এবং এখানে যখন পৌঁছলাম, রবিন মাথা নামাল, অতি সন্তর্পণে শুকল পাথরগুলো, আমার কাছ থেকে চালিয়ে যাবার ইঙ্গিত পেয়ে ও ঘুরে গেল। ভাটি পথে চলল আমার এক গজ আগে আগে। ওর আচরণ থেকেই আমি বুঝতে পারলাম ও বাঘের গন্ধ পেয়ে চলেছে এবং সে গন্ধ খুবই টাটকা। নাবুতে আরো একশো গজ গেলাম, সেখানে পথটি সমতল হয়ে গিয়ে পাহাড়ের পাদদেশ ধরে চলে গেছে, মাটিটা নরম। এখানে আমি একটি বাঘের থাবার ছাপ দেখলাম, এবং এক পলক দেখেই খুশি হলাম যে আমরা কুঁয়ারসাবের পেছু পেছু যাচ্ছি। ও আমাদের থেকে মাত্র এক বা দু মিনিটের পথ এগিয়ে আছে।

নরম মাটি পেরিয়ে খাড়া উত্রাইয়ে এক উন্মুক্ত সমতলে নেমে যাবার আগে পথটি তিনশো গজ গেছে পাথরের ওপর দিয়ে। বাঘটি যদি পথ ধরে চলে, ওকে। হয়তো ওই ফাঁকা সমতলে দেখতে পাব। আমরা আরো পঞ্চাশ গজ গেছি, তখন রবিন থামল আর পথের বাঁ ধারে একটি ঘাসের ফলার ওপর থেকে নিচ অব্দি নাক ঘষে ও ঘুরে দাঁড়ল, ঢুকে গেল ঘাসের মধ্যে, এখানে ঘাস দু ফুট আন্দাজ উঁচু। ঘাসের দূরের দিকে আন্দাজ চল্লিশ ফুট চওড়া ক্লেরোডেনড্রন গাছের এক বন-খণ্ড। নিবিড় বন রচনা করে এ গাছটি, পাঁচ ফুট অবধি উচ্চতা হয় এর, এর পাতা বিস্তৃত হয়ে ছড়ায়, ফুলগুলির সঙ্গে ঘোড়াবাদাম ফুলের অমিল নেই, বড় বড় থোকায় ফোটে। যে ছায়া দেয়, তার জন্য গাছটি বাঘ, সম্বর ও শুয়োরের খুবই প্রিয়। যখন ক্লোরোডেনড্রনগুলির কাছে পৌঁছল, রবিন থেমে গেল, পিছিয়ে এল আমার দিকে, অমনি করেই বলল আমাকে, ও সামনের ঝোপের মধ্যেটা দেখতে পাচ্ছে না এবং আমি ওকে তুলে বয়ে নিয়ে চলি তাই ওর ইচ্ছে।

ওকে তুলে নিয়ে ওর পেছনের পা দুটি ঢুকিয়ে দিলাম আমার বাঁ-হাতি পকেটে এবং যখন সামনের পা দুটি আমার বাম বাহুতে বাধিয়ে নিল, ও তখন নিরাপদ, নির্ভর এবং আমিও দু হাতেই রাইফেল ধরতে পারি। এই সব সময়ে রবিন সর্বদাই উদগ্র আগ্রহী থাকে এবং ও যাই দেখুক, আমার যে শিকার খুঁজছি তার উদ্দেশ্যে গুলি ছোঁড়ার আগে বা পরে শিকারটি যেমন আচরণই করুক, এসে যায় না কিছু। রবিন কখনো নড়ে না, আমার গুলি ছোঁড়া বিফল করে দেয় না, আমার দেখার কাজে ব্যাঘাত করে না।

খুব ধীরে এগিয়ে আমরা ক্লোরোডেনড্রনগুলির আধা পথ গেছি, এমন সময়ে আমার ঠিক সমুখ বরাবর ঝোপগুলো নড়তে দেখলাম। বাঘটি ঝোপগুলো থেকে না-বেরনো অব্দি অপেক্ষা করলাম, তারপর, ওকে মোটামুটি, খোলা জঙ্গলে দেখব আশায় আমি এগিয়ে গেলাম কিন্তু কোথাও দেখলাম না ওকে। আর রবিনকে যখন নামিয়ে দিলাম, ও বাঁয়ে ঘুরল, বুঝিয়ে দিল, বাঘটি কাছের এক গভীর ও সংকীর্ণ গিরিখাতের ভেতরে ঢুকেছে। একটা একলা পাহাড়, যার ওপরকার গুহাগুলিতে বাঘরা প্রায়ই যায়, তার কাছাকাছি পাহাড়ের পা অব্দি চলে গেছে গিরিখাতটি। যেহেতু অত কাছাকাছি কোনো বাঘের সঙ্গে মোকাবিলা করার পক্ষে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার নেই, আরো কি, যেহেতু এখন প্রাতরাশের সময়, রবিন ও আমি ফিরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।

