পর্ণশবরীর শাপ – ১

দ্রুত হাতে জামার বোতাম লাগাচ্ছিল অমিয়। এখন ভোর চারটে। আর আধ ঘণ্টার মধ্যে একটা ইনোভা হাজির হবে তার বাড়ির সামনে। কনস্টেবল তনুময় রাহা গাড়িটা চালিয়ে তাকে নিয়ে যাবে শিলিগুড়ি। ডিপার্টমেন্টের কয়েকটা জরুরি ফাইল পৌঁছে দিতে হবে সেখানে। ইদানীং এ সব কাজ মেইলেই হয় কিন্তু এই ফাইলগুলোর কিছু বিশেষত্ব আছে। তাই এসপি সাহেব নিজে অমিয়কে অনুরোধ করেছেন ফাইলগুলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ঊর্ধ্বতনের অনুরোধ আদেশের শামিল সে কথা এ ক’ বছরে ভালই বুঝেছে অমিয়। তাই দ্বিরুক্তি না করে রাজি হয়ে গেছিল সে। কিন্তু মনটা খুঁতখুঁত করছে অন্য কারণে।

গতকাল সন্ধ্যায় সুভাষ ময়দানে বসে বাদাম ভাজা খেতে খেতে মিতুলকে শিলিগুড়ি যাওয়ার খবরটা দিয়েছিল অমিয়। আঙুলে করে নুনঝাল টাকরায় ঠেকিয়ে চকাস করে শব্দ করে উঠেছিল মিতুল। তার পর অমিয়র দিকে ডাগর চোখ দু’টি তুলে বলেছিল, আমায় নিয়ে চলো।

একটা বেমক্কা বাদাম অমিয়র গলায় আটকে গেছিল দুম করে। সেটাকে কোনও রকমে ম্যানেজ করে ভিতরে ঠেলে দিয়ে চোখ বড়বড় করে অমিয় বলে উঠেছিল, পাগল না কি?

অমিয়র এই বিস্মিত অভিব্যক্তিকে হেলায় উড়িয়ে মিতুল উদাসীন ভাবে বলেছিল, এমন অবাক হওয়ায় কি আছে? মানুষে কি তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বেড়াতে যায় না?

ধাক্কাটা সামলে অমিয় বলেছিল, কিন্তু আমি তো অফিসের কাজে যাচ্ছি মিতুল। সেখানে তোমায় সাথে করে নিয়ে গেলে লোকে কী বলবে?

আগের থেকে আরও উদাসীন মিতুল, লোকের বলাবলিতে কি অত পাত্তা দিলে চলে? সারা বারাসাত জানে তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড। তাই তো ছেলে ছোকরারা আমায় বিরক্ত করার সাহস পায় না। আগে যাও দু’চার জন মেসেঞ্জারে মেসেজ করত, ইদানীং তো সে সবও বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য আমার ভালই হয়েছে। যাক সে কথা, এসপি সাহেব তো তোমায় ভালবাসেন। তাঁকে বলো, তুমি আমায় নিয়ে যাবে। এমনিতেও তো আজ গিয়ে আজ ফিরতে না। রাত্তিরটা একসাথে হোটেলে থেকে যাব। পর দিন ফিরে আসব।

এ বার আর বিষম খাওয়াটা আটকাতে পারেনি অমিয়। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে, জল খাইয়ে, পিঠে হাত বুলিয়ে মিতুলই সামলেছিল ব্যাপারটা। তার পর অমিয় একটু ধাতস্থ হতে সরু চোখে তাকিয়ে বলেছিল, দেখতেই হাট্টাকাট্টা। আসলে তো ভিতুর ডিম। আমার চব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেছে। আমি আর বাচ্চা নই হ্যাঁ?

বলে, দুমদুম করে পা ফেলে এগিয়ে গেছিল মিতুল। অমিয় ছুটেছিল পেছনে, এই মিতুল, শোনো। দাঁড়াও।

ঘুরে তাকিয়েছিল মিতুল। একটা আঙুল সোজা অমিয়র দিকে তুলে হুমকি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, খবরদার পিছুপিছু আসবি না। যা তুই। ভিতু ছেলে আমার একদম ভাল্লাগে না।

তার পর মিতুল যে মুখ ফিরিয়ে ফিক করে হেসে নিয়েছিল সেটা অমিয় দেখতে পায়নি তাই মিতুল চলে যাওয়ার পরে ওখানেই কিছুক্ষণ লাতন হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে। মিতুল তাকে তুইতোকারি করল! তার চেয়েও বড় কথা তার পৌরুষ নিয়ে খোঁটা দিল! মিতুল তো এমন ছিল না আগে। এ সব তিতাসের সঙ্গে মেশার ফল। ওই মাথাটা খাচ্ছে মিতুলের। কিন্তু তিতাসের সাথে বাওয়াল দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। আর এখন তো দেখতে পাচ্ছে মিতুলও তাকে এ পাশ ও পাশ ধুয়ে দিচ্ছে! নিজেকে ভারী অসহায় লাগছিল অমিয়র। বুলেটটাকে মনে হচ্ছিল সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল।

কাল রাত থেকে মিতুলের সাথে আর কথা হয়নি। মিতুল তার ফোন ধরেনি এবং মেসেজেরও রিপ্লাই করেনি। অমিয় চেয়েছিল, ঝামেলাটা মিটিয়ে তার পর যেতে কিন্তু উপায় নেই। যা করার ফিরে এসেই করতে হবে। কয়েকটা দরকারি জিনিস ট্রলিতে ঢুকিয়ে নিচ্ছিল অমিয়, এমন সময় কানে এল গাড়ির হর্ন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হল অমিয়। চারটে কুড়ি বাজে। সময়ের আগে ডিপার্টমেন্টের গাড়ি এসে হাজির! এ তো ভাবাই যাচ্ছে না। বলতে না বলতেই ফের দু’বার হর্ন। বাপরে বাপ! ডিসিপ্লিনের একেবারে হদ্দমুদ্দ। তনুময়ের এই কীর্তি জানতে পারলে বেঙ্গল পুলিশ ব্যারাকপুরে ওর মূর্তিও বসিয়ে দিতে পারে। ট্রলিটা নিয়ে নীচে নেমে এল অমিয় কিন্তু ভারী অবাক হল গাড়িটাকে দেখে! বেদে যেমন সাপের হাঁচি চেনে, তেমনই গাড়ি দেখে তার ঠিকুজি কুষ্ঠি বলে দিতে পারে অমিয়। আসার কথা ছিল একটা সাদা ইনোভার। তার বদলে এসে হাজির হয়েছে একটা নতুন ঝকঝকে লাল কালোয় মেশানো মাহিন্দ্রা থার! অমিয়র বুকের ভিতরটা গুরগুর করে উঠল। এমন একটা জিপ গাড়ি তার চিরকালের স্বপ্ন। ডিপার্টমেন্ট আজকাল এমপ্লয়ির ব্যক্তিগত পছন্দের দিকেও খেয়াল রাখছে না কি? মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল অমিয়, গাড়িটা সে নিজে চালাবে। ছাব্বিশশো সিসির গাড়ি, হাইওয়েতে পড়লে জাস্ট উড়ে বেরিয়ে যাবে। দ্রুত ড্রাইভিং সিটের দিকে এগিয়ে গেল অমিয় কিন্তু তাকে অবাক করে দরজা খুলে নেমে এল পল্লব। হাঁ করে খানিকটা বাতাস গিলে ফেলল অমিয় তার পর গলাটলা ঝেড়ে বলল, তুই এখন? আর এ গাড়িটা কার?

