পঞ্চম খণ্ড – সন্দেহ-ভঞ্জন (মেঘ কাটিয়া গেল—দিবালোক)
প্রথম পরিচ্ছেদ – আশ্চর্য্য বৈরভাব
লাস-চুরি ও খুনের অপরাধে ডাক্তার বেন্টউড ধৃত হইয়াছেন শুনিয়া, গ্রামের সর্ব্বত্র একটা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। গ্রামের যাঁহারা বেন্টউডকে ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন, তাহারা এ সংবাদে সুখী হইলেন। এবং কেহ কেহ এত বড় একজন ডাক্তারকে এরূপ বিপদগ্রস্ত দেখিয়া সহানুভূতিসূচক দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। যাঁহার মনে যে ভাবোদয় হউক না কে, বেন্টউড ধৃত হওয়ায় কি শত্রু কি মিত্র সকলেরই হৃদয় মহাকৌতূহলাক্রান্ত হইয়া উঠিল। বিশেষতঃ অমরেন্দ্রকে পরমশত্রু বেন্টউডের পক্ষ সমর্থনে নিযুক্ত দেখিয়া তাঁহারা সকলেই অজ্ঞাতপূর্ব্ব রহস্যরসাতলের শেষ সীমায় যাইয়া উপনীত হইলেন; এবং অমরেন্দ্রের কাণ্ডকারখানা দেখিয়া সকলেই সাশ্চর্য্যে নানারকমে আজ তাঁহার নিন্দাবাদে প্রবৃত্ত হইলেন।
এদিকে দত্ত সাহেব যেমন বন্দী বেন্টউডকে অপরাধী সাব্যস্ত করিবার জন্য প্রাণপণে প্ৰমাণ সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। অপরদিকে তেমনি অমরেন্দ্রনাথও বন্দীকে নির্দোষ প্রমাণিত করিবার উপাদান অন্বেষণে ঘুরিতে লাগিলেন।
একদিন দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রকে ডাকিয়া কহিলেন, “অমর, তোমার এ সকল বিসদৃশ আচরণের কারণ কি, তাহা আজ আমাকে বলিতে হইবে। কেন, তুমি আমার সহিত এরূপ ব্যবহার করিতেছ?”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমি আপনাকে আপাততঃ কোন কথা বলিব না। বলিবার কোন আবশ্যকতাও নাই।”
অমরেন্দ্রনাথের উত্তরে দত্ত সাহেব নিজেকে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করিলেন, মস্তিষ্ক উষ্ণ হইয়া উঠিল, তিনি নিজেকে কিছুতেই সাম্লাইতে পারিলেন না। চোখ রাঙাইয়া কম্পিত কলেবরে বলিলেন, “এতদূর স্পর্দ্ধা! বিশ্বাসঘাতক! কাপুরুষ! অকৃতজ্ঞ! তুমি আমার বাড়ীতে বসিয়া আমারই মুখের উপরে সমান উত্তর করিতেছ?”
অমরেন্দ্রনাথের মলিন মুখমণ্ডলে আর একটা কাল ছায়া পড়িল! কহিলেন, “আমি বিশ্বাসঘাতক হইলাম কিসে?”
দত্ত সাহেব উগ্রভাবে কহিলেন, “আমি তোমাকে লালিত-পালিত ও সুশিক্ষিত করিবার জন্য কি কষ্টই না স্বীকার করিয়াছি; এরূপ স্থলে আমার সহিত এইরূপ ব্যবহার করিতে দেখিয়া তোমাকে কে না বিশ্বাসঘাতক বলিবে?”
অমরেন্দ্র কহিলেন, “আমার বিশ্বাসঘাতকতার কারণ বুঝিলাম। কিন্তু ইহাতে আমার কাপুরুষতা কি দেখিলেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “তুমি যখন তোমার ভ্রাতৃহত্যাকারীর ভয়ে, তাহারই পক্ষ সমর্থন করিতে প্রস্তুত হইয়াছ, তখন ইহাপেক্ষা লোকের আর কি কাপুরুষতা হইতে পারে। আর তুমি অকৃতজ্ঞ কেন, সে কথা কি তোমাকে এখন বুঝাইয়া দিতে হইবে? তাহা কি তুমি নিজে নিজে বুঝিতে পার নাই?”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “বুঝিয়াছি। আমাকে আর কিছু বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। আপনারই বুঝিবার ভ্রম হইয়াছে।”
নিদারুণ রোষে দত্ত সাহেব পুনঃপ্রজ্বলিত হইয়া কহিলেন, “আমার ভ্রম! কিরূপে আমার ভ্রম হইবে? তুমি আত্মীয়ের বিপক্ষে—শত্রুর পক্ষ সমর্থন করিতেছ, এ কথা শুনিয়া অপর লোকেই বা তোমাকে কি বলিবে?”
স্থিরকণ্ঠে গম্ভীরমুখে অমরেন্দ্র উত্তর করিলেন, “আপনি যেমন আমার নিন্দাবাদ করিতেছেন, তাহারাও সেইরূপ করিবে মাত্র। তাহাতে ক্ষতি কি? আমি সাধারণের মতামত বড় একটা গ্রাহ্য করি না। আমি নিজের মতে যাহা ভাল বুঝিব, তাহাই করিব।”
রোষবিস্ময়বিক্ষুব্ধ হৃদয়ে দত্ত সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ঘৃণাভরে কহিলেন, “তুমি নিজের মতে যাহা ভাল বুঝিবে, তাহা করিবে? অমর, কাহার সমক্ষে দাঁড়াইয়া, কাহার কথার উপরে তুমি এই সকল উত্তর করিতেছ, ভাবিয়া দেখ; ইহার জন্য আমি কিছুতেই তোমাকে ক্ষমা করিব না।”
অ। এখন ক্ষমা না করেন, ভবিষ্যতে করিবেন।
দত্ত। ভবিষ্যতে ক্ষমা করিবার কারণ?
অ। ভবিষ্যতে তাহা শুনিতে পাইবেন। আপাততঃ আপনাকে আমি কিছুই বলিব না।
দত্ত। বটে, পরে আমি তোমার এই ঘৃণ্য আচরণের কারণ জানিতে পারিব?
অমরেন্দ্র ক্ষণেক চিন্তিতভাবে থাকিয়া কহিলেন, “হাঁ, এখন নহে—ডাক্তার বেন্টউডের বিচারকালে আদালত তাহা আপনি জানিতে পারিবেন। বেন্টউডের পক্ষ সমর্থনের জন্য আমি তাহা যথাসময়ে আদালতে প্রকাশ করিব।”
অমরেন্দ্রের কথায় দত্ত সাহেবের কৌতূহল, ক্রোধের মাত্রা অতিক্রম করিয়া উঠিল। কহিলেন, ‘তোমার এ সকল কথার অর্থ কি? কিছুতেই তুমি তোমার মনের অভিপ্রায় প্রকাশ করিতে চাহিতেছ না। তুমি কি ডাক্তার বেন্টউডকে নির্দোষ মনে করিয়াছ? সত্য বলিবে।”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “আমি আপনার প্রতিবাদীর পক্ষ সমর্থনে নিযুক্ত, সুতরাং আপনি আমার কাছে এরূপ কোন প্রশ্নের উত্তর পাইবেন না।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “আমি তোমাকে এত বড়টা করিলাম, আর তুমি আমার এই একটা প্রশ্নের উত্তর করিতে পার না? অমর, আমার ভ্রম ঘুচিয়াছে, আমি তোমাকে মানুষ গড়ি নাই— বানর গড়িয়াছি।”
অমরেন্দ্র কহিলেন, “আদালতে বিচারকালে আপনি সকলই শুনিতে পাইবেন।”
অমরেন্দ্রের এই অবাধ্যতা এবং দৃঢ়তায় দত্ত সাহেব আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। কহিলেন, “অমর, তোমার এই সকল কাণ্ডকারখানায় আমাকে বিষম সমস্যার পড়িতে হইয়াছে; ভাল, তুমি যখন আপাততঃ আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর করিতে একান্ত অসম্মত, তখন আমি বেন্টউডের বিচারকাল পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিব। সম্মত হও, তখন তুমি আমার কাছে সকল কথা খুলিয়া বলিবে।”
অমরেন্দ্র কহিলেন, “নিশ্চয়ই। আমি এইমাত্র আপনাকে বলিয়াছি, বিচারকালে সৰ্ব্বসমক্ষে তাহা স্বীকার করিব। তখন আপনার নিকটে আমার এইরূপ অবাধ্যতা প্রকাশের প্রকৃত কারণ জানিতে পারিয়া, নিশ্চয়ই আপনি আমার উপরে সন্তুষ্ট না হইয়া থাকিতে পারিবেন না।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বেশ তাহাই হইবে। আপাততঃ আমি তোমার সম্বন্ধে আর কোন কথায় থাকিব না। এদিকে আমি বেন্টউডকে দোষী সপ্রমাণ করিবার জন্য যেমন চেষ্টা করিতেছি, তুমিও তেমনি তাহার মুক্তির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা কর। তুমি তোমার সপক্ষে বা বিপক্ষে কোন কথা আমার মুখে আর শুনিতে পাইবে না। কিন্তু বিচারকালে তোমাকে সকল কথা প্রকাশ করিতে হইবে।”
অমর। সে বিষয়ে আপনি এখন নিশ্চিন্ত থাকুন।
দত্ত। কিন্তু যতক্ষণ না তুমি আমার কাছে সে সকল কথা প্রকাশ করিতেছ, ততক্ষণ তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই। নাই কেন—শত্রুসম্পর্ক। এরূপ স্থলে আমার এখানে আর তোমার অবস্থিতি করা এখন ঠিক হয় না। তুমি অদ্যই আমার বাড়ী ত্যাগ করিবে।
নতমুখে অমরেন্দ্র কহিলেন, “আপনি যে এরূপ একটা বন্দোবস্ত করিবেন, আমি তাহা পূৰ্ব্বেই অনুভবে বুঝিতে পারিয়াছিলাম। যাই হোক্, আমি এখনই আলিপুরে গিয়া ডাক্তার বেন্টউডের বাড়ীতে বাসা ঠিক করিয়া লইব। যতদিন মোকদ্দমা শেষ না হয়, ততদিন সেইখানেই থাকিব। ডাক্তার বেন্টউডকে এই বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিবার জন্য সেইখান হইতেই আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিব। মোকদ্দমা শেষ হইলে, তখন আপনি যদি আমাকে আপনার পুনরাশ্রয় প্রদানের যোগ্য বিবেচনা করেন, স্থান দিবেন; আর যদি অযোগ্য বিবেচনা করেন আমার এই বিদায়ই চিরবিদায়।”
একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “বুঝিয়াছি, অমর, আর বলিতে হইবে না। যখন বিপদ আসে, তখন এমনই চারিদিক্ অন্ধকার করিয়া আসে। তুমি আমার সহিত এখন যেরূপ গর্হিত আচরণ করিতেছ, ইহার মধ্যে যেমনই কোন গূঢ় কারণ থাক্ না কেন, আমার কিছুমাত্র বিশ্বাস নাই যে, সেই কারণেরই জন্য ভবিষ্যতে তোমাকে আমি একদিন ক্ষমা করিতে পারিব।”
অমরেন্দ্র কহিলেন, “পূর্ব্বে একবার আপনি আমার এইরূপ অবাধ্যতার মার্জ্জনা করিয়াছেন; পরেও আপনাকে তাহাই করিতে হইবে। কিন্তু যতক্ষণ না বিচার শেষ হইতেছে, ততক্ষণ আমাদের মধ্যে যেন কোন সম্পর্ক নাই—পরস্পর অপরিচিত—এইরূপ ভাবে উভয়কেই থাকিতে হইবে।” এই বলিয়া নতমস্তকে অমরেন্দ্র তথা হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
স্বেদসিক্ত ললাটে হন্তার্পণ করিয়া দত্ত সাহেব একাকী বসিয়া রহিলেন। অমরেন্দ্রের সম্বন্ধে অনেক কথা তাঁহার মনে উঠিতে লাগিল। আপন মনে তিনি কহিলেন, “বেন্টউডের বিচারের দিন অমর নিজের এই উন্মত্ততা ছাড়া আর কি প্রকাশ করিবে? অমরের মস্তিষ্ক একেবারে বিগড়াইয়া গিয়াছে—সে এখন বদ্ধ পাগল।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – উদ্যোগ-পৰ্ব্ব
সেইদিন অমরেন্দ্রনাথ আলিপুরে বেন্টউডের বাটীতে যাইয়া আশ্রয় লইলেন। আবশ্যক বুঝিলেই সেইখান হইতেই তিনি বেন্টউডের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন; এবং নির্বিঘ্নে ইচ্ছামত সময়ে কয়েদখানায় যাতায়াত করিতেন।
একদিন অমরেন্দ্রনাথ বেন্টউডকে কহিলেন, “শুনিতেছি, জুলেখা আপনার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে।”
বেন্টউড কহিলেন, “সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। যতক্ষণ আমার কাছে এই টম্বরু পাথর আছে, ততক্ষণ সে কিছুতেই আমার বিপক্ষে একটা কথাও প্রকাশ করিবে না।”
জুলেখার সম্বন্ধে এক প্রকার কৃতনিশ্চয় হইয়া অমরেন্দ্রনাথ অনেকটা নিশ্চিন্ত হইতে পারিলেন। কহিলেন, “তাহা হইলে আমি আপনাকে নিশ্চয়ই এ বিপদ্ হইতে উদ্ধার করিতে পারিব। জুলেখাকেই আমার ভয়।”
বেন্টউড কহিলেন, “হাঁ, জুলেখা আমার বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে ভয়েরই কথা বটে। কিন্তু আমি বেশ বলিতে পারি, আমার কাছে টম্বরু পাথর থাকিতে প্রাণান্তেও তাহার মুখ দিয়া আমার বিপক্ষে একটি বর্ণও বাহির হইবে না।”
এদিকে দত্ত সাহেব ইনস্পেক্টর গঙ্গারামের সহিত মিলিয়া বেন্টউডের বিরুদ্ধে কেস্টা খুব ভারী করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। যথাসময়ে বেন্টউডের বাটী যথাসাধ্য অনুসন্ধান করা হইল—লাস পাওয়া গেল না। সুরেন্দ্রনাথের হত্যায় বিষ-গুপ্তি চুরির যেমন একটা স্পষ্ট কারণ পাওয়া যায়, ডাক্তারের এই লাসচুরি ও লাস গোপন করিবার তেমন কোন একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ স্থির করিতে না পারিয়া দত্ত সাহেব মনে মনে অত্যন্ত অস্থির হইতে লাগিলেন।
বেন্টউডও লাস-চুরি সম্বন্ধে কোন কথা তাঁহার পক্ষসমর্থনকারী নবীন ব্যারিষ্টার অমরেন্দ্রনাথের নিকটেও এ পর্যন্ত প্রকাশ করেন নাই।
ইতিমধ্যে গঙ্গারাম, বেন্টউডের বিরুদ্ধে সাতজন সাক্ষী ঠিক করিয়া ফেলিয়াছেন। প্রথম সাক্ষী সেলিনার মা–মিসেস্ মার্শন, মধ্যে মধ্যে ঝাড়ফুঁক্ মন্ত্রের অজুহাত দেখাইয়া জুলেখা যে তাঁহাকে হিপ্নটাইজ করিত—তাহা তিনি বলিবেন। দ্বিতীয় সাক্ষী সেলিনা; সুরেন্দ্রনাথের খুন হইবার পূর্ব্বে জুলেখা একদিন বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়া আনিবার জন্য তাহার মাতাকে হিপ্নটাইজ করিয়াছিল, তাহা সেলিনার মুখে প্রকাশ পাইবে। তৃতীয় সাক্ষী আশানুল্লা, সেলিনাদের বহির্ব্বাটীতে বিষ-গুপ্তি কুড়াইয়া পাইবার কথা বলিবে। বিষ-গুপ্তি বিক্রয়ের জন্য আশানুল্লা যে মিস্ আমিনার কাছে গিয়াছিল, তাহা চতুর্থ সাক্ষী মিস্ আমিনা সাক্ষ্য দিবে। পঞ্চম সাক্ষী—স্বয়ং দত্ত সাহেব, সেলিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথের প্রণয়, এবং বেন্টউডের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্বন্ধে যাহা কিছু তিনি জানেন, বলিবেন। ষষ্ঠ সাক্ষী রহিমবক্স, লাস-চুরি করিতে আসিয়া জুলেখা যেরূপে তাহাকে অজ্ঞান করিয়াছিল, তাহা সে বলিবে। তাহার পর সপ্তম সাক্ষী জুলেখা—সকল সাক্ষীর সেরা সাক্ষী, তাহার এজাহারে অনেক সারবান্ কথা প্রকাশ পাইবে। বিষ-গুপ্তির জন্য কিরূপে সে নূতন বিষ তৈয়ারি করিয়াছিল, এবং সেই বিষ-গুপ্তিতে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিবার জন্য সে বেন্টউডকে দিয়াছিল, তাহা জুলেখার জবানবন্দীতে প্রকাশ পাইবে। এইরূপ সপ্তরথী পরিবেষ্ঠিত মৃত্যুব্যূহ ভেদ করিয়া বাহির হওয়া যে, বেন্টউডের পক্ষে একান্ত দুঃসাধ্য, দত্ত সাহেব তাহা এখন বেশ বুঝিতে পারিলেন।
সাক্ষীদের সম্বন্ধে কথা উঠিলে দত্ত সাহেব গঙ্গারামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি মনে করেন, আমরা যেরূপ ভাবিতেছি, সাক্ষীরা সকলেই ঠিক সেইরূপ এজাহার দিবে?”
কিছু ক্ষুণ্ণভাবে গঙ্গারাম কহিলেন, “হাঁ, তবে একজনে উপরে আমার কিছু সন্দেহ আছে।”
“কাহার কথা আপনি বলিতেছেন?”
“জুলেখার।”
“জুলেখা কি বেন্টউডের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে না?”
“আমার ত তাহাই বিশ্বাস।”
“জোর করিয়া—ভয় দেখাইয়া–যেমন করিয়া হউক, জুলেখাকে সকল কথা স্বীকার করাইতে হইবে।”
“সে কিরূপে হইবে, সেটা আইন সঙ্গত কাজ হয় না।”
“তবে উপায়?”
“একটা উপায় আছে।”
“কি বলুন।”
“যদি কোন রকমে টম্বরু পাথর হস্তগত করিতে পারেন, তাহা হইলে সে উপায় করিতে পারি।”
“কোথায় পাইব?”