প্রাতরাশের পর একটি ভারি ৪৫০ রাইফেলে হাতিয়ারবন্দী হয়ে আমি ফিরে এলাম একা, এবং যেমন পাহাড়টির কাছে এলাম, মোষের গলার বড় ঘণ্টার ঢং ঢং এবং একটি লোকের চীৎকার শুনলাম। সুদূর অতীতের দিনে এ পাহাড়টি গুখা আক্রমণকারীদের বিপক্ষে যুদ্ধস্থান হিসেবে আঞ্চলিক অধিবাসীরা ব্যবহার করত। পাহাড়টির চূড়া চ্যাটালো, দেড় বিঘা মত পরিসর তার এবং আওয়াজ আসছিল ওখান থেকেই। তাই আমি পাহাড়ে উঠলাম ও দেখলাম একটি লোক একটা গাছে বসে কুড়োলের মাথা দিয়ে একটা শুকনো ডালে ঘা মারতে মারতে চেঁচাচ্ছে আর গাছের নিচে জড়ো হয়েছে এক পাল মোষ।

আমাকে যখন দেখল, লোকটি জোরে ডাকল, বলল উটের মত বড় শয়তান একটা বাঘ ওদের বহু ঘন্টা যাবৎ ত্ৰাসাচ্ছে এবং ওকে আর ওর মোষদের তার হাত থেকে বাঁচাতে ঠিক সময়েই এসেছি। ওর কাহিনী থেকে বুঝলাম, আমি আর রবিন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবার অল্প পরেই ও পাহাড়ের ওপরে এসে যায় আর ওর মোষদের জন্যে ও যেমন বাঁশপাতা কাটতে লেগেছে, একটি বাঘকে ওর দিকে আসতে দেখে। আগে বহুবার অন্য বাঘদের বেলা যেমন করেছে, এবারও বাঘটিকে তাড়াবার জন্যে ও চেঁচায়, কিন্তু চলে যাবার বদলে ও বাঘটা গজরাতে থাকে। ওর মোষগুলির অনুসরণে ও তখনি ছুট লাগায় আর সবচেয়ে কাছের গাছটায় উঠে পড়ে। ওর চেঁচামেচিতে তোয়াক্কাটি না করে বাঘটা তখন ফিরে ফিরে পায়চারি শুরু করে, মোষগুলো মাথাটা ওর দিকে করে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো আমার আসার শব্দ শুনে থাকবে বাঘটা, কেননা আমি আসার মাত্র একমুহূর্ত আগে ও চলে গেছে।

এ লোকটি এক পুরনো দোস্ত। ওর গ্রামের মোড়লের সঙ্গে ঝগড়া হবার আগে মোড়লের বন্দুক দিয়ে এসব জঙ্গলে ও প্রচুর চোরাশিকার করেছে। ওকে এবং ওর মোষদের জঙ্গল থেকে নিরাপদে পার করে দেবার জন্যে ও আমাকে মিনতি জানাল। অতএব ওকে পথ দেখাতে বলে, কোনো মোষ দলছুট না পড়ে থাকে দেখার জন্যে আমি চললাম পেছন পেছন। প্রথমে মোষগুলো তাদের ঠাস-জমায়েত ভাঙতে অনিচ্ছুক ছিল তবে খানিক খোঁচাবার পর ওদের নড়াতে পারলাম এবং উন্মুক্ত সমতল পেরিয়ে আধাআধি গিয়েছি, তখন আমাদের ডাইনের জঙ্গলে বাঘটা ডাকল। লোকটা জলদি পা চালাল আর আমি তাড়া মারলাম মোষগুলিকে। কেননা এক চওড়া, উন্মুক্ত নদীর ওপারে আমার বন্ধুর গ্রাম, ওর মোষরা সেখানে নিরাপদ। নদী এবং আমাদের মধ্যিখানে এক মাইল অতি দুর্ভেদ্য জঙ্গল।

জানোয়ারদের মারার চেয়ে তাদের ছবি তোলায় আমার আগ্রহ বেশি, এ খ্যাতি অর্জন করেছি এবং আমার বন্ধুকে ছেড়ে দেবার আগে ও অনুনয় জানাল যেন এবারকার মত আমি ফোটোগ্রাফি তুলে রেখে বাঘটাকে মারি। কেননা, ও বলল, বাঘটা প্রত্যহ একটি করে মোষ খাবার মত যথেষ্ট বড় এবং ওকে পাঁচশ দিনে ফতুর করে দেবে। যথাসাধ্য করব বলে কথা দিলাম এবং ফাঁকা সমতলে যাবার জন্যে নিজের পায়ের ছাপ ধরে ফিরে চললাম। সেখানে এক অভিজ্ঞতা হল। যার প্রতিটি খুঁটিনাটি আমার স্মৃতিতে গভীর দাগে দেগে বসে আছে।

