পঞ্চম খণ্ড – গোলকধাঁধা

পঞ্চম খণ্ড – গোলকধাঁধা

“Here Sita stands, my daughter gair,
The duties of thy life to share;
Take from her father, take thy bride,
Join hand to hand, and bliss betide.
A faithful wife, most blest is she,
and so thy shade will fall owe thee.”

Grifeith Ramayann

প্রথম পরিচ্ছেদ

সঞ্জীববাবু টুনুয়াকে সঙ্গে লইয়া রামকুমারবাবুর উদ্যানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। টুনুয়াকে উদ্যানস্থ এক বৃক্ষমূলে বাঁধিয়া পূৰ্ব্বদিকে চলিলেন।

তখন বেলা হইয়াছে—চারিদিকে রৌদ্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে। বর্ষাবারিবিধৌতবৃক্ষপত্রসমূহ বালভানুর কোমল কিরণে বিভাসিত হইয়া মনোহর শোভার সৃজন করিয়াছে। উদ্যানস্থ পুষ্করিণীর কাচ-স্বচ্ছ বারিরাশির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঊর্ম্মিগুলিকে কে যেন হীরকখচিত করিয়াছে।

চৌধুরী মহাশয়ের উদ্যানস্থ পুষ্করিণীর জল নিৰ্ম্মল ও সুন্দর দেখিয়া গ্রামস্থ সকল সুন্দরীরা জল লইতে—গাত্র ধৌত করিতে—স্নান করিতে এই সরোবরে দুই বেলা দেখা দিত। এবং আপন আপন কার্য্যে এক ঘণ্টার স্থলে দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় করিয়া চলিয়া যাইত। আজও কোন প্ৰমদা— হাঁটু অবধি জলে নামিয়া—মস্তকে বৃহদবগুণ্ঠন টানিয়া চাউল ধৌত করিতেছে; তাহার একগুচ্ছ ঘনকৃষ্ণকেশ—অবগুণ্ঠনের মধ্য দিয়া জলে নামিয়া-ষোড়শীর জলমগ্ন কোমল, নধর হস্তের সহিত নাচিয়া নাচিয়া ক্রীড়া করিতেছে। সুন্দরী তাহাতে ঈষদ্বিরক্ত হইয়া, সেই অনাবিষ্টজলার্ড কেশগুলিকে অংশদেশে চাপিবার নিমিত্ত এক একবার মস্তক এক পার্শ্ববর্ত্তী করিয়া স্কন্ধের উপর চাপিতেছে। অবাধ্য কেশরাশি শুনিল না—সেইরূপ জলে লুটিতে লাগিল। বর্দ্ধিতরোষা সুন্দরী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, “আজ অপরাহ্নে মজা দেখাইব—চুল বাঁধিবার সময় তোমাদের আষ্টে পিষ্টে বাঁধিব—দেখিব কেমন করে আর দুষ্টামি কর।”

কোন সৌন্দর্য্যদর্পিতা ললনা বেশী জলে যাইয়া নিজ গৌরবর্ণ সুরূপ, প্রভাযুক্ত শরীরটিকে জলমধ্যে মগ্ন করিতেছে; আবার তখনি তাহা কটি অবধি উঠাইয়া উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিতেছে। কখন বা অল্পক্ষণ স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া জলস্থির হইলে, তাহাতে নিজের সুন্দর মুখের—সুটানা রাজীবচক্ষুদ্বয়ের নধর, বিম্বফলতুল্য অধরের—গাঙ্গচিলের নাসিকাবৎ নাসিকার—ঘনকৃষ্ণ কর্ণমূল- অবধিবিস্তৃত সর্পলাঙ্গুলাকার ধনুবৎ ভ্রূযুগলের— মাংসল, রেখান্বিত চিবুকের ও ঈষদ্রক্তিম, গোলাপাভকপোল যুগলের—প্রতিবিম্ব দেখিয়া আপনমনে মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিতেছে।

কোন বালা কলসী ধরিয়া–পদসঞ্চালনে জল আন্দোলিত করিয়া সন্তরণ করিতেছে।

কোন তন্বী অপনমনে গাত্র মার্জ্জন করিতেছে। গৌরবর্ণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বারম্বার গাত্রমার্জ্জনী- পাড়নে লোহিতবর্ণ হইল, ছাড়ান নাই।

কোন সূক্ষ্মবসনা নিতম্বিনী, জল হইতে উঠিয়াই দেখিল, পরিহিত বসনখানি গাত্রের সঙ্গে এককালে মিলাইয়া গিয়াছে। নিতম্বযুগলে যে বসনাংশ মিশিয়াছে—সুন্দরী তাহা স্বহস্তে কুঞ্চিত করিতে করিতে চলিল। তাহার পশ্চাদ্ধাবিতা পূর্ণকলসিকক্ষেধারিণী কোন সুরসিকা—নিজ কলসীর জল ব্যয় করিয়া; তাহার কৃত কুঞ্চিত বসনাংশে জল বিক্ষেপ করিতে করিতে চলিল। তাহাতে কুঞ্চিতাংশ বসন আবার পূর্ব্ববৎ নিতম্বে মিলাইলা যাইতে লাগিল। পূৰ্ব্বগামিণি কিছু বিরক্ত হইয়া অথচ হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘কি করিস্ ভাই—বাগান পার হ’লেই রাস্তায় পড়তে হবে।’ সে সুরসিকা নাছোড়বান্দা, মানা মানিল না। যখন বাড়ীতে আসিল; দেখে প্রায় অৰ্দ্ধকলসী-জল রসিকতায় ব্যয় হইয়াছে। ননদিনীর নিকটে যথেষ্ট তিরস্কৃতা হইল। রসিকা বলিল, ‘ঘাটে—সিঁড়ি নাম্বার সময়—পা পিছলে পড়ে গেছলেম; কাঁকে বড় লেগেছে—ভরা এক কলসী জল কোনমতে আনতে পারলেম না। ওই যে করে এনেছি তা আমিই জানি আর মা কালী জানে; অন্য কারুর সাধ্য নয়।’

ননদিনী মুখরা হইলেও তাহাকে বড় ভালবাসিত। সে পড়িয়া গিয়াছে শুনিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিতে লাগিল, “বেশী লাগেনি ত বউ? নাই বা জল আনতে; কষ্ট করে আবার কি দরকার ছিল? যে জল তোলা আছে, তাতে কি আজ আর হতো না?” বউ বলিল, ‘একবারে শূন্য কলসী বাড়ী ফিরিয়ে আনবো, যতটুকু পেরেছি কষ্টে সৃষ্টে এনেছি, ননদিনী বৌ-এর কষ্টসহিষ্ণুতা দেখিয়া আরও দুঃখিতা হইয়া বলিল, ‘আজ আর তুমি উঠ না, বেশ করে, যেখানটায় দরদ লেগেছে—চুণে হলুদে প্রলেপ করে দাও, ব্যথা হবে না— সেরে যাবে। সাবধান হয়ে নামতে হয় তা তোমারি দোষ বা কি! যে বুড়ো কলসী-আমিই একদিন পড়তে পড়তে রয়ে গেছলেম।’ ননদিনী রন্ধন ফেলিয়া অগ্রে চুণে হলুদের প্রলেপ করিতে বসিল। এ কথা বাঙ্গালা ও ইংরাজী সংবাদপত্রে প্রকাশ হইয়াছিল কিনা তাহা আমার অজ্ঞাত।

পরিমল গ্রামস্থ যুবতীদিগের সঙ্গে কটী অবধি জলে ডুবাইয়া গাত্র ধৌত করিতেছিল। সকলে তাহার মনরক্ষা করিবার জন্য তাহার রূপের অনেক সুখ্যাতি করিতেছিল। কেহ বলিতেছিল— পরিমল যেন যথার্থ পরি।” কেহ—”মানুষের এত রূপ হয় না।” কেহ—”গায়ের রং দেখছ— যেন দুধে আলতা।” কেহ—”মুখখানি পদ্মের মতন।” কেহ—”তার উপরে চোখ দুটো যেন কালো ভ্রমরের মতন।” কেহ—”নাকটী কেমন টিকল।” কেহ—”গাল-দুটী কেমন নিটোল।” কেহ —”ভ্রূ দুটী কেমন যোড়া।” কেহ—”কানদুটী কেমন ছোট ছোট।” কেহ—”ঠোঁট দুটী কেমন লাল টুকটুকে—আমরা দশটা পান খেলেও এমন হয় না।” কেহ—”গড়নটী কেমন বেঁটে বেঁটে।” কেহ–”হাত দুটী কেমন ছোট ছোট গোলগাল।” কেহ—”কোমরটী কেমন সরু।” কেহ “গড়ন্তী লতাগাছটির মত।” পরিমল আর কত শুনিবে—তারাই বা আর কত বলিবে, পাঠক আর কত পড়িবে, আমিই বা আর কত লিখিব?

পরিমল যখন গাত্রধৌত করিতেছিল, সঞ্জীববাবু তখন অন্তরাল হইতে নজর রাখিয়াছিলেন। গতরাত্রে পরিমল যে আত্মঘাতিনী হইতে জলে পড়িয়াছিল—সেই রহস্যদ্ভেদ করিবার জন্য দেখিতেছিলেন, পরিমল সাঁতার জানে কি না। যদি পরিমল সাঁতার জানে; তাহা হইলে তাহার পূর্ব্বরাত্রের আত্মঘাতিনী হইতে যাওয়া একটা ছল মাত্র। সঞ্জীববাবু অনেকক্ষণ ধরিয়া অপেক্ষা করিলেন—তাহাকে সন্তরণ করিতে, কি অধিক জলে নামিয়া গাত্রধৌত করিতে দেখিলেন না। কটী অবধি জলে নামিয়া সে আপন কার্য্য সমাপ্ত করিল। সঞ্জীববাবু ভাবিলেন, “যে এতদূর চতুরা—তার কি এ বিষয়ে আর সতর্কতা নাই—দেখা যাক্, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়।” ভাবিতে ভাবিতে সে স্থান ত্যাগ করিয়া তিনি রামকুমারবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – দারোগাদ্বয়

রামকুমারবাবু দুইজন অপরিচিত ব্যক্তির সহিত—বৈঠকখানায় বসিয়াছিলেন। সঞ্জীববাবু তথায় প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া রামকুমারবাবু তথায় আসীন অপর ব্যক্তিদ্বয়কে কহিলেন—

“এই মহাশয়–এই সেই লোক।”

অপরিচিত ব্যক্তিদ্বয়ের একজন উঠিয়া সঞ্জীববাবুর হস্ত ধারণ করিয়া বলিলেন, “তুমি আপাততঃ বন্দী।”

সঞ্জীববাবু কোন উদ্বেগের চিহ্ন দেখাইলেন না। সেই সময় কেবলমাত্র তাহার নয়নযুগল একবার জ্বলিয়া উঠিল মাত্র। কহিলেন, “কি দোষে?”