গঙ্গারাম কহিলেন, “বেন্টউড নিজের ঘড়ির চেনে সেই টম্বরু পাথর সংলগ্ন করিয়া রাখিয়াছেন। আমি হাজতে তাঁহার সহিত দেখা করিতে গিয়া জুলেখার সাক্ষ্যের কথা বলিলাম তাহাতে তিনি সেই পাথরখানা দেখাইয়া আমাকে বলিলেন, যতক্ষণ সেটা তাঁহার কাছে আছে, ততক্ষণ জুলেখা প্রাণাতেও তাঁহার বিরুদ্ধে কোন কথা প্রকাশ করিবে না।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “হাঁ, গঙ্গারামবাবু, আপনি ঠিক বলিয়াছেন, সেই টম্বরুর জন্য জুলেখা বেন্টউডকে অত্যন্ত ভয় করে। যাহাই হউক, আজ আমি সেলিনার সহিত দেখা করিব; দেখি, সেলিনার চেষ্টায় যদি জুলেখাকে বেন্টউডের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিতে সম্মত করাইতে পারি।”
সেই চেষ্টায় দত্ত সাহেব তখনই সেলিনাদের বাটীতে যাইয়া উপস্থিত হইলেন; এবং নিজের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া দেখিলেন। দেখিলেন, জুলেখা কিছুতেই বশ মানিবার নহে; সে কাঁদিয়া কাটিয়া অস্থির হইয়া, সকলকেই অস্থির করিয়া তুলিল। সেলিনার মাতা ও সেলিনা তাহাকে কত বুঝাইলেন, সে সকলের পদতলে লুণ্ঠিত হইয়া বলিতে লাগিল, সে তাহার পরগম্বর সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুতেই সাক্ষ্য দিবে না। মরিলেও না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – জুলেখার কাণ্ড
দত্ত সাহেব বিফল মনোরথ হইয়া উঠিয়া গেলেন। তাঁহার প্রস্থানের পরেও সেলিনা ও সেলিনার মা উভয়েই জুলেখাকে নানা রকমে বুঝাইতে লাগিলেন।
জুলেখা না-বুঝিয়া কহিল, “যতক্ষণ পরগম্বর সাহেবের কাছে টম্বরু আছে, ততক্ষণ আমি তাঁর বিরুদ্ধে একটা কথাও বলিতে পারিব না—তাহা হইলে আমাকে জাহান্নমে যাইতে হইবে।”
সেলিনার মাতা কহিলেন, “যদি সে টম্বরুর এত গুণ, তবে সেটা তোর পয়গম্বর সাহেবের কাছে আদায় করিয়া লইতে হয়।”
জুলেখা কহিল, “সহজে কি কেহ কাহাকে দেয়। পয়গম্বর সাহেব সেই টম্বরু একবারও কাছছাড়া করেন না। টম্বরু আমার কাছে থাকলে আমিও কাঁউরূপী সিঙ্গাবোঙ্গাকে মুঠোর ভিতরে রাখতে পারতেম।”
সেলিনা কহিল, “এক কাজ কর জুলেখা; তুই একবার তোর পয়গম্বর সাহেবের সঙ্গে দেখা কর। টম্বরু পাথর না দিলে সাক্ষ্য দিব বলিয়া, ভয় দেখাইয়া তাঁহার টম্বুরুটা আদায় ক’রে নিয়ে আয়।”
জুলেখা সে কথায় বড়-একটা কান দিল না; সে ধীরে ধীরে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল। অপরাহ্ণে জুলেখাকে কেহ বাটীমধ্যে দেখিতে পাইল না। ক্রমে অপরাহ্ণ সায়াহ্নে পরিণত হইল, তথাপি জুলেখার দেখা নাই। তখন সেলিনা ও তাহার মা সভয়ে মনে করিলেন, জুলেখা তাহার পয়গম্বর সাহেবের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবার ভয়েই এখন হইতেই পলাইয়াছে। যত দিন না এই মোকদ্দমার একটা নিষ্পত্তি হইতেছে, ততদিন সে নিশ্চয়ই ফিরিবে না। সহসা জুলেখার অন্তর্দ্ধানে উভয়েই অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত এবং আসন্ন বিপদাশঙ্কায় ভীত হইলেন।
সেলিনা দেখিল, এখন নিশ্চেষ্টভাবে এক মুহূর্ত্ত অতিবাহিত করা উচিত হয় না। মাতাকে কহিল, “এখন এক কাজ করিলে হয় না? এখনই দত্ত সাহেবকে এই সংবাদ দেওয়া হউক। তিনি চেষ্টা করিলে পুলিসের দ্বারা কোন রকমে জুলেখাকে এখনও গ্রেপ্তার করিতে পারিবেন।”
মাতা অমত করিলেন না। তখনই দত্ত সাহেবের বাটীতে লোক প্রেরিত হইল। দত্ত সাহেব তখন বাটীতে ছিলেন না। সন্ধ্যার পরে দত্ত সাহেব পুনরায় সেলিনাদের বাটীতে দেখা দিলেন। জুলেখার পলায়নে তিনিও অনেকটা হতাশ হইয়া পড়িলেন। এ সময়ে জুলেখাকে না পাইলে বেন্টউডের বিরুদ্ধে উপস্থিত এত বড় কেস্টা একেবারে হাল্কা হইয়া যায় দেখিয়া, তিনি হতাশ হইলেও একেবারে হাল ছাড়িতে পারিলেন না। কহিলেন, “এখনও মনে করিলে জুলেখাকে ধরা যাইতে পারে; আমি আজ অপরাহ্নে আলিপুরের পথে তাহাকে যাইতে দেখিয়াছি।”
সেলিনার মাতা কহিলেন, “তখনই আপনি তাহাকে ধরিলেন না কেন? তাহা হইলে আমাদিগকে আর এত গোলযোগে পড়িতে হইত না।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “জুলেখা যে পলাইয়া যাইতেছে, তাহা আমি কিরূপে জানিব? আমি মনে করিয়াছিলাম, আপনাদের কোন কাজে সে কোথায় যাইতেছে।”
সেলিনার মাতা কহিলেন, “না, কই—আমার আজ তাহাকে কোথাও পাঠাই নাই। আপনি তখনই তাহাকে ধরিলে ভাল করিতেন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “এরূপ ঘটিবে পূর্ব্বে জানিলে আমি নিশ্চয়ই তাহাকে ধরিতাম। কিন্তু তাহাকে ধরিয়াই বা কি কাজ হইবে? বেন্টউডের কাছে টম্বরু পাথর থাকিতে জুলেখা বেন্টউডের বিরুদ্ধে একটা কথাও প্রকাশ করিবে না।”
“সে কথা আর একবার করিয়া বলিতে।” দ্বারের বাহির হইতে নারীকণ্ঠে কেহ কহিল।
সবিস্ময়ে সকলে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলেন। সাশ্চর্য্যে দেখিলেন, দ্বার সম্মুখে দাঁড়াইয়া— জুলেখা। হাস্যে ও আনন্দে তাহার কৃষ্ণমুখমণ্ডল উদ্ভাসিত হইয়া ঝক্ঝক্ করিতেছে।
বিস্ময়াতিশয্যে সেলিনা ত্র্যস্তে উঠিয়া কহিল, “জুলেখা আমাদিগকে না বলিয়া এতক্ষণ তুই কোথায় গিয়াছিলি? আমরা ভাবিতেছিলাম, সাক্ষ্য দিবার ভয়ে তুই পলাইয়া গিয়াছিস্।”
জুলেখা কহিল, “পলাইব কেন? আমি আদালতে গিয়া ঠিক ঠিক বলিয়া আসিব।” জুলেখার সহসা এরূপ অপ্রত্যাশিতপূর্ব্ব মতি-পরিবর্তনের কারণ হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া সাতিশয় বিস্ময়ের সহিত দত্ত সাহেব একটু শ্লেষ করিয়া তাহাকে কহিলেন, “টম্বরু পাথরের কথা বুঝি তোর মনে নাই?”
“খুব আছে।” বলিয়া জুলেখা মুষ্টিবদ্ধহস্ত উন্মুক্ত করিল। তাহার উন্মুক্ত কৃষ্ণকরতলে— সকলে আপাদমস্তক শিহরতি হইয়া দেখিলেন—সেই টম্বরু নামক কৃষ্ণবর্ণ প্রস্তরখণ্ড।
টম্বরু প্রস্তর সর্ব্বদা ঘড়ির চেনে সংলগ্ন করিয়া বেন্টউড এ পর্য্যন্ত অতি সাবধানে রক্ষা করিয়া আসিতেছেন; এবং নিজে বেন্টউড সেই টম্বরু সমেত আপাততঃ কারাগৃহে অতি সাবধানে রক্ষিত; এরূপ স্থলে কারাগারে যাইয়া বেন্টউডের নিকট হইতে জুলেখা কিরূপে সেই টম্বরু বাহির করিয়া লইয়া আসিল, তাহা কেহ ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না। জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করায়, জুলেখাও সে সম্বন্ধে কোন কথা প্রকাশ করিতে চাহিল না।
এই ঘটনার পরেই দত্ত সাহেব ইনস্পেক্টর গঙ্গারামকে সংবাদ পাঠাইলেন যে জুলেখা বেন্টউডের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে। টম্বরু সম্বন্ধে কোন কথা প্রকাশ করিলেন না।
ইতিমধ্যে অমরেন্দ্রের সহিত দত্ত সাহেবের আর সাক্ষাৎ হয় নাই।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – আদালতে
অদ্য বেন্টউডের বিচারের দিন। বেলা দশটা বাজিবার পূর্ব্বেই বহু লোক সমাগমে বৃহৎ আদালতগৃহ পরিপূর্ণ। এমন জনতা আর কেহ কখনও দেখে নাই। দর্শকের দল মহাকৌতূহলাক্রান্ত হৃদয়ে অপেক্ষা করিতেছে।
ইনস্পেক্টর গঙ্গারাম তাঁহার সপ্তসাক্ষীর সহিত উপস্থিত আছেন। দত্ত সাহেব কোম্পানী – – তরফের ব্যারিষ্টারের সহিত গম্ভীরভাবে পরস্পর কি বলাবলি করিতেছেন। তাঁহাদের কথোপকথনের কোন অংশ শ্রুতিগোচর না হইলেও দর্শকমণ্ডলী আগ্রহপূর্ণদৃষ্টিতে নীরবে তাঁহাদের গম্ভীর মুখের দিকে চাহিয়া আছে। অপরপার্শ্বে মৃত্যুমলিনমুখে অমরেন্দ্রনাথ, উপস্থিত মোকদ্দমা সংক্রান্ত কয়েকখানি কাগজপত্র লইয়া উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতেছেন।
বেলা এগারটার সময়ে বন্দী বেন্টউড প্রহরী-পরিবেষ্টিত হইয়া আনীত হইলেন। এরূপ বিপন্নাবস্থায়, আসন্ন বিপদের মুখে পড়িয়াও তাঁহার মুখমণ্ডল এখনও হাস্যপ্রসন্ন, এবং প্রশন্ত ললাটফলকে অদ্যাপি চিন্তার একটিও রেখাপাত হয় নাই।
ক্ষণপরে বিচারক আসিয়া নিজের আসন গ্রহণ করিলে, মোকদ্দমা আরম্ভ হইল।
গভর্ণমেন্টপক্ষীয় ব্যারিষ্টার উঠিয়া উপস্থিত মোকদ্দমা বিচারপতিকে বুঝাইয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন, “আসামী মিঃ বেন্টউড একজন কৃত-বিদ্য লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক। ঘটনাক্রমে মিস্ সেলিনার উপরে আসামীর অনুরাগ সঞ্চার হয়। সে অনুরাগের কারণ সেলিনার সৌন্দর্য্য নহে, তাঁহার অতুল ঐশ্বর্য্য। অর্থাকাঙ্ক্ষায় আসামী সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়া উঠিয়াছিলেন; কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার অভীষ্টসিদ্ধির প্রধান অন্তরায় ছিলেন, তখন সেলিনা সুরেন্দ্রনাথকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, এবং সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেলিনার বিবাহ একপ্রকার স্থির হইয়া গিয়াছিল।
এই সময়ে আসামীপক্ষের ব্যারিষ্টার অমরেন্দ্রনাথ বাধা দিয়া কহিলেন, “কে আপনাকে বলিল, সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেলিনার বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছিল? আপনি বোধ হয় জানেন না, এ বিবাহে সেলিনার মাতার আদৌ সম্মতি ছিল না।”
কোম্পানী-তরফের ব্যারিষ্টার কহিলেন, “জানি, সেলিনার মাতার সম্মতির অসম্মতির কথা উত্থাপন প্রাসঙ্গিক হয় না। বিশেষতঃ নিজে মিস্ সেলিনা যখন সুরেন্দ্রনাথকে বিবাহ করিবার জন্য একান্ত কৃতসঙ্কল্প ছিলেন, তখন বিবাহ এক রকম স্থির হইয়াই গিয়াছিল, বলিতে হইবে। মাতার সম্মতি তখন না থাকিলে, পরে তিনি অবশ্যই সম্মত না হইয়া থাকিতে পারিতেন না। সেলিনা তাঁহার একমাত্র কন্যা, পরম স্নেহের পাত্রী, তিনি কখনই সেলিনার মনোমালিন্যের কারণ হইতে পারিতেন না। বিশেষতঃ সেলিনা অপাত্রে হৃদয় অর্পণ করেন নাই; অথবা সুরেন্দ্রনাথ সেলিনার মাতার জামাতৃপদের অযোগ্য ছিলেন না। আপনার এই প্রতিবাদ ঠিক হয় নাই। আসামী যখন দেখিলেন, সুরেন্দ্রনাথ জীবিত থাকিতে সেলিনা লাভের আর কোন উপায় নেই, তখন তিনি নিরুদ্যম হইবার পাত্র নহেন—স্থির করিলেন, তাঁহার এই অভীষ্টসিদ্ধির পথ হইতে এ কন্টক দূর করিতে হইবে। কিন্তু এ সকল কাজে অপর একজনের সহায়তা বিশেষ আবশ্যক। আসামী মিস্ সেলিনাদিগের জুলেখা নাম্নী এক বাঁদীকে হস্তগত করিলেন। জুলেখাকে হস্তগত করিতে আসামীকে বিশেষ চেষ্টা করিতে হয় নাই। জুলেখার জন্মস্থান ছোটনাগপুর। জাতিতে খাড়িয়া। কোদিগের মধ্যে খাড়িয়া জাতিরা তন্ত্রমন্ত্র সংক্রান্ত ঐন্দ্রজালিক বিদ্যায় বড় নিপুণ। আসামীও ঐ সকল বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী; তিনি ইতিপূর্ব্বে ছোটনাগপুরে কোদিগের মধ্যে কিছুকাল অতিবাহিত করিয়া আসিয়াছেন। সেই স্থানে তিনি টম্বরু নামক প্রস্তরের গুণবর্ণনা শ্রবণ করেন, এবং অনেক চেষ্টায় সেই টম্বরু নামক প্রস্তর সংগ্রহ করেন। টম্বরু নামক প্রস্তরখণ্ডকে খাড়িয়ারা অত্যন্ত ভয় ও শ্রদ্ধা করে। সেই টম্বরুর ভয় দেখাইয়া আসামী জুলেখাকে নিজের বশীভূত করিয়া ফেলিলেন। এমন কি উপস্থিত হত্যাকাণ্ডেও জুলেখা সৰ্ব্বতোভাবে আসামীর সাধ্যমত সহায়তা করিয়াছে।”
আসামী তরফের ব্যারিষ্টার অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “অনর্থক আপনি ‘হত্যাকাণ্ড’ শব্দ ব্যবহার করিতেছেন; এখনও সে সম্বন্ধে কোন কথা উঠে নাই, এবং এখনও সম্পূর্ণ তাহার প্রমাণাভাব।”
কোম্পানী-তরফের ব্যারিষ্টার তাঁহার বিপক্ষপক্ষ সমর্থনকারী নবীন ব্যারিষ্টারের এ প্রতিবাদ মান্য করিয়া লইলেন। তাহার পর বলিতে লাগিলেন, “সুরেন্দ্রনাথের অভিভাবক ও প্রতিপালক মিঃ আর দত্ত ছোট নাগপুর হইতে বিষ-গুপ্তি নামক একটী সাংঘাতিক অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া আনে। এই অস্ত্র বিষাক্ত, অতি সহজে ইহাতে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করা যায়। কোল্জাতিদের প্রধান মান্কীরা এই অস্ত্রের ব্যবহার করিয়া থাকে। ইহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলা নিষ্প্রয়োজন—সম্মুখে টেবিলের উপরে ঐ বিষ-গুপ্তি রহিয়াছে, জুরী মহোদয়গণ, ইচ্ছা করিলে দেখিতে পারেন।”
একটু ইতস্ততঃ করিয়া আসামীপক্ষীয় ব্যারিষ্টার অমরেন্দ্রনাথ কহিলেন, “হাঁ, আমি স্বীকার করিতেছি, ঐ বিষ-গুপ্তির দ্বারাই সুরেন্দ্রনাথকে খুন করা হইয়াছে। বিষ-গুপ্তি সম্বন্ধে আর কিছু বর্ণনা বা পরীক্ষার কোন আবশ্যকতা নাই। আপনার বক্তব্য যাহা শেষ করুন।”
কোম্পানী-তরফের ব্যারিষ্টার অমরেন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ দিয়া কহিলেন, “বিষ-গুপ্তির দ্বারা যে সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, ইহা আপনি নিজমুখে স্বীকার করায় বড়ই সুখী হইলাম।” তাহার পর বিচারপতি ও জুরীদিগকে যথারীতি সম্ভাষণ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “আসামীর উপদেশানুসারে জুলেখা একদিন রাত্রে মিসেস্ মারশনকে হিপ্নটাইজ করিয়া মিঃ আর দত্তের বাটী হইতে বিষ-গুপ্তি সংগ্রহ করে। জুলেখা বিষগুপ্তির বিষ তৈয়ারি করিবার প্রণালী জানিত। সে নতুন বিষে বিষ-গুপ্তি পূর্ণ করিয়া আসামীকে দেয়, এবং আসামী এই বিষ-গুপ্তির দ্বারা তাহার অভীষ্টসিদ্ধির একমাত্র অন্তরায় সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছেন।”
