নয়রাট

নয়রাট

দেশভ্রমণের সময় যারা ছন্নের মতো ছুটোছুটি করে– অর্থাৎ সকালে মিউজিয়ম, দুপুরে চিত্রশালা, বিকেলে গির্জেদর্শন, সন্ধ্যায় অপেরা, রাতদুপুরে কাবারে, আমি তাদের দলে নেই। দেশে ফেরার পর কোনও পাক্কা টুরিস্ট যদি আশ্চর্য হয়ে বলেন, ‘সে কী হে? তুমি আগে তিন দিন কাটালে অথচ বলছ রাজা কার্লের বর্মাভরণ-অস্ত্রশস্ত্রের মিউজিয়ম দেখনি– এ তো অবিশ্বাস্য’, আমি তা হলে তা নিয়ে তর্কাতর্কি করিনে কারণ মনে মনে জানি আমি প্রত্যেকটি কড়ির পুরো দাম তোলার জন্য দেশভ্রমণে বেরুইনি। ছয় পয়সার টিকিট আমাকে শ্যামবাজার পর্যন্ত নিয়ে যায়– আমি নামব হেদোয়– তাই আমাকে শ্যামবাজার পর্যন্ত গিয়ে সেখানে নেমে পায়ে হেঁটে ঘষ্টাতে ঘষ্টাতে হেদায় এসে বেঞ্চিতে বসে ধুঁকতে হবে নাকি? আট নম্বরের জুতো ছ টাকায় দিচ্ছে বলে আমার ছ নম্বরি পা-কে আট-নম্বরি পরাতে যাব নাকি?

তাই আমার উপদেশ ও কর্মটি করতে যাবেন না। খাওয়ার যেরকম সীমা আছে, ভালো জিনিস দেখারও একটা সীমা আছে। ক্লান্তি বোধ হলেই দেখা ক্ষান্ত দিয়ে একটা কাফেতে বসে যাবেন কিংবা যদি বাগানে বসবার মতো আবহাওয়া হয় তবে বাগানে বসে কফি, চা, বিয়ার কিছু একটা অর্ডার দিয়ে সিগারেটটি ধরিয়ে আরামসে গা এলিয়ে দেবেন।

এই হল জাবরকাটার মোকা। এ কদিনে যা কিছু দেখেছেন তার মধ্যে যে কটি মনে ঢেউ তুলেছিল সেই ঢেউগুলো শুনবেন। কিংবা বলব আপনার মনের ফিল্ম যে ছবিগুলো তুলেছিল তার গুটিকয়েক ডিভালাপ প্রিন্টিং করবেন, চোখ বন্ধ করে এক-একটা দেখবেন আর মনের ঘাড় নাড়িয়ে বলবেন, উত্তম হয়েছে, খাসা হয়েছে।

আমার পাশের টেবিলে দুই পাঁড় দাবাখেলনেওলা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে দাবা খেলছিলেন। দু কাপ কফি হিম হয়ে গিয়েছে– উপরে কফির ঘন সর পড়েছে। জামবাটি সাইজ অ্যাশ-ট্রে পোড়া সিগারেটে ভর্তি। আরও জন তিনেক লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে, কিন্তু কারও মুখে কথা নেই, এ দৃশ্য বাঙালিকে রঙ ফলিয়ে দেখাতে হবে না। কৈলাস খুড়োর যে ছবি শরৎচন্দ্র এঁকে গিয়েছেন তার দোহার গাইবার প্রয়োজন বাংলা দেশে বহুকাল ধরে হবে না।

খেলোয়াড়দের একজন দেখলুম ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে আসছেন। আধ ঘণ্টাতেই কাবু। হয়ে গেলেন। গজের কিস্তিতে যখন মাত হবু হবু, তখন ঘাড়গর্দানে ‘শ্রাগ’ করে বললেন, ‘স্পাঞ্জ ফেলে দিলুম’, অর্থাৎ আমার খেলা গয়াগঙ্গা-গদাধরহরি।

দর্শকদের একজন তখন মিনমিনিয়ে বললেন, “কেন? ওই বড়েটা একঘর ঠেলে দিলে হয় না?’

খাসা চাল তো! ওদিকে কারও নজরই যায়নি। এ চালে আরও খানিকক্ষণ লড়াই দেওয়া যেতে পারে।

খেলোয়াড়টি উঠে দাঁড়িয়ে দর্শককে বললেন, ‘আপনি তা হলে বসুন।’ দর্শক তখন খেলোয়াড়রূপে বসে প্রথম সামলালেন আপন ঘর, তার পর দিতে আরম্ভ করলেন ধীরে ধীরে চাপ। পষ্ট বোঝা গেল ইনি উচ্চাঙ্গের লেঠেল। এবার অন্য পক্ষের প্রাণ যায় আর কি। শেষটায় তাই হল। পয়লা বারের কসাই এবারে বকরি হয়ে বললেন— ‘যা বললেন তার অর্থ “হরিবোল বল হরি!” ’

আমরা লক্ষ করিনি– কে-ই বা এরূপ স্থলে করে– আরও জনতিনেক দর্শক তখন বেড়ে গিয়েছেন। তাদেরই একজন তখন মিনমিনিয়ে বললেন, “কেন গজটা পেছিয়ে নিলে হয় না?’।

এ চালের অর্থটা আমার কাছে ধরা পড়ল না। কিন্তু কসাই দেখলুম ধরতে পেরেছেন। শুধু বললেন, ‘হু।’ তখন পয়লা বারের কসাই, দুসরা বারের বকরি উঠে বললেন, ‘আপনি তা হলে বসুন।’

অর্থাৎ খোল-নলচে দুই-ই তখন বদলে গিয়েছে।

এবারে সত্যি সত্যি লাগল মোষের লড়াই।

শেষটায় খেলা চাল-মাত হল।

***

ফিরে এসে আপন চেয়ারে বসলুম।

খেলোয়াড়দের একজন তখন পাশ দিয়ে যাচ্ছেন। এক চণ্ডু-খানায় যখন এতক্ষণ একসঙ্গে আফিং খেয়েছি তখন খানিকটে পরিচয় হয়ে গিয়েছে বই কি একটা ছোট নড় করলুম। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘সুপ্রভাত।’

আমি বললুম, ‘বসুন, বসুন।’

 ঝুপ করে বসে পড়ে বললেন, ‘ “বসুন”, “হুঁহ, “বসুন”। ওদিকে আমার প্রাণ যায় আর কি।’

আমি শুধালুম, ‘কেন, কী হয়েছে?’ বুঝলুম লোকটি দিলখোলা।

বললেন, ‘জবাই করবে, মশাই, জবাই করবে আমাকে বউ। বলেছিলুম, এই এলুম বলে। কী করে জানব বলুন, দাবার চক্করে পড়ে যাব। বলতে পারেন, মশাই, এই বিদ্ঘুটে খেলা বের করেছিল কে? হাঁ, হাঁ ভারতবর্ষেই তো এর জন্মভূমি। কিন্তু এদেশে এল কী করে?’

‘শুনেছি পারসিকরা আমাদের কাছ থেকে শেখে, আরবরা তাদের কাছ থেকে, তার পর ক্রুসেডের লড়াইয়ের বন্দি ইয়োরোপীয়রা শেখে আরবদের কাছ থেকে, তারা দেশে ফিরে—’

 ‘আমাদের মজালে। কিন্তু এখন আমার উপায় কী? আপনারা এ অবস্থায় দেশে কী করেন?’

‘চাঁদ-পানা মুখ করে গাল সই।’

‘ব্যস! ব্যামোটা বাধিয়ে বসে আছেন ঠিক; ওষুধটা বের করতে পারেননি। কিন্তু আমি পেরেছি। চলুন, আমার সঙ্গে, লঞ্চ খাবেন।’

‘আর গালও খাব? না?’

‘না, না, আপনাকে বকবে কেন? আমি বলব, এর সঙ্গে গল্প করতে করতে কী করে যে বেলা বয়ে গেল ঠাহর করতে পারিনি। চলুন চলুন, আর দেরি করা নয়।’

চললুম।

ভদ্রলোকের বয়স– এই ধরুন ৪৫-৪৬, স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ, পরনে উত্তম রুচির কোট-পাতলুন-টাই। সবকিছু পরিপাটি। তাই অনুমান করলুম তাঁর অর্ধাঙ্গিনী তাঁকে বকুন-ঝকুন আর যা-ই করুন না কেন, গৃহিণী হিসেবে তিনি ভালোই।

বললেন, ‘যা খুশি তাই বউকে বলে যাবেন, কিচ্ছু ভয় করবেন না। তাঁকে যদি ভুলিয়ে-ভালিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী বানিয়ে সিংহলে পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাতেও আমি কোনও আপত্তি করব না, কিন্তু স্যর, দয়া করে ওই দাবা খেলার কথাটি চেপে যাবেন।’

আমি বললুম, ‘নিশ্চয়ই।’

দরজা খুলে দিলেন স্বয়ং স্ত্রী। কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার পূর্বেই ভদ্রলোক আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘ইনি আমার স্ত্রী, ফ্রানৎসিসকা- ফ্রানৎসিদকা নয়রাট।’ আমি বললুম, ‘আমার নাম আলী।’

ফ্রানৎসিসকার বয়স ৩৫-৩৬ হবে। সুইটজারল্যান্ডে এই বয়সে মেয়েদের পূর্ণ যুবতী বলে ধরা হয়। এ যৌবনে কুমারীর রূপের নেশা আর মাতৃত্বের-মাধুরী মিশে গিয়ে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে তার রস মানুষ নির্ভয়ে উপভোগ করতে পারে– স্বামী সন্দেহের চোখে দেখে না, রমণী আপনার চোখে চটক লাগাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে না। মেয়েদের আচরণ এ সময় সত্যই বড় মধুর হয়; কখনও তারা তরুণীর মতো ভাবে বিহ্বল আত্মহারা হয়ে অকারণ বেদনার কাহিনী বলে যায়, কখনও আবার মাতৃত্বের গর্ব নিয়ে আপনাকে নানা সদুপদেশ দেয়, বিয়ে-থা করে ঘরসংসার পাতবার জন্য স্নিগ্ধচোখে অনুনয়-বিনয় করে।

স্ত্রীকে কিছু বলতে না দিয়েই হার নয়রাট বকে যেতে লাগলেন, ‘বুঝলে ফ্রানৎসিসকা, আমি ঠিক সময়েই ফিরে আসতুম কিন্তু এই হার আলীর সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। ইনি ভারতবর্ষের লোক শুনেছ তো ভারতবর্ষের লোক কিরকম গুণী-জ্ঞানী হয়। ইনি তাদের একজন। তার প্রমাণও আমি হাতে-নাতে পেয়ে গিয়েছি। রাস্তায় আসতে আসতে তাঁকে জিগ্যেস করে জানতে পেলুম, সাতদিন ধরে এসেছেন জিনিভায়, এখনও লিগ অব নেশনসের ‘চিড়িয়াখানা দেখতে যাননি, শামুনি চড়েননি, অপেরা-থিয়েটার কিছুই দেখেননি। আর সব টুরিস্টদের মতো সুইটজারল্যান্ডের প্রত্যেক দ্রষ্টব্য বস্তুকে পিঁপড়ে নিঙড়ে ঘি বের করবার জন্য উঠে পড়ে লাগেননি। আমার তো মনে হয়, এ দেশের উচিত এঁকে এঁর খরচার পয়সা কিছু ফেরত দেওয়া। কী বল?’

পাছে ভদ্রমহিলার অভিমানে ঘা লাগে, আমি তার দেশের কুতুব তাজ ভারতীয় দম্ভের নেশায় তাচ্ছিল্য করছি তাই তাড়াতাড়ি বললুম, “আমি বড় দুর্বল, বেশি ঘোরাঘুরি করলে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আস্তে আস্তে সবকিছুই দেখে নেব।’

ফ্রানৎসিসকা বললেন, “সেই ভালো। শামুনিকস পাহাড় তো আর বসন্তের বরফ নয় যে দু দিনে গলে যাবে, সুইটজারল্যান্ডে ভ্রমণ তো আর দাবা খেলা নয় যে সুযোগ পেয়েও দুটি কিস্তি না দিলে-’

বাকিটা আমি আর শুনতে পাইনি। আমি তখন ওয়ালপেপার হয়ে দেওয়ালের সঙ্গে মিশে যাবার জন্য আস্তে আস্তে পিছুপা হতে আরম্ভ করেছি।

শুনি, হ্যার নয়রাট ব্যথাভরা সুরে বলছেন, “গিন্নি, ছিঃ।’

আমার অবস্থা তখন এক মাতাল আরেক স্যাঙাত মাতালকে সাফাই গাইবার জন্য নিয়ে এসে ধরা পড়লে যা হয়।

নাহ। ভুল করেছি। ফ্রানৎসিসকার কামড়ানোর চেয়ে ঘেউ ঘেউটাই বেশি। বলল, “আহ, আপনারাও যেমন। মেয়েছেলে এরকম দু একটা কথা সবসময়েই কয়ে থাকেন– ওসব কি গায়ে মাখতে আছে? তুমি দাবা খেলায় দু একটা আজেবাজে চাল মাঝে মাঝে দাও না দুশমন কী করে তাই দেখবার জন্য?’

আবার দাবা! খেয়েছে।

ফ্রানৎসিসকা স্বামীকে বললেন, “আজ তো লাঞ্চের ব্যবস্থা বড় মামুলি। সুপ ফিশ আ লা র‍্যুস (রাশান কায়দায়) আর অ্যাপল টার্ট উইথ হুইপট ক্রিম। তার চেয়ে বরঞ্চ চল রেস্তোরাঁয়– জিনিভা লেকের মাছ সুইস কায়দায় রান্না– ভালোমন্দ এটা-সেটা।’ তার পর আমার দিকে তাকিয়ে শুধালেন, ‘আপনি কী খেতে ভালোবাসেন?’

আমি নির্ভয়ে বললুম, ‘সুপ, ফিশ আ লা ব্ল্যুস, অ্যাপল টার্ট উইথ হুইপট ক্রিম।’

হ্যার নয়রা তো আনন্দে গদগদ। বললেন, “দেখলে গিন্নি, কীরকম অদ্ভুত আদব-কায়দা। তুমি যদি বলতে আজ রেঁধেছি, স্ট্রিকনিন-সুপ, পটাসিয়াম সায়ানাইড ফ্রাইড, আর্সেনিক-পুডিং আর কোবরা-রসের কফি তা হলে উনি বলতেন, “দি আইডিয়া, আমি দু বেলা ওই জিনিসই খাই”।

ফ্রানৎসিসকা বললেন, “দেখো, পেটার, বিশ্বসংসারের লোককে তুমি আপন মাপকাঠি দিয়ে মেপ না। তোমার মতো ওঁর পেট অজুহাতের মানওয়ারি জাহাজ নয়।’

পেটার বললেন, ‘সব দাবা খেলোয়াড়কেই অজুহাত-বিদ্যে আয়ত্ত করতে হয়। বিয়ের পরেই যেরকম হনিমুন, দাবা খেলার পরই সেইরকম অজুহাত অন্বেষণ!’

