সাত
ছেলেরা করাল ফেন্সের ওপর বসা। মেলানি নানু আর শর্টি ওদের পাশে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে। রবিনের চোখ পানিতে টলমল করছে।
‘ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এরকম,’ পুলিসম্যান বলল। ‘আজ সকালে বলেছিলেন আপনাদের দুটো ঘোড়া চুরি গেছে। কিন্তু পরে ওরা ফিরে আসে?’
‘হ্যাঁ। এক প্রতিবেশী ফিরিয়ে দিয়ে যায়।’ জানালেন নানু ‘বোঝা যায় ওরা চুরি যায়নি। ডাল পড়ে বেড়া ভেঙে গিয়েছিল, ওখান দিয়ে বেরিয়ে যায়।’
কিশোর টু শব্দটি করল না। কিন্তু ডালের খোঁচা লেগে ওর মত হানি-বানির গা একটুও ছড়ে গেল না কেন এ চিন্তাটা ঘুরপাক খাচ্ছে ওর মাথায়। আর লোকাস্ট হানির অত ভারী ডালটাই বা উড়ে এল কীভাবে?
‘এখন,’ বলল পুলিসটি, ‘আরেকটা ঘোড়া নিখোঁজ।’
এবার মুখ খুলল কিশোর।
‘ড্রাগন চুরি গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই,’ বলল। ‘বেড়ার বাইরে ওগুলো ওরই নালের ছাপ।
‘এবং বেড়ায় এমন কারসাজি করে রাখা হয়েছে যেন গোপনে খোলা-লাগানো যায়,’ বলল রবিন।
‘আর কে যেন জই ফেলে গেছে!’ যোগ করল ডন, ‘চেয়েছে ঘোড়ারা যাতে জইয়ের লোভে বেড়ার কাছে আসে।’
‘খাইছে, আমাদের ধারণা, চোর বেড়া খুলে ড্রাগনকে চুরি করে আবার বেড়া লাগিয়ে গেছে,’ বলল মুসা।
পুলিসম্যান প্যাডে কিছু নোট নিল।
‘ড্রাগনকে শেষবার কে দেখেছে?’
‘নাস্তার পর আমি ড্রাগনকে স্টলে রাখি, জানাল শর্টি। ‘রবিন ওর পিঠে চড়তে চেয়েছিল। কিন্তু হ্যারি বলে ঘোড়াটার পায়ের জখম সারেনি। ড্রাগন স্টলে ছিল যেন ভেট ওকে পরীক্ষা করতে পারে। ওটাই শেষবার ওকে দেখা।’
‘ভেটের সাথে কি কেউ কথা বলেছেন?’
কেউ বলেনি।
‘আমি যখন বেড়া মেরামত করছি তখন শার্প ওখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান,’ জানাল কিশোর। ‘ঘোড়াদের ওষুধ কিনতে যাচ্ছিলেন।’
পুলিসম্যান একটা ভ্রূ তুলল মেলানি নানুর উদ্দেশে।
‘এখানে অনেক লোক কাজ করে, বলল। ‘র্যাঞ্চকর্মী, স্বেচ্ছাসেবক, এই ছেলেগুলো। কারও না কারও তো চোখে পড়ার কথা ঘোড়া চুরি যাচ্ছে।’
‘তখন লাঞ্চের সময়,’ জানালেন নানু। ‘সবাই ডাইনিং রুমে ছিল।’
হ্যাটটা পেছনে ঠেলে দিল পুলিসম্যান।
‘চোর জানবে কীভাবে আপনারা সবাই খেতে বসেছেন?’
‘লাঞ্চ বেলের শব্দ আপনি বাংলাদেশে বসেও শুনতে পাবেন, এতটাই জোরে বাজাই,’ বললেন নানু। ‘ড্রাগনকে যে চুরি করেছে সে জানত হাতে যথেষ্ট সময় পাবে।’
‘তো সবাই ডাইনিং রুমে ছিল,’ বলল পুলিসটি।
‘আমি বাদে,’ বলল শর্টি। ‘আমি আস্তাবলে হানি-বানিকে গোসল করাচ্ছিলাম।’
‘এবং ডেবোরা দেরি করে আসে, ‘ জানাল রবিন।
‘হ্যারি আর আমিও তখন ছিলাম না, বলল কিশোর। ‘আমরা ভাঙা বেড়াটা সারছিলাম।’
‘আচ্ছা,’ পুলিসম্যান নতুন এক পাতা ওল্টাল। ‘তো এই ঘোড়াটা দেখতে কেমন?’
