উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

পঞ্চম। মুকুট ও সিংহাসন

পঞ্চম। মুকুট ও সিংহাসন

‘মদ্য, নৃত্য ও সংগীতের সময় এসেছে! নৃত্যের ক্ষেত্র হচ্ছে রণক্ষেত্র; সংগীত হচ্ছে অস্ত্রের ঝনৎকার আর যোদ্ধার জয়নাদ; এবং মদ্য হচ্ছে শত্রুর রক্ত!’—এই হল তৈমুরের উক্তি।

কিন্তু এই অপূর্ব ‘মদ্য, নৃত্য ও সংগীত’ উপভোগের শক্তি হল না তৈমুরের। মহান খাঁ ইলিয়াজের সঙ্গে লড়াই করতে পারে, তাঁর অধীনে এমন সৈন্য আড়াই শতের বেশি নেই। অতএব তৈমুর অসাধ্যসাধনের চেষ্টা করলেন না।

দিনের বেলায় যথাসময়ে নমাজ করা এবং মসজিদে গিয়ে কোরান পাঠ শ্রবণ করা হল তাঁর প্রধান কর্তব্য। রাত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বসে থাকেন দাবার ছকের সামনে। প্রতিপক্ষ না থাকলেও একলাই ঘুঁটি সাজিয়ে খেলা করেন। তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত দাবা-খেলোয়াড়। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাওয়া যেত না।

তৈমুর একদিন একা একা দাবা খেলছেন, এমন সময় সমরখন্দ থেকে একদল মোল্লা এসে হাজির।

‘খবর?’

‘বড় শুভ খবর! ভগবান তাঁর ভক্তদের দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন।’

‘তার মানে?’

‘অবিশ্বাসীদের হাতে সমরখন্দ, এখনও আত্মসমর্পণ করেনি। যদিও আমির হুসেন আর তৈমুরের সাহায্য পায়নি, তবু সমরখন্দের যোদ্ধারা শত্রুদের বাধা দেবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে এসেছে। আজ চেষ্টার ফল ফলেছে।’

‘যুদ্ধে জয় হয়েছে?’

‘বিনা যুদ্ধে জয় হয়েছে। ভগবানের প্রেরিত কী এক মহামারির কবলে পড়ে জাট-মোগলদের অধিকাংশ ঘোড়া মারা গিয়েছে!’

তৈমুরের মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। তিনি জানতেন, ঘোড়া হারালে জাট-মোগলদের আর কোনও জারিজুরিই থাকে না—এমনকি তারা হারিয়ে ফেলে যুদ্ধ করবার সমস্ত শক্তিই।

মোল্লারা সানন্দে জানালেন, ‘জাট-মোগলরা অস্ত্রশস্ত্র কাঁধে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এর আগে কেউ কোনও দিন জাট সৈনিকদের পায়ে হেঁটে চলতে দেখেনি! তাতার অশ্বারোহীরা সুযোগ পেয়ে শত্রুদের কুকুরের মতন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে!’

তৈমুর বুঝলেন, আবার তাঁর আলস্যের দিন হল গত। এসেছে তাঁর অপূর্ব ‘মদ্য, নৃত্য ও সংগীত’ উপভোগের সময়!

খবর পেয়ে আমির হুসেনও সমরখন্দে ছুটে এলেন। সমরখন্দের উপরে তাঁর দাবি সর্বাগ্রে। তিনি এখানকার ভূতপূর্ব আমিরদের নাতি। সমরখন্দের বাসিন্দারা মহোৎসবের ভিতর দিয়ে সাদরে গ্রহণ করলে তাঁকে।

খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে তৈমুরও ছিলেন হুসেনের সমযোগ্য, কিন্তু তিনি রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেননি। তাঁকে তুষ্ট রাখবার জন্যে হুসেন তাঁকে সবুজ শহর ও তাঁর আশপাশের অনেকখানি জায়গা ছেড়ে দিলেন।

চলতি নিয়ম অনুসারে চেঙ্গিজ খাঁয়ের এক বংশধরকে সিংহাসনে বসিয়ে হুসেন তাঁর নামেই রাজ্য চালাতে লাগলেন।

তৈমুর মুখে কোনও প্রতিবাদ করলেন না; কিন্তু মনে মনে জানতেন, হুসেনের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব বজায় থাকা অসম্ভব। হুসেন তাঁর শ্যালক হলেও আলজাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সমস্ত আত্মীয়তার সম্পর্ক চুকে গিয়েছে। হুসেন তাঁকে ছোট নজরে দেখেন, বহুবার তাঁকে অপমান বা অবহেলা করেছেন, বিপদে ফেলেছেন। তারপর হুসেনের জন্যে তাঁর শেষ পরাজয়ের জ্বালা কখনও তিনি ভুলতে পারবেন না।

এক আকাশে হাজার হাজার ছোট তারা থাকতে পারে, কিন্তু কে কবে শুনেছে একাধিক সূর্যের কথা?

