পঞ্চম পরিচ্ছেদ । স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয়
বিরাট হিন্দুকুশের তুষার-অরণ্য ভেদ করে আপাতত আমরা আর সুবন্ধুর অনুসরণ করব না। ভারতের ছেলে ভারতে ফিরে আসছে, যথাসময়েই আবার তাকে অভ্যর্থনা করে নেব সাদরে। এখন এই অবকাশে আমরা গল্প-সূত্র ছেড়ে অন্যান্য দু-চারটে দরকারি কথা আলোচনা করে নিই। কী বলো?
স্বদেশকে আমরা সবাই ভালোবাসি নিশ্চয়, কারণ বনমানুষ ও সাধারণ জানোয়াররা পর্যন্ত স্বদেশ থেকে নির্বাসিত হলে সুখী হয় না। আফ্রিকার গরিলাদের অন্য দেশে ধরে নিয়ে গেলে প্রায়ই তারা মারা পড়ে। তাদের যত যত্নই করা হোক, যত ভালো খাবারই দেওয়া হোক, তবু তাদের মনের দুঃখ ঘোচে না। এই দুঃখই হচ্ছে তাদের স্বদেশপ্রীতি! গরিলাদের স্বদেশপ্রীতি আছে, আমাদের থাকবে না?
অবশ্য আমাদের—অর্থাৎ মানুষদের মধ্যে—গরিলারও চেয়ে নিম্ন-শ্রেণির জীব আছে দু-চারজন। লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে, তারা বাস করে এই ভারতবর্ষেই। তারা দু-তিন বছর বিলাতি কুয়াশার মধ্যে বাস করে দেশের মাটি, দেশের মায়া, দেশের ভাষা, দেশের সাজপোশাক ভুলতে চায় এবং নিজেদের ব্যর্থ নকল সাহেবিয়ানা নিয়ে গর্ব করতে লজ্জিত হয় না! তোমরা যখনই সুযোগ পাবে, এদের মূর্খতার শাস্তি দিতে ভুলো না।
হাঁ, স্বদেশকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু সে ভালোবাসার পরিমাণ হয়তো যথেষ্ট নয়। এই বর্তমান যুগেই দেশের কতটুকু খবর আমরা রাখতে পারি? প্রাচীন ভারতের খবর আমরা প্রায় কিছুই জানি না বললেও হয়। বিদেশি রাজার তত্বাবধানে ইস্কুল-কলেজে যে-সব ইতিহাস আমরা মুখস্থ করি, তার ভিতরে স্বাধীন ভারতের অধিকাংশ গৌরব ও বর্ণ-বৈচিত্র্যকে অন্ধকারের কালো রং মাখিয়ে ঢেকে রাখা হয় এবং নানাভাবে আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করা হয় যে, ইউরোপীয়রা আসবার আগে ভারতে না ছিল উচ্চতর সভ্যতা, না ছিল প্রকৃত সুশাসন, না ছিল যথার্থ সাম্রাজ্য। কিন্তু তোমরা যদি চন্দ্রগুপ্ত অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত-বিক্রমাদিত্য, কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত ও হর্ষবর্ধন প্রভৃতি প্রাচীন ভারতীয় সম্রাটদের জীবনচরিত পড়ো তাহলে বুঝবে যে, সমগ্র পৃথিবীর কোনও সম্রাটই তাঁদের চেয়ে উচ্চতর সম্মানের দাবি করতে পারেন না। তাঁদের যুগে ভারত সভ্যতা, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, ললিতকলা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে যত উচ্চে উঠেছিল, আজকের অধঃপতিত আমরা তা কল্পনাও করতে পারব না। এইচ জি ওয়েলস