পঞ্চম খণ্ড – পরিণাম—ভয়ানক
প্রথম পরিচ্ছেদ – বন্দীর প্রতি
এদিকে কীর্ত্তিকর সাহেবের সম্মুখে মাঞ্চারজী নীত হইয়াছে। ক্রমে দাদাভাস্কর ও লালুভাইও আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন।
কীর্ত্তিকর মাঞ্চারজীকে বসিতে আজ্ঞা করিয়া বলিলেন, “এই চুরী সম্বন্ধে তুমি সকল কথা যদি খুলিয়া বল, তবে তোমাকে আমরা আমাদের সরকারী সাক্ষীরূপে লইতে পারি। তাহা হইলে তোমার আর কোন ভয় নাই। বিবেচনা করিবার জন্য তোমায় পাঁচ মিনিট সময় দিলাম।”
মাঞ্চারজী নীরবে বসিয়া রহিল। পাঁচ মিনিট অতীত হইয়া গেল—তথাপি মাঞ্চারজী কোন কথা কহিল না।
কীৰ্ত্তিকর কিয়ৎক্ষণ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, “কে চুরী করিয়াছে?”
মাঞ্চারজী নীরব।
কীর্ত্তিকর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে চুরী করিয়াছে?”
মাঞ্চারজী বলিল, “আমি চুরী করি নাই।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “তা জানি। কে চুরী করিয়াছে বল।”
মাঞ্চারজী কোন উত্তর করিল না। নীরবে বসিয়া রহিল।
তখন কীর্ত্তিকর বলিলেন, “দেখ, তোমার ভালর জন্যই বলিতেছি, সব কথা খুলিয়া বলিলে বাঁচিয়া যাইবে; নতুবা দ্বীপান্তরে যাইতে হইবে।”
তথাপি মাঞ্চারজী কোন কথা কহিল না।
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “তুমি সিন্দুক খুলিবার গুপ্তকথা জানিতে পারিয়াছিলে—এ কথা কি অস্বীকার কর?”
মাঞ্চারজী মুখ ফিরাইয়া কহিল, “আমি কিছুই জানি না।”
কীর্ত্তিকর রুক্ষকণ্ঠে বলিলেন, “সকলই জান। কেন গোপন করিয়া নিজের সৰ্ব্বনাশ করিতেছ? আমি তোমাকে বাঁচাইতে ইচ্ছুক।”
মাঞ্চারজী কথা কহে না দেখিয়া কীর্ত্তিকর দাদাভাস্করের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তাহাকে এইখানে লইয়া আইস।”
দাদাভাস্কর সত্বর উঠিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন কীর্ত্তিকর বলিলেন, “মাঞ্চারজী, আমরা তোমার বিষয় সকলই জানি। তোমার বৃদ্ধ মা এখন আমাদের হাতে। বর্জরজী মনে করে সে বড় বুদ্ধিমান — আর পুলিস গাধা। সে আমাদের হাত থেকে তোমার মাকে সরাইবে মনে করিয়াছিল; কিন্তু সে তাহা পারে নাই। আমরা সেই বৃদ্ধার কাছে সমুদয় কথা শুনিয়াছি। যাহা হউক, বর্জরজী যেদিন তোমার মার সন্ধানে যায়, সেদিন তোমার কাছে সে অনেক টাকা রাখিয়া গিয়াছিল। সে টাকা এখনও তোমার কাছে আছে। এসব কথা অস্বীকার করিতে চাও কি?
মাঞ্চারজী বলিল, “টাকা আমার কাছে নাই।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আছে। যদি সব কথা খুলিয়া বল, সে টাকা আমরা লইব না। যদি সৎপথে থাক, তবে ঐ টাকায় বড়লোকের মত থাকিয়া অবশিষ্ট জীবনটা তুমি কাটাইয়া দিতে পারিবে।”
মাঞ্চারজী নীরবে রহিল।
কীর্ত্তিকর বলিতে লাগিলেন, “আর যদি কোন কথা না বল, তবে সে টাকাও আমরা লইব—তুমিও জেলে যাইবে। আবার পাঁচ মিনিট তোমাকে ভাবিবার সময় দেওয়া গেল। “ এই বলিয়া কীর্ত্তিকর চেয়ারে ঠেসান দিয়া, চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়া রহিলেন।
পাঁচ মিনিট অতীত হইলে কীর্ত্তিকর চক্ষু মেলিয়া মাঞ্চারজীর দিকে চাহিলেন। মাঞ্চারজী কোন কথা কহিল না দেখিয়া, তিনি টেবিলস্থ ঘণ্টায় ঘা মারিলেন। অমনই দুইজন কনেষ্টবল গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইল।
কীর্ত্তিকর তাহাদিগকে বলিলেন, “এই আসামীকে হাতকড়ী লাগাও। এর পোষাক খুলে তল্লাস কর।”
তাহারা মাঞ্চারজীর নিকটস্থ হইলে সে লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আমাকে অপমান করিবেন না। আমি টাকা দিতেছি।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “বেশ—এখনই দাও।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – চুরী-রহস্য-উদ্ভেদ
মাঞ্চারজী কম্পিত হস্তে নিজ বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একতাড়া নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিল।
কীর্ত্তিকর নোটগুলি একে একে গণিয়া একখানা কাগজে তাহার নম্বরগুলি লিখিয়া লইলেন। তৎপরে বলিলেন, “দেখ, আবার বলিতেছি, আমাদিগকে যদি সকল কথা খুলিয়া বল, তবে এই নোটগুলি তোমাকে ফিরাইয়া দিব। তুমি যাহাতে বাঁচিয়া যাও, তাহাও করিব।”
এবার মাঞ্চারজী বলিল, “যদি আপনাদের সব কথা বলি, তবে আপনারা যে আমাকে ছাড়িয়া দিবেন—কিরূপে বিশ্বাস করি?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আমার কথাতেই বিশ্বাস।”
এই সময় তথায় দাদাভাস্কর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার পশ্চাতে একটী বৃদ্ধা গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইল।
বৃদ্ধা মাঞ্চারজীকে দেখিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া বলিল, “সেই সয়তানই আমাদের সৰ্ব্বনাশ করিল। তুই আর তার কথা শুনিস্ না। এদের সব বল—এঁরা আমাদের বাঁচাবেন বলেছেন।
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “কাঁদিয়ো না। ঐখানে বসো।”
বৃদ্ধা চক্ষু মুছিতে মুছিতে বসিল। বলা বাহুল্য, এই বৃদ্ধাই মাঞ্চারজীকে লইয়া কলিকাতায় হরেকজীর নিকটে আসে। ইহাও বলা বাহুল্য,সে ইহার সংবাদ পাইয়া কীর্ত্তিকর ইহাকে বোম্বে আনিবার জন্য লোক পাঠাইয়াছিলেন। পাছে পথে কেহ ইহাকে সরাইয়া ফেলে, এইজন্য পুলিসের লোক কীর্ত্তিকরের পরামর্শে ইহাকে জব্বলপুরের পথে না আনিয়া দিল্লী হইয়া বি, বি, সি, আই, রেলপথে লইয়া আসে। সেইজন্যই বর্জরজী ইহার সন্ধান পায় নাই।
পুলিসের হাতে পড়িয়া এই বৃদ্ধা সকল কথাই ভয়ে বলিয়া ফেলিয়াছিল। যাহাতে তাহার ছেলে মাঞ্চারজী সকল কথা বলে, তাহার জন্যও সে বিশেষ চেষ্টা করিতে স্বীকার করিয়াছিল। জেলের ভয়, ফাঁসীর ভয়—বড় ভয়। বৃদ্ধা সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিল।
কীর্ত্তিকর তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “তোমার ছেলেকে অনেক বুঝাইয়াছি; কিন্তু কিছুতেই বুঝিতেছে না।”
বৃদ্ধা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “মাঞ্চারজী, সে সয়তান, তার কথা শুনিস্ না। সেই আমাদের সর্ব্বনাশ করেছে; সে সয়তান কলিকাতায় না এলে আমাদের এ দশা হত না। সেই বিষ খাইয়ে অমন লোক হরেকজীকে খুন করেছে। সব খুলে বল, এঁরা আমাদের বাঁচাবেন।
মাঞ্চারজীও মনে মনে ইহা স্থির করিয়াছিল। সে বেশ বুঝিয়াছিল, তাহার আর বাঁচিবার কোন সম্ভাবনা নাই। আর ইহাও বেশ জানিত যে, বর্জরজী তাহার রক্ষার জন্য কিছুই করিবে না। বরং জেলে গেলে সে সন্তুষ্টই হইবে—নির্বিঘ্নে কমলা বাঈকে বিবাহ করিতেও পারিবে। এমন দুরাত্মার জন্য নিজে মরিবে কেন? যখন উপায় আছে, তখন কেন ইচ্ছা করিয়া জেলে যাইবে? বর্জরজী তাহার কে, আর সে তাহার কি করিবে; তাহাকে ভয় কি? সে ত জেলে থাকিবে। নিশ্চয়ই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর যাইবে। এইরূপ অনেক কথা মাঞ্চারজীর মনে উঠিতে লাগিল, শেষে সে আর ভাবিতে না পারিয়া বলিল, “আমি যদি সব বলি, তাহা হইলে আপনি কি আমাকে রক্ষা করিবেন?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “বাঁচাইব।”
“কেমন করিয়া বিশ্বাস করিব?”
“আমার কথা কখনও মিথ্যা হয় না।”
“আমি সকলই খুলিয়া বলিতেছি, আমাকে মারিবেন না?”
“না।”
“সিন্দুক খুলিবার গুপ্তকথা আমিই জানিতে পারিয়াছিলাম।”
“কিরূপে?”
মাঞ্চারজী বলিতে লাগিল, “একদিন আমি রতনবাঈকে বেশ বুঝাইয়া দিই যে, রস্তমজী আর তাহাকে ভালবাসে না। তাহাই সেদিন রস্তমজী আসিলে সে ইহার জন্য রস্তমজীকে অনেক কথা বলে। তাহাতে রস্তমজী বলেন, ‘রতন, তোমায় কত যত্ন করি, তাহার প্রমাণ তোমার নামে এখনও হরমসজীর সিন্দুক খুলে।’ আমি একথা বর্জরজীকে বলিয়াছিলাম। সে ইহাতে অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া বলে, ‘তবে আর ভয় কি? হরমসজীর সিন্দুক হতে টাকা নিতে হবে। তবে শুনেছি, তাঁর সিন্দুকে বেশী টাকা থাকে না। টাকা ব্যাঙ্কে পঠিয়ে দেয়, তবে উপায় আছে। আমাদের যে লাখ টাকা হরমসজীর ব্যাঙ্কে আছে, আমি কালই গিয়ে এই টাকা পরশ্বঃ দশটার সময় দিবার জন্য বলিব। তাহলে নিশ্চয়ই ব্যাঙ্ক থেকে টাকা এনে সিন্দুকে রাখিবেন।”
কীর্ত্তিকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ টাকা কোথা হইতে আনিয়াছিলে?”
মাঞ্চারজী বলিল, “রাজাবাঈ-এর গহনা বাঁধা দিয়া পাইয়াছিলাম। বর্জরজী ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিয়া আসে। পরে রাজাবাঈ-এর নিকট হইতে চাবী লইয়া সিন্দুক হইতে টাকা বাহির করিয়া লওয়াই স্থির হয়। বর্জরজী এ কাজ আমাকে করিতে বলে। আমি কিছুতেই ইহাতে সম্মত হই না। পরে সে আমাকে নানা রকমে ভয় দেখাইলে আমি সম্মত হইয়াছিলাম। আমরা জানিতাম, সেদিন সন্ধ্যার পর হরমসজী বাড়ী থাকিবেন না—তাহাই সেই সময়ে তাঁহার বাড়ী যাওয়া স্থির হয়; কিন্তু সন্ধ্যার সময় আমার মনটা কেমন খারাপ হইয়া গেল যে, আমি যাইতে অস্বীকার করিলাম।”
কীর্ত্তিকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “তখন বর্জরজী একাই গেল।”
মাঞ্চারজী বলিল, “না। সে আমাকে অনেক গালি দিল, ভীরু কাপুরুষ বলিল, পরে আমাকে অনেক মদ খাওয়াইল—তখন আমরা দুইজনে হরমসজীর বাড়ীর দিকে চলিলাম। হরমসজীর বাড়ীর দরজায় আসিলে আমার বুক এমনই ধড়াস ধড়াস করিতে লাগিল যে, আমি আর অগ্রসর হইতে পারিলাম না, দাঁড়াইলাম। তখন বর্জরজী আমাকে কুৎসিত গালি দিতে লাগিল, আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল। কিন্তু আমি সহসা তাহার হাত হইতে আমার হাত ছিনাইয়া লইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে পলাইলাম।”
কীর্ত্তিকর জিজ্ঞাসা করিলেন, “বর্জরজী কি করিল?”
“তাহা জানি না। আমি অনেকক্ষণ পথে পথে ঘুরিয়া শেষে বাসায় আসিলাম। দেখিলাম, তখনও বর্জরজী ফিরে নাই।”
“কখন সে ফিরিয়া আসিল?”
“প্রায় তখন রাত এগারটা।”
“আসিয়া তোমায় কি বলিল?”
“আমাকে দেখিয়া প্রথমে আমাকে একেবারে মারিতে উদ্যত হইল। আমিও লাফ দিয়া উঠিলাম। সে জানিত, আমার সঙ্গে গায়ের জোরে সে পারে না।”
“তার পর?”
“তার পর ধীরে ধীরে চেয়ারে বসিল, বলিল; “গাধা, তুই থাকিলে সে কাজ পাঁচ মিনিটে হইত, আমার তাহাই করিতে তিন ঘণ্টা লাগিল। পাজী মাগী কিছুতেই রাজী হয় না। তার পর আজ রাত্রে টাকা না পেলে তুই আত্মহত্যা করবি বলায় চাবী দিতে রাজি হল; কিন্তু তাও বলে সে কেবল এক হাজার টাকা নিতে। সে-ও জানে না যে, সিন্দুকে এত টাকা ছিল।”
“তার পর?”
“বর্জরজী বলিল, ‘তার পর চাবী নিয়ে সিন্দুক খুলতে গেলেম, সে-ও সঙ্গে সঙ্গে এলো। চাবী খুলি আর কি—অমনি ছুটে এসে আমার হাত ধরলে, কিছুতেই খুলতে দেয় না। যাই হউক, অনেক কষ্টে খুলে টাকা নিয়ে চলে এসেছি, এই দেখ জানোয়ার।’ এই বলিয়া সে আমাকে এক তাড়া নোট দেখাইল।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – খুন-রহস্য এখনও অজ্ঞাত
কীর্ত্তিকর, দাদাভাস্করকে বলিলেন, “দেখিলে দাদাভাস্কর, তালার সেই ঘেঁড়া দাগের কথা একদিন তোমাকে যেমন বুঝাইয়া দিয়াছিলাম, তাহা এখন ঠিক মিলিয়া যাইতেছে।” তৎপরে মাঞ্চারজীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “তুমি আর কি জান?”
“আর কিছুই জানি না। যাহা জানি, সকলই আমি আপনাকে বলিলাম?”
“তুমি যে সত্যকথা বলিলে ইহার প্রমাণ কি?”
“রাজাবাঈকে জিজ্ঞাসা করিলে জানিতে পারিবেন।”
“মোকদ্দমার সময়ে তুমি এ সকল কথা বলিবে?”
“যদি আপনারা আমাকে সাক্ষী করেন, নিশ্চয়ই বলিব।”
“এখন থেকে আমরা যাহা যাহা বলিব, করিতে প্রস্তুত আছ?”
“যখন আপনাদের উপর নির্ভর করিলাম, তখন কেন করিব না?”
“যদি আমাদের মতে কাজ কর—শেষ পর্যন্ত আমাদের কথা শুন; তবে এ টাকা তোমায় ফেরৎ দিব। ততদিন এ টাকা আমার নিকটে থাকল।”
“এখন যাহা বলিবেন, আমাকে বাধ্য হইয়া করিতে হইবে।”
“যতদিন এ মোকদ্দমা না চুকিয়া যায়, ততদিন তোমাকে আমরা যেখানে থাকিতে বলিব, সেইখানে থাকিতে হইবে।”
“থাকিব।”
“তোমার মা যেখানে আছেন, তুমিও সেইখানে থাকিবে।”
“তাহাই হইবে।”
কীর্ত্তিকর দাদাভাস্করকে বলিলেন, “দুইজন কনেষ্টবল দিয়া ইহাদের সেইখানে পাঠাইয়া দাও। পথে গাড়ীর দরজা যেন বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়—সাবধান!
