পর্ণশবরীর শাপ – ১০

১০

কোন দিগন্তরেখায় বসে লাটাই গোটানোর মতো একটু একটু করে দিনের আলো গুটিয়ে নিচ্ছে কেউ আর তার বদলে বিছিয়ে দিচ্ছে অন্ধকারের সুতোয় বোনা বিষণ্ণ এক চাদর। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে ভাঙা চাঁদ। এখনও সে ম্রিয়মাণ। যেটুকু আলো সে দিচ্ছে সেটুকুও হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন এই পাইন বনের জমাট কুয়াশায়। গাছের পাতা থেকে জল ঝরে পড়ছে টুপটুপ করে আর তাকে সঙ্গত করছে অবিশ্রান্ত ঝিঁঝিঁর ডাক। কিন্তু অরণ্যের এই আদিম সিম্ফনির তাল কেটে গেল বিজাতীয় একটি শব্দে। পাহাড়ি ঢালের কাছে এসে দাঁড়াল একটি জিপ। জিপ থেকে নেমে এল অমিয়, পল্লব আর দীপক পাল। তারা ধরাধরি করে নামিয়ে আনল ভাদুড়ি মশায়কে। তাঁর পরনে রক্তাম্বর। মাথায় জড়ানো লাল উত্তরীয়। গায়ে একটি চাদর। ইশারা করা মাত্র সে চাদর সরিয়ে দিলেন দীপক পাল। দেখা গেল বৃদ্ধ নগ্নগাত্র। প্রবল পাহাড়ি ঠান্ডায় এক বার যেন কেঁপে উঠলেন তিনি কিন্তু পরক্ষণেই অসীম মানসিক জোরে সে শৈত্যকে উপেক্ষা করলেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন অমিয়র দিকে। অমিয় তাঁর হাতে তুলে দিল একটি কাপড়ের ঝোলাব্যাগ। সেটি নিজের কাঁধে গলিয়ে নিলেন দীর্ঘকায় বৃদ্ধ। তার পর এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে।

ত্রিকোণ খাঁজটির সামনে তখন জমাট অন্ধকার। ঝোলা থেকে পাঁচটি মোমবাতি বার করে তিনি এগিয়ে দিলেন অমিয়র দিকে। পাহাড়ি দেওয়ালের নীচে পরপর মোমবাতিগুলোকে সাজিয়ে রাখল অমিয়, তার পর আগুন ধরাল তাতে। জঙ্গলের অন্ধকারে মোমবাতির শিখা কেমন যেন বিভ্রম সৃষ্টি করল নিমেষে। গাছের ছায়া কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল পাথরে খোদিত সেই দেবীমূর্তির ওপরে। যেন জ্বলজ্বল করে উঠল দেবীর পাথরের চোখ। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে সে দিকে তাকিয়ে থেকে ভাদুড়ি মশায় বললেন, এ বার তোমরা ফিরে যাও। এখন আমি দীর্ঘ সময় ধরে পুজো করব। দেবীর তুষ্টিবিধানের চেষ্টা করব। যদি সব ঠিক থাকে আমার বিশ্বাস আজ মধ্য রাতের পর থেকেই তিতাস এবং মিতুলের আচরণের পরিবর্তন দেখা যাবে। যাও, ওদের কাছে কাছে থাকো।

অমিয় বলে উঠল, কিন্তু স্যার আপনাকে এখানে এ ভাবে একা ফেলে…

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন ভাদুড়ি মশায়। বললেন, আমি একা নই অমিয়। আদিম এই অরণ্যের সমস্ত জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, সরীসৃপ সকলে আমার সঙ্গে আছে আর আছেন দেবী পর্ণশবরী স্বয়ং। চাঁদ তার জৌলুস অর্জন করলেই দেবী আবির্ভূতা হবেন। তোমরা থাকলে নতুন কোনও বিপদ হতে পারে। সে আমি সামলাতে পারব না।

মিনতি করে উঠলেন দীপক পাল, আমরা একটাও কথা বলব না স্যার। আচ্ছা সবাই থাকছি না, স্যার আর পল্লববাবু ফিরে যান, আমি থাকি? আমি ওই গাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকব। আপনার যদি কোনও সাহায্য দরকার হয়।

দরকার হবে না। আমার কথা শোনো দীপক। যে কোনও মূল্যে দেবীকে আজ নিদ্রামগ্ন করাতেই হবে আমায়। বড় কঠিন এ পূজাপদ্ধতি। তোমাদের উপস্থিতি আমার মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাবে। আমার অনুরোধ, অবাধ্য হোয়ো না।

মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল অমিয়রা। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে স্নেহের হাসি হেসে ভাদুড়ি মশায় বললেন, আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আশা রাখি, সব মঙ্গল হবে। কাল সকালে আমায় নিতে এসো কেমন? আমি বাড়ি ফিরতে চাই।

এ কথা বলে ওদের দিকে পেছন করে ঘুরে গেলেন বৃদ্ধ। ঝোলা থেকে পুজোর উপকরণ বার করে সাজিয়ে রাখতে শুরু করলেন।

এর পর আর কথা চলে না। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে যেতে বাধ্য হল তিন জন। জিপটা ফের রওনা দিল হোম-স্টের দিকে। ওরা সকলেই জানে, পারলে ভাদুড়ি মশায়ই পারবেন তিতাস আর মিতুলকে সুস্থ করে তুলতে তবু এই বিজন অরণ্যে বৃদ্ধকে একা ছেড়ে আসতে কারোরই মন সায় দিচ্ছিল না। বড় বেশি গম্ভীর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল অমিয়। তার চেয়েও বেশি গম্ভীর হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন দীপক পাল। পল্লব বলল, চিন্তা করবেন না পালদা। আমরা আমাদের মতো করে ভাবছি কিন্তু ভাদুড়ি স্যারের ভাবনার সাথে আমাদের ভাবনা মেলে না। উনি অন্য লিগের মানুষ। ওনার ওপর বিশ্বাস রাখুন। উনি সব সামলে নেবেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। কাল সকালে আমরা সবাই মিলে খুব গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরব।

মৃত মানুষের মতো অভিব্যক্তিহীন চোখ তুলে পল্লবের দিকে তাকালেন দীপক পাল। এত বড় আশার কথাটা পল্লবের নিজের কানেও কেমন যেন প্রহসনের মতো শোনাল।

. . .