‘কালো, তবে পিঠে বড় এক সাদা দাগ থাকায় ড্রাগনের মত দেখায়,’ বলল নথি। ‘দাঁড়ান! আমার কাছে ছবি আছে!’ বেড়া থেকে লাফিয়ে নামল। ‘আপনাকে প্রিন্ট করে দিচ্ছি।’
ও অফিসে দৌড়ে গেল ক্যামেরাটা আনতে। কম্পিউটারের ওপরের তাকে পেল না ওটা। এখানেই তো রেখেছিল, নিশ্চিত ও। ডেস্কের কাগজপত্রের তলায়, তারপর ডেস্কের নিচে খুঁজল রবিন। অনেকগুলো হর্স ট্রফি, বই-পত্রিকা রাখা অগোছালো তাকগুলোয় তল্লাশী চালাল। নেই! ওর ক্যামেরা উধাও।
ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে মাথায়। কম্পিউটার! মেলানি নানুর কম্পিউটারে ছবিগুলো কপি করে রেখেছে। রবিন ছুটে গিয়ে চালু করল ওটা। এখানে পাবে নিশ্চয়ই ওগুলো।
কালচে পর্দা নীল হয়ে উঠল এবং ফাইলগুলো উদয় হলো। শেষমেশ ‘রবিন’স ফাইল পাওয়া গেল। ক্লিক করতেই প্রতিটা ঘোড়ার ছোট-ছোট ছবিতে ভরে উঠল পর্দা। ওই যে, ফুটকি আর বিজলী; ডেইজি আর জাম্পিং জ্যাক। খুঁজছে তো খুঁজছেই, কিন্তু ড্রাগনের ছবি নেই। এবার মনে পড়ল ও ছবি তোলা শুরু করার আগেই তো ড্রাগনকে আস্তাবলে নিয়ে যায় শর্টি
মুসা আর ডন এসে ঘরে ঢুকল।
‘পেলে ড্রাগনের ফটো?’
‘ওর ছবি তো তোলাই হয়নি,’ জানাল রবিন। ‘আর আমার ক্যামেরাটাও পাচ্ছি না।
ঢোক গিলল মুসা।
‘খাইছে, তুমি শিয়োর?’
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
‘ভাগ্যিস মেলানি নানুর কম্পিউটারে ছবিগুলো কপি করে রেখেছিলাম।’ টাইপ করতে লাগল ও। ‘এবার এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখব যে চোরের বাপও খুঁজে পাবে না।’ ম্যাল্ সিরাপ রেসিপি নামে এক ফাইল বানিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল ঘোড়াদের সব কটা ছবি। ‘রেসিপির ফাইলে কেউ ঘোড়া খুঁজতে যাবে না।’ কম্পিউটার বন্ধ করল ও। ‘চলো, দুঃসংবাদটা সবাইকে জানাইগে।’
‘করালে যাও আমি আসছি,’ বলল মুসা, পা বাড়াল বাঙ্কহাউস অভিমুখে। একটা জিনিস নিয়ে আসি।’ জিনিসটা কী কেউ প্রশ্ন করার আগেই দৌড়ে চলে গেল ও।
করালে, রবিন সবাইকে ক্যামেরা চুরি যাওয়ার কথা জানাল।
‘বলো কী!’ রীতিমত শিউরে উঠলেন মেলানি নানু। ‘আমার বাসায় চোর?’ এবার সরাসরি চাইলেন পুলিসম্যানের চোখের দিকে। ‘আপনি ক্যামেরা চোর, ঘোড়াচোরকে খুঁজে বের করুন-যেভাবে পারেন।’ মুখখানা আপেলের মতন লাল হয়ে গেছে।
