পর্ণশবরীর শাপ – ৫

খুব বিপদের সময়েও কখনও কখনও মানুষের মাথা আশ্চর্য রকম ঠান্ডা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। আচমকা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল তিতাস এবং ঘরের সব আলো জ্বেলে দিল আর দু’টো ঘরের মাঝে যে কাঠের দেওয়াল তাতে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে উঠল, পল্লব… অমিয়।

তিতাসের ডাক এবং ওই জোরাল শব্দের মধ্যে যে তীব্র আকুতি ছিল তা অমিয় আর পল্লবের সুষুপ্তিকে ছিঁড়ে ফেলতে বিন্দুমাত্র সময় নেয়নি। এক সাথেই ঘুম ভেঙে গেল দু’জনের। এক মুহূর্তের জন্য দু’জন দু’জনের দিকে তাকাল, গায়ের কম্বল ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে এল বাইরে।

পল্লব আর অমিয় এসে দাঁড়াতে দরজাটা খুলে দিয়েছিল তিতাসই। তার পর বসে পড়েছিল মিতুলকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে। মিতুল তখনও একটা ছোট্ট পাখির মতো কাঁপছে। তার সারা মুখ রক্তশূন্য।

পল্লব আর অমিয় একসঙ্গেই উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করল, কী হয়েছে? তোরা এমন করছিস কেন?

তিতাস কিছু বলার আগেই মিতুল কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল, বাইরে একটা মেয়ে কাঁদছিল আর দেওয়ালে মাথা ঠুকছিল। এক দিকে না। দু’দিকের দেওয়ালেই। আর কান্নাটা যেন দরজার তলা দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢুকে আসছিল ঘরে।

একটু থমকে গেল পল্লব। নরম গলায় বলল, স্বপ্ন দেখেছিস মিতুল?

প্রতিবাদ করে উঠল তিতাস, না পল্লব, স্বপ্ন নয়। আমরা দু’জনেই স্পষ্ট শুনেছি। ফিল করেছি। দু’জনে তো একসাথে ভুল শুনব না। তাই না?

কিন্তু এত রাতে কে কাঁদবে এখানে বসে? আর আমরা তো বাইরে কারও চিহ্ন দেখলাম না। আমাদের দেখে সে লজ্জা পেল না কি? শুধু মেয়ের সামনে কাঁদে, ছেলেদের দেখলে পালিয়ে যায় এ আবার কেমন কাঁদিয়ে?

কাতর চোখে পল্লবের দিকে তাকাল মিতুল। যেন বলতে চাইছে, মজা করছ পল্লবদাদা? আমাদের কষ্ট হচ্ছে আর তুমি হাসছ?

সারল্যমাখা এই দুই চোখের সামনে গুটিয়ে গেল পল্লব। বয়ান পাল্টে বলল, না, হতেই পারে। এমন অনেক কিছুই হয় যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আসলে…

কথা কেটে অমিয় বলল, বাদ দে এ সব। আমার মনে হয়, সবাই মিলে একবার বাইরে থেকে ঘুরে আসি চল। চারপাশটা দেখলে হয়তো কিছু বুঝতে পারব।

আঁতকে উঠল মিতুল, না, না। আমি যাব না। আমি যাব না।

এগিয়ে এল অমিয়। পরমাত্মীয়ের মতো হাতখানি রাখল মিতুলের ঠিক মাথার ওপর। সে হাতে মিশে আছে অনেকখানি ভরসা। মুখ তুলে তাকাল মিতুল। নরম গলায় অমিয় বলল, ভয় কি মিতুল? আমরা সবাই তো আছি। এসো, বাইরে এসো। আমি বলছি বাইরে এলে তোমার ভয়টা কেটে যাবে।

সবাই মিলে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল ওরা। কুয়াশাটা এখন যেন একটু কেটেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা না গেলেও চাঁদের আলোয় অদূর উপত্যকার ঘুমন্ত পাইনবনানী দিব্যি দৃশ্যমান। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। সে শৈত্য কেটে বসে যাচ্ছে খোলা চামড়ায়। যত দূর চোখ যায় কেউ কোত্থাও নেই। শুধু রূপোলী রেনু মেখে পিঠ পেতে শুয়ে আছে নীরব বনভূমি। অমিয় বলল, দেখেছ তো মিতুল কিচ্ছু নেই? আর ভয় পেয়ো না।

নিজেকে শক্ত করে তিতাসও হাত রাখল মিতুলের পিঠে, ঘাবড়াস না। অনেক সময় অমন হয়।

এ বার আর চুপ করে থাকল না মিতুল। বলে ফেলল, কিন্তু রুমালটা!

চমকে উঠল সবাই। তিতাস বলল, রুমাল মানে?

কাঁপা গলায় মিতুল বলল, যে রুমাল দিয়ে ওই মূর্তির শ্যাওলা ঘষে তুলেছিলাম, সেই রুমালটা ফিরে ফিরে আসছে তিতাসদিদি।

অবাক হল তিতাস, মানে?

মানে, রুমালটা আমি ওই ত্রিকোণ খাঁজটার নীচে ফেলে এসেছিলাম। ঘরে এসে দেখলাম, সেটা আমার ট্রলির মধ্যে। তার পর আমি ওটাকে টিস্যু পেপারে মুড়ে বাথরুমের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু ওটা আবার ঘরের মধ্যে চলে এসেছিল।

হতবাক হয়ে গেল অমিয় আর পল্লব। মূর্তি, রুমাল, ত্রিকোণ খাঁজ এই ব্যাপারগুলো ওদের অজানা। তিতাসের দিকে তাকিয়ে পল্লব বলল, মূর্তি মানে? কীসের মূর্তি?

তিতাস বলল, তোদের বলা হয়নি। তোরা যখন রাস্তা খুঁজতে গেছিলি তখন আমি আর মিতুল হঠাৎ করে ফুলের গন্ধ পাই।

ফুলের গন্ধ?

হ্যাঁ রে। অদ্ভুত একটা গন্ধ। আমাদের ছাতিম ফুলের চেয়েও তীব্র অথচ অতটাও জোরাল নয়। মানে এমন গন্ধ আমি আগে কখনও পাইনি। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো কোনও পাহাড়ি অর্কিড থেকে গন্ধটা আসছে। ওটাই খুঁজতে গিয়ে আমরা একটা দেওয়াল খুঁজে পাই যেটার এক পাশে কুলুঙ্গির মতো একটা তেকোণা খাঁজ করা আছে। কিন্তু অনেক দিন কেউ ও দিকে যায় না বলে হয়তো শ্যাওলা পড়েছে দেওয়াল জুড়ে। মিতুলের রুমাল দিয়ে সেই জায়গাটা পরিষ্কার করতেই দেখি পাথরে খোদাই করা একটা দেবীমূর্তি।

কোন দেবী?

সে আমি জানি না। অচেনা। তার পরই তোরা ডাকলি আর আমরা চলে এলাম।

মিতুল বলে উঠল, আর আমি শিওর ওখানেই রুমালটা ফেলে এসেছিলাম।

অমিয় বলল, এখন কোথায় রুমালটা?

মিতুল বলল, শেষ বার দেখেছি, খাটের সামনে মেঝেতে পড়ে আছে।

মিতুলের হাত ধরল অমিয়, চলো তো দেখি। ব্যাপারটা সন্দেহজনক লাগছে।

কথাটা বলে সবে ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে অমিয়, ঠিক তখনই গন্ধটা পেল ওরা। অমিয় আর পল্লবের কাছে গন্ধটা নতুন হলেও মিতুল আর তিতাসের যথেষ্ট পরিচয় আছে এই গন্ধের সঙ্গে। অস্ফুটে বলে উঠল তিতাস, এ তো সেই ফুলের গন্ধটা! এখানে কী করে এল!

ততক্ষণে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে পল্লব আর অমিয়। ওরাও এই অত্যাশ্চর্য গন্ধের উৎস সন্ধানে চারদিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ তিতাসদের ঘরের জানলাটার নীচে চোখ আটকে গেল পল্লবের। কী যেন লেগে রয়েছে জানলার নীচের দেওয়ালে। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠছে। সে বলল, ওগুলো কী?

পল্লবের কথায় সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষিত হল সে দিকে। পায়ে পায়ে জানলার কাছে এগিয়ে গেল ওরা। কিন্তু মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বেলে যা দেখল তাতে অন্তরাত্মা অবধি শিউরে উঠল ওদের। জানলার ঠিক নীচে দেওয়ালের গায়ে তিন জায়গায় পাশাপাশি সমান দূরত্বে লেগে রয়েছে টাটকা রক্ত! সে রক্ত গড়িয়ে নামছে দেওয়াল বেয়ে। তিতাসের কানে বেজে উঠল সেই ‘দুপ’ ‘দুপ’ ‘দুপ’। কেউ যেন দেওয়ালে ঠুকে ঠুকে ফাটিয়ে ফেলেছে মাথা!

এই গভীর, নিশুতি, হিমেল হাওয়ার রাতে বিস্মিত, আতঙ্কিত ও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চারটি প্রাণী। কী হচ্ছে বা কেন হচ্ছে সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই তাদের। তারা বুঝতেও পারছে না, কোন অজান্তে আদিম এক অভিশাপ গ্রাস করেছে তাদের দুই সঙ্গীকে। স্থাণুর মতোই দাঁড়িয়েছিল ওরা। আচমকাই এক ঝটকায় অমিয়র হাত ছাড়িয়ে ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ল মিতুল। আকস্মিকতার প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে অমিয় চিৎকার করে উঠল, মিতুল, তার পর এক লাফে সেও গিয়ে ঢুকল ঘরে।

পল্লব আর তিতাস ঘাবড়ে গেছিল। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে পল্লব বলল, কী হল ব্যাপারটা?

কাঁপা গলায় তিতাস বলল, বুঝতে পারছি না। আয় দেখি।

ঘরে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেল পল্লব আর তিতাস। এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে ওদের চোখের সামনে। প্রচণ্ড ভয়ে বিস্ফারিত চোখে মিতুল পায়ে পায়ে পিছিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের দিকে আর তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অমিয়। মিতুল তার হাত দু’টো জড়ো করে রেখেছে বুকের কাছে। যেন সে নগ্ন এবং প্রাণপণে নিজের আব্রু রক্ষার চেষ্টা করছে। তার আতঙ্কিত দৃষ্টি বলে দিচ্ছে সে অমিয়কে ভয় পাচ্ছে। ভাঙা ফ্যাসফ্যাসে গলায় সে বলছে, তাকিয়ো না। তাকিয়ো না আমার দিকে। আমার লজ্জা করছে। খুব লজ্জা করছে।

আরও দু’পা এগিয়ে গেল অমিয়। ঈষৎ কঠিন গলায় বলে উঠল, কী পাগলামি হচ্ছে মিতুল? কেন এমন করছ? এই তো আমি। এসো। আমার কাছে এসো।

হাত বাড়িয়ে দিল অমিয়, কিন্তু সেই স্পর্শ থেকে বাঁচতেই মিতুল যেন লাফিয়ে উঠে গেল খাটের ওপর। এক কোণে সিঁটিয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, না না। চলে যাও। চলে যাও। আমার লজ্জা করছে।

চিৎকার করতে করতেই মিতুলের চোখ পড়ল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পল্লব আর তিতাসের ওপর। তাতে যেন সে আরও গুটিয়ে গেল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে দু’হাতে মুখ ঢাকল, কেন এমন করছ তোমরা? কেন সবাই মিলে দেখছ আমায়? বলছি তো আমার লজ্জা করছে।

হতাশ মুখে ফিরে তাকাল অমিয়, এ কী বিপদ হল বল তো পল্লব? ও এমন করছে কেন? ওর কী হয়েছে আমি তো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। লজ্জা করছে মানেটা কী?

