পরিশিষ্ট (বাংলার রেনেসাঁস)

পরিশিষ্ট

পাশ্চাত্য রেনেসাঁস বেশি লোকের কাজ নয়, অল্পসংখ্যক বিদ্বান ও শিল্পীর কাজ। প্রাচীন গ্রিসেও প্রদীপের তলায় ছিল অন্ধকার। অধিকাংশ লোকই ক্রীতদাস বা ধর্মান্ধ। পাশ্চাত্য রেনেসাঁস যেখান থেকে প্রেরণা পেয়েছিল সেদেশ প্রাচীন গ্রিস। আর পাশ্চাত্য রিফর্মেশন যে-দেশ থেকে প্রেরণা পেয়েছিল সেদেশ প্রাচীন প্যালেস্টাইন। এই দুটো মুভমেন্ট বিচ্ছিন না হলেও স্বতন্ত্র। লুথার ক্যালভিনকে কেউ রেনেসাঁসের নায়ক বলে না। রেনেসাঁসের অগ্রণী যে ইটালি সেখানে কোনোদিনই রিফর্মেশন ঘটেনি। মোগলদের আমলে যে প্রদেশ মধ্যযুগে ছিল সেপ্রদেশ ইংরেজদের আমল শুরু হবার ষাট বছরের মধ্যেই আধুনিক যুগের আলো বাতাস লেগে নতুন করে জেগে উঠেছিল এটা কি বিস্ময়ের কথা? কোনোদেশে কোনোকালে সবাই কি একদিনে বা এক শতাব্দীতে জেগেছে? ইটালির গ্রামবাসী জনগণ কি আজও রেনেসাঁসের তাৎপর্য বুঝেছে? রেনেসাঁস থেকে শিল্পবিপ্লবে পৌঁছোতে ইংল্যাণ্ডেরই লেগেছে তিনশো বছর। ইটালির তো আরও বেশি। দক্ষিণ ইটালিতে এখনও ও-জিনিস হয়নি।

কাউন্টার রেনেসাঁস ইটালিতেও ঘটেছিল। কাউন্টার রিফর্মেশন জার্মানিতেও। এদেশে ঘটলে আশ্চর্যের কী আছে? আমাদের জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে সব রকমের লোক ছিলেন। বীরপূজা রাশিয়ার মতো নাস্তিকদের দেশেও দেখা যাচ্ছে। যুক্তিবাদ কোন দেশেই-বা সুপ্রতিষ্ঠিত! চীন দেশ কোনোকালেই ঈশ্বরবাদী ছিল না। কিন্তু কোথায় তার রেনেসাঁস! একটি মাত্র মুভমেন্টের উপর মানবভাগ্য নির্ভর করে না। সেমুভমেন্টের দৃঢ়ভিত্তি ইউরোপেও বিরল। দুই মহাযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের পর সেভিত্তিও তেমন দৃঢ় নয়। নইলে সুররিয়ালিস্ট চিত্র বা অ্যাবসার্ড নাটক আসে কেন?

পশ্চিমের রেনেসাঁসের আদিপর্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা ছিল ল্যাটিন। সেভাষায় শিক্ষালাভ করতে ও শিক্ষাদান করতে এক প্রান্তের বিদ্যার্থী ও বিদ্বানরা অপর প্রান্তে যাতায়াত করতেন। অমনি করেই রেনেসাঁস সর্বত্র সঞ্চারিত হয়। ল্যাটিন থেকে ইটালিয়ান, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ভাষায় উপনীত হতে সাহিত্যের বেলা বেশি দিন লাগেনি, কিন্তু দর্শন বিজ্ঞানের বেলা বহু শতাব্দী লেগে যায়। জার্মানরাই সকলের আগে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যাটিনের পরিবর্তে জার্মান চালায়। অথচ ইংরেজরা এই সেদিনও ল্যাটিন পরীক্ষায় পাস না করলে অক্সফোর্ডে কেম্ব্রিজে প্রবেশপত্র দিত না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বঙ্গীকরণ কি রাতারাতি হতে পারে? বঙ্গীকরণ কেন গত শতাব্দীতে হল না, কেন এই শতাব্দীতে হচ্ছে না, তার কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান আলো-বাতাসের মতো আন্তর্জাতিক। মাটির মতো জাতীয় নয়। সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা হয় না। ইংরেজিই একালের ল্যাটিন বা সংস্কৃত। তাকে হটানো জনগণের স্তরে সম্ভব, কিন্তু সুধীজনের স্তরে অসম্ভব। লোকভাষা দিয়ে পপুলার সায়েন্স লেখা যায়, কিন্তু সায়েন্স লিখতে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি আচার্যরা এখনও তো পারলেন না। যে দু-একজন চেষ্টা করেছেন তাঁরা ভারতের অন্যত্র অপঠিত ও অচলিত, ভারতের বাইরে তো অজ্ঞাত ও অপাঙক্তেয়। অমন যে রবীন্দ্রনাথ তাঁকেই-বা চিনত কে, যদি-না তাঁর রচনা ইংরেজিতে তর্জমা হত?

রেনেসাঁস জনগণের সৃষ্টি নয়। জনগণের কাছে তাকে পৌঁছে দিতে হলে তার দায়িত্ব নিতে হবে লোকশিক্ষকদের। নিরক্ষরতা দূর করতে হবে, লক্ষ লক্ষ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। বেতার ও টেলিভিশনের সাহায্য নিতে হবে। রাষ্ট্র যতদিন-না যুদ্ধের জন্যে খরচ কমিয়ে শিক্ষার জন্যে খরচ বাড়াচ্ছে ততদিন ওটা দুরাশা। স্বাধীনতার পরে সামরিক ব্যয় বহুগুণিত হয়েছে। যন্ত্রশিল্পের বিস্তারও প্রভূত ব্যয়সাপেক্ষ। তবে লোকশিক্ষার সমস্যারও একদিন সমাধান হবে। যেটার হবে না সেটা রেনেসাঁসের মূল সমস্যা। হাজার হাজার বছর আমরা চর্বিতচর্বণ ছাড়া আর কিছু করিনি। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস একই বিষয়বস্তু নিয়ে শত শত গ্রন্থ রচনার ইতিহাস। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসও তাই। বিচিত্র অভিজ্ঞতা, অপূর্ব আবিষ্কার না হলে রেনেসাঁস হয় না। অজ্ঞেয়বাদ এদেশে আড়াই হাজার বছর আগেও ছিল। তার থেকে ক-খানা মহাকাব্য হতে পারে! যুক্তিবাদের চূড়ান্ত দেখিয়েছেন বৌদ্ধরা। সে-ই বা কী রেখে গেল! সব দিক বিবেচনা করলে গত শতাব্দী ভূতপূর্ব বহু শতাব্দীর মতো বন্ধ্যা নয়, উর্বরা। বীজ এসেছিল বাইরে থেকে আলোর সঙ্গে বাতাসের সঙ্গে।