আমি বললুম, ‘কিন্তু আমি তো দাবা খেলিনে।’

কথা শুনে দু জনাই খানিকক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শেষটায় পেটার বললেন, ‘দেখলে গিন্নি, অজুহাতের রাজা কারে কয়? একদম কবুল জবাব, উনি দাবা খেলেন না! বাপস! মারি তো হাতি লুটি তো ভাণ্ডার। অজুহাত যদি দিতেই হয় তবে এমন একখানা ঝাড়ব যে মানুষ রা কাড়বার ফাঁকটি পাবে না। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে দেখলেন আমাদের খেলা, আর এখন অম্লান বদনে বলছেন উনি দাবা খেলেন না।’

আমি সবিনয়ে শুধালুম, ‘আপনি কনসার্ট শুনতে যান? আচ্ছা, সেখানে তো পাকি সাড়ে তিন ঘণ্টা বাজনা শোনেন; তাই বলে কি আপনি পিয়ানো, ব্যালা, চেলো কত্তাল বাজান?’

ওদিকে দেখি, ফ্রানৎসিসকা আমাদের তর্কাতর্কিতে কান দিচ্ছেন না; শুধু বললেন, ‘তাই বল, দাবা খেলা হচ্ছিল।’

চাণক্য বান্ধবের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “উৎসবে, ব্যসনে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে যে সঙ্গ দেয় সে বান্ধব।’ আমার বিশ্বাস চাণক্য কখনও বিয়ে করেনি। তা না হলে তিনি ‘রাজদ্বারে’ না বলে ‘জায়াদ্বারে’ বলতেন।

জানি, অতিশয় অভদ্রতা হল– তবু বললুম, “আমার ক্ষিদে পেয়েছে।’

 বন্ধুর ফাঁসিটাকে মুলতবি করাতে পারলুম– এই বা কী কম সান্ত্বনা!

***

আমরা বাড়িতে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে যেরকম হাপুসহুপুস শব্দ করে আহারাদি সমাপন করি, নেমন্তন্ন, খেতে গিয়েও প্রায় সেইরকমই করে থাকি। তফাত মাত্র এইটুকু যে, বাড়িতে চিৎকার করে বলি, ‘আরও দু খানা মাছভাজা দাও’ নেমন্তন্ন বাড়িতে বলি, ‘চৌধুরী মশাইকে আরও দু খানা মাছভাজা দাও।’

সায়েব-সুবোদের কিন্তু বাড়ির খাওয়াতে, রেস্তোরাঁয় আহারে এবং নেমন্তন্নের ভোজনে ভিন্ন ভিন্ন কায়দা-কেতায় খাওয়াদাওয়া করতে হয়। সায়েবরা বাড়িতে খেতে বসে গোগ্রাসে গোস্ত গেলে আর পোশাকি ডিনারে কিংবা ব্যানকুয়েটে একরকম না খেয়েই বাড়ি ফেরে। ব্যানকুয়েটে আপনাকে সুপ দেওয়া হবে আড়াই চামচ, তার থেকে আপনি পাবেন দেড় চামচ। ডিনারে সুপ খেয়ে ন্যাপকিন দিয়ে মোলায়েম কায়দায় ঠোঁট ব্লট করবেন, কিন্তু ডুক অব উইন্ডসরের সঙ্গে ব্যানকুয়েট খেতে বসলে ঠোঁট ব্লট করাও নিষিদ্ধ, অর্থাৎ তখন ধরে নেওয়া হয়, আপনি এতই কম সুপ খেয়েছেন যে আপনার ঠোঁট পর্যন্ত ভেজেনি। তার পর পদের পর পদ উত্তম উত্তম খাদ্য আসবে আপনি আপন প্লেটে তুলে নেবেন কখনও আড়াই আউল, কখনও দু আউন্স এবং খাবেন তার থেকে এক আউন্স কিংবা তার চেয়েও কম। মুরগির হাডিড থেকে যে ছুরি দিয়ে মাংস চাঁচবেন তার উপায় নেই এবং গ্রেভিটুকুর মোহ করছেন কী মরেছেন। সাইড প্লেটে যে এক স্লাইস টোস্ট দিয়েছিল তার এক-দশমাংশের বেশি খেলে পাঁচজনে ভাববে, আপনি রায়লসিমার দুর্ভিক্ষপীড়িত ‘পারিয়া’ কিংবা মধ্য-আফ্রিকার মিশনারি-খেকো হটেনটট।

বিশ্বাস করবেন না, এক খানদানি ক্লাবে আমি দুই পক্ষকে পাকি দু ঘণ্টা ধরে তর্কাতর্কি করতে শুনলুম, সসেজ কী করে খেতে হয়। সমস্যাটা এইরূপ : (ক) সসেজ থেকে ছুরি দিয়ে। চাক্তি কেটে নিয়ে তার উপর মাস্টার্ড মাখাবে কিংবা (খ) প্রথম সসেজের ডগায় মাস্টার্ড মাখিয়ে নিয়ে পরে সসেজ থেকে চাক্তি কেটে তুলবে? আমি প্রথম পক্ষের হয়ে লড়াই করেছিলুম এবং শেষটায় আমরা ভোটে হেরে গেলুম। এর থেকেই বুঝতে পারছেন, আমি খানদানি খানা খেতে শিখিনি– ব্যানকুয়েটে আমার নাভিশ্বাস ওঠে।

বিশ্বাস করবেন না, মাসখানেক হল এক সুইস খবরের কাগজে দেখি, এক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেছেন, প্লেটে যে গ্রেভি পড়ে থাকে, তার উপর রুটি টুকরো টুকরো করে ফেলে সেই গ্রেভি চেটেপুটে নেওয়া (জর্মন শব্দ (tunken) ব্যাকরণসম্মত–অর্থাৎ কায়দাদুরস্ত– কি না?

উত্তরে এক ‘খানদানি মনিষ্যি’ বলেছেন, কিছুকাল পূর্বেও এ অভ্যাস কি বাড়িতে কি রেস্তোরাঁয়, কি ব্যানকুয়েটে সর্বত্রই অতিশয় নিন্দনীয় বলে গণ্য করা হত, কিন্তু আজকের বিশ্বময় খাদ্যাভাবের দিনে বাড়িতে আপন ডাইনিং রুমে– কর্মটি ক্ষমার্হ।

মুরগির ঠ্যাংটি হাতে তুলে নিয়ে ‘কড়কড়ায়তে, মড়মড়ায়তে’ বাড়িতে বেশির ভাগ ইউরোপীয়ই করে, কিন্তু বাইরে নৈব নৈব চ। তবে কোনও কোনও জর্মন এবং সুইস রেস্তোরাঁয় রোস্ট সার্ভ করবার সময় মুরগির ঠ্যাংগুলো উপরের দিকে সাজিয়ে রাখে এবং ঠ্যাংগুলের ডগায় বাটার পেপারের ক্যাপ পরিয়ে দেয়, যাতে করে আপনি হাত নোংরা না করে ঠ্যাংটা চিবুতে পারেন। এ ব্যবস্থা দেখে ইংরেজের জিভে জল আসে, কিন্তু সেটা চেপে গিয়ে বলে, ‘জর্মনরা বর্বর!’

অপিচ এসপেরেগাস এবং আর্টিচোক ছুরি-কাঁটা দিয়ে খাওয়া গো-হত্যার ন্যায় মহাপাপ খেতে হয় হাত দিয়ে।

ইংরেজ যদিস্যাৎ কখনও রাইস কারি কিংবা ইটালিয়ান রিসোট্রো (একরকমের কিমা পোলাও) খায়, তবে টেবিল কিংবা ডেসার্ট শুন দিয়ে সে খাদ্য মুখে তোলে। তাই দেখে ফরাসি-ইতালি আঁতকে ওঠে বলে, কী বর্বরতা! একটা আস্ত চামচ মুখে পুরছে– বাপ। তারা রাইস কারি খায় ডান হাতে কাটা নিয়ে বিনা ছুরিতে। তাই দেখে চীনা ভদ্রসন্তান আবার ভিরমি যায়। বলে, একটা আস্ত ফর্ক মুখে ঢোকাচ্ছে– কী বর্বরতা! তার চেয়ে চপস্টিক কত পরিষ্কার, কত পরিপাটি।

আর বঙ্গসন্তান আমি বলি, এ সবকটা পদ্ধতিই বর্বর না হোক, অন্তত নোংরা। ফর্ক, স্পুন, এমনকি চপস্টিক পর্যন্ত আমার আপন আঙুলের চেয়ে ঢের নোংরা। সবচেয়ে বঢ়িয়া হোটেলের স্পন নিয়ে আপনি আচ্ছাসে ন্যাপকিন দিয়ে ঘষুন দেখতে পাবেন ন্যাপকিন কালো হয়ে গেল। অথচ আপনি হাত ধুয়ে যে খেতে বসেন, তখন কাপড়ে আঙুল ঘষলে কাপড় ময়লা হয় না।

কিন্তু আমার প্রধান আপত্তি টেবিলে বসে খাওয়াতে। টেবিল ক্লথ বাঁচিয়ে, ছুরি-কাঁটা না বাজিয়ে, জল খাওয়ার সময় গ্লাসে ঠোঁটের দাগ না লাগিয়ে, টেবিলের তলায় পাশের কিংবা সামনের লোকের পায়ে গুত্তা না মেরে আপন গেলাস আর পরের গেলাসে খিচুড়ি না পাকিয়ে, আঁত্রের ফর্ক আর জয়েন্টের ফর্কে গোলমাল না বাধিয়ে, প্লেট শেষ হওয়ার পূর্বেই ছুরি-কাটা পাশাপাশি না রেখে, ডাইনে-বাঁয়ে সবকিছু রবিরবাদ না করে, এবং আহারান্তে ঘোঁত ঘোঁত করে ঢেকুর না তুলে আহার করা আমার পক্ষে কঠিন, সুকঠিন। বিলিতি ডিনার খেতে পারেন মাত্র ম্যাজিশিয়ানরাই যাঁদের হাতসাফাই আছে, যারা চিড়িতনের টেক্কাকে বেমালুম হরতনের নয়লা বানিয়ে দিতে পারেন।

এবং সবচেয়ে গর্ভ-যন্ত্রণা, খাওয়ার দিকে আপনি সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারবেন না। এর সঙ্গে ওর সঙ্গে আপনাকে মধুর মধুর বাক্যালাপ করতে হবে। আবহাওয়া থেকে আরম্ভ করে আপনাকে রিলেটিভিটি পর্যন্ত কপচাতে হবে। আবার শুধু গল্প করলে চলবে না– সঙ্গে সঙ্গে খেতে হবে। এর পরিমাণ ঠিক রাখা সে-ও এক কঠিন কর্ম। আপনি যদি প্রধান অতিথি হন, তবে আপনাকে বকর বকর করতে হবে বেশি, যদি আমার মতো ব্যাক-বেঞ্চার হন, তবে চুপ করে সবকিছু শুনে যেতে হবে– তা সে যতই নিরস নিরানন্দ হোক না কেন?

বলুন তো মশাই, ভোজনের নেমন্তন্ন কি এগজামিনেশন হল?

***

 নয়রাট লোকটি খুশগল্প করে ঘরবাড়ি জমজমাট করে রাখতে চান সেকথাটা দু মিনিটেই বুঝে গেলুম, আর গৃহিণীর ভাবসাব দেখে অনুমান করলুম ইনিও সাদাসিধে লোক, লৌকিকতার বড় ধার ধারে না। খানা-টেবিলের পাশে পৌঁছেই বললেন, “এ বাড়িতে পোলিশ গভর্নমেন্ট, (পোলান্ডের ইতিহাসে এত ঘন ঘন অরাজকতা আর বিদ্রোহ হয়েছে যে, জর্মন ভাষায়, ‘পোলিশ গবর্নমেন্ট’ বলতে ‘এলো-মেলো’ ‘ছন্নছাড়া’ বোঝায়) যে যেখানে খুশি বসতে পারেন।’

নয়রাট বাধা দিয়ে বললেন, “সে কী করে হয়? আমি বসব আমার পশ্চাদ্দেশের উপর, তুমি বসবে–।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা রাগ করে বললেন, “ছিঃ, পেটার, ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে এই আজ সকালে; আর এরই ভিতর তুমি আরম্ভ করে দিয়েছ যত সব অশ্লীল কথা! তার ওপর উনি আবার বিদেশি।’

নয়রাট বললেন, “দেখ প্রিয়া, তুমি অনেকগুলো ভুল করছ। প্রথমত, তুমি বিলক্ষণ জানো, আমি দিশি-বিদেশিতে কোনও ফারাক দেখতে পাইনে। যার সঙ্গে আমার মনের মিল, রুচির মিল হয় সে-ই আমার আত্মজন। কী বলেন আলি সাহেব?’

আমি বললুম, অতি খাঁটি কথা। তবে ভারতীয় ঋষি বলেছেন, “আমি” “তুমি”তে পার্থক্য করে লঘুচিত্তের লোক, যার চরিত্র উদার তার কাছে সর্ব বসুধা আত্মজন।’

নয়রাট গুম্ মেরে শুনলেন। অনেকক্ষণ ধরে ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় নাড়িয়ে শেষটায় বললেন, ‘এটা হজম করতে আমার একটু সময় লাগবে–ফ্রান্‌ৎসিসকার রান্নার মতো।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা ভয়ঙ্কর চটে যাওয়ার ভান করে (আমার তাই মনে হল) বললেন, “দেখো, পেটার, তুমি খাওয়া বন্ধ করে এখুনি রেস্তোরাঁ যাও; না হলে এই ডিশ ছুঁড়ে তোমার মাথা ফাটাব।’

পেটার অতি ধীরে ধীরে আরেক চামচ টমাটো সুপ গিলে নিয়ে প্রথম গিন্নিকে শুধালেন, আরও সুপ আছে কি না, তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সবাইকে আত্মজন করা কি কখনও সম্ভব? এই দেখুন না, সেদিন ফ্রান্‌ৎসিসকা বলল, একজোড়া ফেন্সি নতুন জুতো কিনবে– দাম চল্লিশ ফ্রাঁ (৩৮ টাকা) আমি বললুম আমার অত টাকা নেই, ফ্রানৎসিসকা বললে, সে আমার কাছ থেকে টাকা চায় না, তার মা আসছেন দু দিন পরে, তিনি টাকাটা দেবেন। কী আর করি বলুন তো? তদ্দণ্ডেই টাকাটা ঝেড়ে দিলুম। ফ্রানৎসিসকার মা! বাপরে বাপ! আপনি কখনও ম্যানইটার বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন?’

আমি কিছু বলবার পূর্বেই ফ্রানৎসিসকা আমাকে বললেন, ‘দোহাই মা মেরির! এই পেটারটা যে কী মিথ্যাবাদী আপনাকে কী করে বোঝাই? (পেটারের আপত্তি শোনা গেল, ‘ডার্লিং, অশ্লীল গল্পের চেয়ে গালিগালাজ অনেক বেশি খারাপ’) আমার মা যাতে বড়দিন একা-একা না কাটান তার জন্য নিজে আমাকে না বলে–লুৎর্সেন গিয়ে তাঁকে এখানে নিয়ে এল। তার পর বছরের শেষ রাত্রে তার সঙ্গে ধেই ধেই করে নাচলে ভোর চারটে অবধি— ওঁর সঙ্গে নাচলে অন্তত পঁচিশটা নাচ, আমার সঙ্গে দুটো, জোর তিনটে। বুড়িকে শ্যাম্পেন খাইয়ে খাইয়ে টং করিয়ে দিয়ে, যত সব অদ্ভুত পুরনো রাশান আর পোলিশ নাচ। কখনও সে মাটিতে বসে ঊরু থাবড়ায়– মা তখন তার চতুর্দিকে পাই পাই করে চক্কর খাচ্ছেন কখনও বাঁদরের মতো লম্ফ দিয়ে ছাতে মাথা ঠোকে– মা তখন ১৫ ডিগ্রিতে কাত হয়ে স্কার্ট তুলেছেন হাঁটু অবধি। তার পর তাঁকে কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে বাই বাই করে ঘুরল ঝাড়া দশ মিনিট। বাদবাকি নাচনে-ওলা-নাচের-ওলীরা ততক্ষণে ফ্লোর তাদের জন্য সাফ করে দিয়ে আপন আপন টেবিলে চলে গিয়েছে। অরকেস্ট্রাও বদ্ধ পাগল হয়ে গিয়েছে, একটা নাচের জন্য ওরা বাজনা বাজায় দশ, জোর পনের মিনিট ওই মাৎসুক্কা না কী পাগলা নাচের জন্য ওরা বাজনা বাজালে পাকি এক ঘণ্টা। নাচের শেষে মা তো নেতিয়ে পড়ল চেয়ারে, ওদিকে কিন্তু চোখ বন্ধ করে বুড়ি মিটমিটিয়ে হাসছে– খুশিতে ডগোমগো!’