আসামী-তরফের ব্যারিষ্টার কহিলেন, “আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ প্রমাণ – সাপেক্ষ। নতুবা ইহা আপনার একটা স্বকপোল কল্পিত সুন্দর গল্পমাত্র।”
কোম্পানী-তরফের ব্যারিষ্টার কহিলেন, “আমি যতটুকু প্রমাণ করিতে পারিব, তাহার বেশী একটা কথাও বলি নাই—সুতরাং আমি যাহা বলিতেছি, তাহা গল্প নহে জানিবেন। প্রমাণ প্রয়োগে সহজেই বুঝিতে পারিবেন, আসামীই সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃত হত্যাকারী। তাহার পর আরও তিনি এমন কি সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ পর্যন্ত অপহরণ করিয়াছেন; যে সম্বন্ধেও আমার কিছু বক্তব্য আছে।”
বন্দীর তরফের ব্যারিষ্টার মিঃ অমরেন্দ্রনাথ হস্তভঙ্গী সহকারে কহিলেন, “যাহা আপনি বলিয়াছেন, যথেষ্ট। সামান্য এতটুকুকে পাঁউরুটীর মত ফাঁপাইয়া এত বড় করিবার ক্ষমতা আপনার খুব আছে। অতএব লাসচুরি সম্বন্ধে আপনি আর কোন কথা উত্থাপন না করিলেই ভাল হয়।”
বিচারপতি দেখিলেন, একটা ঘটনার সহিত আর একটা ঘটনার সংশ্লিষ্ট ও ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, তখন এ সম্বন্ধে যাহা কিছু সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হওয়া আবশ্যক। এই ঘটনা হইতে অপর ঘটনার এমন কোন বিষয় পাওয়া যাইতে পারে যে, অপরটী তাহাতে খুব ভারী হইয়াও উঠিতে পারে, হাল্কা হইয়াও যাইতে পারে। তিনি গভর্ণমেন্ট তরফের ব্যারিস্টারকে তাঁহার বক্তব্য শেষ করিতে অনুজ্ঞা করিলেন।
কোম্পানী তরফের ব্যারিষ্টার কহিলেন, “মিঃ আর দত্ত, সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ নিজ বাটীতে লইয়া গিয়া একটা ঘরের ভিতর রাখিয়াছিলেন। আসামী, জুলেখার সাহায্যে সেই মৃতদেহ অপহরণ করিয়াছেন।”
অমরেন্দ্রনাথ কহিলে, “আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা একান্ত অপ্রমাণ্য। আপনি ভুল বলিতেছেন।”
কোম্পানী-তরফের ব্যারিষ্টার কহিলেন, “আমার যে কিছুমাত্র ভুল হয় নাই, তাহা আমি নিজে বেশ জানি। আমি যাহা যাহা বলিয়াছি, উপস্থিত বিশিষ্ট সাক্ষীর দ্বারা এখনই সে সকল প্রমাণীকৃত হইবে। মিঃ আর দত্তকে উপস্থিত হইতে হুকুম হউক।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – বিচার
অনন্তর সাক্ষীগণের জোবানবন্দী গৃহীত হইতে লাগিল। উভয় পক্ষীয় ব্যারিষ্টার এবং বিচারকের প্রশ্নাদি বাদ দিয়া কেবল সাক্ষীগণের এজাহারের স্থূলমর্ম্মমাত্র লিখিত হইল। আদালতের চিরাগত প্রথানুসারে সাক্ষীদিগের প্রতি যে কূট-প্রশ্ন পরীক্ষা করা হইয়াছিল, গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে ও অনাবশ্যক বোধে তাহা পরিত্যক্ত হইল।
দত্ত সাহেব যে এজাহার দিলেন, তাহার সংক্ষিপ্ত মর্ম্ম এই,–”আমি সুরেন্দ্রনাথের অভিভাবক এবং প্রতিপালক। আমি জানি, সেলিনার প্রতি সুরেন্দ্রনাথের আন্তরিক অনুরাগ এবং তাহাকে বিবাহ করিবার খুব আগ্রহ ছিল। সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেলিনার বিবাহ হয়, সেলিনার মাতা মিসেস মারশনের এ ইচ্ছা ছিল না। আসামীরও মিস্ সেলিনাকে বিবাহ করিবার একটা বিশেষ আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেলিনা আসামীকে বিবাহ করিতে সম্মত হয় নাই। আমি ইতিপূৰ্ব্বে একদিন আসামীকে আমার বিষ-গুপ্তি দেখাইয়াছিলাম, এবং বিষ-গুপ্তি ব্যবহার করিবার কৌশলও তাঁহাকে বলিয়াছিলাম। আসামী একবার আমার নিকট হইতে ঐ বিষ-গুপ্তি ক্রয় করিতে চাহেন; আমি বিক্রয় করিতে সম্মত হই নাই। তাহার পর এই বিষ-গুপ্তি আমার নিকট হইতে চুরি যায়— বিষ-গুপ্তি অপহৃত হইবার পরেই সুরেন্দ্রনাথ রাত্রে নির্জ্জন পথিমধ্যে এই বিষ-গুপ্তির দ্বারা খুন হয় আমি সুরেন্দ্রনাথের করতলে বিষ-গুপ্তির ক্ষুদ্র ক্ষতচিহ্ন দেখিয়াছি; এবং তাহার মৃতদেহ হইতে বিষ-গুপ্তির বিষের গন্ধের ন্যায় একটা গন্ধও বাহির হইতে দেখিয়াছি। তাহার পর আমার বাড়ী হইতে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ অপহৃত হয়। যে লোককে মৃতদেহ রক্ষার জন্য নিয়োজিত রাখিয়াছিলাম, অপহরণকারী তাহাকেও ঐ বিষ-গুপ্তির বিষের দ্বারা অজ্ঞান করিয়াছিল। বিষ-গুপ্তির বিষ এত তীব্র যে, উহা কোন রকমে রক্তের সহিত মিশ্রিত হইলে, তখনই মৃত্যু ঘটে। এবং উহার গন্ধেও তম্মাত্র অজ্ঞান হইতে হয়। আসামী সুরেন্দ্রনাথকে সেলিনার আশা পরিত্যাগ করিবার জন্য অনেকবার অনেক রকমে ভয় দেখাইতেও ত্রুটি করেন নাই।”
মিস্ সেলিনা নিজের এজাহারে কহিল, “আসামী আমাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক ছিলেন; আমি বিবাহে সম্মত ছিলাম না। আমার জন্য সুরেন্দ্রনাথকে আসামী দারুণ ঈর্ষার চক্ষে দেখিতেন। কয়েকবার আসামী সুরেন্দ্রনাথকে ভয়ও দেখাইয়াছিলেন। জুলেখা হিপনটিজম জানে, আমার মার মাথার ব্যারাম আছে; অসুখ বৃদ্ধি পাইলে, জুলেখা প্রায়ই ঝাড়ফুঁক্ মন্ত্রের অছিলায় হিপ্নটাইজ করিয়া তাঁহাকে সুস্থ করিত। জুলেখা একদিন রাত্রে আমার মাতাকে হিপ্নটাইজ্ করিয়া দত্ত সাহেবের বাটীতে পাঠাইয়া দেয়; আমি অন্তরালে থাকিয়া তাহা দেখিয়াছিলাম। তখন কিছুই বুঝিতে পারি নাই। আমি তখন দত্ত সাহেবের বাটী পর্য্যন্ত মাতার অনুসরণ করিয়া গিয়াছিলাম। এবং সেখান হইতে তাঁহাকে বিষ-গুপ্তি লইয়া ফিরিয়া আসিতেও দেখিয়াছিলাম। তিনি বিষ-গুপ্তি জুলেখার হাতে দিয়াছিলেন, তাহার পর আমি আর সেই বিষ-গুপ্তি দেখি নাই। যেদিন সুরেন্দ্রনাথ খুন হ’ন, সেদিন সন্ধ্যার পর তিনি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। সেই সাক্ষাতেই তাঁহার সহিত আমার শেষ সাক্ষাৎ। আমি বেশ জানি, আসামীর অধিকারে একখানি টম্বরু নামক প্রস্তরখণ্ড থাকায় জুলেখা তাঁহাকে খুব ভয় করিয়া চলিত। ছোটনাগপুরের খাড়িয়ারা টম্বরু নামক প্রস্তরখণ্ডকে যে যথেষ্ট সম্মান করে, তাহা আমি জুলেখার মুখে শুনিয়াছি। আমি খুব জানি, সুরেন্দ্রনাথের হৃদয়ে কোন ভাবান্তর উপস্থিত হয় নাই। সেদিনও আমি তাঁহাকে বিশেষ প্ৰফুল্ল দেখিয়াছি; এমন কোন ভাব দেখি নাই, যাহাতে তিনি আত্মহত্যা করিতে পারেন। আমি আসামীকে তাঁহার পরম শত্রু বলিয়া নিশ্চিতরূপে জানি।”
সেলিনার জোবানবন্দী শেষ হইলে তাহার মাতা উঠিলেন। তিনি কহিলেন, “আমি স্নায়বিকদৌর্বল্য বশতঃ মধ্যে মধ্যে মস্তিষ্কের পীড়ায় কষ্ট পাইয়া থাকি। জুলেখার হিটিক চিকিৎসায় আমি ইহাতে অনেকটা উপকার বোধ করি। যেদিন বিষ-গুপ্তি অপহৃত হয়, সেদিন আমার পীড়ার বৃদ্ধিতে জুলেখা আমাকে হিপ্নটাইজ করিয়াছিল। কিন্তু তখনকার হিপ্টাইড অবস্থায় আমি কি করিয়াছি, তাহা কিছু মনে পড়ে না। জুলেখা অনেক দিন হইতে আমার নিকটে আছে। আমি তাহাকে যথেষ্ট স্নেহ ও বিশ্বাস করি। সে যে আমাকে হিপ্টীজমের অভিভূত অবস্থায় রাখিয়া কোনও প্রকার গর্হিত কার্য্য করাইবে, বলিতে কি, এরূপ সন্দেহ আমার মনে এ পর্যন্ত একবারও উদিত হয় নাই। আমি মিঃ দত্তের বাটীতে কিম্বা আমার নিজের বাটীতে পূৰ্ব্বে কখনও এই বিষ-গুপ্তি দেখি নাই। জুলেখা সেলিনাকে সুরেন্দ্রনাথের অনুরক্তা বলিয়া জানিত। কিন্তু তাহার ইচ্ছা নহে, সুরেন্দ্রনাথের সহিত সেলিনার বিবাহ হয়। আসামীকে বিবাহ করিবার জন্য আমি আমার কন্যাকে কখনও কোন অনুজ্ঞা করি নাই। আমি আসামীর নিকটে টম্বরু নামক একখণ্ড প্রস্তর দেখিয়াছি; কোল্ বা খাড়িয়াজাতির সকলেই টম্বরুকে ভয় ও সম্মান করিয়া থাকে। জুলেখাও এই টম্বরুর জন্য আসামীকে খুব ভয় ও ভক্তি করিত। বন্দী যে সুরেন্দ্রনাথের পরম শত্রু, তাহা তিনি নিজের মুখে স্বীকার করিয়াছেন। আমার কন্যার জন্য তদুভয়ের মধ্যে একটা খুব বিদ্বেষভাব ছিল। উপস্থিত কোন কোন সাক্ষীর ও আমার সমক্ষে আসামী সুরেন্দ্রনাথকে সেলিনার সহিত বিবাহ সংকল্প ত্যাগ করাইবার জন্য নানারকম ভয় দেখাইয়াছিল। আমি লাস চুরির সম্বন্ধে কোন কথা জানি না।”
মিস্ আমিনা এজাহার দিলেন, “হত্যাকাণ্ডের পর আশানুল্লা একদিন এই বিষ-গুপ্তি আমার নিকটে বিক্রয় করিতে আসিয়াছিল। বিষ-গুপ্তি দ্বারা যে সুরেন্দ্রনাথ খুন হইয়াছেন, তাহা আমি পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম। সুতরাং আমি তখনই আশানুল্লাকে দত্ত সাহেবের নিকটে লইয়া যাই এবং সেই বিষ-গুপ্তি দত্ত সাহেবকে দিয়া আসি। আমি আর কিছু জানি না।”
তাহার পর আশানুল্লা এজাহার দিল, “জুলেখা মধ্যে মধ্যে আমাকেও যাদু করিয়া আসামীর খবরাখবর লইত। আসামী একদিন আমাকে পথে দেখিতে পাইয়া, জুলেখাকে চালেনা-দেশমের খবর দিতে বলিলেন। বিষ-গুপ্তির অপর নাম চালেনা-দেশম; তাহা আমি আগে জানিতাম না। একদিন আমি ঐ বিষ-গুপ্তি সেলিনাদের বাড়ীর গেটের কাছে কুড়াইয়া পাইয়া, উহা বিক্রয়ের জন্য মিস্ আমিনাকে দেখাইতে যাই। আমার কাছে বিষ-গুপ্তি দেখিয়া তিনি আমাকে হুজুর দত্ত সাহেবের নিকটে লইয়া যান। আমি আসামীকে লাসচুরি করিতে দেখিয়াছি। একখানি গাড়ীর ভিতরে লাস রাখা হয়। গাড়ীতে সহিস কোচম্যান কেহই ছিল না। আসামী গাড়ীর ভিতরে লাশ রাখিয়া নিজেই সেই গাড়ী হাঁকাইয়া দিলেন। আমি সেই গাড়ীর পিছনে বসিয়া আলিপুরে আসামীর বাড়ীতেও গিয়াছিলাম। আমি আসামীর নিকট হইতে কিছু আদায়ের চেষ্টায় এইরূপ করিয়াছিলাম।”
তাহার পর রহিমবক্সের ডাক হইল। রহিমবক্স পূৰ্ব্বাপেক্ষা অনেকটা সুস্থ হইতে পারিয়াছে। লাসচুরির রাত্রে জুলেখা শয্যাতলে লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপভাবে সহসা তাহাকে অজ্ঞান করিয়াছিল, তাহা নিজের এজাহারে প্রকাশ করিল।
তাহার পর জুলেখার ডাক হইল। তাহার জোবানবন্দীর সারাংশ এই;–আমি বিষ-গুপ্তির বিষ তৈয়ারি করিতে জানি। আমি আসামীকে আগে চিনিতাম না। আসামী আমার মনিব-বাড়ীতে প্রায়ই যাওয়া-আসা করিতেন; ক্রমে তাঁহার সহিত আমার পরিচয় হয়। আসামী কাউরূপী সিঙ্গিবোঙ্গার অনেক মন্ত্রতন্ত্র জানেন। তাঁহার কাছে একখানি টম্বরু ছিল; টম্বরুর অনেক গুণ, টম্বরু দ্বারা কাঁউরূপী সিদ্ধ হওয়া যায়; আমি টম্বরুর জন্য আসামী সাহেবকে বড় ভয় করিতাম। আসামী মিস্ সেলিনাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু মিস্ সেলিনাকে সুরেন্দ্রনাথের অনুরক্তা দেখিয়া আসামী সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিতে কৃতসঙ্কল্প হন। আসামী সেই সময়ে দত্ত সাহেবের বাড়ীতে চালেনা-দেশম দেখিতে পান; সেই চালেনা-দেশমের দ্বারা সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিবেন বলিয়া স্থির করেন। আমি তাহার সাহায্য করিতে সম্মত হইয়াছিলাম; কাঁউরূপীর মহিমায় সেলিনার মাতার দ্বারা চালেনা-দেশম হস্তগত করি। সেলিনার মা নিজে তাহা কিছুই জানিতে পারেন নাই। আমি বিষ তৈয়ারি করিয়া চালেনা-দেশম ঠিক করিয়া রাখি। যে রাত্রে সুরেন্দ্রনাথ খুন হন, সেই রাত্রে সুরেন্দ্রনাথ সেলিনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। নিৰ্জ্জন বাগানে বসিয়া উভয়ে কথোপকথন করিতেছেন, আসামীও ঠিক সেই সময়ে আসিয়া উপস্থিত হন; কিন্তু সুরেন্দ্রনাথকে সেলিনার পার্শ্বে দেখিয়া তিনি তখন সেলিনার সহিত দেখা করেন নাই। যখন সুরেন্দ্রনাথ সেলিনার নিকটে বিদায় লইয়া বাহির হইয়া গেলেন, তখন আসামী আমার নিকট হইতে চালেনা-দেশমটা চাহিয়া লইয়া সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিবার জন্য তাঁহার অনুসরণ করিলেন। পরদিন সকলে উঠিয়া শুনিলাম, সুরেন্দ্রনাথ খুন হইয়াছেন। ইহার পর আসামী লাসচুরি করিবার বন্দোবস্ত ঠিক করিলেন। তাঁহার কাছে টম্বরু ছিল, কোন আপত্তি না করিয়া আমি সে কাজেও তাঁহার সাহায্য করিতে সম্মত হইলাম। দত্ত সাহেবের বাড়ীতে যে ঘরে লাস ছিল, আমি সেই ঘরে যাইয়া লাসের বিছানার নীচে লুকাইয়া রহিলাম। তাহার পর সুযোগমত রহিমবক্সকে চালেনা-দেশমের বিষের সাহায্যে অজ্ঞান করিলাম। আসামী বাহিরে দাঁড়াইয়াছিলেন। আসামীকে তখনই ঘরের ভিতরে আনিবার জন্য আমি বাহিরে দিক্কার একটা জানালা খুলিয়া দিলাম। দুজনে ধরাধরি করিয়া সেই জানালা দিয়া লাস, বাহির করিয়া লইলাম। বাগানের বাহিরে আসামীর নিজের গাড়ী ছিল, সেই গাড়ীতে লাস তুলিয়া দিলাম। আমি আর কিছু জানি না।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ভীষণ পক্ষসমর্থন
প্রাগুক্ত জোবানবন্দীতে সমাগত জনতা বেন্টউডকে সম্পূর্ণরূপে দোষী স্থির করিয়া নিঃসন্দেহ হইতে পারিল। মোকদ্দমাও এক প্রকার শেষ হইয়া আসিল। এখন অমরেন্দ্রনাথের মুখমণ্ডল পূর্ব্বাপেক্ষা আরও মলিন হইয়া গিয়াছে। তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখা যায় না। তিনি শেষ বক্তৃতার জন্য ধীর ধীরে উঠিলেন। তাঁহাকে উঠিতে দেখিয়া জনতার মৃদুগুঞ্জন একেবারে থামিয়া গেল, এবং দর্শকদলের অনেকেই মনে মনে স্থির করিলেন, অমরেন্দ্রনাথ বেন্টউডের পক্ষসমর্থনে অনর্থক চেষ্টা করিতেছেন, আর কোন উপায় নাই।