ক্রাচ দু’টো পাশে রেখে মাটিতে বসে পড়লেন ভাদুড়ি মশায়। এ ভাবে বসতে বড় কষ্ট হয় কিন্তু উপায় কী? দেবীকে তুষ্ট করতে গেলে যে কৃচ্ছ্রসাধন করতেই হবে। তা ছাড়া আর একটু পরেই তো সব ব্যথা বেদনার ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন। আজ নিজের মুখোমুখি হতে গিয়ে বড় আশ্চর্য হয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, নিজেকে তিনি যতটা শক্ত ভাবেন ততটা শক্ত তিনি নন। সাধকের নির্লিপ্তি নেই তাঁর। সংসারের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। যত বার মরার কথা ভাবছিলেন তত বার নাতনি অপালার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ভেসে উঠছিল পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি সৌমেন্দ্রনাথের মুখ। শুধু এই নিকটাত্মীয়েরাই নয়, অবাক হয়ে তিনি ভাবছিলেন, কোন অজান্তে তাঁর মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে কয়েকটা অনাত্মীয় ছেলেমেয়ে। তিতাস, মিতুল, অমিয়, পল্লব, সঞ্জয়, দীপক… সব্বার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল খুব করে। মনে হচ্ছিল, মরে গেলে আর তো এদের সঙ্গে দেখা হবে না। দুপুরের নরম রোদে পিঠ পেতে এরা আর কেউ গল্প শুনবে না তাঁর থেকে। আর নিয়তির এমনই পরিহাস, এদের কাউকে না জানিয়েই তাঁকে চলে যেতে হবে। খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখে জল এসে গেছিল। সেই নোনা জল ঠোঁট ছুঁতেই চমকে উঠেছিলেন তিনি। খুব ধিক্কার দিয়েছিলেন নিজেকে। তার পরেই গুরুর শরণ নিয়েছিলেন। নাহ! এখন আর কোনও দ্বিধা নেই। দ্বন্দ নেই। লক্ষ্যে অবিচল তিনি। পৃথিবীর কোনও শক্তি আজ তাঁকে তাঁর সংকল্প থেকে নড়াতে পারবে না। এখন তিনি সংসারবদ্ধ জীব নীরেন্দ্রনাথ ভাদুড়ি নন। এখন তিনি রামদাস ঠাকুরের প্রিয়তম শিষ্য নীরেন। গুরু বলতেন, ‘লেগেপড়ে থাক নীরেন। অলৌকিক হবেই। শুধু লেগেপড়ে থাক।’ তিনি জানেন, তাঁর এ পুজো সফল হলে সত্যি আবার আলৌকিক হবে। যে ভাবে ব্যাধিগ্রস্ত হয়েছিল তিতাস, মিতুল বা লাকপা, সেই একই ভাবে তাদের স্পর্শ করবে আরোগ্যের জিয়নকাঠি।

ব্যাগ থেকে বার করে আনেন তামার পাত্র। তার ওপরে সিঁদুর লেপে এঁকে ফেলেন দেবীর যন্ত্রটি। মাটির তালের ওপর স্থাপন করেন ঘট। তার ওপর সাজিয়ে দেন গাছের পাতা এবং সব শেষে ব্যাগ থেকে বার করে আনেন একটি ধারাল ছুরি। ছুরিটা তিনি চুপিচুপি চেয়ে নিয়েছেন ডুপচেনের থেকে। তাঁকে দেওয়ার আগে ভাল করে ছুরিটায় ধার দিয়েছে ডুপচেন। আসার আগে ডুপচেনের মাথায় হাত রেখে বসে এসেছেন, চিন্তা কোরো না মা। আশা রাখি তোমার ভাই সুস্থ হয়ে যাবে।

মন্ত্র পড়ে ছুরিটি শোধন করে নিলেন ভাদুড়ি মশায়। যে কোনও অস্ত্রে বলি দেওয়া যায় না। অস্ত্রটিকেও অধিকারী হয়ে উঠতে হয়। সিঁদুরচর্চিত করে ছুরিটি তিনি রেখে দিলেন দেবীর পায়ের তলায়। এক বার মুখ তুলে তাকালেন আকাশের দিকে। গত্তি লেগেছে চাঁদের গায়ে। কুয়াশার জাল ভেদ করে চাঁদের নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছে এই পার্বত্য অরণ্যভূমিতে। তিনি জানেন, ক্ষেত্র প্রস্তুত। এর পর যে কোনও সময় থেমে যাবে অরণ্যের স্বাভাবিক কোলাহল। বাতাস মদির হয়ে উঠবে অচেনা এক সুগন্ধে আর তার কিছুক্ষণ পরেই আবির্ভূতা হবেন দেবী। তার ঠিক আগে কম্পন জাগবে বৃক্ষরাজির শিকড়ে শিকড়ে, আলোড়িত হবে ভূমি। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে উৎসর্গ করতে হবে বলি, এক্ষেত্রে নিজেকে।

চোখ বুজে মনে মনে মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন ভাদুড়ি মশায়। একই সঙ্গে চলতে লাগল দুই হাতের নানাবিধ মুদ্রা। অঞ্জলি অর্পণ করলেন দেবীর চরণকমলে। এ ভাবেই কতটা সময় কেটেছে তাঁর খেয়াল নেই, হঠাৎই অনুভব করলেন, ধীরে ধীরে কমে আসছে জঙ্গলের শব্দ। চোখ খুলে টানটান হয়ে বসলেন তিনি। ওই তো, দেবীর আগমণবার্তা সূচিত হচ্ছে। অতলস্পর্শী এই নিস্তব্ধতা ভয়াবহ, শ্বাসরোধকারী। দেখতে দেখতে সম্পূর্ণ শব্দহীন হয়ে গেল গোটা চরাচর। আর ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভাদুড়ি মশায়ের চেতনা আচ্ছন্ন করে দিল স্বর্গীয় এক সুগন্ধ। বিহ্বলতা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে শক্ত করলেন তিনি। যদিও এই অপার্থিব সুবাসে মানুষের মন বেপথু হওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু এই মুহূর্তে মনঃসংযোগে সামান্য চিড়ও বিপদ ঘটিয়ে দিতে পারে। বৃথা হয়ে যেতে পারে এতক্ষণের পরিশ্রম। ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তায় দেবীর পায়ের কাছ থেকে নামিয়ে আনলেন ছুরিটি। ডান হাতে শক্ত করে চেপে ধরলেন সেটিকে। চোখের কাছে তুলে এক বার ভাল করে দেখে নিলেন বাম হাতের মণিবন্ধ। শক্ত করলেন বাম মুঠি। ওই তো জেগে উঠেছে ধমনী এবং শিরা। তার ওপর আলতো ছোঁয়ালেন ছুরিটি। ভুল করার কোনও অবকাশ নেই। বলিতে ত্রুটি অমার্জনীয়। এক টানেই ছিন্ন করতে হবে মণিবন্ধ। রক্তার্ঘ্য দিতে হবে দেবীকে।