বাঘটি কোথায় আছে সে পাত্তা ও নিজেই দেবে বলে, নইলে জঙ্গলের জানোয়াররা ওর খবর আমাকে দেবে বলে, সমতলে পৌঁছেই অপেক্ষা করব বলে বসে পড়লাম। তখন বেলা আন্দাজ তিনটে হবে এবং যেহেতু রোদটা বেশ তপ্ত আর আরাম-ধরানো, আমার ভাঁজ করা হাঁটুতে মাথা রাখলাম আর কয়েক মিনিট ঝিমিয়েছি, বাঘটির ডাকে জেগে উঠলাম। তারপর একটু থেমে থেমে ঘন ঘন ও ডেকেই চলল।

আশপাশের একশো মাইলের মধ্যে সবচেয়ে ঘন গুল্মজঙ্গলের এক আধ মাইল আন্দাজ চওড়া বলয় আছে সমভূমি ও পাহাড়গুলির মধ্যে। আমার থেকে আন্দাজ তিনশো মাইল দূরে, গুল্মবনের দূরের দিকে পাহাড়ের ওপর বাঘটি আছে বলে আমি স্থির করলাম–যে ভাবে ও ডাকছিল, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ও সঙ্গিনী তল্লাস করছে।

আমি যেখানে বসে আছি তার কাছে সমভূমের উঁচুতে বাঁ হাতি কোনা থেকে শুরু হয়েছে একটি পুরনো গরুর গাড়ি চলার পথ, কয়েক বছর আগে তা কাঠ চালানোর কাজে ব্যবহার হত। বাঘটি যেখানে ডাকছে, পথটি প্রায় সিধে লাইনে সেখানে ঢুকে গেছে। এ পথটি আমাকে ডাক জানোয়ারটির কাছে নিয়ে যাবে কিন্তু পাহাড়ে আছে লম্বা লম্বা ঘাস এবং আমার সহায়তায় রবিন না থাকায় আমার ওকে দেখতে পাবার সম্ভাবনা সামান্যই। তাই আমি গিয়ে বাঘটির খোঁজ করার বদলে স্থির করলাম, ও এসে আমার খোঁজ করুক।

ও শুনতে পাবার পক্ষে আমি বড়ই দূরে আছি তাই কয়েকশো গজ গরুর গাড়ি চলার পথ ধরে ছুটে গেলাম, মাটিতে শুইয়ে রাখলাম রাইফেল, একটি উঁচু গাছের মগ ডালে চড়লাম, এবং তিন বার বাঘের ডাক ডাকলাম। তখনি জবাব পেলাম বাঘটির। গাছ থেকে নেমে আমি ডাকতে ডাকতে দৌড়ে ফিরে এলাম এবং যেখানে বসে বাঘের অপেক্ষা করা যায় তেমন উপযোগী একটিও জায়গা না পেয়েই পৌঁছে গেলাম সমভূমে। কিছু একটা করতে হয়, করতে হয় তাড়াতাড়ি, কেননা বাঘটি খুব জলদি কাছে এসে পড়ছে তাই, একটি ছোট নাবাল জায়গা দেখলাম কালো দুর্গন্ধ জলে বোঝাই। সেটি বাতিল করে দিয়ে–যেখানে পথটি গুল্মবনে ঢুকেছে সেখান থেকে বিশ গজ তফাতে ফাঁকায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে। এখান থেকে পঞ্চাশ গজ অব্দি পথটি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, তারপর পথের ওপর ঝুঁকে পড়া একটি ঝোঁপ আমার চোখ আটকে দিচ্ছে। আমি যা আশা করছি, সেইমত যদি ও পথটি ধরে আসে, ও ওই আড়ালটা পেরোলেই গুলি করব বলে ঠিক করলাম।

রাইফেলটিতে গুলি আছে নিশ্চিত হবার জন্যে ওটাকে খুললাম, তারপর সেফটি-ক্যাচ ঠেলে দিলাম এবং নরম মাটিতে আরাম করে কনুই ঠেস রেখে বাঘ আবির্ভাব হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। খোলা জমিতে যখন পৌঁছেছি, তখন থেকে আর ডাকি নি, তাই ওকে দিক নির্দেশ জানাবার জন্যে নিচু গলায় ডাকলাম একবার, একশো গজ দূর থেকে তৎক্ষণাৎ ও সে ডাকের সাড়া দিল। আমি বিচার করে বুঝলাম, ও যদি ওর স্বাভাবিক গতিবেগে আসে, তাহলে আড়ালটি পেরিয়ে আসবে ত্রিশ সেকেন্ডে। এই ‘ত্রিশ’ সংখ্যাটি গুনলাম অতি ধীরে ধীরে, গুনে গুনে ‘আশি’ অব্দি গুনেছি, তখন চোখের কোনাচ দিয়ে আমার সামনে ডান দিকে একটা নড়াচড়া দেখলাম, সেখানে ঝোপগুলো আমার দশ গজের মধ্যে।