প্র। সে কথা তোমাকে জানিয়ে কোন ফল নাই।

স। তোমরা কি পুলিসকর্ম্মচারী?

দ্বি। হাঁ—শ্বশুরবাড়ী গিয়ে উপস্থিত হলেই বুঝতে পারবে।

স। পূর্ব্বেই বুঝতে পেরেছি—আমার শ্বশুর মহাশয় তাহার পুত্রদ্বয়কে জামাইষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ করতে পাঠিয়েছেন। তা সেখানকার সব ত ভাল? কৰ্ত্তা মশাই ভাল আছেন? শ্বশুর-নন্দিনি ভাল আছে? তোমরা ভাল আছ? নিমন্ত্রণ পত্র টত্র আছে কি? তা না থাকলে বোধ হয় আমার যাওয়া ঘটিবে না।

সঞ্জীববাবুর তীব্র পরিহাসে তাহারা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল। দ্বিতীয় ব্যক্তি নিকটস্থ হাতকড়ি বাহির করিয়া বলিল, “এই নিমন্ত্রণ পত্র।”

সঞ্জীববাবু বলিলেন, “একবারে অত কড়া! কিছু মিঠে রকমের থাকে ত’ দেখ না।”

প্র। (সঙ্গীকে সম্বোধনে) হরিদাস! শীঘ্র হাতকড়ি লাগাও

স। হরিদাস কেন? তুমি লাগাবে এস না—মজাটা দেখাই। বলি ওয়ারেন্ট আছে কি?

প্র। (সত্বরে উঠিয়া নিজ নিকটস্থ হাতকড়ি বাহির করিয়া) “এই আমাদের ওয়ারেন্ট।”

বলিয়া সঞ্জীববাবুর হস্তদ্বয় ধারণ করিলেন।

“আর এই আমার” বলিয়া সঞ্জীববাবু হস্ত ছিনাইয়া লইয়া—কিছু পশ্চাতে হটিয়া—নিকটস্থ পিস্তল বাহির করিয়া দেখাইলেন।

অপরিচিত ব্যক্তিদ্বয় তাহাদিগের নিকটস্থ অস্ত্রাদি বাহির করিতে উদ্যোগ করিবামাত্র সঞ্জীববাবু কহিলেন, “হাত কি পা যদি একচুল নড়ে—তবে মাথার খুলি এখনিই উড়িয়ে দেব—চুপ করে বসে থাক।”

ভাবগতিক দেখিয়া রামকুমারবাবু ভীত হইয়া পুলিস কর্মচারীদ্বয়কে বলিলেন—”থামুন, মহাশয়েরা—আপনারা থামুন।”

তাহারাও ভাবগতিক মন্দ বুঝিয়াছিল—নতুবা দ্বিরুক্তি না করিয়া নিস্তব্ধ রহিবেন কেন? সঞ্জীববাবু জিজ্ঞাসিলেন, “রামকুমারবাবু এরা কে?”

রা। এরাও ভাল গোয়েন্দা।

স। গোয়েন্দার—”য়েন্দা” বাদ বোধ হয়।

প্র। সাবধান—গালাগালি দিও না।

স। গালাগালি কি আর দিতে পারি—তবে একটু তামাসা মাত্র, তা আপনারা এসেই যে সম্বন্ধ পাতিয়েছেন, তাতে তামাসা ত চাইই; সেই খাতিরে ধরে নেবেন। (রামকুমার প্রতি) এনাদের নাম কি, আপনি এদের নাম জানেন?

রা। জানি—এনার নাম হরিদাস—ওনার নাম শিবচন্দ্র।

স। কে বল্লে—এরা গোয়েন্দা? এদের দারোগাই বলে আমি জানি—তার বেশী আর কিছু হতেও পারে না। তবে শুনেছি ওরা লোকের কাছে—নিজেই নিজেকে গোয়েন্দা বলে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়। দু একটা সামান্য ঘটনায়—গোয়েন্দাগিরির বাহাদুরী দেখাবার জন্য কখন বাঁদর সাজে, কখন হনুমান সাজে—কখন ঘোড়া সাজে—কখন ছাগল সাজে। মোট কথা হাতী থেকে—নাগাইদ— ব্যাং—বিছে—ইন্দুর—ছুচো—মাকড়সা—আর্সলা—ছারপোকা উকুন অবধি সাজে—কিন্তু কাজে বাজে।

রা। সঞ্জীব, আমি তোমায় বরাবর মান্য করে আছি—কিন্তু তুমি যে এমন বিশ্বাসঘাতক— এমন দস্যু—এমন কুচক্রী তা আমি জান্তাম না।

স। মহাশয়, আমি বেশ বুঝতে পারছি—আপনার মস্তিষ্ক নানা চিন্তায় একবারে বিকৃত হয়ে পড়েছে। ভাল, এখন আমার অনেক কথা আছে—আগে মনোযোগ দিয়ে শুনুন; তারপর যদি আপনি আমাকে বন্দী হতে বলেন—আমি আপনার নিকট শপথ করে বলছি, আমি আপনার দারোগা দুজনের নিকট—আত্মসমর্পণ করবো।

রা। বল—এখনি বল।

স। তবে শুনুন—কিন্তু ইতিমধ্যে যদি আপনার নিয়োজিত ব্যক্তিগণ কোন অভদ্রতা করে— তবে জানবেন—এখনি আপনার এ বৈঠকখানা—রক্তে লালে লাল হয়ে যাবে।

পিস্তল জামার পকেটে রাখিয়া দিলেন।

সেই সময়েই দেবিদাসবাবু সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন। রামকুমারবাবুর বদনমণ্ডল ঘৃণায়—বিদ্বেষে কেমন এক রকম হইয়া উঠিল; তিনি চিৎকার করিয়া সরোষে বলিলেন, “বেরও— দূর হও দস্যু; এখান থেকে—এখনি দূর হও – “

সঞ্জীববাবু বলিলেন, “এখন না, কিছু পরে। বসুন দেবিদাসবাবু—আমি যতক্ষণ এখানে আছি—আপনি নিৰ্ভয় থাকুন।” রামকুমারবাবুকে কহিলেন, “মহাশয়! আপনি কি অপরাধে আমাকে পুলিস হস্তে সমর্পণ করতে চান্? আমাকে খুলে বলুন।”

রা। আমি কোন বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি—যে দেবিদাস আমার কন্যার হত্যাকারী—তুমি দেবিদাসের ঘুস খেয়ে যাতে তার অপরাধ গোপন থাকে—প্রকাশ না পায়—কেবল তারই চেষ্টা করছো।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – নিরাশায় আশা

সঞ্জীববাবু তচ্ছ্রবণে অগ্রাহ্যের হাসি হাসিলেন। দেবিদাসবাবু রামকুমারবাবুর কথার উত্তর করিতে যাইতেছিলেন, সঞ্জীববাবু তাঁহাকে নিরস্ত করিয়া কহিলেন,–”রামকুমারবাবু আপনি এক্ষণে সকল কথা বল্লেন—সে সকলের কোন প্রমাণ আছে?”

রা। আছে। সম্পূর্ণরূপে প্রমাণ করতে পারি।

স। করুন।

রা। সময়ে সে প্রমাণ পাবে—এখন তুমি কি বলতে চাও বল?

স। চৌধুরী মহাশয়—আপনি আপনার বুদ্ধি সুদ্ধি একেবারে হারিয়ে বসেছেন দেখছি।

রা। আমার জ্ঞান বুদ্ধি হারাই তাতে তোমার ক্ষতি বৃদ্ধি কি—তুমি যে নির্দোষ তার প্রমাণ দেখাও দেখি।

স। (বিমলার ছিন্নপত্র অর্পণান্তর) এই দেখুন।

রামকুমারবাবু তাহা পাঠ করিবার পূর্ব্বে–পত্র হস্তগত হইবামাত্র সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, —“হা ঈশ্বর! এযে আমার সেই বিমলার হাতের লেখা—সে মরেছে, আমায় ছেড়ে গেছে।”

স। মহাশয়, এত অধীর হচ্ছেন কেন? আমি কি আপনাকে বলি নাই যে, আমি আপনার জীবিত কন্যার সন্ধানে ফিরছি? দেখুন—পত্রে কোন্ বারের নাম লেখা আছে।

রামকুমারবাবু আদ্যোপান্ত পত্রখানি দেখিয়া বলিলেন, “সঞ্জীববাবু, এ আপনি কোথায় পেলেন?”

স। আগে আপনি বলুন—কি প্রমাণে আপনি আমাকে আর এই সরলচিত্ত দেবিদাসকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন?

রা। আমি মূর্খ—ঘোর মূর্খ—কাণ্ডজ্ঞানহীন—আপনি আমায় ক্ষমা করুন; বলুন এ পত্র আপনি কোথায় পেলেন?

স। বলছি; আপাততঃ আপনার দারেগোবাবুদের এখান থেকে সরে যেতে বলুন—আমি অন্য লোকের কাছে সে সকল বলতে চাহি না।

রামকুমারবাবুর আদেশানুসারে হরিদাসবাবু ও শিবচন্দ্রবাবু স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।

সঞ্জীববাবু কহিলেন, “এদের আপনি কি প্রমাণে ডেকে এনেছিলেন, আমাকে তা আগে ভেঙে বলুন? এদের কোন যোগ্যতা নাই—কোন একটা কথা বোঝার আগেই—ঘৃণা জানিয়ে বাঁদরামি বলে বসে। আরে, যা বল্লি সেইটাই আগে সন্ধি বিচ্ছেদ করে—তলিয়ে বুঝে দেখ; “বাঁদ্রামি” শব্দটার ভিতর কোন মারপ্যাচ্ আছে কি না।”

রা। বিমলার মাতামহ মৃত্যুর পূর্ব্বে যে উইল করেছিলেন, যার কথা আপনাকে আমি পূৰ্ব্বে বলেছি—সেই উইলখানি চুরি গেছে।

স। কখন সে উইল চুরি হয়েছে?

