উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

পাঁচ । সিংহাসনের ছায়ায়

পাঁচ । সিংহাসনের ছায়ায়

খুব গোপনে চারশোখানা ছোট-বড়-মাঝারি জাহাজ সাজিয়ে নেপোলিয়ন যাত্রা করলেন সমুদ্র-পথে। জাহাজে আছে আটত্রিশ হাজার সৈন্য।

এবং জাহাজে আছেন একদল মহাপণ্ডিত। তাঁদের কেউ কেউ বৈজ্ঞানিক, কেউ দার্শনিক, কেউ প্রত্নতাত্বিক, কেউ রাসায়নিক, কেউ জ্যোতির্বিদ, কেউ জ্যামিতিবিদ বা চিত্রকর বা কবি বা স্থাপত্যবিদ প্রভৃতি। মোট একশো পঁচাত্তর জন। সৈনিকরা অবহেলাভরে এদের ডাকত ‘গাধার দল’ বলে।

সৈন্যরা লড়াই করবে আর পণ্ডিতরা করবেন প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অনুসন্ধান ও অনুশীলন।…এই অনুসন্ধানের ফলেই আজকের বিশ্ববিখ্যাত রোসেটা শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং সকলেই জানেন, এই অমূল্য শিলালিপিখানি পাওয়া গেছে বলেই আজ আমরা প্রাচীন মিশরের সভ্যতা, সাহিত্য, সমাজ ও ধর্ম সম্বন্ধে সমস্ত তথ্যই পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি।

এইখানেই নেপোলিয়নের মহামানবতা। তিনি কাঠগোঁয়ার এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতিহীন দিগবিজয়ী ছিলেন না। রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান—প্রত্যেক বিভাগেই তিনি তাঁর অসাধারণ মস্তিষ্কের পরিচয় রেখে গিয়েছেন।

ইংরেজরা খবর পেলেন, নেপোলিয়ন মস্ত একদল সৈন্য ও অনেক জাহাজ নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন ভূমধ্যসাগরের কোথায়। তাঁরা বিস্মিত হলেন, ভয় পেলেন। নৌ-সেনাপতি নেলসন নৌবহর নিয়ে তখনই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু কোথাও নেপোলিয়নকে পাওয়া গেল না।

নেলসন হতাশ ভাবে বললেন, ‘শয়তান লাভ করেছে শয়তানের সৌভাগ্য!’

ইতিমধ্যে নেপোলিয়ন খুব সহজে মাল্টা দ্বীপ দখল করে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে গিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পড়েছেন।

…উত্তপ্ত, আরক্ত মরু-জগৎ! হু-হু বাতাস আগুন-পাগল ধু-ধু মরুভূমির উপর দিয়ে ছোট চারিদিকে গরম বালি ছড়াতে ছড়াতে। মূর্তিমান অতীতের মতন গগনস্পর্শী পিরামিড অটল মহিমায় তাকিয়ে থাকে বর্তমান শূন্যতার দিকে; স্পিংগকস বা নারসিংহী আকাশে মাথা তুলে চিরস্তব্ধ মুখে গম্ভীরভাবে দেখে বহু যুগের ভুলে যাওয়া স্বপ্ন। শতাব্দীর পর শতাব্দীর পুঞ্জ পুঞ্জ ধুলা ঝরে পড়েছে তাদের পাষাণ পদতলে—তারা ভ্রূক্ষেপ করেনি, ফিরে তাকায়নি!

ঘোড়ার খুরে খুরে বালির মেঘ সৃষ্টি করে মিশরের ম্যামেলিউক সওয়াররা দলে দলে ধেয়ে আসছে ফরাসিদের আক্রমণ করবার জন্যে।

সেনাদলের সামনে ঘোড়ার পিঠে বসে পিরামিডের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে নেপোলিয়ন বললেন, ‘সৈন্যগণ, চল্লিশ শতাব্দী তোমাদের পানে তাকিয়ে আছে চোখ নামিয়ে।’

যুদ্ধে ম্যামেলিউকরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল। নেপোলিয়ন কায়রো শহর দখল করলেন (১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে)।

কিন্তু আবার সৌভাগ্যের সঙ্গে সঙ্গে এল দুর্ভাগ্য। নেলসন খুঁজতে খুঁজতে আবুকির উপসাগরে এসে ফরাসি নৌবহরকে আবিষ্কার করে ফেলেছেন। জলযুদ্ধে ফরাসিদের চারখানা ছাড়া সমস্ত জাহাজ ডুবে গেল (১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে)।