মাঞ্চারজী ও বৃদ্ধাকে সঙ্গে করিয়া দাদাভাস্কর গমনে উদ্যত হইল, কীর্ত্তিকর বলিলেন, “দাঁড়াও।” তৎপরে মাঞ্চারজীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “খুনের বিষয় তুমি কিছু জান?”
মাঞ্চারজী বলিল, “না।”
“ঠিক করিয়া বল। তোমাদের সহিত পেষ্টনজীর আলাপ ছিল?”
“তা ছিল।”
“পেষ্টনজীর নিকট দুইখানা সার্টিফিকেট ছিল, তাহা কি তুমি জানিতে?”
“না।”
“কখনও পেষ্টনজী তোমাকে কি বর্জরজীকে এ কথা বলিয়াছিল?”
“আমায় কখনও বলে নাই। বর্জরজীকে বলিয়াছিল কিনা, আমি জানি না।”
“কখনও এই খুন সম্বন্ধে কোন কথা বর্জরজী তোমাকে বলিয়াছে?”
“না।”
“ঠিক বলিতেছ?”
“কেন আর মিথ্যাকথা ‘বলিব?”
“যাও।”
দাদাভাস্কর তাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া লইয়া বাহিরে গেলেন।
তাহারা প্রস্থান করিলে লালুভাই বলিলেন, “খুন সম্বন্ধে বোধ হয়, এ কিছুই জানে না।”
কীর্ত্তিকর। হাঁ।
লালুভাই। বর্জরজী এ খুনের ভিতর থাকিলে এ নিশ্চয়ই তাহা জানিতে পারিত।
কীর্ত্তিকর। তার কোন মানে নাই।
লালুভাই। দুইজনে দিন রাত এক সঙ্গে থাকিত, যত বদমাইসীর মতলব আঁটিত; খুনের ভিতর বর্জরজী থাকিলে এ নিশ্চয়ই জানিতে পারিত। তবে হয় ত স্বীকার করিতেছে না।
কীর্ত্তিকর। সে জন্য চিন্তার বিশেষ কারণ নাই; এবার খুনী শীঘ্র ধরা পড়িবে।
লালুভাই। আমি ত এ খুন সম্বন্ধে আর কিছুই সন্ধান পাই নাই। যতদূর প্রমাণ পাইয়াছি, তাহাতে দেখিতেছি, হরমসজী ভিন্ন আর কেহই এ খুন করিতে পারে না। সাহেব ত আমাকে এ খুনের সন্ধান কতদূর কি হইল প্রত্যহই জিজ্ঞাসা করিতেছেন। আর প্রত্যহ এক রকম উত্তরও দেওয়া যায় না। আপনার বিশ্বাস কে খুন করিয়াছে?
কীর্ত্তিকর। বিশ্বাস নয়—ধ্রুব সত্য। কাল তাহা জানিতে পারিবেন। আজ এই পর্য্যন্ত।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
খুনের অভিযোগ
পরদিবস কীর্ত্তিকর হরমসজীর বাড়ীতে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। হরমসজী তাঁহাকে চিনিতেন না। তাঁহাকে নিজের আফিসে বসাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার নিকটে মহাশয়ের কি প্রয়োজন?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আপনার সহিত আমার আলাপ নাই—তা না থাক্, হয়ত আপনি আমার নাম কখনও শুনিয়া থাকিবেন; আমার নাম কৃষ্ণজী বলবন্ত কীর্ত্তিকর—পুলিসে কাজ করি।”
হরমসঙ্গী বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “আপনিই কি ডিটেটিভ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট কীর্ত্তিকর সাহেব?”
“হাঁ।”
“আপনার সহিত আলাপ ছিল না। আলাপ হইয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইলাম।”
“আপনার সহিত একটা বিশেষ কথা আছে। কথাটা গোপনীয়। এখানে আমরা কথা কহিলে কাহারও সে কথা শুনিবার সম্ভাবনা আছে কি?”
“না।”
“তবে এইখানেই কথা হইতে পারে। আশা করি, আপনাকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিব, তাহার প্রকৃত উত্তর দিবেন।”
“আপনি এরূপভাবে কথা কহিতেছেন কেন? গোপন করিবার আমার পক্ষে কি আছে?”
“আপনি বর্জরজীর অনুরোধে বা ভয়ে পুলিস-কমিশনার সাহেবকে একখানা পত্র লিখিয়াছেন। সে পত্রে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা সর্বৈব মিথ্যা।”
হরমসজী রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “মহাশয়, আপনি এরূপভাবে আমার সহিত যদি কথা কহেন, তবে এখনই এখান হইতে বিদায় হউন।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “বিদায় হইবার একটু বিলম্ব আছে। আপনার মঙ্গলের জন্যই বলিতেছি। আপনি যদি সকল কথা খুলিয়া বলেন, আপনার পক্ষেই ভাল।”
“যদি না বলি?”
“তাহা হইলে দুঃখের সহিত বলিতেছি,আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইব।”
“আমাকে গ্রেপ্তার! কেন? কিসের জন্য?”
“পেষ্টনজীর খুনের জন্য।”
হরমসজী চকিত হইয়া বলিলেন, “পেষ্টনজীর খুন! পেষ্টনজীর খুনের বিষয় আমি কিছুই জানি না। আপনাকে আমি কোন কথাই বলিব না! আপনি এখনই বিদায় হউন।”
কীর্ত্তিকর ধীরে ধীরে নিজ পকেট হইতে একটী ক্ষুদ্র বাঁশী বাহির করিলেন। সেইটী করতলে নাচাইতে নাচাইতে বলিলেন, “দেখুন, এই বাঁশীটা আমি বাজাইলে এখনই দশ-পনেরজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী আসিয়া আপনাকে লইয়া যাইবে। কেন ইচ্ছা করিয়া এ অপমান ডাকিয়া আনিতেছেন? ইচ্ছা করিয়া ফাঁসীকাঠে কেন মাথা দিতেছেন?”
হরমসঙ্গী উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, হতাশভাবে ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িলেন। ভগ্নকণ্ঠে বলিলেন, “আমার বিরুদ্ধে কি প্রমাণ আছে? আমি এ খুনের কিছুই জানি না!”
“বিশেষ প্রমাণ না থাকিলে কি আপনার মত বড়লোককে গ্রেপ্তার করিতে সাহসী হই?”
“কি প্রমাণ?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “অন্য লোক হইলে বলিতাম না, আপনাকে বলিতেছি; স্থির হইয়া শুনুন। পেষ্টনজীর জামার অস্তরের নীচে দুইখানি কাগজ লুকান ছিল; একখানি বিবাহের সার্টিফিকেট, আর একখানি জন্মের সার্টিফিকেট। এই দুইখানি সার্টিফিকেট তাহার নিকট হইতে লইবার জন্য কোন লোক তাহাকে খুন করিয়াছিল। যে খুন করিয়াছে, সে জানিত, সার্টিফিকেট দুইখানি পেষ্টনজীর নিকটে ছিল।”
হরমসঙ্গীর মুখের ভাব এমনই হইল যে, যেন তিনি এখনই মূর্ছিত হইবেন; তাঁহার মুখ হইতে সমস্ত রক্ত অন্তর্হিত হইল। তিনি ব্যাকুলভাবে কীর্ত্তিকরের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “দেখিতেছেন, আমরা একটু একটু খবর রাখি। আরও জানি যে, সার্টিফিকেটখানি মহাশয়ের গুপ্ত বিবাহের। অন্য সার্টিফিকেটখানি সেই পূর্ব্ব পরিণীতার এক কন্যার।”
হরমসজী লম্ফ দিয়া উঠিলেন; বলিলেন, “আপনাকে কে বলিল?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “স্থির হইয়া বসুন, ব্যস্ত হইবেন না। আপনার পূর্ব্ব পরিণীতা স্ত্রীই বলিয়াছেন।”
এই বলিয়া কীৰ্ত্তিকর নিজ পকেট হইতে একখানি পত্র বাহির করিয়া হরমসজীর সম্মুখে ধরিলেন। বলিলেন, “এ হাতের লেখা আপনি চিনিতে পারেন?”
হরমসজী পত্রখানি দেখিয়া বংশপত্রের ন্যায় কাঁপিতে লাগিলেন। এ তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যু-শয্যায় লিখিত পত্র। লালুভাই ইহা সংগ্রহ করেন। হরমসজী পত্রখানি পড়িলেন। পড়িয়া অর্দ্ধরুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “আমাকে রক্ষা করুন।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “দেখিতেছেন, এই দুইখানি সার্টিফিকেট পেষ্টনজীর নিকট হইতে আপনারই লইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা; সুতরাং—”
হরমসজী কোন কথা কানে না তুলিয়া বলিলেন, “আমাকে রক্ষা করুন—যত টাকা খরচ—”
কীর্ত্তিকর বাধা দিয়া বলিলেন, “টাকার কথা তুলিবেন না। আপনাকে রক্ষা করিব; কিন্তু আপনাকে সকল কথা খুলিয়া বলিতে হইবে। তাহা হইলে আপনার এ বিবাহের কথা এ জগতে আর কেহ জানিতে পারিবে না।”
হরমসজী বলিলেন, “আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই করিব। আমাকে রক্ষা করুন।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ – অভিযুক্ত
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “খুন সম্বন্ধে আপনার বিরুদ্ধে যদিও যথেষ্ট প্রমাণ আছে; তথাপি আমি জানি, আপনি এ খুন করেন নাই। পেষ্টনজীর নিকট যে সার্টিফিকেট ছিল, তাহা আপনি জানিতেন না।”
হরমসজী অধীরভাবে বলিলেন, “আপনি ঠিক বলিয়াছেন—প্রকৃতই আমি কিছু জানিতাম না।”
“যদি বাঁচিতে চাহেন, মানসম্ভ্রম বজায় রাখিতে চাহেন, তবে সকল কথা খুলিয়া বলুন – কিছুই গোপন করিবেন না!”
“আমি কিছুই গোপন করিব না।”
“প্রথমে আপনি কেবল দুই-একদিন হইল, বর্জরজীর কাছে এ সার্টিফিকেটের কথা শুনিয়াছেন।”
“হাঁ।”
“সে আপনার পূর্ব্বের গুপ্ত-বিবাহের কথা প্রকাশ করিয়া দিবে, এই রূপ ভয় দেখায়। এ বিবাহ প্রকাশ হইলে আইনানুসারে আপনার ভয়ানক দণ্ড হইত; কারণ এক বিবাহ থাকিতে আপনি অন্য বিবাহ করিয়াছিলেন। তাহা হইলে আপনার এ স্ত্রী আপনার রক্ষিতারূপে পরিগণিতা হইতেন; আর আপনার কন্যা কমলাবাঈ জারজ হইতেন।”
“হাঁ, এইজন্যই আমি ভয়ে তাহার কথায় সম্মত হইয়াছি—তাহার কথা না শুনিলে সে আমার সর্বনাশ করিবে।”
“তাহার কথামত আপনি কমিশনার সাহেবকে টাকা পাইয়াছি বলিয়া পত্র লিখিয়াছিলেন?”
“হাঁ।”
“আর কি করিতে সম্মত হইয়াছেন? কিছু গোপন করিবেন না।”
“কমলা বাঈএর সহিত তাহার বিবাহ দিতে সম্মত হইয়াছি। আমার স্ত্রীও ইহার জন্য আমাকে জেদ করিয়াছিল। মেয়েও সম্মত আছে।”
“কর্তব্যের অনুরোধে দুঃখের সহিত তবে একটা কথা আপনাদের বলিতে হইল। যেমন বর্জরজী আপনাকে ভয় দেখাইয়া আপনার মেয়ের সহিত তাহার বিবাহ দিতে সম্মত করাইয়াছে, তেমনই এই ছয় মাস ধরিয়া আপনার স্ত্রীকেও সে ভয় দেখাইয়া আসিতেছে।”
হরমসজী। কেন?
কীর্ত্তিকর। যেমন ছেলেবেলায় আপনি ঝোঁকের মাথায় বিবাহ করিয়াছিলেন, তেমনই রাজা বাঈও ছেলেবেলায় একজনকে ভালবাসিয়াছিলেন। তাঁহার একটি পুত্র হইয়াছিল।
হরমসজী লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, “আপনি এখনই আপনার পথ দেখুন, আমারই বাড়ীতে বসিয়া আমাকে এরূপভাবে অপমানিত করায় আপনার ঠিক উদ্দেশ্য বুঝিলাম না।”
“উদ্দেশ্য মহৎ। তাহার পর শুনুন, ছেলেবেলায় যদি কেহ কোন ভুল করে, তাহার জন্য সে আজীবন মন্দ হইতে পারে না। আপনার সহিত বিবাহ হইবার পর হইতে রাজাবাঈ-এর মত পতিব্রতা স্ত্রী জন্মে না।”
এই বলিয়া কীর্ত্তিকর বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একটা বাক্স বাহির করিলেন। ধীরে ধীরে বাক্সটি খুলিয়া হরমসজীর সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন, “এ গহনাগুলি কাহার চিনিতে পারেন?”
হরমসজী বিস্মিত হইয়া বলিলেন, “এ আমার স্ত্রীর গহনা। আপনি ইহা কোথায় পাইলেন?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “সেই কথাই বলিতেছিলাম। বর্জরজীর ভ্রাতা হরেকজীর সহিত রাজা বাঈএর বাল্যপ্রণয় ছিল। কিন্তু কোন কারণে উভয়ের বিবাহ ঘটে নাই। প্রথম যৌবনের লালসা বড় বিশ্রী জিনিস- কেহ তাহা দমন করিতে পারে না, তাহার ফলে একটা ছেলেও হয়। বর্জরজী ইহা জানিত। এই দুরাত্মা নিজের সমস্ত সম্পত্তি উড়াইয়া দিয়া পরে কলিকাতায় ভাইএর নিকটে যায়। সেখানে তাহাকে বিষ খাওয়াইয়া খুন করে। পরে তাহার বিষয়-সম্পত্তি সব উড়াইয়া, টাকার টানাটানি হওয়ায়, আপনার স্ত্রীকে পূর্ব্বকথা প্রকাশ করিয়া দিবার ভয় দেখাইয়া টাকা লইবার চেষ্টায় বোম্বে আসে। এখানে আসিয়া সে কি করিয়াছে, এই গহনাতেই স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছেন। রাজাবাঈ-এর হাতে আর এক পয়সা না থাকায় শেষে তিনি বাধ্য হইয়া গহনাগুলি দেন। তাহার গহনা গণেশমলের নিকট বাঁধা রাখিয়া লাখ টাকা লইয়া আপনারই ব্যাঙ্কে জমা রাখে।”
হরমসজী বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া নীরবে বসিয়া রহিলেন। কীর্ত্তিকর কহিলেন, “বর্জরজী ই আবার আপনার স্ত্রীকে ভয় দেখাইয়া চাবী লইয়া সিন্দুক হইতে টাকা চুরী করে। মাঞ্চারজী সব স্বীকার করিয়াছে।”
হরমসজী কোন কথা বলিতে পারিলেন না—তাঁহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। তখন কীর্ত্তিকর চুরী সম্বন্ধে সকল কথা একে একে তাঁহাকে বলিলেন,। তৎপরে বলিলেন, “অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই। রাজাবাঈকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি নিশ্চয়ই সমস্ত স্বীকার করিবেন। “ হরমসজী এবার কথা কহিলেন। বলিলেন, “হায়—হায়—আমার মান-সম্ভ্রম সকলই গেল—এখন আমার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আপনি বিবেচক। বালকের ন্যায় আপনার এরূপ অধীর হওয়া কৰ্ত্তব্য নয়। স্ত্রীর উপর রাগ করিবেন না। তিনি এই পাষণ্ডের হাতে পড়িয়া অনেক কষ্ট পাইয়াছেন। এখন যাহাতে এই দুরাত্মা সমুচিত দণ্ড পায়, তাহাই করা আমাদের কর্তব্য। আমার পরামর্শ শুনিলে আপনাদের পূর্ব্বের গুপ্তকথা জগতে কেহই জানিতে পারিবে না। অন্ততঃ আপনার কন্যা কমলাবাঈ-এর জন্য আপনার ইহা করা কর্ত্তব্য। নতুবা ভাবুন দেখি, তাহার অবস্থা কি হইবে।’
হরমসজী কাতর কণ্ঠে বলিলেন, “বলুন, আমি কি করিব?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “পরে বলিতেছি। প্রথমে বর্জরজীর সম্বন্ধে দুই একটি কথা জিজ্ঞাস্য আছে। সে আপনার বিবাহের সার্টিফিকেট কোথায় পাইল, এ সম্বন্ধে আপনাকে সে কি বলিয়াছে?”