অস্ফুটে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন ভাদুড়ি মশায়। দেবীর কাছে বলি উৎসর্গ করার মন্ত্র। এক সময় সমাপ্ত হল মন্ত্রপাঠ। ঘট থেকে জল নিয়ে তিন বার ছিটিয়ে দিলেন সিঁদুরচর্চিত ছুরিটির ওপর। বাকি সব সমাপন। এ বার শুধু বলি হলেই দেবী পুনরায় নিদ্রামগ্ন হবেন এবং তার আগে তুলে নেবেন তাঁর অভিশাপ। একটি প্রাণের বিনিময়ে সুস্থ হবে তিনটি মানুষ এবং আসন্ন বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাবে একটি গোটা জনপদ। এ কথা ভাবতেই মনটা বড় ভাল হয়ে গেল ভাদুড়ি মশায়ের। ডান হাতে ছুরি চেপে ধরে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন সেই মৃদু কম্পনের। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই কম্পন অনুভব করা সম্ভব নয়। কিন্তু এক জন সাধক তা বুঝতে পারবেন। মনুষ্যেতর প্রাণীরা এমন অনেক কিছু টের পায় যা মানুষ পায় না। যেমন ভূমিকম্প বা অগ্ন্যুৎপাতের আগে দল বেঁধে পশু-পাখি-কীটপতঙ্গ সংলগ্ন এলাকা ছেড়ে পালায়। মানুষ লোভী। সে প্রকৃতিকে শুধুই ব্যবহার করে। বদলে ফিরিয়ে দেয় না কিছুই। তাই প্রকৃতি মানুষকে এই সব ক্ষমতা দেয়নি। কিন্তু সাধনা মানুষকে নির্লোভ করে তাই সাধনায় ফাঁকি না থাকলে এমন কিছু শক্তি আয়ত্ব করতে পারে মানুষও।

ভাবতে ভাবতেই ভাদুড়ি মশায় অনুভব করলেন মাটির বুকে আলোড়ন জেগেছে। গাছের শিকড়ে শিকড়ে শুরু হয়েছে ফিসফিসানি, আসছে, সে আসছে! এই বার সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। টানটান হয়ে উঠল ভাদুড়ি মশায়ের সমস্ত পেশি। আভূমি নত হয়ে প্রণাম করলেন দেবীকে। অস্ফুটে বলে উঠলেন, বলি নাও মা। বলি নাও। ব্যাধিমুক্ত করো এ পৃথিবী, আরোগ্য আনো। আরোগ্য।

মুষ্ঠিবদ্ধ বাম হাত উল্টো করে সামনে এগিয়ে দিলেন সামনে। কম্পন বাড়ছে ক্রমাগত। ডান হাতের ছুরি তুলে ধরলেন আড়াআড়িভাবে। এই বার… কিন্তু কব্জির ওপর ছুরির আঘাত নেমে আসার আগেই কে যেন পেছন থেকে চেপে ধরল তাঁর হাত এবং সবলে ছুরিটা ছিনিয়ে নিল হাত থেকে!

ছিটকে পেছন ঘুরতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। ছুরি হাতে তাঁর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পল্লব। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে উঠেই কঠিন গলায় বললেন, এ কী! তুমি এখানে কী করছ? আমি তো তোমাদের চলে যেতে বলেছিলাম।

উত্তর দিল না পল্লব। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ভাদুড়ি মশায়ের দিকে। তার চোখ দু’টো যেন ছলছল করছে। ধরা গলায় সে বলে উঠল, দিস ইজ নট ডান স্যার। আপনি যা করতে যাচ্ছিলেন সেটা ঠিক না।

গর্জে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, মূর্খ। আমি ঠিক না ভুল সেটা তুমি ঠিক করে দেবে? ছুরিটা ফেরত দাও। এটা ছেলেখেলা করার সময় না।

আমিও তো সেটাই বলতে চাই স্যার। আমাদের ফিরিয়ে দিয়ে আপনি যেটা করছেন সেটাও ছেলেখেলা। এ ভাবে আপনি কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

থমকে গেলেন ভাদুড়ি মশায়, পল্লব এ কথা জানল কেমন করে? তবে কি ও ফলো করছিল?

একই রকম ধরা গলায় পল্লব বলল, কী ভাবছেন স্যার? আমি জানলাম কী করে? আসলে আমার সন্দেহ হয়েছিল। আমি যখন দেবীকে ঘুম পাড়ানোর দ্বিতীয় কোনও পন্থা আছে কি না জানতে চেয়েছিলাম আপনি উত্তর দেননি। তখন থেকেই আমার মন বলছিল, এমন কোনও একটা রাস্তা আছে যা আপনি আমাদের সামনে বলতে চান না। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার মাথার মধ্যে। উত্তর পেলাম আজ সকালে। অমিয়রা যখন সীতাকে খুঁজতে গেছিল আমি আপনার ঘরে গিয়েছিলাম আপনার সঙ্গে দেখা করতে। গিয়ে দেখলাম, আপনি চোখ বুজে কাঁদছেন। আমি বুঝতে পারলাম আপনি খুব বড় কোনও স্টেপ নিতে চলেছেন। তখন থেকে আমি আপনাকে ফলো করা শুরু করলাম। তার পর একটা সময় ফোনে টাওয়ার পেয়ে আপনি অপালাকে ফোন করলেন এবং নানা অসংলগ্ন কথা বলতে থাকলেন। যে ধরনের কথা আপনার মুখে মানায় না। অত্যন্ত বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলেন আপনি। তখনই আমার সন্দেহ আরও বাড়ে আর সেই সন্দেহ বদ্ধমূল হল যখন আপনি ডুপচেনের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ছুরি চাইতে গেলেন। আমিও দু’য়ে দু’য়ে চার করে ফেললাম।

থমকে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর একটু সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, তুমি একা এসেছ?