রা। যে রাত্রে আমার শয়নগৃহে হত্যাকারীরা প্রবেশ করে। তাতেই আমার সন্দেহ হয় যে আপনিই সেই উইল হস্তগত করেছেন—আপনি সেই ষড়যন্ত্রে আছেন।”

স। আচ্ছা ভাল—এত গেল আমার কথা। তার পর–আপনি দেবিদাসকে কোন সূত্রে দোষী বলে মনে ঠিক দিয়েছেন?

রামকুমারবাবু নিজহস্ত দেবিদাসের অংসোপরে রাখিয়া কহিলেন, “দেবিদাস-আমি অন্যায় করেছি—তোমাকে মিথ্যা দোষে দোষী করে নিজেকেই পাতিত করেছি।”

দেবিদাস কহিলেন, “যদি আপনি মনে এরূপ ঠিক দিয়া থাকেন, যে আমার জীবনের অপেক্ষা মূল্যবান—আমি তার হন্তারক, আপনি তা হলে যথার্থই অন্যায় করেছেন।”

সঞ্জীববাবু কহিলেন, “যাক্ এখন ও সকল বাজে কথা ছেড়ে দাও। এ সকল যে সে লোকের খেলা নয়—এর ভিতর অনেক রহস্য আছে—অনেক ষড়যন্ত্র আছে। যে ষড়যন্ত্রে বিমলা অপহৃতা হয়েছে—দেবিদাসও সেই ষড়যন্ত্রের—লক্ষ্যস্থল; বিমলা যেমন দেবিদাসও তেমনি সেই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যস্থল। যত দিন না এ চক্রভেদ হচ্ছে, তত দিন এ সকল ভৌতিককাণ্ড, বলেই বোধ হবে।”

দে। মহাশয়, (রামকুমারবাবুর প্রতি) আমাকেও এতক্ষণ আপনি জীবিত দেখতে পেতেন না—কেবল আপনার নিয়োজিত কৌশলী গোয়েন্দা মহাশয় সঞ্জীববাবুর কৌশলে ও কৃপায় আমার প্রাণ রক্ষা হয়েছে।”

রামকুমারবাবু কহিলেন, “ওঃ! আমি কি নির্ব্বোধ—কি—অল্পবুদ্ধি। আমার মত মূর্খ জগতে কেউ নাই।”

স। (ঈষদ্বিরক্তিতে) এখন আত্মগ্লানি ছেড়ে দিন—বলুন কোন প্রমাণে আপনি দেবিদাসকে দোষী স্থির করছেন? বাজে কথায় ব্যয় করিবার সময়—এ নয়; আপনার একমাত্র কন্যা হত্যাকারীদিগের হস্তে রয়েছে—সে নিহত হবার পূর্ব্বে তাকে উদ্ধার করতে হবে—নচেৎ আমার সকল শ্রম পণ্ড হবে।

রা। দুই তিন দিন হইল, আমাকে একটী লোক এই কথা জানায়, যে দেবিদাস—আমার কন্যাকে হত্যা করবার জন্য গুণ্ডা নিযুক্ত করেছে।

স। কৈ এ কথা ত পূৰ্ব্বে আমাকে বলেন নাই—সে যে ষড়যন্ত্রীদের একজন হবে, কোন ভুল নাই। আপনি তার চেহারা কেমন ঠিক তা বর্ণনা করে আমাকে বলুন দেখি।

রামকুমারবাবু যে লোককে এইরূপ অভিযোগ করিতে দেখিয়াছিলেন—সেই লোকের আকৃতির পরিচয় দিলেন।

সঞ্জীববাবু তচ্ছ্রবণে কহিলেন, “আমি তাকে জানি; সে একজন দলের প্রধান।”

সঞ্জীববাবু তৎপরে তিনি কি কি করিয়াছিলেন—কেমন করিয়া বিমলার সেই ছিন্নপত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন—সকলই বলিলেন।

রামকুমারবাবু আত্মদোষ স্বীকার করিয়া ক্ষমা চাহিলেন; সঞ্জীববাবুকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়া বলিলেন, “মহাশয়! যদি আপনি আমার বিমলাকে, তার মৃত্যুর পূর্ব্বে উদ্ধার করে আনতে পারেন- আমি আপনাকে যথাযোগ্য পুরস্কার দিব।

সঞ্জীববাবু সে পুরস্কারে পুরস্কৃত হইবার আশা মনোমধ্যে চাপিয়া রাখিয়াছিলেন— রামকুমারবাবুর কথায় তাহা জাগিয়া উঠিল। পাঠক ও পাঠিকাগণ—বোধহয় সহজেই বুঝিয়াছেন সে পুরস্কার অর্থের নহে।

সঞ্জীববাবু তথা হইতে উঠিয়া উদ্যানে—আবদ্ধ গুণ্ডা টুনুয়ার নিকট গমন করিলেন। উভয়ের অনেক প্রশ্নোত্তর হইল—সে সকল লিখিয়া পুস্তক বাড়াইতে চাহি না।

সঞ্জীববাবু তাহার মুখ হইতে কোন কথা বাহির করিতে পারিলেন না—কারণ বোধ হয় সে সত্য সত্যই অন্য কোন বিষয় অবগত ছিল না। অর্থ প্রাপ্তে আদেশানুসারে সে—ও তাহার সঙ্গিগণ এই কার্য্যে প্রবৃত্ত—ষড়যন্ত্রকারীদিগের গুপ্ত সংবাদ কেহই জানে না।

সঞ্জীববাবু টুনুয়াকে রামকুমারবাবুর জিম্মায় রখিয়া নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – পাশব অত্যাচার

“কতদিন আর আশার মুখ চেয়ে থাকবো?”

“আমার আশা তুমি ত্যাগ কর।”

“তোমার ‘আশা ত্যাগ’? এ জীবনে হবে না। যতদিন জীবিত~থাকবো, ততদিন পারবো না। কি চক্ষে—কি ক্ষণে তোমায় দেখেছি তা আমি জানি না। আমি এ পর্যন্ত অনেক রমণী দেখেছি, কিন্তু—এমন রূপ ত কারও দেখি নাই—এমন মিষ্ট কথা ত কারও শুনি নাই।”

“আমাকে এমন করে বিরক্ত কর যদি—তুমি আপনার বিপদ আপনি ডাকিবে। আমি তোমাকে পূর্ব্ব হতে স্পষ্ট বলে সাবধান করে দিচ্ছি।”

“যদি তোমাকে পাব না, তবে কেন তুমি দেখা দিয়েছিলে? কেন তবে তুমি আমার নয়ন- পথের পথিক হয়েছিলে? আমার প্রাণ তোমার রূপে ডুবে আছে—আমি আত্মহারা—আমি আজীবন শুধু তোমার সেবা করবো—তুমি যা বলবে তাই শুনবো। আমায় তুমি ঘৃণা করো না; যদি পাপী বলে ঘৃণা কর—আর কোন পাপকাজের দিকে যাব না; যদি দরিদ্র বলে ঘৃণা কর—সে ঘৃণা ত থাকবে না, আজ বাদে কাল আমি অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হব।”

“তোমার ঐশ্বর্য্য নিয়ে তুমি সুখে থেক—ও ঐশ্বর্য্যে আমার ঘৃণা হয়।”

“যত তোমায় দেখি—ততই পিপাসা বাড়ে। এখন আমার প্রাণের ভিতর কি করছে—তুমি কি করে জানবে? কি করে আমি প্রাণের আগুন চেপে রেখেছি—তা তোমাকে কি করে বুঝাব? ইচ্ছা হয় তোমাতে মিশে যাই—তুমি স্বর্গ—তোমাতে স্বর্গ সুখ আছে। একবার বুকে এস—আমি তোমার উপর বল প্রয়োগ করতে চাই না—সে নৃশংসতা আমার নাই।

“সে ক্ষমতাটুকু থাকলে কি তুমি আর বলপ্রয়োগ করে তোমার অভীষ্ট-সিদ্ধি করতে ত্রুটী করতে—এখন যে তুমি আমার হাতে।”

“তা যাই হোক—তাতে সুখও নাই। তোমার কাছে আমি তোমার কৃপাভিক্ষা করছি—আমার মনের আগুন নিভাও। এখন আমি নেশা করেছি—একটু মদ খেয়েছি—নিতান্ত একটু নয় দস্তুরমত খেয়েছি—কিন্তু তোমায় দেখে সে নেশা চাপা পড়ে গেছে। আমি বেশ প্রকৃতিস্থ আছি; কিন্তু যত তোমায় দেখছি—যত তোমার ঐ চোখ দুটীর চঞ্চল দৃষ্টি দেখছি—ততই অধীর হয়ে পড়ছি। পূৰ্ব্বে ও এমন অনেক দিন হয়েছিল—কিন্তু মনকে দমন করে চেপে গেছলেম; কিন্তু আজ আর মন কিছুতেই মানা মান্‌ছে না, দমন করতে পারছি না। একবার বুকে এস—একদিন আমার কথা রাখ— এক দিনের জন্য আমার এতদিনের আশা পূরাও।”

“এক দিনে যে সর্বনাশ—পাঁচ দিনে তাই—তুমি আমার—”

“(বাধা দিয়া) তুমি অবিবাহিতা—অথচ যৌবনে তোমার শরীর ভেঙ্গে পড়ছে—তোমার সতীত্বনাশের ভয় কিসে আছে? তুমি আমার বিবাহিতা পত্নী হবে—তবে এর জন্য এত অগ্রপশ্চাৎ কেন?”

“যখন তা হব—তখন তোমার জিনিস হব—তোমার যা ইচ্ছা করতে পারবে। এখন তুমি আমার কে? আমি তোমারই বা কে?