হরমসজী বলিলেন, “সে বলে পেষ্টনজী মাতাল হইয়া তাহাকে এক দিন এই সার্টিফিকেট দুইখানার কথা বলিয়াছিল—সেইখানে ফ্রামজীও ছিল। ফ্রামজীর তখন টাকার বড় টানাটানি; সে বলে পেষ্টনজীর নিকট হইতে সার্টিফিকেট দুখানা হাত করিতে পারিলে হরমসজীর নিকট অনেক টাকা আদায় হইবে। বর্জরজী ও ফ্রামজীতে এইরূপ পরামর্শ হয়, ফ্রামজী পেষ্টনজীর নিকট হইতে কোন গতিকে সার্টিফিকেট হস্তগত করিতে প্রতিশ্রুত হয়। সেই-ই তাহাকে গাড়ীর ভিতরে ক্লোরাফর্ম্ম করিয়া খুন করে; সে-ই সার্টিফিকেট লইয়াছিল; পরে পুলিস তাহার পশ্চাতে লাগিলে সে ভয়ে সার্টিফিকেট বর্জরজীর নিকটে দেয়।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “তাহা হইলে আপনার বিশ্বাস যে, ফ্রামজীই পেষ্টনজীকে খুন করিয়াছে?”
হরমসজী বলিলেন, “ফ্রামজী ক্লোরাফৰ্ম্ম কিনিয়াছিল; সেই রাত্রে যেখানে খুন হয়, সেইখান হইতে সে গাড়ী করিয়া বাড়ী আসিয়াছিল। বিশেষতঃ, ক্লোরাফর্ম্ম মাখান যে রুমালখানা পেষ্টনজীর মুখের উপর পাওয়া যায়, তাহা ফ্রামজীর—ফ্রামজীই খুনী।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – আত্ম-প্রকাশ
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “খুনের কথা পরে হইবে। এখন চুরীর সম্বন্ধেই কথা হউক। সে যে চুরী করিয়াছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তবে—”
হর। কি বলুন।
কীর্ত্তি। এ চুরীর জন্য তাহাকে সাজা দিতে গেলে আপনার স্ত্রীকে আদালতে যাইতে হয়; তাহা হইলে আপনাদের গুপ্তকথা প্রকাশ হইয়া পড়ে।
হর। যাহাতে আমি রক্ষা পাই, তাহাই করুন।
কীর্ত্তি। তাহাই করিব। আপাততঃ এ চুরীর কথা আপনি যেরূপ উড়াইয়া দিয়াছেন, সেইরূপই হউক। আমরা মনে করিয়াছি, এ চুরী আদৌ হয় নাই। চুরীর গোলযোগ মিটিয়া গিয়াছে।
হর। এখন কি করিতে চাহেন?
কীৰ্ত্তি। হাঁ। নিজেই স্বীকার করিবে।
হর। তাহা হইলেও ত সকল কথা প্রকাশ হইয়া পড়িবে। আপনি আমাকে রক্ষা করুন- তাহার দণ্ড ভগবান্ দিবেন।
কীৰ্ত্তি। ভগবান্ স্বয়ং কিছু করেন না। আমরাও ভগবানের সৃষ্ট—অনেক স্থলে আমাদের দিয়াই তিনি পাপীর দণ্ড দিয়া থাকেন।
হর। আপনি যাহা ভাল বিবেচনা করেন—করুন, যে কোন উপায়ে আমাকে রক্ষা করুন। আত্মহত্যা করিয়া সকল যন্ত্রণার অবসান করিতাম, কিন্তু কমলার জন্য তাহাও পারিতেছি না। তাহা হইলে সকল কথাই প্রকাশ হইয়া পড়িবে—তাহা হইলে কমলার কি হইবে!
কীৰ্ত্তি। ভয় নাই—যাহাতে সকল দিক্ বজায় থাকে, তাহাই আমি করিব।
হর। দয়া করিয়া তাহাই করুন।
কীর্ত্তি। দয়ার কথা কিছুই নাই। ইহা আমাদের কর্তব্য।
হর। আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।
কীৰ্ত্তি। এই দুরাত্মাকে ছাড়িয়া দিলে সে আপনার সর্ব্বনাশ করিতে ছাড়িবে না।
হর। যখন আমি তাহার সকল কথাই জানিতে পারিয়াছি, তখন সে আর আমার কি করিবে?
কীর্ত্তি। তখন আপনার উপর তাহার ভয়ানক রাগ হইবে। সে সকল কথা প্রকাশ করিয়া দিবে। আপনি তখন তাহার কি করিবেন?
হর। যাহা ভাল হয় করুন। আমার বিবেচনা করিবার আর ক্ষমতা নাই।
কীর্ত্তি। প্রথমে আপনার স্ত্রীকে সকল কথা খুলিয়া বলিতে হইবে।
হর। ইহা আমি কিছুতেই পারিব না।
কীৰ্ত্তি। আমি জানিতাম, আপনার বুদ্ধি-সুদ্ধি আছে। তাঁহাকে আপনার সকল কথা খুলিয়া বলা কি ভাল নহে? নতুবা আমাদের বাধ্য হইয়া তাঁহাকে শমন করিয়া লইয়া যাইতে হইবে। আমি এখন যাহা করিতেছি, আপনার ভালর জন্যই—বন্ধুভাবে। অফিসিয়্যাল করিলে কি ভাল হইবে? আপনাকে কিছু বলিতে হইবে না; আমি সকলই বলিব।
হর। যাহা হয় করুন। আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না—আমি পাগল হইয়া যাইব!
কীর্ত্তি। আপনি অধীর হইবেন না। আমার উপর নির্ভর করুন, আপনার কোন অনিষ্ট হইতে দিব না।
হর। যাহা হয় করুন।
কীর্ত্তি। চলুন, আপনার স্ত্রীর সহিত দেখা করা যাক্।
এই বলিয়া কীর্ত্তিকর উঠিলেন। কম্পিতপদে, স্পন্দিতহৃদয়ে হরমসজী তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। তাঁহারা উভয়ে উপরের বৈঠকখানায় আসিয়া বসিলেন। কীর্ত্তিকরের অনুরোধে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে হরমসজী স্ত্রীকে তথায় ডাকিলেন।
রাজাবাঈ গৃহ মধ্যে অপরিচিত লোক দেখিয়া, স্তম্ভিত হইয়া বাহিরে দাঁড়াইলেন। কীৰ্ত্তিকর উঠিয়া বলিলেন, “আমি পুলিসে চাকরী করি। আপনার সহিত দুই-একটি কথা আছে।”
রাজাবাঈ-এর সর্ব্বাঙ্গ প্রকম্পিত হইল। তাঁহার মুখ সম্পূর্ণ বিবর্ণ হইয়া গেল। দেখিয়া কীর্ত্তিকর বলিলেন, “বসুন।”
অতিকষ্টে কম্পিতপদে আসিয়া রাজাবাঈ একখানি চেয়ারে বসিল।
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “নিতান্ত দুঃখের সহিত, নিতান্ত বাধ্য হইয়া কয়েকটি কথা আপনাকে বলিতে হইতেছে।”
রাজাবাঈ কি বলিবার প্রয়াস পাইলেন, কিন্তু তাঁহার কণ্ঠ হইতে কোন কথা বাহির হইল না। কীর্ত্তিকর তখন বলিলেন, “বর্জরজী আপনাকে ভয় দেখাইয়া যাহা যাহা করিয়াছে, তাহা আমরা সকলই জানি।”
রাজাবাঈ ব্যাকুলভাবে কাঁদিয়া উঠিলেন।
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “ছেলেবেলায় ভুলের জন্য কেহ কখনও আজীবন ভুল করে না। হরমসজী সাহেব এখন সবই জানেন; আমি তাঁহাকে সবই বুঝাইয়া বলিয়াছি, সেজন্য আপনি ব্যাকুল হইবেন না। একজন পাপিষ্ট যে সেই সুবিধা পাইয়া আপনাদের সর্ব্বনাশ করিতেছে, তাহারই দণ্ড দেওয়া আমাদের কর্তব্য। আপনার ন্যায় হরমসজী সাহেবও ছেলেবেলায় একটা ভুল করিয়াছিলেন।
হরমসজী দুই হস্তে মুখ ঢাকিলেন। কীৰ্ত্তিকর তাঁহার গুপ্ত-বিবাহের কথা সমস্তই একে একে বলিতে লাগিলেন।
হরমসজী ও রাজাবাঈ উভয়েই সম্মুখস্থ টেবিলে মুখ ঢাকিয়া নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতেছিলেন।
কীর্ত্তিকর বর্জরজী সম্বন্ধে সমস্ত কথা বলিয়া বলিলেন, “সে যেরূপে টাকা চুরী করিয়াছিল, তাহা আমরা জানি; আপনি যে তাহাকে সিন্দুক খুলিতে প্রতিবন্ধক দিয়াছিলেন, তাহাও আমরা জানি। মাঞ্চারজী আপনার ছেলে নহে, সে জাল জুয়াচোর। বর্জরজী নিজের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য মাঞ্চারজীকে আপনার পুত্র বলিয়া পরিচয় দিয়াছিল। এই লউন আপনার গহনা; তাহাদের লীলাখেলা শেষ হইয়াছে। আর হরমসজী সাহেব, আপনি একবার মহাভ্রমে পড়িয়াছিলেন, আপনার স্ত্রী আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন নাই—তিনি মাঞ্চারজীকে নিজের গর্ভজাত সন্তান বলিয়া জানিতেন।”
উভয়ের কেহই কথা কহিলেন না। মুখ লুকাইয়া ক্রন্দন করিতে লাগিলেন।
কীর্ত্তিকর কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, “এখন আপনাদের অধীর হইলে চলিবে না। এই পাপিষ্ঠের যাহাতে সাজা হয়, তাহা করা কর্ত্তব্য। এ দণ্ডিত না হইলে পরে আরও অনেকের সর্ব্বনাশ করিবে।”
হরমসজী আকুলভাবে বলিয়া উঠিলেন, “আমরা আপনার শরণাপন্ন হইলাম—আপনি এ বিপদ্ হইতে আমাদিগকে রক্ষা করুন।”
কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “সে ইচ্ছা আমার সম্পূর্ণ আছে। বোধ হয়, আপনি এত শীঘ্র বিস্মৃত হন নাই, সেদিন আমি নর-নারী হত্যায় আপনার পবিত্র হস্ত কলঙ্কিত হইতে দিই নাই।”
হরমসজী চকিত হইয়া মাথা তুলিয়া বলিয়া উঠিলেন, “আপনি—আপনি—আপনিই কি–”
বাধা দিয়া কীর্ত্তিকর বলিলেন, “হাঁ, আমিই সেই কাশীনাথ নায়েক; সেটা আমার ছদ্মবেশ—জাল মূৰ্ত্তি।”
হরমসজী ও রাজাবাঈ অবাক্ হইয়া বিস্ময়বিস্ফারিতনেত্রে কীর্ত্তিকরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
সপ্তম পরিচ্ছেদ – দুই ভগিনী
এই সময়ে ধীরে ধীরে কমলাবাঈ সেখানে উপস্থিত হইল। অন্তরাল হইতে কমলাবাঈ এতক্ষণ সমুদয় শুনিতেছিল। তাহাকে দেখিয়া কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আপনাকেও আমার প্রয়োজন।”
কমলা মৃদুকণ্ঠে কহিল, “বলুন।”
কমলাকে দেখিয়া হরমসজী চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
বলিলেন, “তুমি এখানে কেন? আমরা বিশেষ ব্যস্ত আছি। এখন যাও।”
কমলা দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “বাবা, আমি সকলই জানি।”
হরমসজী বিস্মিতভাবে কন্যার দিকে চাহিয়া রহিলেন। ক্ষণপরে ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িলেন, এবং দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া হতাশভাবে বলিলেন, “হা ভগবান, আমার অদৃষ্টে এত কষ্টও ছিল!”
কমলা ধীরে ধীরে পিতার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। আদরে তাঁহার হাত ধরিয়া বলিল, “বাবা, আপনার এখন মাকে দেখাই উচিত। আমি অনেকদিন হইতেই এ সকল কথা জানি, দেখুন মার চেহারা। মা এ কয়মাস বড় কষ্ট পাইতেছেন। আপনার ভয়ে আমি কোন কথাই প্রকাশ করিতে পারি নাই।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আপনার কন্যা দেবী। বংশে কলঙ্ক হয় বলিয়া, জানিয়া-শুনিয়াও বর্জরজীর ন্যায় নরপশুকে বিবাহ করিতে সম্মত হইয়াছিলেন। হরমসজী সাহেব, আপনার অধীর হওয়া ঠিক হয় না।”
হরমসজী উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন, “আপনি ঠিক বলিয়াছেন। এই পাষণ্ডের রক্ত না দেখিয়া আমি জলস্পর্শ করিব না।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আপনাকে আর পাপীর রক্তে হস্ত কলঙ্কিত করিতে হইবে না। সে কাজ বিচারালয়েই হইবে।”
কমলাবাঈ বলিলেন, “বাবা, আমি সকল কথাই জানি। ইনি আমাদের বন্ধু।”
কীর্ত্তি। আপনার কন্যা সকলই জানেন। এ কথা আমরা কয়জনই কেবল জানি, সুতরাং প্রকাশ হইবার কোন সম্ভাবনা নাই।
কমলা। হাঁ বাবা, ইনিই রস্তমজীকে দুই-দুইবার রক্ষা করিয়াছেন। ইনিই আমাদিগকে রক্ষা করিবেন, পাপীর দণ্ড দিবেন। আপনি মাকে দেখুন। মা পাষণ্ডদের হাতে পড়িয়া এ কয়মাস কত কষ্ট পাইয়াছেন।
হরমসজী ধীরে ধীরে উঠিলেন। তাঁহার চক্ষু দিয়া দরবিগলিতধারে অশ্রুধারা বহিতেছিল। তিনি রুমালে চক্ষু মুছিয়া স্ত্রীর পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সাদরে তাঁহার হাত ধরিয়া তাঁহার চক্ষের জল মুছাইয়া দিলেন। বলিলেন, “রাজা, সকলই ত শুনিলে; ছেলেবেলায় আমরা যাহা করিয়াছিলাম, তাহার দণ্ড যথেষ্ট পাইয়াছি। ইনিই আমাদিগকে রক্ষা করিয়াছেন। আমার সে স্ত্রী আর নাই—সুতরাং আমাদের আর কোন ভয় নাই। হরেকজীও মারা গিয়াছে। ভগবান্ অনুগ্রহ করিয়াই শিশু অবস্থাতে তোমার ছেলেটিকে লইয়াছিলেন। নিশ্চয় আমার কন্যাটিকেও তিনি লইয়া তাহাকে পাপ পথ হইতে রক্ষা করিয়াছেন।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “না, আপনার কন্যা বাঁচিয়া আছে।”
হরমসজী বলিলেন, “বাঁচিয়া আছে! কোথায়? আপনি কি তাহার সন্ধান রাখেন? হা ভগবান্!”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “ব্যস্ত হইতেছেন কেন? আপনার সে কন্যা ভালই আছেন।”
হরমসজী বলিলেন, “এখন তাহার বয়স প্রায় বিশ বৎসর হইবে। সে নিশ্চয়ই তাহার মা’র মত হইয়াছে। কোনদিন পিতা বলিয়া আমার নিকট আসিবে। আমার মুখ দেখাইবার আর উপায় থাকিবে না। সে কি আমায় তাহার পিতা বলিয়া জানে?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “না।”
হরমসজী বলিলেন, “তবে আপনি আমার সে কন্যার সন্ধান কিরূপে জানিলেন?”
কীর্ত্তিকর পকেট হইতে এক টুকরা কাগজ বাহির করিলেন। হরমসঙ্গীর মৃত স্ত্রী রস্তমজীকে এই কাগজটুকু দিয়াছিলেন। ইহাতে তিনি যাহার নিকট কন্যা রাখিয়াছিলেন, তাহার ঠিকানা ছিল। কীর্ত্তিকর হরমসজীর হাতে কাগজখানি দিয়া বলিলেন, “আপনার স্ত্রী মৃত্যু সময়ে এই কাগজ রস্তমজীকে দিয়াছিলেন?”
হ। আপনি কি ইহার সন্ধান করিয়াছিলেন?
কী। তিনি রস্তমজীকে সেই কন্যার সন্ধান করিবার জন্য শপথ করাইয়াছিলেন।
হ। সন্ধান কি হইয়াছে?
