উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

পঞ্চম পরিচ্ছেদ । মারি তো গন্ডার

পঞ্চম পরিচ্ছেদ । মারি তো গন্ডার

এইবারে আমরা যে ভয়ঙ্কর ও অতুলনীয় বোম্বেটের কথা আরম্ভ করব, তার নাম হচ্ছে ফ্রান্সিস লোলোনেজ। জাতে ফরাসি। রোমাঞ্চকর তার কাহিনি।

ফ্রান্স থেকে নির্বাসিত হয়ে সে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসে। মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে পর ছাড়া পায়। কিন্তু তারপর সে আর স্বদেশে ফিরে না গিয়ে হাইতি দ্বীপে এসে আশ্রয় নেয়। প্রথমে হয় শিকারি, তারপর বোম্বেটে। তার ভবিষ্যৎ জীবন কী ভয়াবহ হবে এবং সে যে কত প্রলয়কাণ্ডের অনুষ্ঠান করবে, কর্তৃপক্ষ যদি তা কল্পনাও করতে পারতেন, তাহলে কখনওই তাকে মুক্তি ও স্বাধীনতা দিতেন না। বোম্বেটে রূপে সে হয়ে উঠেছিল মূর্তিমান নরপিশাচ! অথচ তার সাহস, বুদ্ধি, বীরত্ব, উৎসাহ ও উদ্যম ছিল অসাধারণ। মানুষ এইসব দুর্লভ গুণের জন্যে আজন্ম সাধনা করে। কিন্তু অপাত্রে এইসব গুণ যে কতটা সাংঘাতিক হতে পারে, লোলোনেজ হচ্ছে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

টর্টুগা দ্বীপ তখন ফরাসিদের অধিকারে এসেছে। সেখানকার লাটও ফরাসি। তখন স্পানিয়ার্ডদের সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্ক ছিল সাপ আর নেউলের সম্পর্ক।

আগেই বলেছি, এখানকার লাটেরা প্রায়ই সাধু মানুষ হতেন না, তাঁরা নিজেরাই বোম্বেটে পুষতেন। টর্টুগার ফরাসি লাট লোলোনেজকে বুদ্ধিমান ও সাহসী দেখে তার উপরে দয়া করলেন। অর্থাৎ তাকে একখানা জাহাজ ও লোকজন দিয়ে কাপ্তেন করে দিলেন। তারপর কাপ্তেন লোলোনেজ সমুদ্রের নীলজলে নিজের অদৃষ্ট পরীক্ষা করতে বেরুল। কিন্তু সে-ও যদি তখন নিজের ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারত, তাহলে সভয়ে এ পথ ছেড়ে ফিরে আসত। অদৃষ্টকে আগে থাকতে দেখা গেলে পৃথিবীর অনেক দুঃখই ঘুচে যেত—মানুষ এমন অন্ধের মতো বিপথে ঘুরে মরত না।

প্রথম কিছুকাল বেশ সুখেই কাটল। লোলোনেজ উপর-উপরি স্পানিয়ার্ডদের কয়েকখানা ধনরত্নে ও বাণিজ্যদ্রব্যে পরিপূর্ণ জাহাজ দখল করে ডাকসাইটে নাম কিনে ফেললে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে স্পানিয়ার্ডদের উপরে তার ভীষণ নিষ্ঠুরতার কাহিনিও চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল—তারা বুঝল, আবার এক মারাত্মক আপদের আবির্ভাব হয়েছে। তখন তারাও মরিয়া হয়ে উঠল! লোলোনেজ তাদের আক্রমণ করলে তারা আর সহজে আত্মসমর্পণ করতে চাইত না—কারণ তারা বুঝে নিয়েছিল যে লোলোনেজের কাছে তাদের ক্ষমা নেই, সে তাদের কয়েদ করতে পারলে বিষম যন্ত্রণা দিয়ে প্রাণবধ না করে ছাড়বে না। তার চেয়ে লড়াই করে বা জলে ডুবে মরা ঢের ভালো!