অমরেন্দ্রনাথ উঠিয়া প্রথমে একবার অদূরবর্তিনী সেলিনার মুখের দিকে চাহিলেন। সেলিনাও তাঁহার দিকে অত্যন্ত আগ্রহপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল। তাহার পর অমরেন্দ্রনাথ একবার ডাক্তার বেন্টউডের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, সাক্ষী দ্বারা অপরাধী সাব্যস্ত হইয়াও তাঁহার কোন ভাববৈলক্ষণ্য ঘটে নাই, তাঁহার মুখভাব তখনও বেশ প্রশান্ত—ভয় বা আকুলতার চিহ্নমাত্রও নাই। বেন্টউড, অমরেন্দ্রনাথকে তাঁহার দিকে চাহিতে দেখিয়া, অমরেন্দ্রনাথের মুখের দিকে চাহিয়া একবার হাসিলেন। সে হাসিতে অমরেন্দ্রনাথ শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি সেই বিষ-গুপ্তিটা তুলিয়া লইয়া, বিচারক এবং জুরিগণকে যথাবিহিত সম্বোধন করিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন, “সাক্ষিগণের জোবানবন্দীতে আমার মক্কেলের অপরাধ সপ্রমাণ হইলেও, প্রকৃত তিনি অপরাধী নহেন—আমি নিজেও একজন সাক্ষী। সাক্ষীরা এজেহারে যাহা বলিয়াছেন, তাহার একটি বর্ণও ঠিক নহে। ডাক্তার বেন্টউড অপরাধী নহেন—আমি নিজেই অপরাধী—সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারী—” বলিতে বলিতে অমরেন্দ্রনাথের স্বর বিকৃত ও ব্যাকুল—জড়িত এবং তৎক্ষণাৎ দৃঢ় ও সুস্পষ্ট হইল। উচ্চকণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “আমি পুৰ্ব্বেই আত্মদোষ স্বীকার করিয়া আমার অপরাধের কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া আসিয়াছি। আমি এখন ডাক্তার বেন্টউডের বাড়ীতে থাকি; সেখানে আমার শয়ন-গৃহে আপনারা সকলেই তাহা দেখিয়া আসিতে পারেন।”
দর্শকগণ নির্ব্বাক্ ও নিঃশব্দ—সকলেই নিষ্পলকনেত্রে অমরেন্দ্রনাথের মুখের দিকে চাহিয়া। অমরেন্দ্রনাথ বলিতে লাগিলেন, “মিস্ সেলিনাকে আমি সর্বান্তঃকরণে ভালবাসি, তাহাকে পত্নীরূপে লাভ করিবার জন্য আমি হিতাহিত-বিবেচনা-শূন্য। পরে যখন দেখিলাম, সুরেন্দ্রনাথ আমার অভীষ্টসিদ্ধির প্রধান অন্তরায়, তখন আমি জুলেখাকে হাত করিলাম। জুলেখার কাছে এই বিষ-গুপ্তি ছিল। সে কিরূপে ইহা হস্তগত করিয়াছিল, তাহা আমি জানি না—আর সে কথায় এখন বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই। আমি জুলেখাকে অর্থ দ্বারা বশীভূত করিয়া তাহার নিকট হইতে বিষ-গুপ্তিটা আদায় করিয়া লই। যে রাত্রে সুরেন্দ্রনাথ খুন হয়, সেদিন আমি কলিকাতায় যাইবার নাম করিয়া বাটী হইতে বাহির হইয়াছিলাম বটে, কিন্তু প্রকৃত তাহা ঘটে নাই। আমি তখন সেলিনাদের বাটীতে যাইয়া, জুলেখার সহিত নিৰ্জ্জনে সাক্ষাৎ করিয়া বিষ-গুপ্তি সংগ্রহ করিলাম। রাত্রে আমি গোপনে সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। তাহার পর দেখিলাম, সেখানে সুরেন্দ্রনাথ আসিয়া উপস্থিত হইল; এবং বাড়ীর ভিতরে না যাইয়া সেলিনার জন্য সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিল। ক্ষণপরে সেলিনাও বাড়ীর ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিল। আমি গোপনে থাকিয়া তাহাদিগকে দেখিতে লাগিলাম—ঈর্ষার বিষাক্ত ছুরিকাঘাতে আমার হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত হইতে লাগিল। তাহার পর যখন সুরেন্দ্রনাথ সেলিনার নিকটে বিদায় লইয়া বাহির হইয়া গেল, আমিও অন্তরাল হইতে বাহির হইয়া দ্রুতপদে তাহার অনুসরণ করিলাম। যখন আমি ছুটিয়া তাহার নিকটবর্ত্তী হইলাম, আমাকে সেইরূপে বিষ-গুপ্তি লইয়া আক্রমণ করিতে দেখিয়া, সুরেন্দ্রনাথ সভয়ে উভয় হস্ত প্রসারিত করিয়া যেমন আমার হস্তস্থিত এই বিষ-গুপ্তি কাড়িয়া লইতে আসিবে, আমি তখনই উদ্যত বিষ-গুপ্তি তাহার বাম করতলে এইরূপ বিদ্ধ করিয়া দিলাম।” বলিয়া তৎক্ষণাৎ অমরেন্দ্রনাথ নিজের বাম করতলে সেই বিষ-গুপ্তি বিদ্ধ করিয়া, সশব্দে সম্মুখবর্তী টেবিলের উপর ফেলিয়া দিলেন।
মুহূর্ত্ত পরে তাঁহার মৃতদেহ সেই বিষ্ময়বিহ্বল নীরব জনতার মধ্যে বিলুণ্ঠিত হইয়া পড়িল।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – বিচারের ফল
মোকদ্দমার এইরূপ অপ্রত্যাশিতপূৰ্ব্ব, ভীতিপ্রদ নিষ্পত্তিতে সকলেরই হৃদয় ব্যথিত হইল। বিচার শেষ হইয়া গেল; অনতিবিলম্বে জনতার লাঘব হইল; এবং অমরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ দত্ত সাহেবের বাটীতে আনীত হইল।
অনন্তর অমরেন্দ্রনাথের কথামত বেন্টউডের বাটী অনুসন্ধান করিয়া দেখা হইল। অনুসন্ধানে অমরেন্দ্রের হস্তলিখিত সেই আত্মদোষস্বীকারপত্র পাওয়া গেল। তিনি আদালতে যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাতে তাহাই লিখিত রহিয়াছে।
অনতিবিলম্বে আইনের ধারানুক্রমে ডাক্তার বেন্টউড হত্যাপরাধ হইতে মুক্তিলাভ করিলেন। এত বড় একটা কাণ্ড হইয়া গেল—তথাপি তাঁহার মনে কোন উদ্বেগ নাই—মুখমণ্ডলে উদ্বেগের কোন চিহ্ন নাই—পরম নিশ্চিন্ত মনে তিনি নিজের বাটীতে ফিরিয়া আসিলেন।
আদালতের সেই অভূতপূর্ব্ব ভীষণ ঘটনায় সেলিনার মাতা ও সেলিনার হৃদয়ে অত্যন্ত আঘাত লাগিল। সজলনেত্রে তাঁহারা আদালত হইতে গৃহে ফিরিলেন। তাঁহাদিগের সঙ্গে সেদিন জুলেখাকে ফিরিতে দেখা গেল না। তৎপরদিনও জুলেখা ফিরিল না।
মোকদ্দমার সেই নিষ্পত্তির সঙ্গে সঙ্গেই জুলেখা একেবারে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। সে এখন টম্বরু পাথর পাইয়াছে—তাহার বুক এখন সপ্তহস্ত পরিমিত, তাহাকে আর পায় কে?
বিচারের পরদিন প্রাতে ইনস্পেক্টর গঙ্গারামবাবু দত্ত সাহেবের সহিত দেখা করিলেন। অন্যান্য কথাবার্তার পর প্রসঙ্গক্রমে কহিলেন, “জুলেখাকে ধরিয়া রাখিলে ভাল হইত। ডাক্তার বেন্টউডের বিপক্ষে এরূপ সাংঘাতিক মিথ্যা সাক্ষ্য দিবার জন্য তাহার কঠিন দণ্ড হওয়া উচিত। সেই বেটীই অনিষ্টের মূল। আমাদের বড়ই ভুল হইয়াছে—বেটী খুব ফাঁকি দিয়াছে।”
দত্ত সাহেব সে কথায় বড়-একটা কান দিলেন না। মুখ তুলিয়া একবার গঙ্গারামের দিকে চাহিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তাঁহার বুকের মধ্যে যে অনলদাহ উপস্থিত হইয়াছিল, যেন তাহারই হল্কা দীর্ঘনিঃশ্বাসের সহিত এক-একবার বাহির হইতেছিল। বাষ্পসংরুদ্ধ কণ্ঠে কহিলেন, “আমার আজ একি সর্ব্বনাশ হইল! সুরেন্—অমর—তোদের মনে এই ছিল রে! তোরা দুইজনেই আমাকে ফাঁকি দিয়া গেলি!”
গঙ্গারাম বড় বিস্মিত হইলেন। কহিলেন, “কি আশ্চর্য্য! আপনি অমরের জন্য আবার দুঃখ করিতেছেন?”
দত্ত সাহেব স্থিরকণ্ঠে কহিলেন, “কেন করিব না, অমরের অপরাধ কি? সুরেন্দ্রের অপেক্ষা অমরেন্দ্রের জন্য আরও দুঃখ হওয়া উচিত। অমর নৈরাশ্যে, ক্ষোভে মরিয়া হইয়া উঠিয়াছিল—– পাগল হইয়া গিয়াছিল—নিশ্চয়ই জুলেখার পরামর্শে সে সুরেন্দ্রকে হত্যা করিয়া থাকিবে। গঙ্গারাম বাবু প্রকৃত কথা বলিতে কি, এখন আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি, এ সকল ভীষণ দুর্ঘটনার জন্য ডাক্তার বেন্টউড দোষী নহেন, সেই জুলেখাই এই সকল সর্ব্বনাশের মূল। সে পিশাচীকে কোন রকমে ধরিতে পারিলে বড় ভাল কাজ হইত।”
গঙ্গারাম কহিলেন, “শীঘ্রই সে ধরা পড়িবে,—মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাহার নামে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে।”
গঙ্গারাম, জুলেখাকে ধৃত করা যতটা সহজ মনে করিতেছেন, সুচতুরা জুলেখাকে যাঁহারা প্রকৃতরূপে চিনিয়াছেন, তাঁহারা ঠিক ততটা সহজ মনে করিতে পারিবেন না। দত্ত সাহেব এই কয়েক দিনে জুলেখার সম্পূর্ণ পরিচয় জ্ঞাত হইয়াছেন; জুলেখা যে আর কখনও ধরা পড়িবে না, সে বিষয়ে তিনি কৃতনিশ্চয় হইতে পারিলেন। জুলেখা এখন টম্বরু হস্তগত করিয়াছে—এইবার সে নিশ্চয়ই একেবার নিজের দেশে ছোটনাগপুরে গিয়া উঠিব; সেই বন্য প্রদেশ হইতে তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করা কিছুতেই সম্ভবপর নহে।
আজ একবারও দত্ত সাহেব বাটীর বাহির হন নাই। যে ঘরে অমরেন্দ্রনাগের মৃতদেহ রাখা হইয়াছিল, কখনও বা সেই ঘরে গিয়া শোকাশ্রু বর্ষণ করিতেছেন, কখনও বা লাইব্রেরী ঘরে আসিয়া প্রকৃতিস্থ হইবার চেষ্টা করিতেছেন। আবার পরক্ষণে উঠিয়া গিয়া অমরেন্দ্রের প্রস্তরকঠিন দেহ বুকে টানিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন। যেমন একদিন সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ বস্ত্রাচ্ছাদিত হইয়া একটি ক্ষুদ্র শয্যার উপর পড়িয়াছিল—আজ অমরেন্দ্রনাথের মৃতদেহও সেই ক্ষুদ্র শয্যায় ঠিক সেইরূপ ভাবে পড়িয়া। যে বিভীষিকা নাটকের যেরূপ শোচনীয় প্রস্তাবনা-দৃশ্যের মাঝখানে একদিন যবনিকা উঠিয়াছিল, দত্ত সাহেবের হৃদয় দ্বিধা করিয়া আজ সেই নাটকের তেমনই একটা ভয়ানক শোকাবহ শেষদৃশ্যের মাঝখানে যবনিকাপাত হইতেছে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ – এখনও অগ্নি নিভিল না
যাঁহাদিগের মুখ চাহিয়া দত্ত সাহেব বড় আশায় বুক বাঁধিয়াছিলেন, আজ তাঁহারা আর এ জগতে নাই। আজ এই জীবন-সায়াহ্নে তাঁহার সকল আশা, সকল আগ্রহ, সকল উদ্যম ব্যর্থ হইয়া গেল। আজ তাঁহার দৃষ্টিসম্মুখে বিশ্বপৃথিবী ঘোর তিমিরাবৃত। আজ সুরেন্দ্রনাথ নাই—অমরেন্দ্রনাথ নাই—অকালে অপঘাতে উভয়েই ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন। তদুভয়ের অভাবে আজ তাঁহার জগতের সকল বন্ধন একেবারে শিথিল হইয়া গিয়াছে। কাহার মুখ চাহিয়া তিনি আর জীবন ধারণ করিবেন? কি কুক্ষণে তিনি পাপ-বিষ-গুপ্তি গৃহে আনিয়া রাখিয়াছিলেন। উভয়েরই বাম করতলে সেই বিষ-গুপ্তির ক্ষতচিহ্ন, উভয়েরই বিষ-গুপ্তির বিষে আজ ইহলোক হইতে অন্তর্হিত। একমাত্র বিষ-গুপ্তি হইতে উভয়েরই কি শোচনীয় পরিণাম! দত্ত সাহেবের পরিণামও কি ভয়ানক!
অমরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ দেখিয়া সুরেন্দ্রনাথের কথা বারংবার দত্ত সাহেবের মনে পড়িতে লাগিল। কিন্তু সে সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ এক্ষণে কোথায়? কে বলিবে, কোথায়? একমাত্র বেন্টউড তাহা জানেন; একমাত্র তিনিই এই প্রশ্নের উত্তর করিতে পারেন। তিনি কি তাহা প্রকাশ করিবেন? যদিও তিনি হত্যাপরাধ হইতে এক্ষণে মুক্তিলাভ করিয়াছেন, এখনও লাসচুরির দাবীতে তিনি অভিযুক্ত; জামিনে খালাস আছেন মাত্র। লাসচুরির মোকদ্দমা উঠিলে, তখন তিনি তৎসম্বন্ধে সত্য প্রকাশ করিবেন কি না—কে জানে?
অপরাহ্নে দত্ত সাহেব লাইব্রেরী ঘরে আসিয়া বসিলে, রহিমবক্স আসিয়া বলিল, সেলিনার মাতা ও সেলিনা তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন। দত্ত সাহেব একবার মন করিলেন, তাঁহাদিগের সহিত দেখা করিবেন না—তাঁহাদিগের জন্যই আজ তাঁহার এই সর্বনাশ উপস্থিত। তাহার পর আবার মনে করিলেন, তাহাদিগের দোষ কি? অদৃষ্টে যাহা ছিল, ঘটিয়াছে—যাহা বাকী আছে, ঘটিবে। তাঁহাদিগকে লইয়া আসিবার জন্য তিনি রহিমবক্সকে অনুমতি দিলেন.
অনতিবিলম্বে কেবল সেলিনার মাতা লাইব্রেরী ঘরে প্রবেশ করিলেন। সেলিনা তাঁহার সঙ্গে নাই।
দত্ত সাহেব দেখিলেন, মিসেস্ মার্শনের মুখমণ্ডল একান্ত বিষণ্ণ। মুখ দেখিয়া বুঝিতে পারা যায়। তিনিও হৃদয়ে বড় আঘাত পাইয়াছেন। কিন্তু কিসের জন্য আঘাত পাইয়াছেন? সুরেন্দ্রনাথের জন্য কি অমরেন্দ্রনাথের জন্য—অথবা জুলেখার জন্য—তাহা তিনিই জানেন।
দত্ত সাহেব তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার সহিত সেলিনাও আসিয়াছিল না?”
সেলিনার মাতা কহিলেন, “হাঁ, আসিয়াছিল; সে কিছুতেই আর আপনার সমক্ষে আসিতে চাহিল না—আমি অনেক বুঝাইলাম, তথাপি সে আমার কথা শুনিল না—চলিয়া গেল। এই কয়েকদিনের দুর্ঘটনায় সে যেন কেমন একরকম হইয়া গিয়াছে; পাগলের মত আপনার মনে কি বলে, কি করে, কাহার সহিত ভাল করিয়া কথা কহে না। তাহার মতিগতি একেবারে খারাপ হইয়া গিয়াছে।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “হইবারই কথা। কেবল সেলিনার কেন, আমারও মতিগতি একেবারে বিগড়াইয়া গিয়াছে। যাক্, এ সকল কথায় আর কাজ নাই। আপনি এখন কি মনে করিয়া আসিয়াছেন, বলুন?”
মিসেস্ মার্শন কহিলেন, “আমরা এখান হইতে উঠিয়া যাইব।”
দত্ত সাহেব সবিস্ময়ে কহিলেন, “উঠিয়া যাইবেন, কেন? কোথায় যাইবেন?”
সেলিনার মাতা কহিলেন, “বোম্বে গিয়া থাকিব, মনে করিতেছি। এখানে বাস করা আমি আর সুবিধাজনক বোধ করি না। এই মাসের মধ্যেই এখানকার বাড়ী বাগান—যাহা কিছু আছে, সমুদয় বিক্রয় করিয়া ফেলিব। এই মাসের মধ্যেই একটা বন্দোবস্ত করিয়া ফেলিতে হইবে। আপনি কি বলেন?”
দত্ত সাহেব বলিলেন, “আমি আর কি বলিব? আপনি নিজে যাহা ভাল বুঝিবেন, করিবেন; আমি ইহাতে আপনাকে কি যুক্তি দিব? আমার নিজেরই বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে লোপ পাইয়াছে। ভাল কথা, জুলেখার কি হইল?”