কী। হাঁ, অনেক অনুসন্ধানের পর। আপনার সেই কন্যা পরমা সুন্দরী—তাহাই—এই পাপিয়সী পয়সার লোভে তাহাকে আর একটী স্ত্রীলোকের নিকট বিক্রয় করিয়া পুনরায় পলাইয়া যায়। আপনার কন্যা এই স্ত্রীলোকের নিকট থাকে। সকল কথাই পরে জানিতে পারিবেন।
হ। আর শুনিবার ইচ্ছা নাই। হা ভগবান্—আমার অদৃষ্টে এত কষ্ট লিখিয়াছিলেন! কী। আপনি কি আপনার কন্যাকে দেখিতে চাহেন?
হ। না—না—না। শৈশবেই তাহার মৃত্যু হইল না কেন?
হরমসজী আবার দুইহাতে মুখ আবৃত করিলেন।
কমলা কীর্ত্তিকরের নিকটস্থ হইয়া বলিলেন, “তিনি আমার ভগিনী—প্রকৃত পক্ষে আইনানুসারে তিনিই বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। তাঁহাকে আর আমাদের কোনমতেই অন্যত্রে থাকিতে দেওয়া কৰ্ত্তব্য নয়। তিনি কোথায় আছেন বলুন, আমি এখনই গিয়া তাঁহাকে লইয়া আসিব।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “আপনার দাসীকে ডাকুন, সে ঠিকানা জানে।
কমলা ব্যগ্রভাবে রতনকে ডাকিল। রতন তৎক্ষণাৎ আসিয়া কমলার পার্শ্বে দাঁড়াইল।
কীর্ত্তিকর ধীরে ধীরে উঠিলেন। ধীরে ধীরে যাইয়া রতনের হাত ধরিয়া বলিলেন, “কমলা বাঈ, আপনি আপনার ভগিনীকে দেখিতে চাহিতেছিলেন—এই লউন, আপনার ভগিনী।” তৎপরে হরমসঙ্গীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “হরমসজী সাহেব, আপনার সে কন্যা এই।”
এই সংবাদে হরমসজী ও রাজাবাঈ স্তম্ভিতভাবে ব্যাকুলদৃষ্টিতে রতনের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহাদের সকলই স্বপ্ন বলিয়া প্রতীয়মান্ হইতে লাগিল।
কমলা ও রতন বিস্মিতভাবে উভয়ে উভয়ের দিকে চাহিয়া রহিল।
প্রায় দশ মিনিট অতীত হইল, সকলেই নীরব, নিস্পন্দ। পরে রতন হাসিয়া ফেলিল। সে ধীরে ধীরে আসিয়া কমলার গলা জড়াইয়া তাহার মুখচুম্বন করিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ – অপূৰ্ব্ব মিলন
রতন হাসিয়া ফেলিল। চিরকালই তাহার হৃদয় যেন হাওয়ায় ভাসিয়া বেড়ায়—এত লঘু। এই দৃশ্যে সে নিজেই জানে না, সহসা কেন তাহার হাসি পাইল।
সে প্রথমে কীর্ত্তিকরের কথা বিশ্বাস করিতে পারে নাই। ভাবিল, হয় ত কীর্ত্তিকর উপহাস করিতেছেন; কিন্তু আবার ভাবিল, কীর্ত্তিকর উপহাস করিবার লোক নহেন। বিশেষতঃ তিনি এরূপ গুরুতর বিষয় লইয়া কখনও উপহাস-বিদ্রূপ করিবেন না।
হরমসজী তাহার পিতা এবং কমলা তাহার ভগ্নী, এ কথা মনে হওয়ায় তাহার হাসি পাইল। সে হাসিয়া ফেলিল। সে দুঃখিত হইবে কি আনন্দিত হইবে, হাসিবে কি কাঁদিবে, তাহার কিছু স্থির করিতে পারিল না।
প্রথমে তাহার মনে যাহা উদয় হইল, সে তাহাই করিল। সে যাইয়া কমলার গলা জড়াইয়া ধরিল, এবং তাহাকে স্নেহভরে চুম্বন করিল।
সে এখন আর কমলার দাসীভাবে ছিল না, প্রিয়সখীতে পরিণতা হইয়াছিল। তাহার সকল কথা কমলাকে বলিয়াছিল। রতন যে তাহারই রস্তমজীকে প্রাণের সহিত ভালবাসে, ইহা জানিতে পারিয়া সে তাহার প্রতি রাগ না কিরিয়া বরং বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছিল।
তাহারা দুটিতে যে দুই ভগিনী, তাহা পরস্পরে অবগত না থাকায়ও উভয়ে উভয়কে সহোদরা ভগিনীর ন্যায় ভালবাসিত। উভয়ের হৃদয় দুঃখ কষ্টে একসূত্রে বদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। কাহারও নিকট কাহারও কথা গোপন ছিল না।
কমলা রতনের সস্নেহ-চুম্বনে চমকিত হইয়া তাহার দিকে চাহিল। কীর্ত্তিকরের কথা বিদ্যুতের ন্যায় তাহার হৃদয়ে বাজিল। কমলা তখন রতনের চিবুক এক হাতে তুলিয়া ধরিয়া, আর এক হাতে তাহার কণ্ঠবেষ্টন করিয়া তাহার উভয় গণ্ডে চুম্বন করিল।
তখন তাহারা উভয়ে কে কাহাকে লইয়া গেল, তাহা তাহারা জানে না, উভয়ে পরস্পরের হাত পরস্পরের মধ্যে লইয়া ধীরে ধীরে হরমসজীর পার্শ্বে আসিয়া জানু পাতিয়া বসিল। উভয়ে হরমসঙ্গীর ক্রোড়ে মস্তক লুকাইল। তখন তাহারা সেই স্নেহময় পিতার চরণদ্বয় অশ্রুজলে ভাসাইয়া দিল।
হরমসজীও কাঁদিতেছিলেন। তিনি অশ্রুসিক্তনেত্রে একে একে দুই কন্যাকে হাত ধরিয়া তুলিয়া তাহাদের মস্তক চুম্বন করিলেন।
তখন তিনি কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন; এবং দুই কন্যার হাত ধরিয়া রাজা বাঈএর পার্শ্বে আসিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। রুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “তোমার একটি কন্যা ছিল— এখন দুইটি হইল।”
রাজাবাঈ উভয় কন্যার গলা জড়াইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তখন সকলের চক্ষু হইতে দরবিগলিত ধারে অশ্রুধারা বহিতেছিল।
অন্য কেহ হইলে নিশ্চয়ই এ দৃশ্যে অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিতেন না। কিন্তু কীর্ত্তিকর সাহেব অবিচলিতভাবে চক্ষু মুদিত করিয়া বসিয়াছিলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “যাহাতে এই পাপিষ্ঠগণ দণ্ডিত হয়, তাহা করা আমাদের সকলেরই কর্তব্য।”
হরমসজী বলিলেন, “আপনি যাহা বলিবেন, আমরা তাহাই করিব।”
কী। এ সকল কথা বর্জরজী যেন কোনরূপে না জানিতে পারে, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পলাইবে—ধরা কঠিন হইবে।
হ। সে কিছুতেই কোন কথা জানিতে পারিবে না।
কী। সে নিশ্চয়ই আপনার নিকট আসিবে। সে কমলাবাঈ লাভের প্রত্যাশা সহজে ছাড়িতে পারিবে না।
হ। বরং মেয়েকে বিষ খাওয়াইয়া মারিব, তব সেই পাষণ্ডের হাতে দিব না।
কী। আর কিছুই করিতে হইবে না। সে আসিলে তাহাকে কোন রকমে আমাদের মলব জানিতে দিবেন না। যেমন তাহাকে যত্ন করিতেন—পূর্ব্বাপর যেমন ভাব দেখাইয়া আসিতেছেন, সেইরূপই করিবেন। উপযুক্ত সময়ে আমরা তাহাকে গ্রেপ্তার করিব।
হ। সে কি আর আসিবে?
কী। খুব সম্ভব। সে এখন কোথায় আছে জানেন?
হ। কেন? যে বাড়ীতে তাহারা দুই জনে ছিল, সেই বাড়ীতেই আছে।
কী। না, সেখানে সে একবার গিয়াছিল বটে, কিন্তু সেই পৰ্য্যন্ত আর যায় নাই।
হ। আমাকে ত কিছুই বলে নাই।
কী। এবার যদি আসে, তাহা হইলে সে এখন কোথায় আছে, তাহা জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিবেন না।
হ। নিশ্চয় করিব।
কী। তবে এখন আমি বিদায় লইতে পারি।
হ। আপনার ঋণ অপরিশোধ্য। আবার কখন আপনার সাক্ষাৎ পাইব?
কী। প্রয়োজন হইলেই আবার আসিব
কীর্ত্তিকর উঠিলেন। তাঁহার সহিত অন্যান্য সকলেও উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
কীর্ত্তিকর হরমসঙ্গীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “বোম্বাই পুলিস আপনার বিবাহে এ টাকা যৌতুক দিবে—কিন্তু দেখিবেন, যেন রস্তমজীর বিবাহে আমরা নিমন্ত্রণে ফাঁক না পড়ি।” বলিয়া রাজাবাঈ-এর দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “আপনাকে আমার আর একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে; রস্তমজী যখন চুরীর অপরাধে ধরা পড়ে, তখন আপনিই না তাহার মোকদ্দমা চালাইবার জন্য একখানা বেনামী পত্র লিখিয়া পাঁচহাজার টাকা পাঠাইয়াছিলেন?’
রাজাবাঈ নীরবে অবনত মুখে রহিল।
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “তবে আমার অনুমান সত্য—যাহা হউক, কাজটা খুব মহৎ হৃদয়েরই হইয়াছে—সন্দেহ নাই। আপনি জানিতেন, রস্তমজী নির্দোষ, নিৰ্দ্দোষ হইয়াও সে অবস্থা- বিপাকে বিপন্ন—কাজটা খুব ভালই করিয়াছিলেন।”
এই বলিয়া হাসিতে হাসিতে কীর্ত্তিকর চলিয়া গেলেন। রাজাবাঈ স্বামীর হাত ধরিয়া বলিলেন, “আমাদের সহায় ভগবান।”
.
এক ব্যক্তি কীর্ত্তিকরের অনুসরণ করিয়াছিলেন, যতক্ষণ তিনি হরমসজীর বাড়ীতে ছিলেন, ততক্ষণ সে-ও বাড়ীর নিকটে তাঁহার প্রতীক্ষায় ছিল। তিনি হরমসজীর বাড়ী হইতে বাহির হইলে সেই ব্যক্তি আবার তাঁহার অনুসরণ করিয়া চলিল।
পরক্ষণে আর একজন কোথা হইতে বাহির হইয়া সেই ব্যক্তির অনুসরণ করিল। সে লোকটাও ইহার প্রতীক্ষায় নিকটেই কোনখানে লুক্কায়িত ছিল।
নবম পরিচ্ছেদ – খুনের উদ্দেশ্য
কীর্ত্তিকর হরমসজীর বাড়ী হইতে বাহির হইয়া রস্তমজীর বাড়ীর দিকে চলিলেন; রস্তমজীর সহিত তাঁহার দেখা করিবার কথা ছিল।
ফ্রামজীকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন থাকায় তিনি রস্তমজীকে লিখিয়াছিলেন, যেন তিনি ফ্রামজীকে তাঁহার বাড়ীতে ডাকিয়া লইয়া আনেন। ফ্ৰামজীও তাঁহার জন্য রস্তমজীর বাড়ীতে অপেক্ষা করিতেছিলেন।
আর বৃদ্ধ মারাঠী বেশে থাকিবার প্রয়োজন নাই দেখিয়া, কীর্ত্তিকর ইতিপূর্ব্বেই রস্তমজীকে তাঁহার নিজ পরিচয় দিয়াছিলেন। মাঞ্চারজী, বর্জরজীর সম্বন্ধেও সকল কথা তাঁহাকে বলিয়াছিলেন।
রস্তমজীর অনুরোধে—কতকটা বা নিজের কৌতূহল নিবৃত্তি করিবার জন্য কীর্ত্তিকর হরমসঙ্গীর মৃত স্ত্রীর কন্যার অনুসন্ধান আরম্ভ করেন। কীর্ত্তিকর যে কার্য্যে যখন হস্তক্ষেপ করিতেন, তাঁহাকে কখনও অকৃতকাৰ্য্য হইতে হয় নাই।
তিনি অতি শীঘ্রই সেই স্ত্রীলোককে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিলেন। তাঁহার নিকট জানিলেন যে, সে বেলাবাঈকে গঙ্গাবাঈয়ের নিকট বিক্রয় করিয়াছিল। পাছে কেহ বেলাকে খুঁজিয়া পায় বলিয়া গঙ্গা তাহার নাম বদলাইয়া রতন রাখিয়াছিল।
এই সকল জানিয়া রতনবাঈ যে হরমসজীর কন্যা, ইহা জানিতে তাঁহার আর বিলম্ব হয় নাই। তিনি এ সমস্ত কথাই রস্তমজীকে বলিয়াছিলেন। রস্তমজী প্রকৃতই সহোদরা ভগিনীর ন্যায় রতনকে ভাল বাসিতেন। তিনি এ কথা শুনিয়া হৃদয়ে বড়ই আনন্দ উপলব্ধি করিয়াছিলেন।
রস্তমজী ও ফ্রামজী উভয়েই অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে কীর্ত্তিকরের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। তাঁহাকে গৃহপ্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া উভয়েই সত্বর উঠিয়া দাঁড়াইলেন। অতি সমাদরে তাঁহাকে বসাইলেন।
কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “ফ্রামজী সাহেব, বর্জরজী প্রমাণ করিতে চায় যে, আপনিই পেষ্টনজীকে খুন করিয়াছেন।”
ফ্রামজী। (সবিস্ময়ে) আমি!
কীর্ত্তিকর। হাঁ, আপনিই
ফ্রামজী। আমি সে রাত্রে বোম্বে ছিলাম না। আপনাকে আমি তাহা প্রমাণ করিয়াও দিয়াছি। আমার ভগিনীর কঠিন পীড়া হওয়ায় আমি সেদিন রাত্রি আটার গাড়ীতে বেন্দোরা যাই। সমস্ত রাত্রি সেখানে ছিলাম। বড় বড় দুইজন ডাক্তার আর সেখানকার সকল লোকই ত এ কথা আপনাকে আর দাদাভাস্কর, সাহেবকে বলিয়াছেন।
কীর্ত্তিকর হাসিয়া বলিলেন, “ফ্রামজী সাহেব, ভয় নাই—আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করিতে আসি নাই। আমি কেবল বলিতেছিলাম যে,গুণবান্ বর্জরজী সাহেব হরমসজী সাহেবকে বেশ ভাল করিয়া বিশ্বাস করাইয়াছিলেন যে, খুন আপনিই করিয়াছেন।”
ফ্রামজী। তিনি তাহাই বিশ্বাস করিয়াছেন।”
কীর্ত্তিকর। হাঁ, করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু এখন আর করেন না।
রস্তমজী বলিলেন, “আপনি কি সকল কথা তাঁহাকে বলিয়াছেন?”
কীৰ্ত্তি। হাঁ, কেবল তাঁহাকে নয়—রাজাবাঈ, কমলাবাঈ, রতনবাঈ সকলের সম্মুখেই সকল কথা বলিয়াছি।
রস্তম। তবে তাঁহারা সকলেই এখন জানিয়াছেন যে, রতন তাঁহাদের কে?
কীৰ্ত্তি। হাঁ।
রস্তম। হরমসজীর বিবাহের কথা, তাঁহার পূর্ব্ব স্ত্রীর কথা সকলই আপনি তাঁহাদের সম্মুখেই বলিলেন?
কীৰ্ত্তি। কেন বলিব না?
রস্তম। তাঁহারা শুনিয়া কি বলিলেন?
কীৰ্ত্তি। কিছুই নয়।
রস্তম। কি করিলেন?
কীৰ্ত্তি। দেখি নাই,তখন চোখ বুজিয়া বসিয়াছিলেন।
সকলেই কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিলেন। ক্ষণপরে রস্তমজী বলিলেন, “তাহা হইলে আপনার স্থির বিশ্বাস, বর্জরজী খুন করিয়াছে?”
কীৰ্ত্তি। নিশ্চয়।
রস্তম। তবে তাহাকে গ্রেপ্তার করিতেছেন না কেন?