যদিও এই শোচনীয় পরাজয়ের জন্যে নেপোলিয়নকে কেউ দায়ী করবে না, তবু খবর শুনে তাঁর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।

কিন্তু তারপরেই নিজেকে সামলে নিয়ে সবাইকে তিনি বললেন, ‘দেখছি দেশে ফেরবার বা সেখান থেকে সাহায্য পাওয়ার পথ বন্ধ হল। উত্তম! আমাদের মাথা তুলে রাখতে হবে ঝড়-দোলানো জলের উপরে; ভয় নেই, সমুদ্র আবার হবে প্রশান্ত! প্রাচ্যের রূপ বদলে দেব আমরা—এই হয়তো বিধাতার বিধান! এইখানেই আমাদের থাকতে হবে, তারপর অতীতের বীরপুরুষদের মতন আমরাও হয়ে উঠব মহিমময়!’

তাঁর দৃষ্টি ছুটল ভারতবর্ষের দিকে। সেখানে তরবারি আস্ফালন করছেন ইংরেজদের মহাশত্রু টিপু সুলতান। তাঁর সঙ্গে চলতে লাগল নেপোলিয়নের কথাবার্তা। পারস্যের শা’য়ের সঙ্গেও ষড়যন্ত্র হতে লাগল। নেপোলিয়ন বললেন, ‘এখানে যদি কেবল পনেরো হাজার সৈন্য রেখে যেতে পারি, আর আমি যদি তিরিশ হাজার সৈন্য পাই, তাহলে ভারতবর্ষে যাত্রা করা অসম্ভব হবে না।’

ওদিকে ফরাসি নৌবহরের পরাজয়ে উৎসাহিত হয়ে তুর্কি ও মিশরীয়রা আবার শত্রু হয়ে দাঁড়াল। কামানের অভাবে একটি যুদ্ধে বিফল হয়ে বাকি যুদ্ধে ফরাসিরা জয়লাভ করলে।

হঠাৎ নেপোলিয়নের হাতে এসে পড়ল খানকয় পুরোনো ফরাসি সংবাদপত্র। দুঃসংবাদ! সমস্ত ইতালি আবার ফ্রান্সের হাতছাড়া হয়েছে।

সেনাপতি ক্লেবারকে মিশরের যুদ্ধ চালাবার জন্যে রেখে, পনেরো মাস পরে নেপোলিয়ন কয়েকজন মাত্র সঙ্গীর সঙ্গে গোপনে আবার স্বদেশের দিকে যাত্রা করলেন।…

আবার ফ্রান্স!…দিকে দিকে উঠল আনন্দ-কোলাহল! ‘নেপোলিয়ন আবার ফিরে এসেছেন! ফ্রান্সের মহাবীর আবার ফিরে এসেছেন! জয় নেপোলিয়নের জয়!’

জয়ধ্বনি শুনে শাসনসভার ডিরেক্টরদের বুক দুরু-দুরু কেঁপে উঠল। তাঁদের বুক অকারণে কাঁপেনি।

নেপোলিয়ন বজ্রকঠিন কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের হাতে আমি যে শ্রীসমৃদ্ধিশালী ফ্রান্সকে সমর্পণ করে গিয়েছিলুম, তোমরা তার কী দশা করেছ? আমি শান্তিপ্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলুম, এসে দেখছি যুদ্ধ! আমি তোমাদের জয়গৌরবের অধিকারী করে গিয়েছিলুম, এসে দেখছি তোমরা পরাজিত! আমি তোমাদের কাছে কোটি কোটি টাকা রেখে গিয়েছিলুম, এসে দেখছি তোমরা ভিক্ষুক! তোমাদের নিয়ে আর চলবে না!’