খুব কায়দার একটা হাসি দিল পল্লব, যারই হোক, আপাতত আমি চালাচ্ছি এটাই বড় কথা। বাই দ্য ওয়ে, উঠে পড়।

আকাশ থেকে পড়ল অমিয়, উঠে পড় মানে?

উঠে পড় মানে উঠে পড়। তুই তো শিলিগুড়ি যাবি? আমরাও ও দিকেই যাচ্ছি। তোকে নামিয়ে দেব।

তেরিয়া হয়ে উঠল অমিয়, ইয়ার্কি হচ্ছে না কি? আমি কি আনোয়ার শাহ যাব যে লর্ডসের মোড় যাওয়ার পথে আমায় নামিয়ে দিবি? আর আমি শিলিগুড়ি যাচ্ছি তোকে কে বলল?

ওকে বলেনি, আমায় বলেছে। মিতুল, বলতে বলতে গাড়ি থেকে নেমে এল তিতাস। সে দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল অমিয়। কী বলা উচিত বুঝে উঠতে পারল না। তিতাস ফের বলল, কী হল? অমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন? সত্যি আমরা ও দিকেই যাচ্ছি। তোকে নামিয়ে দেব।

ও দিকে যাচ্ছিস মানে? কোথায় যাচ্ছিস? নিজের গলাটাকে কেমন যেন বোকাবোকা লাগল অমিয়র।

তিতাস হেসে বলল, আমরা যাচ্ছি দার্জিলিং। মিতুল কাল ফোন করে বলল, তুই না কি ওকে ঘুরতে নিয়ে যেতে চাস না। আমি তখন বললাম, অমিয় নিয়ে যেতে চায় না তো কুছ পরোয়া নেহি। আমি আর পল্লব তো আছি। আমরা তোকে নিয়ে যাব। তাই জন্য আজ একদম ভোরভোর বেরিয়ে পড়েছি। মিতুলকে ওর বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছি, তার পর ভাবলাম তোকেও ড্রপ করে দিই। হাজার হোক তুই বন্ধু মানুষ।

বহুকাল এত অবাক হয়নি অমিয়। সে দেখল, গাড়ির পেছনের জানলা খুলে উঁকি দিচ্ছে মিতুলের দুষ্টুমি ভরা মুখ। চোখ দু’টো ঝিকিয়ে উঠছে কৌতুকে। সে দৃষ্টির একটাই অর্থ হয়, ‘আমি আর বাচ্চা নই হ্যাঁ?’

. . .

এত দিনের লেগাসি অক্ষুণ্ণ রেখে নির্ধারিত সময়ের পঞ্চাশ মিনিট পর মানে পাঁচটা পনেরোয় ঘুমজড়ানো গলায় ফোন করল কনস্টেবল তনুময় রাহা। বলল, স্যার, আপনার বাড়ির নীচে চলে এসেছি।

অমিয় বলল, ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। আমি চাকদা ক্রস করে এসেছি। ধন্যবাদ।

ফোনটা কেটে ড্যাসবোর্ডের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। ভোরের হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার চুল। স্টিরিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিল তিতাস। একটা দরাজ গলা গেয়ে উঠল, ‘দিল তো আখির দিল হ্যায় না/মিঠি সি মুশকিল হ্যায় না/পিয়া পিয়া পিয়া না পিয়া/জিয়া জিয়া জিয়া না জিয়া…’

কিছু কিছু গান তৈরিই হয়েছে লং ড্রাইভের জন্য।

পল্লব বলেছিল, চুপ কর। তুই বিরাট ছ’ফুটিয়া বুলেটবাজ হতে পারিস কিন্তু গাড়িটা আমি তোর থেকে ভাল চালাই।

অমিয় বলেছিল, সে অনেক দিন ধরে চালাচ্ছিস বলে। রেগুলার চালাচ্ছিস বলে। আমি যদি রেগুলার চালাতাম

আরে রাখ রাখ। কী হলে কী হতো ও সব কথার কোনও ভ্যালু নেই। আমি নিয়ে যাচ্ছি চুপ করে বোস।

বাইপাসে গাড়ি চালানো আর পাহাড়ে গাড়ি চালানোর ডিফারেন্স আছে। আমার পাহাড়ি রাস্তায় চালানোর ট্রেনিং আছে হ্যাঁ?

ও রে আমার তেনজিং নোরগে।

বোঝাই যাচ্ছে কে গাড়ি চালাবে তাই নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছিল। শেষপর্যন্ত মধ্যস্থতা করেছিল তিতাস। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, দার্জিলিং থেকে সোনাদা অবধি চালাবে অমিয় আর সোনাদা থেকে চটকপুর অবধি পল্লব।

গাড়ি রওনা দিয়েছিল। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পল্লব গুনগুন করে গান গাইছিল, ‘টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে/আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে/যখনতখন পৌঁছে যাওয়া যায়’, আর মাঝে মাঝে অমিয়কে জ্ঞান দিচ্ছিল, আরে ডাউনওয়ার্ডস যাচ্ছিস থার্ড গিয়ারে? ব্রেক পুড়ে যাবে তো! নাহ আজ আর যাওয়া হল না।

অমিয় উত্তর দেয়নি এবং ব্রেকও পোড়েনি। নির্বিঘ্নেই সোনাদা অবধি পৌঁছে গেছিল ওরা। ড্রাইভারের সিট পল্লবকে ছেড়ে নেমে এসেছিল অমিয়। অমিতাভ বচ্চনের মতো রাজকীয় ভঙ্গিতে স্টিয়ারিং ধরেছিল পল্লব এবং প্রথম বাঁক ঘুরতে না ঘুরতেই একটা পাথুরে গাড্ডায় ফেলে পেছনের চাকার অ্যাক্সেল বেঁকিয়ে দিয়েছিল।

সোনাদা থেকে মেকানিক ধরে আনতে হয়েছে এবং এখন গাড়ি মেরামতি চলছে। অমিয়রা তিন জন দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে আর কিছুটা দূরে একটা উঁচু পাথরের ওপর বসে উদাস মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পল্লব। সে নানা যুক্তি দিতে গেছিল কিন্তু কেউ তার সে যুক্তিতে কর্ণপাত করেনি এবং তাকে নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি করেছে। তার পর থেকেই পল্লবের মধ্যে এই বৈরাগ্য দেখা দিয়েছে।

তিতাস বলল, এর পরে আর নেটওয়ার্ক পাব না। বাড়িতে একটা ফোন করে দিই বুঝলি?

