পঞ্চপ্রিয়া পাঞ্চালী
পঞ্চপাণ্ডব অত্যন্ত অশান্তিতে আছেন। ইন্দ্রপ্রস্থের ঐশ্বর্য ত্যাগ করে বার বৎসর বনবাস আর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করতে হবে, এজন্য নয়। এই কাল উত্তীর্ণ হলেও হয়তো দুর্যোধন রাজ্য ফেরত দেবেন না, তখন আত্মীয় কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, এজন্যও নয়। অশান্তির কারণ, পাঞ্চালী এক মাস তাঁর পঞ্চপতির সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করেছেন।
রাজ্যত্যাগের পর পান্ডবরা প্রথমে কাম্যকবনে এসেছিলেন, এখন দ্বৈতবনে নদীর তীরে আশ্রম নির্মাণ করে বাস করছেন। তাঁদের সঙ্গে পুরোহিত ধৌম্য এবং আরও অনেক ব্রাহ্মণ আছেন, সারথি ইন্দ্রসেন এবং অনান্য দাসদাসী আছে, দ্রৌপদীর সহচরী ধাত্রীকন্যা বালিকা সেবন্তী আছে। দ্রৌপদীর বিস্তর কাজ, বনবাসেও তাকে বৃহৎ সংসার চালাতে হয়। ভগবান সূর্যের দয়ায় তিনি যে তামার হাঁড়িটি পেয়েছেন তাতে রান্না সহজ হয়ে গেছে, দ্রৌপদীর না খাওয়া পর্যন্ত খাদ্য আপনিই বেড়ে যায়, সহস্র লোককে পরিবেশন করলেও কম পড়ে না। গৃহিণীর সকল কর্তব্যই দ্রৌপদী পালন করছেন, শুধু স্বামীদের সঙ্গে কথা বলেন না। কোনও অভাব হলে সেবন্তীই তা পাণ্ডবদের জানায়।
প্রায় চার মাস হল পাণ্ডবরা বনবাসে আছেন। এ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির প্রসন্ন মনে দিনযাপন করছিলেন, যেন বনবাসেই তিনি আজীবন অভ্যস্ত। ভীম প্রথম প্রথম কিছু অসন্তাোষ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু পরে বেশ প্রফুল্ল হয়ে মৃগয়া নিয়েই থাকতেন। অর্জুন নকুল সহদেবও রাজ্যনাশের দুঃখ ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি পাঞ্চালীর ভাবান্তর দেখে পাঁচজনেই উদবিগ্ন হয়েছেন।
দ্যুতসভায় অপমান আর রাজ্যনাশের দুঃখ দ্রৌপদী ভুলতে পারেন নি। তিনি প্রায়ই বিলাপ করতেন যে তাঁর জ্যেষ্ঠ পতির নির্বুদ্ধিতা এবং অন্যান্য পতির অকর্মণ্যতার জন্যই এই দুর্দশায় পড়তে হয়েছে। যুধিষ্ঠির তাকে শান্ত করবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন, ভীম বার বার আশ্বাস দিয়েছেন যে দুঃশাসনের রক্তপান আর দুর্যোধনের উরুভঙ্গ না করে তিনি ছাড়বেন না, অর্জুন নকুল সহদেবও তাকে বহুবার বলেছেন যে ত্রয়োদশ বর্ষ দেখতে দেখতে কেটে যাবে, তার পর আবার সুদিন আসবে। কিন্তু কোনও ফল হয় নি, দ্রৌপদী তাঁর রোষ দমন করতে না পেরে অবশেষে পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে কথা বন্ধ করেছেন।
দ্বৈতবন থেকে দ্বারকা বহু দূর, তথাপি কৃষ্ণ রথে চড়ে মাঝে মাঝে পাণ্ডবদের দেখতে আসেন, দু—একবার সত্যভামাকেও সঙ্গে এনেছেন। এবারে তিনি একাই এসেছেন। যুধিষ্ঠিরের কাছে সকল বৃত্তান্ত শুনে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর গৃহে এলেন।
কৃষ্ণ পাণ্ডবদের মামাতো ভাই, অর্জুনের সমবয়স্ক। সেকালে বউদিদি আর বউমার অনুরূপ কোনও সম্বোধন ছিল কিনা জানা যায় না। থাকলেও তার বাধা ছিল, কারণ সম্পর্কে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর ভাশুরও বটেন দেওরও বটেন। দ্রৌপদীর প্রকৃত নাম কৃষ্ণা, সেজন্য কৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে সখীসম্বন্ধ পাতিয়েছিলেন এবং দুজনেই পরস্পরকে নাম ধরে ডাকতেন।
অভিবাদন ও কুশলপ্রশ্ন বিনিময়ের পর কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, সখী কৃষ্ণা, তোমার চন্দ্রবদন রন্ধনশালার হন্ডিকার ন্যায় দেখাচ্ছে কেন?