“তবে—না কি তুমি আমায় ঘৃণা কর? তবে না কি তুমি আমায় ভালবাস না? তবে নাকি তুমি আমার নও? তুমি আমার এত দিন কেবল মনের কতদূর দৃঢ়তা দেখে আসছো। আমার মনে দৃঢ়তা কিছুই নাই—তোমার আজ্ঞা না লঙ্ঘন করায় যা ঘটেছে। কিন্তু—আজ আর না—এস, তোমার ও কুসুমপ্রার হৃদয়টুকু আর চেপে রেখ না—আজ থেকে আমাকে খুলে দাও—আমি তথায় প্রবেশ করি—দেখি মধ্যে কত মধু আছে।” এই বলিয়া প্রত্যুত্তরকারিণীকে দুই হস্তে—বেষ্টন করিয়া—ধরিয়া—মুখ চুম্বন করিতে লাগিল। বাহুবেষ্টিতা তরুণী নিজেকে মুক্ত করিতে প্রয়াস পাইতে লাগিল, চিৎকার করিয়া উঠিল, কিন্তু মদ্যপ যুবক—চেতনাহীনের ন্যায়—কিছু মানিল না— নিজ অভিপ্রায় সিদ্ধির জন্য পশুবলপ্রকাশ করিতে লাগিল।

বিপদান্বিতা—বর্দ্ধিতরোষা তরুণী কোন উপায় না দেখিয়া—তাহার—মণিবন্ধে সজোরে দংশন করিল। যুবক চিৎকার করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিল। “রাক্ষসী—ডাকিনি” বলিয়া কটূক্তি করিল। তরুণীও তাহাকে যথোচিত তিরস্কার করিল; বলিল, “তুমি আমাকে আজ থেকে তোমার ঘোর শত্রু বলে জান্‌বে—তুমি যেকালে তোমার প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করলে—আমি কেন করবো না, দেখি তুমি কেমন করে নিস্তার পাও।”

যুবকের মুখে—ক্রোধের পরিবর্তে ভয়ের চিহ্ন প্রকটিত হইল। বলিল—”না—তা হলে আমি একবারে মারা যাব—আমি তোমার পায়ে পড়ি।”

“তুমি কি বলেছিলে ভুলে গেছ? মা চণ্ডীদেবীর পা ছুঁয়ে কি বলেছিলে মনে করে দেখ দেখি—তুমি কখন আমায় প্রতি বল-প্রয়োগ, কি, কোন প্রকার কু কথায় বিরক্ত করবে না। আর আমিও প্রতিজ্ঞা করছিলেম—যে তুমি এই ষড়যন্ত্রের যা যা আমায় করতে বলবে তা আমি করবো। তোমার গুপ্তকথা গুপ্ত রাখবো; কিন্তু তুমি সে প্রতিজ্ঞা আজ ভঙ্গ করেছ—আমারও তাই জানবে। তোমার প্রতিজ্ঞার অস্তিত্বে আমার প্রতিজ্ঞা—তাতে আমার কোন পাপ হবে না।”

রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে—বৃক্ষ সমূহের পত্রাবলী প্রচণ্ড রৌদ্রে ঝলসিত-প্রায়। কোন দিকে চাওয়া যায় না। রৌদ্রতপ্ত-বায়ু ইতস্ততঃ প্রধাবিত হইতেছে। নীরবে পাখীরা ঝোপে ম্রিয়মান হইয়া বসিয়া আছে। উত্তপ্ত মরুত্তাড়নে দুই একবার পাখা নাড়িয়া সরিয়া বসিতেছে। কোথা হইতে দুই একটা কোকিল—”কুহু”

“কুহু” করিয়া ডাকিয়া—নিজের বেদনা বুঝাইয়া প্রকৃতিবক্ষে—কাঠিন্যে কোমলতা সৃজন করিতেছে। যদি বা দুই একবার দুই একখানা তরল শ্বেতমেঘ ভাসিতে ভাসিতে আসিয়া—সূর্য্যবক্ষে পড়িয়া—রৌদ্রের প্রদীপ্তি ন্যূন করিতে প্রয়াস পাইতেছে—কিন্তু দুর্বৃত্তবায়ু তাহাদিগকে সরাইয়া দিতেছে। সূর্য্যদেব পূৰ্ব্বাপেক্ষা দ্বিগুণতেজে দেখা দিয়া জগত দগ্ধ করিবার জন্য যেন উদ্যত হইতেছেন।

এমন সময় চণ্ডীতলার সেই ভাঙ্গা বাড়ীতে একটা নিভৃত কক্ষ মধ্যে উক্ত যুবক যুবতীর প্রাগুক্ত কথোপকথন হইতেছিল। যুবক—পাঠক পাঠিকা পরিচিত মহীন্দ্রনাথ। যুবতীকেও আপনারা বার কয়েক দেখিয়াছেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – যমজ ভগ্নী

সন্ধ্যা হইতে অধিক বিলম্ব নাই। অস্তগতপ্রায় আরক্ত রবির অর্দ্ধাংশ মাত্র পশ্চিম গগণের দৃষ্টিসীমার যবনিকা-প্রান্তে দৃষ্টিগোচর হইতেছে। থরে থরে জলদপর্বতগুলি অস্তগমনোন্মুখ রবির হেমাভরশ্মিমালা বুকে ধরিয়া আকাশের ধারে ধারে নিরবে দণ্ডায়মান। বিহগকুল শব্দতরঙ্গে- সান্ধ্যগগন প্রতিধ্বনিত করিয়া স্বীয় স্বীয় নীড়াভিমুখে ধাবমান হইতেছে। পাদপশ্রেণীর শীর্ষস্থিত নব পত্রাবলী রবির হিরন্ময়ীকিরণে প্রতিফলিত হইয়া—স্বর্ণপত্রবৎ শোভা ধারণ করিয়াছে। সেই মনোহর দৃশ্য দর্শনে সমীরণ ক্ষণেক স্থির হইয়া দেখিতেছে; কখন বা সেই পত্রাবলীর প্রশাখা লইয়া ধীরে ধীরে আন্দোলন করিতেছে। সন্ধ্যা আসন্ন দেখিয়া — প্রসন্নমুখে রূপসম্পন্ন কুলললনারা কেহ কলসীকক্ষে,–কেহ—গাত্রমার্জ্জনী হস্তে—কেহ—বাসন্তী রঙ্গের বসনাবগুণ্ঠনে—বাসন্তী সৌন্দৰ্যপূৰ্ণ চন্দ্ৰমুখখানি ঢাকিয়া—কোন যৌবনাবেশে প্রফুল্ল হৃদয়া নবোঢ়া তাম্বুলরাগে বিম্বাধর রঞ্জিত করিয়া, —মধুরে মধুর বিভাবিকাশ করিয়া সরোবর পানে চলিয়াছে।

সঞ্জীববাবু আপন প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদি সঙ্গে লইয়া বিমলার সন্ধানোদ্দেশে বহির্গত হইলেন। সেই সময় একবার উদ্যানে পরিমলের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল।

সজীববাবু জিজ্ঞাসিলেন; “এখানে দাঁড়িয়ে যে পরিমল?”

পরিমল উত্তর করিল, “আপনার সঙ্গে দেখা করবো বলে।”

“কোন কথা আছে নাকি?”

“হাঁ। যে রমণীর কথা কাল আপনি আমায় বলেছিলেন—যাকে দেখে আমায় সন্দেহ করেছিলেন—যার চেহারা ঠিক আমার মত—”

(বাধা দিয়া) “হাঁ। কি হয়েছে তার?”

“সেই কথা বলবো বলে—আপনার অপেক্ষা করছিলেম।” সঞ্জীববাবুর—হস্ত ধরিয়া মলিনমুখে বলিল, “সে আমার যমজ ভগ্নী।”

“তবে এ কথা আমাকে পূৰ্ব্বে বল নাই কেন?”

“আমি জানি সে মরে গেছে।”

“ভাল—মরে গেলে তার আর কথা কি; সে প্রেতিনী হয়েছে নাকি?”

“না। জলে ডুবে যায়,—বাঁচলেও বাঁচতে পারে—কেউ তাকে জল থেকে তুলে বাঁচাতে পারে; বাঁচাতে পারে কি—নিশ্চয় সে বেঁচে আছে—নতুবা—আপনি কেমন করে তাকে দেখতে পেলেন?”

“তুমি যা বল্‌ছো—তা যদি সত্য হয়—তোমার ভগ্নীকেও—আমি নিশ্চয় উদ্ধার করে আবো; কিন্তু–তোমার ভগ্নী এত দূর নীচকার্য্যে প্রবৃত্ত হয়েছে—এই আশ্চৰ্য্য।”

“যাই হোক—আমার এ মিনতি—আপনি আমার ভগ্নীকে খুনেদের হাত থেকে উদ্ধার করে এনে দিন।”

“আমি তোমার ভগ্নীকে নিশ্চয় তোমাকে এনে দিব।”

“আর একটী আমার নিবেদন আছে।”

“কি বল।”

“এ কথা এখন আপনি আমার মামাবাবুকে—কাকেও বলবেন না।”

“আচ্ছা—তাই হবে।”

“যদি আপনি আমাদের বিমলাকে আর আমার সে ভগ্নীকে ফিরিয়ে এনে দিতে পারেন— আপনি এ হতভাগিনীর কাছ থেকে যা পুরষ্কার চাইবেন, আপনাকে দিব।”

“হতভাগিনী বলে ত আগে নিজের পরিচয় দিয়েই বলে—তাতে তোমার কাছে—এক পয়সার স্থানে দু পয়সার প্রত্যাশা করা যায় না; তবে এরূপ স্থলে আমি কি করবো?”

“আপনি উপহাস করুন—আর যাই করুন—আমাকে অকৃতজ্ঞ বিবেচনা করবেন না। এই প্রত্যুপকারে আমি আপনার কথায় আপনার পদে প্রাণ বলিদান দিতে পারি।”

“তাই একদিন বলবো–দেখবো তোমার কথা ঠিক কি না; তবে ‘বলি’টলি, নয়—শুধু ‘দান’ই আমার মতে উত্তম।”

সঞ্জীববাবুর কথায় পরিমল সরমসঙ্কুচিতা হইয়া বলিল, “মহাশয়—আপনার সঙ্গে কথায় কে পারবে?” লজ্জাধিক্যে সে স্থান ত্যাগ করিয়া যাইতে উদ্যত হইল।

সঞ্জীববাবুর তাহার দুইহস্ত ধরিয়া দাঁড়াইলেন। পরিমল অবনত মুখে সঞ্জীববাবুর সম্মুখে নীরবে রহিল।

সঞ্জীববাবু জিজ্ঞাসিলেন, “তোমার আকার কথা—প্রতিজ্ঞার কথা—স্মরণ থাকবে কি?”

“ঈশ্বর সাক্ষী—আপনার উপকার আমি কখনই বিস্মৃত হব না।”

“এ গেল উপকারের কথা—আর আমাকে।”

এই কথায় পরিমল অতিশয় লজ্জিতা হইল। ক্রীড়াবিকুঞ্চিতা সুন্দরী আর কোন উত্তর করিতে পারিল না, ঊর্দ্ধশ্বাসে পলাইল।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – “এ আবার কি?”