‘শান্ত হোন,’ বলে তাঁর কাঁধ চাপড়ে দিল শর্টি। কিন্তু তাতে নানুর মুখের চেহারায় আরও রক্ত জমল।
‘তোমরা ঘোড়াদের ছবি নিচ্ছ এটা কে-কে দেখেছে?’ প্রশ্ন করল পুলিসম্যান।
‘যারাই করালের পাশ দিয়ে গেছে,’ বলল রবিন। ‘র্যাংলার, স্বেচ্ছাসেবক। আর পশ্চিম চারণভূমির এক লোক। স্ট্রাইপড্ শার্ট পরা এক স্বেচ্ছাসেবক। লোকটা বলছিল আমাদের ওখানে থাকাটা নাকি খুবই বিপজ্জনক।’
‘ওটা শার্পের এক স্বেচ্ছাসেবী,’ বলল শর্টি। ‘উদ্ধার পাওয়া ঘোড়াদের মধ্যে যেগুলো সবচাইতে বেশি রোগাভোগা, সেগুলোর সেবা-যত্নের ট্রেনিং দেয় শার্প ওদেরকে। শার্প করালে আসার অনুমতি দেয়ার আগে ঘোড়াগুলোকে এমনকী চোখেও দেখি না আমরা। পশ্চিম তৃণভূমির পুরনো বাঙ্কহাউসটায় থাকে শার্পের লোকেরা। ওরা কখনও এখানে আসে না, কাজেই ওদের ক্যামেরা চুরিরও সুযোগ নেই।’
এসময় ছুটতে ছুটতে এল মুসা।
‘এই যে,’ বলে বাড়িয়ে দিল ঘোড়ার স্কেচটা।
‘ড্রাগন!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘একদম ওর মতই হয়েছে ছবিটা।’
‘আমি ওটা-’ ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছে মুসা, ওটা-তোমার জন্মদিনে উপহার দেব বলে আঁকছিলাম- সারপ্রাইয দিতে চেয়েছিলাম।’
‘দুর্দান্ত সারপ্রাইয,’ বলে, বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল রবিন। হাতে আঁকা ছবিটা দেখাল পুলিসটিকে। ‘ঘোড়াটা লাপাত্তা। এর নাম ড্রাগন। ওকে খুঁজে দিন, প্লিজ।’
পুলিস ছবিটা নিয়ে কথা দিল সাধ্যমত চেষ্টা করবে। একটু পরে, ছোট্ট দলটা পুলিস কারটিকে চলে যেতে দেখল।
‘জানি তোমাদের মন খারাপ,’ বললেন মেলানি নানু। ‘আমারও। তারপরও তোমরা নিজেদের ঘোড়ার যত্ন নিতে যাও।’
‘কিন্তু…কিন্তু ড্রাগনের ব্যাপারটা?’ রবিন শুধাল।
‘র্যাঞ্চের নিয়ম হলো,’ বললেন নানু, ‘মাথায় যদি আকাশও ভেঙে পড়ে, তবুও ঘোড়াদের দানা-পানি দিতে হয়, যত্ন নিতে হয়। এর কোন মাফ নেই। কখনওই নয়। ঘোড়াগুলোকে খাটিয়েছ তোমরা, ওরা ক্লান্ত। শর্টি তোমাদেরকে শিখিয়ে দেবে কীভাবে ওদের যত্ন নিতে হয়। কাজটা হয়ে গেলে, আমি তোমাদেরকে গাড়িতে করে প্রতিবেশী র্যাঞ্চগুলোয় নিয়ে যাব। ওরা হয়তো কেউ ড্রাগনকে দেখে থাকতে পারে।’
.