সেলিনার মাতা কহিলেন, “তাহার কথা আর বলিবেন না—সেই পিশাচী হইতেই এই সকল সৰ্ব্বনাশ ঘটিয়াছে। মোকদ্দমার পর হইতে জুলেখা পালাইয়া গিয়াছে। কই, আর তাহার সন্ধান পাওয়া যায় নাই। হয়ত সে নিজের দেশে চলিয়া গিয়াছে। যাহা হউক, আমিও তাহার হাত এড়াইয়া বাঁচিয়াছি। এখন বুঝিতেছি, কি শয়তানীর হাতে আমি পড়িয়াছিলাম।”
দত্ত সাহেব করিলেন, “পূর্ব্বে ইহা বুঝিতে পারিলে ভাল হইত; কেবল আপনি ত তাহাকে স্পর্দ্ধা দিয়া এই সকল সৰ্ব্বনাশ ঘটাইলেন। আপনি যদি তাহার মন্ত্রতন্ত্রে বিশ্বাস করিয়া, তাহার কথামত না চলিতেন, তাহা হইলে সে আপনাকে হিপ্নটাইজ্ করিয়া বিষ-গুপ্তি সংগ্রহ করিতে পারিত না। বিষ-গুপ্তি না অপহৃত হইলে অকালে আমার সুরেন্দ্র ও অমরেন্দ্রকে প্রাণ হারাইতে হইত না।”
সেলিনার মাতা কাতরকণ্ঠে কহিলেন, “যথেষ্ট হইয়াছে—আমার অবিমৃষ্যকারিতার ফল যথেষ্ট হইয়াছে। আপনি আমাকে আর এ কথা বলিয়া কষ্ট দিবেন না। অনুতাপে আমার হৃদয় দগ্ধ হইতেছে।”
দত্ত সাহেব কঠিনকণ্ঠে কহিলেন, “আমারও দগ্ধ হইতেছে—আমারও হৃদয়ে তুষানলদাহ- আপনি তাহার কি বুঝিবেন? সুরে ও অমর দুজনকেই আমি হারাইয়াছি। দুজনেই মরিয়াছে- একজন অপরের হাতে মরিয়াছে—আর একজন নিজের হাতে মরিয়াছে—সকলই ফুরাইয়াছে। আপনি আপনার কন্যা আর জুলেখা, এই তিন জন হইতেই না আজ আমার এই সর্ব্বনাশ! আপনারা এই দণ্ডেই বোম্বে—যেখানে ইচ্ছা আপনাদের—চলিয়া যান। যাহা হউক, কলিকাতা শহরে আপনারা একটা খুব কীর্তি রাখিয়া গেলেন!”
দত্ত সাহেবের কথা শেষ হইয়াছে মাত্র, সেলিনার মাতা কি বলিবার উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে সহসা সেই কক্ষের দ্বার উন্মুক্ত হইয়া গেল।
উভয়ে সাশ্চর্য্যে সবিস্ময়ে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলেন। কি দেখিলেন? দেখিলেন, সেই উন্মুক্ত দ্বার সম্মুখে দাঁড়াইয়া—সহাস্যমুখে ডাক্তার বেন্টউড।
নবম পরিচ্ছেদ – জুলেখার কথা
দত্ত সাহেব এবং সেলিনার মাতা ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না, তাঁহাদিগের যতদূর অনিষ্ট করিতে হয়, তাহা করিয়া নির্লজ্জ বেন্টউড আর আবার কোন্ সাহসে তাঁহাদিগেরই বাটীতে পদার্পণ করিতে সাহসী হইয়াছেন।
ধীরে ধীরে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বেন্টউড কহিলেন, “মিসেস্ মার্শন! আপনি যে আজ এমন সময়ে—এখানে?”
শিহরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া মিসেস্ মার্শন কহিলেন, “নারকি! তুমি আর আমার সহিত কথা কহিয়ো না। তোমার মত বিশ্বাসঘাতকের সহিত কথা কহিতেও ঘৃণা হয়—তোমার মত লোকের মুখ দেখিতেও পাপ আছে—এখানে আর তিলার্দ্ধ থাকা নয়।” বলিয়া একেবারে গৃহের বাহির হইয়া গেলেন।
বেন্টউড দত্ত সাহেবকে কহিলেন, “বাঁচা গেল! আপনার সহিত গোপনে আমার দুই-একটি কথা আছে।”
দত্ত সাহেব আপদমস্তক রোষ-প্রজ্বলিত হইয়া তীক্ষ্ণস্বরে কহিলেন, “কোন কথা নয়—কোন কথা নয়—তোমার মত পিশাচের সহিত কোন কথা নাই—এখনই তুমি এখান হইতে দূর হইয়া যাও।” বলিতে বলিতে-দত্ত সাহেব বসিয়াছিলেন—উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
ডাক্তার বেন্টউড সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া, গৃহমধ্যস্থ একখানা সর্ব্বাপেক্ষা উপবেশন- আরামদায়ক চেয়ার নির্ব্বাচন করিয়া, তদুপরে উপবেশনপূর্ব্বক কহিলেন, “আমি কাহারও আদেশ মত কাজ করিতে পারি না। যখন নিজের দূর হইতে ইচ্ছা হইবে, তখন আর আপানাকে সে কথা বলিয়া কষ্ট পাইতে হইবে না। আপনি ত জানেন, আমি অনেকটা স্বাধীন-প্রকৃতির লোক।”
দত্ত সাহেব আরও ক্রুদ্ধ হইলেন। কহিলেন, “এখনও আমার কথা শুন, নতুবা ভৃত্যের হস্তে তোমাকে অবমানিত হইতে হইবে।”
বেণ্টউড কহিলেন, “তবে দেখিতেছি, যে প্রয়োজনীয় কথাটা আপনাকে বলিতে আমি এতদূর কষ্ট করিয়া আসিলাম, তাহা শুনিতে আপনার একান্ত ইচ্ছা নাই।”
অনেকটা নরম হইয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “কি কথা—কি এমন প্রয়োজনীয় কথা?”
বে। বস্তুতঃ যাহা ঘটিয়াছে—সত্য সংবাদ
দত্ত। আমি আদালতে তাহা শুনিয়াছি।
বে। তাহা ভুল শুনিয়াছেন। জুলেখার মুখে যাহা শুনিয়াছেন, তাহাও ভুল; সেলিনার মুখে যাহা শুনিয়াছেন—
দত্ত। [বাধা দিয়া] অমরের মুখে যাহা শুনিয়াছি?
বে। তাহাও ভুল—সকল খবরই আমি রাখি। প্রকৃত ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, তাহা সকলই আমি জানি। আপনি কি তাহা শুনিতে চান, না আমাকে দূর হইয়া যাইতে বলেন? কি আপনার অভিরুচি?
দত্ত সাহেব সহসা ইহার কোন উত্তর করিতে পারিলেন না। বেন্টউডের কথায় তিনি আবার বড় গোলমালে পড়িলেন। মনে হইতে লাগিল, বেন্টউডের আরও একটা কিছু অভিপ্রায় আছে। এই হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে এখনও অনেক প্রকৃত কথা জানিতে পারা যায় নাই। জুলেখা নিরুদ্দিষ্টা। একমাত্র বেন্টউডের নিকটেই এখন সেই সকল প্রকৃত সংবাদ পাওয়া যাইতে পারে। এইরূপ ভাবিয়া একটু ইতস্ততঃ করিয়া দত্ত সাহেব পুনরায় নিজের আসন গ্রহণ করিলেন। এবং একটু রুক্ষস্বরে বেন্টউডকে কহিলেন, “কি বলিতে চাও, বল।”
বেন্টউড কহিলেন, “আমি আপনার হত্যাপরাধের দাবী হইতে কিরূপে মুক্তি পাইলাম, তাহা আপনি জানেন। মুক্তিই বা পাইব না কেন? আমার অপরাধ কি? যখন আমি নিজেকে সম্পূর্ণ নিরপরাধ বলিয়া জানি, তখন আমি আপনার মিথ্যা দাবীতে ভীত হইব কেন? যদিও লাসচুরির অপরাধে আমাকে আপাততঃ—”
বাধা দিয়া ক্রোধভরে দত্ত সাহেব কহিলেন, “কোথায় সে লাস? আমি তোমাকে খুব চিনিয়াছি—পাকা বদমায়েস তুমি!”
বেন্টউড কহিলেন, “দেখুন, ইতরের ন্যায় অনর্থক গালাগালি করিবেন না; তাহা হইলে আমি কোন কথা প্রকাশ করিব না। যদি শুনিতে ইচ্ছা থাকে, দ্বিরুক্তি না করিয়া চুপ করিয়া শুনিয়া যান।”
দত্ত সাহেব নীরবে রহিলেন।
বেন্টউড বলিতে লাগিলেন, “লাসচুরির অভিযোগে আমি এখনও অভিযুক্ত; শীঘ্রই ইহার বিচার আরম্ভ হইবে। সেজন্য আমি কিছুমাত্র চিন্তিত নহি। দেখিবেন, এই লাসচুরির মোকদ্দমায় ও আমি কিরূপ ভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করি। আপনার নিকটে খুনের মোকদ্দমার ন্যায় তাহাও স্বপ্নাতীত বলিয়া অনুমিত হইবে। যাহাই হউক, আপাততঃ আমি জামিনে খালাস পাইয়া আপনার সহিত একবার দেখা করিতে আসিলাম।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সর্ব্বনাশের আরও কিছু বাকী আছে কি?”
বেন্টউড সহাস্যে কহিলেন, “সর্ব্বনাশের জন্য নয়—মঙ্গলের জন্য আসিয়াছি। আপনি আমার প্রতি অন্যায় দোষারোপ করিতেছেন। আমার মুখে আদ্যোপান্ত শুনিলে বুঝিতে পারিবেন—এ কি বিস্ময়জনক ব্যাপার!”
দত্ত সাহেব সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি এমন ব্যাপার?”
বেন্ট। ব্যস্ত হইবেন না—ব্যস্ত হইবেন না—যথা সময়ে আমি তাহা আপনার নিকটে প্রকাশ করিব। তাড়াতাড়ি করিবেন না—তাড়াতাড়ির কাজ নয়। ভাল কথা, জুলেখার কি হইল?
দত্ত। সে পালাইয়াছে।
বেন্ট। পলাইবারই কথা—আমার ভয়েই সে পলাইয়া গিয়াছে।
দত্ত। সেটা ঠিক নয়—টম্বরু পাথর এখন তাহার নিকটে—সে এখন আর কাহাকেও ভয় করিবার পাত্রী নহে।
বেন্ট। হাঁ, জুলেখা ভারি চালাক। সে আমার নিকট হইতে টম্বরু পাথরটা বড়ই ফাঁকি দিয়া লইয়াছে। সেদিন আমার খুবই একটা আহাম্মুখী হইয়াছে। আমি যখন হাজতে বন্দী ছিলাম, সেই সময়ে, সে একদিন আমার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল। মোকদ্দমা সংক্রান্ত কোন কথা আছে বলিয়া, সে আমার সহিত নির্জ্জনে দেখা করিবার অনুমতিও পাইয়াছিল। সহসা সেদিন তাহাকে সেখানে উপস্থিত দেখিয়া আমিও অনেকটা সুবিধা বোধ করিলাম। মনে করিলাম, টম্বরুর ভয় দেখাইয়া তাহাকে এমনভাবে সাক্ষ্য দিতে শিখাইয়া দিব, যাহাতে সহজে আমার নিদোষতা সপ্রমাণ হয়। সেই সম্বন্ধেই কথা আরম্ভ করিয়াছি, এমন সময়ে সে নিমেষ মধ্যে বিষ-গুপ্তির বিষের একটা শিশি বাহির করিয়া আমার মুখে সেই বিষ মাখাইয়া দিল, তন্মুহূর্ত্তেই আমি নিঃসংজ্ঞ হইয়া পড়িলাম। জুলেখা অবসর বুঝিয়া সেই টম্বরু পাথরটা সেই সময়েই আমার ঘড়ির চেন হইতে খুলিয়া লইয়াছে।
দশম পরিচ্ছেদ – ইহা কি সম্ভব?
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বিষ-গুপ্তির বিষ কি এমনই ভয়ানক?”
বেন্টউড কহিলেন, “ভয়ানক বই কি, প্রয়োগমাত্রেই মৃত্যু। আদালতে অমরেন্দ্র যখন বিষ-গুপ্তি নিজের করতলে বিদ্ধ করে, তখন আপনি ত নিজেও তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। সেই মুহূর্ত্তেই অমরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হইল। ঐ বিষ শরীরস্থ রক্তের সহিত মিশ্রিত হইতে পারে নাই বালিয়া, আমার মৃত্যু হয় নাই—নিঃশ্বাসের সহিত কেবল গন্ধটা মস্তিষ্কে প্রবেশ করায় আমি অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছিলাম মাত্র। পরে পুনরায় জ্ঞান হইল।”
দত্ত। কতক্ষণ পরে জ্ঞান হইল?
বেন্ট। প্রায় এক ঘণ্টা পরে। জ্ঞান হইলে দেখিলাম, জুলেখা নাই, একজন প্রহরী আমার কাছে বসিয়া রহিয়াছে। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, আমি সহসা মূৰ্চ্ছিত হইয়া গিয়াছি বলিয়া জুলেখা তাহাকে ডাকিয়া আনিয়াছে। তাহার পর কিছুক্ষণ প্রহরীর সহিত মিলিয়া আমার শুশ্রূষা করিতে করিতে জুলেখা কখন তাহার অজ্ঞাতে সরিয়া পড়িয়াছে; কেবল সে নিজে সরিয়া পড়ে নাই—টম্বরুখানাও সরাইয়াছে। তখন আমি বুঝিলাম, আর রক্ষা নাই, এইবারে জুলেখা নিঃসঙ্কোচে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। নিজের সর্ব্বনাশ সমুপস্থিত দেখিয়া আমি অতিশয় ভীত হইলাম। মনে হইল, এইবার বুঝি—
দত্ত। [বাধা দিয়া] ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে হয় কেমন?
বেন্ট। না, তাহা ঠিক নয়; আমাকে ফাঁসীকাঠে ঝুলিতে হইবে না—সে বিশ্বাস আমার মনে প্রচুর পরিমাণে ছিল; সেজন্য আমি একটুও ভাবি নাই। কেনই বা ভাবিতে যাইব? আমি মনে মনে বেশ জানিতাম, যাহাই ঘটুক না কেন—চারিদিক্ হইতে বিপদ্ আসিয়া যেমন ভাবেই আমাকে জড়ীভূত করুক না কেন—আমি নিজেকে নিজে নিশ্চয়ই রক্ষা করিতে পারিব। আর অমরেন্দ্রনাথ যে, এরূপ ভাবে আমার পক্ষ-সমর্থন করিবে, তাহাও আমি পূর্ব্বে ভাবি নাই। কি আশ্চৰ্য্য! এমন জানিলে আমি কখনই তাহাকে আমার পক্ষ-সমর্থনের জন্য অনুরোধ করিতাম না—এমন একটা শোচনীয় কাণ্ড কখনই ঘটিতে দিতাম না।
“অমর রে, হতভাগা—তোর মনে এই ছিল!” বলিয়া দত্ত সাহেব মুখ নত করিলেন। তাঁহার চক্ষু দুটি জলে পূর্ণ হইল।
বেন্টউড কহিলেন, “অমর যে এমন ভয়ঙ্কর নির্ব্বোধ ছিল, তাহা আমি পূর্ব্বে জানিতাম না। একটা স্ত্রীলোকের জন্য নিজে আত্মহত্যা করে, এ জগতে এমন নির্ব্বোধ আর কে আছে?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সেই স্ত্রীলোকেরই জন্য তুমিও ত নিজের জীবন খুব সঙ্কটাপন্ন করিয়াছিলে। ভাগ্যক্রমে মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা পাইয়াছ।”
সরলভাবে বেন্টউড কহিলেন, “আপনি যাহা মনে করিয়াছেন, তাহা ঠিক নয়। সেই স্ত্রীলোকের জন্য নহে, তাহার অতুলৈশ্বর্য্যের জন্য আমি নিজেকে বিপদাপন্ন করিয়াছিলাম মাত্র—তা’ ইহাতে মৃত্যুর হাতে পড়িবার ত কিছুই দেখি না। আমি এখনও বলিতেছি, নিজেকে রক্ষা করিতে পারিব, এ ধারণা আমার মনে বরাবরই খুব প্রবল ছিল।”
দত্ত। আমার ত তাহা বোধ হয় না।
বেন্ট। তবে আমি অমরকে আমার পক্ষ-সমর্থন করিতে বলিলাম কেন?
দত্ত। অমর যে, এরূপ ভাবে তোমার পক্ষ-সমর্থন করিবে, তাহা তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে?
বেন্ট। কিরূপে জানিব? পূৰ্ব্বেই আমি আপনাকে বলিয়াছি। অমর এরূপে আমার পক্ষ-সমর্থন করিবে, আমি তাহা বিন্দু বিসর্গ জানিতাম না। অমরের এরূপ পক্ষ-সমর্থনে আমি একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছি। আমি নিজকে নিৰ্দ্দোষ বলিয়া জানিতাম, তবে আমি কেন প্রাণদণ্ডের ভয় করিতে যাই?