তারপরই লোলোনেজ অদৃষ্টের কাছ থেকে প্রথম ধমক খেলে। আচম্বিতে একদিন নাবিকদের সবচেয়ে বড় শত্রু ঝড় এসে তার জাহাজ ডুবিয়ে দিলে। সে আর তার সঙ্গীরা সমুদ্রের কবল থেকে কোনওগতিকে বাঁচল বটে, কিন্তু ব্রেজিলিয়ানোর মতো সেও তীরে উঠে স্তম্ভিত নেত্রে দেখলে, দলে দলে স্পানিয়ার্ড অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসছে দলবদ্ধ যমের মতো!

যুদ্ধ হল। কিন্তু শত্রুরা দলে এত ভারী ছিল যে, লোলোনেজের সঙ্গীরা অধিকাংশই প্রাণ হারালে—যারা বাঁচল, বন্দি হল।

লোলোনেজও আহত হল, কিন্তু চালাকির জোরে শত্রুদের চোখে ধুলো দিলে। নিজের ক্ষতের রক্তের সঙ্গে তাড়াতাড়ি সমুদ্র তীরের বালি মিশিয়ে সে তার মুখে ও দেহের নানা জায়গায় মাখিয়ে ফেলল এবং বোম্বেটেদের মৃতদেহের সঙ্গে মিশিয়ে মড়ার মতো মাটিতে পড়ে রইল। শত্রুরা তাকে মৃত মনে করে চলে গেল।

লোলোনেজ তখন উঠে বনের ভিতর গিয়ে ঢুকল। আগে নিজের দেহের ক্ষতস্থানগুলো যেমন তেমন করে ব্যান্ডেজ করে ফেললে। তারপর এক শহরে গিয়ে স্পানিয়ার্ডের ছদ্মবেশ গ্রহণ করলে।

স্পানিয়ার্ডরা অনেক ক্রীতদাস রাখত। কয়েকজন ক্রীতদাসের সঙ্গে তার আলাপ হল এবং দিনকয়েকের ভিতরেই সে আলাপ জমিয়ে তুলল রীতিমতো।

সে তাদের বললে, ‘তোমরা যদি আমার কথা শোনো, তাহলে আমি তোমাদের স্বাধীন করে দেব। তোমাদের মনিবের একখানা নৌকো চুরি করে আমার সঙ্গে চলো,—আমি তোমাদের রক্ষা করব।’

অবশেষে তারা রাজি হয়ে গেল। এবং একখানা নৌকো চুরি করে লোলোনেজের সঙ্গে জলপথে বেরিয়ে পড়ল।

ওদিকে স্পানিয়ার্ডরা লোলোনেজের সঙ্গীদের খুব সাবধানে বন্দি করে রাখলে। এবং যখন শুনলে যে লোলোনেজ আর বেঁচে নেই, তখন তাদের আনন্দের আর সীমা-পরিসীমা রইল না। এত বড় শত্রু নিপাত হয়েছে শুনে চারিদিকে আলোকমালা সাজিয়ে তারা উৎসবে মত্ত হয়ে উঠল।

লোলোনেজ ফিরে এসে সব দেখলে—সব শুনলে। তারপর সেখান থেকে সরে পড়ে একেবারে টুর্টুগা দ্বীপে এসে হাজির!

ওয়েস্ট ইন্ডিজে যত শয়তান আছে, এই দ্বীপ হচ্ছে তাদের নিরাপদ স্বদেশ। তার উপরে লোলোনেজ হচ্ছে তখন একজন নামজাদা ব্যক্তি—তার কীর্তিকাহিনি লোকের মুখে মুখে। সুতরাং এখানে এসে একখানা ছোটখাটো জাহাজ ও লোকজন জোগাড় করতে তার বেশিদিন লাগল না। একুশজন লোক ও দরকার মতো হাতিয়ার জোগাড় করে এবারে সে কিউবা দ্বীপের দিকে বেরিয়ে পড়ল। এই দ্বীপের দক্ষিণে এক শহর তখন তামাক, চিনি ও চামড়ার ব্যবসার জন্যে বিখ্যাত। লোলোনেজ আন্দাজ করলে যে, সেখানে নিশ্চয়ই কোনও বড়গোছের শিকার পাওয়া যাবে।

নিজেদের সৌভাগ্যক্রমে কয়েকজন জেলে মাছ ধরতে ধরতে তাকে দেখেই চিনে ফেললে এবং তখনই চটপট দ্বীপের লাটসাহেবের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়ে পড়ে বললে, ‘হুজুর, রক্ষা করুন! লোলোনেজ আমাদের সর্বনাশ করতে এসেছে!’