পেটার বললেন, ‘ডার্লিং, কিন্তু সে রাত্রের সবচেয়ে সেরা নাচের জন্য কে প্রাইজ পেল সেটা তো বললে না।’

তার পর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘মা পেলেন ফার্স্ট প্রাইজ, আমি সেকেন্ড। তাই তো আমি শাশুড়িদের বিলকুল পছন্দ করিনে।’

ফ্রাৎসিসকা বললেন, “আচ্ছা আহামুক তো! নাচের পয়লা প্রাইজ হামেশাই রমণী পায়। দুসরাটা পুরুষ। এটা হচ্ছে শিভালরি। তোমাকে কী করে পয়লা প্রাইজ দিত?’

পেটার আমার দিকে মুখ করে বললেন, ‘গিন্নির রাগ, আমি ওর সঙ্গে নাচলুম না কেন? আচ্ছা মশায়, বলুন তো, আপনি যদি কবিতা পড়ে শোনান, খোশগল্প করেন, বাজনা বাজান কিংবা কালোয়াতি করেন তবে যে সমে সমে মাথা নাড়তে পারে তাকে আদর-কদর করবেন, না, আপন স্ত্রীকে যেহেতু তিনি আপন স্ত্রী। রসের বাজারে আপন-পর করা যায়?’

আমি উল্লসিত হয়ে বললুম, ‘তাই তো আমি নিবেদন করলুম, “যার চরিত্র উদার–অর্থাৎ যিনি রসিক জন– তাঁর কাছে সর্ব বসুধা আত্মজন”।

পেটার নয়রাট বললেন, ‘গিন্নি অবশ্যি একটা কথা ঠিক বলেছেন, আমরা কেউই এটিকেটের ধার ধারিনে। এ বিষয়ে চমৎকার একটা ‘ট্যুনিস’, ‘শেলে’র গল্প আছে। ‘ট্যুনিস– শেল’কে চেনেন?’

আমি বললুম, “ঠিক মনে পড়ছে না।’

 ‘আগাগোড়া একটি প্রতিষ্ঠান’ বলতে পারেন। “ট্যুনিস” কথাটি এসেছে লাতিন “আন্তনিয়ুস” থেকে। আন্তনিয়ুস গালভরা, গেরেমভারি, খানদানি ঐতিহাসিক নাম। আর ট্যুনিস্ অতিশয় প্লিবিয়ান অপভ্রংশ– নামটাতেই তাই একটুখানি রসের আমেজ লাগে।

আমি বললুম, ‘আমাদের “পঞ্চানন” নামটাও গেরেমভারি কিন্তু তার গার্হস্থ্য সংস্করণ “পাঁচু”টাতেও ওইরকম রসসৃষ্টি হয়।’

‘তাই নাকি? আপনারাও তা হলে এ রসে বঞ্চিত নন? আর “শেল” কথাটার মানে “ট্যারা”। বুঝতেই পারছেন, পিতৃদত্ত নাম নয়, পাড়াদও। এবং নাম থেকেই বুঝতে পারছেন ওরা দু জন ডুক ব্যারন নন– খাঁটি ওয়ার্কিং কেলাস। খায়দায়, ফুর্তিফার্তি করে, ফোকটে দু পয়সা মারার তালে থাকে, কাজে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ আর বিয়ারখানায় আড্ডা জমাতে পারলে এরা আর কিছু চায় না।

‘একদিন হয়েছে কী, ট্যুনিস্-শেল রাস্তায় একখানা দশ টাকার নোট কুড়িয়ে পেয়েছে– তা ওরা হামেশাই ওরকমধারা রাস্তায় টাকা কুড়িয়ে পায়, না হলে গল্পই-বা জমবে কী করে?

‘ট্যুনিস্ বলল, “চ, শেল; এই দিয়ে উত্তমরূপে আহারাদি করা যাক।” দু জনা ঢুকল গিয়ে এক রেস্তোরাঁয় আর অর্ডার দিল দু খানা কটলেটের।

‘ওয়েটার এসে ছুরিকাটা আর দু খানা প্লেট সাজিয়ে দিয়ে আনল একখানা বড় ডিশে করে দুখানা কটলেট।’

নয়রাট বললেন, ‘কটলেট তো আর অ্যারোপ্লেনের স্ক্রু নয় যে ফিতে দিয়ে দিয়ে মেপেজুকে কিংবা ছাঁচে ঢেলে, ঠিক একই সাইজে বানানো হবে, কাজেই একখানা কটলেট আরেকখানার চেয়ে সামান্য একটু বড় হবে তাতে আশ্চর্য কী?’

ট্যুনিস তাই ঝপ করে বড় কটলেটখানা আপন প্লেটে তুলে নিল। শেল চুপ করে দেখল। তার পর আস্তে আস্তে ছোট ছোট কটলেটখানা তুলে নিয়ে ট্যুনিসকে বলল, “ট্যুনিস, আদব কায়দা একদম জানিসনে।”–যেন নিজে সে মহা খানদানি ঘরের ছেলে।

‘ট্যুনিস শুধাল, “কেন, কী হয়েছে?”

‘শেল বলল, “ভদ্রতা হচ্ছে, যে ডিশ থেকে প্রথম খাবার তুলবে, সে নেবে ছোট টুকরোটা।”

 ‘ট্যুনিস বলল, “অ। আচ্ছা, তুই যদি প্রথম নিতিস তবে তুই কী করতিস?”

শেল দম্ভ করে বলল, “নিশ্চয়ই ছোট কটলেটটা তুলতুম।”

‘তখন ট্যুনিস বলল, “সেইটেই তো পেয়েছিস, তবে ভ্যাচর ভ্যাচর করছিস কেন?”

নয়রাট গল্প শেষ করে বানাতে মন দিলেন।

 বলতে পারব না, আমার পাঠকদের গল্পটা কীরকম লাগল– আমার কিন্তু উত্তম মনে হল, তাই প্রাণভরে খানিকক্ষণ হেসে নিলুম।

নয়রাট বললেন, ‘তাই যখন কেউ এটিকেট নিয়ে বড় বেশি কপচাতে শুরু করে তখনই আমার এই গল্পটাকে মনে পড়ে আর হাসি পায়। আরে বাবা, সংসারে থাকবি মাত্র দু দিন। তার ভিতর কত হাঙ্গামা, কত হুজ্জত। সেইসব সামলাতে গিয়েই প্রাণটা খাবি খায়। তার ওপর যদি এটিকেটের নাগপাশ দিয়ে সর্বাঙ্গ আর নবদ্বার বেঁধে দাও (ফ্রানৎসিসকার আপত্তি শোনা গেল, “পেটার, আবার অশ্লীল কথা!”) তবে দম ফেলব কী করে? হাঁচবার এটিকেট, কাশবার এটিকেট, থুথু ফেলার এটিকেট, গা চুলকাবার এটিকেট– প্রাণটি যায় আর কী।’

আমি সায় দিলুম।

তখন নয়রাট শুধালেন, ‘বলুন তো, কী সে জিনিস যা চাষা অনাদরে, তাচ্ছিল্যে, এমনকি বলতে পারেন, ঘেন্নাভরে রাস্তায় ফেলে দেয়, আর ভদ্রলোক সেটাকে ধোপদুরস্ত দামি রুমালে ঢেকে, পকেটে পুরে অতি সন্তর্পণে, বাড়ি নিয়ে আসেন?’

আমি খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললুম, ‘তা তো জানিনে।’

বললেন, ‘সিকনি। চাষা ফাঁত করে রাস্তায় নাক ঝেড়ে এদিকে আর তাকায় না, ভদ্রলোক রুমাল খুলে ছিঁক করে তারই উপর একটুখানি নাক ঝেড়ে, সেটিকে সযত্নে ভাঁজ করে, পকেটে পুরে বাড়ি ফেরেন।’

ফ্রানৎসিসকা হঠাৎ বললেন, ‘পেটার, তুমি তো বকবক করে এটিকেটের নিন্দাই করে যাচ্ছ, ওদিকে একদম ভুলে গিয়েছ, ভদ্রলোক প্রাচ্যদেশীয়, সেখানে এটিকেটের অন্ত নেই। এদেশে তো প্রবাদই রয়েছে, “ওরিয়েন্টাল কার্টসি”। যে আচার ওঁদের, তুমি তাই নিয়ে মশকরার পর মশকরা করে যাচ্ছ।’

পেটার বললেন, ‘আদপেই না। আমি তো ভদ্রতার (ম্যানার্স) নিন্দে করছিনে, আমি করছি এটিকেটের। দুটো তো এক জিনিস নয়।’

তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাদের দেশে ব্যবস্থাটা কী রকম?’

আমি বললুম, ‘অনেকটা আপনাদের দেশেরই মতো। অর্থাৎ, ভদ্রতা রক্ষার চেষ্টা আমরাও করে থাকি তবে এটিকেটের বাড়াবাড়ি দেখলে তাই নিয়ে আপনারই মতো টীকাটিপ্পনী কেটে থাকি। তবে কি না ভারতবর্ষ বিরাট দেশ– তার নানা প্রদেশে নানা রকমের এটিকেট। এই ধরুন লক্ষ্ণৌ। সেখানে কোনও খানদানি বাড়িতে নিমন্ত্রণে যেতে হলে বাড়িতে উত্তমরূপে আহারাদি সেরে যেতে হয়। কারণ, খানার মজলিসে গল্প উঠবে, কোন মৌলানা দিনে আড়াই ভোলা খেতেন, কোন সাহেবজাদা দুই ভোলা, কোন পিরজাদা এক ভোলা আর কোন নওয়াব। একদম খেতেনই না। অথচ সংস্কৃত আপ্তবাক্য এ বিষয়ে যারা রচনা করেছেন তারা এ এটিকেট আদপেই মানতেন না।’

কর্তা-গিন্নি উভয়েই শুধালেন, ‘আপ্তবাক্য কী?’

আমি বললুম–

‘পরান্নং প্রাপ্য দুর্বদ্ধে, মা প্রাণেষু দয়াং কুরু।
পরান্নং দুর্লভং লোকে প্রাণাঃ জন্মনি জন্মনি ॥

 অর্থাৎ–

ওরে, মূর্খ, নেমন্তন্ন পেয়েছিস, ভালো করে খেয়ে নে। প্রাণের মায়া করিসনি, কারণ ভেবে দেখ, নেমন্তন্ন কেউ বড় একটা করে না। বেশি খেয়ে যদি মরে যাস তাতেই-বা কী– প্রাণ তো ভগবান প্রতি জন্মে ফ্রি দেয়, তার জন্য তো আর খরচা হয় না।’

***

আমি বললুম, ‘চমৎকার রান্না হয়েছে’–রান্না সত্যই মামুলি রান্নার চেয়ে অনেক ভালো হয়েছিল, পোশাকি রান্না বললেও অত্যুক্তি হয় না। তার পর জিগ্যেস করলুম, ‘রুশ কায়দায় মাছ কী করে রাঁধতে হয়?’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, আপনার বুঝি রান্নার শখ?

আমি বললাম, ‘না , তবে আমার মা খুব ভালো রাঁধতে পারেন আর নতুন নতুন দিশি-বিদেশি পদ শেখাতে তাঁর ভারি আগ্রহ। আমি প্রতিবার দেশ-বিদেশে ঘুরে যখন বাড়ি ফিরি তখন বাড়ির সবাই আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানারকম গল্প শোনে, মা-ও শোনেন, কিন্তু বলার প্রথম ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর তিনি আমাকে একলা-একলি শুধান, নতুন রান্না কী কী খেলুম। আমি ভালো ভালো পদগুলোর নাম করলে পর মা শুধাতেন ওগুলো কী করে রাঁধতে হয়। গোড়ার দিকে বন্ধনপদ্ধতি খেয়াল করে শিখে আসতুম না বলে মাকে কষ্ট করে এপেরিমেন্ট করে করে শেষটায় পদটা তৈরি করার পদ্ধতি বের করতে হত। এখন তাই মোটামুটি পদ্ধতিটা লিখে নিই; মাকে বলা মাত্র দুই ট্রায়েলের পরই ঠিক জিনিস তৈরি করে দেন।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘বলেন কী?’

বললুম, ‘হ্যাঁ, আশ্চর্য হবারই কথা। আমিও একদিন মাকে জিগ্যেস করেছিলুম, তিনি কোনও পদ না দেখে না চেখে তৈরি করেন কী করে? মা বলেছিলেন– এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে– “আরে বাপু, রান্না মানে তো, হয় সেদ্ধ করা, নয় তেলে-ঘিয়ে ভাজা, কিংবা শুকনো শুকনো ভাজা অথবা শিকে ঝলসে নেওয়া। এরই একটা, দুটো কিংবা তিনটে কায়দা চালালেই পদ ঠিক উতরে আসবে। আর তুইও তো বলেছিস আমাদের দেশের বাইরে এমন কোনও মশলা জন্মায় না যা এদেশে নেই। তা হলে তুই যা বিদেশে খেয়েছিস আমি তৈরি করতে পারব না কেন?’

তার পর বললুম, ‘অবশ্য মা আমাকে কখনও এসপেরেগাস কিংবা আর্টিচোক খাওয়াননি কারণ ওগুলো আমাদের দেশে গজায় না। তাই নিয়ে মায়েরও কোনও খেদ নেই– কারণ যেসব শাকসবজি আমাদের দেশে একদম হয় না সেগুলোর কথা আমি মায়ের সামনে একদম চেপে যেতুম।’

ফ্রানৎসিসকা বুদ্ধিমতী মেয়ে, বললেন, ‘ও, পাছে তাঁর দুঃখ থেকে যায়, তিনি তাঁর ছেলের সব প্রিয় খাদ্য খাওয়াতে পারলেন না।’

আমি বললুম, ‘হাঁ। কিন্তু তিনি যে তরো-বেতরো রান্না শেখার জন্য উঠেপড়ে লেগে যেতেন তার আরও একটা কারণ রয়েছে। রান্না হচ্ছে পুরোদস্তুর আর্ট। আর আমার মা–’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, “থামলেন কেন?’

আমি লজ্জার সঙ্গে বললুম, ‘নিজের মায়ের কথা সত্যি হলেও বলতে গেলে কেমন যেন বাধো বাধো ঠেকে। আপনারা হয়তো ভাববেন ফলিয়ে বলছি।’

নয়রাট এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন, এখন হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘ব্যস! হয়েছে। আপনাকে আর এটিকেট দেখাতে হবে না। ফ্রান্‌ৎসিসকা আপনাকে বলেনি, এ বাড়িতে এটিকেট বারণ?

