পঞ্চম। বাংলার রাজা শশাঙ্ক
মধ্য ও পশ্চিম ভারত মহারাজাধিরাজ প্রভাকরবর্ধনের অধিকারভুক্ত ছিল বটে, কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতেও প্রায় তাঁর মতনই ক্ষমতাশালী আর এক নরপতি ছিলেন, তাঁর নাম শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত। উত্তর-পূর্ব ভারতের মগধ, গৌড়ও, রাঢ়দেশ শশাঙ্কের অধীনতা স্বীকার করেছিল; এমনকি, দক্ষিণ ওড়িশার কোঙ্গোদমণ্ডলের মাধববর্মাও ছিলেন তাঁর সামন্তরাজা।
মহারাজা শশাঙ্কের মনে ছিল অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা। যে পরাক্রান্ত গুপ্তসম্রাটরা এক সময়ে সসাগরা ভারতভূমির শাসনদণ্ড দৃঢ় হস্তে পরিচালনা করতেন এবং যাঁদের রাজত্বকালে ভারতবর্ষ জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও ললিতকলা এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছিল, সেই সম্ভ্রান্ত বংশেই তাঁর জন্ম। গুপ্ত-বংশের এক কন্যা মহাসেনগুপ্তাকে জননীরূপে পেয়ে থানেশ্বরের প্রভাকরবর্ধন নিজেকে যার-পর-নাই ভাগ্যবান বলে মনে করতেন। সুতরাং সেই রাজবংশেরই মুকুটধারী পুত্র হয়ে শশাঙ্কের মনে যে বিশেষ উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হবে, এ জন্যে বিস্মিত হওয়ার দরকার নেই।
শশাঙ্কের প্রবল ইচ্ছা ছিল যে, আবার তিনি ফিরিয়ে আনবেন গুপ্তবংশের পূর্বগৌরব। এই ইচ্ছার বশবর্তী হয়ে তিনি জয় করতে লাগলেন রাজ্যের পর রাজ্য। কেবল মগধ, রাঢ় ও গৌড়বঙ্গের অধীশ্বর হয়েই তিনি পরিতুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি দেখলেন, কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মা কর্ণসুবর্ণ (এখন রাঙামাটি নামে খ্যাত। এ স্থানটি মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের দক্ষিণে আছে) নগর পর্যন্ত আক্রমণ ও অধিকার করতে সাহসী হয়েছেন। তিনিও তখন কামরূপরাজকে আক্রমণ ও পরাজিত না করে নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না।
এমন সময়ে গুপ্তবংশীয় আর এক রাজা, মালবের দেবগুপ্তের কাছ থেকে এল এক আমন্ত্রণলিপি।
দেবগুপ্ত লিখেছেন :
‘মহারাজা শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্ত
একই পবিত্র বংশে আমাদের জন্ম। আমাদের দুজনেরই দেহের ভিতরে আছে একই পূর্বপুরুষের রক্ত। সেই রক্তের দোহাই দিয়ে আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি।
গুপ্তবংশের সন্তান আমি, এত দিন বাধ্য হয়েই থানেশ্বরের প্রভাকরবর্ধনের প্রাধান্য স্বীকার করেছিলুম। কিন্তু এত দিন পর ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন। প্রভাকরবর্ধন আর ইহলোকে বিদ্যমান নেই। তাঁর দুই পুত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাই আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হইনি, প্রভাকরবর্ধনের জামাতা কান্যকুব্জের মুখর বংশীয় রাজা গ্রহবর্মাকেও যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করেছি এবং তার সহধর্মিণী রাজশ্রীও এখন আমার হস্তে বন্দিনী।
কিন্তু আমার লোকবল আপনার মতো প্রবল নয়। গুপ্তচরের মুখে সংবাদ পেলুম, থানেশ্বরের নতুন রাজা রাজ্যবর্ধন আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। আমার এই দুঃসময়ে আপনি যদি আমাকে সাহায্য করতে আসেন, তাহলে কেবল যে আমি একাই উপকৃত হব তা নয়, আমরা দুজনে মিলে হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতেও পারব। মহাশয়ের অভিমত অবিলম্বে জানতে পারলে বাধিত হব। ইতি’
মধ্য ও পশ্চিম ভারত পর্যন্ত নিজের অধিকার বিস্তৃত করবার এমন সুযোগ শশাঙ্ক ছাড়তে পারলেন না। তিনি উত্তরে লিখলেন :
‘মহারাজা দেবগুপ্ত,
আপনার সাহায্যের জন্যে আমি যত শীঘ্র সম্ভব যাত্রা করব।