হ্যাঁ স্যার। অমিয় জানে মাইগ্রেনের ওষুধ খেয়ে আমি আপনার ঘরে ঘুমোচ্ছি। ভোরের আগে ও আমায় ডাকবে না। কিন্তু স্যার, এসে যখন পড়েছি আপনাকে এ সর্বনাশ আমি কিছুতেই করতে দেব না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভাদুড়ি মশায়। তারপর নিজেকে শক্ত করে বললেন, ছেলেমানুষি কোরো না পল্লব। এ ছাড়া তিতাস বা মিতুলকে সুস্থ করার দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। আমি বলি উৎসর্গ করার মন্ত্র পাঠ করে ফেলেছি। বলি না দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। হাতে সময় নেই। আমি বেশ বুঝতে পারছি, যে কোনও মুহূর্তে দেবী আবির্ভূতা হবেন। ছুরিটা আমায় দাও।

হাত বাড়ালেন ভাদুড়ি মশায়। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে জেদি গলায় পল্লব বলল, না।

চমকে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়। তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। গর্জন করে উঠলেন, তুমি আমার মুখে মুখে তর্ক করছ?

কঠিন গলায় পল্লব বলল, করছি। আমি ডিশিসন নিয়ে ফেলেছি, আপনাকে মরতে দেব না।

পল্লবের চোখ দু’টো কেমন যেন ঘোলাটে লাগল ভাদুড়ি মশায়ের কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন, ছেলেটা প্রকৃতিস্থ নেই। আবেগের বিস্ফোরণ ছেলেটার স্বাভাবিক বুদ্ধিলোপ ঘটিয়েছে। এখন ওর ওপর জোর খাটিয়ে লাভ হবে না। ভাল মুখে ওর হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিতে হবে। নরম গলায় ভাদুড়ি মশায় বললেন, আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি পল্লব। কিন্তু এ ছাড়া যে আর কোনও উপায় নেই। আমার কথা শোনো দয়া করে। আমায় দিয়ে দাও ছুরিটা। বিশ্বাস করো বলি না হলে অনর্থ হবে।

সেই ঘোলাটে ছলছল চোখে কয়েক মুহূর্ত ভাদুড়ি মশায়ের দিকে তাকিয়ে রইল পল্লব। মনে মনে উৎসাহিত হলেন বৃদ্ধ। মনে হচ্ছে, অনুরোধে কাজ দিয়েছে। ফের হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি কিন্তু তাঁকে অবাক করে ছুরি ধরা হাতটা নিজের দিকে গুটিয়ে নিল পল্লব। অদ্ভুত এক হাসি ফুটে উঠল তার ঠোঁটের কোণে। ঘোর লাগা গলায় সে বলল, কে বলেছে বলি হবে না? বলি হবে তো। আপনি বলি উৎসর্গের মন্ত্র পড়ে ফেলেছেন, এ বার যে কেউ বলি হলেই তো হল।

শিউরে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়। বিপদ যে এ দিক থেকে আসতে পারে তা তিনি কল্পনাও করেননি। কাতর গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন, পাগলামি কোরো না পল্লব। নিজেকে এ সবের মধ্যে টেনে এনো না। আমার বয়স হয়েছে। আমি অনেক দিন বেঁচে নিয়েছি। আমি মরলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না।

চুপ করুন, চিৎকার করে উঠল পল্লব, কে বলেছে ক্ষতি হবে না? আপনি চলে গেলে কত মানুষ ভরসাহারা হয়ে যাবে আপনি বুঝতে পারছেন? আপনি অন্য লিগের মানুষ স্যার। আপনার মতো মানুষ আমি আজ অবধি একটাও দেখিনি। বহু মানুষের মঙ্গলের জন্য আপনার বেঁচে থাকাটা দরকার।

অবাক হয়ে ভাদুড়ি মশায় দেখলেন, পল্লবের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে কান্নার দমকে। কাঁদতে কাঁদতেই পল্লব বলল, দেখুন স্যার, বলি যখন দিতেই হবে তখন তো আমাদের মধ্যে থেকেই কাউকে বেছে নিতে হবে তাই না? আপনি তো আর কাপালিক না যে একটা পাহাড়ি বাচ্চাকে ধরে বলি দিয়ে দেবেন! তাই সেই হিসেবে যদি দেখি, আপনি কাকে কাকে বলি দিতে পারেন? নিজেকে, আমাকে, অমিয়কে আর পালদাকে। তিতাস আর মিতুল তো অসুস্থ। আচ্ছা, ওদেরও লিস্টে রাখছি আমি। এ বার দেখা যাক, কে মরলে সবচেয়ে কম ক্ষতি হবে? আগেই বলেছি, মানুষের মঙ্গলের জন্য আপনার বেঁচে থাকা দরকার। আপনি বাদ। আপনি জাস্ট বাদ। বুঝেছেন?