দ্রৌপদী বললেন, কৃষ্ণ, সব সময় পরিহাস ভাল লাগে না।
কৃষ্ণ বললেন, তোমার কিসের দুঃখ? পাণ্ডবরা তোমার কোন অভাব পূর্ণ করতে পারছেন না তা আমাকে বল। সূক্ষ্ম কৌষেয় বস্ত্র আর রত্নাভরণ চাও? গন্ধ দ্রব্য চাও? এখানে শস্য দুর্লভ, তোমরা মৃগয়ালব্ধ মাংস আর বন্য ফল মূল শাকাদি খেয়ে জীবন ধারণ করছ, তাতে অরুচি হবার কথা, তার ফলে মনও অপ্রসন্ন হয়। যব গোধূম তণ্ডুল মুদগাদি চাও? দুগ্ধবতী ধেনু চাও? ঘৃত তৈল গুড় লবণ হরিদ্রা আর্দ্রক চাও? দশ বিশ কলস উত্তম আসব পাঠিয়ে দেব? পৈষ্টী মাধ্বী আর গৌড়ী মদিরা মৈরেয় আর দ্রাক্ষেয় মদ্য, সবই দ্বারকায় প্রচুর পাওয়া যায়। এখানে বোধ হয় তালরস ভিন্ন কিছুই মেলে না।
দ্রৌপদী হাত নেড়ে বললেন, ওসব কিছুই চাই না। মাধব, তুমি তো মহাপণ্ডিত, লোকে তোমাকে সর্বজ্ঞ বলে। আমার দুর্ভাগ্যের কারণ কি তা বলতে পার? আমার তুল্য হতভাগিনী আর কোথাও দেখেছ?
কৃষ্ণ বললেন, বিস্তর, বিস্তর। আমার যে কোনও পত্নীকে জিজ্ঞাসা করলে শুনবে তিনিই অদ্বিতীয়া হতভাগিনী, অনুপমা দগ্ধকপালিনী। তাঁরা মনে করেন আমিই তাঁদের সমস্ত আধিদৈবিক আধিভৌতিক আর আধ্যাত্মিক দুঃখের কারণ। কৃষ্ণা, দুঃশ্চিন্তা দূর কর। বিধাতা বিশ্বপিতা মঙ্গলদাতা করুণাময়।
—তুমি বিধাতার চাটুকার, তাঁর নিষ্ঠুরতা দেখেও দেখছ না, কেবল করুণাই দেখছ।
—যাজ্ঞসেনী, তুমি কেবল নিজের দুর্ভাগ্যের বিষয় ভাবছ কেন, সৌভাগ্যও স্মরণ কর। তুমি ইন্দ্রপ্রস্থের রাজমহিষী, তোমার তুল্য গৌরবময়ী নারী আর কে আছে? তোমার বর্তমান দুর্দশা চিরদিন থাকবে না, আবার তুমি স্বপদে প্রতিষ্ঠিত হবে। যজ্ঞের অনল থেকে তোমার উৎপত্তি, তুমি অপূর্ব রূপবতী, তোমার পিতা পঞ্চালরাজ দ্রুপদ বর্তমান আছেন, তোমার দুই মহাবল ভ্রাতা আছেন। তোমার পাঁচ বীরপুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে দ্বারকায় আমাদের ভবনে শিক্ষালাভ করছে। পাঁচ পুরুষসিংহ তোমার স্বামী, চার ভাসুর, চার দেবর—
ভাশুর দেবর আবার কোথায় পেলে? ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।
—ভাশুর আর দেবর তোমার কাছেই আছেন। কৃষ্ণা, এই শ্লোকটি কি তুমি শোন নি?—
পতিশ্বশুরতা জ্যেষ্ঠে পতিদেবরতানুজে।
মধ্যমেষু চ পাঞ্চাল্যাস্ত্রিতয়ং ত্রিতয়ং ত্রিষু।।
—জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব পাঞ্চালীর পতি ও ভ্রাতৃশ্বশুর (ভাশুর), কনিষ্ঠ পাণ্ডব পতি ও দেবর, মাঝের তিনজন প্রত্যেকেই পতি ভাশুর ও দেবর।
—তাতেই আমি ধন্য হয়ে গেছি?
—পাঞ্চালী, তুমি ক্রোধ সংবরণ কর। দোষশূন্য মানুষ জগতে নেই, যুধিষ্ঠির দ্যূতপ্রিয় ও সরলস্বভাব, তাই এই বিপদ হয়েছে। তিনি অনুতপ্ত, তাঁকে আর মনঃপীড়া দিও না। তোমার অন্য পতিরা যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাবহ, অগ্রজের মতের বিরুদ্ধে তাঁরা যেতে পারেন না। তাঁদের অকর্মণ্য মনে ক’রো না।
কৃষ্ণ আরও অনেক প্রবোধবাক্য বললেন, নানা শাস্ত্র থেকে ভার্যার কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন, কিন্তু পাঞ্চালীর ক্ষোভ দূর হল না। তখন কৃষ্ণ স্মিতমুখে বিদায় নিয়ে পাণ্ডবদের কাছে গেলেন।
একটি প্রকাণ্ড আটচালায় পুরোহিত ধৌম্য আর অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ বাস করেন। কৃষ্ণের আগমন উপলক্ষ্যে সেখানে একটি মন্ত্রণাসভা বসেছে। যুধিষ্ঠির ও তাঁর ভ্রাতারা কৃষ্ণকে সাদরে সেই সভায় নিয়ে গেলেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, পূজ্যপাদ ধৌম্য ও উপস্থিত বিপ্রগণ, আপনারা সকলে অবধান করুন। বাসুদেব কৃষ্ণ, তুমিও শোন। কৌরবসভায় লাঞ্ছনা ও রাজ্যনাশের শোকে পাঞ্চালীর চিত্তবিকার হয়েছে, পঞ্চপতির প্রতি তাঁর নিদারুণ অভিমান জন্মেছে, তিনি এক মাস আমাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করেন নি। এই দুঃসহ অবস্থার প্রতিকার কোন উপায়ে হতে পারে তা আপনারা নির্ধারণ করুন।
ধৌম্য বললেন, আমি বেদ পুরাণ ও ধর্মশাস্ত্র থেকে শ্লোক উদ্ধার করে পাঞ্চালীকে পতিব্রতা সহধর্মিণীর কর্তব্য বিষয়ে উপদেশ দিতে পারি, পাপের ভয়ও দেখাতে পারি।
কৃষ্ণ বললেন, দ্বিজবর, কিছুই হবে না। আমি এইমাত্র তাঁকে বিস্তর শাস্ত্রীয় উপদেশ শুনিয়ে এখানে এসেছি, আমার চেষ্টায় কোনও ফল হয় নি।
যুধিষ্ঠির বললেন, তবে উপায়?