ফ্রান্‌ৎসিসকা তাড়াতাড়ি বললেন, ‘ছি, পেটার, তুমি ওরকম কড়া কথা কও কেন?’

আমি সঙ্গে সঙ্গে উল্লসিত হয়ে বললুম, ‘আদপেই না। ওঁর ধমক থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, আপনারা সরল প্রকৃতির লোক, আপনাদের সামনে সবকিছু অনায়াসে খুলে বলা যায়। তা হলে শুনুন, যা বলেছিলুম, রান্না হচ্ছে পুরোদস্তুর আর্ট বিশেষ আর আমার মা খাঁটি আর্টিস্ট। ঠিক আর্ট ফর আর্টস সেক নয়, অর্থাৎ তিনি মনের আনন্দে খুদ-খুশির জন্য বেঁধেই যাচ্ছেন, কেউ খাচ্ছে না, কিংবা খেয়েও কেউ ভালোমন্দ কিছু বলছে না– তা নয়। তিনি রান্নার নতুন নতুন টেকনিক শিখতে ভালোবাসতেন সত্যকার আর্টিস্ট যেরকম নতুন নতুন টেকনিক শিখতে ভালোবাসে। আপনি ভালো প্যাস্টেলপেন্টিং করতে পারেন, কিন্তু অয়েলপেন্টিং দেখে কিংবা তার কথা শুনে আপনারও কি ইচ্ছে হবে না সেই টেকনিক রপ্ত করার? কিংবা আপনি উড়কাট করেন– যদি লাইন এনগ্রেভিং, এচিং, মেদজোটিন্ট, আকওয়াটিন্টের খবর পান, তবে সেগুলোও আয়ত্ত করার বাসনা আপনার হবে না?

‘অথচ দেখুন, খাঁটি আর্টিস্ট অজানা জিনিস আয়ত্ত করার জন্য যত উদগ্রীবই হোক-না কেন, হাতের কাছের সামান্যতম মালমশলাও সে অবহেলা করে না– নানা রঙের মাটি, শাকসবজি থেকেও নতুন রঙ আহরণ করার চেষ্টা করে।

‘ভারতবর্ষের যে প্রান্তে আমার দেশ, সেখানে সবসময় জাফরান পাওয়া যায় না। তাই মা তারই একটা “এরজাৎস” সবসময়ে হাতের কাছে রাখেন। বুঝিয়ে বলছি–

‘আমাদের দেশে একরকম ফুল হয় তার নাম শিউলি। শিউলির বোটা সুন্দর কমলা রঙের আর পাপড়ি সাদা। ফুল বাসি হয়ে গেলে মা সেই বোঁটাগুলো রোদ্দুরে শুকিয়ে বোতলে ভরে রাখেন। সেই শুকনো বোটা গরম জলে ছেড়ে দিলে চমৎকার সুগন্ধ আর কমলা রঙ বেরোয়। মেয়েরা সাধারণত এই রঙ দিয়ে শাড়ি ছোপায়। মা খুব সরু চালের ভাত ওই রঙে ছুপিয়ে নিয়ে চিনি কিসমিস, বাদাম দিয়ে ভারি সুন্দর “মিঠাখানা” তৈরি করেন।

‘এটা মায়ের আবিষ্কার নয়। কিন্তু তবু যে বললুম, তার কারণ প্রকৃত গুণী কলাসৃষ্টির জন্য দেশি-বিদেশি কোনও উপকরণ অবহেলা করেন না।’

নয়রাটদের বাড়িতে এটিকেট বারণ, তবু আপন মায়ের কথা একসঙ্গে এতখানি বলে ফেলে কেমন যেন লজ্জা পেলুম।

***

রুশ কবি পুশকিনের রচিত একটি কবিতার সারমর্ম এই–

“হে ভগবান, আমার প্রতিবেশীর যদি ধনজনের অন্ত না থাকে, তার গোলাঘর যদি বারো মাস ভর্তি থাকে, তার সদাশয় সচ্চরিত্র ছেলেমেয়ে যদি বাড়ি আলো করে রয়, তার খ্যাতি প্রতিপত্তি যদি দেশদেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, তবু তাতে আমার কণামাত্র লোভ নেই; কিন্তু তার দাসীটি যদি সুন্দরী হয় তবে তবে, হে ভগবান, আমাকে মাপ কর, সে অবস্থায় আমার চিত্তচাঞ্চল্য হয়।’

পুশকিন সুশিক্ষিত, সুপুরুষ এবং খানদানি ঘরের ছেলে ছিলেন, কাজেই তার ‘চিত্তদৌর্বল্য’ কী প্রকারের হতে পারত সেকথা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয় না। এইবারে সবাই চোখ বন্ধ করে ভেবে নিন কোন জিনিসের প্রতি কার দুর্বলতা আছে।

আমি নিজে বলতে পারি, সাততলা বাড়ি, ঢাউস মোটরগাড়ি, সাহিত্যিক প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এসবের প্রতি আমার কণামাত্র লোভ নেই।

আমার লোভ মাত্র একটি জিনিসের প্রতি– অবসর। যখনই দেখি, লোকটার দু পয়সা আছে অর্থাৎ পেটের দায়ে তাকে দিনের বেশির ভাগ সময় এবং সর্বপ্রকারের শক্তি এবং ক্ষমতা বিক্রি করে দিতে হচ্ছে না, তখন তাকে আমি হিংসে করি। এখানে আমি বিলাসব্যসনের কথা ভাবছিনে, পেটের ভাত,–র(১) কাপড় হলেই হল।

 ‘অবসর’ বলতে আমি কুঁড়েমির কথাও ভাবছিনে। আমার মনে হয়, প্রকৃত ভদ্রজন অবসর পেলে আপন শক্তির সত্য বিকাশ করার সুযোগ পায় এবং তাতে করে সমাজের কল্যাণলাভ হয়। এই ধরুন, আমার বন্ধু শ্ৰী ‘ক’ দাশগুপ্ত। বদ্যির ছেলে– পেটে অসীম এলেম, তুঘোড় ছোকরা, তালেবর ব্যক্তি। সদাগরি আপিসে কর্ম করে, বড়সাহেবকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়, মোটা তনখা ভি পায়।

বয়স তার এখনও তিরিশ পেরোয়নি। পার্টিশনের পর মারোয়াড়ি কারবারিরা যখন তার ‘বস’কে ঘায়েল করে ব্যবসা কিনবার জন্য উঠেপড়ে লাগল, তখন আমার এই বদ্যির ব্যাটা সায়েবকে এমন সব ‘কৌশল’ বাতলালে যে উল্টে ওনারা চোখের জলে নাকের জলে।

সায়েবও বড় নেমকহালাল(২) লোক। প্রায়ই ‘হ্যালো, ড্যাস-গুপটা’, বলে বাড়িতে ঢোকেন, ‘লৌচি’ (লুচি) খেয়ে যান, ড্যাস-গুপটার ছেলেদের জন্য পুজোর বাজারে দু চারখানা ‘ডৌটি’ (ধুতি)ও রেখে যান। আমি বরাবর সকালটা দাশগুপ্তের বাড়িতে কাটাই, তাই সায়েবের সঙ্গে মাঝে মাঝে মোলাকাত হয়ে যায়। লোকটি এদেশে আসা সাধারণ ইংরেজের মতো গাড়ল নয়, ইংরেজি শোলোক খাসা কপচাতে পারে, অর্থাৎ মধুরকণ্ঠে উচ্চস্বরে শেলি-কিটস্ আবৃত্তি করতে পারে।

সায়েবের কথা উপস্থিত থাক। দাশগুপ্তের কথায় ফিরে যাই।

আমি জানি দাশগুপ্ত কোনও চেম্বার অব কমার্সের বড়কর্তা হবার জন্য লালায়িত নয়। দেড় হাজার টাকার মাইনেকেও সে থোড়াই কেয়ার করে।

আমি জানি, আজ যদি তাকে কেউ পাঁচ শ টাকা প্রতি মাসে দেয়, তবে সে কলকাতা শহরের হেথা-হোথা সর্বত্র দশখানা নাইট স্কুল খুলবে। এখন সে আপিসে দিনে সাত ঘণ্টা কাটায় নাইট স্কুল খোলবার মোকা পেলে সে পরমানন্দে দিনে চোদ্দ ঘণ্টা সেগুলোর তদারকিতে, ক্লাস নেওয়াতে কাটাবে। বিশ্বাস করবেন না, সে তার উড়ে চাকরটাকে স্বাক্ষর করার জন্য উড়ে কায়দায় বর্ণমালা পর্যন্ত শিখিয়েছে– চোখ বন্ধ করে মাথা দুলিয়ে দিব্য বলে যায়–

‘ক’ রে কমললোচন শ্রীহরি।
করেন শঙ্খ-চক্রধারী ॥
 ‘খ’ রে খগ-আসনে খগপতি।
খটন্তি লক্ষ্মী-সরস্বতী ॥
‘গ’ রে গরুড়—ইত্যাদি–

 (আমার সহৃদয় উড়িষ্যাবাসী পাঠকবৃন্দ যেন কোনও অপরাধ না নেন– যদি নামতাতে কোনও ভুল থেকে যায়; আমি দাশগুপ্তের মুখে মাত্র দু তিনবার শুনেছি; কেউ যদি আমাকে পুরো পাঠটা পাঠিয়ে দেন, তবে বড় উপকৃত হই)।

অর্থাৎ আজ যদি দাশগুপ্তকে পেটের ধান্দায় আপিস না যেতে হয়, তবে সে তার জীবন্মত্যুর চরম কাম্য কাজে ফলাতে পারবে। কে ক-লক্ষ মণ পাট কিনল, কে ধাপ্পা এবং ঘুষ দিয়ে ক-খানা ওয়াগন বাগালে তাতে দাশগুপ্তের কোনও প্রকারের চিত্তদৌর্বল্যও (হেথাকার ভাষায় ‘দিলচসপি’) নেই। দেড় হাজার টাকার মাইনে কমে গিয়ে পাঁচ শ’ হলে সে দুম করে মোটরখানা বিক্রি করে দিয়ে ট্রামে চড়ে ইস্কুলগুলোর তদারক করবে।

আপনি বিচক্ষণ লোক আপনি শুধাবেন, এ পাগলামি কেন?

এটা পাগলামি নয়।

আসলে দাশগুপ্ত ইস্কুল মেস্টার। তার বাবা টোলে আয়ুর্বেদ শেখাতেন, তার ঠাকুরদাও তাই, তাঁর বাপও তাই, তার উপরের খবর জানিনে।

এবং আমার সুহৃদ যে কী অদ্ভুত ইস্কুল-মেস্টার সে-কথা কী করে বোঝাই? চাকরির ঝামেলার মধ্যিখানেও সে একটা নাইট ইস্কুল চালায়।

একদিন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখি, সে তার ইস্কুলে ইংরেজি পড়াচ্ছে। চেঁচিয়ে বলছে, ‘আই গো!”

ছোঁড়ারা তীব্রকণ্ঠে ঐক্যস্বরে বলছে, ‘আই গো!’

 ‘উই গো!’

 ‘উই গো!’

 ‘ইউ গো!’

‘ইউ গো!’

‘হি গোজ!’

‘হি গোজ!’

‘রাম গোজ।’

‘রাম গোজ!’

‘শ্যাম গোজ!’

 ‘শ্যাম গোজ!’

দাশগুপ্ত সদ্দার-পোডড়ার মতো বলে যাচ্ছে আর ছোঁড়ারা চিৎকার করে দোহার গাইছে।

সর্বশেষে দাশগুপ্ত লাফ দিয়ে উচ্চতম কন্ঠে চেঁচাল, ‘রাম অ্যান্ড শ্যাম গো গো গো!’

 দাশগুপ্তের স্বপ্ন কখনও বাস্তবে পরিণত হবে না। এমন দিন কখনও আসবে না যে, সে পেটের চিন্তার ফৈসালা করে নিয়ে তামাম শহর নাইট স্কুলে নাইট স্কুলে ছয়লাপ করে দিতে পারে।

দাশগুপ্তের কথা যাক। আমি তার উল্লেখ করলুম নয়রাট-জীবনীটা তুলনা দিয়ে খোলসা করার জন্য।

ইয়োরোপে এ জিনিসটা হামেশাই হচ্ছে।

নয়রাট মেট্রিক পাস করেন ১৮ বছর বয়সে, সংসারে ঢোকেন ১৯ বছর বয়সে। তার পর ঝাড়া ছাব্বিশটি বছর ব্যবসা-বাণিজ্য করে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে দেখেন এতখানি পুঁজি জমেছে যে, বাকি জীবন তাঁকে আর সংসারখরচের জন্য ভাবতে হবে না।

নয়রাটের ভাষাতেই বলি,

‘টাকা জমানোর নেশা আমাকে কখনও পায়নি। আমি জানি এ দুনিয়ার বহু লোকই আমার ধারণা নিয়ে সংসারে ঢোকে কিন্তু বেশির ভাগই শেষ পর্যন্ত ধর্মচ্যুত হয়। জীবনে আমার কতকগুলো শখ ছিল–কিন্তু হিসাব করে দেখলুম, সেগুলো বাগে আনতে হলে পেটের একটা ফৈসালা পয়লাই করে নিতে হবে। তাই খাটলুম ছাব্বিশ বছর ধরে একটানা। আমার অসুখ-বিসুখ করে না, আমি একদিনের তরে কাজে কামাই দিইনি– ওই শুধু বিয়ের সময় যে সাতদিন হনিমুন কাটাই বাধ্য হয়ে তারই জন্য ছুটি নিতে হয়েছিল।’

ফ্রানৎসিসকা বললেন, ‘তা ছুটি নিয়েছিলে কেন? আমি বলিনি, তোমার আপিসঘরে, কিম্বা সেখানে জায়গা না হলে তোমার গুদোমঘরে পাদ্রি ডেকে মন্ত্র পড়লেই হবে।’

নয়রাট বললেন, “অন্য মতলব ছিল ডার্লিং, তোমাকে তো আর সবকিছু খুলে বলিনি।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘বটে।’

নয়রাট আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাকে খুলে কই।’

‘বিয়ে করেই বউকে নিয়ে চলে গেলুম এক অজ পাড়াগাঁয়ে। সে গাঁটা খুঁজে বের করতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল এবং সে গাঁ থেকেও আধ মাইল দূরে একটি ‘শালে’ ভাড়া নিলুম সাতদিনের জন্য। সেখানে ইলেকটিরিক আছে–ব্যস আর কিছু না। জলের কল না, খবরের কাজ না, দুধওয়ালা দুধ পর্যন্ত দিয়ে যায় না।’

‘রাত্তিরে ডিনার খেয়েই আমরা সে বাড়িতে গিয়ে উঠলুম।

 ফ্রান্‌ৎসিসকা বাড়িতে ঢুকেই সোহাগ করে বলল–’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘চোপ্।’

নয়রাট বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, চোপ।’ তার পর আমাকে বললেন, ‘আচ্ছা, তা হলে কমিয়ে-সমিয়ে বলছি–বাদবাকিটা পরে আপনাকে একলা-একলি বলব।’

‘ভোর তিনটের সময় আমি চুপসে খাট ছেড়ে উঠে পা টিপে টিপে নামলুম নিচের তলায়। পিছনের বাগানে গিয়ে সেখান থেকে জল সংগ্রহ করে গেলুম রান্নাঘরে। সেখানে নাকে-মুখে বিস্তর ধুঁয়ো গিলে ধরালুম উনুন। তার পর বেকন ফ্রাই করে, গরম কফি, টোস্ট ইত্যাদি বানিয়ে যাবতীয় বস্তু একখানা বিরাট খুঞ্চাতে সাজিয়ে গেলুম উপরের তলায় ফ্রানৃৎসিস্কার বিছানার কাছে। আস্তে আস্তে জাগিয়ে বললুম, “ব্রেকফাস্ট তৈরি।”

ফ্রান্‌ৎসিসকা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল (আবার ‘চোপ’ এবং ‘আচ্ছা, আচ্ছা, চোপ’ শোনা গেল), “ডার্লিং তুমি আমাকে কত-না ভালোবাসো–এই ভোরে এই শীতে আমাকে কিছু না বলে তুমি এতসব করেছ।”

‘আমি বললুম, “ডার্লিং না কচু, ভালোবাসা না হাতি। আমি এসব তৈরি করে আনলুম শুধু তোমাকে দেখাবার জন্য যে, বাদবাকি জীবন তোমাকে এইরকমধারা করতে হবে। আর আমি শুয়ে শুয়ে ব্রেকফাস্ট খাব।’

আমি প্রাণ খুলে হাসলুম।

দেখি নয়রাটও মিটমিটিয়ে হাসছেন। ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘আপনি এই তাড়িখানার বেহুদা প্রলাপটা বিশ্বাস করলেন?’

