1 of 2

ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম – ২০

২১. ॥ একবিংশ অধ্যায় ॥

অকস্মাৎ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়া মনটা যখন আবার কিছুটা একত্রে পুঞ্জীভূত হল, কিছুটা আত্মস্থ হলাম, তখন আমি অনুভব করলাম, অচিরেই বুঝি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে।

ধুলো বালির গাদায় পড়ে আমি অন্ধকারে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পথ খোঁজার চেষ্টা করছি তখনও ঝুর ঝুর করে গুঁড়োমাটি মাথার ওপর পড়ছে। ভাবলাম, বুঝি জ্যান্তই আমাকে কবর দেবার মতলব করেছে।

জমাট বাঁধা আতঙ্ক বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। অল্পতেই দাঁড়াতে পেরে গেলাম।

কয়েক মুহূর্তে স্থবিরের মতো নিশ্চিন্ত-নিষ্পন্দভাবে দাঁড়িয়ে ভাবতে চেষ্টা করলাম, আমি কোন আকস্মিক প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন, আছিই বা কোথায়?

ঠিক সে মুহূর্তেই একটা তীব্র আর্তস্বর শোনা গেল। ডার্ক পিটার্স চাপা অথচ করুণ স্বরে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে সাহায্যের প্রত্যাশায় ডাকাডাকি করছে।

হামাগুড়ি দিয়ে, প্রায় বুকে হেঁটে দু-এক হাত সামনের দিকে যেতেই দুম করে বন্ধু ডার্ক পিটার্সের ঘাড় আর মাথার ওপর আড়াআড়ি পড়ে গেলাম।

মুহূর্তের মধ্যেই নিঃসন্দেহ হলাম, মাটির গুঁড়োয় কোমর অবধি চাপা পড়ে সে উঠে আসার জন্য সে মরিয়া হয়ে কসরৎ চালিয়ে যাচ্ছে।

আমি দুহাতে উন্মাদের মতো গুঁড়ো মাটির স্তূপ সরিয়ে সরিয়ে তাকে আধা সমাধিস্থ অবস্থা থেকে উদ্ধার করলাম। জমাটবাধা আতঙ্ক আর বিস্ময়ের ঘোরটুকু কোনোরকমে কাটিয়ে নিয়ে ডার্ক পিটার্স আর আমি বিষণ্ণ মুখে পাশাপাশি বসে সহজভাবে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম, কোনো-না-কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা যে ফাটলটার মধ্যে গলে গিয়েছিলাম সেটা অকস্মাৎ ওপর থেকে ধসে পড়েছে। আর সে জন্যই আমাদের এখানেই জীবন্ত সমাধি হবার জোগাড় হয়েছে, হবেও হয়তো তাই-ই।

আমরা দীর্ঘ সময় ধরে তীব্র যন্ত্রণা আর নিরবচ্ছিন্ন হতাশায় একেবারেই মনমরা হয়ে পড়লাম। প্রাণরক্ষা পাওয়ার মতো সামান্যতম আশার আলোও আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে উঁকি দিল না।

দীর্ঘ ভাবনা চিন্তার পর শেষপর্যন্ত ডার্ক পিটার্স আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল। করুণ স্বরে বলল–এ অন্ধকার যক্ষপুরী থেকে আমাদের যে করেই হোক উদ্ধার পাবার চেষ্টা করতেই হবে।

তার উৎসাহ-আগ্রহে আমি নতুন জীবনীশক্তি নিয়ে স্তূপাকৃতি গুঁড়ো মাটি সরিয়ে সরিয়ে এক কদম এগোতেই এক টুকরো আলো অতর্কিতে আমার চোখে ধরা দিল। মনে আশার সঞ্চার হল। আর যা-ই হোক, অন্তত বাতাস না পেয়ে শ্বাসরূদ্ধ হয়ে এ মুহূর্তেই মরতে হবে না।

অন্য দুই সঙ্গিকেও সঙ্গে সঙ্গে প্রাণরক্ষার ভরসা দিয়ে দিলাম। গুড়া মাটি আর আবর্জনা সরিয়ে সরিয়ে আরও কিছুটা অগ্রসর হতেই চারদিকের পরিবেশ দেখতে পেলাম। বুঝলাম, আমরা ফাটলের সোজাসুজি অন্তিম প্রান্তে হাজির হয়ে গেছি।

ফাটলটা এবার বাঁ দিকে বেঁকে গেছে। আরও কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে চেষ্টা চালিয়ে বাঁকের মুখে হাজির হতেই মনপ্রাণ খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে উঠল।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করে লম্বা একটা ফাটল খাড়াভাবে ওপরের দিকে উঠে গেছে। ফাটলটার শেষ প্রান্ত আমাদের নজরে না পড়লেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, আর একটু এগোতে পারলে মুক্ত বাতাসে ফুসফুসটাকে ভরে নেওয়া সম্ভব হবে।

ব্যাপারটা এবার মনে পড়ল, এ ফাটলটায় আমরা তিনজনই তো ঢুকেছিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গি তৃতীয়জন, উইলসন এ্যালেন? সে যে বেপাত্তা।

আমরা দুজন–ডার্ক পিটার্স আমি আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলাম, পিছিয়ে গিয়ে পাত্তা লাগাতেই হবে।

দীর্ঘ সময় ধরে হণ্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করে উইলসন এ্যালেনকে বের করার চেষ্টা চালালাম। হায় ঈশ্বর। এ কী সর্বনাশা কাণ্ড ঘটতে চলেছে। মাথার ওপরের মাটির স্তর যে কোনো মুহূর্তে ধ্বসে পড়তে পারে।

এক সময় ডার্ক পিটার্সের চিৎকার কানে এলো, সে উইলসন এলেনের পা চেপে ধরেছে, টানাটানি করছে। তার বাকি শরীরটা গুঁড়োমাটি আর আবর্জনার স্তূপে চাপা পড়ে গেছে। সেখান থেকে তাকে টানাটানি করে বের করে আনা কিছুতেই সম্ভব নয়।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ডার্ক পিটার্সের কথার সত্যতা উপলব্ধি করলাম, বহু আগেই তার শেষ নিকাস বেরিয়ে গেছে।

ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিষণ্ণ মনে সহযাত্রী বন্ধুর দেহটাকে নিষ্ঠুর অদৃষ্টের হাতে সঁপে দিয়ে আমরা পিছন ফিরলাম। বিষণ্ণ মনে ধীর-মন্থর গতিতে আমরা আবার সে বাঁকটার দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম।

দীর্ঘ হতাশা আর প্রত্যাশা বুকে নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পরিশ্রমের মাধ্যমে শেষমেষ আমরা উভয়েই একটা সমতল প্রান্তরে হাজির হতে পারলাম।

কয়েকমুহূর্ত নীরব দম নিয়ে সন্ধানী নজর মেলে চারদিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হলাম, ফাটলটা কৃত্রিম। আর সেটাকে অতিসম্প্রতি সৃষ্টি করা হয়েছে।