পুরোহিত ধৌম্যের খুল্লতাত হৌম্য নামক এক তেজস্বী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ বললেন, পাঞ্চালীকে বিনীত করা মোটেই দুরূহ নয়। পাণ্ডবগণ স্ত্রৈণ হয়ে পড়েছেন, দ্রুপদ নন্দিনীকে অত্যন্ত প্রশ্রয় দিয়েছেন, পঞ্চভ্রাতা তাঁদের এই যৌথ কলত্রটিকে ভয় করেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, আমি অতি সুসাধ্য উপায় বলছি শুনুন। পাঞ্চালীই আপনাদের একমাত্র পত্নী নন। আপনার আর একটি নিজস্ব পত্নী আছেন, রাজা শৈব্যের কন্যা দেবিকা। ভীমের আরও তিন জন পত্নী আছেন, রাক্ষসী হিড়িম্বা, শল্যের ভগিনী কালী, কাশীরাজকন্যা বলন্ধরা। অর্জুনেরও তিন পত্নী আছেন, মণিপুররাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা, নাগকন্যা উলুপী, আর কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা। নকুলের আর এক পত্নী আছেন, চেদিরাজকন্যা করেণুমতী। সহদেবেরও আর এক পত্নী আছেন জরাসন্ধকন্যা, তাঁর নামটি আমার মনে নেই। পাঞ্চালীর এই ন জন সপত্নীকে সত্বর আনাবার ব্যবস্থা করুন। তাঁদের আগমনে দ্রৌপদীর অহংকার দূর হবে, আপনারাও বহু পত্নীর সহিত মিলিত হয়ে পরমানন্দে কালযাপন করবেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, তপোধন, আপনার প্রস্তাব অতি গর্হিত। দ্রৌপদী বহু মনস্তাপ ভোগ করেছেন, আরও দুঃখ কি করে তাঁকে দেব? আমাদের অনেক ভার্যা আছেন সত্য, কিন্তু তারা কেউ সহধর্মিণী পট্টমহিষী নন। আমরা এই যে বনবাসব্রত পালন করছি, এতে পাঞ্চালী ভিন্ন আর কেউ আমাদের সঙ্গিনী হতে পারেন না। কৃষ্ণ, সকল আপদে তুমিই আমাদের সহায়, পাঞ্চালী যাতে প্রকৃতিস্থ হন তার একটা উপায় কর।
একটু চিন্তা করে কৃষ্ণ বললেন, ধর্মরাজ, আমি যথোচিত ব্যবস্থা করব। আজ আমাকে বিদায় দিন, আমার এক মাতুল রাজর্ষি রোহিত এই দ্বৈতবনের পাঁচ ক্রোশ উত্তরে বানপ্রস্থ আশ্রমে বাস করেন। আমি তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে দু দিনের মধ্যে ফিরে আসব।
রথে উঠে কৃষ্ণ তার সারথি দারুককে বললেন, এখান থেকে কিছু উত্তরে জ্বলজ্জট ঋষির আশ্রম আছে, সেখানে চল।
ঋষির বয়স পঞ্চাশ। তাঁর দেহ বিশাল, গাত্রবর্ণ আরক্ত গৌর, জটা ও শ্মশ্রু অগ্নিশিখার ন্যায় অরুণবর্ণ, সেজন্য লোকে তাঁকে জ্বলজ্জট বলে। কৃষ্ণকে সাদরে অভিনন্দন করে তিনি বললেন, জনার্দন, তিন বৎসর পূর্বে প্রভাসতীর্থে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, ভাগ্যবশে আজ আবার মিলন হল। তোমার কোন প্রিয়কার্য সাধন করব তা বল।
কৃষ্ণ বললেন, তপোধন, আমার আত্মীয় ও প্রীতিভাজন পাণ্ডবগণ রাজ্যচ্যুত হয়ে দ্বৈতবনে বাস করছেন। সম্প্রতি তারা আর এক সংকটে পড়েছেন, তা থেকে তাঁদের মুক্ত করবার জন্য আপনার সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি। আপনার পরিচিতা কোনও নারী নিকটে আছে?
জ্বলজ্জট বললেন, নারী ফারী আমার নেই, আমি অকৃতদার। এই বিজন অরণ্যে নারী কোথায় পাবে? তবে হাঁ, অপ্সরা পঞ্চচূড়া মাঝে মাঝে তত্ত্বকথা শুনতে আমার কাছে আসে বটে। সে কিন্তু সুন্দরী নয়।
কৃষ্ণ বললেন, সুন্দরীর প্রয়োজন নেই। পঞ্চচূড়া চিৎকার করতে পারে তো? তা হলেই আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। এখন আমার প্রার্থনাটি শুনুন।
কৃষ্ণ সবিস্তারে তার প্রার্থনা জানালেন। জ্বলজ্জট অট্টহাস্য করে বললেন, বাসুদেব, লোকে তোমাকে কুচক্রী বলে, কিন্তু আমি দেখেছি তুমি সুচক্রী, তোমার উদ্দেশ্য সাধু। নিশ্চিত থাক, তোমার অনুরোধ নিশ্চয়ই রক্ষা করব। দুদিন পরে অপরাহ্ণকালে আমি পাণ্ডবদের আশ্রমে উপস্থিত হব।
প্রণাম করে কৃষ্ণ বিদায় নিলেন এবং আরও উত্তরে যাত্রা করে রাজর্ষি রোহিতের আশ্রমে এলেন। ইনি বলদেবজননী রোহিণীর ভ্রাতা, বানপ্রস্থ অবলম্বন করে সস্ত্রীক অরণ্যবাস করছেন। কৃষ্ণকে দেখে প্রীত হয়ে বললেন, বৎস, বহুকাল পরে তোমাকে দেখছি। তুমি এখানে কিছুদিন অবস্থান করে তোমার মাতুলানী ও আমার আনন্দবর্ধন কর। দ্বারকার সব কুশল তো?