আমি বললুম, ‘কেন করব না? শাদির পয়লা রাতে শুধু ইরানেই নয়, আরও মেলা দেশে মেলা বর বেড়াল মেরেছে, এ তো আর নতুন কিছু নয়। এবারে সুইস সংস্করণটি শেখা হল এই যা।’

দুজনেই জিগ্যেস করলেন, “সে আবার কী?’

আমাকে বাধ্য হয়ে শাদির পয়লা রাতে বেড়াল-মারার গল্পটা বলতে হল, কিন্তু নয়রাটের মতো জমাতে পারলুম না–রসিয়ে গল্প বলা আমার আসে না, সে আমার বন্ধুবান্ধব সকলেই জানেন।

দু জনেই স্বীকার করলেন, ইরানি গল্পটাই ভালো!(৩)

তখন ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘পেটারের বকুনিতে অনেকগুলো ভুল রয়েছে। প্রথমত আমরা হনিমুন যে বাড়িতে কাটাই, সেখানে গ্যাস ছিল, উনুন ধরাবার কথাই ওঠে না, দ্বিতীয়ত, পেটার ককখনো ব্রেকফাস্ট খায় না এবং সর্বশেষ বক্তব্য যে ব্রেকফাস্টের বর্ণনা সে দিল সেটা ইংলিশ ব্রেকফাস্ট। কোনও কটিনেন্টাল শূয়ারের মতো ব্রেকফাস্টের সময় এক গাদা বেকন আর আণ্ডা গেলে না। পেটার গল্পটা শুনেছে নিশ্চয়ই কোনও ইংরেজের কাছ থেকে, আর সেটা পাচার করে দিলে আপনার ওপর দিয়ে।’

পেটার বললেন, ‘রেমব্রান্ট একবার এক ভদ্রলোকের মায়ের পট্রেট এঁকেছিলেন। ভদ্রলোক ছবি দেখে বললেন, তাঁর মায়ের সঙ্গে মিলছে না। রেমব্রান্ট বললেন, “এক শ বছর পর আপনার মায়ের সঙ্গে কেউ এ ছবি মিলিয়ে দেখবে না তারা দেখবে ছবিখানি উতরেছে কি না।”

তার পর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গল্পটি ভালো কি না, সেইটেই হচ্ছে আসল কথা। ঘটেছিল কি না, সে প্রশ্ন সম্পূর্ণ অবান্তর; আপনি কী বলেন?’

আমি বললুম, ‘সুন্দর-ই সত্য না ঘটলেও ঘটা উচিত ছিল।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘বটে!’

নয়রাট বললেন, ‘আমার শখ ছিল দাবা খেলাতে এবং সে ব্যসনে মেতে আমার কত সময়-সামর্থ্য বরবাদ গিয়েছে তার হিসেব-নিকেশ আমি কখনও করিনি। দাবা খেলা আমি আরম্ভ করি সাত বছর বয়সে। আমার বাবা-কাকা দুজনেই পাড় দাবাড়ে ছিলেন আর কাকা রোজ রাত্তিরে বাবার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন। এক রাত্রে আসতে পারলেন না জোর বরফের ঝড় বইছিল বলে আর ওদিকে বাবা তো মৌতাতের সময় হন্যে হয়ে উঠলেন। আমি থাকতে না পেরে বললুম, “তা আমার সঙ্গেই খেল না কেন?” বাবা তো প্রথমটা হেসেই উড়িয়ে দিলেন, কিন্তু জানেন তো দাবার নেশা কী নিদারুণ জিনিস–বরঞ্চ মদের মাতাল খুনির সঙ্গে এক টেবিলে মদ খেতে রাজি হবে না, দাবার মাতাল তার সঙ্গে খেলতে কণামাত্রও আপত্তি জানাবে না। বাবা অত্যন্ত তাচ্ছিল্যভরে খেলতে বসলেন, প্রথম দু বাজি জিতলেও কিন্তু তৃতীয় বাজি হল চালমাত এবং তার পর তিনি আর কখনও জেতেননি। তবে তার হল বুড়ো হাড়, এখনও খুব শক্ত শক্ত চালের চমৎকার চমৎকার উত্তর বাতলে দিতে পারেন।’

আমার আশ্চর্য লাগল, কারণ শরৎ চাটুজ্জেও কৈলাস খুড়োর বর্ণনাতেও ওই কথাই বলেছেন; খুড়ো শেষ বয়সে আটপৌরে খেলা ভুলে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য খেলোয়াড়রা তাঁর কাছে যেত। সেকথাটা নয়রাটকে বলতে তিনি বললেন, ‘অতিশয় হক কথা। পৃথিবীতে মেলা ধর্ম আছে তাই ক্রিশ্চান, জু এবং দাবাড়ে। দাবা খেলা ধর্মের পর্যায়ে পড়ে, আর যারাই এ ধর্ম মানে তারা সব-ভাই সব-ব্রাদার। দাবাড়েদের “পেনফ্রেন্ড” পৃথিবীর সর্বত্র যেরকম ছড়ানো তার সঙ্গে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানের তুলনা হয় না।’

তার পর বললেন, ‘সেই যে বাবা দাবা ধরিয়ে দিলেন তার পর ওর হাত থেকে আমি আর রেহাই পাইনি। একবার এক পাঁড় মাতালকে বলতে শুনেছিলুম, সে নাকি জীবনে মাত্র একবার মদ খেয়েছে। আমরা সবাই আসমান থেকে পড়লুম, উল্লুকটা বলে কী– উদয়াস্ত যে লোকটা “ট্যানিসে”র উপর থাকে, সে কি না জীবনে কুল্পে একটিবার মদ খেয়েছে! বেহেড মাতাল এরেই কয়। তখন মাতাল বললে সে মদ খেয়েছে একবারই তার পর থেকে এ অবধি শুধু তার খোঁয়ারিই ভাঙছে।’

আমি বললুম, ‘ওমর খৈয়াম এ বাবদে যা নিবেদন করেছেন সেটা ঠিক হুবহু এর সঙ্গে খাপ খায় না, তবু অনেকটা এরই কান ঘেঁষে। খৈয়াম বলেছেন, “রোজার পয়লা রাত্তিরে অ্যায়সা পিনা পিউংগা যে তারই নেশার বেহুঁশিতে কেটে যাবে রোজার ঝাড়া পুরো মাসটা। হুঁশ হবে ঈদের দিন। ঈদ মানে পর্ব (পর্ব par exellence), পর্ব মানতে হয়, না হলে জাত যাবে, ধর্ম যাবে, তাই তখন ফের বসে যাব সুরাহি পেয়ালা প্রিয়া নিয়ে।“ তার পর খৈয়াম কী করেছিলেন সে হদিস তার রুবাইয়াতে মেলে না, তবে বিবেচনা করি, দুসরা রমজান ত তিনি তাঁর কায়দা-কানুনে কোনও রদবদল করেননি।’(৪)

ফ্রানৎসিসকা এতক্ষণ কোনও কথা বলেননি। এখন বললেন, ‘আমি তো এ রুবাই ফিটজিরান্ডে পাইনি। আপনি কি ফার্সিতে পড়েছেন?’

আমি বললুম, ‘ফিটজিরাল্ড তো তর্জমা করেছেন মাত্র বাহাত্তর না বিরাশিটি রুবাইয়াৎ। ওমরের নামে প্রচলিত আছে আট শ’ না এক হাজার, আমি ঠিক জানিনে। তবে এ রুবাইটি আপনি নিশ্চয়ই হুইনসফিল্ড কিংবা নিকোলার অনুবাদে পাবেন। এরা ওমরের প্রায় কোনও রুবাই-ই বাদ দেননি।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা শুধালেন, ‘আপনি যে বললেন, “ওমরের নামে প্রচলিত রুবাইয়াৎ” তার অর্থ কী? আপনি কি বলতে চান, এগুলো ওমরের রচনা নয়?’

আমি বললুম, ‘গুণীদের মুখে শুনেছি, ওমরের বেশির ভাগ রুবাইয়াতের মূল বক্তব্য ছিল, “এই বিরাট বিশ্ব-সংসার কোন নিয়মে চলে, কী করলে ঠিক কর্ম করা হয় এসব বোঝা তোমার-আমার সাধ্যের বাইরে। অতএব যে দু দিন এ সংসারে আছ সে দু দিন ফুর্তি করে নাও; মরার পর কে কোথায় যাবে, কী হবে, না হবে তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই।“ তার পর থেকে অন্য যে কোনও কবি এই মতবাদ প্রচার করে নতুন রুবাই লিখতেন তিনি তক্ষুনি সেটা ওমরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেন। তার কারণও সরল। ওমর রাজানুগ্রহ পেয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মুলুকও ছিলেন তাঁর ক্লাসফ্রেন্ড। তাই তিনি নির্ভয়ে ইসলামবিরোধী এই চার্বাকি মতবাদ প্রচার করে যেতে পেরেছিলেন; কিন্তু পরের আমলে আর সব কবির সৌভাগ্য তো হয়নি তারা মোল্লাদের বিলক্ষণ ডরাতেন। তাই তাঁরা তাঁদের বিদ্রোহী মতবাদ ওমরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আপন প্রাণ বাঁচাতেন–ওদিকে যা বলবার তা-ও প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে যেতেন।

‘তাই দেখতে পাবেন, হাফিজের (এবং অন্য আরও কয়েক কবির) দিওয়ানে (তথাকথিত কপ্লিট ওয়ার্কসে’) ওমরের কবিতা, আবার ওমরের দিওয়ানে হাফিজের কবিতা। এ জট ছাড়িয়ে ওমরের কোনগুলো, হাফিজের কোনগুলো সে বের করা আজকের দিনে অসম্ভব।’

নয়রাট বললেন, ‘আপনাদের ওমর কোনও কন্মের নয়। তার স্বর্গপুরীর বর্ণনাতে তিনি বলেছেন,

‘সেই নিরালা পাতায়-ঘেরা
বনের ধারে শীতল ছায়
খাদ্য কিছু, পেয়ালা হাতে,
ছন্দ গেঁথে দিনটা যায়।
 মৌন ভাঙি তার কাছেতে
গুঞ্জে তবে মঞ্জু সুর
 সেই তো সখি, স্বর্গ আমার,
সেই বনানী স্বর্গপুর।’

 ‘অত সব বয়নাক্কার কী প্রয়োজন!

‘এক দাবাতেই যখন তাবৎ কিস্তিমাত হয়?’

ফ্রান্‌ৎসিসকা শুধালেন, “ওমর সম্বন্ধে নানারকমের আজগুবি গল্প শোনা যায় আমার মন সেগুলো মানতে রাজি হয় না, কিন্তু সেগুলো মানা না-মানার চেয়েও বড় প্রশ্ন; খুদ সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে, ইসলামের মতো কট্টর ধর্মাবলম্বীদের দেশে তিনি তার বিদ্রোহ জাহির করলেন কোন সাহসে? বুঝলুম না হয় রাজা আর প্রধানমন্ত্রী তাকে রক্ষা করছিলেন কিন্তু সেইটেই তো শেষ কথা নয়। সে যুগে দেশের পাঁচজন কী ভাবত না-ভাবত তার হয়তো খুব বেশি মূল্য ছিল না। কিন্তু মোল্লা সম্প্রদায়? সে যুগের রাজারাও তো ওদের সমঝে চলতেন।’

আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ভেবে দেখুন তো, রাজাতে-পোপেতে যদি ঝগড়া লাগে তবে শেষ পর্যন্ত কী হয়? হুকুম চালাবার জন্য রাজারা সৈন্যের ওপর নির্ভর করেন। সৈন্যরা যদি রাজার প্রতি সহানুভূতি রাখে তবে তারা হুকুম পাওয়ামাত্রই মোল্লাদের ঠ্যাঙাতে রাজি; পক্ষান্তরে তারা যদি মোল্লাদের মতবাদে বিশ্বাস রাখে তবে তারা বিদ্রোহ করে, অর্থাৎ রাজাকে ধরে ঠ্যাঙায়।

‘এ তো হল কমন সেন্স। তাই এস্থলে প্রশ্ন ইরানের লোক সে আমলে কতখানি ইসলাম অনুরাগী ছিল?

‘ইতিহাস থেকে আমার যেটুকু জ্ঞান হয়েছে কিন্তু থাক, এসব কচকচানি হয়তো হার নয়রাট পছন্দ করছেন না–’

নয়রাট বললেন, ‘ফের এটিকেট? আর এটিকেট হলই-বা আমি আপনার বক্তব্যটা শুনছি ইন টার্মস্ অব চেস্। আপনি এখন ওপনিং গেম্ আরম্ভ করেছেন, তার পর মিড় গেম আসবে– আমি দেখছি আপনি খুঁটিগুলো কী কায়দায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন– যা। বলছিলেন বলে যান।’

আমি বললুম, ‘ইরানের সভ্যতা-সংস্কৃতি আরবদের চেয়ে বহু শত বৎসরের খানদানি। ইরান ইসলাম প্রচারের বহু পূর্বেই রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে গ্রিসের সঙ্গে লড়েছে, ভারতের পশ্চিম সীমান্ত দখল করেছে, মিশরিদের সঙ্গে টক্কর দিয়েছে, রোমানদের বেকাবু করেছে, অর্থাৎ রাষ্ট্র হিসেবে ইরান বহু শত বৎসর ধরে পৃথিবীর পয়লা শক্তি হিসেবে গণ্য হয়েছে। পৃথিবীর সম্পদ ইরানে জড়ো হয়েছিল বলে ইরানিরা যে স্থাপত্য, যে ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিল তার সঙ্গে তুলনা দেবার মতো কলানিদর্শন আজও পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। আর বিলাস ব্যসনের কথা যদি তোলেন তবে আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস ইরানিরা যেরকম পঞ্চেন্দ্রিয়ের পূর্ণতম আনন্দ গ্রহণ করেছে সেরকমধারা তাদের পূর্বে বা পরে কেউ কখনও করতে পারেনি।

‘এই ধরুন না, আরব্য উপন্যাস। অথচ বেশিরভাগ গল্পে যে ছবি পাচ্ছেন সেগুলো আরবের নয়, ইরানের আমার ব্যক্তিগত ‘ফেন্সি’ মত নয়, পণ্ডিতেরা একথাই বলেন।

‘মনে পড়ছে সেই গল্প?– যেখানে এক সুন্দরী তরুণী এসে এক ঝাঁকা-মুটেকে নিয়ে চলল হরেকরকমের সওদা করতে। মাছমাংস, ফলমূল কেনার পর সে তরুণী যেসব সুগন্ধি দ্রব্য কিনল তার সবকটা জিনিসের অনুবাদ কি ইংরেজি, কি ফরাসি, কি বাংলা কোনও ভাষাতেই সম্ভব হয়নি– কারণ, এসব জিনিসের বেশিরভাগই আমাদের অজানা। এমনকি আজকের দিনের আরবরা পর্যন্ত সেসব বস্তু কী, বুঝিয়ে বলতে পারে না। তুলনা দিয়ে বলছি, আজকের দিনে প্যারিসে যে পাঁচ শ রকমের সেন্ট বিক্রি হয় সেগুলোর বয়ান, ফিরিস্তি, অনুবাদ কি এসকিমো ভাষায় সম্ভব?