তিতাস বলল, তুই সরে আয়। আমি দেখছি।

খাটের এক কোণে কম্বলগুলোকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছিল মিতুল আর তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তিতাস। কিন্তু খাটের কাছে গিয়ে আচমকা থমকে দাঁড়াল সে। পেছন ঘুরল এবং অমিয় আর পল্লবকে দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠল। নিমেষে বদলে গেল তার চাহনি। অস্থির হয়ে উঠল আঁখিতারা দু’টি। তাতে এসে জড়ো হল রাজ্যের সংশয়। থরথর করে কেঁপে উঠল তিতাস। তার পর আব্রু রক্ষার মতো করে হাত দু’টো বুকের কাছে জড়ো করে অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল, দেখিস না। দেখিস না তোরা। আমার লজ্জা করছে। খুব লজ্জা করছে।

সকাল সাড়ে পাঁচটা। ঘুম ভাঙলেও তখনও বিছানা ছেড়ে উঠিতে পারেনি বারাসাত। আড়ামোড়া ভাঙছে। এমন সময় ‘শ্রীরঞ্জনী’ অর্থাৎ শ্রী নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটি পুলিশের জিপ। জিপ থেকে নেমে এলেন বারাসাত থানার এএসআই দীপক পাল। অত্যন্ত দ্রুত পদক্ষেপে তিনি ঢুকে গেলেন বাড়ির ভিতর।

ঠিক কুড়ি মিনিট পর জিপটা যখন ফিরতি পথ ধরল তখন পেছনের সিটে দীপক পালের পাশে বসে আছেন ভাদুড়ি মশায়। চিন্তায় কুঁচকে আছে তাঁর ভ্রূযুগল। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, অমিয় তোমায় শুধু এটুকুই বলেছে?

দীপক পালের মধ্যেও একটা অস্থিরতা কাজ করছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ স্যার। আর ওঁরা দু’জনেই খুব লজ্জিত আপনাকে এই বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য।

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। বললেন, আমার বিড়ম্বনাটা বড় কথা নয় দীপক। যে বিপদ লৌকিক তার চরিত্র আঁচ করা যায় কিন্তু যে বিপদ অলৌকিক তার শিকড় অবধি না পৌঁছলে সমাধানের আন্দাজ পাওয়া যায় না। আমাদের পৌঁছতে তো বেশ কিছুটা সময় লাগবে, আমার ভয় করছে, তার মধ্যে না নতুন কোনও বিপদ ঘটে। তিতাসের মতো শক্তিমতী মেয়ের হঠাৎ করে এই লজ্জা পাওয়া আমার মোটে ভাল ঠেকছে না।

ভাদুড়ি মশায় শুধু তিতাসের কথা বললেন কারণ খবরটা তিনি শুনেছেন দীপক পালের মুখ থেকে আর দীপক পাল মিতুলের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। অমিয় ইচ্ছে করেই তাঁকে জানায়নি। ভাদুড়ি মশায়কে নিয়ে তিনিই এতটা পথ আসবেন। তিনি যদি মেয়ের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন তা হলে মুশকিল।

ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ অমিয়র ফোনটা এসেছিল। পুলিশের চাকরিতে ফোন বন্ধ বা সাইলেন্ট করে ঘুমনো যায় না। অন্তত দীপক পাল ঘুমোন না। তাই ফোন বাজতেই ধড়মড় করে উঠে বসেছিলেন। স্ক্রিনে অমিয়র নামটা দেখে তাঁর বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। আজ ভোরেই তো পল্লব আর তিতাস এসে মিতুলকে নিয়ে গেল। অমিয় যে ওদের সঙ্গে যাবে সেটা তখনই বলেছিল তিতাস। এখন তো ওদের চটকপুরের হোম-স্টেতে জমিয়ে ঘুম দেওয়ার কথা। তা হলে? বিপদ আশঙ্কা করে কাঁপা হাতেই ফোন ধরেছিলেন দীপক পাল। ও দিকে থেকে উদভ্রান্তের মতো গলায় অমিয় বলেছিল, অনেক কষ্ট করে টাওয়ার পেয়ে আপনাকে ফোন করেছি পালদা। যখন তখন ফোন কেটে যেতে পারে। আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। এখানে অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে আর আচমকাই আমাদের সবাইকে লজ্জা পেতে শুরু করেছে তিতাস।

ঘাবড়ে গেছিলেন দীপক পাল, লজ্জা পাচ্ছে? মানে?

মানে আমাদের দেখলে ও লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে। বলে বোঝাতে পারব না, ব্যাপারটা মারাত্মক রকমের অস্বাভাবিক। আমার আর পল্লবের বিশ্বাস এর পেছনে কোনও অলৌকিক শক্তির হাত আছে। আমাদের ক্ষমতা নেই এর সঙ্গে লড়াই করার। আপনি যে ভাবে হোক ভাদুড়ি স্যারকে কনভিন্স করে এখানে নিয়ে আসুন।

আশ্চর্য হয়েছিলেন দীপক পাল। বিস্ময়ে বলে ফেলেছিলেন, ভাদুড়ি স্যারকে নিয়ে চটকপুর? ওই রাস্তায় স্যার যাবেন কেমন করে?

বিপন্ন শুনিয়েছিল অমিয়র গলা, জানি না পালদা। যে ভাবে সম্ভব একটা কিছু ব্যবস্থা করুন। আমাদের বড় বিপদ।

ফোন কেটে গিয়েছিল। আর দেরি করেননি দীপক পাল। দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর মন বলছিল, তিতাসের বিপদ শুনলে ভাদুড়ি মশায়ও চুপ করে বসে থাকতে পারবেন না। তাই গুছিয়ে নিয়েছিলেন এক সেট গরম জামাকাপড় আর ভাদুড়ি মশায়ের অনুমতি ছাড়াই বাগডোগরার দু’টো টিকিট কেটে ফেলেছিলেন। দমদম থেকে সে ফ্লাইট ছাড়বে সকাল সাড়ে আটটায়।

অমিয় যতটুকু বলেছিল সবটাই ভাদুড়ি মশায়কে বলেছিলেন দীপক পাল। প্লেনের টিকিটের কথাও বলেছিলেন। তার পর বলেছিলেন, কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছি না স্যার, ওই রাস্তায় আপনি যাবেন কেমন করে?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর গভীর প্রজ্ঞার সাক্ষ্যবাহী, অতীব উজ্জ্বল, গভীরতম চোখ দু’টি দীপক পালের মুখে নিবদ্ধ করে বলে উঠেছিলেন, মনের জোরে।, হাঁক দিয়েছিলেন, বৌমা, আমার ক’টা গরম জামাকাপড় গুছিয়ে দাও।

. . .

হোম-স্টের সামনে যখন সুমোটা এসে পৌঁছল তখন দুপুর একটা। আকাশ মেঘে ঢাকা। রোদের চিহ্নমাত্র নেই। কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারপাশ। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে। বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনের টাওয়ার খোঁজার চেষ্টা করছিল অমিয়। সুমোটা এসে দাঁড়াতেই ছুটে এল। সুমোর ভিতরে উঁকি দিয়ে চিৎকার করে ডাকল, পল্লব।

বাইরে বেরিয়ে এল পল্লবও। দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে সুমো থেকে নেমে দাঁড়ালেন ভাদুড়ি মশায়। দীপক পাল এগিয়ে দিলেন তাঁর ক্রাচ দু’টি। ভারী অপরাধবোধ হল পল্লব আর অমিয়র। ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছেন বৃদ্ধ। ঘন কুয়াশায় নিঃশ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে তাঁর। তবু নেমেই তিনি প্রথম যে কথাটি বললেন সেটি হল, তিতাস কোথায়? আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলো।

ভাদুড়ি মশায় আর দীপক পালের জন্য দু’টি আলাদা ঘর আগে থেকেই বুক করে রেখেছিল পল্লব। সে বলল, নিয়ে যাব স্যার কিন্তু তার আগে আপনি একটু বিশ্রাম নিন। সবটা শুনে নিন।

রাস্তার ধকলে বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ভাদুড়ি মশায়। তাই বোধ হয় বিশ্রামের কথায় আপত্তি করলেন না।

ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে খানিকটা ধাতস্থ হলেন বৃদ্ধ। গরম কফি এনে দিলেন হোম-স্টের মালিক পেমা শেরপা। যদিও তাঁকে কিছুই খুলে বলেনি পল্লব বা অমিয় তবু তিনি আন্দাজ করতে পারছেন কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। কারণ সকাল থেকে মেয়ে দু’টো এক বারের জন্যেও ঘরের বাইরে বেরোয়নি। ব্রেকফাস্টও খায়নি। অতিরিক্ত কৌতূহল দেখানো তাঁর স্বভাব নয়, তাই কফির কাপগুলো নামিয়ে রেখে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তবে একটা ব্যাপার রীতিমতো তাঁর পিলে চমকে দিয়েছে। গত দশ বছর ধরে চটকপুরে হোম-স্টে চালাচ্ছেন তিনি, কোনও দিন এত বয়স্ক কাউকে সমতল থেকে আসতে দেখেননি। তাও আবার ক্রাচ নিয়ে! মনে মনে এই বুড়াবাবার মনের জোরকে সেলাম ঠুকলেন তিনি। হায় পেমা শেরমা, তিনি যদি এই বুড়াবাবাকে চিনতেন তা হলে হয়তো এত অবাক হতেন না।

কফিতে চুমুক দিয়ে দীপক পাল বললেন, মিতুলকে দেখছি না। সে কোথায়?

চোখাচোখি হল পল্লব আর অমিয়র। যেন এই প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষা করেছিল ওরা। পল্লব বলল, আপনি চিন্তা করবেন বলে ইচ্ছে করেই আপনাকে জানাইনি পালদা, একা তিতাসের নয়। মিতুলেরও এই একই সমস্যা হচ্ছে। সেও আমাদের দেখে লজ্জা পাচ্ছে।

যুগপৎ চমকে উঠলেন দীপক পাল ও ভাদুড়ি মশায়। বৃদ্ধের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল আর্তস্বর, সে কী!

ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ালেন দীপক পাল। বললেন, কোথায় আমার মেয়ে? আমাকে নিয়ে চলুন ওর কাছে।

ঘর থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিলেন দীপক পাল, অমিয় তাঁর হাত চেপে ধরল, একটা অনুরোধ করব পালদা?

অমিয়র চোখে চোখ রাখলেন দীপক পাল। এই মুহূর্তে তিনি আর অমিয়র অধস্তন না। তিনি সেই মেয়েটির বাবা, অমিয় যার পাণিপ্রার্থী। যেন সামান্য গুটিয়ে গেল অমিয়, তবু বলল, প্লিজ যাবেন না পালদা। এই অবস্থায় আপনি হয়তো মিতুলকে সহ্য করতে পারবেন না।

উত্তর দিলেন না দীপক পাল। কঠিন গলায় শুধু বললেন, মিতুল কোথায়?