কৃষ্ণ বললেন, পূজ্যপাদ মাতুল, সমস্তই কুশল। আমি আপনাদের চরণদর্শন করতে এসেছি, দীর্ঘকাল থাকতে পারব না, দুদিন পরেই বিশেষ প্রয়োজনে পাণ্ডবাশ্রমে আমাকে ফিরে যেতে হবে।
পাণ্ডবগণের পোষ্যবর্গ প্রায় দু শ, প্রতিদিন দু বেলা এই সমস্ত লোকের আহারের ব্যবস্থা করতে হয়। দ্বৈতবনে হাটবাজার নেই, তণ্ডুলাদি শস্য পাওয়া যায় না, কালে—ভদ্রে দরদ পুক্কশ প্রভৃতি প্রত্যন্তবাসীরা কিছু যব আর মধু এনে দেয়। মৃগয়ালব্ধ পশুর মাংস এবং স্বচ্ছন্দবনজাত ফল মূল ও শাকই পাণ্ডবগণের প্রধান খাদ্য।
প্রত্যহ প্রাতঃকৃত্য সমাপন করেই পঞ্চপাণ্ডব মৃগয়ায় নির্গত হন। আজ একটি বৃহৎ বরাহ দেখে তাঁরা উৎফুল্ল হলেন, কারণ বরাহমাংস তাদের আশ্রিত বিপ্রগণের অতিশয় প্রিয়। অর্জুন শরাঘাত করলেন, কিন্তু বিদ্ধ হয়েও বরাহ মরল না, বেগে ধাবিত হয়ে নিবিড় অরণ্যে মিলিয়ে গেল। তখন পঞ্চপাণ্ডব সকলেই শরমোচন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে নারীকণ্ঠে আর্তনাদ উঠল— হা নাথ, হতোহোম্মি!
তাঁদের শরাঘাতে কি স্ত্রীহত্যা হল? পাণ্ডবগণ ব্যাকুল হয়ে অরণ্যে প্রবেশ করে দেখলেন, বরাহ গতপ্রাণ হয়ে পড়ে আছে, কিন্তু আর কেউ নেই। চতুর্দিকে অন্বেষণ করেও তাঁরা কিছু দেখতে পেলেন না। ভীম বললেন, নিশ্চয় রাক্ষসী মায়া, মারীচ একই প্রকার চিৎকার করে শ্রীরামকে বিভ্রান্ত করেছিল।
যুধিষ্ঠির শঙ্কিত হয়ে বললেন, আশ্রমে শীঘ্র ফিরে চল, জানি না কোনও বিপদ হল কিনা। ভীম তুমি বরাহটাকে কাঁধে নাও।
সকলে আশ্রমে এসে দেখলেন, কোনও বিপদ ঘটে নি। পাঞ্চালী সূর্যদত্ত তাম্রস্থালীতে বরাহমাংস পাক করলেন, প্রচুর পরিমাণে ভোজন করে পরিতৃপ্ত হলেন।
অপরাহ্ণকালে একটি বৃহৎ অশ্বত্থ তরুর তলে সকলে বসেছেন, পুরোহিত ধৌম্য যম—নচিকেতার উপাখ্যান বলছেন। পাঞ্চালীও একটু পশ্চাতে বসে এই পবিত্র কথা শুনছেন। এমন সময় মূর্তিমান বিপদ রূপে জ্বলজ্জট ঋষি উপস্থিত হলেন। তাঁর জটা ও শ্মশ্রু অগ্নিজ্বালার ন্যায় ভয়ংকর, মুখ ক্রোধে রক্তবর্ণ, চক্ষু বিস্ফারিত ও ভ্রূকুটিকুটিল। হুংকার করে জ্বলজ্জট বললেন, ওরে রে নারীঘাতক পাপিবৃন্দ, আজ ব্রহ্মশাপে তোমাদের নরকে প্রেরণ করব!
যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, ভগবান, আমরা কোন মহাপাপ করেছি?
জ্বলজ্জট উত্তর দিলেন, তোমরা শরাঘাতে আমার প্রিয় ভার্যাকে বধ করেছ। ধিক তোমাদের ধনুর্বিদ্যা, একটা বরাহ মারতে গিয়ে ঋষিপত্নীর প্রাণ হরণ করেছ!
যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা কাতর হয়ে ঋষির চরণে নিপতিত হলেন। পাঞ্চালিও গলবস্ত্র হয়ে যুক্ত করে অশ্রুবর্ষণ করতে লাগলেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, প্রভু, আমরা অজ্ঞাতসারে মহাপাপ করে ফেলেছি! আপনি যে দণ্ড দেবেন, যতই কঠোর হক তাই শিরোধার্য করব।
দ্রৌপদী এগিয়ে এসে বললেন, মহামুনি, আমার স্বামীদের শরাঘাতে আপনার প্রিয়া ভার্যার প্রাণবিয়োগ হয়েছে, তার দণ্ড—স্বরূপ আপনি আমার প্রাণ নিয়ে এঁদের মার্জনা করুন। মধ্যম পাণ্ডব, তুমি চিতা রচনা কর, আমি অগ্নিপ্রবেশে প্রাণ বিসর্জন দেব।
জ্বলজ্জট আবার হুংকার দিয়ে বললেন, তুমি তো দেখছি অতি নির্বুদ্ধি রমণী! তোমার প্রাণ বিসর্জনে কি আমার পত্নী জীবিত হবে? আমি পত্নী চাই, এই দণ্ডেই চাই। পাণ্ডবরা আমাকে বিপত্নীক করেছে, আমি পাণ্ডবপত্নী পাঞ্চালীকে চাই। এই বলে জ্বলজ্জট মুনি উন্মত্তের ন্যায় নৃত্য করে ভূমিতে পদাঘাত করতে লাগলেন।
যুধিষ্ঠির যুক্ত করে বললেন, প্রভু, প্রসন্ন হ’ন, পাঞ্চালী ভিন্ন যা চাইবেন তাই দেব।—
ইয়ং হি নঃ প্রিয়া ভার্যা প্রাণেভ্যেঽপি গরীয়সী।
মাতেব পরিপাল্যা চ পূজ্যা জ্যেষ্ঠেব চ স্বসা।।
আমাদের এই প্রিয়া ভার্যা প্রাণাপেক্ষা গরীয়সী, মাতার ন্যায় পরিপালনীয়া, জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় মাননীয়া। এঁকে আমরা কি করে ত্যাগ করব? আপনি বরং শাপানলে আমাকে ভস্মীভূত করে ফেলুন, পাঞ্চালীকে নিষ্কৃতি দিন।
জ্বলজ্জট বললেন, অহো কি মূর্খ! তুমি পুড়ে মরলে পাঞ্চালী সহমৃতা হবে, অনর্থক নারীহত্যার নিমিত্তরূপে আমিও পাপগ্রস্ত হব। পাঞ্চালীকেই চাই।
ভীম করজোড়ে বললেন, তপোধন, আমি একটি নিবেদন করছি, শুনতে আজ্ঞা হক। আপনি জ্যেষ্ঠা পাণ্ডববধূ শ্রীমতী হিড়িম্বাকেই গ্রহণ করুন, পাঞ্চালীর পূর্বেই তাঁর সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছিল।
জ্বলজ্জট বললেন, তুমি অতি ধৃষ্ট দুষ্ট প্রতারক, একটা রাক্ষসীকে আমার স্কন্ধে ন্যস্ত করতে চাও!
ভীম বললেন, প্রভু, হিড়িম্বা রাক্ষসী হলেও যখন মানবীর রূপ ধরেন, তখন তাঁকে ভালই দেখায়। তাঁকে যদি যথেষ্ট মনে না করেন তবে আমাদের আরও আটজন অতিরিক্ত পত্নী আছেন, সব কটিকে নিয়ে পাঞ্চালীকে মুক্তি দিন। আমার ভ্রাতারা নিশ্চয় এতে সম্মত হবেন।
নকুল সহদেব সমস্বরে বললেন, নিশ্চয়, নিশ্চয়।
জ্বলজ্জট বললেন, তোমাদের অপর পত্নীরা এখানে নেই, অনুপস্থিত বস্তু দান করা যায় না। আমি এই মুহূর্তেই পত্নী চাই, পাঞ্চালীকেই চাই।
অর্জুন বললেন, প্রভু, ধর্মরাজ আর পাঞ্চালীকে নিষ্কৃতি দিন, আমাদের চার ভ্রাতাকে ভস্ম করে আপাতত আপনার ক্রোধ উপশান্ত করুন। এর পর অবসর মত একটি ঋষিকন্যার পাণিগ্রহণ করবেন।
জ্বলজ্জট বললেন, তোমরা সকলেই মূর্খ, তথাপি তোমাদের আগ্রহ দেখে আমি কিঞ্চিৎ প্রীত হয়েছি। তোমাদের ভস্ম করে আমার কোনও লাভ হবে না। আমি পত্নী চাই, যে আমার সেবা করবে। যদি নিতান্তই দ্রৌপদীকে ছাড়তে না চাও তবে তাঁর নিষ্ক্রয়স্বরূপ তোমরা পঞ্চভ্রাতা আজীবন আমার দাসত্বে নিযুক্ত থাক।
যুধিষ্ঠির বললেন, মহর্ষি, তাই হক, আমরা আজীবন দাস হয়ে আপনার সেবা করব।
ধৌম্য বললেন, মুনিবর, কাজটা কি ভাল হবে? তার চেয়ে বরং পঞ্চগব্য—ভক্ষণ চান্দ্রায়ণ ইত্যাদি প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করুন। অর্থ তো এঁদের এখন নেই, ত্রয়োদশ বর্ষের অন্তে রাজ্যোদ্ধারের পর যত চাইবেন এঁরা দেবেন।
জ্বলজ্জট প্রচণ্ড গর্জন করে বললেন, তুমি কে হে বিপ্র, আমাদের কথার উপর কথা কইতে এসেছ? ওরে কে আছিস, একটা দীর্ঘ রজ্জু নিয়ে আয়।
যুধিষ্ঠির বললেন, প্রভু, রজ্জুর প্রয়োজন নেই, আমাদের উত্তরীয় দিয়েই বন্ধন করুন।
জ্বলজ্জট যুধিষ্ঠিরাদি প্রত্যেকের কটিদেশে উত্তরীয়ের এক প্রান্ত বাঁধলেন এবং অপর প্রান্তের গুচ্ছ ধারণ করে পাণ্ডবাশ্রম থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। দ্রৌপদী আর্তনাদ করে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে গেলেন। ধৌমাদি বিপ্রগণ স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে রইলেন।
চেতনালাভের পর দ্রৌপদী দেখলেন তিনি তাঁর কক্ষে সেবন্তীর ক্রোড়ে মস্তক রেখে শুয়ে আছেন, কৃষ্ণ তাকে তালবৃন্ত দিয়ে বীজন করছেন।
দ্রৌপদী বললেন, হা পঞ্চ আর্যপুত্র, কোথায় আছ তোমরা?