ওদিক পানে চোখ ফিরিয়ে ঝোপগুলোর ওপর দিয়ে একটা পেল্লায় মাথাকে উঁকি মারতে দেখলাম, এখানে ঝোপগুলো চার ফুট উঁচু। ঝোপগুলোর মাত্র এক কি দুই ফুট ভেতরে আছে বাঘটা কিন্তু আমি ও বলতে ওর মাথাটুকুই দেখতে পেলাম। যখন অতি ধীরে রাইফেলের পয়েন্ট ঘোরাচ্ছি এবং সাইট বরাবর চেয়ে দেখছি, দেখলাম মাথাটা আমার পানে সবটা ফেরানো নেই। আর আমি যেহেতু ওপরপানে গুলি ছুঁড়ছি, ও চেয়ে আছে নিচের দিকে, ওর ডান চোখের এক ইঞ্চি নিচে নিশানা করলাম। ট্রিগার টিপলাম আর পরের আধঘণ্টা ধরে ভয়ে মারা গেলাম প্রায়।

যেমনটি ভেবেছিলাম, তেমন মড়ে পড়ে না গিয়ে বাঘটি পুরো লম্বা শরীরটি নিয়ে ঝোপগুলোর ওপরের শূন্যে সিধে উঠে গেল, চিত হয়ে পড়ল এক ফুট পুরু একটি গাছের ওপর, সেটি ঝড়ে উপড়ে ফেলেছিল। গাছটি তখনো কাঁচা। বিশ্বাস করা সম্ভব নয়, এমন প্রচণ্ড রাগে ও এই গাছটি আক্রমণ করল। কামড়ে টুকরো টুকরো করল ওটাকে, করতে করতে গর্জনের পর গর্জন করতে থাকল আর তার চেয়েও ভয়ংকর যা, একটা ভয়াল রক্ত জমিয়ে দেওয়া আওয়াজ করতে থাকল, যেন ওর চরমতম শত্রুকে ও ফালা ফালা করছে দাঁতে। যেন তুফান এসে পড়েছে ওপরে, তেমনিভাবে গাছটির ডালপালা আছড়াতে থাকল আর আমার পাশের ঝোপগুলো ঝাঁকাতে থাকল, ফুলে ফুলে উঠল, প্রতি মুহূর্তে আমি ভাবলাম ও এসে আমার ওপর পড়ল, কেননা যখন গুলি ছুঁড়ি, ও তাকিয়ে ছিল আমার দিকে, এবং জানত আমি কোথায় আছি।

রাইফেলটিতে ফিরে গুলি ভরার পক্ষেও ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে গেছি ভয়ে। ভয়–যে সামান্য নড়াচড়া ও আওয়াজে বাঘটার মনোযোগ আকৃষ্ট হবে। আঙুল বাঁ ঘোড়ার ট্রিগারে রেখে আধঘণ্টা ধরে আমি শুয়ে শুয়ে ঘামলাম। অবশেষে গাছের ডালপালা ও ঝোপগুলোর আছাড়িপিছাড়ি বন্ধ হল, গর্জনটা কম ঘন ঘন হল, অবশেষে বন্ধ হল আমাকে নিশ্চিত করে। আরো আধঘণ্টা আমি একেবারে নিস্পন্দ পড়ে থাকলাম, ভারি রাইফেলের ওজনে হাতগুলোতে খিল ধরা তারপর পায়ের আঙুলের টানে পেছনপানে সরতে থাকলাম। এভাবে ত্রিশ গজ চলে পায়ের ওপরে উঠে দাঁড়ালাম ও নিচু হয়ে দুমড়ে সবচেয়ে কাছের গাছটিতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য দৌড়ালাম। সেখানেই থেকে গেলাম কয়েক মিনিট, তারপর সব যখন শান্ত, তখন বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।

.

০২.

পরদিন সকালে একজন পাকা গাছে-চড়িয়ে লোককে সঙ্গে নিয়ে আবার সেখানে ফিরে এলাম। যেখানে বাঘটি পড়ে যায় সেখান থেকে আন্দাজ চল্লিশ গজ দূরে, ফাঁকা জমিটির কিনারে উঠেছে একটি গাছ, তা আগের সন্ধ্যাতেই লক্ষ করেছিলাম। খুব সন্তর্পণে আমরা এ গাছের কাছে এগোলাম আর আমি যখন গাছের পেছনে দাঁড়ালাম, লোকটি মগডালে উঠে গেল। বহুক্ষণ সযত্ন নিরীক্ষণের পর ও নিচের দিকে চাইল আর মাথা নাড়ল। যখন মাটিতে নেমে আমার কাছে এল, ও আমাকে বলল যে একটি বড় এলাকা জুড়ে ঝোপগুলি ধরাসাৎ হয়েছে তবে বাঘটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে এবং ঝোপে কোনো নড়াচড়া দেখলে আমাকে হুঁশিয়ার করে দিতে নির্দেশ দিয়ে আমি ওকে গাছের উঁচুতে পাঠিয়ে দিলাম ফের, আর যেখানে বাঘটি তাণ্ডব করেছে সে জায়গাটি দেখতে পেলাম। যেন এমনটি করবে সংকল্প করেই তাণ্ডবটি করেছে ও, কেননা গাছটি থেকে ডালপালা আর বড় বড় কাঠের চাঙ কামড়ে ছিঁড়ে ফেলার ওপরে, বহু ঝোঁপ উপড়ে ফেলেছে শেকড় শুদ্ধ। অন্যগুলো কামড়ে শেষ করেছে। চারিদিকে প্রচুর রক্ত ছেটানো, মাটিতে দুটো জমাটবাঁধা রক্তের চাপ। একটির কাছে দু ইঞ্চি সমচতুষ্কোণ এক টুকরো হাড়, পরীক্ষা করে দেখলাম সেটি বাঘের খুলির অংশ।