ডিরেক্টরদের বুক অকারণে কাঁপেনি।

ফরাসি সাধারণতন্ত্রের দ্বারা গৃহীত দ্বিতীয় মাসের নাম Brumaire। ওই মাসের ৯ তারিখ। সেইদিনই সব হিসাবনিকাশ হয়ে গেল। নেপোলিয়ন সৈন্যদের সাহায্যে অকর্মণ্য ডিরেক্টরদের শাসনসভা থেকে দূর করে দিলেন (২৪ ডিসেম্বর, ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে)।

গত কয়েক বৎসরের ধারাবাহিক দুর্ভাগ্য, বিপ্লব ও অরাজকতার ফলে ফ্রান্স এমন শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে, নেপোলিয়নের কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে কিছুমাত্র ইতস্তত করলে না। নতুন শাসন-সভার নিয়মতন্ত্র যখন জনসাধারণের সামনে দাখিল করা হল, তখন তার স্বপক্ষে ভোট পাওয়া গেল ৩০,১১,০০৭ এবং বিপক্ষে ভোটের সংখ্যা ১,৫৬২ মাত্র!

নেপোলিয়ন হলেন প্রধান এবং আর দুজন হলেন তাঁর সহকারী শাসনকর্তা—তাঁদের নাম হল যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শাসনকর্তা। প্রজাতন্ত্র এগিয়ে গেল অনেকটা রাজতন্ত্রের কাছাকাছি। এইবারে নেপোলিয়ন নিশ্চয়ই দূর থেকে পথের শেষ দেখতে পেলেন—কিন্তু, সবটা নয়! কোনও মানুষ—এমনকী মহামানুষও জীবনপথের শেষটা সম্পূর্ণ দেখতে পায় না, কারণ মাঝে দোলে নিয়তির রহস্যময় কুহেলিকা।

…টুইলারিস রাজপ্রাসাদ! ফ্রান্সের রাজাদের নিবাস। নেপোলিয়ন আজ সেখানে বসে মন্ত্রণাসভা আহ্বান করেন। তাঁর সঙ্গে আরও দুজন কনসাল আছেন বটে, কিন্তু তাঁরা হচ্ছেন নেপোলিয়নেরই প্রতিধ্বনি!

নেপোলিয়ন সর্বপ্রথমে রচনা করলেন নতুন আইনের খসড়া, কারণ বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের আইনকানুন একরকম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বললেই হয়। প্রায় দেড়শত বৎসর হতে চলল, আজও ফ্রান্সে Code Rapoleon বা নেপোলিয়ন-সংহিতা অনুসারে আদালতের বিচারকার্য নির্বাহিত হয়। এবং আজও মধ্য ও দক্ষিণ জার্মানি, প্রুশিয়া, সুইজারল্যান্ড, স্পেন—এমনকি মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা প্রভৃতি দেশের উপরেও নেপোলিয়ন-সংহিতার প্রভাব বিদ্যমান আছে!

ঘরের ব্যাপার ভালো করে গুছিয়ে নিয়ে নেপোলিয়ন বাইরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

সশস্ত্র ইংলন্ড তাঁর বিরুদ্ধে। প্রুশিয়ার রাজাও ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছেন। অস্ট্রিয়া আবার ইতালি কেড়ে নিয়েছে। ফ্রান্স একা এবং তার চারিদিকে বলবান শত্রু। অন্য কোনও লোক হলে ভয়ে ভেঙে পড়ত। কিন্তু নেপোলিয়ন একটুও বিচলিত হলেন না।

ফ্রান্সে তখন আর একজন বড় সেনাপতি ছিলেন। তাঁর নাম জেনারেল মোরো। অনেকেই তাঁকে নেপোলিয়নের সমকক্ষ বলে মনে করতেন এবং অনেকের মতে তাঁর সঙ্গে নেপোলিয়নের রেষারেষি ছিল।

কিন্তু এক্ষেত্রে নেপোলিয়ন যথেষ্ট উদারতা প্রকাশ করলেন। দেড় লক্ষ সৈন্যের সঙ্গে মোরোকে তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন, ফ্রান্সের যত রণপ্রবীণ যোদ্ধা ছিল সেই বিপুল বাহিনীর মধ্যে। সেখানে মোরো, সেনাপতি নে ও গ্রাউচির সাহায্যে অস্ট্রিয়ানদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত হোহেনলিন্ডেন যুদ্ধে (১৮০০ খ্রিস্টাব্দে) জয়লাভ করেন।