ফোন হাতে তিতাস একটু এগিয়ে যেতেই অমিয়র দিকে তাকাল মিতুল। অমিয় একটা চামড়ার জ্যাকেট পরে আছে। গতকাল দার্জিলিং-এর মহাকাল মার্কেট থেকে অমিয়র জন্য গরম জামা কেনা হয়েছে। অমিয় তো শিলিগুড়ি যাবে বলে প্যাকিং করেছিল। ফলে তার কাছে গরম জামাকাপড় কিছুই ছিল না। এই সময় চটকপুরে বেজায় ঠান্ডা পড়ে। তাই তিতাসই ওদের নিয়ে বেরিয়েছিল শপিং করতে। এই জ্যাকেটটা মিতুল কিনে দিয়েছে অমিয়কে। পল্লবদাদা আর তিতাসদিদিকেও একটা করে সুন্দর সোয়েটার কিনে দিয়েছে সে। পল্লবদাদাটা পাগল। ম্যালে প্রায় যত লোক ছিল সব্বাইকে ডেকে ডেকে বলেছে, ইয়ে দেখিয়ে, ইয়ে সোয়েটার মেরা বোন মতলব বহিন খরিদকে দিয়া। গিফট গিফট।

মিতুল জানে অমিয় খুব খুশি হয়েছে জ্যাকেটটা পেয়ে কিন্তু মুখে প্রকাশ করছে না। মিতুল অবশ্য এই গাম্ভীর্যের কারণটা বুঝে গেছে। শিলিগুড়িতে অমিয়র কাজ মেটার পর দার্জিলিংয়ে পৌঁছে ওরা গিয়ে উঠেছিল তিতাসের চেনা হোটেলে। তিতাস আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিল, ওরা চার জন আসবে। রিসেপশনে দাঁড়িয়ে দু’টো ঘরের বুকিং চেয়েছিল তিতাস। হাঁ হাঁ করে উঠেছিল মিতুল, কেন কেন দু’টো ঘর কী হবে?

তিতাস অবাক হয়ে বলেছিল, দু’টো ঘরই তো লাগবে। একটায় আমি আর পল্লব থাকব। আর একটায় তুই তোর বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে থাকবি।

ঘাড় গোঁজ করে মিতুল বলেছিল, না।

না মানে?

হয় একটা ডর্ম নাও। সবাই একসাথে থাকব নয়তো আমি তোমার সাথে থাকব। ও আর পল্লবদাদা এক ঘরে থাকুক।

তিতাস কিছু বলতে যাওয়ার আগে পল্লব বলে উঠেছিল, আই হ্যাভ নো ইস্যু। বারো বছর পরে আমার কাছে তিতাসও যা অমিয়ও তাই। ভাই ভাই।

পল্লবের বোকামিতে বিরক্ত হয়েছিল তিতাস। ধমকে উঠেছিল, সব ব্যাপারে কথা বলিস কেন তুই? দু’টো ঘরই নেওয়া হবে আর তুই চুপচাপ বাধ্য ছেলের মতো আমার সঙ্গে থাকবি।

অমিয় মিনমিন করে বলেছিল, না না আমি আর পল্লবই তো ঠিক আছি।

ফের কিছু বলতে যাচ্ছিল তিতাস তার আগেই তার হাত দু’টো চেপে ধরেছিল মিতুল। কাতর গলায় বলেছিল, প্লিজ, একটু বোঝো।

এর পর মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে পল্লবের পিছু পিছু একটা ঘরে ঢুকে গেছিল অমিয়। সেই থেকেই গম্ভীর হয়ে আছে সে। মিতুলের সঙ্গে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না।

পল্লব এখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে। কিছুটা দূরে তিতাস ফোনে কথা বলছে। অমিয়র জ্যাকেটের হাতা ধরে আলতো টান দিল মিতুল। ঘুরে তাকাল অমিয়। তার মুখ দেখে ফিক করে হেসে ফেলল মিতুল। বলল, কী হয়েছে? মুখটা অমন প্যাঁচার মতো করে আছ কেন?

গলাটাকে যথাসম্ভব ব্যারিটোনে রেখে অমিয় বলল, সেটা তোমায় না ভাবলেও চলবে।

ফের হাসল মিতুল, তাই বুঝি? ভাবার আরও লোক আছে তা হলে?

এ বার মিতুলের চোখে চোখ রেখে তাকাল অমিয়, একদম বাজে কথা বলবে না। তোমার মাথার ঠিক নেই।

যাহ বাবা! আমি কী করলাম?

এত হুজ্জুত করে আমাকে নিয়ে এলে তার পর তিতাস যখন দু’টো ঘর বুক করতে চাইল তখন বাগড়া দিলে কেন?

কয়েক মুহূর্ত অমিয়র দিকে হাসিমাখা চোখে তাকিয়ে রইল মিতুল। তার পর আচমকা অমিয়র নাকটা নেড়ে দিয়ে বলল, অত খায় না রে হেংলুরাম। চটকপুরে গিয়েও তিতাসদিদির সাথেই থাকব।

প্রচণ্ড ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অমিয় আর হাসতে হাসতে মিতুল এগিয়ে গেল তিতাসের কাছে। মনে মনে শিউরে উঠল অমিয়, এ মেয়ের গতিক সুবিধের ঠেকছে না। নির্ঘাৎ তিতাসের পাল্লায় পড়ে শক্তি, সুনীল, ভাস্কর চক্কোত্তি পড়া শুরু করেছে। কবিগুলো মহা বদ। শুধু বদ না, খচ্চর। বাচ্চা মেয়েদের না পাকিয়ে এদের শান্তি নেই। মিতুলের ওপর খুব রাগ হতে শুরু করল অমিয়র কিন্তু রাগের ফাঁক দিয়ে অন্য একটা অনুভূতি আচমকাই আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে। আশ্চর্য হয়ে অমিয় অনুভব করল, মিতুলের রহস্যময়তা এই ঠান্ডার দেশেও তাকে উষ্ণ করে তুলছে ভেতরে ভেতরে। প্যান্টের জিপারটা বেশ আঁট হয়ে উঠেছে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেল অমিয়।

. . .

