পঞ্চদশ। তৈলহীন দীপ
মহারাজাধিরাজ শ্রীহর্ষবর্ধনের দুঃস্বপ্ন সত্যে পরিণত হতে বেশি দিন লাগল না।
চৈনিক পরিব্রাজক হুয়েন সাঙ ৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে যখন স্বদেশ যাত্রা করলেন, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল আর্যাবর্তের বাসিন্দারা। এই বৌদ্ধ পরিব্রাজকের অন্ধ ভক্ত হয়ে হর্ষবর্ধন ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছিলেন গোঁড়া বৌদ্ধের মতো। সেই জন্যে হুয়েন সাঙ হয়ে উঠেছিলেন দেশের লোকের চোখের বালির মতো।
বুদ্ধভক্ত অহিংসাবাদী সম্রাট প্রিয়দর্শী অশোকের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গেই বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের ভাঙন আরম্ভ হয় এবং তার পর অর্ধ শতাব্দী যেতে না যেতেই তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় (খ্রিঃ পূঃ ১৮৫)। আর্যাবর্তে হয় হিন্দু সামাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
ভারতে তখন হীনযান বৌদ্ধমত প্রচলিত ছিল। মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে-সঙ্গেই আরম্ভ হয় বৌদ্ধধর্মের অধঃপতন। শক বা কুশান সম্রাট কনিষ্কের (১২০-১৬০ খ্রিস্টাব্দ) যুগে তা আবার মাথা তোলবার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু কনিষ্কের মৃত্যুর পরে বৌদ্ধধর্মের উপরে ক্রমেই বেশি প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে হিন্দুধর্ম।
হর্ষবর্ধনের যুগে (৬০৬-৬৪৮ খ্রিস্টাব্দ) বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট অবনতি হলেও হুয়েন সাঙের বর্ণনায় দেখা যায়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন মঠ বা সঙ্ঘারামে তখনও বাস করতেন প্রায় দুই লক্ষ ভিক্ষু বা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী। সুতরাং সে সময়ে গৃহী-বৌদ্ধের সংখ্যা যে অগুনতি ছিল এটুকু অনুমান করা যেতে পারে অনায়াসেই।
বলা বাহুল্য, ওদের অধিকাংশই ছিল হীনযান সম্প্রদায়ের লোক। চৈনিক পরিব্রাজকের প্রভাবে পড়ে হর্ষবর্ধন গ্রহণ করলেন মহাযান সম্প্রদায়ের মত—যার প্রতি হীনযানীদের এতটুকু শ্রদ্ধা তো ছিলই না, উপরন্তু আক্রোশ ছিল যথেষ্ট। হিন্দুদের শাক্ত ও বৈষ্ণব এবং মুসলমানদের সিয়া ও সুন্নিদের মতো তখনকার হীনযানী ও মহাযানী বৌদ্ধদেরও মধ্যে দলাদলি ও হানাহানির অন্ত ছিল না। কাজেই বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী হয়েও হর্ষবর্ধন হীনাযানীদের তুষ্ট করতে পারলেন না।
একই অহিংসার মন্ত্র গ্রহণ করেও জৈনরা এখনকার মতন তখনও ছিলেন বৌদ্ধবিরোধী। হর্ষবর্ধনের বৌদ্ধপ্রীতি তাঁরাও সহ্য করতে পারতেন না।
হিন্দুদের তো কথাই নেই। হর্ষবর্ধন পৈতৃক হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেননি বটে, কিন্তু শিব ও সূর্যদেবের উপরে প্রাধান্য দিতেন বুদ্ধদেবকে। ব্রাহ্মণদের কাছে এটা ছিল অমার্জনীয় অপরাধ।
হর্ষবর্ধন সর্বধর্মসমন্বয়ের জন্যে চেষ্টা করেছিলেন কি না এতদিন পরে তা জোর করে বলা যায় না বটে, কিন্তু কী জৈন, কী হিন্দু—এমনকি বৌদ্ধ ধর্মেরও বৃহত্তর সম্প্রদায় পর্যন্ত তাঁর উপরে হয়ে উঠেছিল রীতিমতো খড়গহস্ত।