ফ্রামজী। সে জানিতে পারিলে পলাইবে—তাহাকে ধরা শক্ত হইবে।
কীৰ্ত্তি। প্রমাণ নাই।
রস্তম। তাহা হইলে কি করিবেন? চুরী করিয়াছে, কিন্তু আপনি হরমসঙ্গীর পরিবারের উপর দয়া করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিয়াছেন, এই পিশাচ খুন করিয়াও কি নিষ্কৃতি পাইবে?
কীৰ্ত্তি। এইজন্য ফ্রামজী সাহেবকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।
ফ্রামজী। বলুন।
কীৰ্ত্তি। আপনি খুব ভাল করে মনে করে দেখুন দেখি, কোন দিন সার্টিফিকেটের কথা কোনভাবে বর্জরজী বলেছিল কি না?
ফ্রামজী। না, তাহা হইলে নিশ্চয়ই মনে থাকিত।
কীৰ্ত্তি। আপনি পেষ্টনজী আর বর্জরজীর বাসায় প্রায়ই ত যাইতেন?
ফ্রামজী। প্রায়ই নয়—মধ্যে মধ্যে যাইতাম।
কীর্ত্তি। আপনার কি মনে পড়ে যে, কোন দিন পেষ্টনজীর সঙ্গে বর্জরজীর ঝগড়া-বিবাদ হইয়াছিল?
ফ্রামজী। না, তবে আপনি জিজ্ঞাসা করিলেন বলিয়া এখন মনে পড়িতেছে। একদিন আমি বর্জরজীর সঙ্গে দেখা করিতে গেলে দেখিলাম, সে বাড়ী নাই। তাহার চাকর হাসিতে হাসিতে বলিল, “আপনি বোধ হয়, আজ আর দেখা পাইবেন না।” আমি তাহাকে কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। সে বলিল, “একটু আগে পেষ্টনজী ও আমাদের কর্তা দুজনে দু বোতল মদ শেষ করেছেন। সেই দু বোতলের দেড় বোতল পেষ্টনজী সাহেব একা শেষ করেছেন। তাদের মজা দেখে কে? দুজনে মেজের উপরে গড়াগড়ি। আমার মনিব পেষ্টনজীর বুক থেকে কি কেড়ে নেবার চেষ্টায় ছিলেন, অথচ তিনি তাহা কিছুতেই দিবেন না। অনেক কষ্টে উঠে টলতে টলতে বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন; আমার মনিবও তার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। দেখুন না— হয়ত কোন মদের দোকানে বসে মদ খাচ্ছেন।”
কীৰ্ত্তি। ফ্রামজী সাহেব, আপনি এ কথাটি পূর্ব্বে বলেন নাই কেন?
ফ্রামজী। এটা খুব দরকারী খবর বলিয়া আমার মনেই হয় নাই।
কীর্ত্তি। আমরা যে সাক্ষী খুঁজিয়া বেড়াইতেছিলাম, এই ত সেই সাক্ষী, দেখিতেছেন না কি?
ফ্রামজী। এখন বুঝিতেছি।
কীর্ত্তি। সে চাকর কি বর্জরজীর নিকট বরাবরই ছিল?
ফ্রামজী। না, পরদিন গিয়ে দেখি, সে আর নাই।
কীর্ত্তি। নিশ্চয়ই। আর কি তাহাকে বর্জরজী রাখে। কেবল শুধু বাড়ী থেকে বিদায় করে নাই। একেবারে তাকে বোম্বে হইতেই কোথায় বিদায় করিয়া দিয়াছে।
ফ্রামজী। তারপর তাহার নূতন চাকর আপনাদের দাদাভাস্কর সাহেব।
কীৰ্ত্তি। যাহা হউক, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। মাঞ্চারজীর কাছে আমরা খুন সম্বন্ধে অনেক কথাই জানিতে পারিয়াছি, মাঞ্চারজীই আপনার কোট চুরী করিয়া আনিয়া ‘বর্জরজীকে দেয়, সেই কোটের পকেটে আপনার একখানা রুমালও ছিল; আপনাদের দুইজনের ঘাড়ে খুনের অপরাধটা চাপাইবার জন্যই বদমাইস বর্জরজী ফ্রামজীর সেই কোট পরিয়াছিল। খুনের রাত্রে বর্জরজী, পেষ্টনজীকে মাতাল করিয়া বেড়াইতে বাহির “ইয়াছিল, পথে সে পেষ্টনজীকে একবার ছাড়িয়া দিয়া গোপনে তাহার উপর লক্ষ্য রাখিয়াছিল। যখন সে দেখিল, রস্তমজী পেষ্টনজীকে মাতাল দেখিয়া একখানা গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া চলিয়া গেল, তখন বর্জরজী সুবিধা বুঝিয়া তাড়াতাড়ি সেই গাড়ীতে উঠে, ফ্রামজীর রুমালে ক্লোরাফর্ম্ম মাখাইয়া পেষ্টনজীর মুখে চাপিয়া ধরে—
রস্তমজী বলিলেন, “সংসারে এমন লোকও জন্মায়?”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “অনেক—অনেক।”
এই বলিয়া কীর্ত্তিকর চলিয়া গেলেন। রস্তমজী ও ফ্রামজী উভয়ে বসিয়া নানা বিষয়ে আলোচনা করিতে লাগিলেন।
দশম পরিচ্ছেদ – অলক্ষ্যে আক্রমণ
সন্ধ্যার একটু পরে কীর্ত্তিকর রস্তমজীর বাড়ী হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তখন পথে একে একে গ্যাস জ্বালা হইতেছিল। তিনি চিন্তিত মনে যাইতেছিলেন। তখন রাজপথে বড়ই জনতা, সকলেই নিজ নিজ কাজকর্ম্ম সারিয়া দ্রুতপদে গৃহাভিমুখে ফিরিতেছিল। পথে একস্থানে কয়েকটা গাছ থাকায় সেখানে একেবারেই আলো ছিল না। পার্শ্বেই একটা অন্ধকার গলি। সেখানটা লোকজনও খুব কম। যখন কীর্কির এই স্থান আসিলেন, সহসা একজনের দ্রুত পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিলেন।
তাঁহার বোধ হইল যেন—তিনি দেখিলেন, কে একজন তাঁহাকে লক্ষ করিয়া শাণিত ছুরিকা তুলিল। তিনি মুহূৰ্ত্ত মধ্যে সরিয়া দাঁড়াইলেন হাত বাড়াইয়া সেই আততায়ীকে ধরিতে গেলেন। সে ব্যক্তি তাঁহার পৃষ্ঠদেশ লক্ষ্য করিয়া ছুরি তুলিয়াছিল—কীর্ত্তিকর সরিয়া দাঁড়াইবার জন্য ছুরি তাঁহার মণিবন্ধে পড়িল। আঘাতটা সজোরে লাগিয়াছিল অনেকখানি কাটিয়া গিয়া রক্ত বাহিতে লাগিল।
কীর্ত্তিকর লম্ফ দিয়া তাহাকে ধরিতে অগ্রবর্ত্তী হইলেন; কিন্তু সে ব্যক্তি নিমেষমধ্যে অন্ধকারে মিশিয়া গেল।
তিনি তাহাকে দেখিতে না পাইয়া দাঁড়াইলেন। তখনই একজন পশ্চাৎ হইতে ত্রস্তে আসিয়া বলিল, “মাষ্টার, লাগে নাই ত?”
কীর্ত্তিকর তাহার দিকে ফিরিলেন। তাহাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “গাধা, এখনই তাহার পশ্চাতে যাও—আমার ভাবনা ভাবিতে হইবে না।”
সে মুহূর্ত্ত মধ্যে অন্ধকার গলির ভিতরে অন্তর্হিত হইল।
কীর্ত্তিকর তখন জানিতে পারিলেন যে, তাঁহার ক্ষতস্থান হইতে অনর্গল রক্ত পড়িতেছে। তিনি একটি আলোক স্তম্ভের নিকটে আসিলেন। পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া ক্ষতস্থান উত্তমরূপে বাঁধিলেন। এবং সেই গলির ভিতর দিয়া ধীরে ধীরে চলিলেন।
কিয়দ্দূর আসিয়া দেখিলেন, যে ব্যক্তিকে তিনি সেই ছুরিকাঘাতকারীর অনুসরণে পাঠাইয়াছিলেন, সে আবার ফিরিয়া আসিতেছে। কীর্ত্তিকর দাঁড়াইলেন। সেই ব্যক্তি নিকটস্থ হইলে বলিলেন, “কি হইল?”
“আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। অন্ধকারে কোন গলির ভিতর বা বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছে।”
“ইহাতে তোমাকে গাধা বলিব না ত কি বলিব?”
“মাষ্টার, আমি এ তিন দিন ছায়ার মত তার সঙ্গে সঙ্গে আছি।”
“তা জানি। তাহাতে লাভটা কি হইল?”
“এক নিমেষের জন্যও তাকে চোখের আড়াল হইতে দিই নাই।”
“তা জানি। এখন চোখে ধুলা দিয়া গেল।”
“আমি কি জানি যে, বেটা আপনাকে খুন করিবার চেষ্টা করিবে। আমি তার পশ্চাতে বরাবর আছি। আপনি যতক্ষণ হরমসজীর বাড়ীতে ছিলেন, সে ততক্ষণ আপনার অপেক্ষায় ছিল। তার পর আপনার অনুসরণ করিয়া রস্তমজীর বাড়ীতে এসেছিল। এখন আবার আপনার পশ্চাতে পশ্চাতে আসিতেছিল। আমি বরাবরই ওর সঙ্গে আছি।”
“এখনও খুব সঙ্গে আছ?”
“কি করিব? আপনাকে ছুরি মারিল দেখিয়া আমি, আপনি আঘাত পাইয়াছেন কি না দেখিবার জন্য দাঁড়াইয়াছিলাম; কিন্তু আপনি ত জানেন, আমি এক মিনিটও আপনার নিকট দেরী করি নাই।”
“যাও, এখনই লালুভাই ও দাদাভাস্করকে এই কথা বলিবে যে আমাকে খুন করিতে সাহস করে, সে সামান্য লোক নয়। খুব সাবধান—প্রত্যেক রেল ষ্টেশনে যেন সমস্ত গাড়ী ভাল করিয়া দেখা হয়।”
“যে আজ্ঞা,” বলিয়া সেই ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল। কীর্ত্তিকর কিয়ৎক্ষণ তথায় দাঁড়াইয়া কি ভাবিলেন; তৎপরে বড় রাস্তায় আসিয়া একখানা গাড়ী ডাকিয়া গৃহাভিমুখে চলিলেন। তাঁহার ক্ষতস্থানে বড় যন্ত্রণা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া তিনি গৃহে ফিরিলেন। তাঁহার বাড়ীতে নানাবিধ ওষুধ থাকিত।
যখন তিনি গৃহে ফিরিলেন, তখন বর্জরজী ছুরি হস্তে অন্ধকারে একটা দ্বারের পার্শ্বে লুক্কায়িত ছিল। যখন সে বুঝিল যে, আর কেহ এখন তাহাকে অনুসরণ করিতেছে না, তখন সে ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্য দিয়া চলিল; এবং পকেট হইতে পরচুলের একটা লম্বা দাড়ী মুখে লাগাইয়া দিল। সহজে কাহারই তাহাকে চিনিবার উপায় রহিল না।
মাঞ্চারজীকে বাসায় না দেখিয়া বর্জরজী তখনই বুঝিয়াছিল যে, মাঞ্চারজী পুলিসের হাতে পড়িয়াছে; সম্ভবতঃ সে সকলই স্বীকার করিয়াছে। সুতরাং সেইদিন হইতে বর্জরজী পুলিসের উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখিয়াছিল। অনুসন্ধানে জানিয়াছিল, কোথায় পুলিস মাঞ্চারজীকে রাখিয়াছে।
যাহাতে হরমসজী কালবিলম্ব না করিয়া তাহার সহিত কমলার বিবাহ দেন, সে এক্ষণে সেই চেষ্টায় বিশেষ তৎপর হইয়াছিল, কারণ যে বেশ বুঝিয়াছিল যে, তাহার রক্ষা পাইবার ইহা ব্যতীত আর অন্য উপায় নাই।
অদ্য সে সেই উদ্দেশ্যে হরমসজীর সহিত দেখা করিতে গিয়াছিল। কিন্তু হরমসজীর দ্বারে কীর্ত্তিকরকে দেখিয়া বিস্মিত হইল। পরে কীর্ত্তিকরকে হরমসজীর বাড়ীতে প্রবেশ করিতে দেখিয়া সে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। বুঝিল যে, পুলিস তাহার কথা সকলই জানিতে পারিয়াছে। কীৰ্ত্তিকর তাহারই সন্ধানে হরমসজীর নিকটে আসিয়াছেন। পূৰ্ব্বেই সে জানিতে পারিয়াছিল, কীৰ্ত্তিকর সৰ্ব্বতোভাবে তাহাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টায় আছেন। তিনিই তাহার পরম শত্রু। তিনি থাকিতে . তাহার অভীষ্টসিদ্ধির কোন সম্ভাবনা নাই—তিনি থাকিতে তাহার রক্ষা নাই।
বর্জরজী কীর্ত্তিকরের অপেক্ষায় হরমসজীর বাড়ীর নিকটে লুকাইয়া রহিল। কীর্ত্তিকর বাহির হইবামাত্র তাঁহার অনুসরণ করিল। মনে মনে স্থির করিয়াছিল, এ বিঘ্ন দূর করা একান্ত আবশ্যক। নতুবা আত্মরক্ষার উপায় নাই। কোন রকমে কীর্ত্তিকরকে সরাইতে পারিলে পুলিসের অন্য কাহারই সাধ্য নাই যে, তাহাকে আঁটিয়া উঠে। বর্জরজী এই উদ্দেশ্যে কীর্ত্তিকরকে আক্রমণ করিয়াছিল; কিন্তু দৈবানুকূল্যে কীৰ্ত্তিকর বাঁচিয়া গেলেন। বর্জরজী বিফলমনোরথ হইয়া অন্ধকারে লুকাইয়াছিল।
বর্জরজী রাত্রি বারটা পর্য্যন্ত পথে পথে ঘুরিল। যথাসাধ্য অন্ধকারে লুকাইয়া চলিল। প্ৰায় রাত্রি একটার সময় সে যে বাড়ীতে পুলিস মাঞ্চারজীকে রাখিয়াছিল, সেই বাড়ীর ভিতর নিঃশব্দে প্রবেশ করিল।
একাদশ পরিচ্ছেদ – বন্দী পলাতক
পরদিন অতি প্রাতে ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া দাদাভাস্কর কীর্ত্তিকরের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কীর্ত্তিকর ইহার অনেক পূর্ব্বে উঠিয়া তাঁহার কাগজ-পত্রগুলি দেখিতেছিলেন। তিনি দাদাভাস্করকে ব্যস্ত-সমস্ত দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ব্যাপার কি?”
দাদা। বড়ই আশ্চর্য ব্যাপার—চোখে ধুলা দিয়াছে।
কীৰ্ত্তি। কিছুমাত্র আশ্চর্য্য ব্যাপার নয়—তোমার চোখে ধূলা সহজেই দেওয়া যায়। তবে এতদিন যে ইহা ঘটে নাই—এই আশ্চৰ্য্য!
দাদা। না মাষ্টার, তা ঠিক নয়।
কীৰ্ত্তি। তবে কি বল।
দাদা। মাঞ্চারজী পলাইয়াছে।
কীৰ্ত্তি। কি?
দাদা। যে লোক তাহার পাহারায় ছিল, তারা এসে খবর দিল যে, তারা দুইজনেই পলাইয়াছে।
কীর্ত্তি। কি রকম?
দাদা। কাল রাত এগারটার সময় ঘরের ভিতর মাঞ্চারজী, আর তাহার মা ঘুমাইতেছিল, এমন সময়ে কে আসিয়া সহসা যে লোকটা দরজায় পাহারায় ছিল, সেই লোকটার মুখ চাপিয়া ধরিল। তখনই তাহার হাত মুখ পা কাপড় দিয়া বাঁধিয়া ফেলে; সে একটা কথা কহিতেও পারে না।
কীর্ত্তি। সে তোমার চেয়েও গাধা—গাধার গাধা। আমি গড়িয়া তুলিব, আর তোমরা ভাঙিয়া ফেলিবে।
দাদা। যাই বলুন—সে যাহা বলিল, তাহাই আপনাকে বলিতেছি।
কীৰ্ত্তি। বল।
দাদা। সে সেইভাবেই পড়ে থাকে। তাহার চোখও বাঁধা ছিল, সুতরাং সে কিছুই দেখিতে পায় নাই। তবে শব্দে বুঝয়াছিল যে, একটু পরে মাঞ্চারজী ও তাহার মা সেই লোকের সঙ্গে চলিয়া যায়।
কীর্ত্তি। তার পর?