জেনারেল মেসেনাকে পাঠানো হল ইতালিতে। কিন্তু সেখানে ফরাসিরা বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারলে না। মেসেনা পিছু হটে জেনোয়া নগরে গিয়ে আশ্রয় নিলেন—নগর হল অবরুদ্ধ। সুচেট নামে আর একজন ফরাসি সেনাপতিও অস্ট্রিয়ানদের সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। অস্ট্রিয়ার প্রধান সেনাপতি কাউন্ট মেলাস সানন্দে দেখলেন, তাঁর সামনে ফ্রান্সের দ্বার খোলা। অস্ট্রিয়ানরা সগর্বে বলতে লাগল—আমরা ইতালি জয় করেছি, এইবারে ফ্রান্সের উপরে হানা দেব।

নেপোলিয়ন বুঝলেন, অবিলম্বে সসৈন্যে ইতালিতে যেতে না পারলে সর্বনাশের সম্ভাবনা। কিন্তু সৈন্য কোথায়? আসল ফৌজ তো জেনারেল মোরের সঙ্গে!

তিনি তাড়াতাড়ি সৈন্য সংগ্রহ করতে লাগলেন। কিছুদিন পরে অর্ধশিক্ষিত নতুন লোক নিয়ে যে ফৌজ গঠন করা হল, গুপ্তচরের মুখে তার খবর পেয়ে অস্ট্রিয়ানরা বেজায় ঠাট্টা করতে আরম্ভ করলে—তাদের খবরের কাগজে বেরুতে লাগল হরেকরকম ব্যঙ্গচিত্র!

নেপোলিয়ন স্থির করলেন, অপ্রত্যাশিত ভাবে তিনি অস্ট্রিয়ানদের আক্রমণ করবেন।

একচক্ষু হরিণের মতন অস্ট্রিয়ান সেনাপতি মেলাসের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ইতালিতে আবদ্ধ অর্ধপরাজিত ফরাসিদের দিকে। এবং তিনি জানতেন, নেপোলিয়নকে আসতে হবে সমতল ক্ষেত্র দিয়ে।

নেপোলিয়ন ও মেলাসের মাঝখানে আছে ইউরোপের হিমালয়, মহাপর্বত আল্পস এই মেঘচুম্বী হিমারণ্য পার হয়ে বিপুল এক বাহিনী যে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, এ-কথা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।

কিন্তু নেপোলিয়ন বললেন, ‘দু-হাজার বৎসর আগে কার্থেজের মহাবীর হানিবল যা করতে পেরেছিলেন, আমরাই বা তা করতে পারব না কেন?’

এই অপূর্ব প্রস্তাব শুনে সৈনিকরাও পরম উৎসাহিত হয়ে উঠল।

তুষার, তুষার, তুষার! ডাইনে বামে তুষারের প্রাচীরের পর তুষারের প্রাচীর, পায়ের তলায় তুষার-কর্দম, মাথার উপরে ঝরছে তুষার বৃষ্টি। সংকীর্ণ পথের পাশে বিরাট অতল খাদ—ভীষণ মৃত্যুগহ্বর! কোথাও কোথাও পথের রেখা পর্যন্ত বিলুপ্ত। একটু শব্দ হলেই পাহাড়ের মতন বৃহৎ বরফের স্তূপ সেই নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার রাজ্যকে বজ্ররবে প্রকম্পিত করে হুড়মুড়িয়ে নেমে আসে এবং শত শত লোককে নিয়ে অতল পাতালের দিকে অদৃশ্য হয়। এরই ভিতর দিয়ে হাজার হাজার ফরাসি সৈন্য অগ্রসর হচ্ছে ধীরে ধীরে, ভয়ে নিশ্বাস বন্ধ করে। পদাতিক, অশ্বারোহী, মালবাহী সৈনিক! ভারী ভারী কামানের গাড়ি, রসদের গাড়ি! এক-একটি কামান টানতে দরকার হয় একশো লোক। নেপোলিয়ন নিজে সঙ্গে সঙ্গে থেকে তদবির করেন—সাধারণ সৈনিকের মতন তিনিও করেন সমান কষ্টভোগ।

কাউন্ট মেলাস ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারেননি। পাভিয়া শহরের এক মহিলা-বন্ধুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘তোমাকে পাভিয়া ত্যাগ করতে হবে না। ওখানে কোনও বিপদের ভয় নেই।’ ঠিক তার বারো ঘণ্টা পরে নেপোলিয়ন সেখানে গিয়ে হাজির হলেন।