লাটসাহেবের কাছে তখন খবর গিয়ে পৌঁছেছে যে, লোলোনেজ আর বেঁচে নেই। তাই তিনি জেলেদের কথায় নির্ভর করতে পারলেন না। তবু সাবধানের মার নেই ভেবে তিনি জেলেদের সঙ্গে একখানা বড় জাহাজ, নব্বইজন সৈনিক ও দশটা কামান পাঠিয়ে দিলেন। জাহাজের সেনাপতির উপরে হুকুম রইল—’বোম্বেটে বিনাশ না করে তিনি যেন ফিরে না আসেন। প্রত্যেক বোম্বেটেকে ফাঁসিকাঠে লটকে আসতে হবে—কেবল দলের সরদার লোলোনেজ ছাড়া। তাকে জ্যান্ত বন্দি করে হাভানা শহরে ধরে আনতে হবে।’ জাহাজের সঙ্গে একজন জল্লাদও চলল।

জাহাজখানা ঘটনাস্থলে এল। বোম্বেটেদের গুপ্তচর সরদারকে এসে খবর দিলে—’লাটসাহেবের জাহাজ তাদের ধরবার জন্যে বন্দরে গিয়ে হাজির হয়েছে।’

কিন্তু লোলোনেজ এত সহজে ভড়কে যাওয়ার ছেলে নয়। সে বলল, ‘আমি পালাব না। ওই জাহাজখানাকেই আমরা বন্দি করব। আমাদের একখানা ভালো জাহাজ দরকার!’

বোম্বেটেরা জনকয় জেলেকে ধরে ফেলল। লোলোনেজ তাদের বললে, ‘আজ রাত্রে বন্দরে ঢোকবার পথ আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে। নইলে তোদের খুন করব।’

জেলেরা বাধ্য হয়ে সেই রাত্রে তাদের নিয়ে বন্দরে গিয়ে ঢুকল।

লাটের জাহাজের প্রহরী জিজ্ঞাসা করলে, ‘কে তোমরা?’

প্রাণের দায়ে জেলেরা বললে, ‘আমরা জেলে।’

‘বোম্বেটেরা এখন কোথায়?’

‘আমরা কোনও বোম্বেটে দেখিনি।’

জাহাজের লোকরা ভাবলে, তাদের দেখে কাপুরুষ বোম্বেটেরা নিশ্চয়ই ভয়ে লম্বা দিয়েছে।

ভোর যখন হয় হয় তাদের ভুল ভাঙল তখন। বোম্বেটের দল দুই পাশ থেকে জাহাজ আক্রমণ করেছে!

স্পানিয়ার্ডরা বীরের মতো লড়াই করলে, কিন্তু তবু হেরে গেল। এরা দুর্জয় শত্রু, আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় নেই।

জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বিজয়ী লোলোনেজ বলল, ‘স্পানিয়ার্ডগুলোকে একে একে আমার সামনে নিয়ে এসো।’

বন্দিদের একে একে সরদারের সামনে আনা হতে লাগল।

লোলোনেজ বলল, ‘একে একে এদের মাথা কেটে ফেলো।’

একে একে তাদের মাথা উড়ে গেল।

সবশেষে নিয়ে আসা হল সেই জল্লাদকে। জাতে সে কাফ্রি।

জল্লাদ সরদারের হাতে পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললে, ‘আমাকে মারবেন না হুজুর! আপনি যা জানতে চান সব কথা খুলে বলব—কিছু লুকোব না।’

লোলোনেজ তাকে গোটাকয়েক গুপ্তকথা জিজ্ঞাসা করলে। প্রাণরক্ষার আশায় সে সব কথার সঠিক জবাব দিল।

লোলোনেজ বলল, ‘আর কিছু জানিস না?’