করালের ভেতরে, কাউবয় বুট খুলল ছেলেরা। পা শুকনো রাখতে হলদে রবারের বুট পরল। এবার ঘোড়াদের স্নান করিয়ে যত্ন নিল। রবিন জাম্পিং জ্যাককে ব্রাশ করল। আহা, এটা যদি ড্রাগন হত! ওর পাশে, বিজলীর লেজে আটকে থাকা গাছের ছোট-ছোট পাতা চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে ফেলে দিল কিশোর।
‘ভেবো না,’ রবিনকে বলল ও। ‘আমরা ড্রাগনকে ঠিক খুঁজে বের করব।’
একটু দূরে, মুসা রিবন বাঁধছে ডেইজির কেশরে।
‘খাইছে, অপূর্ব লাগছে তোকে,’ বলে, ওর চকচকে পশমে হাত বুলিয়ে দিল।
‘ফুটকিও কম যায় না,’ বলল ডন। ব্রাশ করায় ছোট্ট ঘোড়াটার তেল চুকচুকে শরীর চিকচিক করছে।
শর্টি চারপাশে ঘুরে ওদের কাজ দেখল।
‘বাহ, চমৎকার,’ বলল। ‘এবার দেখে নাও ঘোড়ার খুর কীভাবে পরিষ্কার করে।’ বিজলীর পা বরাবর আলতো হাত বুলিয়ে পায়ের পাতাটা তুলে নিল সে। ‘পায়ে কিছু বিধলে খুব কষ্ট পায় ওরা,’ বলল। মাথা ঝাঁকাল ছেলেরা। ঘোড়াদের খুরে প্রায়ই এটা-সেটা আটকে যায়। ওগুলো বেছে বেছে বের করতে হয়।’ দেখিয়ে দিল কাজটা কীভাবে করে। ‘কাজটা হয়ে গেলে, তৃণভূমিতে পাঠিয়ে দাও তোমার ঘোড়াকে। তাহলে খানিকটা বিশ্রাম পাবে ওরা। যাই, আমার কিছু কাজ বাকি আছে,’ নিজের ঘোড়ায় চড়ে, চলে গেল রাইড করে।
ছেলেরা সাবধানী হাতে ওদের ঘোড়াদের খুর থেকে মাটি, পাথর আর খড়কুটো, কাঠের ছিলকা এসব বের করল।
‘ওয়াও!’ বলে উঠল ডন, ওর হাতে ছোট, চকচকে কিছু একটা। ‘এটা ফুটকির খুরে ছিল।’
মুসা জিনিসটা নিয়ে আলোয় তুলে ধরল।
‘কাঁচের পুঁতি,’ বলল। ‘নেকলেসে যেগুলো গাঁথা হয়।’
অপর খুরটাও পরিষ্কার করল ডন।
‘এই যে, আরেকটা। আরও একটা!’ এভাবে মোট ছটা পুঁতি বের করল ডন ফুটকির খুর থেকে। ‘এগুলো কোত্থেকে জোটালি রে?’ প্রশ্ন করল ঘোড়াটাকে। কিন্তু ফুটকি মুখ খুলল না।
কাজ সেরে, ছেলেরা বাড়িতে মেলানি নানুর খোঁজে গেল।
‘আমি এখানে,’ অফিস থেকে গলা ছাড়লেন তিনি।
‘নানু, ড্রাগনকে খুঁজতে যাব না আমরা?’ বলল কিশোর সবার হয়ে।
‘আরেকটু পরে।’ কম্পিউটারে কাজ করছেন নানু। তাঁর ডেস্কের ওপর হলদে কাগজের উঁচু স্তূপ। ‘যে পুলিসম্যান এখানে এসেছিল তাকে বলেছিলাম আমাকে এটা ফ্যাক্স করতে।’ মুসার আঁকা ড্রাগনের ছবির একটা কপি তুলে ধরলেন। ‘ফ্লায়ার বানিয়ে বিলি করব। ঘণ্টাখানেক লাগবে আরও।’
‘এ-ক ঘণ্টা!’ রীতিমত আঁতকে উঠল ডন। অপেক্ষায় বড়ই আপত্তি ওর।