যখন আমি চলে যাই বাঘ এখানেই ছিল, তার প্রমাণ হল দুটি রক্তের চাপ, আর আরেকটি তথ্য–এ জায়গা থেকে কোনো রক্ত-নিশানা রওনা হয় নি। গত সন্ধ্যায় যে সব সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম, তা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। কেননা যখন পালাবার ব্যাপারটি শুরু করি আমি ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জানোয়ারের দশ গজের মধ্যে একটি সদ্য জখম বাঘ।

জায়গাটি বেড় দিয়ে চলে গিয়ে, যে পাতাগুলো ওর মুখে ঘষটে গেছে তাতে এখানে সেখানে রক্তের ছোট ছোট দাগ পেলাম। বাঘের গতিপথের এই সকল নিশানী দুশো গজ দূরে এক মহাকায় শিমুল গাছের দিকে সিধে চলে গেছে লক্ষ করে আমি ফিরে গেলাম। যে জমি আমাকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে, তা পরিষ্কার পাখির চোখে দেখা ছবির মত দেখার জন্যে আমার লোকটি যে গাছে ছিল সেটিতেই উঠে পড়লাম। কেননা, প্রবল অস্বস্তিতে আমার বোধ হচ্ছিল ওকে জ্যান্তই দেখব আমি। মাথায় গুলি খেয়ে বাঘ দিনের পর দিন বেঁচে থাকতে পারে, এমন কি সে জখম থেকে সেরে উঠতেও পারে।

এ বাঘটির খুলির এক টুকরো খোয়া গেছে তা সত্যি। এর আগে যেহেতু ঠিক ওর মত, জখমওয়ালা কোনো জানোয়ারের সঙ্গে আমি কখনো মোকাবিলা করি নি, আমি জানি না ও কি করবে-কয়েক ঘণ্টা বা কয়েক দিন বাঁচবে, না বুড়ো হয়ে মরা অব্দি বেঁচে থাকবে। এই কারণে ঠিক করলাম, অন্যান্য জখম বাঘের মতই আচরণ করব ওর সঙ্গে, ওকে অনুসরণ করার সময়ে যে ঝুঁকি এড়ানো চলে সে ঝুঁকি নেব না।

গাছের মগডালের আসন থেকে দেখলাম, শিমূল গাছ বরাবর লাইনটির সামান্য বাঁয়ে দুটি গাছ। যেখানে রক্ত, সেখান থেকে কাছের গাছটি ত্রিশ গজ দূরে, অপরটি পঞ্চাশ গজ এগিয়ে। আমার লোকটিকে গাছের ওপরে রেখে আমি নিচে নামলাম, আমার রাইফেল, একটি শটগান ও একশো কার্তুজের একটি থলি নিলাম। অতি সন্তর্পণে কাছের গাছটির কাছে গেলাম, ওটি বেয়ে ত্রিশ গজ উঁচু অব্দি চড়লাম, একটি মজবুত দড়ির প্রান্তে যে রাইফেল ও শটগান বেঁধেছিলাম, তা টেনে তুললাম আমি ওঠার পর। যদি দরকার পড়ে তবে যেখানে চট করে ওটি পাব, গাছের তেমন এক ফাঁকে রাইফেলটি ঠিকভাবে বসিয়ে দিয়ে আমি দু দিকে ছোটগুলি বর্ষণ করতে থাকলাম ঝোপগুলোর ওপর। গজের পর গজ ধরে ধরে দ্বিতীয় গাছের তলা অব্দি। বাঘটি বেঁচে আছে, আর এই এলাকাতেই আছে ধরে নিয়ে, ওর ঠাহরমালুম পাবার উদ্দেশ্যে আমি এ কাজ করতে থাকলাম। কেন না জখমী বাঘ, কাছাকাছি গুলির আওয়াজ শুনলে বা গায়ে একটি বিধলে হয় গর্জাবে নয় আক্রমণ করতে তেড়ে বেরোবে। বাঘটির উপস্থিতির কোনো জানান না পেয়ে আমি দ্বিতীয় গাছটিতে গেলাম ও শিমূল গাছটির কয়েক গজ ভেতর পর্যন্ত ঝোপগুলিতে গুলি ছুঁড়তে লাগলাম। শেষ গুলিটি ছুঁড়লাম শিমূল গাছটিতেই। মনে হল ওই শেষ গুলিটি ছোঁড়ার পর চাপা গর্জন শুনলাম একটা, কিন্তু দ্বিতীয়বার কোনো সাড়া না পেয়ে ভাবলাম ওটি আমার মনেরই ভুল। আমার কার্তুজের থলে এখন শূন্য অতএব আমার লোকটিকে ডেকে নিয়ে আজকের মত ক্ষান্ত দিয়ে বাড়ি চলে গেলাম।