স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বলতে অশোককেই বোঝায়। অশোক ছিলেন আসমুদ্র হিমাচলের অধীশ্বর, কিন্তু তিনি রাজ্যশাসন করেছেন প্রেমের দ্বারা। রণক্ষেত্রে ভারতের নেপোলিয়ন উপাধি লাভ করেছেন সমুদ্রগুপ্ত, তাঁর দেশ ছিল বাংলার পাশেই পাটলিপুত্রে। সমগ্র ভারত জয় করেও তিনি তৃপ্ত হননি, ললিতকলা ও সাহিত্যক্ষেত্রেও তাঁর নাম প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। সম্রাট হর্ষবর্ধনও কেবল দুর্ধর্ষ দিগবিজয়ী ছিলেন না, সংস্কৃত সাহিত্যেও তিনি একজন অমর নাট্যকার ও কবি বলে পরিচিত (‘নাগানন্দ’, ‘রত্নাবলী’ ও ‘প্রিয়দর্শিকা’ প্রভৃতি তাঁরই বিখ্যাত রচনা)। তাঁর মতন একাধারে শ্রেষ্ঠ কবি ও দিগবিজয়ী সম্রাট পৃথিবীর ইতিহাসে আর নেই। সমুদ্রগুপ্ত সম্বন্ধেও ওই কথা বলা যায়।
এমন সব সন্তানের পিতৃভূমি যে ভারতবর্ষ, আলেকজান্ডার দিগবিজয়ীরূপে সেখানে এসে কেমন করে অম্লান গৌরবে স্বদেশে ফিরে গেলেন? তোমাদের মনে স্বভাবতই এই প্রশ্নের উদয় হতে পারে। এর জবাবে বলা যায় : ঐতিহাসিক যুগে বিরাট ভারতসাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতিরূপে সর্বাগ্রে দেখি চন্দ্রগুপ্তকে। তিনি আলেকজান্ডারের সমসাময়িক হলেও গ্রিকদের ভারত আক্রমণের সময়ে ছিলেন স্বদেশ থেকে নির্বাসিত, সহায়-সম্পদহীন ব্যক্তি। তাঁর হাতে রাজ্য থাকলে আলেকজান্ডার হয়তো বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারতেন না। আলেকজান্ডার উত্তরে ভারতের এক অংশ মাত্র অধিকার করেছিলেন, তাও তখন বিভক্ত ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে এবং সে সব রাজ্যে রাজাদের মধ্যে ছিল না একতা। তখন আালেকজান্ডারের প্রধান শত্রু রাজা পুরুর চেয়েও ঢের বেশি বিখ্যাত ও শক্তিশালী ছিলেন পাটলিপুত্রের (বর্তমান পাটনার) নন্দবংশীয় রাজা। তাঁর নিয়মিত বাহিনীতে ছিল আশি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, আট হাজার যুদ্ধরথ ও ছয় হাজার রণহস্তী। দরকার হলে এদের সংখ্যা ঢের বাড়তে পারত, কারণ এর কয়েক বৎসর পরেই দেখি, মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই পাটলিপুত্রের ফৌজ দাঁড়িয়েছে এইরকম : ছয় লক্ষ পদাতিক, তিরিশহাজার অশ্বারোহী, নয় হাজার রণহস্তী এবং অসংখ্য রথ। সুতরাং পাটলিপুত্রের রাজা নন্দের সঙ্গে আলেকজান্ডারের শক্তি পরীক্ষা হলে কী হত বলা যায় না। আলেকজান্ডার পাটলিপুত্রের দিকে আসবার প্রস্তাবও করেছিলেন বটে, কিন্তু সেই প্রস্তাব শুনেই সমগ্র গ্রিকবাহিনী বিদ্রোহের ভাব প্রকাশ করেছিল এবং তার প্রধান কারণই এই যে ক্ষুদ্র রাজা পুরুর দেশেই গ্রিকরা ভারতীয় বীরত্বের যেটুকু তিক্ত আস্বাদ পেয়েছিল, তাদের পক্ষে সেইটুকুই হয়ে উঠেছিল যথেষ্টের বেশি।