এবার ব্যাপারটা খোলসা হয়ে গেল, যে সংঘর্ষের তীব্র আওয়াজ শুনে আমরা দারুণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, সে সংঘর্ষই আমাদের মুক্তির জীবন রক্ষার পথটাকেও উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।

ডার্ক পিটার্স ও আমি উভয়েরই শরীর মন দু-ই ক্লান্ত। উঠে খাড়াভাবে দাঁড়ানোও সম্ভব হচ্ছে না, কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।

ডার্ক পিটার্স কোনোরকমে বলল, পিস্তলে ফাঁকা আওয়াজ করে আমাদের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দিলে কেমন হয়? তবে জংলিরা নির্ঘাৎ আমাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে।

তার প্রস্তাবটাকে আমি মন থেকে মেনে নিতে পারলাম না।

পরবর্তী ঘটনায় অবশ্য ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়, তার পরামর্শ মাফিক কাজ করলে অনুতাপে আমাদের আঙুল কামড়াতে হত। ভাগ্য ভালো যে, পরমুহূর্তেই জঘণ্য একটা চক্রান্তের আভাস পেয়ে গেলাম। অতএব আমাদের অবস্থিতির কথা কিছুতেই জংলিগুলোর কাছে ফাস করা নিরাপদ হবে না, আমরা করবও না।

ডার্ক পিটার্স পিস্তলটাকে জ্যাকেটের পকেট থেকে টেনে বের করে নেবার পরও যথাস্থানেই গুঁজে রাখল।

আমরা প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে এক সময় সমতলে উঠে গেলাম। নজর মেলে চারদিকে দৃষ্টিপাত করতেই কিছুক্ষণ আগেকার ভয়ঙ্কর সে বিস্ফোরণটার রহস্যভেদ করে ফেলতে পারলাম।

আমাদের ভয়ঙ্কর সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মূলে যে অসভ্য জংলিদের জঘণ্য চক্রান্ত রয়েছে যারা আমাদেও সঙ্গে এতদিন বন্ধুত্বের অভিনয়ে লিপ্ত ছিল।

জংলিরা চুনাপাথরের পাহাড়ের গায়ে কিছু কাঠের গুঁড়ি পুঁতে আর কিছু আড়াআড়িভাবে বেঁধে মাচার মতো তৈরি করেছিল। তার ওপরে ময়লা আবর্জনা আর গুঁড়ো মাটি ও ধুলো প্রভৃতি গোপনে কাঠের গুঁড়ির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে তা হুড়মুড় করে আমাদের মাথার ওপর ভেঙে পড়ে।

ডার্ক পিটার্স আর আমি ছাড়া আমাদের অন্য সব সঙ্গিদের কী মর্মান্তিক পরিণতি ঘটেছে তা বুঝতে দেরি হলো না। ভাগ্যের জোরে আমরা দুজন প্রাণে বেঁচে গেলাম।

এ-দ্বীপে আমরা, একমাত্র আমরা দুজনই জীবন্ত সাদা চামড়ার মানুষ। উফ্! আমাদের মেকি বন্ধুত্বের ফাঁদে ফেলার জন্য জংলিগুলো কী জঘণ্য চক্রান্তেই না লিপ্ত হয়েছিল।

.

২২. ॥ দ্বাবিংশ অধ্যায় ॥

আমরা এখন যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে প্রতিটা মুহূর্ত কাটাচ্ছি তাতে তো মনে হচ্ছে। তা চিরদিনের মতো ভূ-গর্ভে সমাহিত হয়ে থাকার চেয়ে কোনো অংশে কম দুর্বিষহ নয়।

এখন আমাদের সামনে দুটো পথ খোলা দেখতে পাচ্ছি–অসভ্য জংলিদের হাতে বেঘোরে প্রাণ দেওয়া নতুবা, জীবনভোর তাদের হাতে বন্দি হয়ে দিনাতিপাত করা। এর চেয়ে ভালো কোনো ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তো এখন পর্যন্ত কিছুই মাথায় আসছে না। এখন জঙ্গলের ঘাপটি মেরে থেকে তাদের চোখে ধূলো দেওয়া যেতে পারলেও তা দিয়ে আর কতদিন? শীঘ্রই মেরু অঞ্চলে শীত নেমে আসবে। ফলে না খেয়ে শুকিয়েই মারা যেতে হবে। অন্যথায় জংলিদের হাতে ধরা পড়তে হবে। উভয়সঙ্কটে পড়ে আমরা হতাশায় জর্জরিত হতে লাগলাম।

অসভ্য জংলিরা আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। তারা অবশ্যই মওকা। খুঁজছে ‘জেন’-কে লুঠ করে আমাদের যাবতীয় সম্পত্তি কিভাবে হাতিয়ে নেবে।

উপসাগরের বুকেই হয়তো আমাদের জাহাজটা নোঙর করা অবস্থায়ই রয়েছে। আর আমাদের সঙ্গি, যাদের জাহাজ পাহারা দেবার জন্য মোতায়েন করে এসেছিলাম তারা তো আমাদের এমন চরমতম দুর্গতির কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি। আর কী বিপদ যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাও তাদের অজানা।

হায় ঈশ্বর। এখন যদি আমরা জাহাজে তাদের পাশে থাকতে পারতাম তবে জাহাজ নিয়ে চম্পট দিতাম, আর মরতে হলে একই সঙ্গে মৃত্যুর শিকার হতাম।

ভাবলাম, এখন পিস্তলের ফাঁকা আওয়াজ করে জাহাজের সহকর্মীদের আমাদের দূরবস্থার কথা জা নিয়ে দিলে হয়তো ভালোই হবে। পরমুহূর্তেই মনে হলো এতে ভালো করতে গিয়ে হয়তো তাদের সর্বনাশই করা হবে।

এবার আমাদের আর একটা ভাবনা, চুপি চুপি উপসাগরে ফিরে গিয়ে জংলিদেরই একটা শালতি নিয়ে সোজা জাহাজে হাজির হওয়া। ব্যস, তারপরই এ মরণ ফাঁদ থেকে চম্পট দেওয়া। না, এ দুঃসাহসিক পরিকল্পনাটাকে বাস্তবায়িত করতে পারা খুবই ক্ষীণ অনুমান করে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাতিল করতেই হল।

আমাদের ঘিরে লতাপাতার ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্যে টু-উইট আর তার সাগরেদরা নির্ঘাৎ ঘাপটি মেরে রয়েছে। তাই নিতান্ত অন্য উপায়ে জঙ্গলের গোপন অন্তরালে আত্মগোপন করে আসন্ন সংঘর্ষ এবং জাহাজটার ধ্বংস মুখ বুজেই দেখতে হবে।

আমরা ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখতে লাগলাম, দলে দলে দ্বীপবাসী জংলি ষাট-সত্তরটা শালতিতে হুড়মুড় করে উঠতে শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে অস্ত্র বলতে সঙ্গে রয়েছে ইয়া মোটা মোটা কাঠের গদা আর বিভিন্ন আকৃতির পাথরের স্তূপ।