সঞ্জীববাবু যাহাকে একবার দেখিতেন—তাহার হৃদয়ের সমস্ত ভাব সেই বারেক দর্শনে বুঝিয়া লইতে পারিতেন। কিন্তু তিনি কতবার পরিমলকে দেখিয়াছেন—কতবার তাহার সহিত কথোপকথন করিয়া আসিতেছেন—তথাপি—তিনি পরিমলের ক্ষুদ্র হৃদয়ের গুপ্তকথার তিলার্দ্ধাংশ বাহির করিতে পারিলেন না। এ পর্যন্ত যত বার তিনি পরিমলকে দেখিয়াছেন—প্রত্যেক বারেই তাহাকে এক এক অভিনবভাবে থাকিতে, নূতন ধরণে কথা কহিতে—দেখিয়াছেন। যেন, কাল যাকে দেখিয়াছেন – আর তার সেই মূর্ত্তি ধরিয়া অন্য একজন আসিয়া উপস্থিত। সঞ্জীববাবু কখন কখন পরিমলকে সন্দেহ করেন, আবার কিয়ৎ পরেই তিনি নিঃসন্দেহে মনে মনে স্বীকার করেন, পরিমল—নিরপরাধিনী।

আজ তিনি, তাহার মুখে শুনিলেন—যে তাহার আবার এক যমজ ভগ্নী আছে—পরিমল আবার এ কথা কাহারও নিকট বিশেষতঃ তাহার মামাবাবুর নিকট প্রকাশ করিতেও নিষেধ করিয়াছে। তবে পরিমল কি নিজের নির্দোষিতা সাব্যস্ত করিবার জন্য এই এক নূতন কৌশল জাল বিস্তার করিল? এতদিন ত এ কথা প্রকাশ করে নাই—যদি বা প্রকাশ করিল—তাহার মামাবাবুর নিকট—কি অন্য যে কেহ হউক, কাহারও নিকট এ কথা প্রকাশ করিতে নিষেধ করিল কেন? পাছে রামকুমারবাবু তাহার এই মিথ্যা কৌশল ভাঙ্গিয়া দেয়; কারণ রামকুমারবাবু অবশ্যই জানেন যে পরিমলের যমজ ভগ্নী আছে—কি কখন ছিল কি না। দুষ্টবুদ্ধি স্ত্রীলোকের নিকট কৌশলের অভাব নাই। সঞ্জীববাবু আপন মনে এরূপ অনেক তর্ক বিতর্ক করিলেন—আপনাকে একজন সামান্য বালিকার নিকট এরূপ বার বার প্রতারিত হওয়ায় নিজেকে শত শত ধিক্কার দিলেন।

.

মনে মনে নানা কূটতর্কের মীমাংসা করিতে করিতে সঞ্জীববাবু প্রাগুক্ত, চণ্ডীতলার বনের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়াছে। নিৰ্ম্মল নীলিমাবুকে দুই একটী তারা দূরে দূরে উঁকি মারিতেছে। দিবসের ম্লানশশী উজ্জ্বলাননা নক্ষত্র ললনাদিগকে তাহার দর্শন পথে পতিতা হইতে দেখিয়া—আনন্দোৎফুল্ল মুখে মৃদু হাসিতেছে। তারানাথের হাসি দেখিতে যেখানে যত তারা ছিল— ছুটিয়া আসিতে লাগিল; এক দুই–তিন–চার—আর গণনা করা যায় না—অসংখ্য। অনেক স্থানে জড় জগতের প্রত্যেক পদার্থে নিঃস্বার্থ প্রেমের নিদর্শন দৃষ্ট হয়, প্রাণীজগতে—শুধু স্বার্থ—শুধু— আত্মপ্রসাদ। জড় জগৎ নিশ্চিন্ত-নীরব – প্রশান্ত—নিশ্চঞ্চল–কৰ্ত্তব্যাকর্ত্তব্যহীন। প্রাণীজগৎ— তদ্বিপরীত উদ্বেগপূর্ণ—শান্তিহীন—অত্যাচার উৎপাত—উপদ্রব যত কিছু আছে—সে সকলে প্ৰবিদ্ধ, প্রতি কাৰ্য্যে—প্রতি পদক্ষেপে—পরস্পরে সংশয় দংশন। ধন্য—জড় জগৎ। ধিক্ অজড়—তোমরা।

সঞ্জীববাবু পূর্ব্বোক্ত বনস্থিত সেই ভগ্নবাটীতে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, যে গুপ্তগৃহে তিনি পূর্ব্বে এক রমণীর মৃতদেহের সন্ধান পাইয়াছিলেন—সেই গৃহমধ্য হইতে দ্বারের ফাটল দিয়া সূক্ষ্ম আলোকরশ্মি কতিপয় গৃহবহির্ভাগে নীত হইয়াছে। দ্বারের ফাটল দিয়া গৃহমধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন—যাহা দৃষ্টিগোচর হইল—তাহাতে তিনি দুই এক পদ পিছাইয়া আসিলেন;–বিস্ময়াধিক্যে তিনি চমকিত হইলেন। দেখিলেন, কক্ষমধ্যে আর কেহ নাই—কেবল মহীন্দ্রনাথ—ও মহেন্দ্ৰনাথ মহেন্দ্রনাথ—একখানি শাণিত বৃহচ্ছুরিকা মহীন্দ্রনাথের বক্ষঃস্থল লক্ষ্য করিয়া রুদ্রমূর্তিতে দণ্ডায়মান–প্রদীপালোকে ছোরাখানা চক্‌ক্‌ করিয়া জ্বলিতেছে। মহীন্দ্রনাথ—সংসঙ্কোচ—বিবর্ণমুখ স্থির হইয়া এক পার্শ্বে উপবিষ্ট।

সঞ্জীববাবু কবাটে কর্ণ রাখিয়া তাহাদিগের কথোপকথন শুনিতে লাগিলেন।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – অন্তরালে

মহেন্দ্ৰনাথ বলিল;—”এখন ত তোমার কাজ শেষ হয়ে এসেছে; এক রকম ধরতে গেলে আমিই সব করেছি; যা কখন আমাদের কোন পুরুষে করে নাই—আমি তা তোমার জন্যে করেছি। আর কি চাও? এখন যা কথা ছিল—ভালয় ভালয় তার বান্দোবস্ত ও সময় বল, আমার যা করবার তাই করি। দেখ্‌ছ ছুরি—এই ছুরি তোমার অনেক কাজে ঘুরেছে—এইবার নয় তোমার বুকে বসে মুহুর্ত্তের বিশ্রাম করবে।

ম। “কি চাও তুমি বল না—এত গৌরচন্দ্রিকা কেন?”

মহে। আমি চাই—আমার এই খৎ খানার এক পার্শ্বে তোমার একটী মাত্র সই।

ম। আচ্ছা—তোমার ছুরিখানা এখন রাখ—এ বিষয়ে একটা কথা স্থির হ’ক।

মহে। কথাবার্তা আবার কি? সহজে না বশে এস—কাজে আসবে। আমি সে পাত্র নই বাবা! অম্‌নি ছাড়ছি না। আগে সই কর—তার পর যা বলার বল।

ম। আমি যা বলেছি—মুখ থেকে একবার যা বার করেছি, তা তুমি নিশ্চয় পাবে—আমার কথাও যা খও তা।

মহে। আমার কাছে তা নয়—তোমার কথা যা আর কলাপাতে লেখা তা—দুদিন পরে শুকিয়ে গেলে—চুকে গেল।

ম। তুমি কি আমাকে এমনই মনে কর নাকি?

মহে। কি ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠীর তুমি! তোমাকে ত আর জানি না। নিশ্চয় জেন, সই না করে— কখনই এ বাড়ী থেকে জ্যান্ত ফিরে যাবে না।

ম। আমি কি অস্বীকার করছি না কি? এত ভুল বোঝ কেন? আমি ত সই করতে এখনই রাজী আছি—অত বিসম্বাদ—বাগ্বিতণ্ডা তোল কেন?

মহে। তাইত বল্‌ছি—সইটী কর—আর রাজা হও গিয়ে

ম। বিমলাকে আগে খুন কর—তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তোমার খতে সই করে দিব।

মহে। বিমলা বিমলা করে এত ভাবনা কেন? মরেছে, ধরতে গেলে সেত মরেই রয়েছে। বিমলার মরবার পর তুমি সই করবে? কেন আমাদের ফাঁকি দিতে চাও নাকি? তা বাবা হবে না— বাঁচতে চাও যদি ও সব মন্ত্রণা ছাড়; আমাদের ফাঁকি যে দেবে সে এখন তার মার পেটে আছে।

ম। আমি কি তাই বলছি না কি? আচ্ছা ত অবিশ্বাসী মন তোমার।

মহে। কি বিশ্বাসী লোক তুমি?

ম। একটা কথা হচ্ছে—কি জান,—সঞ্জীবটা সহজ লোক নয়। সে যেকালে জেনেছে বিমলা মরে নাই—এখনও বেঁচে আছে—সে কালে সে বিমলাকে কখনই খুন করতে দেবে না—বেঁচে থাকতে থাকতেই তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে; প্রত্যেক পলে এ সন্দেহ আমার মনে উঠছে। এখনই মেয়েটাকে সাবাড় কর—তার বাপ—পাড়ার পাঁচজন, বেটা সঞ্জীব জানুক্‌—সে এসে প্ৰত্যক্ষ দেখুক—মরেছে—তারপর চিতায় ফেলে পোড়াক; তখন আমি বুঝবো যে–হাঁ সব ঠিক্—আর কোন সন্দেহ, কি ভয় করবার কোন কারণ নাই।”

মহে। তুমি কি মনে কর নাকি যে আমি তোমাকে সইটা করিয়ে নিয়ে, শেষে—তাকে তার বাপের কাছে রেখে আসবো? সেই রকম কথা দেখছি যে। তাই যদি করবো—তবে তোমার সই নিয়েই বা কি হবে? তুমি বিষয় আশয় পাবে—তবে ত তোমার কাছ থেকে আমার যা কিছু আদায় হবে; নৈলে তুমিও যে কপৰ্দ্দকহীন, আমিও তথৈবচ। বুঝলে—মহীন্দ্রনাথ? তুমি ও কথা মনে স্থান দিও না। তোমার জন্যে আমি যা করেছি—যদি তুমি অকৃতজ্ঞ না হতে, তবে আমার কথায় কখনই অসম্মত হতে পারতে না। তোমার জন্যে—তোমার কার্য্যে আমার একটী মাত্র পুত্র—তাকেও বিসৰ্জ্জন দিয়েছি। সে আমার পাপের ফল হয়েছে—এরিই মধ্যে কি তুমি সে সব কথা ভুলে যেতে বলে?