তারপর আর এক প্রশ্ন। ভারতবর্ষে আমরা গ্রিক বীরত্বের যে ইতিহাস পাই, তা বহুস্থলেই অতিরঞ্জিত, কোথাও কল্পিত এবং কোথাও অমূলক কিনা? আমার বিশ্বাস, হাঁ। কারণ এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক চিত্রকর নিজের ছবিই নিজে এঁকেছেন। এই খবরের কাগজের যুগে, সদাসজাগ বেতার, টেলিগ্রাফ ও টেলিফোনের রাজ্যেও নিত্যই দেখছি যুদ্ধে নিযুক্ত দুই পক্ষই প্রাণপণে সত্যগোপন করছে, হেরে বলছে হারিনি, সামান্য জয়কে বলছে অসামান্য। সুতরাং সেই কল্পনাপ্রিয় আদ্যিকালে গ্রিকরা যে সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের মতো ইতিহাস লিখেছিল, তা কেমন করে বলি? গ্রিকরা যে কোথাও হারেনি, তাই বা কেমন করে মানি? আধুনিক ইউরোপীয় লেখকরাই গ্রিক ঐতিহাসিকদের কোনও কোনও অতিরঞ্জিত ও অসত্য কথা দেখিয়ে দিয়েছেন। আর একটা লক্ষ করবার বিষয় হচ্ছে, ভারতের বুকের উপর দিয়ে এতবড় একটা ঝড় বয়ে গেল, তবু হিন্দু, বৌদ্ধ বা জৈন সাহিত্যে তার এতটুকু ইঙ্গিত বা উল্লেখ দেখা যায় না! এও অস্বাভাবিক বা সন্দেহজনক।
এবং গ্রিকরা যে অকারণে ভয় পায়নি, তার কিছুদিন পরেই সে প্রমাণ পাওয়া যায়। সে এখন নয়, যথাসময়ে বলব।
গ্রিকদের সঙ্গে ভারতবাসীদের প্রথম মৃত্যুমিলন হয় যে নাট্যশালায়, এখন সেই অঞ্চলের তখনকার অবস্থার সঙ্গে তোমাদের পরিচিত করতে চাই। গল্প বলা বন্ধ রেখে বাজে কথা বলছি বলে তোমাদের অনেকেই হয়তো রাগ করবে। কিন্তু আমাদের দেশের পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে লোকের পরিচয় এত অল্প যে, স্থান-কাল সম্বন্ধে একটু ভূমিকা না দিলে এই ঐতিহাসিক কাহিনির আসল রসটুকু কিছুতেই জমবে না।
সীমান্তের যে প্রদেশগুলি উত্তরভারতবর্ষের সিংহদ্বারের মতো এবং সর্বপ্রথমেই যাদের মধ্য দিয়ে আসবার সময়ে গ্রিকদের তরবারি ব্যবহার করতে হয়েছিল প্রাণপণে, সে-যুগে তাদের কতকগুলি বিশেষত্ব ছিল।
ভারতের উত্তর সীমান্তের দেশগুলিতে আজকাল প্রধানত মুসলমানদের বাস। কিন্তু মহম্মদের জন্মের বহু শত বৎসর আগেই আলেকজান্ডার এসেছিলেন ভারতবর্ষে। সুতরাং পৃথিবীতে তখন একজনও মুসলমান ছিলেন না (একজন ক্রিশ্চানও ছিলেন না, কারণ যিশুখ্রিস্ট জন্মাবার তিনশো সাতাশ বৎসর আগে আলেকজান্ডার সসৈন্যে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেছিলেন)।