দত্ত সাহেব দেখিলেন, কথায় কথায় তিনি আবার এক বিপুল রহস্যের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছেন; অথচ রহস্যের মর্ম্মভেদ হইতে পারে, বেন্টউডের নিকট হইতে এ পর্যন্ত তেমন একটিও কাজের কথা পাওয়া যাইতেছে না। সমুদয় শুনিবার জন্য তিনি কহিলেন, “প্রাণদণ্ড না হইলেও সুদীর্ঘকাল জেলখানায় বাস করিতে হইবেই।”
বেন্টউড কহিলেন, “কিছুতেই নহে। আপনি এখন এরূপ মনে করিতে পারেন, বটে; কিন্তু আমার স্থির ধারণা, কিছুই হইবে না। মোকদ্দমাটা শেষ হইলেই টম্বরু পাথরখানা আদায় করিবার জন্য আমি একবার ছোটনাগপুরে গিয়া জুলেখার সন্ধান করিয়া দেখিব। তাহার পর একেবারে বোম্বে যাইব। সেখানে কিছুদিন বাস করিব।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “কে জানে মোকদ্দমার ফল কি হইবে? ভাল হইলেই ভাল। বোম্বে গেলে এখানকার দুই-একজন পরিচিত ব্যক্তির সহিত সেখানে সাক্ষাৎ হইবে।”
বেন্টউড কহিলেন, “বটে! আমাদিগের বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে দুই-একজন নাকি? কাহাদের কথা আপনি বলিতেছেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “মিসেস্ মার্শন। তিনি তাঁহার কন্যাকে লইয়া বোম্বে যাইবেন, স্থির করিয়াছেন। সেইখানেই বাস করিবেন।”
বেন্টউড কহিলেন, “বটে! তাহা হইলে এখনও আমার আশা সফল হইবার সম্ভাবনা আছে, দেখিতেছি। পরে হয় ত আমি সেলিনাকে বিবাহ করিতে পারিব।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সেলিনা কখনই তোমাকে বিবাহ করিতে সম্মত হইবে না। তাহার অমতে – “
বেন্টউড বাধা দিয়া কহিলেন, “তাহা আমি জানি। তাহার মতামতে বড় কিছু আসে-যায় না, অনিচ্ছাসত্ত্বেও যাহাতে সে আমাকে বিবাহ করিতে বাধ্য হয়, আমি তাহার উপায় জানি।”
দত্ত সাহেব এইবার স্থৈর্য্য হারাইলেন। একান্ত ব্যগ্রভাবে, একান্ত রুষ্টভাবে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিলেন, “আমি তোমার এ সকল প্রহেলিকার অর্থ ভাল বুঝি না—আমি তোমার মত গোলমেলে লোক আর কখনও দেখি নাই। তুমি এখন কি মনে করিয়া এখানে আসিয়াছ, বল।”
বেন্ট। সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীর নাম আপনার নিকটে প্রকাশ করিতে।
দত্ত। আমি তাহা জানি। অমরেন্দ্র হত্যাকারী।
বেন্ট। ঠিক তাহা নহে। প্রকৃত হত্যাকারীকে রক্ষা করিবার জন্য সে নিজে খুন স্বীকার করিয়াছে।
বজ্রচকিতের ন্যায় দত্ত সাহেব সরিয়া দাঁড়াইলেন। জড়িতকণ্ঠে কহিলেন, “প্রকৃত হত্যাকারীকে রক্ষা করিবার জন্য? কে সে হত্যাকারী?”
বেন্ট। আপনি কি এখনও বুঝিতে পারেন নাই? ভালবাসার পাত্রীর জন্যই লোকে নিজের প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয় না। এখনও কি আপনাকে বুঝাইয়া বলিতে হইবে, কাহার জন্য?
দত্ত। সেলিনা?
বেন্ট। হাঁ, সেলিনা—আর কেহ নহে—সেলিনা নিজহস্তে আপনার সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে।
একাদশ পরিচ্ছেদ – চাক্ষুষী-বিদ্যা
“সেলিনা সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে!” ইহা কি বিশ্বাস? ইহা কখনই হইতে পারে না— একান্ত অসম্ভব।” বলিয়া দত্ত সাহেব বিস্ময়স্থিরনেত্রে বেন্টউডের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
বেন্টউড কহিলেন, “আমার ত তাহা বোধ হয় না; ইহার একটি বর্ণও মিথ্যা নহে। আমি স্বচক্ষে সেলিনাকে খুন করিতে দেখিয়াছি। কেবল আমি কেন, অমরও দেখিয়াছিল।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “ইহাও মিথ্যাকথা—অমর তখন এখানে ছিল না, কলিকাতায় গিয়াছিল।”
বেন্টউড কহিলেন, “একটি বর্ণও মিথ্যা নহে; আপনি ত আদালতে অমরেন্দ্রনাথের মুখেই সে কথা শুনিয়াছেন যে, অমরেন্দ্রনাথ সেদিন কলিকাতায় যায় নাই, সেলিনাদের বাড়ীতে গোপনে অপেক্ষা করিতেছিল।”
দত্ত সাহেব ব্যাকুলভাবে কহিলেন, ‘হাঁ, ঠিক বটে! কিন্তু, সেলিনা যে সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছে, ইহা আমি কখনই বিশ্বাস করিতে পারি না। সুরেন্দ্রনাথের প্রতি সেলিনার যথেষ্ট ভালবাসা ছিল, কেন সে এমন কাজ করিবে? কোন্ কারণে সেলিনা সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিবে? একান্ত অসম্ভব!”
বেন্টউড কহিলেন, “এ জগতে অসম্ভব কিছুই নাই।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “কি কারণে সেলিনা সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিল?”
বেন্টউড কহিলেন, “কারণ কিছুই নাই—তা’ না থাকিলেও, সেলিনাই সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছে।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “কারণ কিছুই নাই, অথচ সেলিনা সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিল; কে এ কথা বিশ্বাস করিবে?”
বেন্টউড কহিলেন, “আপনিই বিশ্বাস করিবেন।”
এই বলিয়া তিনি, গবাক্ষপার্শ্বে একটা কুঁজো ও একটা বড় কাঁচের গ্লাস ছিল, তাহা তুলিয়া আনিয়া দত্ত সাহেবের সম্মুখে টেবিলের উপরে রাখিলেন। এবং কুঁজো হইতে জল ঢালিয়া কাচের গ্লাসটা পূর্ণ করিয়া লইলেন।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “এ আবার কি হইতেছে?”
বেণ্টউড কহিলেন, “আপনি এই গ্লাসটি বেশ করিয়া দেখুন, ইহাতে জল আছে কি না। ঠিক করিয়া বলিবেন।”
দত্ত সাহেব দেখিলেন, গ্লাসটা জলে এরূপ পরিপূর্ণ যে, একটু নাড়া পাইলেই গ্লাস হইতে জল উছলিয়া পড়িয়া যাইবে। দত্ত সাহেব তাহা বেন্টউডকে বলিলেন।
বেন্টউড কহিলেন, “বেশ, এইবার আপনি এই গ্লাসের দিকে এক দৃষ্টে চাহিয়া থাকুন, অন্য কোন দিকে চাহিবেন না।”
পরক্ষণে বেন্টউড বাতিদান হইতে মোমবাতিটা তুলিয়া লইলেন, এবং নিজের পকেট হইতে একটা দিয়াশালাই বাহির করিয়া সেই বাতিটা জ্বালিলেন। গলিত মোমের বিন্দুগুলি নিঃসৃত হইয়া যাহাতে ঠিক গ্লাসের মধ্যে পড়ে, এরূপভাবে সেই প্রজ্বলিত মোমের বাতি ঊর্দ্ধে তুলিয়া ধরিয়া, তিনি দত্ত সাহেবকে কহিলেন, “যতক্ষণ না গ্লাসের জলে পঁচিশ ফোঁটা মোম পড়ে, ততক্ষণ আপনি একদৃষ্টে এই গ্লাসের দিকেই চাহিয়া থাকিবেন।
দত্ত সাহেব স্থিরলক্ষ্যে গ্লাসের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বেন্টউড গণনা করিয়া এক-এক বিন্দু গলিত মোম সেই গ্লাসের জলে ফেলিতে লাগিলেন। দত্ত সাহেব দেখিলেন, গলিত মোম বিন্দুগুলি গ্লাসের জলে পড়িয়া জমাট বাঁধিয়া ছোট ছোট ফোটা সাদা ফুলের মত দেখাইতেছে। দত্ত সাহেব সাশ্চর্য্যে আরও দেখিলেন, একটির পর একটি করিয়া ক্রমান্বয়ে উপর হইতে গলিত মোমের বিন্দুগুলি গ্লাসের জলে পড়িতেছে; সেই সঙ্গে গ্লাসের জলও ক্রমশঃ কমিয়া যাইতেছে। পঁচিশ ফোঁটার শেষ ফোঁটা যখন পড়িল, তখন গ্লাসে আদৌ জল নাই।
বেন্টউড কহিলেন, “এখন একবার ভাল করিয়া দেখুন, গ্লাসে জল আছে কি না। গ্লাস স্পর্শ করিবেন না।”
দত্ত সাহেব বিশেষ মনোযোগ সহকারে দেখিলেন, কিছুমাত্র জল নাই। কহিলেন, “কই, এখন আর জল দেখিতে পাইতেছি না।”
বেন্টউড কহিলেন, “ভাল, যতক্ষণ না আর পঁচিশ ফোঁটা মোম পড়ে, ততক্ষণের জন্য আবার আপনি গ্লাসের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকুন। অন্যদিকে চাহিবেন না।”
দত্ত সাহেব তাহাই করিলেন। দেখিলেন বেন্টউড এবার এক হইতে গণনা আরম্ভ না করিয়া, পঁচিশ হইতে বিপরীত গণনা আরম্ভ করিয়া, এক-এক বিন্দু গলিত মোম সেই গ্লাসে ফেলিতে লাগিলেন। পঁচিশ—চব্বিশ—তেইশ—বাইশ—, ক্রমে দশ,ক্রমে গ্লাসে জল বাড়িতে লাগিল। দত্ত সাহেব দেখিলেন, পূর্ব্ববৎ বিন্দুগুলি পুষ্পাকারে জমাট বাঁধিতে লাগিল। ক্রমে পাঁচ—গ্লাস প্রায় পরিপূর্ণ হইল। ক্রমে যখন গণনা শেষ হইল, তখন গ্লাস পূর্ব্ববৎ পরিপূর্ণ—একটু নাড়া পাইলেই জল, উছলিয়া পড়িয়া যাইবে। জলের উপরে সেই ক্ষুদ্র পুস্পাকৃতি মোমের বিন্দুগুলি ভাসিতেছে। দত্ত সাহেবের বিস্ময়ের সীমা রহিল না।
তখন ডাক্তার বেন্টউড গ্লাস হইতে জল ফেলিয়া দিলেন; এবং গ্লাসটা দত্ত সাহেবের হাতে দিয়া বলিলেন, “এখন আপনি গ্লাসটা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন, ইহা আপনারই নিত্যব্যবহার্য্য গ্লাস। ম্যাজিক দেখাইবার গ্লাস নহে, অথবা সেরূপ কোন কৌশল ইহার মধ্যে নাই। গ্লাসটি বেশ করিয়া দেখুন, আমার কথা সত্য কি না। তাহার পর আমাকে বুঝাইয়াঁ বলুন, এ রহস্যের কারণ কি?”
গ্লাসটি বিশেষরূপে পর্যবেক্ষণ করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “কই, ইহাতে তেমন কোন কৌশল দেখিতেছি না। বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার, এ রহস্যের মর্ম্ম বুঝাইয়া বলিব কি, নিজেই কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।”
বেন্টউড কহিলেন, “ইহা যে ম্যাজিক, নহে; সে সম্বন্ধে আপনি এখনও নিঃসন্দেহ হইতে পারেন নাই, দেখিতেছি। ভাল, আরও আপনাকে দুই-একটা এইরূপ ঘটনা দেখাইব, তখন আপনার মনে আর কোন সন্দেহ থাকিবে না। [ভিত্তি সংলগ্ন ঘড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া] ঐ দেখুন, আপনার ঘড়ীতে এখন সাতটা আটান্ন মিনিট হইয়াছে; এখনই আট্টা বাজিবে, আপনি অনন্যমনা হইয়া এই দুই মিনিট আমার মুখের দিকে চাহিয়া থাকুন।”
দত্ত সাহেব তাহাই করিলেন। স্থিরদৃষ্টিতে বেন্টউডের মুখের দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, তাঁহার চক্ষু উল্কাপিণ্ডের ন্যায় জলিতেছে, কি ভীষনোজ্জ্বল দৃষ্টি—এমন তিনি আর কখনও দেখেন নাই। অতি কষ্টে দত্ত সাহেব, বেন্টউডের চোখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। সেই দুই মিনিট তাঁহার নিকটে দুই ঘণ্টার ন্যায় প্রতীত হইল। দেয়ালের ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া আটা বাজিতে আরম্ভ করিল।
তৎক্ষণাৎ বেন্টউড কহিলেন, “আপনার বাম করতল দেখুন।”
দত্ত সাহেব নিজের বাম করতলের দিকে চাহিলেন। একদিন সুরেন্দ্রনাথের বাম করতলের যেখানে বিষ-গুপ্তির যেমন ক্ষতচিহ্ন, এবং যেরূপ ভাবে দুই-এক বিন্দু রক্ত লাগিয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন, এখন নিজের করতলেও ঠিক সেইস্থানে সেইরূপ ক্ষতচিহ্ন, এবং দুই-একবিন্দু রক্ত দেখিতে পাইলেন। দেখিয়া তিনি বিস্ময়প্রকাশের কিছুমাত্র সময়ও পাইলেন না—দেখিতে দেখিতে তৎক্ষণাৎ সেই ক্ষতচিহ্ন ও দুই-একবিন্দু রক্ত করতলে লীন হইয়া গেল।
বেন্টউড কহিলেন, “এইবার আপনার দক্ষিণ হস্তের করতল দেখুন।
দত্ত সাহেব সবিস্ময়ে দেখিলেন, নিজের দক্ষিণ করতলে রক্তাক্ষরে নিজের নাম স্বাক্ষরিত রহিয়াছে। দেখিবামাত্র অতি সহজে নিজের সেই নাম সহি চিনিতে পারিলেন। দেখিতে দেখিতে তাহাও ক্ষণমধ্যে অস্পষ্ট হইতে অস্পষ্টতর হইয়া করতলেই মিলাইয়া গেল।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – সুন্দরী সসের নীহার
বেন্টউড কহিলেন, “এখন বুঝিলেন কি, কেন এরূপ হইল? ইহা হিপনটিজম ছাড়া আর কিছুই নহে। প্রথমতঃ আপনি জলপূর্ণ গ্লাস, জলশূন্য হইতে দেখিয়াছিলেন, তাহা ঠিক নহে— গ্লাসের জল পূর্ব্ববৎ গ্লাসেই ঠিক ছিল। আমি আপনাকে এরূপভাবে ইচ্ছাশক্তি পরিচালন করিলাম, যাহাতে আপনি মনে করেন, গ্লাসে আর জল নাই, আপনিও ঠিক তাহাই দেখিলেন। তাহার পর আপনি যে নিজের বামকরতলে ক্ষতচিহ্ন, এবং দক্ষিণ করতলে নিজের দস্তখত্, তাহা কিছুই নহে, জানিবেন। ইহা আপনার মনের একটি খেয়ালমাত্র। বলুন দেখি, কি কারণে এরূপ ঘটনা সম্ভবপর?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “প্রবল ইচ্ছাশক্তির নিকটে দুর্ব্বল ইচ্ছাশক্তি কোন কাজ করে না।”
বেন্টউড কহিলেন, “স্বীকার করি, কথাটা ঠিক; কিন্তু ইহাতে আমি বুঝিলাম কি? ইচ্ছাশক্তি দুৰ্ব্বল বা সবল হউক, একে অপরের স্থান কিরূপে অধিকার করিবে? আমার ইচ্ছা আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার ইচ্ছানুযায়ী কাজ করিবে?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সে সম্বন্ধে আমি ঠিক করিয়া কিছুই বলিতে পারিব না। তবে এমন অনেক দেখা যায়—হিপ্নটিজম্ প্রক্রিয়ার কথা বলিতেছি না—অনেকেই পরের পীড়াপীড়ি বা প্ররোচনায় বাধ্য হইয়া, নিজের কিছুমাত্র ইচ্ছা নাই—এমন অনেক কাজ সম্পন্ন করিয়া থাকে।”
বেন্টউড কহিলেন, “বেশ কথা—আপনি যাহা বলিলেন, তাহা বেশ যুক্তিসঙ্গত। উহাও একপ্রকার হিপনটিজম—আপনার ইচ্ছা নাই, অথচ আপনাকে বলিয়া কহিয়া আপনার দ্বারা একটা কাজ করাইয়া লইতে পারি—তাহাতে অবশ্যই আমার নিজের কিছু ইচ্ছাশক্তি অথবা বিশেষ একটা আগ্রহ থাকা প্রয়োজন, নতুবা কার্য্যোদ্ধার হয় না। ভাল আপনাকে আরও একটা বিষয় দেখাইতেছি; আপনি স্থিরমনে আমার তর্জ্জনী অঙ্গুলির দিকে চাহিয়া দেখুন।”