এবার সাধ্যমত দ্রুতগতিতে শালতি চালিয়ে তারা কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের একমাত্র অবলম্বন জেন-কে ঘিরে ফেলল। জাহাজটার দখল নেওয়াই যে তাদের লক্ষ্য আমাদের তা বুঝতে দেরি হলো না।

আমি তো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি, জাহাজ রক্ষার জন্য রেখে-আসা নাবিকরা এতগুলো অসভ্য জংলির সঙ্গে লড়াই করে সফল হওয়া তো দূরের ব্যাপার প্রতিরোধের জন্য হাতিয়ারে হাত দেবারই সুযোগ পাবে না।

কিন্তু পরমুহূর্তেই দেখলাম, আমাদের সহকর্মী অসহায় নাবিকরা জাহাজটাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। জংলিদের শাতিগুলো বন্দুকের গুলির আওতায় এলে জাহাজ থামল।

কিন্তু হায়। আমাদের সহকর্মীদের মতলব পুরোপুরি ভেস্তে গেল। এর পিছনে কোনো অজ্ঞাত কারণ কাজ করেছে নতুবা আকস্মিক পরিস্থিতির উত্তেজনা ও ব্যস্ততার জন্য তারা ব্যর্থ হয়েছে।

সত্যি ব্যাপারটা ভাববার মতোই বটে। একটা শালতির গায়েও গোলাগুলি লাগল, একটা জংলিও মারা তো গেলই না, এমনকি গায়ে কাঁটার আঁচড়ও লাগল না।

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে আমাদের এ-ধারণাই হলো যে, আর তারা জায়গামত পৌঁছাবার আগেই গোলাবারুদ কোনোক্রমে পানিতে পড়ে গেছে, তা নাহলে সব কটা গুলিই তাদের মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

তা সত্ত্বেও লাভ তো একটা হলই। গোলাগুলির বুক-কাঁপানো আওয়াজ তাদের অনভ্যস্ত কান বরদাস্ত করতে পারল না। আর সে সঙ্গে আকস্মিক ধোঁয়ার ব্যাপারটা। তাদের মনে বিস্ময় ও আতঙ্কের সঞ্চার ঘটাল। তা দেখে আমার তো মনেই হলো তারা বুঝি রণে ভঙ্গ দিয়ে কেটেই পড়বে।

আমাদের সঙ্গীরা যদি আক্রমণটাকে আরও কিছুক্ষণ টিকে থাকতে পারত তবে হয়তো তারা পালিয়েই যেত। আর জঙ্গলিদের শাতিগুলো ইতিমধ্যেই এত কাছে চলে এসেছিল যে লক্ষ্য করে জাহাজের মুখ ঘুরিয়েনিল। ব্যস, এতেই অসভ্য জংলিগুলো আকস্মিক বিস্ময় ও আতঙ্কটুকু কাটিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে পাওয়ার উপযুক্ত সময় সুযোগ পেয়ে গেল।

আবার জাহাজ থেকে আমাদের সহকর্মীদের ছোঁড়া গোলাগুলি জংলিদের চরম দুর্গতিতে ফেলে দেয়। সাত-আটটা শাতি ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। সত্তর-আশিজন জংলি মারা পেল। আর আতঙ্কে পানিতে পড়ে গিয়ে নাস্তানাবুদ হতে লাগল কম করেও একশো। অবশ্য তাদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক ভয়ানক জখমও হল। আর যারা রইল তারা প্রাণের মায়ায় সোজা চম্পট দিল।

কার্যত দেখা গেল, আমাদের সঙ্গিসাথীদের বাধা দেওয়া সার্থক হয়েছে। তাতেও কিন্তু তারা বিপদের হাত থেকে পুরোপুরি অব্যাহতি পেল না। এই মওকায় শাতির দেড়শোরও বেশি জংলি যে যেদিকে পারল কেটে পড়ল। জনাকয়েক দড়ি বেয়ে জাহাজের ডেকের ওপর উঠে পড়ল।

আমাদের সঙ্গিরা বারুদে আগুন দেবার ফুরসুতটুকুও পেল না। ব্যস, তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার আর কোনো প্রতিবন্ধতাও থাকল না। তারা উন্মাদের মতো আমাদের লোকজনদের ওপর তুমুল আক্রমণ চালিয়ে মেরে সাবাড় করে দিতে লাগল।

আমাদের সঙ্গি সাথিরা মরে ভূত হয়ে যাবার পর জঙ্গিরা হুড়মুড় করে যে যেদিক দিয়ে পারল জাহাজে উঠে পড়ল। এবার আমাদের জাহাজ ‘জেন’-এর ডেকের ওপর হিংসার জোয়ার বয়ে চলল। ডেকের মেঝে রক্তে পিছল হয়ে গেল।

অসভ্য জংলিরা এবার হৈহল্লা করতে করতে জাহাজটাকে তীরের দিকে নিয়ে গেল। সেটাকে উপহার হিসেবে সর্দার টু-উইটের হাতে তুলে দিল।

এদিকে সর্দার টু-উইট তার দলবল নিয়ে সমুদ্রের দিকে চলে গেল। আমরা জঙ্গলের গোপন অন্তরাল থেকে বেরিয়ে শিকার করে ফেললাম। খুশিতে মন-প্রাণ চনম নিয়ে উঠল। আর যা-ই হোক, একটা সপ্তাহ খাবারের জন্য আমাদের আর ভেবে মরতে হবে না। ঝুপড়িতে ফিরে যাবার সময় একটা গাছতলা থেকে আমরা প্রচুর কাঠবাদামও কুড়িয়ে নিলাম। ব্যস, নিশ্চিন্ত মনে আবার ঝুপড়িতে মাথা গুঁজলাম।

বাদামগুলো আর পাখিটাকে আস্তানায় রেখে আমরা এবার ডালপালায় ফাটলের মুখটা বন্ধ করে দিয়ে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল দিয়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চললাম। আমাদের জাহাজটার পরিস্থিতি একবারটি নিজের চোখে দেখার জন্য মন দারুণ ছটফট করছে।

সমুদ্রের ধারে পৌঁছেই দেখতে পেলাম, অসভ্য জংলিরা জাহাজটাকে ভাঙাচোরার কাজ মিটিয়ে ফেলেছে। এবার আগুন ধরাবার তোড়জোর চলছে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জাহাজের ভেতর দিয়ে ধোয়ার রাশি কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে ওপরে উঠে যাচ্ছে।

জাহাজের দড়িদড়া, পাল, মাস্তুলের যা-কিছু ছিল এক এক করে সবই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগল।

জাহাজের চারদিকে শালতিতে যে অসভ্য জংলি ভিড় করে হৈ-হল্লা করছে তাদের সংখ্যা কম হলেও হাজার দশেক তো হবেই।

আমরা গোপন অন্তরাল থেকে জাহাজটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকলাম, ভাবলাম যে কোনো মুহূর্তে জাহাজে ভয়ঙ্কর একটা কিছু ঘটে যাবে, আশঙ্কায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম।