ভারতে প্রচলিত তখন প্রধানত বৈদিক হিন্দুধর্ম। ইউরোপীয় গ্রিকরা ছিলেন পৌত্তলিক। কিন্তু আগেই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, হিন্দুরা খুব সম্ভবত তখন প্রতিমা ও মন্দির গড়ে পূজা করতেন না, অথবা করলেও তার বেশি চলন হয়নি। অনেক ঐতিহাসিকের মত হচ্ছে, এদেশে মন্দির ও প্রতিমার চলন হয় গ্রিকদের দেখাদেখি। ভারতে তখন জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মেরও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠা হয়েছে বটে, কিন্তু জৈন ও বুদ্ধেরও কোনও মূর্তি গড়া হয়নি। প্রথম বুদ্ধমূর্তিরও জন্ম গ্রিক প্রভাবের ফলে।
সীমান্তের দেশগুলিতে বাস করত তখন কেবল ভারতের লোক নয়, বাইরেকার নানান জাতি। একদিক থেকে আসত চিনের বাসিন্দারা আর একদিক থেকে আসত মধ্য এশিয়ার শক ও হুন প্রভৃতি যাযাবর জাতিরা এবং আর এক দিক থেকে আসত পারসি ও গ্রিক প্রভৃতি আর্যরা। এমনি নানা ধর্মের নানা জাতির লোকের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে সীমান্তবাসী বহু ভারতীয়ের মনের ভাব হয়ে উঠেছিল অনেকটা সার্বজনীন। এ-অবস্থায় দেশাত্মবোধের ও হিন্দুত্বের ভাবও অনেকটা কমজোরি হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। হয়তো সেই কারণেই সীমান্ত প্রদেশে আজ হিন্দুদের সংখ্যা এত অল্প।
তোমরা শুনলে অবাক হবে, সে-যুগেও ভারতে বিশ্বাসঘাতকের অভাব হয়নি। এ লোকটি আগে ছিল পারসিদের মাহিনা করা সৈনিক, পরে হয় আলেকজান্ডারের বিশ্বস্ত এক হিন্দু সেনাপতি। এর নাম শশীগুপ্ত, গ্রিকরা ডাকত সিসিকোটস বলে। গ্রিকদের সঙ্গে সেও ভারতের বিরুদ্ধে তরবারি ধারণ করে এবং সেও ছিল উত্তর ভারতের বাসিন্দা। আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের পরে সীমান্তের আরও বহু বিশ্বাসঘাতক হিন্দু গ্রিকবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল বা দিতে বাধ্য হয়েছিল।
সে-যুগে সীমান্তের একটি বিখ্যাত রাজ্য ছিল তক্ষশীলা। বর্তমান রাওয়ালপিন্ডি শহর থেকে বিশ-বাইশ মাইল দূরে আজও প্রাচীন তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। কিন্তু এই ধ্বংসাবশেষ দেখে অভিভূত হলেও তক্ষশীলার অতীত গৌরবের কাহিনি আমরা কিছুই অনুমান করতে পারব না। কারণ প্রাচীন প্রাচ্য জগতে তক্ষশীলা ছিল অন্যতম প্রধান নগর। জাতকের মতে, তক্ষশীলা হচ্ছে গান্ধার রাজ্যের অন্তর্গত শহর, ‘মহাভারতে’র রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মহিষী ও দুর্যোধনের মাতা গান্ধারী এই দেশেরই মেয়ে। বর্তমান পেশোয়ারও ওই গান্ধারেরই আর একটি স্থান, কিন্তু তখন তার নাম ছিল ‘পুরুষপুর’। ওখানকার লোকদের দেহ ছিল যে সত্যিকার পুরুষেরই মতো, আজও পেশোয়ারিদের দেখলে সেটা অনুমান করা যায়।