ইতিমধ্যে জেনোয়ার পতন হল, ফরাসি সেনাপতি মেসেনা আত্মসমর্পণ করলেন।

ওদিকে নেপোলিয়নের সঙ্গী সেনাপতি লেনস মন্টিবেলো ক্ষেত্রে ভীষণ এক যুদ্ধে অস্ট্রিয়ানদের হারিয়ে দিলেন।

এই সু ও কু খবর একসঙ্গে নেপোলিয়নের কানে গিয়ে পৌঁছোলো। তিনি ধাবিত হলেন মেলাসের অধীনস্থ প্রধানশত্রু-বাহিনীর দিকে। দুইপক্ষে মিলন হল বিখ্যাত মারেঙ্গো ক্ষেত্রে (১৪ জুন, ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে)।

মেলাসের সৈন্যসংখ্যা চল্লিশ হাজার। নেপোলিয়নের অধীনে বিশহাজারের বেশি সৈন্য ছিল না। তবু তিনি বীর-বিক্রমে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করলেন। তিনি সেনাপতি দেসেক্সের সঙ্গে পাঁচহাজার সৈন্য রেখে এগিয়ে এসেছিলেন এবং কথা ছিল এই সংরক্ষিত সেনাদল যথাসময়ে রণক্ষেত্রে আগমন করবে।

দুই পক্ষে যুদ্ধ হল বহুক্ষণ ধরে। কিন্তু চল্লিশ হাজার শত্রুর সঙ্গে বিশ হাজার ফরাসি শেষ পর্যন্ত যুঝতে পারলে না, তারা পশ্চাৎপদ হতে লাগল।

মেলাস বিপুল আনন্দে তাঁর সহকারী জাককে ডেকে বললেন, ‘আমরা জয়লাভ করেছি। শত্রুরা পালাচ্ছে, তুমি অশ্বারোহীদের নিয়ে ওদের পশ্চাদ্ধাবন করো।’ এই বলে তিনি নিশ্চিন্ত ভাবে রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে গেলেন। ‘লড়াই তো শেষ হয়ে এল, আর এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করি কেন?’—তাঁর ভাবটা ছিল অনেকটা এইরকম আর কি!

নেপোলিয়ন যখন ভাবছেন ভাগ্যদেবী আমার উপরে আবার বিমুখ হয়েছেন, তখন প্রান্তরের প্রান্তে আবির্ভূত হল দেসেক্সের সংরক্ষিত সেনাদল।

দেসেক্স ঘোড়া ছুটিয়ে নেপোলিয়নের কাছে এসে বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে যুদ্ধে আমরা পরাজিত হয়েছি।’

নেপোলিয়ন বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি। তুমি আক্রমণ করো, আমি পলাতকদের ফিরিয়ে আনি।’

তাজা পাঁচ হাজার সৈনিক নিয়ে দেসেক্স শত্রুদলের উপরে বাঘের মতন ঝাঁপিয়ে পড়লেন। যারা পালাচ্ছিল, নেপোলিয়নের উৎসাহবাণী শুনে তারাও আবার ফিরে দাঁড়াল। খানিক পরেই মারেঙ্গোর ক্ষেত্রে দশ হাজার হতাহত অস্ট্রিয়ান সৈন্যের উপরে উড়তে লাগল ফরাসিদের বিজয়পতাকা। বন্দিও হল কয়েক হাজার শত্রু!

নেপোলিয়নের জীবনে মারেঙ্গো হচ্ছে একটি অদ্ভুত ও স্মরণীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তিনি হেরেও জিতে গেলেন। এবং এই একটিমাত্র যুদ্ধের ফলে অস্ট্রিয়ার সমস্ত লম্ভঝম্প বন্ধ হয়ে গেল, সন্ধি করে সে ইতালিকে আবার ফিরিয়ে দিলে নেপোলিয়নের হাতে! কিন্তু যাঁর জন্যে মারেঙ্গো হল ফরাসিদের গৌরব-স্মৃতি, সেই সেনাপতি দেসেক্স রণক্ষেত্রেই বরণ করে নিলেন বীরের মৃত্যুকে।

ফরাসিরা যখন মারেঙ্গোর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন একজন পর্যটক ফ্রান্সের দিকে আসছিলেন সেইখান দিয়ে। তিনি সদলবলে দেসেক্সের আগমন দেখেননি। ফ্রান্সে পৌঁছে তিনি দিলেন ফরাসিদের পরাজয়-সংবাদ! নেপোলিয়নের শত্রুরা যো পেয়ে অমনি ষড়যন্ত্র আরম্ভ করলে—প্রথম কনসালকে তাড়াবার জন্যে! কিন্তু তাদের বড় আশায় পড়ল ছাই, কারণ তারপরেই এল এই অপূর্ব জয়লাভের সমস্ত সংবাদ—সঙ্গে সঙ্গে শত্রুদের মাথা হেঁট, মুখ বন্ধ!