কিছুদিন পরেই ছোট-বড় এটা-ওটা-সেটা নিয়ে মনান্তর আর মতান্তর হতে লাগল। দুজনেই যেখানে প্রভু হতে চায়, সেখানে গৃহ কলহ বাঁধতে কতক্ষণ?

কী নিয়ে যে আসল ঝগড়া বাঁধল, ইতিহাসে লেখা নেই, কিন্তু আরম্ভ হল যুদ্ধ। কেউ নিলে হুসেনের পক্ষ, কেউ নিলে তৈমুরের পক্ষ এবং দুই পক্ষেই রক্তপিপাসা সমান প্রবল। দেশ জুড়ে জেগে উঠল অস্ত্র ঝঞ্জনা এবং তারই মাঝে মাঝে হঠাৎ জাট-মোগলরা আবির্ভূত হয়ে দুই পক্ষেরই উপরে দুরন্ত ঈগলের মতন ছোঁ মেরে চলে যায়!

এই ভাবে কেটে গেল দীর্ঘ ছয় বৎসর!

বলা বাহুল্য, প্রথম প্রথম তৈমুরের চেয়ে হুসেনের পক্ষই ছিল সমধিক প্রবল। কিন্তু বীরত্বে, সাহসিকতায়, বুদ্ধি-চাতুর্যে ও কৌশলে তৈমুরের সঙ্গে যে হুসেনের তুলনাই হয় না, তার প্রমাণ এর আগেও পাওয়া গিয়েছে বারংবার। দেখতে দেখতে তৈমুর কেবল দলে ভারীই হয়ে উঠলেন না, যুদ্ধের পরে যুদ্ধ জয় ও কেল্লার পর কেল্লা দখল করতে লাগলেন। এসব ছোট ছোট যুদ্ধের আলাদা আলাদা বর্ণনা দেওয়ার দরকার নেই।

হুসেনের ব্যবহারও ছিল না ভদ্র ও মিষ্ট। সে জন্যেও অনেক সর্দার তার পক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।

একদিন তৈমুর সদলবলে উপবিষ্ট। হঠাৎ একটি মানুষ নিতান্ত ঘরের লোকের মতন সভায় এসে, অন্যান্য সভাসদদের মাঝখানে গিয়ে বসে পড়লেন বিনাবাক্যব্যয়ে!

সবাই সবিস্ময়ে চিনলে, তিনি হচ্ছেন হুসেনের দলের এক মস্তবড় মাতব্বর ও মাথাওয়ালা লোক। তাঁর নাম সর্দার মঙ্গলি বোগা, জাতে মোগল—তৈমুরের এক প্রধান শত্রু! তৈমুর কিন্তু ব্যাপারটা বুঝলেন। কোনওরকম বিস্ময় প্রকাশ না করে মঙ্গলির দিকে দিলেন খাবারের থালা এগিয়ে।

খাবার খেয়ে মঙ্গলি বললেন, ‘আজ আমির তৈমুরের লুন খেলুম। আজ থেকে আমি আর কারুর দিকে ফিরে তাকাব না।’

কিছুকাল পরে এই সর্দার মঙ্গলি বুদ্ধির জোরে তৈমুরকে একটি যুদ্ধে জয়ী করেছিলেন।

তৈমুরের তাতারিদের সঙ্গে কারা ইউসুফ নামে এক তুর্কি সর্দারের বিষম লড়াই বেঁধেছিল। তুর্কিরা এমন ভাবে তাতারিদের ঘিরে ফেললে যে, তৈমুরের জয়লাভ করবার কোনও সম্ভাবনাই আর দেখা গেল না।

হঠাৎ মঙ্গলি করলেন কী, মাটির দিকে হেঁট হয়ে পড়ে এক মৃত তুর্কির দেহ থেকে তার দাড়ি-গোঁফওয়ালা মাথা-কামানো মুণ্ডটা বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে নিজের বর্শাদণ্ডের আগায় বসিয়ে দিলেন।

তারপর শূন্যে বর্শাদণ্ড নাচাতে নাচাতে তাতারিদের দলে ঢুকে বিকট চিৎকার করে বললেন, ‘জয়, জয়! দ্যাখো—দ্যাখো, আমি কারা ইউসুফকে বধ করেছি! এই দ্যাখো তার মুণ্ড!’

তাতারিরা বিপুল আনন্দে যেন খেপে উঠে দ্বিগুণ উৎসাহে লড়তে লাগল এবং সেনাপতির মৃত্যুসংবাদ শুনে তুর্কিরা হতাশ হয়ে বেগে পালাতে আরম্ভ করলে। তারা এমন অন্ধের মতন পালাতে লাগল যে, তাদের দেহের ঠেলার চোটে অত্যন্ত জীবন্ত ও অত্যন্ত ক্রুদ্ধ কারা ইউসুফকেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে পলায়ন করতে হল!