তক্ষশীলা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার জন্যও অত্যন্ত খ্যাতি অর্জন করেছিল। প্রাচীন ভারতের অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র বারাণসীও নানা বিদ্যার জন্যে তক্ষশীলার কাছে ঋণী। বিশেষ করে চিকিৎসা বিদ্যা শেখবার জন্যে তক্ষশীলায় তখন সারা ভারতের ছাত্রদের গমন করতে হত। পাটনা বা পাটলিপুত্রের রাজা বিম্বসারের সভা-চিকিৎসক জীবককে শিক্ষালাভের জন্যে তক্ষশীলায় সাত বৎসর বাস করতে হয়েছিল। পরে সম্রাট কনিষ্কের যুগে তক্ষশীলার আরও উন্নতি হয়, কারণ পুরুষপুরেই ছিল কনিষ্কের রাজধানী। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, শকবংশীয় বৌদ্ধ ভারতসম্রাট কনিষ্ক পুরুষপুরে একটি অপূর্ব মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন, প্রাচীন জগতে যা পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য বলে গণ্য হত। মন্দিরটি কাঠের। তেরতলা। উচ্চতায় চারিশত ফুট—অর্থাৎ কলকাতার মনুমেন্টের চেয়ে কিছু কম তিনগুণ বেশি লম্বা। দ্বিতীয় শতাব্দীতে নির্মিত সে মন্দির এখন আর নেই, গজনীর মুসলমান দিগবিজয়ী মামুদ তাকে ধ্বংস করেছিলেন।
তক্ষশীলার কাছেই ছিল রাজা হস্তীর রাজ্য। পরের পরিচ্ছেদে গল্প শুরু হলেই তোমরা এঁর কথা শুনবে।
আলেকজান্ডার যখন ভারতে পদার্পণ করেন, সেই সময়ে দুই প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে তক্ষশীলার যুদ্ধ চলছিল। তার একটি হচ্ছে ক্ষুদ্র পার্বত্য রাজ্য, নাম ‘অভিসার’ (আজও এর সঠিক অবস্থানের কথা আবিষ্কৃত হয়নি)। আর একটি হচ্ছে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ রাজ্য, ইতিহাস-বিখ্যাত পুরু ছিলেন তার রাজা। ঝিলম ও চিনাব নদের মধ্যবর্তী স্থলে ছিল পুরুর রাজ্য বিস্তৃত এবং তার নগরের সংখ্যা ছিল তিন শত। সুতরাং বোঝা যায় পুরু বড় তুচ্ছ রাজা ছিলেন না। তাঁর সৈন্যসংখ্যাও ছিল পঞ্চাশ হাজার।
কিন্তু সীমান্তে এখনকার মতন তখনও পার্বত্য খণ্ডরাজ্য ছিল অনেক। গ্রিকদের বিবরণীতে বহু দেশের নাম পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁরা ভারতীয় নাম আয়ত্তে আনতে পারতেন না বলে বিকৃত করে লিখতেন। এই দেখ না, চন্দ্রগুপ্তকে তাঁরা বলতেন, স্যান্ড্রাকোটস! কাজেই গ্রিকদের পুথিপত্রে সীমান্তের অধিকাংশ দেশের নাম পড়ে আজ আর কিছু ধরবার উপায় নেই, বিশেষ একে তো সেই সব খণ্ডরাজ্যের অনেকগুলিই পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তার উপরে বাকি যাদের অস্তিত্ব আছে, মুসলমান ধর্ম অবলম্বন করে তারাও আপনাদের নতুন নতুন নাম রেখেছে—যেমন ‘পুরুষপুর’ হয়েছে ‘পেশোয়ার’। কোনও কোনও গ্রিক নামের সঙ্গে আবার আসল নামের কিছুই সম্পর্ক নেই। যেমন ঝিলম নদ গ্রিকদের পাল্লায় পড়ে হয়েছে Hydaspes এবং চিনাব নদ হয়েছে Akesines!