পরদিন সকালে ফিরে এলাম যখন, দেখলাম আমার বন্ধু সেই মোষওয়ালা খোলা জমিতে মোষ চরাচ্ছে। আমাকে দেখে ও গভীর স্বস্তি পেল বলে মনে হল এবং এর কারণ জানলাম পরে। ঘাস তখনো শিশিরে ভিজে রয়েছে তার মধ্যে আমরা একটি শুকনো জায়গা খুঁজে বের করলাম আর সেখানে বসে ধূমপান করতে করতে স্ব-স্ব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগলাম। আমি আপনাদের আগেই বলেছি, আমার বন্ধুটি প্রচুর চোরাশিকার করেছে এবং সারাটি জীবন বাঘ অধ্যুষিত অঞ্চলে মোষ চরাবার বা শিকার করার ফলে ওর অরণ্য সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা যথেষ্ট।

সেদিন সেই চওড়া, উন্মুক্ত নদীর কাছে ওকে রেখে চলে যাই, তারপর ও পেরিয়ে চলে যায় আরো দূরে এবং যে-দিকে আমি গেলাম সেদিক থেকে আসা শব্দটব্দ শুনতে বসে পড়ে। দুটো বাঘকে ডাকতে শোনে। আমার গুলির পর একটি বাঘের ক্রমান্বয় গর্জন শোনে। আর অতি স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত করে, আমি একটি বাঘকে জখম করেছি, সেটি আমাকে মেরে ফেলেছে।

পরদিন সকালে একই জায়গায় ফিরে এসে একশোটা গুলি ছোঁড়ার শব্দে ও বেজায় অবাক হয় আর আজ সকালে, কৌতূহল আর চাপতে না পেরে ও দেখতে এসেছে ব্যাপারখানা হল কি। রক্তের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ওর মোষরা দেখিয়ে দিয়েছে কোথায় পড়ে যায় বাঘটি। ও শুকনো রক্তের ছোপ দেখেছে, হাড়ের টুকরোও। ওর মতে, খুলির একাংশ উড়ে যাবার পর কোনো জানোয়ারেরই কয়েক ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব নয় এবং বাঘটি মৃত বলে ও এমনই সুনিশ্চিত যে মোষগুলো নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে আমার হয়ে মরা বাঘটি খুঁজে বের করতে চাইল। মোষের সহায়তায় মরা বাঘ উদ্ধার করবার এ পন্থার কথা শুনেছি আমি, কিন্তু নিজে কখনো এটি চেষ্টা করে দেখি নি। ওর মোষগুলির কোনো ক্ষতি হলে ওকেই ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করতে হবে, এই শর্তে আমি ওর প্রস্তাবে রাজী হলাম।

গুনতিতে পঁচিশটি মোষকে জড়ো করে নিয়ে, আগের দিনে যে লাইনটি বরাবর গুলি বর্ষণ করেছি, তা ধরে ধরে মোষগুলির অনুসরণে শিমূল গাছটির উদ্দেশে রওনা হলাম। আমার খুব আস্তে এগোচ্ছি, কেননা কোথায় পা ফেলব তা দেখতে শুধু চিবুক-সমান উঁচু ঝোঁপই সরাতে হচ্ছে না হাত দিয়ে দিয়ে, মোষদের তরফে দলছুট হয়ে চলার অতি স্বাভাবিক প্রবণতাও দমন করতে হচ্ছে ঘন ঘন। সেখানে ঝোপগুলি পাতলা, সেই শিমূল গাছের কাছে যখন এগিয়েছি, দেখলাম একটি ছোট নাবাল গর্ত-সেটি শুকনো পাতায় ভর্তি আর পাতাগুলো চেপ্টে আছে, তার ওপর অনেকগুলো রক্তের ছোপ, কতকগুলো শুকনো, কতকগুলো জমাট বাঁধার অবস্থায়, একটি একেবারে টাটকা। যখন মাটিতে হাত রাখলাম, দেখলাম জমিটি উষ্ণ।