গাড়িটা যখন ঠিক হল ততক্ষণে সূর্য হেলে পড়েছে। সাড়ে চারটে বাজছে। অমিয় বলেছিল, আমার মনে হয় আমাদের সোনাদাতেই কোথাও থেকে যাওয়া উচিত। এখান থেকে চটকপুর পৌঁছতে ঘণ্টা দু’-আড়াই তো লাগবেই। রাতের বেলা এই রাস্তায় গাড়ি চালানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

তিতাস বলেছিল, আমারও তাই মনে হয়। এক দিন হোমস্টের টাকা নষ্ট হবে। সে হোক। কাল সকালেই যাব। আমাদের তো ফেরার তাড়া নেই।

কিন্তু বেঁকে বসেছিল পল্লব। বাচ্চাদের মতো জেদ করতে শুরু করেছিল, হয় সে এখনই যাবে নয়তো আর যাবেই না। ওরা ঘুরলে ঘুরুক, কাল সকালে শিলিগুড়ি থেকে বাস ধরে সে ফিরে যাবে কলকাতা।

নরমে গরমে তিতাস বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। তিতাস বুঝেছিল, গাড়ি চালানো নিয়ে প্যাঁক দেওয়ায় পল্লবের তার কেটে গেছে আর তারকাটা পল্লব ষাঁড়ের মতো জেদি, শরৎবাবুর গল্পের নায়িকার মতো অভিমানী এবং গাধার চেয়েও বুদ্ধিহীন। অগত্যা গাড়ি উঠতে শুরু করেছিল এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা ধরে।

পাহাড়ের বুকে সন্ধে নামে ঝুপ করে। তাই মিনিট পনেরো গাড়ি চলতে না চলতেই আঁধার ঘনিয়ে এসেছিল প্রাচীন সব মহাবৃক্ষের পাতার ভাঁজে ভাঁজে। কেউ যেন মিহি রেশমি চাদরের মতো করে বিছিয়ে দিচ্ছিল কুয়াশা। ঝিঁঝিঁর ডাকের সাথে পাল্লা দিয়ে সে কুয়াশা ঘনতর হয়ে উঠছিল ক্রমশ। তাকে ভেদ করে দিশা দেখাতে দম বেরিয়ে যাচ্ছিল হেডলাইটের। ফগলাইটগুলোও জ্বালিয়ে দিয়েছিল পল্লব কিন্তু তাতেও বিশেষ সুবিধে হচ্ছিল না। তিতাস বেশ বুঝতে পারছিল, ভারী মাইনাস পাওয়ারের চশমা চোখে নিয়ে এই রাস্তায় গাড়ি চালাতে পল্লবের প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। সে বলে উঠেছিল, অনেক বাহাদুরি হয়েছে। অমিয়কে চালাতে দে।

কথা বাড়ায়নি পল্লব। চুপচাপ নেমে এসেছিল ড্রাইভিং সিট থেকে। ফের যেন অনির্দেশ্যের দিকে চলতে শুরু করেছিল গাড়িটা। সবাই চুপ করে বসেছিল। কেউ কোনও কথা বলছিল না। সিগারেট খাওয়ারও উপায় নেই। কাচ নামালেই হাড় জমিয়ে দিচ্ছে ঠান্ডা। গোটা পাহাড়টাই কেমন যেন জবুথবু হয়ে গেছে হঠাৎ করে। ঘণ্টা দু’য়েক এ ভাবেই চলল কিন্তু একটা চড়াইতে ওঠার পর ওরা যা দেখল তাতে ওদের সব্বার মন ভাল হয়ে গেল একসাথে। এতক্ষণ গোমড়া হয়ে থাকা পল্লবও বলে উঠল, ওহ মাই গড!

জঙ্গলের মধ্যে একটা ছড়ানো জায়গা। একটা রাস্তা চলে গেছে সোজা আর একটা বাঁ দিকে। ঠিক এই জায়গাটাতে এসেই যেন কেউ এক টানে ছিঁড়ে দিয়েছে কুয়াশার একঘেয়ে চাদর। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। বাঁ দিকের জঙ্গল ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে তাই দৃষ্টিসীমা উন্মুক্ত হয়েছে দিগন্তে। সেখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। চাঁদের আলো পিছলে যাচ্ছে তার মোমের শরীরে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওরা চার জন নেমে এল গাড়ি থেকে। এ দৃশ্য পৃথিবীর নয়। এমন দৃশ্যকে বর্ণনা করার জন্যই অপার্থিব শব্দটির জন্ম হয়েছে। বিভোর হয়ে নগাধিরাজ হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। এই অসহ্য সৌন্দর্য কেমন যেন ঘোর লাগিয়ে দিল ওদের চোখে। মায়াকাজল পরিয়ে দিল আঁখিপল্লবে। হারিয়ে গেল সময়জ্ঞান। তাই ওরা কেউ খেয়াল করল না, জঙ্গলের সমস্ত শব্দ কমে আসছে ধীরে ধীরে। যেন কারও আগমনের ইঙ্গিতে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে এই আদিম অভয়ারণ্য। গাছের পাতাগুলি যেন ফিসফিস করে বলছে, চুপ! চুপ! সে আসছে। সে মোটে কোলাহল পছন্দ করে না। সে আসছে। সে আসছে চুপ! চুপ!

তার পর আচমকাই সম্পূর্ণ শব্দহীন হয়ে গেল বিস্তীর্ণ অরণ্যবনানী।

সৌন্দর্যের একটা অমোঘ আগ্রাসন রয়েছে। সেই টানেই ওরা যে আরও কতক্ষণ ওখানেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকত তার ঠিক নেই, কিন্তু ওদের সাড় ফিরে এল একটা আচম্বিত চিৎকারে। সেই নিস্তব্ধ পাহাড়ি জঙ্গলে চিৎকারটি এতটাই বিসদৃশ ও অসঙ্গতিপূর্ণ যে প্রথমটায় ওদের কানে তালা ধরে গেল আর পরমুহূর্তে একসাথে চমকে উঠল ওরা। মিতুল তো ভয় পেয়ে তিতাসের হাত খামচে ধরল। ঘুরে তাকিয়ে ওরা অবাক হয়ে গেল। এক পাহাড়ি যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছুটা দূরেই। তার জামাকাপড় শতছিন্ন এবং ময়লা। গালে অনেক দিনের না কামানো দাড়ি। মাথার চুলে জট পড়েছে অবহেলায়। সবচেয়ে আশ্চর্যের তার চোখ দু’টি। সে দৃষ্টিতে যেন এসে ভিড় করেছে সারা পৃথিবীর ভয়। সেই হাত নেড়ে নেড়ে চিৎকার করছে, ভাগো, ভাগো। জান পেয়ারি তো জলদি ভাগো। ও আ রহি হ্যায়। ও আ রহি হ্যায়।

বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে অমিয় জিজ্ঞেস করল, কৌন হ্যায় আপ?