এক মুহূর্ত তাঁর দিকে চেয়ে রইল অমিয়। তার পর মাথা নীচু করে বলল, আসুন।

তবে এর পর যা ঘটল তার জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। তিতাস আর মিতুলকে এক ঘরেই রাখা হয়েছিল। বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল পল্লব। গাড়ির রেঞ্চ দিয়ে ভিতরের ছিটকিনিটা আগেই উপড়ে ফেলেছিল অমিয়, যাতে ওরা কেউ ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে না দিতে পারে। ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ই খানিক চমকে উঠল পল্লব, জানলার পর্দাগুলো টানা! একটু আগেও সে যখন ভাদুড়ি মশায়কে গাড়ি থেকে নামাতে গেছিল তখনও তো পর্দা খোলা ছিল। বাইরে থেকেও দেখা যাচ্ছিল তিতাস আর মিতুলকে। দু’জনেই গুটিসুটি মেরে দু’টো খাটের ওপর বসেছিল। বোধহীনতার সঙ্গে আতঙ্ক মিলেমিশে ছিল তাদের দৃষ্টিতে। কেউ তো নড়াচড়া করছিল না। তা হলে এখন পর্দা টেনে দিল কে? তিতাস না মিতুল? পল্লবের মনে কেমন যেন কু ডেকে উঠল কিন্তু সাবধান করার আগেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল অমিয় আর অতর্কিতে দরজার পাশ থেকে বেরিয়ে এসে জল ভরা ভারী স্টিলের জগটা অমিয়র মুখ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল মিতুল।

দুর্দান্ত অ্যাথলিট অমিয়। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে চকিতে নামিয়ে নিল মাথা আর জগটা এসে আছড়ে পড়ল অমিয়র ঠিক পেছনে থাকা দীপক পালের মুখে।

ওফ, শব্দ করে দু’হাতে মুখ ঢাকলেন দীপক পাল। স্তম্ভিত পল্লব দেখল তাঁর আঙুলের ফাঁক দিয়ে দরদর করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। ঠিক তখনই তীব্র রিরংসায় অমিয়র গায়ে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল তিতাস। ভাঙা বীভৎস গলায় বলে উঠল, কেন আসিস তোরা? বলেছি না লজ্জা করে!

নাকের ওপরে বেশ খানিকটা কেটে গেছে দীপক পালের। সেখানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিলেন পেমা শেরপা আর অমিয়র হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধছিল পল্লব।

রক্তাক্ত দীপক পালকে ধরে কোনও মতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল পল্লব। ও দিকে তিতাস তখন হাতের সামনে যা পাচ্ছে ছুঁড়ে মারছে অমিয়র দিকে আর খাটের নীচে ঢুকে গিয়ে সবটা জুলজুল করে দেখছে মিতুল। অমিয় প্রাণপণে তিতাসের আঘাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিল, তিতাস, কী করছিস তুই? শান্ত হ… প্লিজ শান্ত হ।

শান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। উল্টে আগ্রাসন বাড়ছিল তিতাসের। চোখের মণি দু’টো ঘুরছিল এ দিক, ও দিক। ফুলে উঠেছিল নাকের পাটা। ফেনা জমেছিল ঠোঁটের কোণে। অমিয়কে মারার জন্য এক সময় সে একটা কাচের গ্লাস তুলে নিয়েছিল হাতে। কিন্তু গ্লাসটা ছোঁড়ার আগেই খপ করে তার হাত ধরে ফেলেছিল অমিয়। অমিয়র শক্ত পাঞ্জার মধ্যে কিছুক্ষণ ছটফট করেছিল তিতাস তার পর একটা সময় বন্য কুক্কুরীর মতো কামড় বসিয়ে দিয়েছিল অমিয়র হাতে। ছিটকে সরে গিয়েছিল অমিয় আর সেই সুযোগে তিতাস ছুটে ঢুকে গিয়েছিল মিতুলের পাশে। খাটের তলায়। সেখান থেকেই টানা বলে যাচ্ছিল, যা! যা! চলে যা! যা বলছি!

ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হতে ভাদুড়ি মশায় বললেন, এখন একটু সুস্থ বোধ করছ দীপক?

মাথা নাড়লেন দীপক পাল, হ্যাঁ স্যার।

কিন্তু বড় ক্লান্ত শোনাল তাঁর গলা। শারীরিক যন্ত্রণাকে হয়তো তিনি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন কিন্তু মিতুলকে যে অবস্থায় তিনি দেখেছেন তা তাঁর মনে ঘনিয়ে তুলেছে অপরিসীম বেদনা। যার আরোগ্য এই মুহূর্তে কারও কাছে নেই। অস্থির গলায় তিনি বললেন, এ বার কী হবে স্যার?

দীপক পালের পিঠে হাত রাখলেন বৃদ্ধ, ধৈর্য ধরো দীপক। আগে আমাকে সবটা শুনতে দাও। পল্লব, শুরু থেকে কী হয়েছে সবটা বলো। কোনও তুচ্ছতম ঘটনাও বাদ দেবে না। আমার মন বলছে, তোমাদের কার্যকলাপের মধ্যেই এ অমঙ্গলের উৎস লুকিয়ে আছে। বলো।

চেয়ার টেনে ভাদুড়ি মশায়ের মুখোমুখি বসল পল্লব। তার পর বলতে শুরু করল। সোনাদায় গাড়ি খারাপ হওয়া থেকে রাস্তা গুলিয়ে ফেলা, অপ্রকৃতিস্থ সেই পাহাড়ি যুবকের আগমন, তার পর গভীর রাতে তিতাসের ঘুম থেকে ডেকে তোলা, আশ্চর্য সেই ফুলের গন্ধ, তিতাস ও মিতুলের দেবীমূর্তি দর্শন, ফেলে দেওয়া রুমাল ফিরে ফিরে আসা এবং দেওয়ালে তিন জায়গায় তাজা রক্তের দাগ… কিছুই বাদ দিল না পল্লব।

পল্লবের কথা চলাকালীন একটিও শব্দ খরচ করেননি ভাদুড়ি মশায়। মাথা নীচু করে দু’হাতে কপালের রগ ধরে নিশ্চুপে শুনছিলেন। পল্লব চুপ করতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুলে তাকালেন তিনি। চিন্তার মেঘ ঘনিয়েছে তাঁর কপালে। আরও গম্ভীর হয়ে গেছে মুখ। মৃদু গলায় অমিয় বলল, কিছু বুঝতে পারলেন স্যার?

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। বললেন, মনে হয় পেরেছি। পর্ণশবরী। কিন্তু এ যে অসম্ভব।

অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল অমিয়রা। কাতর গলায় পল্লব বলল, কী বললেন একটু বুঝিয়ে বলবেন স্যার?

ভাদুড়ি মশায় হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, এখনও দিনের আলো আছে। যে জায়গায় তোমরা রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছিলে, সেখানে আমায় এক বার নিয়ে যেতে পারবে?

উঠে দাঁড়াল অমিয়, পারব স্যার। আসুন, হাত বাড়িয়ে দিল সে ভাদুড়ি মশায়ের দিকে।

গর্জন করে লাল-কালো জিপটা ছুটে চলল পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে। গাড়িটা চালাচ্ছে অমিয়। পাশে দীপক পাল। পেছনের সিটে পল্লবের সঙ্গে ভাদুড়ি মশায়। একটু ইতস্তত করে পল্লব বলল, একটা কথা বলব স্যার?

বলো।

আপনি তখন পর্ণশরবী না কি যেন…

পর্ণশরবী নয়, পর্ণশবরী। দেবী পর্ণশবরী, কথা কেটে বলে উঠলেন ভাদুড়িমশায়, যদিও আদিতে হিন্দু দেবী কিন্তু পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্মে অন্তর্ভুক্তি ঘটে। বৌদ্ধতন্ত্র মতে দেবী তারার একুশটি রূপের কুড়িতম প্রকাশ এই পর্ণশবরী। দেবীর তিনটি মস্তক, ছয়টি হাত। ডান দিকের প্রথম হাতে ধরে থাকেন বজ্র, দ্বিতীয় হাতে কুঠার এবং তৃতীয় হাতে একটি তীর। বাম দিকের প্রথম হাতে দড়ির ফাঁদ, দ্বিতীয় হাতে ফুলে-ফলে শোভিত একটি পাখা এবং তৃতীয় হাতে ধনুক। দেবী জঙ্গলের অধিষ্ঠাত্রী, একই সাথে নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যাধি ও আরোগ্যকে।

সামান্য পেছন ঘুরে বসলেন দীপক পাল। যদিও অমিয় গাড়ি চালাচ্ছে তবু যে তার কান এ দিকেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। পল্লব বলল, কিন্তু তার সাথে তিতাস বা মিতুলের…

ফের মাঝপথে থামিয়ে দিলেন ভাদুড়ি মশায়, সম্পর্ক আছে বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু একটা বড় খটকা রয়েছে।

কী খটকা স্যার?

দেখো পল্লব, তোমাদের কথা শুনে যা বুঝেছি তার থেকে আমি আন্দাজ করছি দেবী তিতাস আর মিতুলের ওপর কুপিতা হয়েছেন কিন্তু দেবী অত্যন্ত শান্তস্বভাবা, মায়ার আধার। তাঁর এ অদ্ভুত ক্রোধের কারণ আমি ধরতে পারছি না। আর তার চেয়েও বড় কথা, তিতাস বা মিতুলের পক্ষে তো দেবীকে জাগানো সম্ভব নয়, কিন্তু তিনি যে জেগেছেন এ নিশ্চিত। কে জাগাল তাঁকে? আমার মন বলছে এর সব উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ওই ত্রিকোণাকার খাঁজটিতেই। তাই সবার আগে আমাদের ওই জায়গাটা খুঁজে পেতে হবে।

খুব বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না, অমিয় দেখতে পেয়ে গেল সেই শ্যাওলাধরা দেওয়াল, যার মধ্যে কুলুঙ্গির মতো খাঁজ কাঁটা রয়েছে। মূল রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে গিয়েছে জঙ্গল। তার পর আবার পাহাড়ি একটা ঢাল উঠে গেছে ওপর দিকে। সেখানেই দেওয়ালটা। মূল পথের খুব কাছে হলেও জায়গাটা আসলে লোকচক্ষুর অন্তরালে।

ভাদুড়ি মশায়কে ধরে ধরে ওরা নামিয়ে আনল সেখানে। ভুরু কুঁচকে তিনি তাকিয়ে রইলেন পাথরে খোদিত দেবী মূর্তির দিকে। খুব মন দিয়ে দেখছিল পল্লব। অদ্ভুত মূর্তিটা! দেখলেই কেমন যেন ভয় ভয় লাগে। হঠাৎই খাঁজের নীচের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, ও কী?

সঙ্গে সঙ্গে ওরাও তাকাল সে দিকে। শ্যাওলার ওপর কালচে মতো কী যেন লেগে রয়েছে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে। ঝুঁকে এগিয়ে গেল অমিয়, তার পর আঙুল ঘষে বলে উঠল, স্যার, এ তো রক্ত। শুকিয়ে গেছে।

রক্ত শব্দটা যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল ভাদুড়ি মশায়ের মধ্যে। থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি। ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাঁর মুখ। অস্ফুটে বলে উঠলেন, সর্বনাশ!