ছয় বছর পরে দেখা গেল, তৈমুরের দল যেমন ভারী, হুসেনের দল তেমনি হালকা। হুসেন শেষ-যুদ্ধ দিলেন ইতিহাসখ্যাত বাল্ক শহরে। সেখানেও বিজয়লক্ষ্মী হলেন তাঁর প্রতি বিমুখ।

তৈমুরের কাছে হুসেন তখন আর্জি জানালেন, ‘আমি পরাজয় স্বীকার ও রাজ্য ত্যাগ করছি। তুমি আমাকে মক্কায় যেতে অনুমতি দাও।’

তৈমুর নারাজ হলেন না।

তারপর কী হল সঠিক জানা যায়নি। তবে শোনা যায়, তৈমুরের দুইজন সেনানী প্রভুর মতামতের অপেক্ষা না রেখেই, গোপনে হুসেনকে হত্যা করে। খুব সম্ভব, তৈমুর ব্যাপারটা আগেই জানতে পেরেছিলেন, কিন্তু বাধা দেবার চেষ্টা করেননি।

তৈমুর বাল্ক শহর ত্যাগ করলেন না। স্থির করলেন, এই শহরে বসেই তিনি দূর করবেন ভবিষ্যতের সমস্ত অনিশ্চয়তা। তাঁর একমাত্র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পরলোকে, নিজেকে জাহির করবার এত বড় সুযোগ ত্যাগ করা হচ্ছে মূর্খতা। তিনি বুঝেছিলেন, হুসেনের অবর্তমানে তাতার সর্দাররা একত্র সমবেত হয়ে নতুন এক আমির নির্বাচন করতে আসবেন।

বাল্ক হচ্ছে আফগানিস্তানের অতি পুরাতন শহর। ইতিহাস-পূর্ব যুগে এই নগরে পারসি ধর্ম প্রবর্তক জোরোয়াস্তারের জন্ম ও মৃত্যু হয়েছিল। একসময়ে এখানে যে বৌদ্ধধর্মেরও প্রভাব ছিল, একটি বুদ্ধমূর্তির ধ্বংসাবশেষ সে প্রমাণ করে দেয়। গ্রিকদের ইতিহাস বিখ্যাত ব্যাকট্রিয়ার রাজধানী হয়ে এই নগর ব্যাবিলনের মতোই সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠেছিল। আলেকজান্ডার দি গ্রেট খ্রিস্টপূর্ব ৩২৮ অব্দে এই নগর আক্রমণ ও অধিকার করেছিলেন। ১২২০ খ্রিস্টাব্দে মোগল দিগবিজয়ী চেঙ্গিজ খাঁর হস্তে বাল্ক পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। তারপর তৈমুর আবার একে গড়ে তোলেন। লোকে একে ডাকে ‘নগরমাতা’ বলে।

চারিদিক থেকে বাল্ক শহরে এসে জড়ো হলেন দলে দলে তাতার সর্দার। মস্ত সভা বসল। চলল তর্কাতর্কি। তৈমুর কিন্তু সভায় যোগ না দিয়ে তফাতে বসে দেখতে লাগলেন, বাতাসের গতি কোন দিকে!

এই কিছুকাল আগে তৈমুর পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন নিরাশ্রয় ভবঘুরের মতন। তিনি বড় বংশের ছেলে হলেও তাঁর দেহে নেই রাজরক্ত। কাজেই তাঁর প্রতিপক্ষের অভাব হল না।

তৈমুরের দলভুক্ত সর্দাররা বললেন, ‘রাজ্যকে সুশাসিত করতে হলে একজন যোগ্যতম প্রধান ব্যক্তির দরকার। তৈমুরের চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি কেউ নেই।’

আর একদল বললেন, ‘প্রচলিত বিধি অনুসারে কোনও তাতারই মুকুট ধারণ করতে পারবে না। সিংহাসনে বসাতে হবে চেঙ্গিজ খাঁয়ের কোনও বংশধরকে!’

মোল্লারা বললেন, ‘মোগলরা হচ্ছে অবিশ্বাসী—ইসলামের বিরোধী। পুরোনো নিয়ম চুলোয় যাক—তৈমুর হচ্ছেন মুসলমান, তিনি বিধর্মীর অধীন হতে যাবেন কেন? চেঙ্গিজ খাঁয়ের তরবারির চেয়ে তৈমুরের তরবারি ছোট নয়!’

তৈমুরের দলই জয়ী হলেন। আজ থেকে তিনি হলেন স্বাধীন নৃপতি। ভারতবর্ষ থেকে অ্যারাল সমুদ্রতীর পর্যন্ত বিশাল রাজ্য হল তাঁর হস্তগত।

তৈমুরের দৃষ্টি ফিরতে লাগল পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে! এইবার আরম্ভ হবে তাঁর দিগবিজয়ী জীবন।