এমন সময় জাহাজের ভেতর থেকে ঘনকালো মেঘের মতো ধোঁয়ার কুণ্ডুলি– আগুনের হল্কা পর মুহূর্তেই আচমকা ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণ। আগুন, পোড়াকাঠ, ছাই আর মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন টুকরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সে এক রীতিমত নারকীয় দৃশ্য।

অসভ্য জংলিগুলো জাহাজটা ধ্বংসের মধ্য দিয়ে তাদের চক্রান্তের প্রাপ্য ফল হাতে-নাতে পেয়ে গেল। সে বিস্ফোরণে হাজার খানেক অসভ্য জংলি নির্মমভাবে মৃত্যুর শিকার হলো আর কতজন যে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ল তার ইয়ত্তা নেই।

জংলিদের মধ্যে যারা জীবিত রইল তারা আকস্মিক বিপদের আশঙ্কায় এমন হকচকিয়ে গেল যে কেউ-ই আহত পল্লীবাসীদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। আর তাদের মধ্যে অভাবনীয় একটা পরিবর্তন ঘটে গেল। আতঙ্কে অবোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে করতে গভীর জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাল।  

জংলিদের বড় একটা দলকে এরই মধ্যে জঙ্গলে ঢুকতে দেখা গেল। কতকগুলো কাঠের খোটা নিয়ে একটু পরেই তারা বেরিয়ে এলো।

একটু পরেই দেখলাম, আঠারোই জানুয়ারি লাল দাঁতের পাটি আর বড় বড় নখযুক্ত যে বিচিত্র জানোয়ারটাকে আমরা জাহাজে তুলে নিয়েছিলাম তার মৃত দেহটা জঙ্গলের এক জায়গায় পড়ে রয়েছে, আর জংলিরা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে তার কাছে গেল। দেখতে দেখতে সেটাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল।

ক্যাপ্টেন গাই ঘর বোঝাই করে জানোয়ারটাকে যথোপযুক্ত সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এটাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবেন।

প্রচণ্ড বিস্ফোরণটা ঘটায় জানোয়ারটা হয়তো ছিটকে এখানে এসে পড়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, এটাকে নিয়ে জংলিদের এত কৌতূহলই বা কেন?

লক্ষ্য করলাম, কেউই জানোয়ারটার কাছাকাছি যেতে সাহস পাচ্ছে না। দূরে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সবাই জানোয়ারটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

জংলিরা একটু বাদে জঙ্গলের গভীর থেকে নিয়ে আসা খোঁটাগুলোকে জানোয়ারটার চারিদিকে বৃত্তাকারে পুঁতে দিয়ে ব্যস্ত পায়ে দ্বীপের ভেতরে, জঙ্গলের দিকে চলে গেল। সবাই গলা ছেড়ে বলতে লাগল ‘টেকেলি-লি! টেকিলি-লি! টেকেলি লি!

মিনিট কয়েকের মধ্যেই তারা ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে চলে গেল। একটু পরেই তাদের কণ্ঠস্বরও আর শোনা গেল না।

.

২৩. ॥ ত্রয়োবিংশ অধ্যায়

বিচিত্র জানোয়ারটাকে নিয়ে অসভ্য জংলিদের কৌতূহলের ব্যাপার স্যাপার ঘটার পর আমরা পাহাড়ের ওপরের গোপন আশ্রয়স্থানেই আরও সাতটা দিন অবস্থান করি। তবে মাঝে-মধ্যে অত্যন্ত সতর্কতা বজায় রেখে খাদ্য ও পানীয়, কাঠ-বাদাম আর ঝর্ণার পানি আনতে আস্তানার বাইরে বেরোই।

আমরা শুকনো ঘাস-পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালি। মওকা মতো পাখিটা পেয়ে যাওয়ায় খুবই সুবিধা হয়ে গেছে। তবে তার মাংস একটু-আধটু শক্ত হলেও খেতে খুবই সুস্বাদু।

গিরিখাতের কাছে গিয়ে আরও তিনটি পখির দেখা পেলাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, তাদের একটাকেও শিকার করা গেল না। আসলে তারা মাটিতে না নামার জন্যই তাদের ধরা সম্ভব হয়নি।

কয়েকের দিনের মধ্যেই আমাদের খাদ্যের অভাব দেখা দিল। তা ছাড়া একনাগাড়ে আর কতদিনই বা কাঠ বাদাম খেতে ভালো লাগে। তাই খাদ্যের সমস্যা মেটাবার জন্য আমরা দুজনে আলোচনার মাধ্যমে স্থির করলাম, করাত ঠুকে নিচে নেমে যাব।

আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী গোপন আস্তানাটা থেকে নিচে নামার জন্য সতর্কতার সঙ্গে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল দিয়ে নিচের দিকে কিছুটা পথ নেমে যেতেই অদূরে জংলিদের কণ্ঠস্বর কানে এলো। আমরা প্রমাদ গুণলাম। লম্বা-লম্বা পায়ে উঠে এসে আবার আস্তানায় মাথা গুঁজলাম। ভাগ্যের জোরেই তাদের হাতে ধরা পড়ে বেঘোরো প্রাণ খোয়াবার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছি।

কিন্তু এভাবে তো আর পেটে কিল মেরে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এখন উপায়?

আমরা চিন্তা করে দেখলাম, পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে নামতে না পারলে কিছুতেই বাঁচা সম্ভব নয়। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বাদাম চিবালেও বাদামের যোগান তো অচিরেই একদিন বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই বহু খোঁজাখুঁজি করে দুদশটার বেশি মেলে না। এরপর তো ঝর্ণার পানিই একমাত্র সম্বল হয়ে দাঁড়াবে।

এক বিকেলে আমরা ঝুপড়িটা থেকে বেরিয়ে খাদ্যের খোঁজে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে ফেললাম। ভয় হচ্ছিল, যদি পথ হারিয়ে অন্য দিকে চলে যাই, আস্তানায় ফিরতে না পারি তবেই কেলেঙ্কারি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। মাথার চারদিকে হাজারো দুশ্চিন্তা আর হতাশা ভিড় করে থাকলেও বিকেলের পড়ন্ত রোদে এদিকটার পাহাড় আর অজানা অদেখা বিচিত্র সব গাছগাছালি ও লতাগুল্মই কেবল নয়, পাখি পাখালিও আমাকে কম মুগ্ধ করল না। গাছের ডালে ডালে হরেক রং ও আকৃতিবিশিষ্ট পাখি ঘুরে বেড়ালেও আমরা বহু চেষ্টা করে একটাকেও ঘায়েল করতে পারলাম না। আসলে পাথর ছুঁড়ে গাছের পাখিকে নামানো বড়ই কঠিন সাধ্য ব্যাপার। সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের হাত অ-পটু। জংলিদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের তুলনা বিন্দুমাত্র চলে না।