নানু ওকে এক বাহু দিয়ে আলিঙ্গন করলেন।
‘অপেক্ষা করতে আমারও ভাল্লাগে না,’ বললেন। ‘তোমার বয়সে আমি আর টিম প্রতি রোববার শহরে যেতাম আইসক্রিম খেতে। এক রবিবার থেকে আরেক রবিবার যেন কিছুতেই আসতে চাইত না।’
টাইপিং আরম্ভ করলেন তিনি। ঘোড়া চুরি, লিখে, বিরতি নিলেন। ‘কাজে ব্যস্ত থাকলে সময়টা দ্রুত কেটে যাবে, ছেলেদেরকে বললেন। ‘মুসা, তুমি বার্নের মুরালটা নিয়ে কাজ করতে পারো। আর, ডন, বার্নের পেছনে এক পুরনো সাইকেল আছে। র্যাঞ্চে সাইকেল চালিয়ে দেখতে পারো কোন ঘোড়ার আরও পানি চাই কিনা। কিশোর আর রবিন, তোমরা আস্তাবলের কিছু স্টল মাক করতে পারো।’
‘মাক মানে?’ রবিন প্রশ্ন করল।
‘এর মানে স্টল সাফ-সুতরো করা, মেঝে থেকে পুরনো বেডিংপত্র সরানো, দেয়াল ঘষে পরিষ্কার করা, টাটকা বালি আর খড় রাখা। ফ্লায়ারগুলো রেডি হয়ে গেলেই কাউবেল বাজাব আমি।’
ছেলেরা তখুনি কাজে লেগে পড়ল। বিশাল ম্যাপ্ল্ গাছ তিনটের নিচে চরে বেড়ানো ঘোড়াদের স্কেচটা বের করল মুসা। হেলিকপ্টার বীজ যোগ করবে ছবিতে, ডনকে চমকে দিতে। লম্বা, বাদামি শুঁটিসহ এক হানি লোকাস্টও জুড়বে ছবিটিতে।
ভ্রূ কুঁচকে গেল মুসার। খাইছে, লোকাস্ট গাছ তো আশপাশে কোথাও দেখেনি ও। ব্যাপারটা অদ্ভূত অন্তত একটা গাছ হলেও তো থাকার কথা। বেড়ার ওপর লোকাস্টের ডাল পড়ে কীভাবে? কিশোর বলছিল ঝড়ো বাতাসে উড়ে এসেছে ওটা। কিন্তু তেজী বাতাসে তো অন্যান্য আরও অনেক গাছের ডালই ভেঙে পড়ার কথা। কই, আর কোন ডাল তো দেখেনি ও। ওদিকে আবারও গেলে ভালমত লক্ষ্য করতে হবে ব্যাপারটা।
আস্তাবলে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে লেগে পড়েছে কিশোর আর রবিন। এক চাকার এক ঠেলা গাড়িতে ঝাড়ন আর পিচফর্ক বোঝাই দিয়ে ড্রাগনের ফাঁকা স্টলটিতে ঢুকল রবিন
‘তুই কোথায়?’ ফিসফিস করল ভারাক্রান্ত মনে। ফর্ক দিয়ে পুরানো খড় তুলে ঠেলা গাড়িতে রাখল, তারপর ঝাঁট দিল মেঝে। এবার হোস চালু করে দেয়াল ঘষতে লাগল। অন্ধকার এক কোনায়, কে যেন কাঠে ছোট্ট এক হৃদয় খোদাই করে ভেতরে টি এ + এস এল লিখেছে। কিশোরকে ওটা দেখাল ও।
‘ঠিক অমন একটা হার্ট আমিও এক ম্যাপ্ গাছে দেখেছি, ‘ বলল কিশোর। ‘মেলানি নানু হয়তো জানেন কারা এই টি এ আর এস এল।’
এক বস্তা তাজা খড় বয়ে এনে মেঝেতে বিছাল ওরা।
‘আমরা তোকে খুঁজে বের করবই,’ ড্রাগনের স্টল ত্যাগের সময় ফিসফিস করে বলল রবিন। ‘কথা দিলাম।’
.