দাদা। দুইটার সময় তাহার বল্লীতে পাহারায় যে থাকিবে, সে গিয়া তাহার এই অবস্থা দেখিতে পায়। সেই তখন তাহার হাত মুখ পা খুলিয়া দেয়। তাহার পর তাহারা দুইজনে আমার কাছে আসে।
কীর্ত্তি। দেখ দাদাভাস্কর, তুমি কাজ যত সহজ মনে কর, তত নয়
দাদা। আমি কবে কাজ সহজ বলিয়াছি। ঢের ঢের বদমাইস এ বয়সে দেখিলাম—কিন্তু ইহার মত বকেয়া বদমাইস আর দেখি নাই।
কীৰ্ত্তি। বাঁচিয়া থাকিলে আর পুলিসে থাকিলে আরও অনেক দেখিতে পাইবে।
দাদা। এখন কি করা উচিত?
কীর্ত্তি। দাদাভাস্কর, আমি তোমার মত নিরেট নই।
দাদা। তাকি আমি জানি না।
কীৰ্ত্তি। আমি কোন কাজেই একজনের উপর ভার দিয়া নিশ্চিন্ত থাকি না। আমি মাঞ্চারজীর উপর নজর রাখিবার জন্য আর এক জনকে রাখিয়াছিলাম।
দাদা। সেটা আবশ্যক বলিয়া আমার মনে হয় নাই।
কীৰ্ত্তি। তাহাই অনেক সময়েই তুমি শেষে হাত কামড়াইয়া মর।
দাদা। তাহা এখন বেশ বুঝিয়াছি।
কীৰ্ত্তি। সে লোক যখন এখনও ফিরে নাই, তখন সে নিশ্চয়ই ইহাদের পশ্চাতে আছে। শীঘ্রই সংবাদ পাইবে।
এই সময়ে এক ব্যক্তি আসিয়া কীৰ্ত্তিকরকে সেলাম দিয়া তাঁহার হাতে একখানি পত্র দিল। কীৰ্ত্তকর পত্র পড়িয়া দাদাভাস্করের হাতে দিয়া বলিলেন, “পড়িয়া দেখ।”
দাদাভাস্কর পড়িলেন।
“মহাশয়,
হুকুম মত মাঞ্চারজীর উপর পাহারায় ছিলাম। তাহার বাড়ীর সম্মুখে রাস্তায় এক বাড়ীর দরজায় বসিয়াছিলাম। রাত্রি প্রায় একটার সময় মাঞ্চারজী ও তাহার মা এবং একজন দাড়ীওয়ালা লোক তিনজনে বাড়ীর বাহির হইয়া আসে। আমি তাহাদের অনুসরণ করি।
তাহারা বুড়ীবন্দরে আসিয়া একখানা নৌকা ভাড়া করে। তাহার পর মাঞ্চারজী তাহার মাকে লইয়া নৌকায় উঠিয়া নৌকা খুলিয়া দেয়। দাড়ীওয়ালা লোক অন্যদিকে চলিয়া যায়।
মাঞ্চারজীর উপর নজর রাখিবার হুকুম আমার উপর ছিল, কাজেই আমি আর দাড়ীওয়ালার অনুসরণ করিতে পারিলাম না।
আমিও আপাততঃ একখানা নৌকা ভাড়া করিয়া মাঞ্চারজীর নৌকার সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। আপনাকে সংবাদ দেওয়া কৰ্ত্তব্য ভাবিয়া পেনসিলে এ পত্র লিখিয়া একজন পাহারাওয়ালার হাতে দিয়া গেলাম। পরে যাহা হয় সংবাদ দিব।
অনুগত দাস
রাঙ্গা রাও।”
কীর্ত্তিকরের সম্মুখে পত্রখানি রাখিয়া দাদাভাস্কর বলিলেন, “আপনার ন্যায় আমার ক্ষমতা থাকিলে, আমিও এতদিনে সুপারিন্টেণ্ডেন্ট হইতাম।”
কীৰ্ত্তি। সুপারিন্টেণ্ডেন্টত হইতে, এখন কি করিবে বল দেখি।
দাদা। এখনই মাঞ্চারজীকে গ্রেপ্তার করিতে রওনা হইতাম, আপনি কি করিতেন জানি না।
কীর্ত্তি। মাঞ্চারজীকে আমাদের বেশী দরকার না বর্জরজীকে?
দাদা। বর্জরজীকে ধরা বড় শক্ত।
কীৰ্ত্তি। তবেই হইয়াছে। এখন—এখনি যাও, দেখিবে কয়টা পিস্তলের দোকান আছে, তাহাদের এই পত্রখানি দেখাও।”
দাদাভাস্কর পত্রখানি হাতে লইয়া পড়িলেন—
“বিশেষ চেনা লোক না হইলে গুলিসুদ্ধ কার্ট্রিজ কাহাকেও বেচিবেন না। চাহিলে গুলিওয়ালা বলিয়া ফাঁকা কার্ট্রিজ দিবেন।
কে বি কীৰ্ত্তিকর
ডিটেটিভ সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট।”
কীৰ্ত্তি। কিছু বুঝিলে?
দাদা। কিছুই নয়।
কীর্ত্তি। বর্জরজী ছদ্মবেশে এখনও এই সহরেই আছে। মাঞ্চারজীকে নৌকা করিয়া বিদায় করিয়া দিয়াছে।
দাদা। তা ত এখন বেশ জানিতে পারা যাইতেছে।
কীৰ্ত্তি। সে সহজ লোক নয়—সহজে নিজ উদ্দেশ্য ছাড়িবে না, শেষ পৰ্য্যন্ত দেখিবে।
দাদা। সে এই রকম লোক বলিয়াই বোধ হয়।
কীৰ্ত্তি। আমাকেও সে দেখিয়া লইবে।
দাদা। আপনার বিশেষ সাবধানে থাকা উচিত।
কীৰ্ত্তি। ভয় নাই। যাহা বলিতেছিলাম শোন। খুব সম্ভব বর্জরজীর কাছে পিস্তল নাই, তা থাকিলে সে ছুরি চালাইত না। আমার উপর নিশ্চয়ই গুলি চালাইত। গতবারে ছুরিতে কিছু হয় নাই, এবার সে গুলি চালাইবার চেষ্টা করিবে। সুতরাং যে কোন উপায়ে, সে একটা রিভলবার আর কার্ট্রিজ কিনিবে।
দাদা। ফাঁকা কার্ট্রিজ দিতে বলিতেছেন কেন?
কীৰ্ত্তি। সে সেই কার্ট্রিজ আমার উপর চালাইলে আমি মরিব না বলিয়া।
দাদা। আপনার মত বুদ্ধি আমার কবে হইবে? কাশীনাথ সেজে নিজের হাতেই সব কাজ সারিয়া ফেলিলেন, আমাদের কেবল ঘুরে মরাই সার হইল। আমার দুই-একদিন সন্দেহ হইয়াছিল, আপনার কাছে একদিন সে কথা তুলিয়াছিলাম, কিন্তু আপনি কথাটা এমন ভাবে উড়াইয়া দিলেন যে, আমরা তখন তাহা বুঝিতেই পারিলাম না।
কীৰ্ত্তি। এ সকল দুঃখ করিবার সময় এখন নয়। এখন এই কাজে যাও! আমিও বর্জরজীর সন্ধানে চলিলাম। লালুভাইকে তাহার চাকরকে খুঁজিয়া বাহির করিতে বলিয়াছি।
তখন কীৰ্ত্তিকর ও দাদাভাস্কর উভয়েই সত্বর বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – নূতন খবর
পূর্ব্বোক্ত ঘটনার দুই দিবস পরে একদিন রাত্রে রতনবাঈ সর্ব্বাঙ্গ বস্ত্রে আচ্ছাদিত করিয়া অতি সন্তর্পণে কীর্ত্তিকর সাহেবের বাড়ীতে প্রবিষ্ট হইল।
তখন অনেক রাত্রি হইয়াছিল। কীর্ত্তিকর সমস্ত দিনের পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত হইয়া শয়ন করিতে যাইতেছিলেন, সহসা রতনবাঈকে দেখিয়া তিনি ফিরিলেন।
রতন দ্রুতপদে আসিয়াছিল। সে অত্যন্ত হাঁপাইতেছিল—আসিয়া একখানা চেয়ারে বসিয়া পড়িল। কিয়ৎক্ষণ বসিয়া, একটু স্থির হইয়া সে কীর্ত্তিকরের হাতে একখানা পত্ৰ দিল।
কীর্ত্তিকর পত্রখানি পাঠ করিলেন;—
“মাননীয় হরমসজী সাহেব,
আমি জানি, কীর্ত্তিকর আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আমার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলিয়াছে। সে যতই মিথ্যা কথা বলুক না কেন, আমি বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করি না।
আপনার কন্যার সহিত আমার বিবাহ দিবেন, স্বীকার করিয়াছেন, জানিবেন, আমি তাহাকে বিবাহ করিবই করিব। যদি আপনি এক্ষণে বিবাহ দিতে অসম্মত হন, আরও জানিবেন, আমি আপনাকে সহজে ছাড়িব না। আমি আপনার সমস্ত গুপ্ত-রহস্য সমস্ত বোম্বে সহরে প্রচার করিয়া দিব। সহরময় আপনার কলঙ্ক-কাহিনী রটিবে। তখন সকলেই রাজাবাঈকে কুলটা বলিয়া জানিবে, কমলাকে জারজ স্থির করিবে।
আপনার কুকীর্ত্তির কথাও প্রকাশ করিতে কুণ্ঠিত হইব না; আপনার যে কন্যা পতিতা— সেই রতনকে বিবাহ করিয়া আপনার সমস্ত সম্পত্তি দখল করিব। কেবল ইহাই নহে, যেরূপে হয়, আপনাদের এ জীবনলীলা শেষ করিয়া দিব। পুলিসে আমার কিছুই করিতে পারিবে না। কীৰ্ত্তিকরের মত আমি অনেক নির্ব্বোধ-শিরোমণি ডিটেটিভ দেখিয়াছি।”
কীর্ত্তিকর এই পর্য্যন্ত পড়িয়া নিম্নোর্দ্ধে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, “হুঁ।” একটু থামিয়া আবার পড়িয়া যাইতে লাগিলেন;-
“তিন দিনের মধ্যে আমার সহিত কমলার বিবাহ দেওয়াই চাই—নতুবা আপনার মঙ্গল হইবে না। যদি ভাল চান, তবে কাল রাত্রি একটার সময় আমার সহিত গিরগোমের মোড়ে একাকী আসিয়া দেখা করিবেন।
যদি পুলিসে সংবাদ পাঠান বা পুলিসের কোন লোক বা অপর কাহাকে সঙ্গে লইয়া আসেন, তবে আমার দেখা পাইবেন না। আমিও তখন বুঝিব, আমার কি করা কর্ত্তব্য। ৫০০০ টাকা সঙ্গে আনা চাই। আপাততঃ আমার টাকার বড় প্রয়োজন আছে।
বর্জরজী।”
কীর্ত্তিকর পত্র পাঠ করিয়া কাগজ কলম টানিয়া লইয়া একখানি পত্র লিখিয়া বলিলেন,
“ভয় নাই—যাও। পত্রে সব লিখিয়া দিয়াছি।”
রতনবাঈ কোন কথা না কহিয়া উঠিল। কীর্ত্তিকর বলিলেন,
“তোমার একাকী এরূপে যাওয়া উচিত নহে। চল, আমি তোমায় পৌঁছাইয়া আসি।
উভয়ে বাড়ী হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। কীর্ত্তিকর রাজপথে আসিয়া একখানা গাড়ী ডাকিলেন। তৎপরে তিনি রতনকে হরমসজীর বাড়ী পৌঁছাইয়া দিয়া বাড়ী ফিরিলেন।
পরদিন অতি প্রাতে লালুভাই আসিয়া কীর্ত্তিকরের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া কীর্ত্তিকর বলিলেন, “কতদূর কি সন্ধান করিলেন?”
লালুভাই বলিলেন, “অনেক কষ্টে বর্জরজীর সেই চাকরটার সন্ধান পাইয়াছি।”
“কি সন্ধান পাইলেন?”
“চাকরটাকে টাকা কড়ি দিয়া ভুলাইয়া তাহাকে কলিকাতার পাঠাইয়া দিয়াছে।”
“সে এখন সেইখানেই আছে?”
“হাঁ, কলিকাতা-পুলিসে টেলিগ্রাফ করিয়াছি।”
“এই চাকর বেটা বর্জরজীকে পেষ্টনজীর নিকট হইতে সার্টিফিকেট কাড়িয়া লইতে দেখিয়াছিল, তাহাই তাহাকে সরাইয়াছে। আপাততঃ এই এক সাক্ষীই যথেষ্ট।”
“সে কলিকাতাতেই আছে। তাহার সন্ধান পাইলেই তাহাকে এখানে আনা যাইবে। কিন্তু বর্জরজী কোথায় অছে, কিছু সন্ধান পাইলেন?
“না, এইখানেই লুকাইয়া আছে। দাদাভাস্কর তাহার সন্ধানে আছে।”
“আপনার উপদেশানুসারে মাঞ্চারজীর সন্ধানে গিয়াছিলাম।”
“সে এখন কোথায় আছে?”
“আমাদের লোক তাহার সঙ্গেই আছে। তাহারা সালসতী দ্বীপে একটি স্ত্রীলোকের বাড়ীতে আছে। মাঞ্চারজী আর বর্জরজী এই স্ত্রীলোকটাকে বহুদিন হইতে জানিত।”
“মাঞ্চারজীর সহিত দেখা করিয়াছিলেন?”
“হাঁ, সেদিন রাত্রে বর্জরজী যাইয়া তাহাদের বলে যে, যদি তাহারা তখনই তাহার সঙ্গে না যায়, তাহা হইলে উভয়কেই খুন করিবে। তাহারা প্রাণের ভয়ে তাহার সঙ্গে চলিয়া যায়। সে-ই তাহাদিগকে সালসতীতে যাইতে বলে। সেইখানে তাহার জন্য তাহাদের অপেক্ষা করিতে বলে।”
“আপনাকে সে কি বলিল?”
“সে আমার সহিত তখনই ফিরিয়া আসিতে চাহিয়াছিল। সে যাহা করিয়াছে, কেবল বর্জরজীর ভয়ে। সে এখন আমরা যাহা বলিব, তাহাই করিতে প্রস্তুত আছে।”
“তাহাকে এখন সেইখানেই থাকিতে বলিয়াছেন ত?”
“হাঁ, আর আপনার কথামত বলিয়াছি যে, বর্জরজী তাহাকে যাহা বলে তাহা করিতে।”
“সেখানে আরও লোক রাখিয়াছেন ত?”
“আমাদের চারিজনকে রাখিয়া আসিয়াছি। তাহারা নিকটেই লুকাইয়া আছে। মাঞ্চারজী তাহাদের চোখের আড়াল হইতে পারিবে না। আর বর্জরজী সেখানে গেলেই তাহারা তাহাকে গ্রেপ্তার করিবে।”
“সে সেখানে যাইবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন।”
এই সময়ে দাদাভাস্কর তথায় আসিয়া বলিলেন, “আপনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা ঠিক।”
কীৰ্ত্তি। কি?
দাদা। কাল একজন অপরিচিত সাহেব লক্ এণ্ড এন্ড্রর দোকানে হইতে একটা রিভলবার আর এক ডজন কার্ট্রিজ কিনিয়াছে।
কীর্ত্তি। সে সাহেবের লম্বা দাড়ী ছিল?
দাদা। হাঁ।
কীৰ্ত্তি। তবেই ঠিক হইয়াছে, আমাদের সেই বন্ধুই বটে। ফাঁকা কার্ট্রিজ দিয়াছে ত?
দাদা। হাঁ।
কীর্ত্তি। বর্জরজী কোথায় লুকাইয়া আছে, কিছু সন্ধান পাইলে?
দাদা। এখনও ত কিছু পাই নাই। তবে ভায়া বোম্বে থাকিলে দাদাভাস্করের হাত এড়াইতে পারিবেন না।
কীর্ত্তি। চারিদিকে লোক রাখিয়াছ ত?