তাঁর বলার মধ্যে এমন এক হতাশা মিশে ছিল যা নিমেষে চারিয়ে গেল বাকি তিন জনের মধ্যে। উৎকণ্ঠিত গলায় অমিয় বলে উঠল, কী হল স্যার? এমন করে সর্বনাশ বললেন কেন?

বড় ক্লান্ত শোনাল ভাদুড়ি মশায়ের গলা, যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই। অতি ভয়ানক এক তন্ত্রের সাহায্যে কেউ দেবীকে জাগিয়েছে। দেবীকে অশান্ত করে তুলেছে এবং দেবীর রুদ্ররূপের প্রকাশ ঘটিয়েছে। দেবী এখন বিরাজ করছেন এই অরণ্যে। চাঁদ উঠলেই কোনও এক প্রাচীন মহাবৃক্ষের বুক চিরে বেরিয়ে আসবেন তিনি এবং অস্থির হয়ে বিচরণ করবেন এই সমগ্র অঞ্চলজুড়ে। ওই যে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত দেখছ তা বলির রক্ত। নরবলি।

শব্দটা যেন গেঁথে গেল ওদের মাথার মধ্যে। তীব্র আতঙ্কে অমিয়র হাত চেপে ধরে পল্লব বলে উঠল, নরবলি?

ক্লান্ত মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়, হ্যাঁ পল্লব। নরবলি।

অবাক হয়ে ভাদুড়ি মশায়ের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। চোখের পাতা ফেলতেও যেন ভুলে গেল বুঝি বা! একটু সময় নিয়ে ভাদুড়ি মশায় বললেন, আমার স্থির বিশ্বাস, এই অঞ্চলেই এমন কেউ আছে যে তন্ত্রে পারদর্শী আর ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থ চরিতার্থ করতে তীব্র প্রতিশোধস্পৃহায় সেই দেবীকে জাগিয়েছে। কোনও নিরপরাধকে বলি দিয়েছে ঠিক এইখানে। সে ব্যাধিগ্রস্ত করতে চায় এই পাহাড়ি জনপদকে। বিপদ শুধু মিতুল বা তিতাসের নয়, গোটা চটকপুরই এখন একটা মারণ বোমার ওপর বসে রয়েছে যার সলতেতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই।

কিন্তু স্যার, মিতুল বা তিতাস কী এমন করেছিল যার জন্য ওদের এই অবস্থা হল? ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন দীপক পাল।

দেবীকে উত্যক্ত করেছিল। ফুলের যে তীব্র সুবাস মিতুল এবং তিতাস পেয়েছিল, তা ছিল আসলে দেবীর সাবধানবাণী। তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন, ‘আমায় বিরক্ত কোরো না। চলে যাও।’ কিন্তু তীব্র কৌতূহল ওদের টেনে এনেছিল এই অবধি এবং তার পরেই সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেছিল ওরা।

ভুল? বলে উঠল অমিয়?

হ্যাঁ ভুল। রুমাল দিয়ে ওরা ঘষে তুলে ফেলেছিল দেবীমূর্তির শ্যাওলা, যা তাঁর স্বাভাবিক আবরণ। দৈবী মুহূর্তে ওরা প্রত্যক্ষ করেছিল দেবীর নগ্নতা। দেবী লজ্জা পেয়েছিলেন আর তাই দেবী ওদের মনে বুনে দিয়েছেন পৃথিবীর আদিমতম লজ্জাবোধ। দেবীর শাপে ওরা ব্যাধিগ্রস্ত। এ ব্যাধি মানসিক।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। তার পর এই সময়ে যে প্রশ্নটি উঠে আসার কথা ছিল ঠিক সেই প্রশ্নটিই করল পল্লব। কাঁপা গলায় বলল, এই অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় কি স্যার?

সামান্য ভেবে ভাদুড়ি মশায় বললেন, উপায় একটাই, যে জাগিয়েছে তাকেই আবার দেবীকে ঘুম পাড়াতে হবে। চিন্ময়ীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে মৃন্ময়ী রূপে।

এ তো অদ্ভুত একটা প্রোবাবিলিটির কথা হয়ে গেল স্যার, দ্রুত বলে উঠল অমিয়, এর মধ্যে তো অনেকগুলো ইফস অ্যান্ড বাটস রয়েছে।

রয়েছে তো, কেটে কেটে বললেন ভাদুড়ি মশায়। প্রথমত যে দেবীকে জাগিয়েছে তাকে শণাক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত তাকে রাজি করাতে হবে তন্ত্র প্রয়োগের জন্য।

আর চুপ করে থাকতে পারল না পল্লব। বলে উঠল, এ ভাবে হয় না কি? সে যদি রাজি না হয় আর সবচেয়ে বড় কথা কে এই কাজ করেছে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে নিশ্চয়তা কি? সেক্ষেত্রে অন্য কী উপায় আছে স্যার?

পাইনবনের ফাঁকে ফাঁকে তখন ফুরিয়ে আসছে দিনের আলো। পাখিরা দল বেঁধে ফিরে যাচ্ছে বাসায়। সারা দিন ধরে কর্মচঞ্চল পৃথিবী প্রস্তুত হচ্ছে বিশ্রামের জন্য। এই অবসন্ন বৃদ্ধ পৃথিবীর পিঠের ওপর দাঁড়িয়ে আরও অনেক বেশি ক্লান্তি বোধ করলেন শ্রী নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি। পল্লবের এ প্রশ্নের উত্তর তিনি দিতে পারবেন না। এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায় না। দিতে নেই। কারণ, অতি প্রাচীন এবং গূঢ় এই তন্ত্রমতে দেবীকে যে জাগিয়েছে সে যদি দেবীকে ঘুম না পাড়ায় তা হলে মাত্র আর একটি ভাবেই দেবীকে নিদ্রামগ্ন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন আরও একটি নরবলি।

অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে তিতাস আর মিতুলের। গত রাতের পর থেকে একদানা খাবার খাওয়ানো যায়নি কাউকে। দু’জনেই গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে খাটের তলায়। কাউকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই কাঁদছে নয়তো হিংস্র হয়ে উঠছে। দু’জনেরই সমস্ত স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। খাটের নীচেই মলমূত্র ত্যাগ করছে তারা। বোঝা যাচ্ছে, বদ্ধ উন্মাদ হতে তাদের আর খুব বেশি দেরি নেই।

নিজের ঘরে সিলিং-এর দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলেন ভাদুড়ি মশায়। দীপক পাল, পল্লব আর অমিয় চুপচাপ বসেছিল ছড়িয়েছিটিয়ে। ওরা জানে, এই মুহূর্তে ওদের কিছুই করার নেই। তিতাসের কথা ভাবতে ভাবতে বারবার চোখে জল এসে যাচ্ছিল পল্লবের। কত উৎসাহ নিয়ে এই বেড়াতে আসার প্ল্যানটা করেছিল তিতাস আর সেই কি না এখন শাপগ্রস্ত! আর মিতুল? অমন ফুটফুটে প্রাণচঞ্চল মেয়েটা! কেন ওর সাথেই বারবার হয় এমন সব বিপদ?

বাইরে চুপ করে থাকলেও আসলে ভেতরে ভেতরে খুবই অস্থির হয়ে উঠছিল পল্লব। সেই যে ফিরেছেন তার পর থেকে আর একটা কথা বলেননি ভাদুড়ি মশায়। সে একটা দ্বিতীয় পন্থার খোঁজ জানতে চেয়েছিল, সেটাও বলেননি। এসে থেকে শুধু আকাশপাতাল ভেবে চলেছেন। এ দিকে হোম-স্টের মালিক পেমা শেরপা সবটা জেনে গেছে। সে জানিয়ে দিয়েছে, এ ভাবে অসুস্থ মানুষ নিয়ে এখানে থাকা যাবে না। আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যে চেক আউট করে নিতে হবে। তার মানে হাতে আছে আর মাত্র আঠেরো ঘণ্টা। তার মধ্যেই তিতাস আর মিতুলকে সুস্থ হতে হবে, নয়তো ওদের নিয়ে যে পদ্ধতিতে এখান থেকে বেরতে হবে, সেটা তিতাস কিংবা মিতুলের সাথে কিছুতেই হতে দিতে পারবে না পল্লব। আর বসে থাকতে পারল না সে। ডেকে উঠল, স্যার।

উঁ, বলে তার দিকে ফিরে তাকালেন ভাদুড়ি মশায়।

অস্থির পল্লব বলল, কাল সকালের মধ্যে হোম-স্টে ছেড়ে দিতে হবে। তার মধ্যে সুস্থ না হলে তিতাস আর মিতুলকে নিয়ে কী ভাবে যাব আমরা?

কাল আমরা যেতে পারব না। আমার আরও কিছুটা সময় দরকার, গলা ঝেড়ে বললেন ভাদুড়ি মশায়, অমিয়, তুমি ওই পেমা বলে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলে আরও এক দিনের বুকিং বাড়িয়ে নাও। সোজা কথায় রাজি না হলে তোমার পদাধিকার প্রয়োগ কোরো। যদিও আমি এ সবের তীব্র বিরোধী কিন্তু এই মুহূর্তে এটাই আপদ্ধর্ম। এতে দোষ নেই। আর তোমার কথা বলা হলে ওকে নিয়ে আমার কাছে এসো। ওর থেকে কিছু খোঁজখবর নিতে হবে।

মিনিট পনেরো পর যখন পেমাকে নিয়ে দীপক পাল আর অমিয় এ ঘরে ঢুকল, মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সে রীতিমতো বিরক্ত। ঘরে ঢুকেই অমিয় বলল, স্যার, পেমা আমাদের আরও এক দিনের বুকিং বাড়িয়ে দিয়েছে তবে ও বলেছে পরশু চলে যেতেই হবে।

বিরক্ত গলায় পেমা বলল, হাঁ সাব। পরশো মেরা নয়া বুকিং হ্যায়। টুরিস্ট আয়েগা।

গম্ভীর গলায় ভাদুড়ি মশায় বললেন, বেশ। পরশুই তোমার ঘর ছেড়ে দেব আমরা কিন্তু তার আগে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। তুমি দেখতেই পাচ্ছ আমরা কেমন বিপদে পড়েছি। এ অবস্থায় তোমার সাহায্য না পেলে আমাদের চলবে না। তুমি বোসো।

একটা চেয়ার টেনে বসল পেমা। বলল, বোলিয়ে, কেয়া জাননা চাহতে হ্যায়?

একটুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে যেন তার ভেতরটা পড়ে নিতে চাইছেন। ভাদুড়ি মশায়ের এই দৃষ্টির সামনে পেমা যেন খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে গেল। বলল, আপ পুছিয়ে না বুড়াবাবা। হাম আপলোগোকা হেল্প করেগা।

এ বার পেমার গলায় সেই আগের বিরক্তি উধাও। বরং অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ শোনাল তার কণ্ঠস্বর। ভাদুড়ি মশায় বললেন, আচ্ছা, সম্প্রতি মানে ধরো মাসখানেকের মধ্যে তোমাদের এখানে কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে? মানে কেউ অসুস্থ হয়েছে? সে অসুস্থতা শারীরিক বা মানসিক দু’রকমই হতে পারে। তবে আমি কিন্তু স্বাভাবিক অসুস্থতার কথা বলছি না। আমি বলছি এমন কিছু যা স্বাভাবিক নয়, আনন্যাচারাল। তুমি বুঝতে পারছ তো আমি কী বলছি?