লক্কড়মার্কা সাইকেলটা চালিয়ে র্যাঞ্চে চক্কর দিচ্ছে ডন। নকশার প্রতিটা ‘X’ চিহ্নিত জায়গায় গিয়ে, প্রয়োজনমত পানি দিচ্ছে বালতিতে, গোল্ডফিশগুলোরও খবর নিল এই ফাঁকে। শেষ স্টপ ওর বাদামি টাউটার ছাউনিতে।
‘অ্যাই, বাদামি,’ হাঁকল ডন। কিন্তু এবার আর ছোট্ট ঘোড়াটা মাথা বের করল না। ডন হোস চালু করে আকাশের দিকে তাক করল পানির ধারা। ‘জল পড়ে, পাতা নড়ে, সুর করে গাইল, কিশোরের কাছ থেকে শুনেছে এটা। তবুও বাদামি টাউটার দেখা নেই। বেড়া টপকাল ডন। ছাউনির কাছে জুতোর পালিশের মতন পরিচিত এক গন্ধ পেল।
‘বাদামি?’ বলে, হেঁটে ভেতরে ঢুকল। কিন্তু টাট্টু ঘোড়াটাকে পেল না। মাটিতে খড়ের ওপর পড়ে রয়েছে একটা খালি শিশি, বাদামি জুতো পালিশের। ঘোড়ার নাল পালিশ করে নাকি কেউ? কই, এমন কথা তো কখনও শোনেনি ও। আর ছোট্ট ঘোড়াটাই বা গেল কোথায়? ওকেও কি কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে নাকি?
এক লাফে বাইকে চড়ে র্যাঞ্চ অভিমুখে পাঁই পাঁই পেডাল মারল ডন। এক পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই দেখল পশু চিকিৎসক শার্প প্রকাণ্ড এক সাদা রঙের ঘোড়াকে এদিকেই হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে।
‘আপনি কি বাদামিকে দেখেছেন?’ প্রশ্ন করল ডন।
ভ্রূ কোঁচকাল ভেট।
‘বাদামি?’ পাল্টা জবাব চাইল।
‘শেডের ছোট বাদামি টাট্টুটা, জানাল ডন। ‘আমি ওকে বাদামি বলি।’
‘ও, ও, বাদামি। ওকে, ইয়ে, পালক নিয়েছে। একটা পরিবার একটু আগে নিয়ে গেছে,’ বলল শার্প।
ডনের মনে পড়ল সেই ট্রেইলারটায় চাপিয়ে এক বাদামি টাট্টু আর মস্ত এক কালো রঙের ঘোড়াকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। ও ভেবেছিল হানি আর বানিকে ফিরিয়ে দিয়েছে ট্রেইলারটা সেই পড়শীর। কিন্তু ওটা নিশ্চয়ই বাদামির নতুন পরিবারের।
‘যাক, ও ড্রাগনের মত চুরি যায়নি জেনে ভাল লাগছে,’ বলল ডন।
নিমেষে হাসি মুছে গেল শার্পের মুখ থেকে।
‘কী?’
‘ড্রাগনকে কে যেন চুরি করেছে,’ জানাল ডন।
গলা খাঁকরাল ভেট।
‘সর্বনাশ!’ লোকটার কণ্ঠা ওঠা-নামা করল। ‘এমন ভয়ঙ্কর কাজ কে করতে পারে?’