‘ইরানের তুলনায় সে যুগে আরবরা ছিল প্যারিসের তুলনায় অনুন্নত অর্থাৎ সভ্যতা-সংস্কৃতি নিম্ন পর্যায়ে। সেই আরবরা যখন ধর্মের বাঁধনে একজোট হয়ে ইরানে হানা দিল তখন বিলাস-ব্যসনে ফুর্তি-ফার্তিতে বে-এক্তেয়ার ইরানিরা লড়াইয়ে হেরে গেল। আপনাদের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত দিতে গেলে গ্রিস-রোমের কাহিনী বলতে হয়, সে কাহিনী আমার বলার প্রয়োজন নেই। সেটা হবে “সুইটজারল্যান্ডে ঘড়ি আনার মতো”।

‘ইরানিরা মুসলমান হয়ে গেল, কেন হল সে কথা আরেকদিন হবে, যারা হতে চাইল না অথচ জানত দেশে থাকলে অর্থনীতির অলঙ্ঘ্য নিয়মে একদিন হতেই হবে, তারা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল আমার দেশ ভারতবর্ষে– সে ইতিহাসও এস্থলে অবান্তর।

 ‘আরবরা মরুভূমির সরল, প্রিমিটিভ মানুষ; তারা ইরানের বিলাস-ব্যভিচার দেখে স্তম্ভিত শকট’, ‘আউট-রেজড’। আবার ইরানিরাও আরবদের বেদুইন ধরন-ধারণ দেখে ততোধিক স্তম্ভিত এবং ‘শকট’।

‘তদুপরি আরেকটা কথা ভুললে চলবে না, আরবরা সেমিটি বংশের (ইহুদি গোত্রের সঙ্গে তাদের ‘মেলে’), আর ইরানিরা আর্য। জীবনাদর্শ ভিন্ন ভিন্ন; ধর্ম এক হলে কী হয়? প্যারিসের ক্রিশ্চান আর নিগ্রো ক্রিশ্চান কি একই ব্যক্তি?

 ‘এইবার মোদ্দা কথায় ফিরে যাই; ইরানিরা মুসলমান হল বটে (এবং এদের অনেকেই খাঁটি মুসলিম) কিন্তু তাদের মজ্জাগত মদ্যাদি পঞ্চ’মকার ছাড়তে পারল না। তাই ইরানের জনসাধারণ, ওমরের মদ্য-দর্শনবাদ খুশিসে বরদাস্ত করে নিল।

‘দেশের লোক যখন গোপনে গোপনে মদ খায় তখন রাজার আর কী ভাবনা? মোল্লারা যা বলে বলুক, যা করে করুক– এবং একথাও রাজার অজানা ছিল না যে, বহু লোক আপন হারেমে বসে ঐতিহ্যগত মদ্যপানে কার্পণ্য করেন না।

‘তাই ওমর বেঁচে গেলেন, রাজাও কোনও মুশকিলে পড়লেন না।’

***

নয়রাট বললেন, ‘আপনাদের ওমর খৈয়াম যা আমার ট্যুনিস-শেলও তা।’

আমি ঠিক বুঝতে না পেরে শুধালুম, ‘ট্যুনিস-শেল নিয়ে তো সব রসিকতার গল্প, আর খৈয়াম তো রচেছেন চতুস্পদী।’

নয়রাট বললেন, ‘মিলটা অন্য জায়গায়। আপনিই বললেন না, দুনিয়ার যত ঈশ্বর-বিদ্রোহী, মদ্যোৎসাহী চতুষ্পদী– তা সে ওমরের হোক, হাফিজের হোক, আত্তারের হোক, সবকটা এসে জুটেছে ওমরের চতুর্দিকে, ঠিক তেমনি রসিকতার গল্পে নায়ক যদি মাত্র দু জন হয়, আর তার একজন আরেক জনের ওপর টেক্কা মারার চেষ্টা করে তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলো ট্যুনিস-শেলের নামে চালু হবেই হবে। এগুলোকে তাই সাই (চক্র) বলা হয়। ওমর সাইকল, ট্যুনিস-শেল সাইল কিম্বা পলডি সাইকল। ওমর যেরকম ইরানের, ট্যুনিস-শেল তেমনি জর্মনির কলোন শহরের আবার পলডি সুইটজারল্যান্ডের। আপনাদের ভারতবর্ষে এরকম সাইকল আছে? ’

আমি বললুম, ‘এন্তার! হর-পার্বতী সাইকল, গোপালভড় সাইকল, শেখ চিল্লি সাইকল এবং আরও বিস্তর। কিন্তু পলডি সাইকলের বিশেষত্ব কী?’

নয়রাট বললেন, ‘পলডি হলেন অতিশয় খানদানি ঘরের ছেলে, উত্তম বেশ ভূষায় ছিমছাম হয়ে বেরোন না, সকলের সঙ্গে অতিশয় দ্র ব্যবহার–এ তো সব হল; কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, তিনি একটি পয়লা নম্বরের বক্কেশ্বর, আনাড়ির চূড়ামণি– বেঅকুফের শিরোমণি। দু একটা উদাহরণ দিচ্ছি–’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘কিন্তু প্লিজ, অশ্লীলগুলো না।’

 নয়রাট বেদনাতুরতার ভান করে বললেন, ‘ফ্রান্‌ৎসিসকাকে নিয়ে ওই তো বিপদ। এক শ’ বার বোঝাবার চেষ্টা করেছি, শ্লীল-অশ্লীল– একেবারে স্বতঃসিদ্ধরূপে অর্থাৎ perse– পৃথিবীতে নেই, যেরকম নিজের থেকে ‘ডার্ট’ বা ময়লা বলে কোনও জিনিস হয় না। অস্থানে পড়লেই জিনিস ডার্ট হয়। ডাস্টবিনের ভিতরকার ময়লা ময়লা নয়– একথা কেউ বলে না, ‘ডাস্টবিন ময়লা হয়ে গিয়েছে, ওটা সাফ কর’, বলে, ‘ডাস্টবিন ভর্তি হয়ে গিয়েছে।’ ঠিক তেমনি সুন্দরীর ঠোঁটের উপর লিপস্টিক ডার্ট নয়, কিন্তু যদি সেই লিপস্টিক আমার গালে লেগে যায়–

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘পেটার! আবার!”

আমার মনে হল, ফ্রান্‌ৎসিসকা বাড়াবাড়ি করছেন, তাই নয়রাটকে সমর্থন করার জন্য গুনগুন্ করলুম,

‘অধরের তাম্বুল বয়ানে লেগেছে
ঘুমে ঢুলুঢুলু আঁখি’

 দুজনেই জিগ্যেস করলেন, “মানে?’

আমি সালঙ্কার সবিস্তর নন্দকুমার গণ্ডে চন্দ্রাবলীর তাম্বুলরাগের বর্ণনা দিলুম।

নয়রাটকে আর পায় কে? চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘শুনলে, গিন্নি শুনলে? শ্রীকৃষ্ণ ভারতীয়দের স্বয়ং ভগবান, আমাদের যেরকম যিশুখ্রিস্ট। তিনি যদি রাধা ভিন্ন অন্য রমণীকে দয়া দেখাতে পারেন, তবে আমার গালে কিংবা ইভনিং শার্টে লিপস্টিক আবিষ্কার করলে তুমি মর্মাহত হও কেন?’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বাধা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী চিড মিথ্যেবাদী রে, বাবা! আমি আর মা-বোন ভিন্ন অন্য মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে হলে যে পুরুষ-হা পুরুষই বটে– শব্দের জন্য পকেট-ডিক্সনারি বের করে তার গালে লিপস্টিক! ডু লিবার হার গট ফন বেনটাইম (বাংলায়–”হে পিণ্ডিদাদন খানের মা কালী।”)।’

আমি বললুম, ‘কিন্তু হার নয়রাট, একটা ভুল করবেন না। দেবতা যা করবার অধিকার রাখেন, সাধারণ মানুষের তা নেই। কিন্তু সেকথা থাক, শ্লীল-অশ্লীল সম্বন্ধে আপনি কী যেন বলছিলেন?’

নয়রাট বললেন, ‘perse বাই ইটসেলফ যেরকম ডার্ট হয় না, ঠিক তেমনি স্ব-হকে কোনও জিনিস অশ্লীল নয়। উদাহরণ দিয়ে বলি, যেখানে বাইবেল পাঠ হচ্ছে সেখানে হঠাৎ পেটের ব্যামো নিয়ে আরম্ভ করা অশ্লীল এবং তার চেয়েও ভালো দৃষ্টান্ত ডাক্তাররা যেখানে যৌন সম্পর্কের আলোচনা করছেন, সেখানে বেমক্কা বাইবেল পাঠ আরম্ভ করা তার চেয়েও বেশি অশ্লীল।’

অর্থাৎ বক্তব্য বস্তু প্রতীয়মান, জাজ্বল্যমান করার জন্য যে কোনও দৃষ্টান্ত, যে কোনও তথ্য, যে কোনও গল্প শ্লীল– তা সে পঁচিশবার দাস্তের বয়ানই হোক, গণিকা জীবনকাহিনীই হোক। পক্ষান্তরে ইররেলেভেন্ট আউট অব প্লেস (বেমক্কা) জিনিস, তা সে ধর্মসঙ্গীতই হোক আর টমাস আকুনিয়াসের জীবনই হোক।’

আমার আশ্চর্য লাগল। কারণ দেশের ভটচাজ মশাই (‘পদটীকা’ দ্রষ্টব্য) এবং কাবুলের মৌলানা মির আসলম (‘দেশে-বিদেশে’ দ্রষ্টব্য) ওই একই কথা বলেছিলেন।

আমি বললুম, ‘খাঁটি কথা। কিন্তু এসব থাক না এখন। বরঞ্চ একটা পলডি গল্প বলুন।’’

 নয়রাট বললেন, ‘সেই ভালো।’

 ‘পিয়ন পলডিকে মনিঅর্ডারের টাকা দিল। পলডি দিল জোর টিপস। পাশে বসেছিলেন বন্ধু, তিনি বললেন, “পলডি, অত বেশি টিপস দিলে কেন?” পলডি পরম সন্তোষ সহকারে মাথা হেলিয়ে-দুলিয়ে বলল, “ওই তো! কিসসু জানো না, কিসসু সমঝো না; জোর টিপস দিলে ঘন ঘন মনিঅর্ডার নিয়ে আসবে না?” ’

আমার হাসি শেষ হবার পূর্বেই নয়রাট বললেন, কিংবা ধরুন পডির বুকে ব্যথা। ডাক্তার অনেকক্ষণ ধরে বুক-পিঠ বাজিয়ে বললেন, “ঠিক ডায়গনোজ করতে পারছিনে। তবে মনে হচ্ছে অত্যধিক মদ্যপানই কারণ।’

পডি হেসে বললেন, ‘তাই নিয়ে বিচলিত হবেন না, ডাক্তার, আমি না হয় আরেকদিন আসব, যেদিন আপনি অত্যধিক মদ্যপান করে মাতাল হয়ে যাননি।’

নয়রাট বললেন, ‘পলডি-রসিকতাতে শুধু থাকে রস। ওগুলোর ভিতর দিয়ে পডির দেশ, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি সম্বন্ধে বিশেষ কোনও খবর পাওয়া যায় না কিন্তু ট্যুনিস-শেলের গল্পের ভিতর দিয়ে জর্মনি, কলোনের শ্রমিক-শ্রেণি এবং তাদের জীবনধারণ সম্বন্ধে অনেক খবর পাওয়া যায় এবং তাতে করে গল্পগুলো বেশ একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের রঙ ধরে। এই ধরুন পাদ্রি সম্প্রদায়কে নিয়ে আমরা প্রায়ই ব্যঙ্গ করে থাকি। তারই একটা ট্যুনিস-শেল সাইক্লে বেশ খানিকটে রসের সৃষ্টি করেছে।

‘ট্যুনিস আর শেল একখানা দশ টাকার নোট কুড়িয়ে পেয়েছে (কটলেটের গল্পে পূর্বেই বলেছি তারা হরদম রাস্তায় টাকা কুড়িয়ে পায়) এবং ঝগড়া লেগে গিয়েছে টাকাটার ওপর কার হক। ট্যুনিস বলে সে আগে দেখেছে; শেল বলে সে আগে কুড়িয়ে নিয়েছে এবং ‘পজেশন ইজ থ্রি-ফোর্থ অব ল’। তার পর এ বলে ও মিথ্যেবাদী, ও বলে এ মিথ্যেবাদী। করতে করতে হঠাৎ ট্যুনিস বলল, “তাই সই, মিথ্যেবাদী হওয়াটাও কিছু সোজা কর্ম নয়, আমি হচ্ছি পাঁড় মিথ্যেবাদী আর তুই হচ্ছিস পেঁচি (এমেচার) মিথ্যেবাদী।” শেল বলল, “গাঁজা, ঠিক তার উল্টো।”

 ‘তখন স্থির হল পাল্লা দিয়ে দু জনে মিথ্যে কথা বলবে, যে সবচেয়ে বেহুদা বেশরম মিথ্যে বলতে পারবে, টাকাটা সে-ই পাবে।

‘তখন ট্যুনিস বিসমিল্লা বলে আরম্ভ করল—

 ‘পরশুদিন ঘরে মন টিকছিল না বলে বাইরে এসে এক লক্ষে চলে গেলুম আমেরিকায়। সেখানে পৌঁছল এক সমুদ্রপারের ‘লিডো’তে। দেখি হাজার হাজার মেয়েম সেখানে চান করছে, সাঁতার কাটছে। আর ছুঁড়িগুলো কী বেহায়া! আমার এই একটা নেকটাইয়ের কাপড় দিয়ে তিনটে মেয়ের সুইমিং কম হয়ে যায়। (ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘পেটার, আবার?’ নয়রাট বললেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, টাপেটোপে বলছি’।) আমার ভয়ঙ্কর রাগ হল। করলুম কী, সবকটা হুলো-মেনিকে ধরে একটা ব্যাগে পুরে দিলুম আরেক লাফ। এবার পৌঁছলুম, ফুজি-আমা পাহাড়ের কাছে। ব্যাগের ভিতর তিন হাজার বেড়াল ক্যাঁও ম্যাঁও করছিল বলে আমার দারুণ বিরক্তি বোধ হল। তাই আস্ত ব্যাগটা গিলে ফেলে গোটা আড়াই ঢেকুর তুললুম, তার পর—”

‘শেল বাধা দিয়ে বলল, “এতে আর মিথ্যে কোনখানটায় হল? আমি তো তোর সঙ্গেই ছিলুম, পষ্ট দেখলুম, তুই এসব করছিলি।” ’

ফ্রান্‌ৎসিসকা গল্পটা আগে শোনেননি বলে হাসলেন। আমিও বললুম, ‘এ গল্পটা ভারি নতুন ধরনের। শেলের উত্তরটা অত্যন্ত আচমকা একটা ধাক্কা দিল।’

নয়রাট বললেন, ‘গল্পটা এখনও শেষ হয়নি।’

 আমরা বললুম, ‘সে কী কথা?’