কৃষ্ণ বললেন, কৃষ্ণা, আশ্বস্ত হও। পঞ্চপাণ্ডব নিরাপদে আছেন, তাঁরা অশ্বত্থ—তরুতলে উপবিষ্ট হয়ে পাপনাশের জন্য অঘমর্ষণ মন্ত্র জপ করছেন। তুমি একটু সুস্থ হলেই তোমাকে তাঁদের কাছে নিয়ে যাব।
—সেই ভয়ংকর ঋষি কোথায়?
—আর ভয় নেই। তিনি পঞ্চপাণ্ডবকে পশুর ন্যায় বন্ধন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, দৈবক্রমে পথে আমার সঙ্গে দেখা হল। আমি তাঁকে বললাম, তপোধন, করেছেন কি? এঁরা অকর্মণ্য বিলাসী ক্ষত্রিয়, আপনার কোনও কাজ করতে পারবেন না, অনর্থক অন্ন ধ্বংস করবেন। তিনি বললেন, না, পাঞ্চালীকেই এনে দাও। আমি উত্তর দিলাম, পাঞ্চালী আরও অকর্মণ্যা, আরও বিলাসিনী, শুধু নিজের প্রসাধন করতে জানেন। আমি ফিরে গিয়ে আপনাকে একটি কর্মিষ্ঠা ব্রজনারী পাঠিয়ে দেব। আপাতত আপনি পাঞ্চালীর নিষ্ক্রিয়স্বরূপ এই সবৎসা ধেনু নিন, দধি, দুগ্ধ, ঘৃতাদি খেয়ে বাঁচবেন। আমার মাতুল রাজর্ষি রোহিত এটি আমাকে উপহার দিয়েছেন। জ্বলজ্জট মুনি তাতেই সম্মত হয়ে পাঞ্চালীর পতিদের মুক্তি দিলেন।
দ্রৌপদী বললেন, ধন্য সেই ধেনু যার মূল্য পাণ্ডবমহিষীর সমান। কিন্তু ঋষিপত্নীহত্যার পাপ থেকে পাণ্ডবগণ মুক্তি পাবেন কী করে?
কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, ঋষিপত্নী হত্যা হয় নি। অপ্সরা পঞ্চচূড়া ঠিক তাঁর পত্নী নন, সেবাদাসী বলা যেতে পারে। বরাহ তাঁকে ঈষৎ দন্তাঘাত করেছিল, তিনি ভয়ে চিৎকার করে আশ্রমে পালিয়ে গিয়ে মূর্ছিত হয়েছিলেন। জ্বলজ্জট তাঁকে দেখে ভেবেছিলেন বুঝি মরে গেছেন। পাণ্ডবদের মুক্তিলাভের পর আমি ঋষির সঙ্গে তাঁর আশ্রমে গিয়ে দেখলাম পঞ্চচূড়া দোলনায় দুলছেন।
দ্রৌপদী বললেন, কৃষ্ণ, এখনই আমাকে পতিগণের সকাশে নিয়ে চল। হা, আমি অপরাধিনী, এক মাস তাঁদের উপেক্ষা করেছি, এখন কোন বাক্যে ক্ষমাভিক্ষা করব?
—পাঞ্চালী, ক্ষমা চেয়ে অনর্থক তাঁদের বিব্রত ক’রো না, তাঁরা তো তোমার উপর অপ্রসন্ন হন নি। বহুদিন পরে তোমার সম্ভাষণ শোনবার জন্য তাঁরা তৃষিত চাতকের ন্যায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন।
—গোবিন্দ, আমি তাঁদের কি বলব?
—পুরুষজাতি ভার্যার মুখে নিজের স্তুতি শুনলে যেমন পরিতৃপ্ত হয় তেমন আর কিছুতে হয় না। কৃষ্ণা, তুমি পঞ্চপাণ্ডবের কাছে গিয়ে তাঁদের স্তুতি কর।
—হা কৃষ্ণ, আমি তাঁদের গঞ্জনাই দিয়েছি, এই দগ্ধ মুখে স্তুতি আসবে কেন? কি বলব তুমিই শিখিয়ে দাও।
—সখী কৃষ্ণা, বাগদেবী তোমার রসনায় অধিষ্ঠান করবেন, তুমি আজ সর্বসমক্ষে অসংকোচে তাঁদের সংবর্ধনা কর। এখন আমার সঙ্গে পতিসন্দর্শনে চল। সেবন্তী, মাল্য প্রস্তুত হয়েছে?