যাক, নাম নিয়ে বড় আসে যায় না। কারণ নাম বা রাজ্য লুপ্ত হোক, সীমান্তের দেশগুলি আগেও যেমন ছিল এখনও আছে অবিকল তেমনি। উপরন্তু সেখানকার জড় পাহাড় ও পাথরের মতোই জ্যান্ত মানুষগুলিরও ধাত একটুও বদলায়নি! আজও তাদের কাছে জীবনের সব চেয়ে বড় আমোদ হচ্ছে মারামারি, খুনোখুনি, যুদ্ধবিগ্রহ। যখন বাইরের শত্রু পাওয়া যায় না, তখন তারা নিজেদের মধ্যেই দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে দেয়। প্রথম বয়সে আমি ওই অঞ্চলে বৎসরখানেক বাস করেছিলুম। সেই সময়েই প্রমাণ পেয়েছিলুম, মানুষের প্রাণকে তারা নদীর জলের চেয়ে মূল্যবান বলে ভাবে না। বর্তমান পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি ব্রিটিশ-রাজ পর্যন্ত তাদের অত্যাচারে সর্বদাই তটস্থ, সর্বদাই বাপু-বাছা বলে ও মোটা টাকা ভাতা দিয়ে তাদের মাথা ঠান্ডা রাখবার চেষ্টায় থাকেন। কারণ উড়োজাহাজের বোমা, মেশিনগানের গোলা ও ব্রিটিশ সিংহের গর্জন এদের কোনওটিই তাদের যুদ্ধ উন্মাদনাকে শান্ত করতে পারে না। মরণখেলা তারা খেলবেই এবং মরতে মরতে মারবেই।
আলেকজান্ডারের যুগে তারা মুসলমান ছিল না, হয়তো আর্য ও সভ্যও ছিল না, কিন্তু হিন্দুই ছিল বলে মনে করি। এবং তাদের শৌর্য-বীর্য ছিল এখনকার মতোই ভয়ানক! ভারতের বিপুল সিংহদ্বারের সামনে এই নির্ভীক, যুদ্ধপ্রিয় দৌবারিকদের দেখে গ্রিক দিগবিজয়ীকে যথেষ্ট দুর্ভাবনায় পড়তে হয়েছিল। এদের পিছনে রেখে ভারতবর্ষের বুকের ভিতরে প্রবেশ করা আর আত্মহত্যা করা যে একই কথা, সেটা বুঝতে তাঁর মতো নিপুণ সেনাপতির বিলম্ব হয়নি। তাই ভারত-বিজয়ের স্বপ্ন ভুলে বিরাট বাহিনী নিয়ে সর্বাগ্রে তাঁকে এদেরই আক্রমণ করতে হয়েছিল এবং তখনকার মতো এদের টিট করবার জন্যে তাঁর কেটে গিয়েছিল বহুকাল।
যে রঙ্গমঞ্চের উপরে অতঃপর আমাদের মহানাটকের অভিনয় আরম্ভ হবে, তার পৃষ্ঠপটের একটি রেখাচিত্র এখানে এঁকে রাখলুম। এটি তোমরা স্মরণ করে রেখো। শত শত যুগ ধরে এই পৃষ্ঠপটের সুমুখ দিয়ে এসেছে দিগবিজয়ের স্বপ্ন দেখে, দেশ-লুণ্ঠনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, অথবা সোনার ভারতে স্থায়ী ঘর বাঁধবে বলে পঙ্গপালের মতো লক্ষ লক্ষ বিদেশি। তাদের দৌরাত্ম্যে আজ সোনার ভারতের নামমাত্র অবশিষ্ট আছে, কিন্তু এখানে আর সোনা পাওয়া যায় না।
তোমরা গল্প শোনবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছ?
মনে আছে, ভারতপুত্র সুবন্ধু ফিরে আসছে আবার তার পিতৃভূমিতে,—দুই চক্ষে তার উন্মত্ত উত্তেজনা, দুই চরণে তার কালবৈশাখীর প্রচণ্ড গতি?
তারপর সুবন্ধু কিনেছে একটি ঘোড়া, কিন্তু পথশ্রমে ও দ্রুতগতির জন্যে সে মারা পড়ল। দ্বিতীয় ঘোড়া কিনলে, তারও সেই দশা হল। কিন্তু তার তৃতীয় অশ্ব মাটির উপর দিয়ে যেন উড়ে আসছে পক্ষীরাজের মতো!
বহুযুগের ওপার থেকে তার ঘোড়ার পদশব্দ তোমরা শুনতে পাচ্ছ?
সুবন্ধু এসে হাজির হয়েছে ভারতের দ্বারে। কিন্তু তখনও কারুর ঘুম ভাঙেনি।…জাগো ভারত! জাগো পঞ্চনদের তীর!