উত্তর দিল না যুবকটি। বিড়বিড় করে একটাই কথা বলতে লাগল, ভাগো ভাগো। ও আ রহি হ্যায়। তার পর এ দিক ও দিক তাকিয়ে কিছু যেন শোঁকার চেষ্টা করল। কিছুর একটা গন্ধ পেয়েছে সে। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা চোখ দু’টি বিস্ফারিত হয়ে গেল এবং প্রাণভয়ে ভীত একটা খরগোশ বাচ্চার মতোই দৌড়ে মিলিয়ে গেল জঙ্গলের বাঁকে। যেমন অতর্কিতে এসেছিল তেমন ভাবেই চলে গেল সে। কিন্তু ফেলে রেখে গেল একটা গা শিরশিরে অনুভূতি, অভূতপূর্ব এই সৌন্দর্যের মধ্যে বেশ কিছুটা ভীতিউদ্রেককারী অস্বস্তি। তখনই কাঞ্চনজঙ্ঘার মাখনরঙা চুড়োটাও ঢেকে দিল বেশ বড় এক খণ্ড কালো মেঘ। তিতাসের হাতটা শক্ত করে ধরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় মিতুল বলে উঠল, কে ও? আর কার আসার কথা বলছে? কে আসছে?

মিতুলকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল তিতাস, তবু নিজের গলাটাই বড্ড নড়বড়ে শোনাল তার কাছে, কে আবার আসবে? আমার তো মনে হয় ওনার মাথা খারাপ। না রে পল্লব?

পল্লবও একটু থমকে গেছে। থেমে থেমেই বলল, তাই তো মনে হয়। না, এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা আর ঠিক নয়। চল এগোই। চারদিকটা হঠাৎ কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করেছিস?

গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল অমিয়, হুম। দিস ইজ ভেরি আনইউজুয়াল। জঙ্গল ভীষণ লাইভলি একটা এনটিটি কিন্তু পার্টিকুলার এই জায়গাটায় যেন কোনও প্রাণ নেই। কমপ্লিট লাইফলেস। যখন এসেছিলাম তখনও কিন্তু এমন ছিল না।

পল্লব বলল, হ্যাঁ সেই জন্যই তো বলছি চল। কেন জানি না মনে হচ্ছে সামথিং ইজ হ্যাপেনিং। কিছু একটা ঘটছে আমাদের অগোচরে।

এই বলে পল্লব গাড়ির দিকে এগোতেই অমিয় বলে উঠল, দাঁড়া পল্লব। একটা গ্লিচ আছে। মনে হচ্ছে রাস্তা হারিয়েছি।

চমকে উঠল বাকিরা। কিন্তু কেউ কিছু বলার আগেই অমিয় দু’হাত তুলে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, সরি সরি, মাই ব্যাড। রাস্তা হারাইনি। গুলিয়েছি। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আসলে আমার যতদূর মনে আছে, এখান থেকে একটা রাস্তা যায় লেকের দিকে আর একটা রাস্তা চটকপুর। এখানে কোন রাস্তাটা আমি ডিসাইড করতে পারছি না। চল পল্লব, চট করে একটু এগিয়ে দেখে আসি। একটু গেলেই আমি বুঝে যাব।

প্রায় আর্তনাদ করে উঠল মিতুল, গিয়ে দেখে আসবে মানে?

অমিয় এগিয়ে এল মিতুলের কাছে। কাঁধে হাত রেখে বলল, ভয় পেয়ো না মিতুল। ওই পাগলাটে লোকটা এসে আমাদের কনফিডেন্সে হালকা চিড় ধরিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু ও সব কিচ্ছু না। কী সুন্দর চাঁদের আলো আছে। জাস্ট এই একটু ওপরে গেলেই আমি বুঝে যাব কোনটা ঠিক রাস্তা। তুমি আর তিতাস দাঁড়াও। আমরা যাব আর আসব। গাড়ির ইঞ্জিন, হেডলাইট সব অন করে যাচ্ছি। এই আওয়াজে কোনও বন্য জন্তুও কাছে আসবে না। নাথিং টু ওরি। পল্লব, কাম অন, রাস্তার পাশের একটা গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে নিল অমিয়। হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে।

পল্লবের মোটেই এই মুহূর্তে ভাস্কো ডা গামা হতে ইচ্ছে করছিল না। সে বলল, গাড়িটা নিয়েই চল না। হেঁটে যাওয়ার কী দরকার?

অমিয় বলল, আরে বোকাটা! এখানে সরু রাস্তা, গিয়ে যদি দেখি ভুল রাস্তায় এসেছি, গাড়ি ঘোরাতে পারব না। প্রমিস, বেশি হাঁটাব না। একটু গেলেই আমি বুঝতে পারব।

শিওর?

শিওর।

চল তবে, ব্যাজার মুখে হাঁটা দিল পল্লব।

ওরা দু’জন চলে যেতেই জায়গাটা যেন আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। শব্দ বলতে শুধু গাড়ির ইঞ্জিনটা গরগর করছে। তিতাস বলল, বাইরে ঠান্ডা লাগছে। আয় মিতুল, ভিতরে গিয়ে বসি।

গাড়ির দরজাটা খুলতে গিয়েই থমকে গেল তিতাস। এক ঝলক তীব্র সুগন্ধ এসে ঝাপটা মারল নাকে। চমকে ফিরে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল মিতুলও গন্ধটা পেয়েছে। বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেছে তার দুই চোখ। সে বলল, কী সুন্দর গন্ধ দেখেছ তিতাসদিদি?

সত্যিই এ সুগন্ধের চরিত্র মনোমুগ্ধকর। তীব্র অথচ মাথা ধরিয়ে দেয় না। অদ্ভুত একটা বন্য ছন্দ যেন লুকিয়ে আছে এই গন্ধের পরতে পরতে। তিতাস বলল, কোত্থেকে আসছে বল দেখি গন্ধটা?

মিতুল বলল, বুঝতে পারছি না। তবে খুব কাছ থেকেই আসছে।

হুম। মনে হচ্ছে যেন অনেক ফুল একসঙ্গে ফুটেছে! এতক্ষণ তো ছিল না গন্ধটা!

সেটাই তো! এমন হঠাৎ করে ফুল ফোটে না কি?