কিন্তু বিনা অপরাধে আপনি রাজশ্রীদেবীকে বন্দিনী করেছেন কেন? এ যে গুপ্তবংশের পক্ষে কলঙ্কের কথা। গুপ্তবংশের কেউ কোনও দিন নারীর বিরুদ্ধে হাত তোলেননি। অতএব অবিলম্বে রাজশ্রীদেবীকে মুক্তিদান করলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হব। ইতি’
কালবিলম্ব না করে মহাসমারোহে শশাঙ্ক সৈন্যসজ্জা আরম্ভ করলেন। নির্বোধরা এবং শত্রুরা আজ অপবাদ দেয়, বাঙালি সামরিক জাতি নয়, বাঙালি অস্ত্রধারণ করতে জানে না। কিন্তু আগে—এমনকি খ্রিস্টপূর্ব যুগেও বাঙালিদের কেউ কাপুরুষ বলতে ভরসা করত না। সাধারণত মগধ ও বঙ্গ বলতে সবাই তখন এক দেশই বুঝত। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, মগধ ও বঙ্গের সিংহাসনে বিরাজ করছেন একই রাজা।
ইতিহাস-পূর্ব যুগেও দেখা যায়, মধ্য এশিয়া থেকে আগত বিদেশি আর্য জাতি উত্তরাপথের অধিকাংশ অধিকার করেও মগধ ও বঙ্গের স্বাধীনতা হরণ করতে পারেননি। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ রচনাকালেও মগধ ও বঙ্গ বাহুবলে আপন স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। মহাভারত ও রামায়ণেও বাঙালি রাজাদের নাম আছে। স্বর্গীয় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেখিয়েছেন : ‘বুদ্ধদেবের জন্মের পূর্বে বাঙালিরা জলে ও স্থলে এত প্রবল হইয়াছিল যে, বঙ্গরাজ্যের একটি ত্যাজ্যপুত্র সাত শত লোক লইয়া নৌকাযোগে লঙ্কাদ্বীপ দখল করিয়াছিলেন।…প্রাচীন গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় যে বড় বড় খাঁটি আর্যরাজগণ, এমনকি যাঁহারা ভারতবংশীয় বলিয়া আপনাদের গৌরব করিতেন, তাঁহারাও বিবাহসূত্রে বঙ্গেশ্বরের সহিত মিলিত হইবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতেন।’
মগধ ও বঙ্গের শুদ্র অধিপতি মহাপদ্মনন্দই হচ্ছেন আর্যাবর্তের সর্বপ্রথম সম্রাট বা ‘একরাট’। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে দিগবিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডার যখন ভারতের পঞ্চনদ প্রদেশ অধিকার করেন, তখন বহু বিজ্ঞাপিত আর্যবীরগণ প্রাণপণেও তাঁর অগ্রগতি রুদ্ধ করতে পারেননি। সে-সময়ে আর্যাবর্তের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট বাস করতেন মগধবঙ্গের যুক্ত সাম্রাজ্যে। তাঁকে জয় না করলে ভারতবর্ষ জয় করা হয় না। অতএব আলেকজান্ডার মগধবঙ্গকে আক্রমণ করতে অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু গ্রিক ঐতিহাসিকেরই বর্ণনায় দেখি, মগধবঙ্গের শূদ্র রাজার মহাশক্তির কথা শুনে আলেকজান্ডার ভয় পেয়ে সমগ্র আর্যাবর্ত জয় করবার দুরাশায় জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চাৎপদ না হয়ে পারেননি।
মহারাজা শশাঙ্কের পরলোক গমনের অনেক পরেও দেখি, বাঙালির বাহুবল অধিকতর প্রবল হয়ে উঠেছে। অষ্টম শতাব্দীতে গৌড়-বঙ্গের অধীশ্বর ধর্মপাল উত্তরে দিল্লি ও জলন্ধর পর্যন্ত ও দক্ষিণে বিন্ধ্যগিরিশ্রেণি পর্যন্ত নিজের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেছিলেন। উপরন্তু বাঙালি সৈন্যদল জয়যাত্রায় বেরিয়ে রাজপুতানার কতক অংশ (ভোজদেশ ও মৎস্যদেশ), পাঞ্জাব (কুরু ও যদু), গান্ধার ও যবন, কীর (কাঙ্গড়া) ও অবন্তী (উজ্জয়িনী) প্রভৃতি দেশের রাজাদের অনায়াসে পরাজিত করেছিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে বারংবার দেখা গিয়েছে, প্রত্যেক দেশেই উন্নতি ও অবনতির এক-একটা যুগ আসে। কোথায় আজ প্রাচীন মিশর, পারস্য, গ্রিক, রোমীয়, তাতার ও আরব সাম্রাজ্য? এক জাতি ওঠে এবং এক জাতি পড়ে।
বাঙালির ক্ষাত্রবীর্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল মুসলমান অধিকারের যুগেই। কিন্তু বাঙালি কোনওদিনই নিঃশেষে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। মুসলমানরা যখন ভারতে অত্যন্ত প্রবল, তখনও স্বদেশের স্বাধীনতা-যজ্ঞে ইন্ধনের মতন আপন আপন জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাংলার প্রতাপ, সীতারাম, চাঁদ রায় ও কেদার রায় প্রভৃতি। তবু দুষ্ট রসনায় শুনি মিথ্যা কথা—বাঙালি ভীরু, বাঙালি যোদ্ধা নয়। একেই বলে অদৃষ্টের পরিহাস।