পেমা বলল, হাঁ সমঝ লিয়া। ইধার বহোত বাঙ্গালি টুরিস্ট আতা হ্যায়। হামে বাঙলা আতা হ্যায় থোড়াথোড়া।

পল্লব বলল, বাহ, খুব ভাল। বাংলা ভাষার গর্বে আমার বুক ফুলে উঠেছে। কিন্তু তুমি আগে স্যারের কথার উত্তর দাও। কেউ এখানে রিসেন্টলি অসুস্থ হয়েছে?

মাথা নেড়ে পেমা বলল, নাহি তো। ইধার থোড়া থোড়া সর্দি, বুখার হোতা হ্যায় লেকিন কোই আনন্যাচারাল কুচ নেহি হুয়া।

একটু যেন হতাশ হলেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, কেউ অসুস্থ হয়নি?

নাহি বুড়াবাবা। ইয়ে ছোটা জাগা হ্যায়। অগর হোতা তো মুঝে পতা হোতা। ফিরভি আপ চাহেঙ্গে তো অউর কিসিসে পুছ সকতে হ্যায়। বগল মে হি মেরা ভাই কা হোম-স্টে হ্যায়। আপ উসসে পুছতাচ কর লিজিয়ে।

মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়, নাহ। তাতে লাভ কী হবে? আচ্ছা পেমা একটা কথা বলো, তোমাদের এই গ্রামে এমন কেউ আছে যে তন্ত্র নিয়ে কাজকর্ম করে? তুমি জানো তো তন্ত্র কি?

উৎসাহিত হল পেমা, হাঁ হাঁ, ও তো সব কো মালুম হ্যায়। তন্ত্রা তো ব্ল্যাক ম্যাজিক হোতা হ্যায় না বুড়াবাবা?

অন্য সময় হলে হয়তো তন্ত্রের এই অপমানে জ্বলে উঠতেন ভাদুড়ি মশায় কিন্তু এই মুহূর্তে চুপ করে রইলেন। এটা পেমা শেরপাকে তন্ত্র বোঝানোর সময় নয়। দু’দিকে মাথা নেড়ে তিনি বললেন, ব্ল্যাক ম্যাজিক আর তন্ত্রয় অনেক পার্থক্য আছে পেমা। সে যাই হোক, এমন কাউকে চেনো যে এ সব করে?

একটু ভেবে পেমা বলল, দেখিয়ে বুড়াবাবা, ইধার দো গাঁও হ্যায়। আপার অউর লোয়ার চটকপুর। ইধার হিন্দু অউর বুদ্ধিস্ট দোনো হি রহেতা হ্যায়। হিন্দু থোড়া জ্যাদা হ্যায় লেকিন বুদ্ধিস্ট ভি হ্যায়। সব আপনা আপনা পূজা করতা হ্যায়। কোই কিসিকো তন নেহি করতা। লেকিন ও ব্ল্যাক ম্যাজিক ফ্যাজিক ইধার নাহি হোতা।

হুম, বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভাদুড়ি মশায়।

পেমা বলল, অউর কুছ পুছনা চাহতে হ্যায় আপ?

ভাদুড়ি মশায় নেতিবাচক মাথা নাড়লেন। বিদায় নিয়ে চলে গেল পেমা। যাওয়ার আগে মনে করিয়ে দিতে ভুলল না, পরশু সকাল দশটার মধ্যে ঘর ছেড়ে দিতে হবে।

অসহায় গলায় অমিয় বলল, এ বার তা হলে কী হবে স্যার? কিছুই তো জানা গেল না। আর আমরা লোকাল লোক নই, আমাদের পক্ষে তো কাউকে খুঁজে বার করা অসম্ভব।

উত্তর দিলেন না ভাদুড়ি মশায়। যত সময় গড়াচ্ছে ভেতরে ভেতরে ভীত হয়ে উঠছেন তিনি। তিতাস আর মিতুলের যা অবস্থা দেখেছেন, অত্যন্ত দ্রুত ওদের আরোগ্য না হলে ওরা চিরতরে উন্মাদ হয়ে যাবে। সেই অবস্থা থেকে কোনও উপায়েই আর ওদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই ওদের সুস্থ করতে গেলে সেই মানুষটাকে খুঁজে পেতে হবে যে দেবীকে জাগিয়েছে। কিন্তু কে সে? পেমা তো বলছে এই অঞ্চলে এমন কেউ নেই যে তন্ত্রচর্চা করে। নাহ, পেমাকে এই প্রশ্ন করা ভুল হয়েছে। কেউ যদি এই ধরনের গোপন, গূঢ় সাধনা করে সে তো আর লোক জানিয়ে করবে না। তা হলে উপায়? দ্বিতীয় এবং শেষ যে রাস্তাটি খোলা রয়েছে সেটি এতটাই অসম্ভব ও অবাস্তব যে তা না থাকার শামিল। নরবলির কথাটা মাথায় আসতেই ফের বড় অসহায় বোধ করলেন ভাদুড়ি মশায়। শেষ কবে এমন বিপদে পড়েছেন মনে করতে পারলেন না। পরিস্থিতি ক্রমশই হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে তা তিনি দিব্যি বুঝতে পারছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোমরা ঘরে যাও। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। এ ভাবে হবে না। আমাকে অন্য পথের সন্ধান করতে হবে।

ওই ভয়াবহ পন্থাটি ছাড়া অন্য পথ যে নেই তা তিনি খুব ভাল করে জানেন কিন্তু সন্তানসম দীপক পাল এবং তাঁর নাতনির বয়সি পল্লব আর অমিয়কে কেমন করে বলবেন সে কথা? না না, ও পথের কথা চিন্তা করেও লাভ নেই। ধ্যানে বসতে হবে। গুরুকে স্মরণ করতে হবে। যদি এ অসম্ভব সম্ভব হয়, গুরুর ইচ্ছেতেই হবে। সবই গুরুকৃপা।

মাথা নীচু করে পরাজিত সৈনিকের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় পল্লবরা। ওদের গমনপথের দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধ। তার পর চোখ বোজেন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি সদাহাস্যময় মানুষের চেহারা। বেঁটেখাটো মানুষটির পরনে সাদা ফতুয়া, হেঁটো ধুতি। ধূলিমলিন খালি পা। একমুখ অযত্নলালিত দাড়িগোঁফ। কপালের ওপর এসে পড়া চুল আর সেই আশ্চর্য দৃষ্টি। অমন ভালবাসা নিয়ে তাকাতে শুধু মায়েরাই পারে। শ্রী রামদাস চট্টোপাধ্যায়। কানে বাজে গুরুর কণ্ঠস্বর, ‘লেগেপড়ে থাক নীরেন। অলৌকিক হবেই। শুধু লেগেপড়ে থাক।’

গলা ধরে আসে ভাদুড়ি মশায়ের। হাত জোড় করে বলেন, কৃপা করো প্রভু। পথ দেখাও। বড় কষ্ট পাচ্ছে মেয়ে দু’টো। ওরা যে বড় ছেলেমানুষ।

. . .

তিতাসদের ঘরের বাইরের বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে আছে অমিয় আর পল্লব। কেউই কোনও কথা বলছে না শুধু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে একের পর এক সিগারেট। তিতাসদের ঘর অন্ধকার। কিছুক্ষণ আগে ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে এসেছিল অমিয়। এখন এসে দেখছে, সে আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফের আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না অমিয়র। কী হবে জ্বালিয়ে? তিতাস আর মিতুল ক্রমেই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। অন্ধকারই এখন ওদের কাছে আরামদায়ক। এ সব ভাবতে ভাবতে সিগারেটটা যে কখন ফুরিয়ে এসেছে অমিয় খেয়াল করেনি। আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতেই সেটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে ঘষে নিভিয়ে দিল সে আর মুখ তুলতেই চমকে উঠল। কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এক মহিলা। এই মহিলাকে অমিয় এর আগে কয়েক বার দেখেছে। ইনি পেমার স্ত্রী। গলা খাঁকরে অমিয় বলল, কুছ বোলনা চাহতে হ্যায় আপ?

মহিলা মাথা নাড়লেন, কিন্তু হ্যাঁ বা না কী বললেন ঠিক বোঝা গেল না। ইতিমধ্যে পল্লবও ঘুরে তাকিয়েছে। মহিলা নীচু গলায় বললেন, সাব, আপলোগোকা চায়ে, পকোড়া।

উদাসীন গলায় অমিয় বলল, আপ অন্দর রখ দিজিয়ে।

মাথা নেড়ে দ্রুত এক বার পেছন দিকে তাকালেন মহিলা তার পর দ্রুত পায়ে ঢুকে গেলেন অমিয়দের ঘরের মধ্যে। হতাশ গলায় পল্লব বলল, আর চা! কী কুক্ষণে যে এখানে এসেছিলাম এখন তাই ভাবছি। কী হবে রে অমিয়? আমার তো মাথা কাজ করছে না।

উত্তর দিল না অমিয়। সরু চোখে সে তাকিয়ে আছে নিজেদের ঘরের দিকে। চাপা গলায় বলল, চা আর পকোড়া রাখতে কতক্ষণ সময় লাগে? ওই মহিলা এখনও বেরল না কেন বল তো ঘর থেকে? আয় তো দেখি।

দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগোল অমিয়। পেছনে অমিয়। দরজাটা ভেতর থেকে ভেজানো। জানলার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যাচ্ছে ঘর অন্ধকার। একটুর জন্য হলেও বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল অমিয়র। তবু হাত বাড়িয়ে সে ঠেলে খুলে দিল দরজা আর দিতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেই মহিলা। যেন তিনি অমিয়দের জন্যই অপেক্ষা করছেন। বাইরের আবছা আলোয় বড়ই অদ্ভুত দেখাচ্ছে তাঁকে। ঘাবড়ে যাওয়া গলায় অমিয় বলল, কেয়া? কেয়া চাহিয়ে আপকো?

অমিয়র দিকে দু’পা এগিয়ে এলেন মহিলা তার পর খুব নীচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে বললেন, পেমা ঝুট বোল রাহা হ্যায় সাব।

রাত একটা। খুব মৃদু শব্দ করে নড়ে উঠল দরজাটা। টানটান হয়ে বসেছিল অমিয়। এক লাফে দরজাটা খুলে দিল সে আর ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে এলেন সেই মহিলা, পেমা শেরপার স্ত্রী। মাথা থেকে চাদরের ঘোমটাটা সরিয়ে দিলেন তিনি। উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছেন। ভাদুড়ি মশায় বললেন, বোসো মা। জল খাবে?

মাথা নাড়লেন তিনি, নাহি বুড়াবাবা। জ্যাদা টাইম নেহি হ্যায়। পেমা সো রাহা হ্যায়, কভি ভি উঠ জায়েগা।

‘পেমা ঝুট বোল রাহা হ্যায় সাব’, কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিল অমিয়। তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এই মহিলা ফের ফিসফিস করে বলেছিলেন, আভি ম্যায় যা রাহা হু, লেকিন রাত কো আউঙ্গি। আপলোগ সোনা মত।

তার পর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেছিলেন ঘর ছেড়ে। ঘাবড়ে যাওয়া গলায় অমিয় বলেছিল, কী হচ্ছে বল তো পল্লব? হঠাৎ এই মহিলা আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছেন কেন? আর পেমা ঝুট বলছে মানে? কী মিথ্যে বলছে ও?