তিতাস হেসে বলল, ফুটতেই পারে। বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানো হোরাশিও? জানিস তো মিতুল, ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি জ্যোৎস্না রাতে না কি নানা অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড হয়। মনে হচ্ছে এখানেও তেমন কিছু হচ্ছে। আয় তো দেখি, গন্ধটা আসছে কোত্থেকে?

বেশ ঘাবড়ে গেল মিতুল, থাক না তিতাসদিদি। কী দরকার?

আরে বোকা, শুধু দরকার দিয়ে দুনিয়া চললে তো মিটেই যেত। আয় আয়। কিচ্ছু হবে না। অমিয় ঠিক বলেছে। ওই মাথাপাগলা লোকটা আচমকা এসে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। এখন আবার আমার কনফিডেন্স ফিরে এসেছে। ওরা ফিরতে ফিরতে আমরা দেখে চলে আসব। এই চাঁদের আলোয়, পাহাড়ের বুকে তুই আর আমি যদি একটা নতুন অর্কিড আবিষ্কার করে ফেলি কেমন দুর্দান্ত ব্যাপার হবে ভাবতে পারছিস?, অনিচ্ছুক মিতুলের হাত ধরে সুগন্ধের উৎস সন্ধানে হাঁটা লাগাল তিতাস।

কিছুটা গিয়েই কিন্তু মিতুলের বেশ ভাল লাগতে শুরু করল। গন্ধটার মধ্যে একটা নেশা নেশা ব্যাপার আছে। মনে হয়, গন্ধটা কেমন যেন আদর হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শরীর জুড়ে।

চাঁদের আলোয় এত তেজ হয় মিতুলের জানা ছিল না। সব যেন একেবারে ঝকঝক করছে। কে বলবে একটু আগে কুয়াশায় দু’হাত দূরের জিনিসও ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না? কিন্তু কিছুটা গিয়েই ওরা বুঝতে পারল, গন্ধটা কোনও একটা বিশেষ জায়গা থেকে আসছে না। যেন চারপাশে বাতাসের মধ্যে থেকেই এই গন্ধের জন্ম হচ্ছে। নয়তো সারাক্ষণ গন্ধটা এমন করে ঘিরে থাকছে কী ভাবে? হতাশ হয়ে ফিরে আসতে যাবে তখনই মিতুলের চোখ আটকে গেল একটা পাথুরে দেওয়ালে। বাকি আর কিছুর থেকে এই দেওয়ালটা যেন অতিরিক্ত চকচক করছে! দেওয়ালটা শ্যাওলায় ঢাকা কিন্তু একটা জায়গায় ত্রিভুজাকৃতি একটা খাঁজ তৈরি হয়েছে। অনেকটা যেমন পুরোনো দিনের বাড়িতে কুলুঙ্গি থাকত, তেমন। তিতাসের হাত ধরে টানল মিতুল, দেখো তিতাসদিদি।

মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ত্রিকোণ খাঁজটার দিকে এগিয়ে গেল তিতাস। ভাল করে দেখে বলল, মনে হচ্ছে এখানে কোনও একটা মূর্তি খোদাই করা আছে কিন্তু শ্যাওলায় ঢেকে গেছে সবটা। তোর কাছে রুমাল আছে মিতুল?

রুমালটা তিতাসের হাতে না দিয়ে মিতুল নিজেই ঘষে ঘষে শ্যাওলা তুলতে শুরু করল। ওরা কেউ জানতেও পারল না তখনই অনতিদূরেই জঙ্গলের গভীরে পাতায় পাতায় জাগল তীব্র এক আলোড়ন। অমঙ্গলের আশঙ্কায় সঙ্কুচিত হয়ে উঠল পক্ষীকুল। তীব্র ভয়ে কন্দরে গিয়ে লুকোল বন্যজন্তুরা আর সেই মুহূর্তে বিশাল এক মহাবৃক্ষের বুক চিরে বেরিয়ে এল এক আলোকিত নারীর অবয়ব। আর এ দিকেও সেই সময় রুমাল দিয়ে সমস্ত শ্যাওলা ঘষে তুলে ফেলল মিতুল। ওরা অবাক হয়ে দেখল, পাথরের গায়ে খোদিত এক দেবীমূর্তি যা ওদের সম্পূর্ণ অচেনা। তিতাস হয়তো আরও একটু মন দিয়ে দেখতে চাইছিল কিন্তু দূর থেকে ভেসে এল পল্লব আর অমিয়র উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, তিতাস, মিতুল… কোথায় তোরা? মিতুল… তিতাস…

সময় নষ্ট না করে ওরা দ্রুত এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। মিতুল ফেলে রেখে গেল তার শ্যাওলায় নোংরা হয়ে যাওয়া রুমালটি।

. . .

সাড়ে সাতটা নাগাদ ওরা এসে পৌঁছল চটকপুরের হোমস্টে-তে। এ বারও সেই এক ব্যবস্থা। একটা ঘরে তিতাস আর মিতুল। অন্য ঘরে অমিয় আর পল্লব। অমিয়র দিকে একটা চোরা চাহনি দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল মিতুল। জুতো-মোজা ছেড়ে মিতুলই আগে ফ্রেশ হয়ে নিল। তার পর তিতাস ঢুকল বাথরুমে। মিতুল ভাবল, তিতাসদিদি বেরতে বেরতে আনপ্যাক করে নেওয়া যাক। কিন্তু চেয়ারের ওপর ট্রলিটা তুলে ঢাকনাটা খুলতেই ভয়ে, বিস্ময়ে জমে পাথর হয়ে গেল সে। চোখ দু’টো অবিশ্বাসে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল বাইরের দিকে। ফুলে উঠল নাকের পাটা। হৃদপিণ্ডটা যেন আটকে গেল গলার কাছে। ট্রলির মধ্যে সে যা দেখছে তা অসম্ভব, অবাস্তব। না না, এ কী করে হতে পারে?

ট্রলির ভিতর সমস্ত জামাকাপড়ের ওপরে নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে শ্যাওলা মাখা একটি রুমাল। মিতুল একশো শতাংশ নিশ্চিত, এই রুমালটিই সে কিছুক্ষণ আগে ফেলে এসেছে সেই ত্রিকোণ খাঁজের নীচে।

ঝাল ঝাল দিশি মুরগির ঝোল আর হাতেগড়া গরম রুটির মতো উপাদেয় খাদ্য খুব কমই আছে পৃথিবীতে। বাকিরা সবাই খুব তৃপ্তি করে খেলেও মিতুল কিন্তু একফোঁটা স্বাদ পাচ্ছিল না। অস্থির এক আশঙ্কা যেন তার সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলোকেই ভোঁতা করে দিয়েছে। মিতুল কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না, ফেলে দেওয়া রুমালটা কী ভাবে চলে এল তার ট্রলির মধ্যে? তবে কি কোনও বিপদ হতে চলেছে? কিন্তু এই আশঙ্কার কথা সে কাউকে বলেনি। এমনকী তিতাসদিদিকেও না। সে চায় না, সবার বেড়ানোটা মাটি হয়ে যাক।

কী রে মিতুল? মুরগিটার জন্য মন খারাপ করছে? পল্লবের কথায় চমকে তাকাল মিতুল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কই না তো।

তা হলে অমন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিস কেন? রান্না তো দিব্যি হয়েছে।

উৎকণ্ঠিত হয়ে তিতাস বলল, কী হয়েছে? খেতে ইচ্ছে করছে না? শরীর খারাপ লাগছে?