‘না হুজুর!’

লোলোনেজ বললে, ‘এ কালামানিককে নিয়ে আর আমার দরকার নেই। এর মাথাটা কেটে ফেলো।’

জল্লাদেরও মাথা উড়ে গেল।

কেবল একজন লোককে বোম্বেটেরা বধ করল না।

তাকে ডেকে লোলোনেজ বললে, ‘যা, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যা! তোদের লাটসাহেবকে আমার এই কথাগুলো জানিয়ে দিস : আজ থেকে কোনও স্পানিয়ার্ডকে আমি আর একফোঁটাও দয়া করব না। লাটসাহেব আমাদের উপরে যে অসীম দয়া প্রকাশের চেষ্টা করেছিলেন তাও আমি কখনও ভুলব না। আমি খুব শীঘ্রই তাঁর উপরেও ঠিক সেইরকম দয়া দেখাবার জন্যে ফিরে আসব।’

লাটসাহেব সব শুনে রাগে তিনটে হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, এবার থেকে কোনও বোম্বেটেকে হাতে পেলে আমিও ছেড়ে কথা কইব না—তার একমাত্র দণ্ড হবে প্রাণদণ্ড!’

হাভানার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বললেন, ‘কখনও অমন প্রতিজ্ঞা করা উচিত নয়! তাহলে বোম্বেটে ধরা পড়ুক আর না পড়ুক—আমাদেরই মারা পড়বার সম্ভাবনা বেশি!’

লাটসাহেব তখন মনের রাগ মনেই পুষে নিজের প্রতিজ্ঞাকে বাতিল করতে বাধ্য হলেন।

লোলোনেজ কিছুদিন ধরে সমুদ্রের এ বন্দর থেকে ও বন্দরে জাহাজ নিয়ে ঘুরে বেড়াল এবং একখানা খুব মূল্যবান জাহাজকেও বন্দি করল—তার ভিতরে অনেক সোনা-রুপোর তাল ছিল তারপর রীতিমতো ধনীর মতো সে আবার বোম্বেটে দ্বীপে—অর্থাৎ টর্টুগায় ফিরে এল। সেখানকার বাসিন্দারা মহাসমারোহে তাকে সংবর্ধনা করল!

লোলোনেজের মাথার ভিতরে তখন এমন এক বিরাট ফন্দির উদয় হয়েছে, এতদিন বোম্বেটে জগতে যা কল্পনাতীত ছিল। বোম্বেটে বলতে বোঝায়, জলপথে যারা ছোটখাটো নৌকো বজরা বা বড়জোর জাহাজ লুট করে। সেই লুটের মাল নিয়েই তারা খুশি হয়ে গা-ঢাকা দেয়।

কিন্তু লোলোনেজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এইটুকুতেই তৃপ্ত হয়ে থাকতে পারলে না। সে দেখাতে চায়, ইচ্ছা করলে বোম্বেটেরাও কত অসামান্য কাজ করতে পারে!

তার ফন্দি হচ্ছে এই, লুটের মাল বেচে এবারে সে অনেকগুলো জাহাজ কিনে প্রকাণ্ড এক নৌবাহিনী গঠন করবে। তার অধীনে বোম্বেটে সৈন্যের সংখ্যা হবে অন্তত পাঁচশত! তারপর সে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নানা স্পেনীয় রাজ্যে হানা দিয়ে গ্রাম ও ছোট-বড় নগর লুণ্ঠন করবে!

তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত উচ্চ! স্পেনরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা! স্পেন সাম্রাজ্য সে সময়ে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল—ইউরোপের কোনও শক্তিই তার কাছে পাত্তা পেত না!

বোম্বেটে দ্বীপও লোলোনেজের এ অসম্ভব প্রস্তাব শুনে আনন্দে ও উৎসাহে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল! মারি তো গণ্ডার—লুটি তো ভাণ্ডার!