সেটা তো এই মহিলার বয়ান না শুনলে বোঝা যাবে না, গম্ভীর মুখে বলেছিল পল্লব, সময় নষ্ট করে লাভ নেই অমিয়, স্যারের কাছে চল। কে বলতে পারে এই মহিলাই হয়তো আমাদের কোনও লিড দেবেন।

সবটা শুনে যেন খানিক প্রফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন ভাদুড়ি মশায়। স্মিত হাসি দেখা গিয়েছিল ঠোঁটের কোণে। বলেছিলেন, মেঘ অত্যন্ত বেশি ঘনীভূত হয়ে উঠলে সে যেমন আর জলকণাদের ধরে রাখতে পারে না তেমনই বিপদও অত্যন্ত বেশি করে ঘনিয়ে উঠলে তার মধ্যে থেকেই উদ্ধারের পথ উঁকি দেয়। আমার মন বলছে, এই মেয়েটি আমাদের দিশা দেখাবে। সে কখন আসবে কিছু বলেছে?

না স্যার। তা বলেনি।

তা হলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

সেই শুরু হয়েছিল অপেক্ষা আর তার অবসান হল এইমাত্র। ভাদুড়ি মশায় বললেন, তোমার নাম কী মা?

ডুপচেন বুড়াবাবা।

বাহ! কিন্তু ডুপচেন, এই ভাবে ছটফট করলে তো তুমি কথা বলতে পারবে না। তার জন্য তো তোমায় শান্ত হয়ে বসতে হবে।

ডুপচেন বসলেন না। তাঁর শরীরীভাষা বলে দিচ্ছে, তিনি অনেক কিছু বলতে চান কিন্তু এই ভাবে যে স্বামীকে লুকিয়ে এসেছেন তা তাঁর মধ্যে একটা ভয়ের জন্ম দিয়েছে। সেই ভয়টাকে তিনি অতিক্রম করতে পারছেন না। সেটা বুঝেই যেন দীপক পাল বলে উঠলেন, আপ চ্যান সে বৈঠিয়ে। ম্যায় বাহার যা রাহা হু। অগর আপকে ঘর মে লাইট জ্বলা তো ম্যায় আপকো বতাউঙ্গা। ঠিক হ্যায়?

একটু যেন স্বস্তি পেলেন ডুপচেন। হাত জোড় করে বললেন, বহোত মেহেরবানি সাব।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন দীপক পাল। সেই গভীর দৃষ্টিতে ডুপচেনের দিকে তাকিয়ে ভাদুড়ি মশায় বললেন, এ বার বলো, পেমা কী লুকোচ্ছে আমাদের থেকে?

নিজেকে যেন একটু গুছিয়ে নিলেন ডুপচেন। তার পর বললেন, বুড়াবাবা, পেমা যো বোল রাহা হ্যায় না রিসেন্টলি কিসিকা আনন্যাচারাল বিমারি নাহি হুয়া উও ঝুট হ্যায়। মেরা ভাই লাকপা, উও এক দিন অচানক পাগল হো গয়া, বলতে বলতে গলা ধরে এলে ডুপচেনের।

চমকে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়। অস্ফুটে বললেন, পাগল হয়ে গেছে?

চোখ মুছে ডুপচেন বললেন, হাঁ বুড়াবাবা। আভি তো উও জঙ্গল মে হি রহেতা হ্যায়। ইধার নাহি আতা। বহোত আচ্ছা লড়কা থা লাকপা।

অবাক হয়ে অমিয় বলল, কিন্তু এই কথাটা লুকনোর কী আছে?

ডুপচেন বললেন, ইধার সারে লোগো কা হোম-স্টে কা বিজনেস হ্যায় সাব। ইন লোগোকো লাগতা হ্যায়, অগর টুরিস্ট লোগোকো পতা চলা কি কোই অচানক পাগল হো গয়া ফির উও লোগ নেহি আয়েঙ্গে। ম্যায়নে কিতনি বার বোলি, লাকপা কো ডক্টর দিখাও, কোই শুনতা হি নেহি মেরি বাত। এক দিন উও বেচারা ইধার চলা আয়া থা। সবনে মিলকে উসে পিটা। ভাগা দিয়া, ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ডুপচেন। হাত জোড় করে বললেন, আপলোগোকে সাথ যো দো দিদি হ্যায় উন দোনো কি ভি তো সেম প্রবলেম হুয়ি। আপ তো উন দোনো কি ইলাজ করেঙ্গে না বুড়াবাবা? লাকপা কো ভি ইলাজ কর দিজিয়ে না।

ডুপচেনের কান্নায় চোখ ছলছল করে উঠল পল্লবের। ডুপচেনের হাত দু’টো ধরে ভাদুড়ি মশায় বললেন, মা গো, আরোগ্য দেওয়ার ক্ষমতা যদি আমার থাকত তা হলে আমাদের সঙ্গের মেয়ে দু’টিকে আমি ইতিমধ্যেই সারিয়ে তুলতাম। আমি চেষ্টা করছি। তোমার ভাইয়ের জন্যও চেষ্টা করব। তার আগে খুলে বলো তো যে দিন থেকে তোমার ভাইয়ের এই অবস্থা সে দিন ঠিক কী কী হয়েছিল?

এই প্রশ্নের উত্তরে ডুপচেন যা বললেন তাতে কাহিনির সূত্রপাত আড়াই বছর আগে। সেই সময় লাকপার সঙ্গে একটি নেপালি মেয়ের বিয়ে হয়। তার নাম সীতা। কিন্তু বিয়ের কিছু দিনের মধ্যেই সীতার শরীরে শ্বেতির মতো এক ধরনের চর্মরোগ দেখা দেয়। দার্জিলিং এমনকী শিলগুড়িতে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েও কোনও লাভ হয় না। সীতার শরীরে সাদা ছোপের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সবাই ভয় পেয়ে যায় যে রোগটা ছোঁয়াচে এবং সীতাকে এক দিন জোর করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। লাকপা চুপ করে থাকে। কারণ ইতিমধ্যেই বৈজন্থী বলে একটা মেয়ের সাথে তার প্রেম হয়ে গেছিল। সীতা চলে যাওয়ার কিছু দিন পরে লাকপা বৈজন্থীকে বিয়ে করে। গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর সীতা দার্জিলিংয়ে চলে যায় এবং সেখানের একটা তিব্বতি আর্টের দোকানে চাকরি নেয়। চটকপুরের অনেকেই মাঝে মাঝে কর্মসূত্রে দার্জিলিং যায়। তাদেরই কেউ কেউ সীতাকে সেই দোকানে কাজ করতে দেখেছে। কিন্তু সীতা কারও সাথে কথা বলেনি। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তা এই ভাবেই দিন চলছিল। কালের নিয়মে সীতার কথা ভুলে গিয়েছিল চটকপুর। লাকপাও খুশি ছিল বৈজন্থীকে নিয়ে। এমন সময় মাস খানেক আগে এক দিন সন্ধেবেলায় বৈজন্থী তাদের ভাঁড়ার ঘর খুলে দেখে ভেতরে সীতা বসে আছে! প্রচণ্ড চিৎকার জুড়ে দেয় বৈজন্থী। কিন্তু সীতা জোর গলায় বলতে থাকে, সে নিজে আসেনি। লাকপাই তাকে এনেছে এবং এখানে লুকিয়ে রেখেছে। বলেছে, বৈজন্থী ঘুমোলে এখান থেকে বার করবে। আর শুধু আজ বলে নয়, গত তিন মাস ধরে সে নিয়মিত আসছে। এসে ভাঁড়ার ঘরে লুকিয়ে থাকে। রাত বাড়লে লাকপা তার সাথে সোহাগ করে তার পর ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে সে সোনাদা থেকে গাড়ি ধরে দার্জিলিং ফিরে যায়। লাকপা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সীতার কথা এবং তাকে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু বৈজন্থী লাকপার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। সেই থেকে তাদের ঝগড়া চলতে থাকে এবং তিন দিন পর তা বিরাট আকার ধারণ করে। রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বৈজন্থী। তাকে খুঁজতে বেরোয় লাকপা এবং সারা রাত কেটে গেলেও সে বা বৈজন্থী কেউ ফেরে না। পরের দিন সকালে দলবল নিয়ে জঙ্গলে যাওয়া হয়। সেখানেই লেকের ধারে উন্মাদ লাকপাকে খুঁজে পায় গ্রামের লোক। কিন্তু বৈজন্থীর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায় না। মানুষটা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে! গ্রামের লোক কিন্তু খোঁজখবর না করে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের একটাই ভয়, এই সব খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়লে এখানে আর টুরিস্ট আসবে না। হোম-স্টে চালিয়েই এখানের মানুষ সারাবছরের উপার্জন করে। তাদের ভয়টা ডুপচেন বোঝেন, তবু লাকপা তো তাঁর নিজের ভাই। কিছুতেই লাকপার এই পরিণতি তিনি মেনে নিতে পারেন না। তাঁর মন বলে, লাকপার পাগল হয়ে যাওয়া এবং বৈজন্থীর হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে।

চাদরের খুঁট দিয়ে ফের চোখ মোছেন ডুপচেন। ততক্ষণে কিন্তু ডুপচেনের কথা শুনে ভাদুড়ি মশায়ের ভুরু কুঁচকে গেছে। তিনি বললেন, আচ্ছা, ওই সীতা মেয়েটি কেমন ছিল?

ডুপচেন বললেন, আচ্ছা হি তো থা বুড়াবাবা। জিস দিন সবনে উসে গাঁও সে নিকাল দিয়া, বহোত রো রহি থি। জানে কে বাদ দো সাল তক উও ইধার নাহি আয়ি, লেকিন উস দিন কিউ আয়ি থি মুঝে নাহি পতা।

এমনটা কী হতে পারে যে লাকপাই ওকে নিয়ে এসেছিল?

নেহি নেহি। কভি নেহি, প্রায় শিউরে ওঠেন ডুপচেন, লাকপা নে বৈজন্থী কো বহোত পেয়ার করতা থা। লেকিন সীতা উও অজীব সা ঝুট কিউ বোলি থি মুঝে আভি তক সমঝ মে নাহি আয়ি।

কেমন যেন সবটা ঘেঁটে যাচ্ছিল অমিয় আর পল্লবের। এত নতুন চরিত্রের সমাহারে ওদের কী কার্যোদ্ধার হবে কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না ওরা। আর সত্যি বলতে এটা এমন কিছু মারাত্মক তথ্য নয় যা পেমা গোপন করেছিল। ব্যবসা চালাতে গেলে এটুকু সাবধানতা তো নিতেই হবে। তবে ওরা হতাশ হলেও ভাদুড়ি মশায়ের উত্তেজনা কিন্তু উত্তরোত্তর বাড়ছিল। ব্যগ্র গলায় তিনি বললেন, আচ্ছা, এই লাকপার বাড়িটা কত দূর?

ডুপচেন বললেন, ইধার হি, বগল মে।

কাল সকালে আমাকে সেখানে এক বার নিয়ে যেতে পারবে মা?