নয়রাট বললেন, ‘গল্পটা যদিও খাস কলোন শহরের, তবু তার টেকনিকে একটু চীনা পদ্ধতি এসে গিয়েছে। এ গল্পে দুটো ‘সারপ্রাইজ’, কিংবা বলতে পারেন দুটো কিক আছে। খুলে বলছি :

‘ট্যুনিস আর শেল যখন রাইন নদীর পাড়ের রেলিঙে ভর করে মিথ্যের জাহাজ ভাসাচ্ছিল, তখন এক পাদ্রি সাহেব পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তসৌন্দর্য নিরীক্ষণ করছিলেন। অনিচ্ছায় কিংবা স্বেচ্ছায়ও হতে পারে, ট্যুনিস-শেলের বিকট মিথ্যের বহর তার কানে এসে পৌঁছেছিল। থাকতে না পেরে বলরেন, “ছি, ছি, বাছারা; এরকম ডাহা মিথ্যে তোমরা মুখ দিয়ে বের করছ কী করে? জান না, মিথ্যা কথা মহাপাপ? আমি জীবনে কখনও মিথ্যা বলিনি।”

‘ট্যুনিস পাদ্রির কথা শুনে প্রথম হকচকিয়ে গেল, তার পর থ মেরে গেল। সম্বিতে ফিরে শেষটায় ক্ষীণকণ্ঠে, বাজি হারার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শেলুকে বলল, “ভাই শেল, নোটটা ওকেই দে, টাকাটা ওরই পাওনা। তুই এরকম পাড় মিথ্যে বলতে পারবিনে; আন্মো পারব না।” ’

আমি বললুম ‘খাসা গল্প; এটা মনে রাখতে হবে।’

 ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘কিন্তু আমি জানি, পেটার ওখানে থাকলে প্রাইজটা সে-ই পেত।’

আমি নয়রাটকে বললুম, ‘গল্পটি সুন্দর, কিন্তু এতে টিপিকাল কলোনের কী আছে? আমাদের মোল্লা-পুরুত সম্বন্ধেও তো এরকম বদনাম আছে।’

নয়রটি বললেন, ‘আমি জানতুম না। তবে নুন আরেকটা আর এর জবাব আপনি দিতে পারবেন না।

‘ট্যুনিস-শেল আবার একখানা দশ টাকার নোট পেয়েছে (ট্যুনিস-শেল সাইক্লের ভিতরে হচ্ছে “নোটের সাব-সাইকেল”)। এবারে ঝগড়া হয়নি। দু জনে সেই টাকা দিয়ে মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছে রাস্তায়। পুলিশ তাদের পৌঁছে দিয়েছে হাসপাতালে। সকালবেলা তাদের ঘুম ভেঙেছে আর নেশা কেটেছে। দেখে চতুর্দিক ফিটফাট, ছিমছাম। ট্যুনিস শুধাল, “ওরে শেল, এ আবার এলুম কোথায়?” শেল বলল, “আমিও তাই ভাবছি। দাঁড়া, দেখে আসছি।”

‘শেল গেল ঘরের বাইরে। পাঁচ সেকেন্ডের ভিতর ছুটে এসে বলল, “ওরে ট্যুনিস– আমরা ভারতবর্ষে পৌঁছে গিয়েছি– রাতারাতি আমাদের ভারতে পাচার করে দিয়েছে।”

ট্যুনিস তো তাজ্জব। শুধাল, “কী করে জানলি?”

বললে, করিডরে মোটা হরপে লেখা আছে “Die Toiletten bifinden sich auf jenseits des Ganges.”

নয়রাট বললেন, ‘অর্থাৎ “করিডরের দু পাশে বাথরুমের ব্যবস্থা আছে”। এখন ‘করিডর’ শব্দ জর্মনে Gang আর Gang-এর দু পাশে অর্থাৎ ষষ্ঠী তৎপুরুষ Ganges, তার মানে বাথরুম গঙ্গার (নদীর) দু পারে।’

‘তাই ট্যুনিস-শেল রাতারাতি ভারতে পৌঁছে গিয়েছে।’

 নয়রাট বললেন, ‘দেশভ্রমণের গল্পই যদি উঠল তবে সেই সাবসাইক্লই চলুক।’

আমি বললুম ‘উত্তম প্রস্তাব।’

নয়রাট বললেন, ‘ট্যুনিস-শেল পেটের ধান্দায় হামবুর্গ গিয়ে জাহাজের খালাসির চাকরি নিয়ে পৌঁছেছে গিয়ে ইস্তাম্বুল শহরে, সেখানে–’।

ফ্রানৎসিসকা বললেন, ‘না, পেটার, ওটা চলবে না।’

নয়রাট ব্যথাভরা নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘গল্পটা কিন্তু ছিল খাসা; তার আর কী করা যায়! তবে তাদের নিয়ে যাই নিউইয়র্কে।

‘হয়েছে কী, টুনিসের এক মামা নিউইয়র্কে দু পয়সা রেখে মারা গিয়েছে। ট্যুনিস উকিলের চিঠি পেয়েছে তাকে সেখানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজের শনাক্ত দিয়ে টাকাটা ছাড়িয়ে আনতে হবে। ওদিকে ট্যুনিস আবার ভয়ানক ভীতু ধরনের লোক। একা বিদেশ যেতে ডরায়– শেলকে বলল, “ভাই তুই চ।” শেল ভাবল– আর আমিও তাই ভাবতুম– মন্দ কী, ফোকটে মার্কিন মুলুকটা দেখা হয়ে যাবে।

‘তারা নিউইয়র্ক পৌঁছল ঠিক বড়দিনের দিন। তামাম মার্কিন দেশ ঝেটিয়ে এসে জড় হয়েছে নিউইয়র্কে পরব করার জন্য, সব হোটেল আগাগোড়া ভর্তি, করিডরে পর্যন্ত ক্যাম্প কট পেতে শোবার ব্যবস্থা ফালতো গেস্টদের জন্য করা হয়েছে।

‘মহা দুর্ভাবনায় পড়ল দুই ইয়ার। ডিসেম্বরের শীতে আশ্রয় না পেলে শীতেই অক্কালাভ। দুই বন্ধু কলোন গির্জের মা মেরিকে স্মরণ করে এক ডজন মোমবাতি মানত করল। আপনি তো মুসলমান, এসব মানেন না, কিন্তু—’

আমি বললুম, ‘আলবত মানি। এক শ’ বার মানি। কলকাতায় মৌলা আলীর দর্গায় মোমবাতি মানত করলে বহু বাসনা পূর্ণ হয়। আর আমাদের দেশে এমন জায়গাও আছে যেখানে মানত করলে মোকদ্দমা পর্যন্ত জেতা যায়।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা শুধালেন, ‘ডিভোর্স পাবার দরগা আছে?”

আমি বললুম, ‘বিলক্ষণ, তবে সেখানে স্বামী-স্ত্রীকে একসঙ্গে গিয়ে কামনাটা জানাতে হয়।’

নয়রাট আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ।’ তার পর গল্পের খেই তুলে নিয়ে বললেন, ‘কলোনের মা মেরি বড় জাগ্রত দেবতা। একটা হোটেলে শেষটায় একটা ডবল রুম জুটে গেল, কিন্তু ব্যবস্থাটা শুনে দুই ইয়ারই আঁতকে উঠলেন।

‘ঘর পঞ্চাশ তলায়, আর লিফট বিগড়ে গিয়েছে!

‘দুইজনাই একসঙ্গে বলল, “হে মা মেরি, এতটা দয়াই যখন করলে, তখন লিফটুটা সারাতে পারলে না মা?”

আমি বললুম, ‘আমাদের গোপালভাঁড়ও তাই বলেছিল,–

‘এত দয়াই যদি করলি, মা কালী,
তবে আরেকটু দয়া করে,
বনে আছে দেদার ফড়িং
খা না দুটো ধরে।

নয়রাট বললেন, ‘গল্পটা কী?’

আমি বললুম, ‘আপনাকে একদিন সময়মতো আমাদের “গোপালভাঁড়-সাইক্ল” শোনাব, তবে তার অনেকগুলো ফ্রান্‌ৎসিসকার সামনে বলা চলবে না।’

নয়রাট বললেন, ‘তবে নিয়ে চলুন আপনাদের ডিভোর্স-দর্গায়।’

 সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে ফ্রান্‌ৎসিসকা ভাঁড়ারঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। আমি বললুম, ‘অত তাড়া কিসের? ভারত যাবার জাহাজ আরও সপ্তাহখানেক পর ছাড়ে।’

নয়রাট বললেন, ‘তখন ট্যুনিস শেলকে বলল, “ভাই, এ ছাড়া আর উপায় যখন নেই তখন চ, সিঁড়ি ভাঙি আর কি?”

শেল বলল, “একটা ব্যবস্থা করলে হয় না, প্রতি তলা উঠতে উঠতে তুই এক-একটা করে গল্প বলবি আর তাতেই মশগুল হয়ে আমরা পঞ্চাশতলা বেয়ে নেব। তুই তো মেলা গল্প জানিস।”

 ট্যুনিস বলল, “যা বলেছিস, সাধে কি আর তোকে সঙ্গে এনেছিলুম? তবে শোন”, বলে আরম্ভ করলে সিঁড়ি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে গল্প বলা।’

নয়রাট বললেন, “সে কত বাহারে গল্প। আমি গল্প কলেক্ট করিনে, কিন্তু আমার এক বন্ধু আছেন, তাঁর সঙ্গে আমি আপনাকে আলাপ করিয়ে দেব, তিনি সবকটা জানেন।’

‘তা সে কথা থাক।’

‘ট্যুনিস আর শেল এক-এক তলার সিঁড়ি ভাঙে আর ট্যুনিস এক-একখানা জাত-রু গল্প ছাড়ে। হেসে খেলে বিন-মেহনত, বিন-কসরতে তারা পঁচিশতলা এক ঝটকায় মেরে দিল।

‘তখন ট্যুনিস বললে, “ভাই শেল, আমার সব গল্প খতম। আর কোনও গল্প মনে পড়ছে না।”

‘তখন শেল্‌ বলল, “ঘাবড়াসনি। আমারো কিছু পুঁজি আছে।”

‘বলে তখন শেল আরম্ভ করল গল্প বলতে। সে-ও কিছু কম বাহারে নয়, তবে ট্যুনিস তালেবর ব্যক্তি, তার সঙ্গে তুলনা হয় না।

‘করে করে তারা আরও চব্বিশখানা সিঁড়ি ভাঙল– গল্প বলার সঙ্গে সঙ্গে।

‘মাত্র একতলা বাকি। শে দুম্ করে মাটিতে বসে পড়ল। এক ঝটকায় হোক আর ঊনপঞ্চাশ ঝটকায়ই তোক পাগুলো তো আর গল্প শুনতে পায় না। শে ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়ে বলল, “ভাই আমার গুদোমও খতম।”

‘তখন ট্যুনিস বলল, “কুছু পরোয়া নদারদ। আমার একখানা খাসা গল্প মনে পড়েছে– একদম সত্যি গল্প। আমরা ফ্ল্যাটের চাবি সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছি।”

.

লাঞ্চ খেতে এসে তখন প্রায় চায়ের সময় হয়ে গিয়েছে অথচ গালগল্পের কম্বলের ভিতর এমনি ওম জমে গিয়েছে যে সে কম্বল ফুটো করে বেরোতে ইচ্ছে করে না। শীতের দেশ তো– উভয়ার্থে শীতের দেশ, ইয়োরোপীয়দের মনেও শীত; আড্ডা জমিয়ে সঙ্গসুখের আলিঙ্গনে সেটাকে গরম করতে জানে না–তাই এদের কুণ্ডলিতে বহুদিন পরে যেন বসন্ত’ রেস্টুরেন্টের আনন্দ পেলুম।

শেষটায় একটা হাফ-মোক পেয়ে বললুম, ‘আমি তা হলে উঠি।’

 নয়রাট একটি কথা বললেন, “কেন?”

আমি একটু অবাক হয়ে গেলুম। এরকম অবস্থায় সচরাচর বলা হয়, ‘সে কী কথা? এখনই যাবেন কেন?’ কিংবা ‘বড্ড কাজ পড়ে আছে বুঝি?’ অথবা অন্য কিছু। আমার কোনও জবাব যোগাল না।

নয়রাট বললেন, ‘দেখুন মশাই, আপনাকে বলিনি, কিন্তু আপনাকে আমি বিলক্ষণ চিনি। গেল কয়েকদিন ধরে যখনই লেকের পাড় দিয়ে কাজকর্মে কোথাও যেতে হয়েছে, তখনই আপনাকে দেখেছি, ওই একই বেঞ্চের উপর– তা-ও আবার একই পাশে বসে আছেন। শুনেছি, ইংলন্ডের পার্কে চেয়ারে বসলে তার জন্য ট্যাক্স দিতে হয়–’

ফ্রান্‌ৎসিসকা বললেন, ‘সেখানে দম ফেলতেও ট্যাক্স দিতে হয় এবং তারই ভয়ে কেউ যদি দম বন্ধ করে, তবে মরে গিয়ে তাকে ডেথ-ট্যাক্স দিতে হয়।’

নয়রাট বললেন, ‘তা হলে বিবেচনা করি সেখানে বিয়ের ওপরও ট্যাক্স আছে। আহা, ইংলন্ডে জন্মালে হত।’

ফ্রান্সৎসিসকা বললেন, “আহা, আমি যদি তিব্বতে জন্মাতুম। সেখানে প্রত্যেক রমণীর পাঁচটা করে স্বামী থাকে, আর সব কটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়।’

আমি বললুম, ‘ষাট, ষাট (ইংরেজিতে tut tut), ওরকম অলুক্ষণে কথা কইবেন না।

সমস্বরে, ‘কেন?’

আমি বললুম’ তা হলে আসছে জন্মে, পেটারকে জন্মাতে হবে ইংলন্ডে আর মাদাম ফ্রান্‌ৎসিসকা (বলে তাঁর দিকে বাও’ করে বললুম) আপনাকে জন্ম নিতে হবে তিব্বতে।’

দু জনাই কিচির-মিচির করে উঠলেন। তার থেকে যে প্রশ্ন ওতরাল তার মোটামুটি জিজ্ঞাসা, ‘আসছে জন্মে’ কথাটার মানে কী? আমরা তো মরে গিয়ে হয় স্বর্গে যাব, কিংবা নরকে, কিংবা কন্ধুর হয়ে যাব, কিন্তু ‘আসছে জন্মে’ তার অর্থ কী?