ম। যাক্, অত কথায় দরকার কি-যে মূহুর্তে বিমলা মরবে, সেই মুহুর্তে আমি তোমার কাগজে সই কবো—কোন আপত্তি করবো না—করতেও দিও না তুমি।

মহে। তুমি সই কর, দেখবে সে মরেছে।

ম। কতক্ষণের মধ্যে?

মহে। খুব বেশী হয় ত—এক ঘণ্টা।

ম। ভাল—তার পর তার মৃতদেহ?

মহে। তার পিত্রালয়ের সম্মুখে চালান্ দেওয়া হবে।

ম। আচ্ছা—আমায় ভাব্‌তে চিত্ততে একটু সময় দাও। তার পর আমি সই করছি।

মহে। আচ্ছা—মহীন্দ্রনাথ, যদি আর কোন উত্তরাধিকারী এসে জুটে পড়ে, তবে কি হবে?

ম। তুমি ত জান—যার বিষয় আমি তার ভাইপো। আমি অগ্রে, আমার চেয়ে আর কার অধিক অধিকার থাকতে পারে? বিমলা—আর তোমার ভাইপো? তা বিমলা ত মরণমুখে। আর দেবিদাস—গুণ্ডারা তাকে ধরে এতক্ষণ যমালয়ে পৌঁছে দিয়েছে। আমি সে খবর পেয়েছি, সে আধমরা হয়ে পড়ে আছে। আমার হুকুম হলেই একবারে নিকেস হবে; তার কোন সন্দেহ নাই; সে হুকুমও আমি অনেকক্ষণ দিয়েছি।

মহে। আচ্ছা, মহীন্দ্রনাথ, তোমার কাকা তোমাকে বাতিল করে এমন উইল করলে কেন?

র। আমার স্বভাব চরিত্রে আমার উপর তার বড় ঘৃণা হয়েছিল। আমাকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দেয়—সেই অবধি আমি এ দেশ ছাড়া হই। আর আমি এ দেশে সে পৰ্য্যন্ত আসিনি—এবার আমার অভীষ্ট-সিদ্ধ করবার জন্যে এসেছি।

মহে। তুমি যে কালে এতদিন দেশ ছাড়া হয়েছিলে, সে কালে তোমার পরিচয় প্রমাণ করে— বিষয়ে অধিকার লওয়া কিছু শক্ত

ম। দেবিদাস মরেছে—বাকী বিমলা; বিমলার মৃত্যুর পর—আমার বিষয়াধিকারে কোন বাধা নাই।

মহে। কেন, বিমলার মৃত্যুর পর ত বিমলার পিতা তার কন্যার অংশে—অধিকার পেতে পারে। ম। সে পথ মেরে দিয়েছি—আদত উইল—জানত—সে শৰ্ম্মা অনেক পূর্ব্বে হস্তগত করেছে। যে রাত্রে আমরা রামকুমারবাবুকে খুন করতে তার শয়ন ঘরে প্রবেশ করি, সেই রাত্রে আমি আদত উইল বার করে এনেছি।

মহে। সেখানা যত্ন করে রেখেছ ত?

ম। সে আর তোমায় বলে দিতে হবে না।

মহে। ভাল, সইটী এখন করে দাও—আমিও বিমলাকে একদম শেষ করে ফেলি।

ম। ভাল—তোমার মনে বিশ্বাস না হয়—আমি সই করে দিচ্ছি।

মহে। আর একটা কথা হচ্ছে—তুমি বিষয় নিতে গেলেই সকল লোকের এই সকল খুনের সন্দেহ তোমার উপরই হবে। তার কি করেছ?

ম। সে পথ মেরে দিয়েছি। কেন, সেই ছেঁড়া পত্রের কথা ভুলে গেছ নাকি? যখন সেই বিবাহের রাত্রে আমরা যে ঘর থেকে বিমলাকে বার করে আনি, সেই ঘরে পত্রখানা ফেলে দিয়ে আসি—যেন দেবিদাস বিমলাকে খুন করবো বলে শাসাচ্ছে। তাতে লোকের মনে দেবিদাসের উপর সন্দেহ হবারই কথা, তাও ত হয়েছে।

মহে। কই, তাতে দেবিদাসের নাম ত তুমি লেখ নাই—‘ক, খ, গ, ঘ, ঙ’ লিখেই সেরেছে। ম। সেই পত্রখানা পড়লেই সহজে বুঝা যাবে যে, সে খানা দেবিদাসের পত্র। তার আগেকার আবার সেই গণককারের কথা, পত্রের সঙ্গে গণককারের গণনার অনেক মিল আছে। আর, আমি বেঁচে আছি কি মরে গেছি—তা এখানকার কেউ জানে না; আরও ছয় সাত মাস আমি এম্নি বাইরে বাইরে থাকবো। যখন দেখবো যে সব গোলযোগ মিটে গেছে—লোকের আমার উপর সন্দেহ করবার কোন কারণ নাই—তখন ধীরে ধীরে কাজ গুছিয়ে নেব।

মহে। তুমি ভয়ানক তুখড় লোক।

ম। এ রকম কাজে এ রকম তুখোড় লোক না হলে চলে কি?

সঞ্জীববাবু সেই সমস্ত গুপ্তকথা স্পষ্ট শুনিতে পাইলেন। এখন কি করিবেন—তাহাই ভাবিতে লাগিলেন। যদি তিনি এক্ষণে কোন সদুপায় স্থির করিতে না পারেন, তাহা হইলে বিমলার মৃত্যু অনিবার্য্য; আর নিজের এত পরিশ্রম এত উদ্বোগ—এত উদ্যম—এত কষ্টস্বীকার—সকলই বিফল। তাহাদিগের কথোপকথনে তিনি বুঝিতে পারিলেন, সে বিমলা—এই স্থানেই আছে। এখন যদি তিনি তাহাদিগের অল্প অবসর দেন—তাহা হইলে দুরাত্মা মহেন্দ্রনাথ এখনিই বিমলাকে হত্যা করিবে। অদৃষ্টের উপর নির্ভর করিয়া তিনি সেই গৃহমধ্যে একবারে লাফাইয়া পড়িলেন। গৃহস্থিত ব্যক্তিদ্বয়—কি ব্যাপার বুঝিবার পূর্ব্বে সঞ্জীববাবু মহেন্দ্রনাথের হস্ত হইতে তাহার ছোরা সজোরে কাড়িয়া লইলেন। নিজ হস্তস্থিত পিস্তল উঠাইয়া কহিলেন, “ভাল চাও—যেমন আছ ঠিক তেন্নি থাক—এক পা এগিয়েছ কি—মরেছ।”

উভয়ে এই আকস্মিক ভয়ে কম্পান্বিত—বুদ্ধিহত; সহজেই গোয়েন্দাশ্রেষ্ঠ সঞ্জীববাবুর হস্তে আত্মসমর্পণ করিল।

সঞ্জীববাবু তদুভয়কে পিছমোড়া করিয়া হাতকড়ি লাগাইলেন; উভয়ব্যক্তির হাতকড়ি একত্রে সংযোজন করিয়া দিয়া—বাহিরে আসিলেন। তাহারা গৃহমধ্যে রহিল, সঞ্জীববাবু সেই গৃহদ্বারে চাবিবন্ধ করিয়া বিমলার অনুসন্ধানের নিমিত্ত বাটীর উত্তরাংশে চলিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – বিমলার কি হইল

সঞ্জীববাবু কিয়দ্দুর অগ্রসর হইয়া রমণীকন্ঠোচ্চারিত স্বর শুনিতে পাইলেন। শব্দ লক্ষ্য করিয়া, কিছু দূর যাইয়া দেখিতে পাইলেন—একটী কক্ষমধ্যে দুইটী বালিকা পরস্পর কথোপকথন করিতেছে। একটী অপেক্ষাকৃত বয়ঃক্রমে কনিষ্ঠা—মলিন শষ্যার উপর শয়ন করিয়া রহিয়াছে; অপরটী তাহার শয্যা-পার্শ্বে বিষণ্ণ মুখে বসিয়া।

সেই কক্ষের দ্বারসম্মুখে ক্ষুদ্রবৃহদ্রন্ধ্র বিশিষ্ট একখানি কম্বল ঝুলান ছিল। কক্ষমধ্যে এক পার্শ্বে একটী প্রদীপ জ্বলিতেছে, তদালোক সঞ্জীববাবু কম্বল-যবনিকার ছিদ্র দিয়া উভয়কে উত্তমরূপে দেখিয়া লইলেন। বুঝিলেন, তিনি যে উদ্দেশে আসিয়াছেন—তাহা সিদ্ধপ্রায়; যে বালিকা শয্যায় শয়ান রহিয়াছে সে বিমলা—ব্যতীত আর কেহই নহে। আর যে তাহার শয্যার পার্শ্বে বসিয়া আছে–সে পরিমলের যমজ ভগ্নি—সঞ্জীববাবু যাহাকে রামকুমারবাবুর উদ্যানে,—তাহার বাটির উপরতলে, বিমলার শয়নগৃহে দস্যুদলকে পথ প্রদর্শন করিতে,–এই বাটীতে শয়নগৃহে দস্যুদলকে পথ প্রদর্শন করিতে,–এই বাটীতে দর্পণে যাহার প্রতিচ্ছায়া প্রকটিত হইতে, তাহার অল্পক্ষণ পরেই সম্মুখ দিয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটিয়া যাইতে দেখিয়াছিলেন।

আনন্দে সঞ্জীববাবু যেমন গৃহমধ্যে প্রবেশ করিতে যাইবেন, উপবিষ্টা রমণী তখনই ছুরিহস্তে শয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, “সাবধান এ ঘরে পা বাড়াইলে–রক্ষা থাকবে না—মবে। যদি বাঁচবার আশা থাকে—কথা শোন; নতুবা এই ছুরি—এই ছুরি তোমার বুকে না বসিয়ে ছাড়বো না।”

সঞ্জীববাবু সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করিয়া হাসিলেন। হাসিয়া কহিলেন, “আমার দ্বারা তোমাদের মঙ্গল ভিন্ন অমঙ্গল হবে না। আমাকে তোমরা তোমাদের উপকারী বন্ধু বলেই জানবে।” গৃহমধ্যে প্রবেশিলেন।