এই বলিয়া বেন্টউড পার্শ্ববর্তী আমারী হইতে একখানি পুস্তক বাহির করিয়া, বামহস্থে সেই পুস্তকের মধ্যবর্তী কোন পৃষ্ঠা উন্মুক্ত রাখিয়া, দত্ত সাহেবের সমক্ষে দক্ষিণ হস্ত সবেগে সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। দত্ত সাহেব দেখিলেন, বেন্টউডের হস্ত মুষ্টিবদ্ধ, কেবল তজ্জনী উন্মুক্ত রহিয়াছে—এবং শতকিয়ার ৪ লিখিবার মত ঘুরিয়া ফিরিয়া সেই হস্ত ঊর্দ্ধ ও অধে ঘন ঘন আন্দোলিত হইতেছে। ক্ষণপরে দেখিলেন, সেই তর্জ্জনীর অগ্রভাগে একটু নীলালোকরেখা—এমন অনুজ্জ্বল, একবার দেখা যাইতেছে, একবার দেখা যাইতেছে না। পরক্ষণে দেখিলেন, সেই গৃহের একটা কোণে অস্পষ্ট ধূমের মত খানিকটা কি দেখা গেল—দেখিতে দেখিতে ধূম নিবিড় হইল— দেখিতে দেখিতে সেই পুঞ্জীকৃত ধূম দীর্ঘে দুইহস্ত পরিমিত হইল। ক্রমে সরিয়া সরিয়া তাঁহারই দিকে আসিতে লাগিল; যত নিকটবর্ত্তী হইতে লাগিল, আকারে ততই বাড়িতে লাগিল। এবং কেমন যেন একটা আকার প্রাপ্ত হইল—আরও দীর্ঘ হইল—আরও দীর্ঘ হইল। দেখিয়া, একটি বহিঃ-রেখাঙ্কিত মনুষ্যাকৃতি বলিয়া তখন দত্ত সাহেবের বোধ হইল। দেখিতে দেখিতে সেই মূৰ্ত্তি স্পষ্ট হইল; দত্ত সাহেব সবিস্ময়ে দেখিলেন, এক অপ্সরোবিনিন্দিতা পরমসুন্দরী আরব-নবীনার মূর্ত্তি। তাহার পরিধানে গাঢ় নীলরঙের পেশোয়াজ; সন্মাচুীর কাজ করা, জাফ্রাণরঙের ঝোলা আস্তীনের ভিতর দিয়া তাহার শ্বেত প্রস্তরচিতবৎ নিৰ্ম্মল, নিটোল হাত দুইখানি দেখা যাইতেছে; রক্তপদ্মাক্ত কোমল করপল্লবে পুষ্পচয় ও পুষ্পলতা। ঈষদুন্নত বক্ষে বিবিধ কারুকার্য্যবিশিষ্ট স্বর্ণতারামালাখচিত সবুজ মখমলের কাঁচুলী! জরদরঙের ঢিলে পাজামা–তন্নিম্নে জরীর চটিজুতা পরা ক্ষুদ্র সুন্দর পা দুইখানি শোভা পাইতেছে। প্রস্ফুটচন্দ্রকরসম্পাতে ঊর্ম্মিচঞ্চল সরোবক্ষে যেমন শোভা হয়, অতুল্য যৌবনলাবণ্যে সেই অসংখ্যমণিমুক্তাহীরকাদি ভূষণালঙ্কৃতা সুবেশা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা সুন্দরীর বর্ণবিভা সর্ব্বাঙ্গে জ্বল্ জ্বল্ করিতেছে; দেখিয়া অনুমিত হয়, তাহার সেই যৌবনপুস্পিতা দেহলতা হইতে, তাহার সেই সৌকুমার্য্যময় সুবিমল ললাট হইতে, এবং তাহার সেই কুসুমকোমল ললাম কপোল হইতে এখনও লুব্ধ তপ্তসূর্য্যকর সেই অপার্থিব আরক্তলাবণ্যবিভা অপহরণ করিতে পারে নাই। মুখখানি অতি সুন্দর,—সুগঠিত ললাট, সেই সুগঠিত ললাটে আলোচনবিলম্বী অলকগুচ্ছ, সুগঠিত নাসা, ভ্রূ সুগঠিত, সুগঠিত চক্ষু ও চক্ষুঃপল্লব। সুগঠিত কপোল, চিবুক সুগঠিত—কিছুরই তুলনা হয় না; তেমনই অতুলনীর সম্পূর্ণ মৃদুরক্ত ওষ্ঠাধরে সুমধুর মৃদুহাসি। অসামান্য রূপৈশ্বর্য্যে সেই মুর্ত্তি উজ্জ্বলপ্রজ্বলিতরক্তালোকপরিবেষ্টতবৎ প্রতীয়মান হইতেছে। দত্ত সাহেব দেখিলেন, সেই রক্তালোকমণ্ডলমধ্যবর্তিনীর অতিদীর্ঘ কৃষ্ণতার ঈষচ্চঞ্চলোজ্জ্বল নয়ন দুটি তাঁহারই দিকে চাহিয়া আছে। সেই আলোকময়ীর আপাদমস্তক—প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রস্ফুট এবং প্রোজ্জ্বল; এমন কি কনিষ্ঠাঙ্গুলির অঙ্গুরীয়কটি পর্য্যন্ত সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছে। এই ছায়ামূর্ত্তি এত পরিষ্কার এবং এমন নিঁখুত যে, ছায়ামূর্ত্তি বলিয়া বোধ হয় না। দেখিয়া দত্ত সাহেব মনে করিলেন, যদি আমি পূৰ্ব্বে ইহাকে কোথায় দেখিতাম, আজ চিনিয়া লইতে ক্ষণমাত্র বিলম্ব হইত না। দেখিতে-না-দেখিতে, সেই মূর্ত্তি অস্পষ্ট হইল—আরও অস্পষ্ট হইল—আরও অস্পষ্ট—আরও—দেখিয়া আর কিছুই বুঝা যায় না—আর কিছুই নাই—না সেই আলোকমণ্ডল—না সেই তন্মধ্যবর্তিনী লাবণ্যময়ী—না তাহার সেই করধৃত পুষ্পস্তবক ও পুষ্পলতা। দেখিতে না দেখিতে সকলই মিলাইয়া গেল। কেবল সেই আলেকমণ্ডলটী পুঞ্জীকৃত ধূমের ন্যায় বোধ হইতেছে। তাহাও ক্রমে ছোট হইয়া, তরল হইয়া মিলাইয়া আসিতেছে—দেখিতে না দেখিতে গৃহকোণে লীন হইয়া গেল। এ কি অলৌকিক রহস্য! দেখিয়া দত্ত সাহেব চমকিত হইলেন। সমুদয় স্বপ্ন বলিয়া মনে হইল। সবিস্ময়ে বেন্টউডের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। সবিস্ময়ে দেখিলেন, অর্দ্ধমুদিতনেত্রে এক-দৃষ্টে তাঁহারই দিকে বেন্টউড চাহিয়া আছেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – ঘটনা-রহস্য
দত্ত সাহেব প্রকৃতিস্থ হইলে, বেন্টউড নিজ হস্তহিত সেই পুস্তকখানি বন্ধ করিয়া দত্ত সাহেবের হাতে দিয়া কহিলেন, “এইমাত্র আপনি সে সুন্দরীকে দেখিলেন, এই পুস্তক মধ্যে তাহার প্রতিকৃতি আছে কি না খুঁজিয়া দেখুন।”
দত্ত সাহেব দেখিলেন, সে পুস্তকের নাম ‘আরেবিয়ান নাইটস্।’ তিনি সৌৎসুকে পাতার পর পাতা উল্টাইয়া যাইতে লাগিলেন। পুস্তকখানি সুরঞ্জিত চিত্রশোভিত। প্রায় মাঝামাঝি উল্টাইয়া দেখিতে পাইলেন, এইমাত্র যে সুন্দরীকে দেখিয়াছিলেন, তাহারই একখানি নিখুঁত প্রতিকৃতি; তন্নিম্নে লিখিত রহিয়াছে, “হারুণ-অল্-রসীদের প্রিয়তমা সুন্দরী সমসেল্ নীহার।”
কি আশ্চৰ্য্য! সেই মুখ, সেই চোখ, সেই-দৃষ্টি, এবং সেই হাসি; পরিধানে সেই ঘন নীলরঙের পেশোয়াজ, এবং জরদ রঙের ঢিলে পাজামা, বাহূপরি জাফ্রাণ রঙের সেই আস্তীন। এবং পদ্মার করতলে প্রস্ফুটিত পুষ্পদাম ও পুষ্পলতা। সেই সব—এমন কি কনিষ্ঠাঙ্গুলিতে অঙ্গুরিটি পর্য্যন্ত রহিয়াছে। দত্ত সাহেব স্তম্ভিতভাবে বেন্টউডের মুখের দিকে চাহিলেন।
বেন্টউড কহিলেন, “কি দেখিলেন? কিছু বুঝিতে পারিলেন কি?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “কিছু না—কিছু না, বড়ই আশ্চর্য্য ব্যাপার এ কি রহস্য!”
বেন্টউড কহিলেন, “আপনি কি বোধ করেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “বোধ আর কি করিব, ইহাও হিপ্নটিজম্ হইবে।”
বেন্টউড কহিলেন, নিশ্চয়ই। এখন বুঝিতে পারিলেন, হিটিজমের দ্বারা কতটা কাজ হয়। আমি যাহা মনে করিব, বা চিন্তা করিব, কেবল তাহাই আপনি দেখিবেন না—কোন একখানি প্রতিকৃতিকে সজীব করিয়াও দেখান যাইতে পারে। আমি যে ছবিখানি দেখিতেছিলাম, বলুন দেখি, কিরূপে তাহার পূর্ণ প্রতিকৃতি আপনার চোখে প্রতিফলিত করিলাম? এমন কি যদি বলেন, আমি এই হিটিজম্ প্রক্রিয়ার দ্বারা আরও শতবিধ অদ্ভুত ব্যাপার আপনাকে দেখাইতে পারি। এমন কি মনে করিলে, আপনি যখন এখানে ঘুমাইবেন, তখন আমি নিজের বাড়ীতে বসিয়া আপনাকে গভীর রাত্রে জাগাইতে পারি, জাগিয়া আপনি কোন বহুদিনমৃত বন্ধুকে শয্যাপার্শ্বে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিবেন। মনে করিলে এই হিটিজমে আপনাকে আকাশে তুলিতে পারি, স্বর্গে লইয়া যাইতে পারি, আবার নরকের মধ্যেও ফেলিতে পারি—এমন কি মনে করিলে, আপনাকে অতল সাগরগর্ভেও শায়িত করিতে পারি।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সকল বুঝিলাম। কিন্তু, সেলিনা কোন্ কারণে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিল—বুঝিলাম না। কিরূপে আমি ইহা বিশ্বাস করিব?”
বেন্টউড কহিলেন, “কেন বিশ্বাস করিবেন না? সেলিনার মাতা বিষ-গুপ্তি অপহরণ করিয়াছিলেন, তাহা যখন আপনি বিশ্বাস করিয়াছেন, তখন ইহাও আপনি অবশ্য বিশ্বাস করিবেন। বলুন দেখি, কোন্ কারণে সেলিনার মাতা আপনার বিষ-গুপ্তি অপহরণ করিয়াছিলেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “তিনি যাহা করিয়াছেন, তাহা নিজের অজ্ঞাতে–স্বেচ্ছায় নহে। তাঁহাকে পাপিষ্ঠা জুলেখা হিপ্নটাইজ করিয়াছিল।”
বেন্টউড কহিলেন, “সেলিনারও সেই দশা ঘটিয়াছিল। যাক্, আর তর্কবিতর্কে কাজ নাই। প্রকৃত ব্যাপার যাহা কিছু ঘটিয়াছে, আমার মুখে শুনুন। জুলেখা, সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিবার উদ্দেশ্যে সেলিনাকে হিপ্নটাইজ করিয়াছিল। সেলিনা সেই মোহিষ্ণু অবস্থায় নিজের অজ্ঞাতে সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছে। এমন কি এখনও সেলিনা এ সম্বন্ধে কিছুই জানে না—এখনও তাহার মনে দৃঢ় বিশ্বাস, অমরেন্দ্রই সুরেন্দ্রের হত্যাকারী।”
দত্ত সাহেবের মনে হইল, তিনি যেন স্বপ্ন দেখিতেছেন, সেইরূপ স্বপ্নাসক্তের ন্যায় জড়িতকণ্ঠে কহিলেন, “তবে কি অমরেন্দ্র সেলিনাকে বাঁচাইবার জন্য নিজের প্রাণ দিল?”
বেন্টউড কহিলেন, “নিশ্চয়ই—কিন্তু সেলিনা ইহার বিন্দুবিসর্গ জানে না।”
দত্ত সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেলিনা সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছে, অমর তাহা কিরূপে জানিতে পারিয়াছিল?”
বেন্টউড কহিলেন, “অমর স্বচক্ষে তাহা দেখিয়াছিল। যাহা কিছু ঘটিয়াছে, সমুদয়ই আপনাকে বুঝাইয়া বলিতেছি। যাহাতে সেলিনা ও সুরেন্দ্রনাথের পরস্পর দেখা সাক্ষাৎ না হয়, সেজন্য সেলিনার মাতা সুরেন্দ্রনাথকে তাঁহাদিগের বাটীতে যাইতে নিষেধ করেন। যেদিন সুরেন্দ্রনাথ খুন হয়, সেইদিন সুরেন্দ্রনাথ সন্ধ্যার পর সেলিনাদের বাটীতে গিয়াছিল। গোপনে সেলিনার সহিত সাক্ষাতের বন্দোবস্ত ছিল। বলিতে পারি না, অমরেন্দ্রনাথ তাহা কিরূপে জানিতে পারে; তদুভয়ের মধ্যে কি কথাবার্তা স্থির হয়, অন্তরালে থাকিয়া তাহা শুনিবার জন্য অমরেন্দ্রনাথও সন্ধ্যার পর সেলিনাদের বাটীতে যাইতে মনস্থ করে। পাছে সুরেন্দ্রনাথের মনে কোন সন্দেহ উপস্থিত হয়, সেইজন্য অমরেন্দ্রনাথ কলিকাতায় যাইব বলিয়া, পূর্বেই বাটী হইতে বহির্গত হয়। কিন্তু কলিকাতায় না গিয়া, অমরেন্দ্র যথা সময়ে সেলিনাদের বাটীতে গিয়া গোপনে সুরেন্দ্রনাথের অপেক্ষা করিতেছিল। ঠিক সেই সময়ে আমিও ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হইয়াছিলাম। অমরেন্দ্র যে অভিপ্রায়ে গিয়াছিল, আমিও ঠিক সেই অভিপ্রায়ে সেখানে গিয়াছিলাম।”
দত্ত সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেলিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথ দেখা করিতে যাইবে, তাহা তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে?”
বেন্টউড কহিলেন, “জুলেখার মুখে আমি শুনিয়াছিলাম। জুলেখা সকল খবরই রাখিত— সেলিনাদের বাটীতে যখন যাহা কিছু ঘটিত, জুলেখার নিকটে আমি সকল খবরই পাইতাম। আমি সেলিনাদের বহির্ব্বাটীতে অমরেন্দ্রকে লুকাইয়া থাকিতে দেখিয়া তাহার মনের ভাব বেশ বুঝিতে পারিলাম। তাহাকে কোন কথা বলিলাম না—দেখা করিলাম না—গোপনে আমিও অপর স্থানে লুকাইয়া রহিলাম। পরে যথাসময়ে সুরেন্দ্র দেখা দিল। এদিকে সেলিনাও বাড়ীর ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিল—তাহার হাতে বিষ-গুপ্তি—চক্ষু দুটী অৰ্দ্ধমুদিত। চোখমুখের ভাব ও চলিবার ভঙ্গীতে বুঝিতে পারিলাম, সেলিনা তখন সহজ অবস্থায় নাই—তাহাকে কেহ হিপ্নটাইজ় করিয়াছে। সেলিনা সুরেন্দ্রনাথের দিকে অগ্রসর হইয়া চলিল। সেলিনাকে সম্মুখবর্তিনী হইতে দেখিয়া সুরেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল। সেলিনার হাতে বিষ-গুপ্তি ছিল, হৃদয়ের আবেগে সুরেন্দ্রনাথ তাহা দেখিয়াও দেখিল না। প্রণয় মনুষ্যকে বিবেক সম্বন্ধে অন্ধ করে জানিতাম, এখন দেখিলাম, কেবল তাহাই নহে, প্রণয় মনুষ্যকে সত্যসত্যই অন্ধ করে। যাহাই হউক, সুরেন্দ্রনাথ সেলিনাকে সম্মুখবর্তিনী দেখিয়া যেমন উভয় হস্ত প্রসারিত করিয়া তাহাকে বক্ষে ধরিতে যাইবে— সেলিনা সেই বিষ-গুপ্তি সুরেন্দ্রনাথের বাম করতলে বিদ্ধ করিয়া দিল। তখনই সুরেন্দ্রনাথ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করিয়া মাটীতে পড়িয়া গেল। তখনই তাহার মৃত্যু হইল।”
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – রহস্য-সংযোগ
দত্ত সাহেব উত্তেজিতভাবে কহিলেন, “কি ভয়ানক! সেলিনাদের বাড়ীতে এই হত্যাকাণ্ড হইয়াছিল!”
বেন্টউড কহিলেন, “সেলিনাদের বাড়ীতেই এই ঘটনা হইয়াছিল। সুরেন্দ্রনাথকে আঘাত করিয়াই সেলিনা বিষ-গুপ্তিটা সেইখানে ঘাস-বনে ফেলিয়া দিল। আশানুল্লা সেইখান হইতে ঐ বিষগুপ্তি কুড়াইয়া আনে, আপনি তাহা জানেন। বিষ-গুপ্তি ফেলিয়া দিয়া সেলিনা দ্রুত পদে বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেল। সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ সেইখানে পড়িয়া রহিল। তখন উজ্জ্বলচন্দ্রালোকে চারিদিক্ দেখা যাইতেছিল। গতিক ভাল নয় দেখিয়া, অমর আর আমি স্ব স্ব গুপ্তস্থান হইতে একসঙ্গে বাহির হইয়া পড়িলাম। অমর আমাকে দেখিয়া বিস্মিত হইল। সেলিনাদের বাড়ীতে মৃতদেহ ফেলিয়া রাখা যে যুক্তিসঙ্গত নহে, দুই-এক কথায় তখনই তাহা আমি অমরকে বুঝাইয়া বলিলাম। অমরও বুঝিল, মৃতদেহ তখনই সেখান হইতে স্তানান্তরিত করিতে হইবে। তখন দুজনে মিলিয়া ধরাধরি করিয়া, সেই মৃতদেহ বাহির করিয়া বাহিরের পথে আনিয়া ফেলিলাম। এমন সময়ে কিছুদূরে কাহার পদশব্দ শুনিলাম। শুনিয়াই মৃতদেহ ফেলিয়া আমরা পলাইয়া গেলাম। নতুবা খুনের অপরাধে আমরাই তখন ধরা পড়িতাম। ঠিক সেই সময়ে আপনি আসিয়া সেই মৃতদেহ পথের ধারে পড়িয়া থাকিতে দেখিলেন।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “হাঁ, আমি সুরেন্দ্রনাথের আর্তনাদ শুনিয়াই তখনই ছুটিয়া গিয়াছিলাম। কই, তোমাদের কাহাকেও সেখানে দেখি নাই।”
বেন্টউড কহিলেন, “আপনার পদশব্দ শুনিয়াই, আমরা যত শীঘ্র সম্ভব পলাইয়া গিয়াছিলাম। সাধ করিয়া কে ফাঁসীর দড়ীটা টানিয়া নিজের গলায় লাগাইতে চাহে? এখন আপনি বুঝিতে পারিলেন কি, কেন অমরেন্দ্র আপনার সহিত এরূপ ব্যবহার করিতেছিল? কেন সে আপনার বিপক্ষে—আমার পক্ষ-সমর্থনে সম্মত হইয়াছিল?”