আমি বললুম, ‘এই যে পেটার শুধালেন, আমি বেঞ্চিতে সবসময় বসে থাকি কেন? তার অর্থ আমি চলাফেরা, হাঁটাহাঁটি করি না কেন? সুইটজারল্যান্ড যদি ইংলিশ কায়দায় বেঞ্চিতে বসতে হত তা হলে ট্যাক্স দিয়ে দিয়ে আমি ফতুর হয়ে যেতুম সেকথা আমি খুব ভালো করেই জানি কিন্তু চলাফেরা করলে আমাকে খেসারতি দিতে হবে অনেক অনেক বেশি।’

লাইন কোন দিকে চলেছে ফ্রান্‌ৎসিসকা যেন তার খানিকটা আভাস পেয়েছেন বলে মনে হল। পেটার কিন্তু রাতভর হদিস না পেয়ে শুধালেন, ‘এর কোনও মানে হয় না। আপনি রাস্তায় হাঁটছেন, তার জন্য ট্যাক্স দিতে হবে কেন? ইংলন্ডের মতো বর্বর দেশেও ওরকম ট্যাক্স নেই।’

আমি বললুম, ‘পরজন্মে মানুষ এ পৃথিবীতে আসে পূর্বজন্মের কামনা নিয়ে। আমি সমস্ত দিন যতদূর সম্ভব চুপচাপ বসে থাকি যাতে করে ভগবান পরজন্মে আমাকে এমন জায়গায় বসান যেখানে আমাকে কোনওকিছু না করতে হয়। আমি যদি হাঁটাহাঁটি করি, তবে ভগবান ভাববেন, আমি ওই কর্মই পছন্দ করি, আর আমাকে এ জগতে পাঠাবেন পোল্টম্যান করে। তখন মরি আর কী, জলঝড়ে, বিষ্টিতুফানে এর বাড়ি ওর বাড়ি চিঠি-পার্শেল বয়ে বয়ে।’

ফ্রান্‌ৎসিসকা শুধালেন, ‘আমি ঠিক ঠিক বুঝতে পারছিনে কিন্তু কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছি। আপনি বলতে চান, মানুষ মরে গিয়ে এই পৃথিবীতে আবার ফিরে আসে। সে কী করে হয়?’

জ্ঞানী পাঠক! অপরাধ নেবেন না। আপনি সেস্থলে থাকলে আমার অনেক পূর্বেই বুঝে যেতেন, ‘জন্মান্তরবাদ’ এরা জানে না এবং আপনি সেইটি বুঝতে পেরে তখুনি তার শাস্ত্রসম্মত সদুত্তর দিয়ে দিতেন। কিন্তু আমি তো পণ্ডিত নই, দেশ আমাকে আদর করে না, দেশ আমাকে খেতে-পরতে দেয় না। তাই তো লক্ষ্মীছাড়া গৃহহারা হয়ে গিয়েছি বিদেশ, আমি অতশত বুঝতে পারব কী করে?

তদুপরি আরেক কথা আছে। আমি মুসলমানের ছেলে। ইসলাম জন্মান্তরবাদ মানে না। যদিও প্রাগৈতিহাসিক যুগে মক্কাবাসীরা জন্মান্তরে বিশ্বাস করত। সেই যুগের একটি আরবি কবিতা এই সুবাদে মনে পড়ল।

কবিতাটির গীতিরস বাংলাতে অনুবাদ করার মতো বাংলা-ভাষা-জ্ঞান আমার নেই কিন্তু কল্পনাচতুর পাঠক হয়তো আমার অনুবাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি পেরিয়ে গিয়ে ঠিক তত্ত্বটি সমঝে যাবেন। মরুভূমির আরব বেদুইন প্রিয়াকে উদ্দেশ করে বলছে,

‘প্রিয়ে,
আরবভূমি, মরুভূমি নীরস কর্কশ
তোমার আমার প্রেমের সুধাশ্যামলিম-রস
কেউ বুঝতে পারল না।
তাই সর্বদেহমনহৃদয় দিয়ে প্রার্থনা করি,
 তুমি যেন এমন দেশে জন্মাও–
–আসছে জন্মে–
কত শত শতাব্দীর পরে তা জানিনে,
যেখানে মানুষ জলে ডুবে আত্মহত্যা করার
আনন্দ অনায়াসে অনুভব করতে পারে।’

 এর টীকা অনাবশ্যক। আরব দেশে হাঁটুজলের বেশি গভীরতর কোনওপ্রকার নদীপুকুর নেই। তাই কবি জন্মান্তরে সেই দেশের কামনা করেছেন যেখানে মানুষ জলে ডুবে চরম শান্তি পায়।

সে দেশ বাংলা দেশ। চেরাপুঞ্জির দেশ, যেখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। নদীনালা, পুকুর-হাওরে জলের থৈ থৈ।

আরব বেদুইন কবি এই দেশই মনে মনে কামনা করেছিল।

***

আমি বললুম, “আসছে জন্মের কথা থাক। আপনি যে এ জন্মের কাহিনী আরম্ভ করেছিলেন সেইটি তো শেষ করলেন না। আপনি বলছিলেন আপনার গুটিকয়েক শখ পূরণ করার জন্য আপনি একটানা ছাব্বিশ বছর খেটে পয়সা জমিয়ে এখন দিব্য আরাম করতে পারছেন। আপনার শখগুলো কী? ’

নয়রাট বললেন, ‘এক নম্বর দাবা খেলা আর দুনম্বর–বলতে একটু বাধো বাধো ঠেকছে।’

আমি বললুম, ‘এইবার আপনারা ভদ্রতা “আরম্ভ” করলেন।’

নয়রাট বললেন, ‘ভদ্রতায় ঠেকছে না, ঠেকছে অন্য জায়গায়। তবু না হয় বলেই ফেলি। আমি যখন ইস্কুলে যেতুম তখন একটি জারজ ছেলেকে আমার ক্লাসের ছেলেরা বড় ক্ষ্যাপা ছেলেরা এ বিষয়ে যে কীরকম কূর আর নিষ্ঠুর হতে পারে তার বর্ণনা আপনি নিশ্চয়ই মোপাসায় পড়েছেন। আমি তখনও গল্পটি পড়িনি কিন্তু আজ মনে হয় ছেলেটির দুর্দৈব কাহিনী মোপাসা শতাংশের একাংশও বর্ণনা করতে পারেননি। আমার নিজের বিশ্বাস যৌনবোধ না জন্মানো পর্যন্ত মানুষের মনে স্নেহ-করুণা ইতাদি কোনও প্রকারের সদ্‌গুণ দেখা দেয় না। তাই বালকেরা হয় সচরাচর অত্যন্ত নিষ্ঠুর আমি ক্লাসের আর সকলের চেয়ে ছিলুম বয়সে একটু বড়, আমার তখন নিজের অজানাতেই যৌনবোধ আরম্ভ হয়েছে এবং তাই ওই হতভাগ্য ছেলেটার জন্য আমার হৃদয়ে গভীর বেদনার উদ্রেক হত। কিন্তু বয়সে বড় হলে কী হয়, আমি ছিলুম একে রোগাপটকা, তার ওপর মারামারি হাতাহাতির প্রতি আমার আন্তরিক ঘৃণা। তাই আমি তাকে কোনওপ্রকারে সাহায্য না করতে পেরে মনে মনে বড় লজ্জা বোধ করতুম। তবে সুযোগ পেলেই, আর পাঁচটা ছেলের চোখের আড়ালে ওর হাতে একটা চকলেট গুঁজে দিতুম, রাস্তায় দেখা হলে একটা আইসক্রিম খাইয়ে দিতুম।

‘প্রথম যেদিন তাকে চকলেট দিয়েছিলুম সেদিন সে আমার দিকে বদ্ধ ইডিয়টের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল, তার পর দরদর করে তার দু চোখ বেয়ে জল বেরিয়ে এসেছিল। ক্লাসের তিরিশটে কসাইয়ের ভিতরেও যে একটি ছেলে গোপনে গোপনে তার জন্য হৃদয়ে দরদ ধরে এর কল্পনাও যে কখনও তার মনের কোণে ঠাই দিতে পারেনি।’

তাকিয়ে দেখি ফ্রান্‌ৎসিসকার চোখ ছলছল করছে। অথচ তিনি নিশ্চয় এ কাহিনী আগে শুনে থাকবেন। মনে মনে বললুম, নয়রাট সত্যই ‘সহধর্মিণী’ পেয়েছেন। বাইরে বললুম, ‘থামলেন কেন?’

বললেন, ‘এখনও বাধো বাধো ঠেকছে। তবু বলছি, কারণ এ বিষয়ে আমি মিশনারি।’

 ‘ছেলেটাকে ধমক দিয়ে বললুম, “এই ফুল! চোখ মুছে ফেল। আর সবাই দেখে ফেললে তোকে জ্বালাবে আরও বেশি, আমাকেও রেহাই দেবে না।”

‘চোখের জলের সঙ্গে আনন্দ আর কৃতজ্ঞতা মিশে গিয়ে তার চেহারা যে কীরকম বিকৃত হয়ে গিয়েছিল তার ছবি আমি আজও দেখতে পাই।

 ‘আপনাকে কী বলব, তার পর সেদিন ক্লাসে বসে যখনই আড়নয়নে তাকিয়েছি তখনই দেখেছি, সে চোখ বন্ধ করে আছে, তার ঠোঁটের দু কোণে গভীর প্রশস্তির মৃদু হাস্য, আর গালের আপেল দুটো খুশিতে উপরের দিকে উঠে চোখ দুটো যেন চেপে ধরেছে। আমি তো ভয়ে মরি, মূর্খটা আবার কী বলতে গিয়ে কী না বলে ফেলে।

‘তার পর দিন থেকে আরম্ভ হল আরেক আজব কেচ্ছা। ছেলেরা রুটিনমাফিক তাকে ‘ব্যা–ড’ বলল, চুলে ধরে টান দিল, অন্যান্য প্রকরণেরও কোনও খাকতি হল না কিন্তু সে-ও রুটিনমাফিক চিৎকার চেঁচামেচি গালাগাল দিল না– সে দেখি, চোখ বন্ধ করে মিটমিটিয়ে হাসছে– আমি ভাবলুম, হয়েছে, ছোঁড়াটা বোধ করি ক্ষেপে গেছে।

 ‘বহু পরে সে আমাকে একদিন বলেছিল, সে নাকি তখন খুশিতে ডগোমগো, তার নাকি ভারি আনন্দ, তার আর কী ভয়, এই ক্লাসেই তার একটি বন্ধু রয়েছে, সে তাকে চকলেট খাইয়েছে।’

আমি বললুম, ‘অতিশয় হ কথা! ফার্সিতে প্রবাদ আছে–

‘দুশমন্ চিকুন, আগ মেহেরবান বাশ দোস্ত! ’
‘দুশমন্ কী করতে পারে, দোস্ত যদি মেহেরবান্ হয়!”

নয়রাট উল্লসিত হয়ে ফ্রান্‌ৎসিসকাকে বললেন, ‘বউ, প্রবাদটা টুকে নাও তো, কাউকে দিয়ে ফার্সিতে লিখিয়ে নিজে জৰ্মনে গথিক হরফে তর্জমা লিখে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখব।’

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এতদিন ধরে আমি জুতসই একটা প্রবাদের সন্ধানে ছিলুম– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

তার পর বললেন, ‘ছোঁড়াটা অদ্ভুত। আমাকে বিপদে না ফেলার জন্য আমার কাছে এসে ন্যাওটামি করত না। একলা-একলি দেখা হলে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করত।

‘তার কয়েকদিন পরে আমার জন্মদিন। ক্লাসের ছোঁড়াগুলোর প্রতি যদিও আমি ওই ছোকরাটাকে জ্বালাতন করার জন্য বিরক্ত হতুম তবু অন্য বাবদে ওরাই তো আমার সঙ্গী; তাই তাদের নেমতন্ন করলুম, আর না করলে মা-ই বা কী ভাববে? তারা আমার জন্য উপহার আনল, বই, পেন্সিল, ছুরি, কলের লাটিম এবং আর পাঁচটা জিনিস। আমরা কে লেনেড় খাচ্ছি, জোর হৈ-হুঁল্লোড় চলছে, এমন সময় বাড়ির দাসী আমার কানে কানে বলল, “ছোটবার, তোমার জন্য একটি ছেলে নিচের তলায় গেটে দাঁড়িয়ে। কিছুতেই উপরে আসতে চায় না; তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।”

‘আমার সব বন্ধুই তো গটগট করে উপরে আসে। এ আবার কে?’

‘গিয়ে দেখি সেই পাগলা। হাতে এক ঢাউস বাক্স। লজ্জায় লাল হয়ে বলল– “তোর জন্মদিনে একটা প্রেজেন্ট এনেছি। ছোট্ট একটা পাল-লাগানো ইয়ট।”

‘বলে কী? ইয়ট’ তখন আমাদের স্বপ্নের বাইরে। পুরো বছরের জলখাবারের পয়সা। জমালেও আমাদের ক্লাসের ধনী ছোকরা আডলফ পর্যন্ত ইয়ট কিনতে পারে না– তখনো জানতুম না, সে পয়সাওলা ছেলে।

‘লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেল। বললুম, “তুই উপরে চ, কেক খাবি।”

 ‘বলল, “না, ভাই, তুই যা, উপরে আরও অনেক সব রয়েছে।”

‘আমি তাকে জোর করে উপরে টেনে নিয়ে এলুম। কোত্থেকে সাহস পেলুম আজও জানিনে। বোধহয় ইয়টের কৃতজ্ঞতায়।

আমি থাকতে না পেরে বললুম, ‘ছিঃ, ও জিনিস নিয়ে ঠাট্টা করবেন না!’

নয়রাট বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ। তার পর উপরে কী হল ঠিক বলতে পারব না। প্রথমটায় সবাই থ মেরে গেল। তার পর একে একে সক্কলেই পাগলার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করলে। তার চোখ দিয়ে আবার সেই পয়লা দিনের মতো ঝরঝর করে জল নেমে এল।

‘সেইদিনই আমি মনস্থির করলুম, বড় হলে আমি সর্বত্র এরকম ছেলেদের অন্যায় অত্যাচার থেকে বাঁচাব। ভগবান আমাকে আজ দেখিয়ে দিয়েছেন, এ শক্তি আমার ভিতরে আছে।’

নয়রাট হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বললেন, ‘এখখনি আসছি; আমি একটা টেলিফোন করতে ভুলে গিয়েছিলুম।’

বুঝলুম, বিনয়ী লোক, লজ্জা ঢাকবার অবকাশ খুঁজেছেন ॥

————

১. শব্দটা গ্রাম্য; কিন্তু পূজনীয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার অভিধানে শব্দটিকে অবহেলা করেননি বলে আমি ড্যাস দিয়ে সারলুম। তিনি গুরুজন– তাঁর শাস্ত্রাধিকার আছে।

২. ‘নেমকহারাম’ অর্থাৎ ‘অকৃতজ্ঞ’ সমাসটা বাংলায় চলে। ‘নেমকহালাল’ ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ ‘কৃতজ্ঞ’। নেমকহালাল কথাগুলো কিন্তু কৃতজ্ঞ অকৃতজ্ঞের চেয়ে জোরদার। ‘নমক’ = ‘নুন’–তার ‘অপমান’ (হারাম) কিম্বা ‘সম্মান’ (হালাল)।

৩. পঞ্চতন্ত্র ১ম পর্ব, দ্রষ্টব্য

৪. সুফিরা মদ্য ‘ভগবদ-প্রেম’ অর্থে ব্যাখ্যা করেন।

৫. ‘রুবাই’ একবচন, ‘রুবাইয়াৎ’ বহুবচন।