আগের দিন আমি যখন একশোটি কার্তুজ বর্ষণ করি–এই নাবালেই শুয়েছিল বাঘটি, এ যত অবিশ্বাস্যই মনে হ’ক, এবং আজ আমাদের ও মোষগুলোকে যখন কাছে আসতে দেখে, শুধু তখনি সরে গেছে ও। মোষগুলো ইতিমধ্যে রক্ত দেখে মাটি আঁচড়ে ভোস ভেঁস করতে আরম্ভ করেছে। তাই তেড়ে আসা বাঘ আর খ্যাপা মোষের পালের মধ্যে আটকে পড়ার সম্ভাবনা আমার পছন্দ হল না, আমার বন্ধুর হাত ধরে ওকে পেছনে ঘোরালাম এবং মোষগুলির অনুসরণে ফাঁকা জমির উদ্দেশে রওনা হলাম। যখন নিরাপদ জায়গায় পৌঁছলাম, লোকটিকে বাড়ি যেতে বললাম আর বললাম, পরদিন আবার আসব এবং বাঘটির সঙ্গে একা মোকাবিলা করব।

বাড়ি থেকে আসতে ও যেতে প্রত্যেকদিন জঙ্গলের যে পথে এসেছি গেছি তা কিছুদূর গেছে নরম মাটি দিয়ে আর এই চতুর্থ দিনে এই নরম মাটিতে একটি বড় মন্দা বাঘের থাবার ছাপ দেখলাম। থাবার ছাপ ধরে গিয়ে দেখলাম, শিমূল গাছের একশো গজ ডাইনে গিয়ে বাঘটি এক দুর্ভেদ্য গুল্ম বনে ঢুকেছে। এই এক গোলমেলে ব্যাপার। এখন যদি এ জঙ্গলে কোনো বাঘ দেখি তাহলে খুব কাছ থেকে তাকে না দেখা অব্দি জানব না এটা আহত বাগটা, না অনাহত অন্য একটা। যা হক, যখন দেখা দেবে তখন এ সমস্যার মোকাবিলা করা যাবে, দুশ্চিন্তা করে কোনো লাভ হবে না, তাই ঢুকে পড়লাম ঝোপে আর শিমূল গাছটির গোড়ার সেই নাবালের উদ্দেশে রওনা হলাম।

অনুসরণ করার জন্যে কোনো রক্তের নিশানা নেই, তাই এঁকেবেঁকে চলতে থাকলাম এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময়কাল ধরে। ঘন ঝোপে কয়েক ইঞ্চির বেসি চোখ চলছিল না। অবশেষে পৌঁছলাম একটি দশ ফুট চওড়া শুকনো নদীতে। নদীতে নামার আগে চোখ তুলে চাইলাম, দেখলাম একটি বাঘের পেছনের বাঁ পা আর লেজটুকু। ওর শরীর আর মাথা গাছের আড়ালে গোপন রেখে বাঘটি একেবারে নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে আছে, দেখা যাচ্ছে শুধু এই পা-খানা। কাঁধে রাইফেল তুললাম, আবার নামলাম। পা ভেঙে দেওয়া সোজা হত কেননা বাঘ আছে মাত্র দশ গজ দূরে। পায়ের মালিক যদি আহত বাঘটি হত তবে সে ঠিক কাজ হত। কিন্তু এ এলাকায় আছে দুটি বাঘ এবং ভুল বাঘটির ঠ্যাং ভেঙে দিলে আমার কষ্ট দ্বিগুণ বাড়বে। এ জমিতে এমনিতেই আমার যথেষ্ট কষ্ট। অচিরে পা সরিয়ে নেওয়া হ’ল, বাঘটি সরে চলে যাচ্ছে শুনলাম, আর যেখানে ও দাঁড়িয়েছিল সেখানে গিয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেখলাম–ওই পা ভেঙে দিই নি বলে অনুশোচনা করার পক্ষে এখন খুবই দেরি হয়ে গেছে।

আরো এগিয়ে সিকি মাইল গিয়ে একটি ছোট নদী, এবং এখন জখম সামলে বাঘটি এই নদীর উদ্দেশ্যে চলেছে এটাই সম্ভব। ওকে মাঝপথে ধরা অথবা তাতে ব্যর্থ হলে ওর জন্যে সে জলের কাছে অপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে আমি একটি সঁড়িপথ ধরলাম। জানতাম সেটি ওই নদীতে গেছে আর ওটি ধরে কিছু দূর এগিয়েছি, বাঁ দিকে ঘণ্টার আওয়াজের মত সম্বরের ডাক শুনলাম, সম্বরটি জঙ্গল ধরে ছুটে পালাল। এখন পরিষ্কার বোঝা গেল, আমি বাঘটি থেকে এগিয়ে আছি এবং আর কয়েক পা মাত্র এগিয়েছি, তখন শুকনো কাঠ ভাঙার জোর শব্দ শুনলাম যেন কোনো ভারি জানোয়ার ওর ওপরে পড়ল। শব্দটি এল পঞ্চাশ গজ দূর থেকে, যেখান থেকে সম্বরটি ডাকে, ঠিক সেই জায়গাটি থেকে। সম্বরটি আরণ্য প্রাণীদের এক বাঘের উপস্থিতি বিষয়ে হুশিয়ারী জানিয়েছে ভুল নেই তাতে, অতএব কাঠটি শুধু ভাঙতে পারে বাঘটিই। তাই যেদিক থেকে আওয়াজ এল সেদিকে পানে গুঁড়ি মেরে চলতে শুরু করলাম হাত ও হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে পড়ে।