‘আমরা পুলিসকে জানিয়েছি, এখন ফ্লায়ার ছড়াব,’ ডন আশ্বস্ত করল শার্পকে।
‘তাই?’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছল ভেট। ‘তারমানে সবাই এখন ড্রাগনকে খুঁজবে। খুব ভাল।’ এসময় আঠারো চাকার এক ট্রাক র্যাঞ্চের কাছের রাস্তা দিয়ে গড়গড় করে যাওয়ার সময় জোরাল, তীব্র হর্ন বাজাল।
ডন প্রথমটায় ভেবেছিল ওটা বুঝি চলন্ত ভ্যান। এবার দেখল ওটার দু’পাশ জুড়ে বড়-বড় গর্ত।
‘ওটা কী ধরনের ট্রাক?’ জিজ্ঞেস করল ও।
‘ট্রাক?’ বলল শার্প। ‘হুম, দেখে তো মনে হচ্ছে গরুর ট্রাক। গরু আনা-নেয়া করে। গর্তগুলো গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্যে। হ্যাঁ, ক্যাল্ ট্রাক। যাই, লুসিকে পুরনো করালে রেখে আসি।’ হাঁটা ধরল লোকটা।
‘ঘোড়ায় চড়ে গেলেই তো পারেন,’ বাতলে দিল ডন।
চোখ কপালে উঠে গেল ভেটের।
‘ঘোড়ায় চড়ে? ও, হ্যাঁ, তাই তো, রাইড করতে ভালবাসি আমি। আমার জন্মই তো স্যাড়লের ওপর। হেহ্-হেহ্।’ রেকাবে এক পা রেখে ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু ঘোড়াটা ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। এক পা রেকাবে, অন্যটা মাটিতে লাফাতে লাগল শার্প। ‘আস্তে, ওরে, আস্তে। থাম না রে, বাবা!’ গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে লাফাচ্ছেই কেবল। শেষমেশ স্যাড়লে উঠে বসতে পারল।
‘পরে দেখা হবে,’ বলল। দু’হাতে স্যাল্ হর্নটা কষে চেপে ধরল–ডেবোরা যেটা করতে মানা করেছিল ডনকে তারপর বিদঘুটে ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে পশ্চিম তৃণভূমির দিকে চলল। দৃশ্যটা অনেকটা যেন ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ লাফাইয়া চলিল গোছের লাগল ডনের চোখে। কোনমতে হাসি চাপল ও।
কাউবেল বাজল। এক লাফে বাইকে চড়ে পেডাল মেরে আস্তাবলে পৌঁছল ডন। রবিন, কিশোর আর ডন ঝটপট কাউবয় বুট পরে নিল। র্যাকে ওদের হলদে বুটগুলো রাখল রবিন।
‘আমাদের বুটেও ডনের বুটের মত কীসের যেন দাগ লেগেছে,’ বলল। ‘তফাৎ শুধু ওরগুলো বাদামি আর আমাদেরগুলো কালো।’
দাগগুলো লাগল কোত্থেকে? দীর্ঘ, সংকীর্ণ আস্তাবলটার এমাথা-ওমাথায় চোখ বোলাল ওরা। দু’পাশেই সারবাঁধা স্টল। রবিন আর কিশোর হাত-মুখ ধুয়েছে সেখানকার মাটি ভেজা। ড্রাগনের স্টল থেকে কালো এক দাগ গড়িয়ে বেরিয়ে এসেছে। কিশোর নুয়ে পড়ে স্পর্শ করল ওটা।
‘জুতো পালিশের মত গন্ধ।’
‘বাদামির শেডে আমিও পালিশ দেখেছি,’ জানাল ডন।
‘কাউবয়রা হয়তো স্যাডল পালিশ করে কালি দিয়ে,’ বলল রবিন। ‘কিংবা তাদের বুট।’
এসময় আবারও ঘণ্টা বাজল। ছেলেরা দ্রুতপায়ে মেলানি নানুর গাড়ির দিকে চলল। এখন ড্রাগনকে খুঁজতে যাচ্ছে ওরা।
র্যাঞ্চ থেকে র্যাঞ্চে, প্রতিটা ফার্মে, সব কটা বাড়িতে ফ্লায়ার বিলাল ছেলেরা। শহরে, সব কটা দোকানের জানালাতেও ফ্লায়ার সাঁটল। বিগ হার্পস হট ডগ প্যালেসে নাকেমুখে কিছু গুঁজে আবারও কাজে ফিরল দলটা।
লাইব্রেরি, কমিউনিটি সেন্টার আর শেরিফের অফিসের বুলেটিন বোর্ডে ফ্লায়ার লাগাল ওরা। গ্রোসারি স্টোর আর শপিং সেন্টারের বাইরে পার্ক করে রাখা গাড়িগুলোর উইণ্ডশিল্ড ওয়াইপারের নিচে ফ্লায়ার গুঁজে দিল।
ডেয়ার টু ড্রিম র্যাঞ্চে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল ওদের।
‘কী, মনে হয়, কাজ হবে? ড্রাগনকে পাওয়া যাবে?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘আশা তো করি,’ বলল কিশোর।