সেবন্তী একটা ঝুড়ি দেখিয়ে বললে, এই যে। অন্য ফুল পাওয়া গেল না, শুধু কদম ফুলের মালা।
কৃষ্ণ বললেন, ওতেই হবে।
ধৌম্যাদি দ্বিজগণে বেষ্টিত হয়ে পঞ্চপাণ্ডব অশ্বত্থতরুমূলে উপবিষ্ট ছিলেন, তাঁদের মন্ত্রজপ সমাপ্ত হয়েছে। কৃষ্ণ সহিত দ্রৌপদীকে আসতে দেখে সকলে গাত্রোত্থান করলেন।
পঞ্চপাণ্ডবের প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ করে দ্রৌপদী কৃতাঞ্জলিপুটে পাষাণপ্রতিমার ন্যায় নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
কৃষ্ণ বললেন, পাঞ্চালী, তোমার মৌন ভঙ্গ কর।
পাঞ্চালী গদগদ কণ্ঠে বলতে লাগলেন। —দেবসম্ভব পঞ্চ আর্যপুত্র, পতিমহিমায় অভিভূত হয়ে আমি সম্ভাষণ করছি, যা মনে আসছে তাই বলছি, আমার প্রগলভতা ক্ষমা কর। পিতৃভবনে স্বয়ংবরসভায় ধনঞ্জয়কে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, ইনি লক্ষ্যভেদ করলে আনন্দে বিবশ হয়েছিলাম, এঁকেই পতিরূপে পাব ভেবে নিজেকে শতধন্য জ্ঞান করেছিলাম। কিন্তু বিধাতা আর গুরুজনরা আমার ইচ্ছা—অনিচ্ছার অপেক্ষা রাখেন নি, পঞ্চভ্রাতার সঙ্গে আমার বিবাহ দিলেন। অন্তর্যামী সাক্ষী, কিছুকাল পরেই আমার সকল ক্ষোভ দূর হইল, পঞ্চপতি আমার অন্তরে একীভূত হয়ে গেলেন। পঞ্চেন্দ্রিয়ের অনুভূতি যেমন পৃথক পৃথক এবং একযোগে অন্তঃকরণ রঞ্জিত করে সেইরূপ পঞ্চপতি স্বতন্ত্র ও মিলিতভাবে আমার হৃদয় উদভাসিত করেছেন।
পাণ্ডবাগ্রজ, ইন্দ্রপ্রস্থে যখন পট্টমহিষী ছিলাম, তখন বসনভূষণে ও প্রসাধনে আমি প্রচুর অর্থব্যয় করেছি, প্রিয়জনকে মুক্ত হস্তে দান করেছি। যখন যা চেয়েছি, তুমি তখনই তা দিয়েছ, প্রশ্ন কর নি, অপব্যয়ের জন্য অনুযোগ কর নি। দাসদাসীদের আমি শাসন করেছি, তোমার প্রিয় পরিচারকগণ আমার কঠোরতার জন্য তোমার কাছে অভিযোগ করেছে, কিন্তু তুমি কর্ণপাত কর নি, পাছে পাণ্ডব মহিষীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। তুমি শান্তিপ্রিয় ক্ষমাশীল ধর্মভীরু তোমার ধর্মাধর্মের বিচারপদ্ধতি না বুঝে আমি বহু ভর্ৎসনা করেছি, তথাপি এই অপ্রিয়বাদিনীর প্রতি ক্রুদ্ধ হও নি। অজাতশত্রু মহামান্য ধর্মরাজ, তোমার মহত্ত্ব বোঝবার শক্তি ক জনের আছে?
মধ্যম পাণ্ডব, তুমি জরাসন্ধবিজয়ী মহাবল, দুঃসাধ্য কর্মই তোমার যোগ্য, কিন্তু আমি ক্ষুদ্র বৃহৎ নানা কর্মে তোমাকে নিযুক্ত করেছি, আমার প্রতি প্রীতিবশে তুমি যেন ধন্য হয়ে সে সকল সম্পাদন করেছ। তুমি ভোজনবিলাসী রন্ধনবিদ্যায় পারদর্শী। ইন্দ্রপ্রস্থে বহুসংখ্যক নিপুণ সূপকার তোমার তৃপ্তিবিধান করত, কিন্তু এই অরণ্যাবাসে আমি যে সামান্য ভোজ্য এক পাকে রন্ধন করে তোমাকে দিয়ে থাকি তাতেই তুমি তুষ্ট হও, কখনও অনুযোগ কর না যে বিস্বাদ বা অতিলবণ বা ঊনলবণ হয়েছে। নরশার্দুল! তোমাদের সকলের চেষ্টায় রাজ্যোদ্ধার হবে, কিন্তু আমার লাঞ্ছনার যোগ্য প্রতিশোধ একমাত্র তুমিই নিতে পারবে। দুর্যোধন আর দুঃশাসনকে তাদের অন্তিম দশায় মনে করিয়ে দিও যে পাণ্ডবমহিষীকে নির্যাতন করে কেউ নিস্তার পায় না।