মাথা নাড়লেন ডুপচেন, কিউ নেহি? সুবাহ পাঁচ বাজে পেমা পানি লেনে নীচে জায়েগা তব ম্যায় আপলোগোকো লে কে যাউঙ্গি। আব মুঝে জানা হোগা বুড়াবাবা।

ডুপচেনের মাথায় হাত রাখলেন ভাদুড়ি মশায়, যাও মা। কাল সকালে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি যে বিপদের ঝুঁকি নিয়েও আমায় সবটা খুলে বললে, সে জন্য আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

হাত জোড় করে চলে গেলেন ডুপচেন। প্রায় ছুটে এসে ঘরে ঢুকলেন দীপক পাল। উদ্গ্রীব হয়ে বললেন, কী স্যার? কথা বলে কিছু লাভ হল?

মাথা নাড়লেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, মনে হচ্ছে একটা আলোর দিশা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাকে এক বার লাকপার বাড়ির চারদিকটা ঘুরে দেখতে হবে। যদি আমার অনুমান ঠিক হয় তা হলে লাকপার বাড়ির আশেপাশেই আমি তন্ত্রসাধনার উপকরণ খুঁজে পাব। আমার মন বলছে, ওখানেই লুকিয়ে আছে সমাধানের সূত্র।

কোনও কথা বললেন না দীপক পাল। শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন বৃদ্ধের হাত দু’টি। তাঁর চোখ ছলছল করছে। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল পল্লব আর অমিয়। অসহায় তিনটে মানুষ বহুক্ষণ পরে কোনও আশার কথা শুনেছে। প্রাণপণে সেটাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছিল তারা।

. . .

অত্যন্ত দ্রুত শুরু হল পরের দিন সকালটা। ভোর পাঁচটা বাজতে না বাজতেই অমিয়রা গিয়ে হাজির হল লাকপার বাড়ি। বেরিয়ে এল লাকপার দুই দাদা। ডুপচেন তাদের কানে কানে কী যেন বলল তাতে তারাই ভাদুড়ি মশায়কে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল বাড়িটা। তীব্র সন্ধানী চোখে বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি জরিপ করে নিচ্ছিলেন ভাদুড়ি মশায় কিন্তু বাড়িতে কিছু পাওয়া গেল না। বাড়ি থেকে বেরিয়েই চোখে পড়ল একটা ছোট্ট টিনের ঘর। যেন খেলনাবাড়ি। বড়জোর একটা মানুষ আঁটতে পারে তার ভেতরে। ভাদুড়ি মশায়ের প্রশ্নের উত্তরে ডুপচেন জানালেন, ওটা সীতার তৈরি ঠাকুরঘর। লাকপারা হিন্দু কিন্তু সীতা ছিল বৌদ্ধ। তাই সে আলাদা করে নিজের ঠাকুরঘর বানিয়েছিল। সীতা চলে গেছে কিন্তু ঠাকুরঘর রয়ে গেছে। ঠাকুর দেবতার ব্যাপার বলে কেউ আর ঘরটা ভাঙেনি। শুনেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ভাদুড়ি মশায়ের চোখ দু’টো। তিনি দেখতে চাইলেন সেই ঘর। তালা খোলা হল। ঘরের মধ্যে সাধারণ একটা কাঠের সিংহাসন। তাতে অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। পুজোর উপকরণ ছড়িয়েছিটিয়ে আছে কিন্তু দেখেই বোঝা যায় বহু দিন এ ঘরে কেউ ঢোকে না। সেই ঘরটাও খুঁটিয়ে দেখলেন ভাদুড়ি মশায় কিন্তু সেখানেও কিছু পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে ফিরে আসছেন এমন সময় দীপক পাল বললেন, আচ্ছা স্যার, পল্লববাবুর কাছে শুনলাম ওই সীতা নামের মেয়েটি না কি ভাঁড়ার ঘরে লুকিয়েছিল। তা সেই ঘরটা একবার দেখবেন না?

থমকে গেলেন ভাদুড়ি মশায়, ঠিক বলেছ। ওই ঘরটার কথা আমার মনে ছিল না।

খোলা হল ভাঁড়ার ঘরের দরজা। চাল, ডাল, নুন, আলুর বস্তায় ভর্তি। দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে না। সুইচ টিপতে জ্বলে উঠল অনুজ্বল এক বাল্ব। সেই ধোঁয়াটে আলোয় বড় অদ্ভুত দেখাচ্ছিল ঘরটাকে। দীপক পালের কাছ থেকে টর্চ নিয়ে প্রতিটা কোণা তন্ন তন্ন করে খুঁজছিলেন ভাদুড়ি মশায়। তাঁর নির্দেশে কখনও কখনও কোনও বস্তা সরিয়ে দিচ্ছিলেন দীপক পাল এবং লাকপার এক দাদা।

এক মাস আগের এক সন্ধেয় সীতা এই ঘরে লুকিয়ে বসেছিল। তার পর অনেক মানুষের পা পড়েছে এই ঘরে। যা কিছু চিহ্ন ছিল সে কি এই এক মাসে মুছে যায়নি? দেখতে দেখতে এটাই ভাবছিল অমিয়। তখনই কিছু একটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন ভাদুড়ি মশায়।

এক দিকের দেওয়ালে সারি দিয়ে রাখা তেলের টিন। তারই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সিঁদুরের দাগ, একটা নক্সার কোণা। দ্রুত হাতে তেলের টিনগুলো সরিয়ে ফেললেন দীপক পাল এবং টর্চের আলোয় উদ্ভাসিত হল সিঁদুর দিয়ে আঁকা একটা অদ্ভুত জ্যামিতিক নক্সা। নক্সাটা ভাল করে দেখল পল্লব, একটা বর্গক্ষেত্রের পেটের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি আর একটা বর্গক্ষেত্র আঁকা হয়েছে। তাতে যে ত্রিভুজগুলি তৈরি হয়েছে তাদের পেটের মধ্যে আবার একটা করে বর্গক্ষেত্র। তাদের মাথাগুলি বেরিয়ে আছে বাইরে। মূল বর্গক্ষেত্রের পেটের মাঝে দুটো ত্রিভুজ উল্টো হয়ে পরস্পরকে ছেদ করেছে। তাতে যে নিউক্লিয়াসের মতো জায়গাটি তৈরি হয়েছে সেখানে আঁকা একটি বৃত্ত এবং তার মধ্যে আঁকা ছোট ছোট তিনটি ত্রিভুজ। কিন্তু সবকটা ত্রিভুজই উল্টো। এমন অদ্ভুত নক্সার কী মানে কিছুই বুঝতে পারল না পল্লব কিন্তু নক্সাটা দেখা মাত্রই অস্থির হয়ে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়। কয়েক মুহূর্ত নির্নিমেষে সেই নক্সার দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি এবং এক রাশ হতাশা ঝরে পড়ল তাঁর কণ্ঠ থেকে। বলে উঠলেন, হা ঈশ্বর।

চমকে উঠল উপস্থিত সকলে। এগিয়ে গেল অমিয়, কী হল স্যার?

ক্লান্ত গলায় ভাদুড়ি মশায় বললেন, যা সন্দেহ করেছিলাম তাই। আমার যা দেখার দেখা হয়ে গেছে। বাইরে চলো।

বাইরে এসে অমিয়রা তিন জন ঘিরে ধরল ভাদুড়ি মশায়কে। পল্লব বলল, কী বুঝলেন একটু খুলে বলুন স্যার। আর দেওয়ালে আঁকা ওই নক্সার মানে কি?

ভাদুড়ি মশায় বললেন, নক্সা নয় পল্লব। ও একটি অতি জটিল যন্ত্র।

যন্ত্র? হাঁ হয়ে গেলেন দীপক পাল, যন্ত্র মানে তো মেশিন।

স্নেহের হাসি হাসলেন ভাদুড়ি মশায়। পিঠে হাত রেখে বললেন, এ যন্ত্র সে যন্ত্র নয় দীপক। খুব ছোট আর সহজ করে বলতে গেলে যখন দেব-দেবীর মূর্তি কল্পিত হয়নি তখন এই যন্ত্রেই দেব-দেবীর পুজো করা হতো। এই যে আজ আমরা মা কালীর যে মূর্তি দেখি ষোড়শ শতাব্দীর আগে কিন্তু এ মূর্তি ছিল না। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ মায়ের মূর্তি কল্পনা করেন। তার আগে যন্ত্রেই মায়ের পুজো হতো। আর শুধু তাই নয়, এখনও মূর্তি থাকলেও পুজোর সময় তাম্রতাটে যন্ত্র আঁকা হয়।

অমিয় বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি দেখেছি। কালী পুজোর সময় একটা তামার পাত্রে সিঁদুর লেপে বেল পাতার ডাঁটি দিয়ে এমন আঁকা হয়।

ঠিক বলেছ। ওই হল যন্ত্র। এখানেও দেওয়ালে একটা যন্ত্র আঁকা হয়েছে।

পল্লব বলল, তার মানে কি এই যন্ত্রেই দেব বা দেবী অবস্থান করেন?

হ্যাঁ। কিন্তু সমগ্র যন্ত্রেই অভীষ্ট দেব বা দেবীর অবস্থিতি নয়। যন্ত্র হল আসলে দেব বা দেবীর নগরী। মানে ধরো, তুমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে চাও। গিয়েই তো তুমি দুম করে তাঁর ঘরে চলে যেতে পারবে না। প্রথমে তোমাকে গেটের সিকিওরিটি পেরতে হবে। তার পর যেতে হবে উপাচার্যের অফিসে। সেখানে গিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে তবে তুমি তাঁর সাথে দেখা করতে পারবে। তাই তো? যে কোনও যন্ত্রও ঠিক তেমন। শক্তিযন্ত্র অনুসারে যদি বলি, সাধারণভাবে এর বাইরের অংশকে বলা হয় ‘দ্বার’। তার পরের অংশটির নাম ‘ভুপুর’। তার পর রয়েছে ‘দল’ এবং ওই যে ভিতরে গোল অংশটি মানে যেটি যন্ত্রের নিউক্লিয়াস সেটির নাম ‘কর্ণিকা’। ওরই মধ্যে মধ্যবিন্দুতে দেব বা দেবীর অবস্থান। এই যন্ত্রেই দেবী পর্ণশবীরর পূজা করা হয়েছে আর সবচেয়ে ভয়ের কথা কী জানো, ওই যে ভিতরের তিনটি ত্রিভুজ উল্টে রয়েছে।

অবাক হল পল্লব, কেন স্যার? ত্রিভুজ উল্টে থাকার সাথে ভয়ের কী সম্পর্ক?

বেশ হাওয়া দিচ্ছে। হাত দিয়ে গলার মাফলারটা একটু টেনে দিলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর বললেন, তোমাদের মনে আছে আমি বলেছিলাম, দেবী পর্ণশবরী শান্তস্বভাবা, মায়ার আধার? তাঁর এ ক্রোধের কারণ আশ্চর্যজনক?