অমিয় বলল, ওর বোধ হয় গন্ধ লাগছে বুঝলি? মাটন, দিশি মুরগি এগুলো ঠিক ও খেতে পারে না। একটা ডিম ভেজে দিতে বলব?

সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে দেখে ভারী লজ্জা পেল মিতুল। জোর করে রুমালের ভাবনাটা দূর করে খাওয়াতে মন দিল সে। ভাদুড়িদাদু একটা কথা খুব বলেন। তিনি বলেন, ‘যেটা তোমার কন্ট্রোলের বাইরে সেটা নিয়ে ভেবে মাথা খারাপ কোরো না। যখন যেটা হবে দেখা যাবে। অবস্থা বুঝে পরিস্থিতির সাথে লড়াই করতে হবে।’ আপাতত সেটা ভেবেই নিজেকে শক্ত করল মিতুল।

খাওয়া শেষ করেই যে যার কম্বলের তলায় ঢুকে গিয়েছিল ওরা। সেই ভোর তিনটে থেকে দৌড়াদৌড়ি চলছে। এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম হয়নি। ঘুম জড়িয়ে আসছিল ওদের সকলেরই চোখের পাতায়। কম্বল মুড়ি দিয়ে তিতাসদিদির সঙ্গে দু’চারটে কথা বলতে বলতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মিতুল খেয়াল করেনি। ঘুম ভাঙল যখন, তখন অনেক রাত। বালিশের পাশে রাখা মোবাইলের ঘড়িতে মিতুল দেখল রাত প্রায় সোয়া দুটো। একটু একটু হিসি পাচ্ছে বটে কিন্তু এই শীতের রাতে জল ঘাঁটতে হবে ভাবলেই গায়ে জ্বর আসছে। মটকা মেরে পড়ে রইল মিতুল।

একদম গায়ে গায়ে দু’টো ঘর নেওয়া হয়েছে। ঘর দু’টোর একই সেট-আপ। দরজা দিয়ে ঢুকে ডান দিকে বাথরুম। বাঁ দিকে একটা খাট। খাটের গায়েই জানলা। এই খাটের একদম সোজাসুজি উল্টো দিকে আরও একটা খাট। সে খাটও জানলার গায়েই। ও দিকেও একটা দরজা আছে বটে কিন্তু সেটা দিয়ে বেরনো যায় না। বাইরে থেকে বন্ধ। ঘরের মাঝখানে দেওয়াল ঘেঁষে টেবিল আর চেয়ার পাতা। ছিমছাম ব্যবস্থাপনা। হোম-স্টের মালিক পেমা শেরপা জানিয়েছিল, দু’টো ঘরেই যে দরজা দিয়ে ঢুকতে হয় সে দিকের জানলা দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তাই তিতাসদিদির কাছে আবদার করে এই খাটটা চেয়ে নিয়েছিল মিতুল।

সন্ধেবেলায় একবার চন্দ্রালোকিত নগাধিরাজকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। মিতুলের ভারী লোভ হল। কনুইতে ভর দিয়ে সে জানলার পর্দা সরিয়ে দিল খানিকটা। নাহ, দেখা যাচ্ছে না। বড্ড কুয়াশা। তবে একেবারে হতাশও হল না মিতুল, এই চাঁদের আলোয় কুয়াশামাখা ঘুমন্ত পাহাড় তার অন্তরকে হঠাৎই দ্রব করে দিল। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় বইতে পড়া সেই বিশাল কচ্ছপটার কথা। যার পিঠে এমন করেই গজিয়ে উঠেছিল একটা আস্ত পৃথিবী। মিতুলের মনে হচ্ছিল, সবটাই বুঝি স্বপ্ন। এক্ষুনি সেই বুড়ো কচ্ছপটা ঘুম ভেঙে চলতে শুরু করবে আর চোখের সামনে এই কুয়াশাঘেরা পাইন বনটাও চলতে শুরু করবে ধীরে ধীরে। হাঁ করে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল সে। বাইরে ‘ওম মণিপদ্মে হুম’ লেখা তিব্বতি পতাকা টাঙানো। সেগুলোর ওড়াউড়ি দেখে বোঝা যাচ্ছে, বেশ হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। হঠাৎই অমিয়র কথা মনে পড়তে লাগল মিতুলের। মানুষটা ঘুমোচ্ছে পাশের ঘরে। আহা রে! বেচারা মনখারাপ করেছে। খুব চেয়েছিল, মিতুলের সঙ্গে এক ঘরে থাকতে। তা মিতুলও কি চায়নি? কিন্তু লজ্জাশরম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। যত যাই হয়ে যাক, পল্লবদাদা আর তিতাসদিদির সামনে সে কিছুতেই মানুষটাকে নিয়ে ঘরে দরজা দিতে পারবে না। তাতে যদি মানুষটা তাকে ভুল বোঝে তো সে ভুল ভাঙানোর উপায় মিতুলের জানা আছে। আধশোয়া হয়ে এ সব ভাবতে ভাবতেই জানলা থেকে চোখ সরিয়ে ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়েছিল মিতুল, হঠাৎই তার কানে এল একটা বিজাতীয় শব্দ। কম্বলের ওমের মধ্যে থেকেও মুহূর্তে খাড়া হয়ে গেল মিতুলের গায়ের রোম! কোন ফাঁক দিয়ে যেন কম্বলের ভিতরে ঢুকে পড়ল পাহাড়ের সমস্ত ঝোড়ো হাওয়া! জমিয়ে দিল হাড়মজ্জা। দাঁতে দাঁত লেগে গেল নিমেষে। নিজেকে প্রাণপণে সামলাতে সামলাতে মিতুল বুঝতে পারল, ঠান্ডায় নয়, তার শরীর আচমকা বিদ্রোহ করে উঠেছে ভয়ে। একটা মেয়েগলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর শব্দটা আসছে মিতুল যে জানলা দিয়ে এতক্ষণ পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছিল, ঠিক তার বাইরে থেকে। ভয় পেলেও মানুষের প্রতিবর্ত ক্রিয়া কাজ করে। সেই তাগিদেই শব্দটা কানে আসা মাত্র মিতুল জানলার বাইরে তাকাল কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। যত দূরে চোখ যায় কোনও জনমনিষ্যি নেই। অথচ কান্নার শব্দটা ভীষণ রকম জ্যান্ত। হাত, পা অসাড় হয়ে গেলেও চেতনা এখনও কাজ করছে। মিতুল বুঝতে পারল, যে কাঁদছে সে বসে আছে জানলাটার নীচের দেওয়ালে। তাই তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এই গভীর রাতে, প্রবল শীতে কোন মেয়ে জানলার নীচের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে কাঁদবে? কেন কাঁদবে? আর সে এলই বা কখন? সে তো ঠায় বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরিয়ে সে সিলিং-এর দিকে তাকিয়েছিল। ওইটুকু সময়ের মধ্যে কারও পক্ষেই তো এসে বসে পড়া সম্ভব না। তবে কি যে এসেছে বুকে হেঁটে এসেছে? মানুষ কি বুকে হাঁটে?