খাদ্য। খাদ্য। একমাত্র খাদ্যই আমাদের সর্বক্ষণের চিন্তা হয়ে দাঁড়াল। ডার্ক পিটার্সের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, যে করেই হোক, মাইল দেড়েক পথ পাড়ি দিয়ে আমরা সাগরের ধারে যাবই।

পাহাড়ের ওপরের গোপন মাথাগোঁজার জায়গাটা থেকে উঁকি ঝুঁকি মেরে বহুবার দেখেছি, সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে প্রায়ই বহু কচ্ছপ ঘোরাফেরা করে। একটাকে ঘায়েল করতে পারলে অন্তত দিন কয়েকের জন্য খাদ্যাভাব দূর হবে।

এরকম দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা পাহাড়ের গায়ের মাটি আর পাথরের স্তূপ আর ঝোঁপঝাড়ের আড়াল দিয়ে দিয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে পথ পাড়ি দিতে লাগলাম।

ঘটনাটা একেবারেই আচমকা ঘটে গেল একটা বাঁক ঘুরতেই পিছনের একটা গুহা থেকে শিকারি পশুর মতো পাঁচজন জংলি হঠাৎ আমাদের আক্রমণ করে বসল। আমরা ব্যাপারটা ভালোভাবে বোঝার আগেই জংলিদের একজনের গদার আঘাতে ডার্ক পিটার্স বিকট আর্তনাদ করে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এবার সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হল।

সবাই ডার্ক পিটার্সের দিকে মন দেওয়ায় আমি আকস্মিক পরিস্থিতিটাকে একটু সামলে নেবার ফুরসৎ পেলাম।

আমার জ্যাকেটের দু-পকেটে দুটো পিস্তল তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। যন্ত্রচালিতের মতো দু-পকেটে হাত চালান করে দিয়ে তাদের বের করে আনলাম। দু হাতে দুটোকে শক্ত করে ধরে লড়াকু জংলিদের ওপর আক্রমণ চালাতে লাগলাম।

দু-দুটো তাজা গুলি ক্রোধোন্মত্ত দুটো জংলির বুকে গেঁথে দিলাম। তৃতীয়জন ডার্ক পিটার্সকে লক্ষ করে বর্শা ছোঁড়ার চেষ্টা করতেই পিস্তল থাকা সত্ত্বেও সে নিজের দৈহিক শক্তিকে ব্যবহার করল। ঝট করে নিহত জংলিদের একটা গদা কুড়িয়ে নিয়ে প্রথমে বর্শাধারীকে এবং পরমুহূর্তে অন্য দুজনকে গদার আঘাতে ধরাশায়ী করে ফেলল।

আমরা যে এত সহজে শয়তানগুলোকে সাবাড় করে দিতে পারব ভাবতেই পারিনি। জয়ের আনন্দটুকু ভাগাভাগি করে উপলব্ধি করার সুযোগই পেলাম না। হঠাৎ বহু জংলির মিলিত কণ্ঠস্বর, চিৎকার চাচামেচি বাতাসবাহিত হয়ে আমাদের কানে এলো।

ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হলো না। পিস্তলের আওয়াজে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উৎসস্থল অনুমান করে জংলিরা ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে ছুটে আসছে।

আমরা ধরা পড়ে যাবার আতঙ্কে মুষড়ে পড়ার জোগাড় হলাম। পাহাড়ের দিকে। ছুটে পালাতে গেলে জংলিদের দিকেই যেতে হবে। আবার যদি নিচের দিকে নেমে যেতে চেষ্টা করি তবেও তাদের চোখে পড়ে যাবার সম্ভাবনা কম নেই। এখন উভয়। সঙ্কটে পড়ে আমরা বাঁচার পথ হাতড়াচ্ছি; ঠিক সে মুহূর্তেই আমার গুলির আঘাতে সে মারা গেছে ভেবেছিলাম। কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই আমরা তাকে জাপ্টে ধরে ফেললাম।

আমি তাকে খতম করে ফেলতেই চেয়েছিলাম। ডার্ক পিটার্স বাধা দিল। তাকে জিইয়ে রাখার কারণ সম্বন্ধে সে বলল–শয়তানটাকে ধরে আমাদের ডেরায় নিয়ে যেতে পারলে তার সাহায্যে আমাদের এখান থেকে কেটে পড়ার উপায় জেনে নেওয়া যাবে। উদ্ধার পাওয়া সহজ হবে।

আমরা গুলি করার ভয় দেখিয়ে তাকে ঠাণ্ডা রাখলাম। সে গোবেচারির মতো আমাদের নিরাপদ পথে সমুদ্রের দিকে নিয়ে চলল। আশ্চর্য ব্যাপার। মিনিট কয়েকের। মধ্যেই সে যেন আমাদের পুরোপুরি অনুগত ভৃত্য বনে গেল।

আমরা পথ প্রদর্শক জংলিটার নির্দেশিত পথে বন-পাহাড় অতিক্রম করে উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে সমুদ্রের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম।

সেখান থেকে সমুদ্রের দূরত্ব আর মাত্র দুশ গজের মতো। এমন সময় নজরে পড়ল দ্বীপের বিভিন্ন দিক থেকে ক্রোধোন্মত্ত জানোয়ারের মতো গর্জন করতে হাজার হাজার অসভ্য জংলি আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে।

প্রাণভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ফিরে যাব মনস্থ করে ঘুরে দাঁড়াতেই, বিশালায়তন একটা পাথরের আড়ালে একটি শালতি গলুই নজরে পড়ল। প্রাণের মায়ায় আমরা সেদিকেই উধশ্বাসে ছুটতে লাগলাম।

ছুটতে ছুটতে কাছে গিয়ে দেখি, একটা নয়, দু-দুটো শালতি গাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর সে দুটো একেবারেই অরক্ষিত। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখি, ছয়টা দড়িদড়ার গোছা আর দুটো কচ্ছপ ছাড়া আর কিছুই নেই। চারদিকে অনসুন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে জংলিদের চিহ্নমাত্রও নজরে পড়ল না।

আর ভালো-মন্দ চিন্তা না করে আমরা দুজন ঝটপট একটা শালতিতে উঠে বসলাম। বন্দি-জংলিটাকেও জোর জবরদস্তি তুলে নিলাম। এবার উভয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে সেটাকে সাগরে ভাসিয়ে দিলাম। শয়তান জংলিটা বার কয়েক হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে কোনো ফয়দা হবার নয় ভেবে মুখ গোমড়া করে নিতান্ত অনুগতের মতে, বসে রইল।

হায়! হায় ঈশ্বর! বিপদ যে কিছুতেই আমাদের পিছন ছাড়ে না। তীর ছেড়ে মাত্র পঞ্চাশ গজ এগোতে-না-এগোতেই মর্মে মর্মে বুঝতে পারলাম, অন্য শাতিটাকে ওখানে ফেলে এসে কী ভুলই না আমরা করেছি।