থুতু ছিটকে এল পল্লবের মুখ থেকে। ফুলে উঠল নাকের পাটা। সে থরথর করে কাঁপছে। চিৎকার করে আবার বলল, এর পর অমিয় আর পালদা। ওরা দু’জনেই পুলিশ। সোসাইটির প্রতি ওদের অনেক কনট্রিবিউশন আছে। ওরা দু’জনেও বাদ। ক্লিয়ার স্যার? তার পর তিতাস। ও তো ডাক্তার। ও মানুষকে প্রাণ দেয়। ওকে তো বেঁচে থাকতেই হবে। সো তিতাস আউট হয়ে গেল এই লিস্ট থেকে। অকাট্য যুক্তি আমার। আপনি কাটতে পারবেন না আমায়, হাসি আর কান্নায় বেপথু পল্লবের স্বাভাবিক চিত্তবৃত্তি। ভাদুড়ি মশায়ের দিকে এগিয়ে এল সে। নীচু গলায় বলল, এ বার মিতুল। ওর তো মরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বাচ্চা একটা মেয়ে। এখনও কিছুই দেখেনি এ দুনিয়ার। তা ছাড়া ও আমাকে দাদা বলে ডাকে। আমাকে সোয়েটার কিনে দিয়েছে জানেন? আমি তো ওকে মরতে দিতে পারব না স্যার। তা হলে হারাধনের দশটি ছেলের মধ্যে পড়ে রইল কে? এই আমি শ্রী শ্রীযুক্ত শ্রীল পল্লব চক্রবর্তী। কী করেছি আমি এত দিনে? এই সোসাইটিতে আমার কী কন্ট্রিবিউশন? কিস্যু না। নাথিং। কলেজে থাকতে আমি রাজনীতি করতাম জানেন স্যার? স্বপ্ন দেখতাম সাম্যবাদের। স্বপ্ন দেখতাম, যৌথখামার হবে। দুনিয়ার সব গরিব মানুষের ঘরে গন্ধ ছুটবে গরম ভাতের। কেউ অভুক্ত থাকবে না। পুঁজিবাদের মুখে সপাটে লাথি মেরে আমরা নিয়ে আসব রক্তরাঙা ভোর। আর একটা ১৯১৭ আসবে। আসবে নভেম্বর বিপ্লব। কিন্তু তার পর আমি কী করেছি? আপনি নিশ্চয়ই জানেন স্যার, বিপ্লবের পথ চিরকাল গার্হস্থ্যের দিকে বেঁকে যায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমি লোভী। পুঁজিবাদ আমায় গিলে খেয়েছে। আমি গাড়ি কিনেছি। নতুন মডেলের গাড়ি দেখলে আমার জিভ দিয়ে লালা পড়ে। এসির হাওয়া ছাড়া আমার ঘুম আসে না। আমি সত্যভ্রষ্ট হয়েছি স্যার। আমি বিপ্লবকে ধোঁকা দিয়েছি। আই অ্যাম আ ট্রেটার। আর ট্রেটারদের শাস্তি কি জানেন? তাদের মার্কেটপ্লেসে বেঁধে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়। সেই হিসেবে আমার তো মৃত্যুই প্রাপ্য। তাই আমাকে প্লিজ বাধা দেবেন না। লেট মি গো। লেট মি গো…

ছুরিটা উঁচু করে তুলে ধরল পল্লব। ভাদুড়ি মশায় অনুভব করলেন, কম্পন এই মুহূর্তে তীব্রতম। আর সময় নেই। চোখের সামনে পৌত্রসম এক যুবককে মরতে দিতে পারেন না তিনি। বাঁ হাতের ক্রাচটা দিয়ে তিনি সজোরে মারলেন পল্লবের পায়ে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না পল্লব। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ভাদুড়ি মশায়ের পক্ষে যতটা দ্রুত যাওয়া সম্ভব তিনি এগিয়ে গেলেন ছুরিটা কেড়ে নিতে। কিন্তু এক পাক গড়িয়ে তাঁর নাগালের বাইরে চলে এল পল্লব এবং হাঁটুর ওপর বসে ছুরিটা আড়াআড়ি চালিয়ে চালিয়ে দিল নিজের কব্জিতে। রক্ত ছিটকে গিয়ে লাগল পাথরের দেবীমূর্তিতে আর তখনই তীব্র এক আলোর উদ্ভাসন হল। মহাবৃক্ষের বুক চিরে আবির্ভূতা হলেন দেবী। তাঁর তিন আননে নয়টি চক্ষু। ছয়টি হস্ত। চুল উড়ছে সাপের ফণার মতো। অপার্থিব সুবাসে শ্বাসরোধ হয়ে এল। সেই আলোকসামান্য তেজোদ্দীপ্ত উপস্থিতি সহ্য করতে পারলেন না ভাদুড়ি মশায় বা পল্লব কেউই। ছিটকে পড়লেন পাথরের দেওয়ালে। পল্লবের হাত থেকে খসে গেল ছুরি। তার পর ধীরে ধীরে সব অন্ধকার হয়ে এল।

১১

হোম-স্টের ঘরে বসে অমিয়র কাছে সবটা শুনছিলেন ভাদুড়ি মশায়। ভোরবেলা পল্লবকে বিছানায় না দেখে অমিয় শিউরে ওঠে। দীপক পালকে ডাকতে যাবে, তার আগেই মিতুলদের ঘর থেকে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে সে থমকে যায়। ছুটে যায় সে দিকে। ঘরের মধ্যে থেকে তিতাস তখন পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে, এটা নিশ্চয়ই গাধা পল্লবটার কাজ। নইলে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করার বুদ্ধি আর কার হবে? এই পল্লব, অমিয়… দরজা খোল।

তিতাসের গলাটা ভারী স্বাভাবিক লাগে অমিয়র। সে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়। দেখে, তিতাস জামাকাপড় পরে রেডি আর মিতুল দাঁত মাজছে। ঘরের মধ্যে মলমূত্রের বিন্দুমাত্র গন্ধ নেই। যেন সবটা স্বাভাবিক। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে তিতাস আর মিতুল। ততক্ষণে ছুটে এসেছেন দীপক পালও। তাঁকে আর অমিয়কে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিতাস বলে ওঠে, কী হয়েছে? অমন হাঁ করে কী দেখছেন আপনারা? হোয়াটস রং উইথ ইউ অমিয়?

আর থাকতে পারেন না দীপক পাল। ছুটে গিয়ে মিতুলকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন। অমিয়র চোখেও তখন জল। তিতাসের হাত দু’টো ধরে বলে, তিতাস, আই কান্ট বিলিভ দিস। ভাদুড়ি স্যার আবার একটা মিরাকল করেছেন!

অবাক হয়ে যায় তিতাস আর মিতুল। তাদের সবটা খুলে বলে অমিয় এবং ভাদুড়ি মশায় যে কাল রাতেই জঙ্গলে গেছেন সে কথা জানায়। তা ছাড়া পল্লবকে খুঁজে না পাওয়ার খবরটা দিতেও ভোলে না। তক্ষুনি জঙ্গলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ওরা চার জন। সেই পাহাড়ি ঢালের কাছে এসে ওরা অবাক হয়ে দেখে, দেবীমূর্তি ফের শ্যাওলায় ঢেকে গেছে এবং ত্রিকোণ খাঁজের নীচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন ভাদুড়ি মশায় আর পল্লব। ওদের ডাকে দু’জনেই চোখ মেলে তাকায়। দু’জনের চোখেই থতিয়ে যাওয়া ভাব।

তার পরেরটুকু তো ভাদুড়ি মশায় নিজেই জানেন। জ্ঞান ফিরে পেয়েই তিনি প্রথম যে কথাটি বলেন, সেটি হল, পল্লব!