হুয়েন সাঙ দেশে ফিরে গেলেন। লোকে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবলে, হর্ষবর্ধন বোধহয় বৌদ্ধদের নিয়ে আর বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।
সত্য কথা বলতে কী, হর্ষবর্ধন অল্পবিস্তর বাড়াবাড়ি করতেও বাকি রাখেননি। বড় বড় ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা হুয়েন সাঙের মত অসার ও ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করবার জন্যে প্রায়ই তাঁকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করতেন। সে সময়েও (এখনকার মতো) তর্কের সময়ে হাতাহাতি হত যথেষ্ট।
কিন্তু হর্ষবর্ধন তাঁর প্রিয়পাত্রের প্রতিযোগীকে জয়লাভ করবার সুযোগ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না।
তিনি ঘোষণা করে দিয়েছিলেন : ‘যে কোনও ব্যক্তি চৈনিক গুরুর গায়ে হাত দেবে বা তাঁকে আহত করবে, তার প্রাণদণ্ড হবে। যে কোনও ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে কথা কইবে, তার জিভ কেটে ফেলা হবে। আর যারা তাঁর উপদেশবাণী শুনে লাভবান হতে চায় তাদের কোনও ভয় নেই।’
বলা বাহুল্য, এই ঘোষণার পর আর কোনও সাহসী পণ্ডিত হুয়েন সাঙের সঙ্গে তর্ক করতে অগ্রসর হননি। তর্কের খাতিরে জিহ্বাকে বলি দেওয়ার জন্যে কারুরই লোভ হতে পারে না।
কিছুদিন যায়। সাম্রাজ্যের কোথাও বহিঃশত্রু নেই। সিংহাসন নিষ্কণ্টক। বাণভট্টের সঙ্গে নিরুদবেগে কাব্যচর্চা করেন রাজকবি শ্রীহর্ষবর্ধন। এ জীবনের মতন তিনি কোশবদ্ধ করেছেন তরবারিকে। তাঁর কাছে রাঙা রক্তের চেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে কালো কালি।
বৌদ্ধ চিনসম্রাট হর্ষবর্ধনের সভায় এক রাজদূত পাঠালেন, নাম তাঁর ওয়াং-হিউএন-সি। দূতের সঙ্গে এল তিরিশ জন অশ্বারোহী দেহরক্ষী।
আবার একে চিনা দূত! জনসাধারণের মনে নতুন করে জেগে উঠল সন্দেহ ও অসন্তোষ। কে জানে, এই নবাগত কী গূঢ় উদ্দেশ্য নিয়ে পদার্পণ করেছে ভারতবর্ষে! এর কুমন্ত্রণা শুনে এবার হিন্দুদের মুখে ভালো করে কালি মাখাবার জন্যে মহারাজা হয়তো প্রকাশ্যেই গ্রহণ করবেন বৌদ্ধধর্ম।
পলাতক মন্ত্রী অর্জুনাশ্ব গোপনে কোথায় বসে দিন গুনছিল। এতদিন পরে এসেছে তার আত্মপ্রকাশের লগ্ন! সে রাজ্যের চারিদিকে গুপ্তচর পাঠিয়ে দিলে। তারা চুপি চুপি প্রচার করে বেড়াতে লাগল, ‘অতি বার্ধক্যে রাজার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, তিনি বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করে সনাতন হিন্দুধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করতে চান। প্রত্যেক হিন্দুর উচিত, এমন স্বধর্মবিদ্বেষী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা।’
তারপর ভারতের দুর্ভাগ্য নিয়ে এল এক দুর্দিন।
এক সঙ্ঘারামে বুদ্ধদেবের সন্ধ্যারতি দেখে হর্ষবর্ধন প্রাসাদে ফিরে আসছিলেন।
অন্ধকার ফুঁড়ে যমদূতের মতো বেরিয়ে এল একদল অস্ত্রধারী লোক। তারা হর্ষবর্ধনকে আক্রমণ করলে একসঙ্গে।
রক্ষীরা প্রাণপণে বাধা দিলে, কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারলে না। দলে তারা হালকা।
মহারাজাধিরাজ শ্রীহর্ষবর্ধনের রক্তাক্ত দেহ পৃথিবীর কোলে শুয়ে ত্যাগ করলেন অন্তিম নিশ্বাস।
মহাভারতের শেষ মহাবীর! আর্যাবর্তের শেষ হিন্দু সম্রাট!