দত্ত সাহেব একটা মর্মান্তিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “সকলই বুঝিয়াছি। অমর বলিয়াছিল, যখন আমি প্রকৃত ব্যাপার জানিতে পারিব, তখন তাহার সকল অপরাধ মার্জ্জনা করিব—এখন দেখিতেছি, তাহাই ঠিক। নিরপরাধা সেলিনাকে রক্ষা করিতে সে প্রাণপণ করিয়াছিল। এদিকে আবার তোমারও কোন অপরাধ নাই, অথচ তোমার এই বিপদ–তোমাকেও রক্ষা করিতে হইবে। অমর ঠিক করিয়াছে। এরূপ স্থলে ইহা ভিন্ন আর উপায় কি? অমর দেবতার কাজ করিয়াছে—অমর মানুষ ছিল না—সে দেবতা—স্বর্গে গিয়াছে। হায়, তোমরা যদি পূর্ব্বে আমার কাছে এই সকল বিষয় প্রকাশ করিতে, তাহা হইলে আমি কখনই এতটা ঘটিতে দিতাম না।”
বেন্টউড কহিলেন, “আমার বিবেচনায় তাহা ঠিক নহে। সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে আপনার মনের অবস্থা ঠিক ছিল না; বিশেষতঃ আপনি আমার প্রতি যেরূপ অন্যায় দোষারোপ করিতে লাগিলেন, তাহাতে আপনার নিকটে তখন কোন কথা প্রকাশ করিতে আমাদের সাহস হইল না।” শুনিয়া রাগিয়া দত্ত সাহেব উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কহিলেন, “আমি তোমার উপরে অন্যায় দেষারোপ করিয়াছি? আমি এখনও বলিতেছি, একমাত্র তুমিই এই সকল দুর্ঘটনার মূল। অনুরাগেই হউক, বা বিষয়ের লোভেই হউক—যেজন্যই হউক না কেন, তুমি যদি সেলিনাকে বিবাহ করিবার জন্য এতটা ব্যগ্র না হইতে, তাহা হইলে কখনই আমার এ সর্ব্বনাশ ঘটিত না। জুলেখার এমন কি দোষ? টম্বরুর ভয় দেখাইয়া তুমি তাহাকে যাহা হুকুম করিতে, সে তাহাই করিত। তুমি যেরূপ দোষী, জুলেখা ততটা নহে। তোমার জন্যই আমি সুরেন্দ্র ও অমরকে চিরকালের জন্য হারাইয়াছি? তুমি যেরূপ মহাপাপী, তোমার মুখ দেখিলেও পাপ আছে।”
বেন্টউড বিরক্তভাবে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “আপনার যাহা মনে আসে বলুন, তাহাতে আমার বিশেষ ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই। দেখিতেছি, আপনার মনে এখনও বিশ্বাস, আমি মহাপাপী—সকল দোষ আমারই। ভাল, কাল যদি আপনি বৈকালে আমার সহিত একবার দেখা করেন, তাহা হইলে প্রমাণ পাইবেন, আপনি আমাকে যেরূপ ভয়ানক পিশাচ মনে করিতেছেন, ঠিক তাহা নহে। ভাল, কাল আমি বৈকালে একবার আসিব
দত্ত। আর তোমাকে আসিতে হইবে না—তোমার ছায়াস্পর্শ করা অবিধেয়। আমি আর তোমার মুখদর্শন করিতে চাহি না।
বেন্ট। পরে না করেন, ক্ষতি নাই। কাল একবার করিবেন, নতুবা নিজেই ঠকিবেন। তাহা হইলে, ইহার জন্য আপনাকে পশ্চাত্তাপ করিতে হইবে। বিশেষ কথা আছে।
দত্ত। কি এমন কথা?
বেন্ট। কাল জানিতে পাইবেন।
দত্ত। এখন বলিলে ক্ষতি কি?
বেন্ট। না—কাল বলিব।
দত্ত। এখন না বলিবার কারণ?
বেন্ট। কারণ জিজ্ঞাসা করিবেন না। কাল সমুদয় জানিতে পারিবেন। আপনি যদি সদ্বিবেচক হন, আমার সহিত দেখা করিতে অমত করিবেন না। কাল বৈকালে সেলিনা ও তাহার মাকে এখানে আসিতে বলিবেন। তাঁহাদিগকেও প্রয়োজন আছে।
দত্ত। তাঁহারা কেহই আসিবেন না। এই ত এখনই দেখিলে, তোমাকে এখানে আসিতে দেখিয়া মিসেস্ মার্শন রাগিয়া চলিয়া গেলেন।
বেন্টউড কহিলেন, “হাঁ, মিসেস্ মার্শনকে আমি জানি; তাঁহার বুদ্ধি-বিবেচনা কিছুই নাই। যাহা হউক, আমি আপাততঃ উঠিলাম। আপনি কি কাল আমার সহিত দেখা করিতে সম্মত আছেন?” বলিয়া টুপীটা লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
দত্ত সাহেব কহিলেন, “আচ্ছা, তাহাই হইবে, যদি বিশেষ কোন কথা থাকে, একবার দেখা করিতে ক্ষতি কি?”
বেন্টউড কহিলেন, “মিসেস্ মার্র্শন আর তাঁহার কন্যাকে আসিতে বলিবেন। ভুলিবেন না।” দত্ত। চেষ্টা করিয়া দেখিব।
“বেশ কথা।” বলিয়া বেন্টউড বিদায় লইলেন। ঘরের বাহিরে গিয়া, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ায়, ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, “আর একটা কথা, সেলিনা সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে, ইহা আপনি সেলিনার নিকটে প্রকাশ করিবেন না।”
দত্ত সাহেব একটু ভাবিয়া কহিলেন, “না, এখন কোন কথা বলিব না। কিন্তু ইহার পর বলিব—অমর যাহার জন্য নিজের প্রাণ দিয়াছে, সে ইহা জানিবে না?”
বেন্টউড কহিলেন, “জানিয়া লাভ কি? লাভের মধ্যে ইহাই হইবে, যখন সেলিনা জানিবে, সে নিজেই সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছে, তাহার অপরাধে নিরপরাধ অমরেন্দ্র প্রাণ দিয়াছে, তখন সেলিনার মনের অবস্থা কি ভয়ানক হইবে, ভাবিয়া দেখুন দেখি; হয়ত সে চিরকালের জন্য উন্মাদিনী হইয়া যাইবে। সেলিনা এখন এক রকম বেশ আছে, কেন আর তাহাকে চিরব্যথিত করিবেন? আমি আপনাকে বিশেষ করিয়া বলিতেছি, ঘুণাক্ষরেও আপনি সেলিনার কাছে কোন কথা প্রকাশ করিবেন না—তাহার সর্ব্বনাশ করিবেন না। বিশেষতঃ যতক্ষণ না কাল আমি আপনার সহিত দেখা করিতেছি, ততক্ষণ আপনি এ বিষয়ে খুব সাবধানে থাকিবেন। আপনি বরং ইহার জন্য শপথ করুন।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “ভাল, তাহাই হইবে, আমি স্বীকার করিলাম, সেলিনাকে কোন কথা বলিব না।”
পরক্ষণে বেন্টউড চলিয়া গেলেন।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
অনন্তর দত্ত সাহেব, পরদিন অপরাহ্ণে কন্যা সমভিব্যাহারে মিসেস্ মার্শনকে আসিবার জন্য একখানি পত্র লিখিয়া রহিমবক্সের মারফৎ পাঠাইয়া দিলেন। বেন্টউডের সম্বন্ধে কোন কথা পত্রে উল্লেখ করিলেন না। তিনি জানিতেন, সেই সময়ে বেন্টউড উপস্থিত থাকিবে, ইহা মিসেস্ মারশন জানিতে পারিলে কখনই আসিবেন না। বেন্টউডের উপরে তাঁহার ভয়ানক রাগ। অনতিবিলম্বে প্রত্যুত্তর লইয়া সেলিনাদের বাটী হইতে রহিমবক্স ফিরিয়া আসিল। সেলিনার মাতা আসিতে সম্মত হইয়াছেন।
শুনিয়া দত্ত সাহেব আশ্বস্ত হইলেন। আপন মনে বলিলেন, “বাঁচা গেল, বেন্টউড—লোকটা বড়ই ভয়ানক—দেখি, পিশাচের মনে আরও কি আছে?”
বেন্টউডের কথাগুলি দত্ত সাহেব বহুক্ষণ মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন। ভাবিয়া কিছুই ঠিক করিতে পারিলেন না। বেন্টউড কল্য অপরাহ্ণে এখানে সেলিনার মাতা ও সেলিনাকে কেন উপস্থিত থাকিতে বলিয়া গেল, এবং ইহাতে তাহার কি অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। নিতান্ত উদ্বেগের সহিত বেন্টউডের পুনরাগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
বেন্টউডকে বিশ্বাস নাই—হয় ত আবার অমরেন্দ্রের লাসও অপহৃত হইতে পারে, যে ঘরে অমরেন্দ্রের মৃতদেহ ছিল, সেই ঘরে দত্ত সাহেব সারারাত্রি জাগিয়া কাটাইলেন।
প্রভাতে রহিমকে অমরেন্দ্রের মৃতদেহের পাহারায় রাখিয়া নিজে স্নানাদি সমাপন করিলেন। মনে মনে স্থির করিলেন, আজ বেন্টউড আসিলে, সহজে তাহাকে ছাড়া হইবে না; কাল বড় ফাঁকি দিয়া গিয়াছে। সে নিশ্চয়ই সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহের সকল খবর রাখে, সে নিজেই মৃতদেহ বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে। আজ আসিলে, জোর করিয়া তাহার নিকট হইতে সমুদয় কথা বাহির করিয়া লইতে হইবে। যতক্ষণ না সমুদয় কথা স্বীকার করিবে, কিছুতেই তাহার নিস্তার নাই।
অপরাহ্ণে সেলিনার মাতা কন্যাসহ দত্ত সাহেবের বাটীতে দেখা দিলেন। সেলিনাকে দেখিয়া আর চিনিতে পারা যায় না। তাহার মুখমণ্ডল বিবর্ণ ও শুষ্ক—দৃষ্টিতে সে ঔজ্জ্বল্য নাই—একান্ত নিষ্প্রভ—যেন কতদিন রোগভোগ করিয়া এইমাত্র উঠিয়া আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়া দত্ত সাহেবের মনে বড় কষ্ট হইতে লাগিল। মনে ভাবিলেন, হতভাগিনি, তুমি জান না, তুমি নিজের হাতে কি ভয়ানক কাজ করিয়াছ। তোমার দোষ কি, জুলেখা ও বেন্টউড এই সকল দুর্ঘটনার মূল সেই পিশাচ-পিশাচীর হাতে পড়িয়া তুমি মহাপাপ করিয়াছে।।
মূর্ত্তিমতী বিষণ্ণতা সেলিনার সেই ম্লান মুখের দিকে দত্ত সাহেব ভাল করিয়া চাহিতে পারিলেন না। সেলিনাকে তিনি যেরূপ কাতর দেখিলেন, তাহাতে বেন্টউড তাঁহাকে সেলিনার নিকটে হত্যা-সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে মানা না করিলেও তিনি কিছুতেই তাহা সেলিনার নিকটে প্রকাশ করিতে সাহস করিতেন না।
সেলিনার মাতা কহিলেন, “কাল বেন্টউড আপনার এখানে কেন আসিয়াছিল?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সেদিন সুরেন্দ্রনাথ যেরূপে খুন হয়, তাহা বলিতে আসিয়াছিল। সেলিনা কহিল, “ডাক্তার বেন্টউড বড় ভয়ানক লোক—তাহারই মন্ত্রণার অমরেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছেন। সেদিন আমার সহিত সুরেন্দ্রনাথের দেখা করিবার কথা ছিল। তাঁহার সহিত দেখা হইলে আমি তাঁহাকে সাবধান করিয়া দিতে পারিতাম। অমরেন্দ্রনাথ ও বেন্টউডের সঙ্গে বিবাদ করিতেও মানা করিতে পারিতাম।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “সেদিন সন্ধ্যার পর সুরেন্দ্রনাথের সহিত কি তোমার দেখা হয় নাই?” সেলিনা কহিল, “না, দেখা করিতে পারি নাই। সুরেন্দ্রনাথ হয়ত বহির্ব্বাটীতে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন, এমন সময়ে অমরেন্দ্রনাথ আসিয়া পড়েন; কথায় কথায় তাঁহার সহিত বিবাদ ঘটায় অমরেন্দ্র তাঁহাকে খুন করিয়াছেন।”
সেলিনার সরল কথার ভাবে দত্ত সাহেব বুঝিতে পারিলেন, সেলিনা নিজ হস্তে কি ভয়ানক কাজ করিয়াছে, কিন্তু নিজে সে তাহার কিছুই অবগত নহে। জিজ্ঞাসা করিলেন, “সেদিন তুমি সুরেন্দ্রনাথের সহিত কেন দেখা করিতে পার নাই?”
সেলিনা কহিল, “সেদিন আমি বড় অসুস্থ ছিলাম। জুলেখা আমার কাছে ছিল; সে আমাকে নীচে নামিতে দেয় নাই। যখন আমার একান্ত কষ্ট হইতে লাগিল, সে নিজে ঝাড়-ফুঁক্ মন্ত্রে আমার চিকিৎসা করে। তখনই আমি ঘুমাইয়া পড়ি। যখন ঘুম ভাঙিল, তখন রাত অনেক।
দত্ত সাহেবের মনে আর কোন সন্দেহ রহিল না। বুঝিতে পারিলেন, বেন্টউড যাহা বলিয়াছিল, তাহা মিথ্যা নহে। সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিবার জন্য জুলেখা সেলিনাকে হিপ্নটাইজ করিয়াছিল। পিশাচী জুলেখাই সেলিনা-মূৰ্ত্তিতে সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছে।
ষোড়শ পরিচ্ছেদ – এ কি স্বপ্ন!
অন্যান্য দুই-একটি কথার পর সেলিনার মাতা দত্ত সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি আমাদিগকে আসিতে লিখিয়াছেন কেন?”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “ডাক্তার বেন্টউডের কথামত আমি আপনাদিগকে আসিতে লিখিয়াছিলাম। এখনই বেন্টউড আসিবে। তাহার আসিবার কথা আছে।”
শুনিয়া ক্রোধভরে সেলিনার মাতা উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কহিলেন, “তাহা হইলে আপনি আমাদিগকে অপমানিত করিতে মনস্থ করিয়াছেন। আপনার এরূপ ব্যবহারে আমি বিশেষ দুঃখিত হইলাম। বুঝিতে পারিলাম না, আপনার উদ্দেশ্য কি।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “এখানে আনিয়া আপনাদিগের অপমান করা আমার উদ্দেশ্য নহে। বেন্টউডের বিশেষ অনুরোধ ক্রমে আমি আপনাদিগকে আসিতে লিখিয়াছিলাম। বেন্টউডের কোন উদ্দেশ্য আছে, বোধ করি।”
সেলিনা সবিস্ময়ে কহিলেন, “কি উদ্দেশ্য বেন্টউড আপনাকে এমন অনুরোধ করিয়াছে, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না।”
দত্ত সাহেব কহিলেন, “আমিও তাহা ঠিক বলিতে পারি না। বোধ করি, আমাদিগের এই সকল দুর্ঘটনার সম্বন্ধে যাহা কিছু সে জানে, অদ্য তাহা প্রকাশ করিবে।”
সেলিনার মাতা কহিলেন, “যাহা প্রকাশ হইবার তাহা ত হইয়াছে—সকলই আমরা শুনিয়াছি। যাহা হউক, আপনি যে বেন্টউডের কথামত আমাদিগকে আসিতে লিখিয়াছেন, সে কথা পূৰ্ব্বে জানিতে পারিলে কখনই আমরা আসিতাম না। আপনি বড় অন্যায় করিয়াছেন। আমি এখনই উঠিলাম, নারকী বেন্টউডের সহিত আমি দেখা করিতে চাহি না,” বলিয়া, তথা হইতে দ্রুত উঠিয়া যেমন কক্ষের বাহির হইতে যাইবেন, দেখিলেন—দ্বার-সম্মুখে সহাস্যমুখে ডাক্তার বেন্টউড দাঁড়াইয়া। দেখিয়া স্তম্ভিতভাবে দাঁড়াইলেন।
ডাক্তার বেন্টউড তাঁহাকে কহিলেন, “আপনি কোথায় যাইতেছেন? বসুন, যাইবেন না। আপনাকে আবশ্যক আছে। একটু অপেক্ষা করিলে, একটা আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখিতে পাইবেন।”
বেন্টউডের কথায় দত্ত সাহেবের ন্যায় মিসেস্ মার্শনেরও ক্রোধটা অজ্ঞাতভাবে সহসা কৌতূহলে পরিণত হইয়া গেল। তিনি কহিলেন, “কি এমন আশ্চর্য্য ব্যাপার?”
বেন্টউড সহাস্যে কহিলেন, “দেখিতে পাইবেন—দেখিতে পাইবেন—অপেক্ষা করুন, তাড়াতাড়ি করিবেন না। [সেলিনার প্রতি] এই যে তুমিও আসিয়াছ, ভালই হইয়াছে। তুমি কি শুকাইয়া গিয়াছ। তোমাকে দেখিয়া যে সহসা চিনিতে পারিবার যো নাই। যাহা হউক, যাহাতে তোমার মলিনমুখে শীঘ্র হাসি আসে, তাহা আমি করিতেছি।” দত্ত সাহেবের প্রতি “আর আপনি মিঃ দত্ত, আপনাকেও বলি—”
বাধা দিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “আমাকে আর কিছু বলিতে হইবে না—আমি তোমার বাজে কথা আর শুনিতে চাই না—তুমি আমার সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ চুরি করিয়া কি করিলে, আমি কেবল তাহা এখনই জানিতে চাই।”
বেন্টউড কহিলেন, “তাহাই হইবে, ব্যস্ত হইতেছেন কেন? এখনই আপনি তাহা জানিতে পারিবেন। সেইজন্যই ত আমি এখানে আসিয়াছি। এখন এই মিলনান্ত নাটকের শেষ দৃশ্যটার অভিনয় শেষ করিতে পারিলে আমারও ছুটি হয়।”
সেলিনার মাতা সবিস্ময়ে কহিলেন, “কি আশ্চর্য্য! এই সকল দুর্ঘটনাকে আপনি মিলনান্ত বলিতেছেন? বিয়োগান্ত বলুন।”
বেন্টউড় কহিলেন, “ইহাতে আমি বিয়োগান্তের কিছুই ত দেখি না। এই বৰ্ত্তমান মিলনদৃশ্যে বুঝিতে পারিবেন, আমার কথাই ঠিক।”
দত্ত সাহেব অধিকতর বিস্ময়াপন্ন হইয়া, চেয়ার ঠেলিয়া উঠিয়া কহিলেন, “আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না, ইহার অর্থ কি?”
বেন্টউড কহিলেন, “অর্থ বুঝাইয়া দিতেছি-ঐ দ্বারের দিকে চাহিয়া দেখিলেই আমার কথার অর্থ বুঝিতে পারিবেন।”
তখনই গৃহমধ্যস্থ সকলে সাশ্চর্য্যে, সবিস্ময়ে, সাগ্রহে সেইদিকে চাহিয়া দেখিলেন। যাহা দেখিলেন, তাহা আশাতীত, তাহা স্বপ্নাতীত এবং তাহা একান্ত অভাবনীয়। দেখিলেন, সেই উন্মুক্ত দ্বারদেশে বেশ সবল ও সুস্থদেহে স্মিতমুখে দাঁড়াইয়া—তাঁহাদিগের সুরেন্দ্রনাথ।