মাথা নাড়ল পল্লব, মনে আছে।

ওই তিনটে উল্টোনো ত্রিভুজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর রহস্য। ত্রিভুজ সোজা থাকা মানে দেবীর শান্ত, প্রসন্ন রূপের পুজো করা কিন্তু উল্টোনো ত্রিভুজ মানে আহ্বান করা দেবীর সংহারক শক্তিকে। এই ভাঁড়ার ঘর থেকেই গোপন তন্ত্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল এবং যার প্রভাব পড়েছিল লাকপা ও তার স্ত্রী বৈজন্থীর ওপর। যদি খুব ভুল না করে থাকি, সীতা তন্ত্রসিদ্ধা। সে ফিরে এসেছিল প্রতিশোধ নিতে। যে ব্যাধির দোহাই দিয়ে তাকে এক দিন এই গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই গ্রাম সংলগ্ন অঞ্চলেই সে জাগিয়ে দিয়ে গেছিল ব্যাধির দেবীকে। সে জানত, এক বার দেবীর রুদ্ররূপকে জাগিয়ে দিতে পারলে তিন পক্ষকালের মধ্যে ব্যাধিগ্রস্ত হবে সংলগ্ন অঞ্চল। এক মাস পার হয়েছে, হাতে রয়েছে আর পনেরো দিন। দেবীকে যদি ফের নিদ্রায় পাঠানো না যায় তা হলে পনেরো দিনের মধ্যেই কোনও না ভয়ানক ছোঁয়াচে ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে চটকপুর এবং গ্রামটি উজাড় হয়ে যাবে।

স্তম্ভিত হয়ে গেল ওরা তিন জন। দীপক পাল অস্ফুটে বলে উঠলেন, সর্বনাশ!

অমিয় বলে উঠল, কিন্তু স্যার তা হলে লাকপা, তিতাস আর মিতুলের সাথে এমন হল কেন? আপনি তো বলছেন, আসল ঘটনাটা ঘটবে আরও পনেরো দিন পর।

সে তো আমি আগেই বলেছি অমিয়। দৈবী মুহূর্তে ওরা দেবীকে বিরক্ত করেছিল। এটা মিতুল, তিতাস বা লাকপা শুধু নয়, যে কারও সাথেই হতে পারত। এই চন্দ্রালোকিত বনভূমিতে যেই ঢুকবে তারই এই বিপদ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ দেবী এখানে ভীষণ ভাবে জাগরুক।

বুঝলাম। আর বৈজন্থী? তার কী হল, প্রশ্ন করল পল্লব।

থমকে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। রুমাল দিয়ে চশমার কাচ মুছলেন অল্প সময় ধরে। তার পর চশমাটা পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সম্ভবত সে মারা গেছে। তাকেই বলি দেওয়া হয়েছে পাথরে খোদিত ওই জাগ্রত দেবী মূর্তির সামনে। লাকপার এই ভাঁড়ার ঘরের ভিতরে যে গূঢ় তন্ত্রাচার শুরু হয়েছে তা শেষ হয়েছে ওই ত্রিকোণাকার খাঁজের সামনে গিয়ে।

শিউরে উঠল সকলে। অমিয় বলল, কিন্তু স্যার, সীতার পক্ষে কি বৈজন্থীকে বলি দেওয়া সম্ভব? বৈজন্থী বাধা দেবে না? একা একটা মেয়ের পক্ষের আর একটা একেবারে মেরে ফেলাটা কিন্তু খুবই অস্বাভাবিক।

যদি বৈজন্থী ঘোরগ্রস্ত থাকে তা হলে অসম্ভব নয়। ডুপচেন যে বলছে বৈজন্থী রাগ করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল, আমার সেটা মনে হয় না। আমার মনে হয় সেই সময় থেকেই বৈজন্থীর ওপর কাজ শুরু করেছিল এই তন্ত্র যা অবধ্য নিয়তির মতো তিন দিন পর বৈজন্থীকে টেনে নিয়ে গেছিল ওই মূর্তি অবধি। সীতা জানত বৈজন্থী আসবে। আর তার চেয়েও বড় কথা, তুমি কী করে জানছ সীতা একাই ছিল? তার কোনও সহকারী ছিল না?

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল অমিয়। তার পর ধীরে ধীরে বলল, স্যার আপনি শিওর তো সীতাই এই কাজ করেছে?

পল্লব দেখল, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের জন্য হলেও বৃদ্ধের দু’চোখে ঝিকিয়ে উঠল ক্রোধ। কিন্তু অপরিমিত সংযমে মুহূর্তে সে ক্রোধ বশীভূত করলেন বৃদ্ধ। তার পর অমিয়র চোখে চোখ রেখে গম্ভীর গলায় বললেন, নিশ্চিত কী করে হব অমিয়? আমি তো ঘটনাস্থলে ছিলাম না। আমি যা বলছি সবই আমার অনুমান। তবে একটা কথা আমি তোমায় বলতে পারি, গুরুকৃপায় আজ অবধি আমার সমস্ত অনুমানই অভ্রান্ত হয়েছে।

ভাদুড়ি মশায়ের অভিমানের জায়গাটা ধরতে পারল অমিয়। হাত জোড় করে বলল, ক্ষমা করবেন স্যার। আমি ও ভাবে সংশয় প্রকাশ করতে চাইনি। দয়া করে ভুল বুঝবেন না আমায়। আমাদের বলুন, এ বার কী করণীয়?

অমিয়র পিঠে হাত রাখলেন ভাদুড়ি মশায়, অস্থির হোয়ো না। আমি রাগ করিনি। আমি বলি কি ডুপচেনের কাছ থেকে দোকানের নামটা জেনে নিয়ে এই মুহূর্তে তুমি আর দীপক দার্জিলিং চলে যাও। গিয়ে সীতাকে নিয়ে এসো। মহিলা পুলিশ নিয়ে নাও সঙ্গে। কিন্তু যে কোনও মূল্যে সীতাকে আমার চাই। এক বার যদি তাকে নিয়ে আসতে পারো তা হলে সে অনিচ্ছুক হলেও আমি তাকে বিপরীত তন্ত্রাচারে বাধ্য করতে পারব বলে আশা রাখি আর তা হলেই এ বিপদের অবসান হবে।

হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল অমিয়দের মুখে। পুলিশি তৎপরতায় দীপক পাল বলে উঠলেন, চলুন স্যার। সোনাদা পৌঁছে গেলে টাওয়ার পেয়ে যাব। আপনাদের কলেজের এক সিনিয়ার এখন মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে আছেন বলেছিলেন না? তাঁর সাথে কথা বলে নেবেন।

জিপ ছুটল দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। কাচের জানলায় মুখ ঠেকিয়ে খাটের নীচে শুয়ে থাকা তিতাস আর মিতুলকে দেখতে দেখতে ফিসফিস করে পল্লব বলল, আজকের রাতটুকু তিতাস। তার পর আবার গান গাইবি তুই।

পল্লবের চোখের জলে আর্দ হল জানলার কাচ।

. . .

সোয়া ছ’টা নাগাদ অমিয়রা রওনা দিয়েছিল। তার পর থেকে শুধুই ঘর-বার করে গেছে পল্লব। এক মুহূর্তের জন্যও স্থির হয়ে বসতে পারেনি। দুপুর তিনটে নাগাদ নীচের বাঁকে গাড়ির হর্ণ শোনা গেল। তিন লাফে ভাদুড়ি মশায়ের ঘরে ঢুকে গেল পল্লব, স্যার ওরা আসছে।

জিপটা এসে দাঁড়াল হোম-স্টের সামনে। পৃথিবীর যাবতীয় হতাশা মুখে নিয়ে জিপ থেকে নেমে এলেন দীপক পাল আর অমিয়। অস্থির পল্লব বলে উঠল, সীতা? সীতা কোথায়?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অমিয় বলল, সীতা দার্জিলিং-এর ওই দোকানে কাজ করত ঠিকই। কিন্তু আজ থেকে দেড় বছর আগে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সঙ্গে সে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। সীতা যেখানে থাকত সেখানেও খোঁজ নিয়েছিলাম আমরা। কেউ কিছু বলতে পারেনি। দোকানে সীতার যে ভোটার আই-ডির ফোটোকপি ছিল সেটা লোকাল থানায় জমা দিয়ে এসেছি আমরা। ওঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, আজ থেকেই সীতাকে খুঁজবেন। তবে পুলিশে চাকরির সুবাদে আমি জানি এ কাজ হয়তো অসম্ভব নয় কিন্তু দুঃসাধ্য। এই বিপুল জনঅরণ্যে শুধুমাত্র ভোটার আই-ডির সূত্র ধরে একটা মানুষকে খুঁজে বার করতে কত সময় লাগবে কেউ জানে না। এর চেয়ে খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা সহজ।

সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন দীপক পাল। ধপ করে বসে পড়ল পল্লব। তীরে এসে যে এ ভাবে তরী ডুবতে পারে তা তার ধারণায় ছিল না। ধারণায় ছিল না অমিয়দেরও। সকলের চেহারাতেই হাল ছেড়ে দেওয়ার ভাবটি স্পষ্ট। তারাও গা এলিয়ে দিল হোম-স্টের সামনে পেতে রাখা চেয়ারগুলোয়। শুধু একা ঋজু শালগাছটির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। শক্ত হয়ে উঠল তাঁর চোয়াল। কাউকে না বললেও এ ঘটনার জন্য মনে মনে প্রস্তুতই ছিলেন তিনি। তাই এতক্ষণ ধরে শুধু গুরুকেই স্মরণ করে গেছেন। শেষ পন্থাটি অবলম্বন করার কথা ভাবলেই হাজার দ্বিধা এসে ঘিরে ধরছিল তাঁকে। কিন্তু গুরুই কাটিয়ে দিয়েছেন সে দ্বিধা। মনে পড়ে গিয়েছে সেই দিনটির কথা।

গুরু মৃত্যুশয্যায়। তাঁকে ঘিরে কীর্তন গান হচ্ছে। কান্নাকাটি মোটে পছন্দ করতেন না সদাহাস্যময় মানুষটি তাই বুকে পাথর রেখে সকলে কান্না চেপে আছে। খবর পেয়ে বারাসাত থেকে ছুটে গিয়েছিলেন ভাদুড়ি মশায়। তিনি গিয়ে দাঁড়াতেই চোখ মেলে চেয়েছিলেন শ্রী রামদাস চট্টোপাধ্যায়। অস্ফুটে বলেছিলেন, নীরেন এসেচে। নীরেন। ওকে আমার কাছে পাঠা।

মাথার কাছে বসে হাওয়া করছিল দুই গুরুভাই। তাদেরই এক জন উঠে এসে বলেছিল, যা নীরেন। গুরুদেব তোকে ডাকছেন।

গুরুর পাশে বসে তাঁর শীর্ণ হাত দু’টি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন ভাদুড়ি মশায়। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন রামদাস ঠাকুর। চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না ভাদুড়ি মশায়। তবু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলেছিলেন, এত তাড়াতাড়ি না গেলেই কি চলছিল না?

অপার স্নেহে হেসেছিলেন রামদাস ঠাকুর। বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি কি রে পাগলা? অনেক দিন বেঁচে নিয়েচি। আর কত জল, হাওয়া, অন্ন ধ্বংস করব এ পৃথিবীর? বেশি দিন বাঁচলে দর পড়ে যায় বুঝলি? একটা সময় আসবে যখন মনের মধ্যে ডাক শুনতে পাবি। তখন যেন আর আঁকড়ে থাকিস না বাপ।

আজ সেই ডাক শুনতে পাচ্ছেন ভাদুড়ি মশায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। নরবলিতে একটা মানুষই তো লাগে।