ঘুরে তাকিয়ে পল্লবকে দেখে শিহরিত হন তিনি এবং কেঁদে ফেলেন। অস্ফুটে বলতে থাকেন, জয় মা। জয় মা। অলৌকিক হয়েছে তিতাস। অলৌকিক হয়েছে। আমি না, তোমাদের সব্বাইকে এবং এই চটকপুরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে পল্লব।

নিজের কব্জিটা অমিয় আর তিতাসকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিল পল্লব। সেখানে ক্ষত তো দূর, সামান্য আঁচড়েরও দাগ নেই। বিস্মিত তিতাস বলল, কিন্তু স্যার এটা কী ভাবে সম্ভব হল একটু বলুন প্লিজ।

একটু চুপ করে থেকে ভাদুড়ি মশায় বলে উঠলেন, ঠিক কী ভাবে হল আমি বলতে পারব না তিতাস। দেবীর লীলা বুঝি সামান্য মানুষের সাধ্য কী? যা বলছি, সবই আমার অনুমান। দেখো, বলি শব্দটার মধ্যে তো বলের ধারণা নিহিত আছে। বলিপ্রদত্ত জীবটিকে মারবার জন্য বলপ্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেই বলের বিষয়টাই ছিল না। আমি সজ্ঞানে নিজেকে উৎসর্গ করব ঠিক করেছিলাম। তার পর পল্লব যখন এল সেও স্বেচ্ছায় নিজেকে বলি দিতে চাইল। দু’জন মানুষের এই ঐকান্তিক আত্মত্যাগের ইচ্ছে একটি বলির প্রারব্ধকে ছাপিয়ে গেল। প্রারব্ধ মানে হল কৃতকর্মের দরুন অর্জিত ফল। তাই দেবী কোনও বলিই নিলেন না। উল্টে কাঙ্ক্ষিত বর দান করলেন আমায়। সুস্থ হয়ে উঠলে তোমরা। আমার স্থির বিশ্বাস ডুপচেনের ভাই লাকপাও সুস্থ হয়ে গেছে। সে খুব শিগগিরই ফিরে আসবে। আর শুধু তাই নয়, প্রীত হয়ে আমার এত বছরের ব্যাধিগ্রস্ত পা দু’টিকেও পুরোপুরি ঠিক করে দিলেন আরোগ্যের দেবী! দূর করে দিলেন আমার অনেকখানি জরা। বিশ্বাস করো, মনে হচ্ছে যেন আমার কুড়ি বছর বয়স কমে গেছে।

হ্যাঁ, ফেরার পথে হেঁটেই জিপে উঠেছেন ভাদুড়ি মশায়। তাঁর ক্রাচ দু’টি পড়ে আছে ওই পাহাড়ি দেওয়ালের কাছে। এই মিরাকলটা দেখে সবাই এমন ভেবলে আছে যে পল্লব বলার সুযোগ পায়নি, বহু দিন ধরে সে গলার একটা সমস্যায় ভুগছিল। সব সময় মনে হতো গলায় আঁশের মতো কী যেন আটকে আছে। সেটার আর চিহ্নমাত্র নেই। তারও নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে।

. . .

ছয় মাস পর…

ভাদুড়ি মশায়দের পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। সেখানে একটা নাটক করবে ছেলেমেয়েরা। নাটকটা পল্লবের লেখা এবং ডিরেকশন দিচ্ছে সেই। তবে শুধু ছেলেমেয়েরাই নয়, এ নাটকে অমিয়, মিতুল, সঞ্জয় আর অপালা অভিনয় করছে। অপালা বিদেশ থেকে ফিরেছে এবং জোর করে সঞ্জয়কে ছুটি নিতে বাধ্য করেছে। তিতাস নিয়েছে স্টেজ ডিজাইনের দায়িত্ব আর দীপক পাল হয়েছেন ম্যানেজার। সন্ধের টিফিন, চা, ড্রেসারের সাথে আলোচনা, মাল ডেলিভারি এ সবগুলো তিনিই দেখছেন। এ ক’ দিন একটা প্রবন্ধ লিখছিলেন বলে রিহার্সাল দেখার সময় পাননি ভাদুড়ি মশায়। আজ রিহার্সাল দেখতে বসেছেন। পল্লব এখনও এসে পৌঁছয়নি, কিন্তু কুশীলবরা পার্ট মুখস্থ বলছে। পল্লব খুব কড়া ডিরেক্টর। প্রম্পট করার ঘোরতর বিরোধী সে। তাই পার্ট মুখস্থ না হলে সে রেগে যায়। নাটকটা শুনতে বেশ ভালই লাগছে ভাদুড়ি মশায়ের। খাসা লেখে ছেলেটা। ছেলেটার হাতে লেখা আছে। লেগেপড়ে থাকলে উন্নতি করবে। এখন নাটক ক্লাইম্যাক্সে দাঁড়িয়ে আছে। নায়ক আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে আর তাকে বাধা দিচ্ছে তার এক মাস্টারমশাই। অমিয় নায়কের চরিত্রে অভিনয় করছে। সংলাপ বলে উঠল সে, ”তা হলে হারাধনের দশটি ছেলের মধ্যে পড়ে রইল কে? এই আমি শ্রী শ্রীযুক্ত শ্রীল বিধান সরকার। কী করেছি আমি এত দিনে? এই সোসাইটিতে আমার কী কন্ট্রিবিউশন? কিস্যু না। নাথিং। কলেজে থাকতে আমি রাজনীতি করতাম জানেন স্যার? স্বপ্ন দেখতাম সাম্যবাদের। স্বপ্ন দেখতাম, যৌথখামার হবে। দুনিয়ার সব গরিব মানুষের ঘরে গন্ধ ছুটবে গরম ভাতের। কেউ অভুক্ত থাকবে না। পুঁজিবাদের মুখে সপাটে লাথি মেরে আমরা নিয়ে আসব রক্তরাঙা ভোর। আর একটা ১৯১৭ আসবে। আসবে নভেম্বর বিপ্লব। কিন্তু তার পর আমি কী করেছি? আপনি নিশ্চয়ই জানেন স্যার, বিপ্লবের পথ চিরকাল গার্হস্থ্যের দিকে বেঁকে যায়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমি লোভী। পুঁজিবাদ আমায় গিলে খেয়েছে। আমি গাড়ি কিনেছি। নতুন মডেলের গাড়ি দেখলে আমার জিভ দিয়ে লালা পড়ে। এসির হাওয়া ছাড়া আমার ঘুম আসে না। আমি সত্যভ্রষ্ট হয়েছি স্যার। আমি বিপ্লবকে ধোঁকা দিয়েছি। আই অ্যাম আ ট্রেটার। আর ট্রেটারদের শাস্তি কি জানেন? তাদের মার্কেটপ্লেসে বেঁধে পাথর ছুঁড়ে মারা হয়। সেই হিসেবে আমার তো মৃত্যুই প্রাপ্য। তাই আমাকে প্লিজ বাধা দেবেন না। লেট মি গো। লেট মি গো…”