দীপালোকে সঞ্জীববাবুকে চিনিতে পারিয়া রাগোন্মত্তা বালিকা নিজ হস্তস্থিত ছুরিকা গৃহতলে নিক্ষেপ করিয়া আনন্দাধীর চিত্তে বলিল, “আপনি! সঞ্জীববাবু! আপনি আমাদের রক্ষা করুন। আমি মনে করেছিলেম, পাপীষ্ঠ মহীন্দ্রনাথ। আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন—দুরাত্মারা আজ বিমলাকে খুন করবার পরামর্শ করেছে। (বিমলার প্রতি) বিমলা—বিমলা আর আমাদের ভয় নাই। ভয়বিহ্বলা বিমলা সবিস্ময়ে উঠিয়া বসিল। সসঙ্কোচনেত্রে সঞ্জীববাবুর মুখ পানে নীরবে চাহিয়া রহিল মাত্র।

সঞ্জীববাবু তাহাকে শঙ্কিত দেখিয়া বলিলেন, “বিমলা, আমি তোমার উদ্ধারের জন্য এসেছি— আমাকে তোমার ভয় করবার কোন কারণ নাই।”

বিমলার বৃহল্লোচনযুগল সজল হইল—বালিকা রোদনের উপক্রম করিল। সঞ্জীববাবু প্রবোধ দিয়া শান্ত করিলেন।

বয়োজ্যেষ্ঠা বলিল, “এখনি আপনি আমাদের এখান থেকে নিয়ে চলুন—নচেৎ সৰ্ব্বনাশ হ’বে; দুরাত্মা মহীন্দ্রনাথ এখনি এসে বিমলাকে খুন করবে।”

সঞ্জীববাবু কহিলেন, “আমি থাকতে তোমাদের কোন ভয় নাই—আমি তা’দের বন্দী করে এসেছি। মহেন্দ্র আর মহীন্দ্রনাথ ছাড়া এ বাটীতে এখন আর কেহ আছে?

“না। সকলে সন্ধ্যার পূর্ব্বে কোথায় চলে গিয়াছে—আজ আর তারা আসবে না; যদি আসে—শেষ রাত্রে!”

“তবে আর তোমাদের ভয় নাই। আমি তোমাকে কতকগুলি কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।”

“কি বলুন—আমি আপনাকে মিথ্যা কথা বলবো না।”

“তোমার নাম কি?”

“নিরমল।”

তখন সঞ্জীববাবুর একটা কথা মনে পড়িয়া গেল; তিনি উদ্যানে যে রক্তকলঙ্কিত রুমাল পাইয়াছিলেন—বাহির করিয়া কহিলেন, “এ রুমাল কি তোমার?”

নি। হাঁ—এ রুমাল আমার। (দেখিয়া) এই যে নাম লেখা রয়েছে—রক্তে খানিকটা ঢেকে গেছে। স। তুমি এ দলে কেন মিশেছ?

নি। কেন মিশেছি? সে অনেক কথা।

স। বোধ করি এই দলস্থ কেহ তোমার জার।

নিরমলের বিশাললোচনযুগল রোষদীপ্ত হইয়া, জ্বালিয়া উঠিল। বলিল, “সাবধান—বুঝে সুজে কথা বলবেন আপনি।”

স। আমাকে তুমি সকল কথা খুলে বল।

নি। কি বলবো বলুন।

স। তুমি এ দলে কেন মিশেছ?

নি। তবে শুনুন—আমি আপনাকে সব কথাই বলছি। প্রায় আট বৎসর হ’ল—যখন আমার বয়স ছয় বৎসর হ’বে, তখন আমার পিতা মাতা আর এক ভগ্নী—সকলে গঙ্গাসাগরে যাই; দৈবদুৰ্ব্বিপাকে নৌকাডুবি হয়ে আমরা জলমগ্ন হই। আমাকে এক ব্রাহ্মণ উদ্ধার করেন। তিনি আমার পিতা মাতা ভগ্নীর অনেক অনুসন্ধান করেছিলেন—কোন সন্ধান পান নাই। শেষে তিনি আমাকে তাঁর নিজবাটী – ময়মনসিংহে সঙ্গে করে নিয়ে যান। আমিও তাঁর স্নেহে ও যত্নে তাঁর নিতান্ত অনুগত হই। তাতে তিনি আমাকে এবং তাঁর কোন সন্তানাদি না থাকায় আপন কন্যার ন্যায় ভালবাসতে লাগিলেন। আমি কখনও কোন দিন তাঁর একটী কথার অবাধ্য হই নাই। তিনি যা বলতেন—তা আমি শিরোধার্য্য করে নিতেম্। প্রায় সাত আট বৎসর তিনি আমায় সমান কৃপাস্নেহনেত্রে দেখে আছিলেন–এক দিনের জন্যেও আমার উপর বিরক্ত হন নাই। তারপর পাপিষ্ট—মহীন্দ্রনাথ—সেখানে যায় এবং আমাকে তার পাপ প্রলোভনে নেবার জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করতে থাকে। সেখানে মহেন্দ্রনাথ—আপনার বোধ হয় তাকে চিনতে বাকী নাই— সেও আমাদের পাড়ায় থাকতো। তার নরেন্দ্রনাথ নামে এক পুত্র ছিল—সে সেদিন মরেছে—তাও আপনি জানেন; তারই রক্তের দাগ রুমালে রয়েছে। সেই নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মহীন্দ্রনাথ বন্ধুত্ব করে। উভয়ে সমচরিত্র—অতি শীঘ্রই তাদের বন্ধুত্ব জন্মিল। নরেন্দ্রনাথ আমাদের প্রতিবাসী—সে আমার সঙ্গে কথাবাৰ্ত্তা কহিত—আমিও তাতে কোন বাধা দেখি নাই। শেষে উভয়েই তাহাদের মন্দ অভিপ্রায়ে আমাকে নেবার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি তখন নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে কথাবাৰ্ত্তা বন্ধ করে দিলেম। আর বাটীর বাহিরে আতেম না। তাহারা তাহাদের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য অনেক মন্ত্ৰণা করতে লাগলো। আজ পনের দিন হল, আমি সন্ধ্যার পর গা ধুয়ে ঘরে ফিরছি—অমনি কোথা থেকে পাঁচ সাত জন লোক ছুটে এসে আমাকে কোন কথা বলতে না দিয়ে—আমার হাত মুখ একবারে বেঁধে ফেলে, ধরে নিয়ে যায়। শেষে বুঝলেম, যে এ মহীন্দ্র ও নরেন্দ্রর পাষণ্ডপণা। তার পর আমাকে এই বনে এনে ফেলে—তাদের পশু প্রবৃত্তি চরিতার্থ করবার জন্য অনেক কৌশল করে। আমি সদত সতর্ক থাকতেম—সর্পের বিবরের পার্শ্বে শায়িত ব্যক্তি যেমন সতর্ক থাকে— তেমনি আমি সতর্ক থাকতেম; তার পর তারা একদিন রাত্রে বিমলাকে অপহরণ করে নিয়ে আসে। আমার উপর বিমলার ভার দেয়। সেই অবধি মহীন্দ্র আমার উপর আর কোন অত্যাচারের চেষ্টা করে নাই। কি পরামর্শ করে মহীন্দ্রনাথ এইখানকার চণ্ডীদেবীর নিকট এমন শপথও করে এবং আমাকেও শপথ করায়ে নেয়—যে আমি বিমলা সম্বন্ধে কোন কথা কখনও প্রকাশ করবো না- তাদের যা যা সাহায্য আমার দ্বারা হতে পারে, তা করবো।

স। বটে! তার পর কি হল?

নি। তার পর আমাকে এরা যা যা বলে আসছে—আমি তাই করে আছি। যে দিন বিমলাকে এরা প্রথম আনে—বিমলা আমাকে দেখে আমার ভগ্নীর কথা তোলে—তাতে জানতে পারি বিমলা আমার মামাত ভগ্নী। এ জগতে আমি জানতেম আমার কেউ নাই—এ সংবাদে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হলেম্—তখন থেকে কি প্রকারে বিমলাকে নির্ব্বিঘ্নে রাখবো—উদ্ধার করবো, তাই আমার এক মাত্র চিন্তা হল। কিন্তু—এ পর্য্যন্ত কোন উপায় করতে পারি নাই। এদের মতেই আমাকে চলতে হয়। যদি তা না চলি তবে বিমলার আর আমার রক্ষা থাকে না।”

স। তোমার বিবাহ হয় নাই?

নি। ময়মনসিংহে এক আমার আত্মীয় লোক আছে—যে সে আমার জাতি কুল অবগত আছে?

স। “তুমি এখন আমার সঙ্গে যেতে চাও, না এই দলে এমন করে আরও কিছুদিন থাকতে চাও? কি ভাল বিবেচনা কর?”

নি। আমি আপনার পায়ে ধরে যেতে চাই। অধিক কি বলবো, আমার কত যাতনা আপনি কি বুঝবেন? বিমলাকে পেয়েই আমি একরকমে জীবিত আছি—নতুবা এতদিন নিশ্চয় আমাকে আত্মহত্যা করতে হত। আপনার পায়ে পড়ি—বিমলাকে আর আমাকে এখান থেকে শীঘ্র নিয়ে চলুন। আমাদের অদৃষ্ট নিতান্ত মন্দ—বিপদ ঘতে বেশী বিলম্ব ঘটে না। আমাদের এখনি এখান থেকে নিয়ে চলুন—আমাকে না নিয়ে যেতে চান্—বিমলাকে নিয়ে যান—আমি আপনার সম্মুখে এই ছুরি (পরিত্যক্ত ছুরিকা ভূতল হইতে গ্রহণান্তর) আমার নিজের বুকে বসিয়ে আপনার সম্মুখে প্রাণ বিসর্জ্জন দিই। আর পারেন যদি আমাদের দুজনকেই এ বিপদ থেকে উদ্ধার করুন।

স। সেই জন্যই আমার এখানে আসা। এস, আমার সঙ্গে এস।

নবম পরিচ্ছেদ – তাহার পর কি হইল?