দাদা। সব রেল স্টেশনে, সব বন্দরে সব পথে লোক রাখিয়াছি।
কীৰ্ত্তি। কাল বৈকালে চারিটার সময় আপনারা দুই জনেই এখানে আসিবেন, বিশেষ কাজ আছে। এখন যান।
তাঁহারা উভয়ে প্রস্থান করিলেন। কীর্ত্তিকর তাঁহার কাগজ-পত্রে মনোনিবেশ করিলেন।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – পাপিষ্ঠের কাণ্ড
সেইদিন রাত্রে প্রায় বারটার সময়ে হরমসঙ্গী গিরগামের মোড়ে আসিয়া দাঁড়াইলেন। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, কেহ কোথায়ও নাই—পথে একটি লোকও চলিতেছে না।
তাঁহার সে সময়ের মনের অবস্থা বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। তিনি কাপুরুষ ছিলেন না, তথাপি বর্জরজীর সহিত একাকী এত রাত্রে সাক্ষাৎ করায় তাঁহার হৃদয় সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল। তবে তাঁহার একমাত্র ভরসা—কীর্ত্তিকর। তিনি রতনকে দিয়া তাঁহাকে পত্রে যাহা যাহা করিতে বলিয়াছিলেন, তিনি তাহাই করিতেছিলেন, সুতরাং তিনি জানিতেন, যাহাতে তাঁহার কোন বিপদ না ঘটে, কীর্ত্তিকর নিশ্চয়ই তাহার ব্যবস্থা করিয়াছেন।
তিনি কাহাকেও কোন দিকে দেখিতে পাইলেন না। দূরস্থ গির্জ্জায় ঘড়িতে টং টং করিয়া বারটা বাজিল। তিনি আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিলেন, কিন্তু বর্জরজী তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিল না।
আর অপেক্ষা করা বৃথা ভাবিয়া তিনি গৃহাভিমুখে ফিরিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে কে পশ্চাদ্দিক্ হইতে তাঁহার পৃষ্ঠে হস্তস্থাপন করিল। তিনি চমকিত হইয়া ফিরিয়া দেখিলেন, একটি স্ত্রীলোক। সে অতি অস্ফুটস্বরে কহিল, “আসুন—বর্জরজী আপনাকে লইয়া যাইবার জন্য আমাকে পাঠাইয়াছেন।”
হরমসজী দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। তাঁহার হৃদয় আবার সবলে স্পন্দিত হইতে লাগিল।
একটা অন্ধকারপূর্ণ গলির ভিতর আসিয়া সেই স্ত্রীলোকটি বলিল, “আপনার চোখ বাঁধিয়া আমি লইয়া যাইব। আপত্তি থাকে ত ফিরিয়া যাইতে পারেন।”
হরসমজী সাহসে ভর করিয়া বলিলেন, “যখন তাহার সহিত দেখা করিব বলিয়া আসিয়াছি, তখন ইহাতে আপত্তি করিব কেন?”
স্ত্রীলোক আর কোন কথা না কহিয়া একখানা রুমাল বাহির করিয়া হরমসজীর চোখ বিশেষরূপে বাঁধিয়া দিল। হরমসজীর আর কিছুই দেখিবার উপায় রহিল না।
তখন সেই স্ত্রীলোক তাঁহার হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। এইরূপে হরমসজী প্রায় পনের মিনিট চলিলেন। তাহার পর তিনি বুঝিলেন, তিনি একটি গৃহের মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।
তখন সেই স্ত্রীলোক হরমসঙ্গীর হাত ছাড়িয়া দিয়া চক্ষুর বন্ধন খুলিয়া দিল। হরমসজী দেখিলেন, তিনি একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আসিয়াছেন। প্রকোষ্ঠে একটি টেবিল ও দুইখানি চেয়ার ব্যতীত আর কোন আসবাব নাই। টেবিলের উপর একটি বাতি জ্বলিতেছে।
চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, গৃহের একটি দ্বার ব্যতীত আর দ্বার নাই। একটি গবাক্ষ আছে, তাহাও সুদৃঢ়রূপে আবদ্ধ।
গৃহে আর কেহ লোক নাই। স্ত্রীলোকটি তাঁহাকে বসিতে বলিয়া অতি সাবধানে দ্বারটি অগ্রে বন্ধ করিল। তাহার পর বলিল, “এখন আমাদের কথাবার্তা হইতে পারে।”
স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বরে হরমসজী তাহার দিকে সবিস্ময়ে চাহিলেন। সেই স্ত্রীলোক তখন তাহার মুখ হইতে একটা রবারের মুখোস্ টানিয়া খুলিতেছিল; হরমসজী বিস্মিত হইয়া দেখিলেন, সে স্ত্রীলোক নহে—স্বয়ং বর্জরজী।
বর্জরজী হাসিয়া বলিলন, “লোকের চারিদিকে শত্রু জুটিলে রাধ্য হইয়া এইরূপ সাবধানে থাকিতে হয়; সংসারের লোক পরের ভাল দেখিতে পারে না। তাহাই আমার এত শত্ৰু।”
হরমসজী বহু কষ্টে নিজ মনোভাব গোপন করিয়া বলিলেন, “আমি কি বিবাহ দিব না বলিয়াছি যে, তুমি আমাকে এরূপ চিঠী লিখিয়াছ?”
বর্জরজী সে কথায় কোন উত্তর না করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কীর্ত্তিকর না আপনার সঙ্গে দেখা করিয়াছিল?”
হরমসজী কহিলেন, “হাঁ, অনেক কথা বলিয়াছিল; আমি তাহার একটি কথাও বিশ্বাস করি নাই—আমি কি পুলিসকে চিনি না?”
বর্জরজী জিজ্ঞাসা করিলেন, “টাকা আনিয়াছেন?”
হরমসজী বলিলেন, “হাঁ, যখন তোমার সহিত কন্যার বিবাহ দিব, যখন তোমারই সব হইবে, তখন তোমাকে বিশ্বাস করিব না ত আর কাহাকে করিব?”
এই বলিয়া হরমসজী পাঁচ হাজার টাকার নোট গণিয়া বর্জরজীর হাতে দিলেন। নোটগুলি পকেটে রাখিয়া বর্জরজী বলিলেন, “হাঁ, এখন বুঝিলাম, কীর্ত্তিকর বেটা আপনাকে বুঝাইয়া উঠিতে পারে নাই।
বেটা কোন কারণে আমার পরম শত্রু হইয়াছে—আমাকে জব্দ করিবার চেষ্টায় আছে।”
“আমার জামাতা হইলে বোম্বে সহরে তোমার শত্রুতা করিতে সাহস করে কে?”
“সেইজন্য কালই গোপনে এ বিবাহ কার্য্য শেষ করা উচিত।”
“আমার কিছুতেই আপত্তি নাই। আমার মান-সম্ভ্রম সকলই তোমার হাতে। তোমার সহিত কমলার বিবাহ হইলে তোমারও সম্ভ্রম যাহা—আমারও তাহাই।”
“তা ত নিশ্চয়। এখন বিবাহ বিশেষ গোপনে হওয়া দরকার, নতুবা কীৰ্ত্তিকর বিশেষ গোল করিতে পারে। একবার বিবাহ হইয়া গেলে তাহার পর সকলকে বলিলে বেটা আর কিছুই করিতে পারিবে না।”
“তাহাই হউক—কালই গোপনে বিবাহ দিব। তুমি আমার বাড়ী আসিয়ো, ইতিমধ্যে সমস্ত আয়োজন ঠিক করিয়া রাখিব।”
“আপনার বাড়ীতে বিবাহ হইবে না। বিবাহের পূর্ব্বে আমি কিছুতেই কীর্ত্তিকরকে জানিতে দিব না যে, আমি কোথায় আছি।”
“সে কিরূপে টের পাইবে?”
“তাঁহাকে আপনি চিনেন না। যাহাই হউক, আপনার বাড়ীতে বিবাহ হইবে না। আমি বাড়ী স্থির করিয়াছি; সেইখানে গোপনে বিবাহ হইবে।”
“তুমি যদি জেদ্ কর—তবে তাহাই হউক। আমরা সেইখানে যাইব।”
“কমলা ব্যতীত আর কাহাকেও সঙ্গে লইবেন না।”
“আমার স্ত্রী আর রতনকে না লইলে তাহারা শুনিবে কেন?”
বর্জরজী একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, “তা এদের দুজনকে লইতে পারেন।”
“সাক্ষী চাহি ত?”
“দুইজন সাক্ষীর দরকার—একজন আমার লোক, একজন আপনার লোক। আমি মাঞ্চারজীকে আনিব। আপনি আপনার বিশেষ বিশ্বাসী একজন লোককে আনিবেন। খুব বৃদ্ধলোক হওয়া চাই।”
“তাহা হইলে আমার ব্যাঙ্কের মারোয়ানজীকে লইব। সে বৃদ্ধ বিশেষ বিশ্বাসী।”
“হাঁ তাহাকে লইতে পারেন।”
“পুরোহিত?”
“একজন বিশেষ বিশ্বাসী পুরোহিত আপনি সংগ্রহ করিবেন। আমার এখন যোগাড় করা সুবিধা হইবে না। আমি ভারি ব্যস্ত।”
“কে রেজেষ্টারী করিবে?”
“আপনি ত বিবাহের রেজেষ্ট্রার-আপনি রেজেষ্টারী করিলেই চলিবে।”
“তাহা হইতে পারে।”
“তবে সমস্ত কথা ঠিক থাকিল; কাল সন্ধ্যার পর মজাগণের মোড়ে দুইখানা গাড়ী থাকিবে। আপনারা সকলে সেইখানে আসিয়া ঐ দুই গাড়ীতে উঠিয়া বসিবেন। কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না। যে বাড়ীতে বিবাহ হইবে, কোচম্যান সেই বাড়ীতে আপনাদের লইয়া যাইবে।”
“কথা ঠিক থাকিল। এখন উঠিলাম, রাত্রি অনেক হইয়াছে।”
“কিছু মনে করিবেন না। বিবাহ হইয়া গেলে আর এত সাবধানতার প্রয়োজন হইবে না,” বলিয়া বর্জরজী আবার হরমসজীর চক্ষু বাঁধিয়া দিল। আবার সেইরূপ হাত ধরিয়া তাঁহাকে লইয়া চলিল।
কিছুদূর আসিয়া সহসা বর্জরজী বলিল, “এখন যান।” এই বলিয়া অন্তর্হিত হইল। হরমসজী চক্ষু হইতে রুমাল খুলিয়া সত্বর পদে গৃহাভিমুখে ধাবিত হইলেন।
চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – অদ্ভুত বিবাহ
পরদিবস সন্ধ্যার প্রাক্কালে হরমসজীর বাড়ী হইতে নিঃশব্দে ছয়জন বাহির হইলেন। তিনজন পুরুষ, তিনটি স্ত্রীলোক।
প্রথমে যিনি বাড়ী হইতে বাহির হইলেন, তিনি হরমসজী। অদ্য হরমসজী বিশেষ যত্নসহকারে বেশভূষা করিয়াছেন।
তাঁহার পশ্চাতে আসিলেন, একটি বৃদ্ধ পার্শী পুরোহিত। তাঁহার দুগ্ধফেণনিভ লম্বমান পোষাকে তাঁহাকে বড়ই ভাল দেখাইতেছিল। তাঁহার পশ্চাতে ব্যাঙ্কের বৃদ্ধ কেরাণী মারোয়ানজী চলিলেন।
তাঁহাদের পশ্চাতে আসিবেন কমলাবাঈ, রাজাবাঈ ও রতনবাঈ। কমলা আজ অলঙ্কারে সর্ব্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করিয়াছে। অতি সুন্দর রেশমী শাড়ীতে তাহার সৌন্দর্য্য শতগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। রাস্তার লোকে বিমুগ্ধভাবে তাহার দিকে চাহিতে লাগিল। রাজাবাঈ ও রতনবাঈ উভয়েই বড় বিমর্ষ। অবগুণ্ঠনে বদনাবৃত করিয়া ধীরপদে চলিতেছিলেন। তাঁহাদের মুখ কেহই দেখিতে পাইতেছিল না।
এইরূপে ধীরে ধীরে পদব্রজে তাঁহারা সকলে মজাগণের মোড় পর্যন্ত আসিলেন। এলফিনষ্টোন সার্কেল হইতে মোজাগণ বড় নিকটে নহে। তাঁহাদের তথায় পৌঁছিতে প্রায় আট্টা রাত্রি হইল।
তাঁহারা তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, গাছের ছায়ার অন্ধকারে সত্যসত্যই দুইখানি গাড়ী অপেক্ষা করিতেছে। গাড়ীর উপর কোচম্যানদ্বয় বসিয়া ঝিমাইতেছে।
তাঁহারা গাড়ীর নিকটস্থ হইলে কোচম্যানদ্বয় উঠিয়া বসিল। কোন কথা কহিল না। হরমসজী কন্যাকে লইয়া একখানি গাড়ীতে উঠিলেন। রাজাবাঈ ও পুরোহিত মহাশয়ও সেই গাড়ীতে উঠিলেন। অপর গাড়ীতে রতনবাঈ ও কেরাণী চলিলেন
গাড়ী প্রায় একঘণ্টা চলিল। তাঁহারা দেখিলেন, গাড়ী পারেল ছাড়াইয়া আরও বহুদুর চলিল। প্রায় দশটার সময় গাড়ী দুইখানি একটা ভাঙ্গা প্রাচীর-বেষ্টিত অরক্ষিত বাগানের ভিতর প্রবিষ্ট হইল।
এই বাগানের ভিতর কিয়দ্দূর গিয়া গাড়ী দুইখানা একটা ভাঙ্গা বাড়ীর সম্মুখে দাঁড়াইল। কোচম্যানদ্বয় লম্ফ দিয়া কোবাক্স হইতে নামিল। সত্বর ঘোড়া খুলিয়া একটা গাছে বাঁধিল। তৎপরে একজন দ্বার খুলিতে গেল। অপর কোচম্যান একটা বাতি জ্বালিয়া গাড়ীর নিকট আসিয়া সকলকে নামিতে ইঙ্গিত করিল।
তাঁহারা সকলে গাড়ী হইতে নামিলেন। কোচম্যানদ্বয় অগ্রে অগ্রে চলিল। অপর সকলে নীরবে সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন।
বাড়ীটিতে বহুকাল কেহ বাস করে নাই—সমস্ত ঘরই ধুলিপূর্ণ। এরূপ স্থানে এরূপ বিবাহ বোধ হয়, আর কাহারও হয় নাই।
তাঁহারা সকলে গৃহে প্রবিষ্ট হইলে কোচম্যান দুইজন অতি সাবধানে দ্বার রুদ্ধ করিয়া ভিতর হইতে দ্বারে তালা লাগাইল। পরে তাহাদের সকলকে সঙ্গে আসিতে ইঙ্গিত করিল। একজন আলো ধরিয়া আগে আগে চলিল।
তাঁহারা আর একটি প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন। একজন কোচম্যান এ গৃহের দ্বারও পূর্বরূপ চাবি বন্ধ করিল। তখন হরমসজী বলিলেন, “তোমরা এরূপ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিতেছ কেন? বর্জরজী কোথায়? সে না আসিলে আমরা আর একপদও অগ্রসর হইব না।”
তখন একজন কোচম্যান মুখ হইতে মুখোস্ খুলিয়া ফেলিয়া হাসিতে হাসিতে বলিল, “শ্বশুর মহাশয়, কিছু মনে করিবেন না। চারিদিকে শত্রু বলিয়াই এত সতর্ক হইতে হইয়াছে। কমলাকে আমি বিবাহ করিতেছি বলিয়াই আমার এত শত্রু। রস্তমজী আমার পরম শত্রু, কীর্ত্তিকরকে হাত করিয়াছে; তাহাই এত সাবধানে চলিতেছি। আজ বিবাহ হইয়া যাক, কাল আপনার বাড়ীতে খুব ধূমধাম করা যাইবে।”
হরমসজী বলিলেন, “যথার্থই এঁরা ভয় পাইতেছিলেন।”
বর্জরজী বলিল, “শাশুড়ী ঠাকুরাণী নিশ্চয়ই আমাকে ক্ষমা করিবেন। কমলাও ক্ষমা করিবে।”
হরমসজী বলিলেন, “তা হইলে আর বিলম্ব করা উচিত নয়। একে?”
বর্জরজী বলিল, “মাঞ্চারজী। সাক্ষী হইবে বলিয়া আনিয়াছি।”
হরমসজী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় বিবাহ হইবে?”