এখানে ঝোপগুলি ছ থেকে আট ফুট উঁচু, উপরদিকের ডালপালার ঘন পত্র সন্নিবেশ, বোঁটায় পাতা খুব কম, তাই দশ থেকে পনের ফুট দূর অব্দি দেখতে পাচ্ছিলাম তার ফাঁক দিয়ে। যদি বাঘ আক্রমণ করে সে আসবে সামনের জায়গাটি থেকে (কেননা অন্য কোনো দিকে আমি গুলি করতে পারব না) এই উৎকণ্ঠাভরা আশায় আমি তিরিশ গজ গিয়েছি, তখন চোখে পড়ল ওপরের পাতার ফাঁক দিয়ে গলে পড়া রোদ ঝলমল করছে লাল কোনো কিছুর ওপর। হতে পারে ওটা শুধু একগুচ্ছ শুকনো পাতা, আবার হতে পারে ওটা বাঘটি। ডানদিকে দু’গজ সরে গেলে বস্তুটি আরো ভালভাবে আমার নজরের মধ্যে আসে, তাই চিবুক মাটি ছোঁয়া অবধি মাথা নিচু করে, মাটিতে পেট ঘষটে এই দূরত্ব পেরোলাম হামাগুড়ি দিয়ে এবং মাথা তুলে দেখলাম, বাঘ আমার সামনে। আমার দিকে চেয়ে গুঁড়ি মেরে বসেছিল ও, রোদ ঝলকাচ্ছিল ওর বাঁ কাঁধে এবং আমার দুটি বুলেট খেয়ে একটি শব্দও না করে কাত হয়ে গড়িয়ে গেল ও।

সামনে দাঁড়িয়ে ওর মহিমাময় আকারটি চোখ বুলিয়ে দেখলাম যখন, তখন আমার সামনে পড়ে আছে তা নিশ্চিত জানবার জন্য পায়ের নিচের নরম অংশ পরীক্ষা করার প্রয়োজন হল না।

চারদিন আগে ছোঁড়া বুলেটের প্রবেশ স্থানটি চামড়ার এক ভাজে চাপা পড়েছিল এবং ওর মাথার পেছনে ছিল একটি বড় গর্ত, সেটি বিস্ময়জনকভাবে একেবারে পরিষ্কার ও সেরে ওঠা।

আমি জানতাম আমার রাইফেলের গুলির শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে, তাই উল্কণ্ঠা থেকে মুক্তি দিতে তাড়াতাড়ি বাড়ি গেলাম এবং যখন এক পট চা পান করছি এবং এই শিকার কাহিনীর শেষ অধ্যায় শোনাচ্ছি আমার লোকেরা জড় হতে থাকল।

কুড়িটি মানুষের এক বাহক-দল নিয়ে আমার বোন এবং রবিনের সঙ্গে, যেখানে বাঘটি পড়ে আছে সেখানে ফিরে এলাম এবং রশি দিয়ে ওকে খুঁটিতে বাঁধার আগে আমার বোন এবং আমি ওকে মাপলাম নাক থেকে লেজের ডগা এবং লেজের ডগা থেকে নাক অবধি। প্রথমবার কোনো ভুল করি নি সে-বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য বাড়িতে এসে আবার মাপলাম ওকে। এই পরিমাপগুলির কোনো দাম নেই, কেননা সেগুলিকে সার্টিফিকেট দিতে কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষী হাজির ছিল না। তবু বাঘের থাবার ছাপ দেখে জঙ্গল সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকেরা যে রকম নির্ভুলভাবে বাঘের দৈর্ঘ্য নিরূপণ করতে পারেন, তা বোঝাবার পক্ষে মাপগুলি আগ্রহোদ্দীপক। আপনাদের মনে থাকবে উইন্ডহ্যাম বলেছিলেন, বাঘটি ‘বিটুইন পেগস’ দশ ফুট, তা ‘ওভার কার্ভ মোটামুটি দাঁড়ায় দশ ফুট ছয় ইঞ্চি। একজন শিকারী বলেছিলেন ‘ওভার কার্ভস’ বাঘটি দশ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, আরেকজন বলেছিলেন ও দশ ফুট ছ ইঞ্চি অথবা কিছু বেশি হবে। এই সব আন্দাজী হিসেব করার সাত বছর বাদে গুলি খাওয়ার পর আমার বোন এবং আমি বাঘটিকে ‘ওভার কার্ভ দশ ফুট সাত ইঞ্চি এইমত মেপে দেখি।

গল্পটি আমি কিছু বিস্তারিত করেই বললাম, আমার নিশ্চিত মনে হচ্ছে ১৯২০ থেকে ১৯৩০-রে মধ্যে যাঁরা বাঘটির পেছনে ফেরেন, তারা জেনে কুতুহলী হবেন কিভাবে পাওয়ালগড়ের কুঁয়ারসাহেবের অন্তিম ঘনিয়েছিল।