বিমলা ও নিরমলকে সমভিব্যাহারে লইয়া সঞ্জীববাবু রামকুমারবাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বিমলা ও নিরমলকে বৈঠকখানা গৃহে অপেক্ষা করিতে বলিয়া তিনি রামকুমার বাবুর সহিত পূর্ণানন্দে সাক্ষাৎ করিতে চলিলেন।

অলিন্দে বসিয়া রামকুমারবাবু, দেবিদাস ও পরিমল কথোপকথন করিতেছিলেন। এমন সময় সঞ্জীববাবুও তথায় হাস্যাস্যে প্রবেশিলেন। অধীরা পরিমল তাঁহাকে দেখিবামাত্র উঠিয়া দাঁড়াইল — সৌৎসুকে বলিল, “বিমলা কোথায়? আমার দিদি কোথায়? কি হল তাদের? আপনি বোধ হয় অকৃ—”

বাধা দিয়া সঞ্জীবাবু কহিলেন, “কখনও কোন বিষয়ে এ পর্যন্ত অকৃতকাৰ্য্য হই নাই—আজও তাই জানবে।”

প। কোথায়? বিমলা কোথায়?

স। বিমলা আর তোমার ভগ্নী নিরমল, বৈঠকখানা গৃহে বসে আছে। ইচ্ছা হয় দেখে আসতে পার।

সঞ্জীববাবুর কথা শেষ হইতে না হইতে—তথায় এক আনন্দ কোলাহল পড়িয়া গেল। সেই কোলাহল বৈঠকখানা গৃহাভিমুখে ছুটিল।

হর্ষোন্মত্ত রামকুমারবাবু তদীয় দুহিতা বিমলাকে দেখিবামাত্র বক্ষোপরি তুলিয়া লইলেন। পরিমল ভগ্নী নিরমলের স্কন্ধে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিল।

তৎপরে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় পরস্পর বৃত্তান্ত-বর্ণনে অতিবাহিত হইল।

.

সঞ্জীববাবু মহীন্দ্রনাথ, মহেন্দ্রনাথ ও টুনুয়াকে বিচারপতির হস্তে সমর্পণ করিলেন। কার্য্যশেষে তিনি একদিন সকলের আসাক্ষাতে—কাহাকেও কিছু না বলিয়া অন্তর্হিত হইলেন। রামকুমারবাবু, তাহাকে পুরষ্কৃত করিবার নিমিত্ত অনেক অনুসন্ধান করিলেন—সন্ধানপ্রাপ্ত হইলেন না। এই ঘটনায় পরিমলের হৃদয় একবারে ভাঙ্গিয়া গেল। তাহার কারণ পাঠকের অনবগত নহে।

মহীন্দ্রনাথ বাল্যকাল হইতেই পিতৃমাতৃহীন। অল্প বয়সেই অতি মদ্যপ ও বেশ্যাসক্ত হইয়া পড়ে। মধ্যে মধ্যে পিতৃব্য ঘনশ্যাম মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের অর্থালঙ্কারাদি চুরি করিয়া বদখেয়ালিতে যোগ দিত; তজ্জন্য মহীন্দ্রনাথ পিতৃব্যের চক্ষুশূল হইয়াছিল। বিশেষতঃ ঘনশ্যাম মুখোপাধ্যায় নিতান্ত কৃপণ ছিলেন। একদিন মহীন্দ্রনাথ তাহার পিতৃব্যের প্রায় ১৫০০ দেড় হাজার টাকার গহনা চুরি করে। তাহাতে তাহার পিতৃব্য তাহাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করিবার চেষ্টা পান; কিন্তু সেই চৌর্য্যবৃত্তির পর মহীন্দ্রনাথ একবারে নিরুদ্দেশ হয়। তাহার পর ঢাকায় গিয়া এক বেশ্যার প্রেমে উন্মত্ত হয়—সেই বেশ্যা কৌশলে তাহার অর্থের প্রায় সমূদয় আত্মসাৎ করে। এই সময়ে নিরমল মহীন্দ্রনাথের দৃষ্টিপথে পতিতা হয়। তাহাকে নানা প্রলোভন দেখাইয়া নিজ করতলগত করিতে চেষ্টা পায়। ইতিমধ্যে পিতৃব্যের মৃত্যুসংবাদ তাহার কর্ণগোচর হইল—মহেন্দ্রনাথও তাহার পুত্রের সহিত সেই বিষয় হস্তগত করিয়া লইবার পরামর্শ স্থির করিয়া দেশে ফিরিয়া আসে। আসিবার কালে নিরমলকে অপহরণ করিয়া পলায়ন করে। অবশেষে নিজ পরামর্শের অনেক অংশ সিদ্ধ করিয়া সঞ্জীববাবু কর্তৃক এক কালে বিফলকাম হয়

মাসৈক সময়ের মধ্যে শুভদিন স্থির করিয়া রামকুমারবাবু—দেবিদাসের সহিত বিমলার, গ্রামস্থ জনৈক ভদ্রসন্তানের সহিত নিরমলের বিবাহ দিলেন। পরিমলের বিবাহের সকল উদ্যোগই তিনি করিয়াছিলেন; কিন্তু পরিমল কিছুতেই বিবাহে সম্মতি দিল না। রামকুমারবাবু তৎপরে দুই এক দিনের মধ্যে বুঝিতে পারিলেন, পরিমল সঞ্জীববাবুর অনুরক্তা। তিনি এক দিবস অন্তরাল হইতে পরিমলের আপন মুখ হইতে এ কথা ব্যক্ত হইতে শুনিয়াছিলেন।

দশম পরিচ্ছেদ – সমাপ্তি

প্রায় তিন মাস সময় অতীত হইল—সঞ্জীববাবুর দেখা নাই। এক দিন সন্ধ্যার পর—যখন পূর্ণিমার শশী তাঁহার শুভ্রস্নিগ্ধালোকে জগন্মণ্ডল হাসাইতে আরম্ভ করিয়াছে—মৃদুমন্দ-মলয়বাবু জ্যোৎস্নাসমুদ্রে সন্তরণ দিতেছে—প্রস্ফুটিত কুসুম সকল সমীরণ বক্ষে সৌরভরাশি ঢালিতেছে, দুলিতেছে। তখন পরিমল উদ্যানের একপ্রান্তে বসিয়া—কত কি ভাবিতেছে। ভাবিয়া, কিছু স্থির করিতে না পারিয়া—আকুল হইতেছে।

এমন সময় তথায় এক ব্যক্তি প্রবেশ করিল, পরিমলের সম্মুখীন হইবামাত্র পরিমল তাহাকে দেখিয়া চমকিতচিত্তে উঠিয়া দাঁড়াইল। সহসা কোন কথা বলিতে না পারিয়া নীরবে রহিল।

আগন্তুক পরিমলের হাত দুইটী ধরিয়া বলিলেন, “পরিমল, আমার পুরস্কারের কি হল? ফাঁকি দিলে?”

পাঠক, মহাশয়দিগের বোধ হয় আগন্তুককে চিনিতে বাকি নাই—ইনি আমাদিগের সেই সঞ্জীববাবু।

পরিমল সঞ্জীববাবুর ধরা নিজের হাতখানির উপর দৃষ্টি রাখিয়া বলিল, “আপনাকে আমার মামাবাবু—কতদিন ধরে অনুসন্ধান করছেন—তিনি আপনাকে দেখে কত আনন্দিত হইবেন। এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন?

স। তোমার মামাবাবুর কথা ছেড়ে দাও—তোমার কথা বলছি। তোমার প্রতিজ্ঞা কি তুমি ভুলে গেছ? হতে পারে।”

প। আমার কি আছে—যে আমি আপনাকে দিব?

স। এখন এই কথা বলবে বৈকি। কাজ শেষ হয়ে গেছে—কি না—কেমন পরিমল?

প। আপনার উপকার আমি এ জীবনে ভুলবো না।

স। তাতে আমার লাভ কি? প্রকারান্তরে তুমি আমাকে ফাঁকি দিচ্ছ—কেমন কি না? এই তখন তুমি আমার কথায় প্রাণ অবধি দিতে চেয়েছিলে।

প। তা যদি চান্ ত, বলুন।

স। পরিমল, তাই চাই—অন্য কিছু চাই না।

পরিমল এ কথায় বড় লজ্জিতা হইল—মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিল না। সঞ্জীববাবু তাহার হাত এখনও ধরিয়াছিলেন, নতুবা সে নিশ্চয় পলাইত।

সঞ্জীববাবু পুনরপি কহিলেন, “চুপ করে রৈলে যে—না হয় বল আমায় আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়।”

পরিমল সে কথা কানে না করিয়া অন্য কথা কহিল, “এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন?”

স। তিন মাসে কি তাঁবাদী হয়ে গেছে নাকি?

কি লজ্জা! পরিমল ধৃত কর আকর্ষণ করিতে লাগিল।

সঞ্জীববাবু কহিলেন, “পরিমল! আমি সত্য বলছি—আমি তোমার মামাবাবুর নিকট হইতে পুরস্কার নেবার জন্য আসি নাই; তোমার প্রতিজ্ঞা—তোমাকে স্মরণ করাতে এসেছি।

প। এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন?

বেশী লজ্জার সময় কি বলিলে কি উত্তর করিলে চলে কিছুই ঠিক হয় না, তাই এককথা একশতবার মুখ দিয়া বাহির হইয়া পড়ে; দেখিতেছি পরিমলের এক্ষণে সেই দশা, আজ তাই বার বার তাহার মুখে “এতদিন আপনি কোথায় ছিলেন।”

স। আমাকে এক নিজের মকদ্দমা নিয়ে থাকতে হয়েছিল, পৈতৃক অতুল সম্পত্তি পরহস্তগত ছিল। অনেক চেষ্টায় এখন তা পরমেশ্বরের কৃপায় উদ্ধার করেছি!

প। তবে আর গোয়েন্দাগিরি করে বেড়াতে হবে না।

স। আমি গোয়েন্দাগিরি উদরদায়ে এ পর্য্যন্ত করি নাই; পরের উপকারের জন্য—আমার এ কার্য্যে প্রবৃত্তি। এ প্রবৃত্তি বোধ হয় আমার চিরকাল থাকবে।

.

সঞ্জীববাবু পরিমলের নিকট হইতে বিদায় লইয়া রামকুমারবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। রামকুমারবাবু তাঁহাকে দেখিবা মাত্র আহ্লাদে উৎফুল্ল হইলেন। অনেক সমাদর অভ্যর্থনা করিলেন।

সময়ে পরিমলের সহিত তাঁহার বিবাহের কথা উত্থাপন করিলেন; সঞ্জীববাবু কি অস্বীকার করিতে পারেন? পরিমলেরও এবার তাহার মামাবাবুর কথায় অসম্মতি নাই। সেই মাসে শুভদিন দেখিয়া রামকুমারবাবু মহাসমারোহে সঞ্জীববাবুর সহিত নিজ ভাগিনেয়ী পরিমলের শুভ বিবাহ সমাধা করিলেন।

***