মুহূর্তে ভুরু কুঁচকে গেল ভাদুড়ি মশায়ের। এ কথাগুলো যে তাঁর ভারী চেনা। বিদ্যুচ্চমকের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। চন্দ্রালোকিত বনভূমিতে দাঁড়িয়ে পল্লব পাগলের মতো করছে। কখনও কাঁদছে, কখনও হাসছে। আর ঠিক এই কথাগুলোই বলছে! মনটা খারাপ হয়ে গেল ভাদুড়ি মশায়ের। আহা রে! ছেলেটার মনের মধ্যে জমাট বেঁধে আছে এই দুঃখের পাহাড়। তাই নাটকের সংলাপেও এ কথাগুলো লিখেছে সে। কিন্তু একটা জায়গায় খটকা লাগল ভাদুড়ি মশায়ের। সে দিন ঘোরের মধ্যে বলা কথাগুলো হুবহু এক কী করে লিখল পল্লব? সে সময় তার স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পেয়েছিল, ফলে সে কী বলেছিল তা তো তার পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে থাকার কথা নয়। তা হলে? তিতাসকে জিজ্ঞেস করলেন, এ নাটকটা কি পল্লব পাহাড় থেকে ফিরে এসে লিখেছে?

তিতাস বলল, না তো স্যার। এ ওর কলেজে থাকতে লেখা নাটক। জানেন, দারুণ হিট করেছিল নাটকটা? আমরা কত শো করেছিলাম। এই বিধান সরকারের চরিত্রে পল্লব নিজেই অভিনয় করত। ওর এই মোনোলগটায় লোকে স্পেলবাউন্ড হয়ে যেত। কাঁদতে কাঁদতে হাততালি দিত।

প্রেমিকের গুণাবলীর কথা বলতে গিয়ে রীতিমতো উত্তেজিত তিতাস। কিন্তু উত্তোরত্তর কুঁচকে যাচ্ছিল ভাদুড়ি মশায়ের ভ্রূযুগল। একটু একটু করে তাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠছিল ক্রোধ। কূট একটি সম্ভাবনা ক্রমশ দৃঢ় হয়ে বসে যাচ্ছিল তাঁর মনে। অস্থির ভাবে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন পল্লবের জন্য।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই পল্লব চলে এল। তাকে বসতে না দিয়েই ভাদুড়ি মশায় বললেন, আমার লাইব্রেরি ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

আসতে না আসতেই লাইব্রেরি ঘর! বাকিদের মতোই পল্লবও ভারী অবাক হয়ে গেল কিন্তু বৃদ্ধকে প্রশ্ন করার নিয়ম নেই। পায়ে পায়ে সে গিয়ে ঢুকল লাইব্রেরি ঘরে। এই সেই লাইব্রেরি যা দেখলে পল্লব তীব্র ইনফিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। গিয়ে নিজের ইজিচেয়ারে বসে পড়লেন ভাদুড়ি মশায়। হাত দিয়ে পল্লবকে সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন, বোসো।

পল্লব বসল ঠিকই কিন্তু ভাদুড়ি মশায়ের এই আচরণের কারণ সে ধরতে পারছিল না। তীব্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। এই তীক্ষ্ন অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে যে কেউই ঘাবড়ে যাবে। গুটিয়ে যাবে। পল্লবেরও তাই হল। সে আমতা আমতা করে বলল, কী হল স্যার? কী দেখছেন অমন করে?

হঠাৎই সম্পুর্ণ একটা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ। বললেন, আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে পল্লব? কথা দাও মিথ্যে বলবে না?

ঘাবড়ে গেল পল্লব। বলল, না, আপনাকে মিথ্যে বলব কেন? আপনাকে আমি ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি। আজ অবধি আপনার সামনে মিথ্যে বলিনি।

আচমকা চাপা গলায় গর্জে উঠলেন ভাদুড়ি মশায়, বলেছ। চরম মিথ্যে বলেছ তুমি।

কবে? কোথায়? আশ্চর্য হল পল্লব?

চটকপুরে, সেই ত্রিকোণাকার খাঁজের সামনে, কঠিন গলায় বললেন ভাদুড়ি মশায়, সে দিন তুমি যা করেছিলে তা অভিনয়। তুমি সত্যি সত্যি নিজেকে ত্যাগ করতে আসোনি সে দিন। তুমি আমায় ছলনা করেছিলে। এমনকী ছলনা করেছিলে দেবীকেও।

মাথায় বাজ পড়লেও বুঝি বা পল্লব এত অবাক হতো না। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ভাদুড়ি মশায়ের দিকে। কাটা কাটা উচ্চারণে তিনি বললেন, ভাবছ কী করে আমি ধরে ফেললাম তাই তো? তোমার এই নাটকটা তোমায় ধরিয়ে দিয়েছে পল্লব। তুমি খেয়াল করোনি, এ নাটকে সেই সংলাপগুলোই আছে যা সে দিন রাতে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলে। অভিনয় না হলে প্রতিটা শব্দ কিছুতেই এক হতে পারে না। অথবা তুমি সবই জানতে কিন্তু ভেবেছিলে, আমি বুড়ো মানুষ, ছ’ মাস পরে হয়তো সব ভুলে যাব। কেন করেছিলে এই মিথ্যাচার? বলো কেন করেছিলে? ক্ষমাহীন শোনাল ভাদুড়ি মশায়ের কণ্ঠ।

কিছুক্ষণ তাঁর দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল পল্লব। তার পর ধীরে ধীরে বলল, মাই ব্যাড স্যার। সত্যি আমার মনে ছিল না এই নাটকে ওই সংলাপগুলো আছে। না হলে এ নাটক আমি অভিনয় করতে দিতাম না। আসলে এটা তিতাসের খুব প্রিয় নাটক তো তাই ওই এটাকে বেছেছিল। আর একটা কথা, আমি সে দিন মিথ্যে বলিনি স্যার।

মিথ্যে বলোনি? এখনও অস্বীকার করছ নিজের পাপ?