তৃতীয় পাণ্ডব! তুমি বয়োজ্যেষ্ঠ নও তথাপি তোমার ভ্রাতারা যুদ্ধকালে তোমারই নেতৃত্ব মেনে থাকেন। তুমি দেবপ্রিয় সর্বগুণাকর, অদ্বিতীয় ধনুর্ধর, দেবসেনাপতি স্কন্দতুল্য রূপবান, নৃত্যগীতাদি কলায় পটু, হৃষীকেশ কৃষ্ণ তোমার অভিন্নহৃদয় সখা। যখন সুভদ্রাকে বিবাহ করে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজপুরীতে এনেছিলে তখন আমি ক্ষুদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু সত্য বলছি, এখন আমার কোনো দুঃখ নেই। যে নারী পঞ্চপতির ভার্যা সে কোন অধিকারে সপত্নীকে ঈর্ষা করবে? সুভদ্রা আমার প্রিয়তমা ভগিনী, দ্বারকায় তার কাছে আমার পঞ্চপুত্রকে রেখে নিশ্চিন্ত আছি। পরন্তপ মহারথ, কুরুপাণ্ডবসমরে তুমিই পাণ্ডবসেনাপতি হবে, বাসুদেবের সহায়তায় বিপক্ষের সকল বীরকেই তুমি পরাস্ত করবে। কুরুপিতামহ ভীষ্ম আমার মহাগুরু, তোমাদের আচার্য দ্রোণ আমার নমস্য, কিন্তু দ্যুতসভায় তাঁরা রাজকুলবধুকে রক্ষা করেন নি, বীরের কর্তব্য পালন করেন নি, কাপুরুষবৎ নিশ্চেষ্ট ছিলেন। সব্যসাচী, সম্মুখ সমরে মর্মভেদী শরাঘাতে তাঁদের সেই কর্তব্যচ্যুতি স্মরণ করিয়ে দিও।
চতুর্থ পাণ্ডব, তুমি সুকুমারদর্শন বিলাসপ্রিয়, কিন্তু যুদ্ধে দুর্ধর্ষ। ইন্দ্রপ্রস্থে তুমি বিচিত্র পরিচ্ছদ, এবং বহু রত্নালংকার ধারণ করতে, কিন্তু এখানে আমাকে অল্পভূষণা দেখে তুমিও নিরাভরণ হয়েছ, গন্ধমাল্যাদি বর্জন করেছ। তোমার সমবেদনায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে তুমি দশার্ণ ত্রিগর্ত পঞ্চনদ প্রভৃতি বহু দেশ জয় করেছিলে। আগামী সমরেও তুমি জয়লাভ করে যশস্বী হবে।
কনিষ্ঠ পাণ্ডব! তুমি আমার পতি ও দেবর, প্রেম ও স্নেহের পাত্র, বিশেষভাবে স্নেহেরই পাত্র। বনযাত্রাকালে আর্যা কুন্তী আমাকে বলেছিলেন, পাঞ্চালী, আমার পুত্র সহদেবকে দেখো, সে যেন বিপদে অবসন্ন না হয়। নির্ভীক অরিন্দম। তুমি অবসন্ন হও নি, যুদ্ধের জন্য অধীর হয়ে আছ। পূর্বে তুমি মাহিষ্মতীরাজ দুর্মতি নীলকে এবং কালমুখ নামক নররাক্ষসগণকে পরাস্ত করেছিলে। দুরাত্মা কৌরবগণের সহিত যুদ্ধেও তুমি নিশ্চয় বিজয়ী হবে।
হে দেবপ্রতিম মহাপ্রাণ পঞ্চপতি! দেববন্দনাকালে দেবতার দোষকীর্তন কেউ করে না, তোমাদের দোষের কথাও এখন আমার মনে নেই। আজ আমার জন্য তোমরা জীবন দিতে উদ্যত হয়েছিলে, দাসত্ব বরণ করেছিলে। কোন নারী আমার তুল্য পতিপ্রিয়া? পতিনির্বাসিতা সীতা নয়, পতিপরিত্যক্তা দময়ন্তীও নয়। তোমরা অপর পত্নীদের পিত্রালয়ে রেখে কেবল আমাকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘ ত্রয়োদশ বৎসর যাপন করতে এসেছ, এক দুই বা তিন অখণ্ড পত্নীর পরিবর্তে আমার পঞ্চমাংশেই তুষ্ট আছ। কোন স্ত্রী আমার ন্যায় গৌরবিণী? কোন পতি তোমাদের ন্যায় সংযমী? বহুবর্ষপূর্বে পিতৃগৃহে বিবাহমণ্ডপে একই দিনে তোমাদের কণ্ঠে একে একে মাল্য দিয়েছিলাম, আজ এই অরণ্যভূমিতে মুক্তাকাশতলে একই ক্ষণে পুনর্বার দিচ্ছি। মহানুভব পঞ্চপতি, প্রসন্ন হও, স্নিগ্ধনয়নে আমাকে দেখ।
পাঞ্চালী পঞ্চপাণ্ডবের কন্ঠে মালা দিলেন, সেবন্তী শঙ্খধ্বনি করলে, বিপ্রগণ সাধু সাধু বললেন, কৃষ্ণ আনন্দে করতালি দিলেন। তারপর দ্রৌপদীর মস্তকে করপল্লব রেখে যুধিষ্ঠির বললেন, পাঞ্চালী, তোমাকে অতিশয় ক্লান্ত ও অবসন্নপ্রায় দেখছি, এখন স্বগৃহে বিশ্রাম করবে চল।
যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী প্রস্থান করলেন। কৃষ্ণকে অন্তরালে নিয়ে গিয়ে অর্জুন বললেন, মাধব, জ্বলজ্জট ঋষিটিকে পেলে কোথায়? তাঁর অভিনয় উত্তম হয়েছে, কিন্তু হাস্যদমনের জন্য তিনি বিকট মুখভঙ্গী করছিলেন। ভাগ্যক্রমে ধর্মরাজ, পাঞ্চালী ও আর সকলে তা লক্ষ্য করেন নি।
ভীম বললেন, ওহে কৃষ্ণ! একবার এদিকে এস তো। পাঞ্চালী বোধ হয় আর কখনও আমাদের গঞ্জনা দেবেন না, কি বল?
কৃষ্ণ বললেন, মাঝে মাঝে দেবেন বই কি, ওঁর বাকশক্তির তো কিছুমাত্র হানি হয় নি।
১৩৬০ (১৯৫৩)