আমরা পরিষ্কার দেখতে পেলাম, ক্রোধোন্মত্ত জানোয়ারের মতো তর্জন গর্জন করতে করতে অসভ্য জংলিরা সে শালতিটার দিকে সাধ্যাতীত দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে। আমাদের তুলনায় দ্বিগুণ তাদের গতি।

এখন চরমতম পরিস্থিতিতে আমাদের আত্মরক্ষার উপায় একটাই, একটা মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে যে কোনো উপায়ে তাদের আগেই সেখানে হাজির হয়ে ফেলে আসা শাতিটার দখল নেওয়া।

সে শালতিটা যে কতদূরে রয়েছে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা না থাকলেও আমরা নিঃসন্দেহ যে, এতে সাফল্য লাভ করতে পারলেই পিতৃদত্ত প্রাণটাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। আর তা যদি সম্ভব না হয় তবে নরবলির শিকার হওয়ার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার ক্ষমতা কারোরই নেই।

একদিকে আমরা সাধ্যমত দ্রুতগতিতে শাতি চালাতে লাগালাম, আর অন্য দিকে অসভ্য জংলিরাও লম্বা লম্বা পা ফেলে তার চেয়ে দ্রুত এগিয়ে চলল।

না, শেষ রক্ষা করতে পারলাম না। আমাদের চেয়ে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে একাধিক জংলি যথাস্থানে পৌঁছে শালতিটা দখল করতে গেলে অতর্কিতে ডার্ক পিটার্সের হাতের পিস্তল থেকে গুলি ছিটকে বেরিয়ে জংলিদের একজনের মাথার খুলিটা দিল উড়িয়ে। সে চোখের পলকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।

বেগতিক দেখে অন্য জংলিটা প্রাণের মায়ায় উদ্ধশ্বাসে ছুটে পালিয়ে গেল।

জংলিদের বাকি দলদলটা তখনও শাতিটা থেকে বিশ-ত্রিশ কদম দূরে রয়েছে।

আমরা উল্কার বেগে ধেয়ে গিয়ে শালতিটার দখল নিয়ে নিলাম। ব্যস, আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আমরা ব্যস্ত হাতে দাঁড় চালাতে লাগলাম।

মৃত্যুভয় অগ্রাহ্য করে জংলিদের মধ্য থেকে দুজন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরে এগিয়ে এসে শালক্টিা ধরে ঝুলতে লাগল। আমরাও পরিস্থিতি খারাপ দেখে কোমর থেকে ছুরি বের করে অদ্ভুতভাবে ঝুলে-থাকা জংলি দুটোকে পরপারে পাঠিয়ে দিলাম।

হায়! এ কী মহাসমস্যা। অসভ্য জংলিদের কবল থেকে দেখছি কিছুতেই অব্যাহতি পাওয়া যাবে না। জংলিদের একটা বিশাল দল হৈ-হল্লা করতে করতে উধশ্বাসে আমাদের অনুসরণ করতে লাগল।

উপায়ান্তর না দেখে ডার্ক পিটার্স বুদ্ধি করে বন্দুকের বেয়নেটের আঘাত হেনে হেনে দ্বিতীয় শাতিটার দাঁড়গুলো, গলুই আর একটা দিক ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলল। এভাবে সেটাকে পুরোপুরি ব্যবহারের অনুপযোগি করে দিয়ে আমরা ব্যস্ত। হাতে দাঁড় টেনে টেনে বার সমুদ্রে পৌঁছে গেলাম।

আমরা তখনও ক্রোধোন্মত্ত অসভ্য জংলিদের তর্জন-গর্জন বাতাসবাহিত হয়ে আমাদের কানে পৌঁছতে লাগল। আমরা দাঁড় টানার ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, ভাঙা শালতিটার পাশে দাঁড়িয়ে তারা বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে আমাদের লক্ষ্য করে বিকট স্বরে চিল্লাচিল্লি করছে।

সমূহ বিপদের হাত থেকে এখনকার মতো অব্যাহতি পাওয়া গেল বটে। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত কুয়াশার আস্তরণে মোড়া। এখন অসভ্য জংলিদের চারটি শালতির মধ্যে একটা দখল আমরা নিয়েছি। দ্বিতীয়টা ডার্ক পিটার্সের বন্দুকের বেয়নেটের আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আর বাকি দুটো আমাদের জাহাজ জেন গাইের বিস্ফোরণের ফলে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে–খবরটা আমাদের বন্দি জংলিটার মুখ থেকে জানতে পারলাম।

জংলিদের এখন একমাত্র ভরসা ডিঙিগুলো। তারা নির্ঘাৎ সেগুলো নিয়ে আমাদের পিছু নেবে। এখান থেকে মাইল তিনেক দূরে সেগুলো রয়েছে–এও বন্দি জংলিটার মুখ থেকেই শোনা। তাই তারা এখানে পৌঁছাবার আগেই আমাদের ঐ দ্বীপ থেকে অবশ্যই বহু দূরে চলে যাওয়া চাই-ই চাই।

কেবলমাত্র আমরা দুজনই নয়, বন্দি-জংলিটার হাতেও বৈঠা দিয়ে জোরসে চালাবার জন্য বার বার তাড়া দিতে লাগলাম। আধঘণ্টা একনাগাড়ে বৈঠা চালাবার পর আর পাঁচ-ছয় মাইল দক্ষিণে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, বেশ কয়েকটি ডিঙি নৌকা আমাদের অনুসরণ করার জন্য তৎপরতার সঙ্গে উপসাগর থেকে বেরোচ্ছে। আর কিছুটা এগিয়ে এসে অনুসরণকারী জংলিরা দেখল, আমরা বার-সাগরে পড়ে গেছি। তারা হতাশ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে থমকে ডোঙা দাঁড় করিয়ে দিল।

আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। দ্রুত বৈঠা চালিয়ে আমরা তীর থেকে দূরে বহুদূরে চলে গেলাম। এবার ঢেউয়ের হাতে নিজেদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দিলাম।

.

২৪. ॥ চতুর্বিংশ অধ্যায় ॥

আমাদের সেদিনকার কাণ্ডকারখানার কথা ভাবলে আজ নিজেই বিশ্বাস করতে উৎসাহ পাই না। এও কি কাউকে বিশ্বাস করানোর মতো কথা, সাধারণ একটা শালতি চেপে আমরা তিনটি প্রাণী দক্ষিণ মেরু সাগরের বুকেনির্বিবাদে এগিয়ে চলেছি।

এখন আমাদের সঙ্গে খাবার বলতে সম্বল মাত্র তিনটি কচ্ছপ।

এদিকে আর এক আতঙ্কের ব্যাপার–মেরুবৃত্তের দীর্ঘ শীতঋতু। সে-ও প্রায় আমাদের শিয়রে পৌঁছে গেছে। অতএব আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা অবশ্যকর্তব্য, কোন পথে কোন, দিকে অগ্রসর হব।

আমার অদৃষ্ট সম্বল করে ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে চলেছি। পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ইতিমধ্য ছয়-সাতটা একই চরিত্রের দ্বীপ আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ল। একটা থেকে অন্যরা পাঁচ-ছয় লীগ দূরে অবস্থান করছে।

অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে করতেই আমাদের কোনো দ্বীপেই শালতি ভেড়াতে সাহসে কুলাল না। উত্তর দিক থেকে এতটা পথ পাড়ি দিতে গিয়ে যে ভয়ঙ্কর বিপদসঙ্কুল বরফের এলাকা পেরিয়ে এখানে হাজির হয়েছি আবার যদি সে পথেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি তবে নিতান্তই বোকামি করা হবে। তাই একটা মাত্র পথই অবলম্বন করার মতো রয়েছে–দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাওয়া। অনন্যোপায় হয়ে আমরা এ-সিদ্ধান্তই নিলাম। বলা তো যায় না, পথে অন্য কোনো দেশ আর অধিকতর। মনোরম আবহাওয়া পেলেও পেতে পারি।

ইতিপূর্বে দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের ওপর দিয়ে পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ঝড় তুফানমুক্ত মনোরম আবহাওয়া পেয়েছি। কিন্তু সামান্য একটা শাতি সম্বল করে আমরা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলেছি, তার ওপরে ওটার অবস্থাও মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়।

শালতিটার অবস্থা খারাপ দেখে আমরা চলতি অবস্থাতেই সেটাকে তাপ্লিতুপ্পি। দিয়ে একটু পোক্ত করে নিতে গেলাম। ব্যস্ত-হাতে কাজ চালিয়ে মাস্তুল বসিয়ে দেওয়া হল। এবার তাতে বেঁধে দিলাম ছোট একটা পাল।

দক্ষিণ-পূর্বদিকে পৎপৎ করে পতাকা উড়তে লাগল। অনুকুল বাতাস লাগায় আমাদের শাতিটা এবার উল্কার বেগে ধেয়ে চলল।

সমুদ্র শান্ত। কুয়াশার চিহ্নও নেই। এমনকি নিকট বা কাছে বরফের চিহ্নও নজরে পড়ছে না।

আমাদের সমুদ্র কচ্ছপ তিনটির মধ্যে বড় কচ্ছপটাকে কাটাকাটি করে তার ভেতর থেকে প্রচুর মাংসই কেবল নয়, পানিও পাওয়া গেল।

কচ্ছপের মাংস দিয়ে পেটের জ্বালানিভিয়ে আমরা আবার দক্ষিণ দিকে শাতি চালিয়ে দিলাম।

পয়লা মার্চের সকাল। ঝকমকে সকাল। বহু সাধারণ ঘটনা থেকে আমাদের মনে হতে লাগল, আমরা নতুনতর ও বিস্ময়কর এক জগতে হাজির হয়েছি।

দক্ষিণ দিগন্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে প্রতিনিয়ত একটা হালকা বাষ্পের উঁচু স্তর দেখা যেতে লাগল। আর থেকে থেকে একটা আলোকচ্ছটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে ধেয়ে চলে যেতে লাগল। আবার কখনও বা সেটা বিপরীতমুখি অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্বে ছুটে চলল।

আমার বুঝতে দেরি হলো না। আলোকচ্ছটার ব্যাপারটা আরোরা বেরিয়ালিস এর খেলা ছাড়া কিছু নয়। আর একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়ল, সমুদ্রজলের তাপমাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আর পানির রঙেরও পরিবর্তন ঘটছে। দুটো ব্যাপারই আমার মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করল।

২ মার্চ। বন্দি-জংলিটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার মুখ থেকে ছেড়ে আসা মরণফাঁদ দ্বীপটা সম্বন্ধে বহু তথ্যই আদায় করতে পারলাম। তবে এখন আর সে পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে ফয়দাই বা কি? কেবলমাত্র এটুকু বললেই চলবে, দ্বীপখণ্ডটা আটটা দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। আর সব কটাই একই রাজার দ্বারা শাসিত হচ্ছে। সালেমন তার নাম।

সে সব দ্বীপের বাসিন্দারা চামড়ার ডোঙা ছাড়া অন্য কোনোকিছু দিয়ে ডোঙা তৈরির কৌশল জানে না। আর বড় যানের মধ্যে সম্বল ছিল এ শালতি চারটি। দক্ষিণ পশ্চিমের কোনো বড় দ্বীপ থেকে হঠাৎ ভাসতে ভাসতে এদিকে চলে এসেছিল। এখানকার দ্বীপবাসীদের চোখে পড়ে যাওয়ায়, তারা সেগুলোকে ধরে নিজেদের কাজে লাগাতে থাকে।

বন্দি জংলিটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আর যা-কিছু জানতে পারলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তথ্য হচ্ছে–আমরা সে দ্বীপটাকে ছেড়ে এসেছি সেটার নাম ‘সালাল’। আর বন্দির নিজের নাম নু-নু। না, থাক, ওসব কথা বলে মিছে সময় নষ্ট করতে চাই না।

মার্চের তিন তারিখ। আজ লক্ষ্য করলাম, পানির তাপমাত্রা সত্যি বেশ বেড়ে গেছে। তার রঙও ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। অবাক হবার মতো ঘটনাই বটে।

আরও অবাক হলাম সামান্য এগিয়ে লক্ষ্য করলাম, শান্ত সমুদ্রের বুকে হঠাৎ কিছুটা জায়গা জুড়ে ঘূর্ণি পাক–উত্তাল উদ্দাম অবস্থা।

মার্চের চার তারিখ। আজ হঠাৎ উত্তরের বাতাস বয়ে গেল। ফুল প্যান্টটাকে গুটাবার সময় জ্যাকেটের পকেট থেকে সাদা একটা রুমাল বার করি। আমার প্রায় গা ঘেঁষে নুনু বসে। বাতাসে উড়ে হঠাৎ রুমালের কোণটা তার নাকে লেগে যাওয়া মাত্র রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে যাবার মতো ব্যাপার ঘটে গেল। নুনু মুখে বার কয়েক বিশি রকম গোঁ-গোঁ আওয়াজ করল। পরমুহূর্তেই ভয়ানক খিচুনি শুরু হয়ে গেল। তার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় জড়ানো গলায় অনবরত ‘টুকেলি-লি! টুকেলি-লি, বলতে লাগল।

পাঁচই মার্চ। বাতাসের বেগ কমতে কমতে আজ একেবারেই কমে গেল। তীব্র স্রোতের টানে আমাদের শাতিটা উল্কার বেগে দক্ষিণ দিকেই দ্রুত এগিয়ে চলল।

আমার কেবলই মনে হতে লাগল, যে কোনো মুহূর্তে আমরা বুঝি বিপদের সম্মুখীন হতে পারি। কিন্তু আমরা আশঙ্কা অনুযায়ী সে রকম কিছুই ঘটল না। ডার্ক পিটার্সের মুখের দিকে নজর ফিরিয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। তবে এমন একটা ভাব তার মুখে লক্ষ্য করলাম, যা দেখে আমি নিজের বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম না।