মারেঙ্গোর যুদ্ধের পরে ফরাসি দেশে নেপোলিয়নের প্রভুত্ব হল সুপ্রতিষ্ঠিত। এবং ফরাসিরা বেশ বুঝলে, তাদের রক্ষা করতে পারেন একমাত্র নেপোলিয়নই।

নেপোলিয়নের ক্রমোন্নতি দেখে রাজপক্ষভুক্ত ব্যক্তিরা অত্যন্ত ভীত হল। তারা ফ্রান্সের সিংহাসনে বিতাড়িত ও নির্বাসিত রাজবংশের কারুকে বসাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তারা যখন বুঝলে যে নেপোলিয়ন বেঁচে থাকতে তাদের বাসনা পূর্ণ হওয়ার কোনওই সম্ভাবনা নেই, তখন তাঁকে হত্যা করবার ঘৃণ্য চেষ্টা হল।

নেপোলিয়ন একদিন সস্ত্রীক রঙ্গালয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ গাড়ির অনতিদূরেই ফাটল একটা মস্ত বোমা। আশপাশের বাড়িগুলোর ছাদ ভেঙে পড়ল এবং নেপোলিয়নের গাড়িরও জানলাগুলো চুরমার হয়ে গেল—কিন্তু তিনি ও তাঁর স্ত্রী বেঁচে গেলেন আশ্চর্যভাবে।

অধিকাংশ ইউরোপ হল নেপোলিয়নের বশীভূত। জার্মানি, অস্ট্রিয়া, স্পেন, ইতালি, রুশিয়া ও হল্যান্ড—সকলেই নেপোলিয়নের দলে। তাঁকে স্বীকার করতে নারাজ কেবল ইংল্যান্ড। নেপোলিয়ন স্থির করলেন এইবার তাঁর শেষশত্রু নিপাত করবেন।

ডানকার্ক ও বুলোন বন্দরে ইংল্যান্ড আক্রমণের বন্দোবস্ত হতে লাগল। নেপোলিয়ন নানা আকারের অনেক জাহাজ ও একলক্ষ সৈন্য এনে সেখানে জড়ো করলেন।

এই বন্দোবস্ত পণ্ড করবার জন্যে ইংল্যান্ড থেকে প্রেরিত হলেন নেলসন। ফরাসিদের সঙ্গে ইংরেজদের জলযুদ্ধ হল। যুদ্ধে হেরে ইংরেজরা পলায়ন করলেন। তাঁদের অনেক লোকও মারা পড়ল। নেপোলিয়নের সৈনিকদের কাছে নেলসনের এই প্রথম পরাজয়।

নেলসনের অসাফল্যে ইংল্যান্ডের ভাবনার আর সীমা রইল না। ইংরেজরা ভাবলেন, ইউরোপে কেউ আমাদের বন্ধু নেই। নেপোলিয়ন যদি ইংল্যান্ড আক্রমণ করেন তাহলে হয়তো আমরা তাঁকে ঠেকাতে পারব না। তখন তাঁরা বাধ্য হয়ে নেপোলিয়নের সঙ্গে সন্ধি করে ফেললেন (১৮০২ খ্রিস্টাব্দে)। এই সন্ধি আমেন্সের সন্ধি নামে বিখ্যাত। দীর্ঘ দশবৎসর পরে ইউরোপের সর্বত্র শান্তির প্রতিষ্ঠা হল। কেবল রণক্ষেত্রে নয়, রাজনীতির ক্ষেত্রেও নেপোলিয়নের যশ হল ষোলো কলায় পরিপূর্ণ।

ফ্রান্সের কৃতজ্ঞ জনসাধারণ নেপোলিয়নকে তখন আজীবনের জন্যে কনসাল বলে স্বীকার করে নিলে।

নেপোলিয়ন শ্রেষ্ঠাসন লাভ করলেন। আর একপদ অগ্রসর হলেই রাজমুকুট!