পাপ? হেসে উঠল পল্লব, পাপের তো প্রশ্নই ওঠে না। আর আবার বলছি, আমি সে দিন কোনও মিথ্যাচার করিনি। আমি অভিনয় করেছিলাম এটা ঠিকই কারণ আমি আপনি নই। আপনার মতো উদার নই। সত্যি সত্যি নিজেকে উৎসর্গ করার মতো বুকের পাটা আমার নেই কিন্তু ভুলে যাবেন না, শ্রী শম্ভু মিত্র বলেছেন, ‘অভিনয় হল আত্মার মধ্যে থেকে মিথ্যাভাষণ।’ এটা একটা অক্সিমোরন স্যার। যা আত্মার মধ্যে থেকে বলা হয় তা চরম সত্য আবার একই সাথে অভিনেতাকে অন্য অনেকগুলো দিক খেয়াল রাখতে হয়। এক জন অভিনেতা যখন সম্রাট শাহজাহানের চরিত্রে অভিনয় করে সে নিজেকে শাহেনশা ভাবে। না হলে সে চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলবে কেমন করে? দর্শকের কাছে চরিত্রটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে কি করে? কিন্তু আবার একই সঙ্গে তাকে মাথায় রাখতে হয়, কোন জায়গাটায় ক্ল্যাপ পাওয়ার জন্য থামতে হবে। উইংসের কোন দিক থেকে আলো খেতে হবে। সহ অভিনেতাকে ঠিক জায়গায় পরবর্তী সংলাপের খেই ধরিয়ে দিতে হবে। তাই আপনি যেমন বলতে পারেন না অভিনেতা খোদ সম্রাট শাহজাহান তেমনই বলতে পারেন না তিনি শাহজাহান নন। আপনি তো রসতত্ত্ব আমার থেকে ভাল জানেন স্যার। নিশ্চয়ই জানেন, বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থেকে বলা মুশকিল আপনি জলে না স্থলে আছেন? কারণ যে মুহূর্তে ভাবলেন আপনি স্থলে ওমনি সাগরের ঢেউ এসে আপনার পা ভিজিয়ে দিল। আবার যেই ভাবলেন আপনি জলে ওমনি জল সরে গেল পায়ের তলা থেকে। কোনটাকে আপনি মিথ্যে বলবেন স্যার? আমি সে দিন একটা ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিয়েছিলাম। ইয়েস আই রিপিট, ক্যালকুলেটিভ রিস্ক। অনেক অঙ্ক কষে নেওয়া একটা ঝুঁকি। আমার মনে হয়েছিল, দু’টো মানুষের আত্মত্যাগের ইচ্ছে একটি বলির চেয়ে ওজনে ভারী হবে। তিতাস, মিতুল বা আপনি… আমি কাউকেই হারাতে পারতাম না স্যার। আপনি চলে গেলে ক্ষতি কম কিছু হতো না। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কেন জানি না, আমার বিশ্বাস আমাকে ড্রাইভ করেছিল। বলেছিল, যদি আমি ঠিক করে অভিনয় করতে পারি তা হলে দেবীকেও বিভ্রান্ত করতে পারব। এত মানুষ যখন অভিনয়কে সত্য বলে মেনে নিয়ে হাসে, কাঁদে তখন দেবীর কেন ক্যাথারসিস হবে হবে না? তিনি আমার থেকে বেশি জানেন বলে? বেশি বোঝেন বলে? কিন্তু আমিও তো আমার ক্রাফটটা, শিল্পটা মন দিয়ে অভ্যাস করেছি স্যার। এও তো সাধনা। আমার সাধনাতেও তো ফাঁকি নেই। প্রেসিডেন্সি কলেজ আমায় ফাঁকি দিতে শেখায়নি। এ বার যদি আপনি বলেন আমি ভুল করেছি, সে ভুল আমি মাথা পেতে স্বীকার করে নেব।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল পল্লব। তার মুখ জ্বলজ্বল করছে এক জ্যোতিতে। এ জ্যোতি আর কিচ্ছু নয়, আত্মপ্রত্যয়। কনফিডেন্স। সে দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়ি মশায়। তার পর ধীরে ধীরে বললেন, আর একটা খটকা। হাতে যে ছুরি বসিয়েছিলে, সেটাও কি?

হ্যাঁ স্যার। সেটাও অভিনয় ছিল। একটু চড়া দাগের অভিনয় মাত্র। তিতাস ডাক্তার। ওর সাথে কথায় কথায় আমি জানতে পেরেছিলাম, আর্টারি কেটে না গেলে রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় না। ছুরিটা আমি কোণাকুণি বসিয়েছিলাম।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন ভাদুড়ি মশায়। পল্লব যা বলছে তা তিনি যুক্তি দিয়ে কাটতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। শেষে বলে উঠলেন, দেবীর সাথে যে ছলনা করলে, দেবী যদি তোমার ওপর কুপিতা হতেন? বা এখনও সময় চলে যায়নি, তিনি যদি কুপিতা হন?

নির্মল হাসল পল্লব। বলল, আপনি তো আছেন। বাঁচিয়ে নেবেন। আর নয়তো তখন আবার কিছু একটা বুদ্ধি খাটানো যাবে। স্যার আমি জানি, আমি আলফাল বকি বলে আপনি আমায় অন্যদের চেয়ে কম ভালবাসেন। কিন্তু আমি আপনাকে খুব ভালবাসি স্যার। মাফ করবেন, আপনার না থাকাটা আমি অ্যাফোর্ড করতে পারতাম না।

চিকচিক করছে পল্লবের চোখ। এক রাশ পাড়ভাঙা ঢেউয়ের মতো কখন যে স্নেহ এসে তাঁর চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছে বুঝতেই পারেননি ভাদুড়ি মশায়। পল্লবকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। মস্তক আঘ্রাণ করে বললেন, বেঁচে থাকো বাবা। বেঁচে থাকো। তোমার মঙ্গল হোক। তুমি আবার একবার প্রমাণ করে দিয়েছ, এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অলৌকিক হল মানুষের বুদ্ধিমত্তা, ইনটেলিজেন্স।