আমার স্পষ্টই মনে হতে লাগল, মেরু শীত আর বেশি দূরে নয়। কিন্তু তার কষ্টদায়ক পরিস্থিতি অনুভূত হচ্ছে না। শরীরও মনে কেমন যেন অসারতা বোধ হতে লাগল, সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করলাম। ব্যস, এটুকুই।

মার্চের ছয় তারিখ। ধোয়াটে বাষ্পের আস্তরণটা ওপরে উঠতে উঠতে অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে। ক্রমেই ফ্যাকাশে হতে হতে সে ধোঁয়াটে রংটাও অনেকটা হালকা হয়ে গেছে। এত গরম হয়ে গেছে যে হাত পর্যন্ত ছোঁয়ানো যাচ্ছে না। আর সাদাটে ভাবটাও অপেক্ষাকৃত গাঢ় হয়ে এসেছে।

আরও কিছুটা এগোতেই শালতির একেবারে কাছাকাছি পানির তোলপাড়ানি নজরে পড়ল। আর তার সঙ্গে বাষ্পের ওপরের দিকটাও অস্বাভাবিক রকম জ্বলে উঠল। বাষ্পের আগুন নিভে যাওয়ার পর আর পানির তোলপাড়ানি বন্ধ হয়ে গেল। ছাইয়ের মতো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাদাটে গুঁড়ো কিছুটা শাতিতে আর পানির অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।

বন্দি-জংলি নুনু শালতিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকল। আমরা টানাটানি করে কিছুতেই তাকে ওঠাতে পারলাম না। সে শালতির কাঠ আঁকড়ে পড়ে রইল।

মার্চের সাত তারিখ। আমরা নুনু-কে বার বার জিজ্ঞাসা করলাম, তার দ্বীপবাসী জাতভাইরা কেন আমাদের সঙ্গিদের মেরে সাবাড় করে দিতে উঠে পড়ে লেগেছিল? কিন্তু শত চেষ্টা করেও তার কাছে থেকে আমাদের বাঞ্ছিত উত্তরটা পেলাম না। ভয়ে শিটকে লেগে সে শাতিটার তলায়ই পড়ে থাকল।

আটই মার্চ। আমাদের গতি অব্যাহতই রইল। সাদা একটা জানোয়ারকে শালতির পাশ দিয়ে ভেসে যেতে দেখলাম। আমরা মালান্টের সাগরের প্রায় কূল ঘেঁষে ঠিক এরকমই একটা জানোয়ারকে ভেসে যেতে দেখেছিলাম। যেটাকে নিয়ে জংলিদের মধ্যে রীতিমত আলোড়ন জেগে গিয়েছিল।

আমি অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে জানোয়ারটাকে শালতিতে তুলে নেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু হঠাৎ কেমন একটা অসাড়তা আমাকে পেয়ে বসল। ইচ্ছা পূর্ণ হলো না।

ইতিমধ্যে পানির তাপমাত্রা আরও অনেকগুণ বেড়ে গেছে। হাত ছোঁয়ানোই সম্ভব নয়।

ডার্ক পিটার্স মুখে কলুপ এঁটে বসে। সে যে কেন হঠাৎ ক্রমশ গম্ভীর ও উদাসিন হয়ে পড়েছে, আমার মাথায় এলো না। এদিকে শাতির তলায় পড়ে নুনু কেবল শ্বাসক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যস, এর বেশি কোনো সাড়াশব্দই তার দিক থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।

মার্চের নয় তারিখ। মিহি ছাইয়ের মতো আস্তরণটা এখন চারদিকেই প্রচুর পরিমাণে পড়তে লাগল। পড়ছে তো পড়ছেই, এর বিরাম নেই। আবার বারে অন্তরালটা ওপরে উঠতে উঠতে সুবিশাল ও সীমা পরিসীমাহীন জলপ্রপাত আকাশচুম্বী কোনো প্রাচীর ডিঙিয়ে চুপিচুপি সমুদ্রে আছড়ে পড়ছে। এ ছাড়া অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে এর তুলনা করা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। একেবারেই নিঃশব্দে। সুবিশাল একটা পর্দা পুরো দক্ষিণ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্পূর্ণ নিঃশব্দে সবকিছুই ঘটে চলেছে।

মার্চের একুশ তারিখের কথা বলছি–আজ আমাদের মাথার ওপরে বিষণ্ণ অন্ধকারের পর্দা চাঁদোয়ার মতো অবস্থান করছে। দুধের মতো সাদা সমুদ্রের জলরাশির ভেতর থেকে একটা লকলকে আগুনের শিখা যেন আমাদের শাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। একটা ব্যাপার আমাদের যারপরনাই বিস্ময়ে অভিভূত করছে, ছাইয়ের মতো মিহি গুঁড়োগুলো বাতাসে ভেসে শাতির ওপর আর আমাদের গায়ে পড়ে পড়ে অনবরত জমা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বিস্ময় উৎপাদনকারী ব্যাপারটা হচ্ছে, সে গুঁড়োগুলোই পানি পড়ামাত্র গলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

যতই অবাক হই না কেন, আমরা কিন্তু খুবই দ্রুত গতিতে অনবরত সেদিকে ছুটে চলেছি।

রাতের অন্ধকার মিলিয়ে গিয়ে ক্রমে ভোরের আলো ফুটে উঠল। বাইশে মার্চের সকাল। রাতের অন্ধকার মিলিয়ে গেলেও আগেকার সে অন্ধকার পর্দাটা যেন ক্রমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে পড়তে লাগল। তবে পানির স্বচ্ছ উজ্জ্বলতার ছোঁয়া লাগায় সে অন্ধকারটাকে আমাদের চোখ দুটো এখন অনেকাংশে বরদাস্ত করে নিয়েছে।

সে পর্দার আড়াল থেকে সাদা পাখির ঝাঁক অনবরত উড়ে আসছে। আর সেই অনাদি অনন্ত কালের ‘টুকেলি-লি! টুকেলি-লি!’ বলে ডাকাডাকি করতে করতে আমাদের চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

ব্যস, তারপরই শাতির তলায় পড়ে-থাকা জংলি নুনু দেহটা বার-কয়েক তির তির করে নড়েচড়ে উঠল। আমি ব্যস্ত হাতে তার গা স্পর্শ করলাম। চমকে উঠলাম। তার আত্মাও দেহ-খাঁচাটা ছেড়ে উড়ে গেছে।

মুহূর্তের মধ্যেই সে জলপ্রপাতটা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে একটা ফাটলের সৃষ্টি করে আমার দিকে ধেয়ে এলো। আর আমরাও দ্রুত ছুটে গিয়ে জলপ্রপাতটার ফাটলটার আশ্রয় নিলাম। কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তেই আচ্ছাদিতদেহ একটা মনুষ্যমূর্তি হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল। কে সে? কার মুর্তি? সত্যলোকের যে কোনো অধিবাসীর তুলনায় তার আকৃতি অনেক, অনেক বড়। আর তার গায়ের রং বরফের মতো ধবধবে সাদা।