বর্জরজী বলিল, “আসুন, এটা পোড়োবাড়ী—এখানে কোন বেটা সন্ধান পাইবে না বলিয়া এই বাড়ীটাই স্থির করিয়াছি। আসুন, একটা ঘরও পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছি।”
হরমসজী বলিলেন, “একটু আলোর বন্দোবস্ত করা উচিত ছিল।”
বর্জরজী বলিল, “বেশী আলো করা উচিত বিবেচনা করি নাই। সকলে জানে এ বাড়ীতে কেহ বাস করে না। বেশী আলো হইলে আলো বাহিরের লোকে দেখিতে পাইতে পারে।”
সত্যই একটি বাতির আলোয় কেহ কাহারও মুখ স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছিলেন না। হরমসজী বলিলেন, “চল।”
“কিছু মনে করিবেন না। দরজাগুলা ভাল করে বন্ধ করে যাওয়া প্রয়োজন। সাবধানের বিনাশ নাই।” বলিয়া বর্জরজী দ্বার বন্ধ করিতে লাগিল। মাঞ্চারজী আলো ধরিয়া চলিল।
এইরূপে পাঁচ-সাতটি ঘর উত্তীর্ণ হইয়া আসিয়া তাহারা একটি বৃহৎ হলে উপস্থিত হইলেন। তথায় একটা বিস্তৃত বিছানা করা রহিয়াছে। বিছানার পার্শ্বে বিবাহের প্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্যই সংগ্রহ আছে। একপার্শ্বে কাগজ কলম দোয়াতও রক্ষিত হইয়াছে।
সকলে গিয়া এই বিছানায় উপবিষ্ট হইলেন। কমলাবাঈ পিতার পার্শ্বে বসিল—তাহার পশ্চাতে অবগুন্ঠনাবৃত রাজাবাঈ ও রতনবাঈ বসিলেন। কমলার সম্মুখে বর্জরজী বরবেশ ধারণ করিয়া আসিয়া বসিল। তাহার পশ্চাতে মাঞ্চারজী ও বৃদ্ধ কেরাণী উপবিষ্ট হইল। পুরোহিত মহাশয় তাঁহাদিগের সম্মুখে উপবিষ্ট হইলেন। তাঁহার সম্মুখে একটি মাত্র বাতি জ্বলিতে লাগিল।
সে আলোতে বর-কন্যার মুখ ব্যতীত আর কাহারই মুখ স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল না। এইজন্য পুরোহিত মহাশয় আর একটা বাতি জ্বালিবার কথা বলিলেন। কিন্তু বর্জরজী তাহাতে আপত্তি করিয়া বলি, “কাল শ্বশুর মহাশয়ের বাড়ীতে যত বলিবেন—বাতি জ্বালিব। আজ ইহাতেই কাজ সারিয়া লউন।”
পুরোহিত বলিলেন, “আপনার যেরূপ অভিরুচি।”
বর্জরজী। পুরোহিত মহাশয় শীঘ্র শীঘ্র কাজটি সারিয়া ফেলুন।
পুরোহিত। যত শীঘ্র পারি, করিতেছি।
হরমসজী। এদিকে রাতও অনেক হইয়াছে।
পুরোহিত মহাশয় কমলাবাঈকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “মা, যাহা যাহা আমি বলি, তুমি তাহাই বলিয়া যাও।”
তাহার পর বিবাহ কার্য্য আরম্ভ হইল। বর্জরজী আনন্দে উৎফুল্ল—আনন্দে চারিদিক্ অন্ধকার দেখিতেছিল।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – পাপের ফল
বিবাহের মন্ত্রাদি পাঠ করিতে প্রায় আরও অর্দ্ধ ঘটিকা কাটিয়া গেল। পুরোহিত মন্ত্ৰ শেষ করিয়া হরমসজীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আমার কাজ শেষ হইয়াছে, এখন আপনাদের কার্য্য করুন।”
হরমসজী বলিলেন, “তবে এখন রেজেষ্টারি শেষ করা যাক্।”
বর্জরজী বলিল, “আর দেরী করার প্রয়োজন নাই।”
হরমসজী কালি কলম ও ছাপান ফারম লইয়া সম্মুখে সব বিস্তৃত করিলেন। তৎপরে বর্জরজীকে বলিলেন, “আগে তুমি সহি কর, পরে কমলা করিবে। তোমাদের সহি হইলে দুইজন সাক্ষী সহি করিবেন।”
বর্জরজী কাগজ টানিয়া লইয়া বিবাহের সার্টিফিকেটে সহি করিল। হরমসজী কাগজখানি লইয়া কন্যার সম্মুখে ধরিলেন। কমলা একটু ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। হরমসজী বলিলেন, ‘এইখানে সহি কর।” কমলা কম্পিত হস্তে সহি করিল।
তৎপরে হরমসজী, মাঞ্চারজী ও বৃদ্ধ কেরাণীকে বলিলেন, “এইবার আপনারা দুইজনে এইখানে সহি করুন।”
তাহারা দুইজনে কাগজ লইয়া সহি করিলেন। তখন হরমসজী কাগজখানি লইয়া আগাগোড়া পাঠ করিলেন। পরে অতি সাবধানে কাগজের নিম্নে আপনিও সহি করিলেন। পরে বলিলেন, “এখন সব কাজ শেষ হইল। এ সার্টিফিকেট আমার কন্যার কাছে থাক্?”
বর্জরজী বলিল, “না, ইহা আমার নিকটে থাকিবে।”
হরমসজী। কন্যার কাছে থাকাই নিয়ম।
বর্জরজী। ইহা কমলার নিকটেই থাকিবে। কাল আমি তাহাকে দিব।
“তুমি যদি আজ রাখিতে চাও রাখিতে পার,” বলিয়া হরমসঙ্গী সার্টিফিকেটখানি বর্জরজীর হাতে দিলেন। বর্জরজী সার্টিফিকেট লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। অতি যত্নসহকারে ইহা নিজ বস্ত্রাভ্যন্তরে রাখিয়া গৃহতলে সজোরে এক পদাঘাত করিয়া বলিল, “শালা, কীর্ত্তিকর এখন আমার কি করে—আমি দেখিতে চাই।”
পুরোহিত মহাশয়ও ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। তিনি এখন নিজের দক্ষিণ হস্তের জামার আস্তীনটা গুটাইয়া মণিবন্ধের ক্ষতস্থানটা বর্জরজীকে দেখাইলেন।
বর্জরজী দেখিয়া শিহরিয়া লাফাইয়া উঠিল, স্তম্ভিতভাবে পুরোহিতের মুখের দিকে চাহিল।
পুরোহিত বলিলেন, “বর্জরজী সাহেব, এখন আপনি বেশ বুঝিতে পারিতেছেন, শালা কীর্ত্তিকর নামে এখানে কেহ উপস্থিত নাই—বোনাই কীৰ্ত্তিকর মহাশয় সম্মুখেই উপস্থিত আছেন। বর্জরজী সাহেব, পেষ্টনজীর খুনের অপরাধে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করিলাম।”
“কি?” বলিয়া বর্জরজী লম্ফ-দিয়া দশ হাত দূরে গিয়া দাঁড়াইল। এবং বিস্ফারিত নয়নে আবার বৃদ্ধ পুরোহিতের দিকে চাহিল। তখন পুরোহিত মুখ হইতে দুগ্ধশ্বেত সুদীর্ঘ শ্মশ্রু অপসারিত করিয়া কীৰ্ত্তিকরে পরিণত হইয়াছেন।
বর্জরজী নিমেষ মধ্যে পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া তাঁহার মস্তক লক্ষ্য করিয়া আওয়াজ করিল।
লম্ফ দিয়া কীর্ত্তিকর সরিয়া দাঁড়াইলেন। বর্জরজী তখন আবার রিভলবার ছুড়িল—তৎপরে ফিরিয়া হরমসজীকে লক্ষ্য করিয়া ছুড়িল। ফাঁকা কার্ট্রিজ না হইলে কাহারই সে যাত্রা রক্ষা পাইবার উপায় ছিল না।
এই সকল কাৰ্য্য এক নিমেষের মধ্যে শেষ হইয়া গেল। সে রিভলবার বাহির করিবামাত্র রাজাবাঈ ও রতনবাঈ সবেগে তাহার উপর আসিয়া পড়িলেন।
বলা বাহুল্য, তাঁহাদের উভয়ের কেহই রাজাবাঈ বা রতনবাঈ নহেন। একজন স্বয়ং কমিশনার সাহেব-অপরে দাদাভাস্কর।
বর্জরজী সিংহবলে তাঁহাদিগকে ঝাড়া দিয়া ফেলিয়া উপর্যুপরি তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া চারিটি আওয়াজ করিল। তৎপরে সবলে দাদাভাস্করের মস্তক লক্ষ্য করিয়া পিস্তলটা নিক্ষেপ করিল। দাদাভাস্কর লম্ফ দিয়া সরিয়া না গেলে তাঁহার মস্তক বিচূর্ণ হইত।
তখন বর্জরজী ঊর্দ্ধশ্বাসে জানালার দিকে ছুটিল। কিন্তু বৃদ্ধ কেরাণীরূপী লালুভাই সুকৌশলে তাহার পায়ের ভিতরে নিজ পা এমনই ভাবে জড়াইয়া দিলেন যে, সে একেবারে ভূমিশায়ী হইল।
সাহেব, কীর্ত্তিকর, দাদাভাস্কর তিন জনে তাহাকে ধরিতে ছুটিলেন; কিন্তু তাঁহারা তাহার নিকটস্থ হইবার পূর্ব্বেই সে লম্ফ দিয়া উঠিল। বিদ্যুদ্বেগে কমলার দিকে ছুটিল। কমলা ভয় পাইয়া, ছুটিয়া ঘরের বাহির হইয়া বারান্দার দিকে গেল। বর্জরজীও ক্ষুধার্ত্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় সেইদিকে ধাবিত হইল। দাদাভাস্কর তাহার পথরোধ করিলে সে তাঁহাকে ভয়ানক বেগে এক ধাক্কা দিল।
তাঁহারা এই উন্মত্ত নর-রাক্ষসকে ধরিবার পূর্ব্বেই সে গিয়া কমলার উপর পড়িল। হরমসজী কন্যাকে রক্ষা করিতে গিয়া তিনিও তাহার উপর পড়িলেন। চীৎকার করিয়া বলিলেন, “আমার মেয়েকে মেরে ফেলে?”
তখন এক ভয়াবহ যুদ্ধ বাধিল। নরপ্রেত বর্জরজী বারান্দার রেলিং-এর উপর ফেলিয়া সবলে কমলার গলা টিপিয়া ধরিয়াছে—কমলার চক্ষুদ্বয় কপালে উঠিয়াছে। দাদাভাস্কর ও কীর্ত্তিকর বর্জরজীর হাত ধরিয়া সবলে টানিতেছেন, কিন্তু কিছুতেই কমলার গলা হইতে তাহার হাত ছাড়াইতে পারিতেছেন না। আর এখ মুহূর্ত্ত হইলে কমলার প্রাণ-বায়ু বহির্গত হয়।
এই সময়ে চারিদিক প্রকম্পিত করিয়া আর একবার পিস্তলের শব্দ হইল। কমিশনার সাহেব অনন্যোপায় দেখিয়া নিমেষমধ্যে পকেট হইতে পিস্তল বাহির করিয়া বর্জরজীর মস্তক লক্ষ্য করিয়া ছুড়িলেন। পিস্তলের গুলিতে তাহার মস্তক বিচূর্ণ হইয়া তাহার মস্তিষ্ক চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া গেল। কমলার মুখমণ্ডল বর্জরজীর মস্তিষ্কে আবরিত হইল। কমলা অবশদেহে ভূতলশায়ী হইল।
লালুভাই মুহূৰ্ত্তমধ্যে কমলাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন। সকলে কমলার শুশ্রূষায় নিযুক্ত হইলেন। তাহাকে অপর গৃহে লইয়া যাওয়া হইল। কমিশনার সাহেব পদাঘাতে বর্জরজীর মৃতদেহ দূরে নিক্ষেপ করিয়া বিছানা স্কন্ধে তুলিয়া লইলেন। কীর্ত্তিকর চিকিৎসা বিদ্যায় নিপুণ ছিলেন। তাঁহার যত্নে কমলাবাঈ শীঘ্রই নিশ্বাস ফেলিল, চক্ষুরুন্মীলন করিল, ব্যাকুলভাবে চারিদিকে চাহিতে লাগিল। হরমসজী আসিয়া কন্যাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইলেন।
কমলা একটু সুস্থ হইলে তাঁহারা সকলে তৎক্ষণাৎ তাহারে বাড়ীতে পাঠাইয়া দিলেন। হরমসজী কন্যার সহিত গেলেন। দাদাভাস্কর নিজেই গাড়ী হাঁকাইয়া চলিলেন।
তৎপরে আর সকলে যে গৃহে বর্জরজীর মৃতদেহ পড়িয়াছিল, তথায় আসিল। সাহেব বলিলেন, “এ লাস এখানেই এখন থাক। জন কতক পাহারাওয়ালাকে পাহারায় পাঠাইয়া দাও।”
লালুভাই। হুজুর, আমার মামলাটা একদম মাটি করিয়া দিলেন।
সাহেব। কি রকম?
লালুভাই। বিচারে বেটার ফাঁসী হইলে আমি প্রমোসন পাইতাম।
সাহেব। ঠিক বলিয়াছ, লালুভাই—বেটার ফাঁসী হওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু উপায় ছিল না—আর এক মিনিট হইলে কমলাবাঈকে খুন করিত।
কীর্ত্তিকর। আমরা দুইজনে প্রাণপণে উহার হাত টানিয়া না থাকিলে কিছুতেই কমলাবাঈ বাঁচিত না।
লালুভাই। আমার কেস ত গেল!
সাহেব বলিলেন, “ভয় নাই। যাহাতে প্রমোসন নষ্ট না হয়, সেজন্য আমি গভর্নমেন্টকে বিশেষ করিয়া লিখিব।”
কীর্ত্তিকর বলিলেন, “মাঞ্চারজী কই?”
মাঞ্চারজী তথায় ছিল না। যখন সকলে কমলাবাঈকে লইয়া ব্যস্ত ছিলেন, সে সেই অবসরে জানালা দিয়া পলাইয়াছিল।
উপসংহার
পরদিন বোম্বে সহরের সকলে শুনিল যে, পেষ্টনজীর খুনী এতদিন পরে ধরা পড়িয়াছে। কিন্তু পুলিস তাহাকে ঘেরাও করায় সে গুলি চালাইতে আরম্ভ করিয়াছিল, সেজন্য পুলিস নিরুপায় হইয়া তাহাকে গুলি করিয়া মারিতে বাধ্য হইয়াছে। স্বয়ং কমিশনার সাহেব তাহাকে গুলি করিয়াছিলেন।
লালুভাই ও দাদাভাস্কর, ডিটেটিভ ইনস্পেক্টরদ্বয় বিশেষ দক্ষতার সহিত বিশেষ যত্নে ও পরিশ্রমে সেই নরাধমকে ধরিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, এইজন্য গভর্ণমেন্ট তাঁহাদের প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া উভয়কেই প্রোমোসন দিয়াছেন।
হরমসজী ও রাজাবাঈ-এর পূর্ব্বকথা কিছুই প্রকাশ পাইল না। তাঁহারা চিরকাল ইহার জন্য কীর্ত্তিকরের নিকট কৃতজ্ঞ রহিলেন।
মাঞ্চারজীর আর কেহ সন্ধান লইলেন না। সে মাতার সহিত দেখা না করিয়াই বোম্বে হইতে পলাইয়াছিল। সেই অবধি তাহার আর কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই।
হরমসজী কিছু টাকা দিয়া মাঞ্চারজীর মাকে আবার কলিকাতায় পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। সেই অবধি বুড়ীর আর কোন সংবাদ নাই।
আবার হরমসঙ্গীর সুখের সংসারে পূর্ব্বসুখ দেখা দিল। বোধ হয়, এখন এই সকল দুঃখ-কষ্টের পর তাঁহারা আরও অধিকতর সুখী হইলেন।
বলিতে হইবে কি যে রস্তমজীর সহিত কমলাবাঈ-এর বিবাহ হইল? এখন হরমসজীর ব্যাঙ্কের নাম হইয়াছে, “হরমসজী ও রস্তমজী”। আজ রস্তমজী, হরমসজীর ব্যাঙ্কের অর্দ্ধেক অংশীদার হইয়াছেন।”
আর দুঃখিনী রতন—কমলা তাহাকে কিছুতেই অন্যত্র যাইতে দিল না। রতন কমলার পুত্রকন্যাদিগকে লালনপালন করিয়া পরম সুখ উপলব্ধি করিত। তাহারা তাহাকেই মা বলিয়া ডাকিত।
হরমসজী তাঁহার সম্পত্তির ঠিক অর্দ্ধেক রতনকে দিয়াছিলেন। রতন সেই সমস্ত টাকায় অনাথা বালিকাদিগের জন্য একটি অনাথ আশ্রম স্থাপনা করিয়াছে।
***