একটু অপেক্ষা করল মিতুল, তার শোনার ভুল নয় তো? নাহ, শোনায় কোনও ভুল নেই। ওই তো সে কাঁদছে। ফুঁপিয়ে চলেছে একঘেয়ে একটানা সুরে। যেন সারা পৃথিবীর বিষাদ মিশে আছে সেই কান্নায়।

মনস্থির করে ফেলল মিতুল, তিতাসদিদিকে ডাকতে হবে। গভীর নিশুতি রাতে অবাঞ্ছিত এই কান্না তার বুকের মধ্যে যে ভয়ের পশম বুনতে শুরু করেছে তার সাথে একা লড়াই করার মতো ক্ষমতা তার নেই। কোনও শব্দ না করে বিছানার ওপর উঠে বসল মিতুল। জানলাটা ফের পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করল না। তার যে ঘুম ভেঙে গেছে বাইরে যে আছে তাকে কোনও ভাবেই জানাতে চায় না মিতুল। ধীরে ধীরে গা থেকে সরিয়ে দিল কম্বল। মাটিতে পা রাখল কিন্তু কী যেন একটা ঠেকল পায়ে। কাচের জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় মিতুল দেখল, তার পায়ের নীচে পড়ে আছে সেই শ্যাওলামাখা রুমাল। যেটা সে খেতে যাওয়ার আগে টিস্যু পেপারে মুড়ে ফেলে দিয়েছিল বাথরুমের ডাস্টবিনে!

মিতুল বুঝতে পারল, পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে গেছে এবং কী ভাবে এই পরিস্থিতির সাথে লড়তে হয় সে সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই তার। ভয়টা ক্রমশ তার পা বেয়ে উঠে আসতে লাগল। ছড়িয়ে পড়তে লাগল রক্তস্রোতের মধ্যে আর ঠিক তখনই ‘দুপ’ করে একটা শব্দ হল। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের বিরতি, তার পর ফের ‘দুপ’, এবং তার পর আবার। গা’টা কেমন যেন গোলাতে লাগল মিতুলের। ভাবনার পারম্পর্যও গুলিয়ে যেতে লাগল একটু একটু করে। ও দিকে কান্না কিন্তু থামেনি, শুধু এই অতিরিক্ত শব্দটা যোগ হয়েছে। কেউ যেন কাঁদতে কাঁদতে মাথা ঠুকছে জানলার নীচের দেওয়ালে আর একটা জায়গায় ঠুকছে না। পর পর তিন জায়গায় ঠুকছে আর তাই এমন শব্দ হচ্ছে, ‘দুপ’ ‘দুপ’ ‘দুপ’।

স্থানুর মতো বসে রইল মিতুল। উঠে তিতাসকে ডাকতে যাওয়া তো দূর, পা দু’টোকে ফের খাটে তুলে নেওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে সে। কতক্ষণ যে সে ও ভাবে বসেছিল মিতুল জানে না। সাড় ফিরল তিতাসের চিৎকারে।

মিতুল, বলে চিৎকার করে ধড়মড় করে খাটের ওপর উঠে বসেছে তিতাস। তার চোখমুখে তীব্র অবিশ্বাস এবং আতঙ্ক মিলেমিশে আছে। আর সেই অনুভূতি এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছে তিতাসকে যে মাঝরাতে মিতুল কেন এ ভাবে বসে আছে সে প্রশ্ন তার মাথায় এল না। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠল, মিতুল, একটা মেয়ে যেন কাঁদছে আর মাথা ঠুকছে! এই আমার দিকের জানলাটার ঠিক বাইরে!

ফ্যাসফ্যাসে গলায় মিতুল বলে উঠল, তিতাসদিদি, আমার দিকে জানলার বাইরেও একই জিনিস হচ্ছে!

স্তব্ধ হয়ে গেল তিতাস। কান্না এবং সেই ‘দুপ’ ‘দুপ’ ‘দুপ’ আওয়াজ এখন ঘরের দু’দিক দিয়েই আসছে। যেন একই সময়ে এক জনই দু’দিকে অবস্থান করছে। নয়তো এমন অত্যাশ্চর্য তালমিল সম্ভব না। তিতাস বুঝল, মিতুল ভয় পেয়েছে। কিন্তু সে কী করে সান্ত্বনা দেবে মিতুলকে? সে তো নিজেও আতঙ্কিত। তবু নিজের মনকে শক্ত করল তিতাস। সে বড়। তার অনেক দায়িত্ব। মিতুলকে সাহস দিতে হবে। দরকারে পল্লব আর অমিয়কে ডেকে তুলতে হবে। জানতে হবে এই অদ্ভুত ঘটনার কার্যকারণ। খাট থেকে নামতে চাইল তিতাস আর তখনই সে খেয়াল করল, কান্নার শব্দ জায়গাবদল করছে। শুধু তিতাস না, মিতুলও খেয়াল করেছে। দু’জনেই কাঠ হয়ে বসে শুনল, সেই ফুঁপিয়ে ওঠা একঘেয়ে কান্না জানলার নীচ বরাবর এগিয়ে আসছে দরজার দিকে এবং একটা সময় পর তা যেন দুই দরজার তলা দিয়ে দু’দিক থেকেই গড়িয়ে গড়িয়ে ঢুকে পড়তে লাগল ঘরের মধ্যে। ঘনিয়ে উঠতে লাগল ঘরের মেঝে জুড়ে।

আর একটুর অপেক্ষা। তার পরেই আতঙ্কের নাভিমূল থেকে উঠে আসা সেই ক্রন্দন বুঝি ছুঁয়ে ফেলবে ওদের পায়ের পাতা।