বার বার পড়েও চিন আবার দাঁড়িয়ে উঠছে। বাঙালিও পড়ে মরবে না, আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে।
অতঃপর আমাদের কাহিনির সূত্র ধরা যাক। মহারাজা শশাঙ্কের সৈন্যসজ্জা সমাপ্ত হল। বিপুল এক বাহিনী নিয়ে তিনি মালবরাজ দেবগুপ্তকে সাহায্য করবার জন্য অগ্রসর হলেন। তাঁর মনে আনন্দের সীমা নেই। এত দিন পরে তিনি লাভ করেছেন দিগবিজয়ে যাত্রা করবার যথার্থ সুযোগ। তাঁরও বুকের ভিতরে আজ যেন আবার জাগ্রত হয়েছে ভারতবিজয়ী সমুদ্রগুপ্তের অমর আত্মা।
দেবগুপ্ত আছেন কান্যকুব্জে। মগধবঙ্গ থেকে বহু—বহু দূরে। সেকালের কোনও সৈন্যদলই একালের মতো দ্রুতবেগে যুদ্ধযাত্রা করত না বা করতে পারত না। অশ্ব ও হস্তী অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে পথ পার হতে পারে বটে, কিন্তু কোনও বাহিনীই তো কেবল অশ্বারোহী, গজারোহী বা রথারোহী সৈন্য নিয়ে গঠিত নয়, সঙ্গে সঙ্গে থাকে অসংখ্য পদাতিকও এবং তাদেরও পিছনে ফেলে রেখে অগ্রসর হওয়া চলে না। তার উপরে সেকালের পথ-ঘাটের অবস্থাও ভালো ছিল না। কাজে-কাজেই যদিও শশাঙ্কের মন যাচ্ছিল বাতাসের আগে আগে, তবু তাঁর এবং সৈন্যদের দেহের গতি হল মন্থর।
অবশেষে শশাঙ্ক সদলবলে এসে উপস্থিত হলেন কান্যকুব্জের অনতিদূরে।
সেইখানে গুপ্তচরে মুখে শোনা গেল চরম এক দুঃসংবাদ!
যাঁকে সাহায্য করবার জন্য শশাঙ্ক নদ-নদী, পর্বত, কান্তার ও প্রান্তর অতিক্রম করে স্বরাজ্য ছেড়ে এত দূরে এসে পড়েছেন, সেই মালবরাজ দেবগুপ্ত ইতিমধ্যেই থানেশ্বররাজ রাজ্যবর্ধনের দ্বারা আক্রান্ত, পরাজিত ও নিহত হয়েছেন!
শশাঙ্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পেলে আঘাত। কিন্তু তিনি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন, এখন আর প্রত্যাগমন করা চলে না। তাহলে দেশব্যাপী নিন্দুকের জিহ্বা তাঁকে ‘কাপুরুষ’ বলে অখ্যাতি রটনা করবে। তার উপরে এখনও তাঁর প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি। দেবগুপ্ত আর তিনি একই বংশজাত। রাজ্যবর্ধন তাঁর আত্মীয় ও বন্ধুকে হত্যা করেছেন, তাঁকে শাস্তি না দিয়ে তিনি এ স্থান ত্যাগ করবেন না।
গুপ্তচরের দিকে ফিরে শশাঙ্ক শুধোলেন, ‘প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজশ্রী কোথায়?’
‘মহারাজা দেবগুপ্ত তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু তার পর তিনি যে কোথায় গিয়েছেন, কেউ তা জানে না।’
‘দুর্বল নারীর প্রতি সবল পুরুষের অত্যাচার হচ্ছে মহাপাপ। হতভাগ্য দেবগুপ্তকে হয়তো সেই পাপের জন্যেই নিজের প্রাণ দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে। চর, তুমি আর কোনও সংবাদ জানো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ! কিন্তু তাও সুসংবাদ নয়।’
‘কী রকম?’
‘থানেশ্বরের মহারাজা রাজ্যবর্ধন আপনার আগমন সংবাদ পেয়েছেন।’
‘এটা খুবই স্বাভাবিক। তার পর?’
‘তিনি আপনাকে আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন।’
‘তাঁর সৈন্যসংখ্যা জানো?’
‘জানি। তিনি দশ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে কান্যকুব্জ আক্রমণ করেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর সৈন্যসংখ্যা আরও কম। কারণ, মহারাজা দেবগুপ্তের সঙ্গে যুদ্ধে প্রায় তিন হাজার সৈন্য হতাহত হয়েছে।’
শশাঙ্ক নীরবে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ‘চর, তুমি মূল্যবান সংবাদ এনেছ। তোমাকে পুরস্কৃত করব। এখন যাও।’
গুপ্তচর অভিবাদন করে বিদায় নিলে।
শশাঙ্ক সহাস্যে মনে মনে বললেন, ‘আমার এক লক্ষ সৈন্যের বিরুদ্ধে রাজ্যবর্ধনের সাত হাজার সৈন্য। যুদ্ধে আমার জয় অনিবার্য’।