ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম – (অ্যাডগার অ্যালান পো’র লেখা একমাত্র সম্পূর্ণ উপন্যাস)
প্রথম অধ্যায়
মাস কয়েক আগে আমি দক্ষিণ সমুদ্র ও অন্যান্য বেশ কয়েকটা অভিযান একের পর
এক সম্পূর্ণ করে আবার যুক্তরাস্ট্রে ফিরে এসেছি।
অভিযানকালে একেবারে হঠাৎ-ই ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড শহরে কয়েকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায় এবং আলাপ পরিচয় হয়।
আমার অভিযানের কথা জানতে পেরে তারা আমাকে বার বার বিশেষভাবে অনুরোধ করতে থাকেন, আমি যেসব জায়গায় অভিযান সেরে এসেছি, সে সব জায়গার পরিপূর্ণ বিবরণ এবং দেখে শুনে যা-কিছু উপলব্ধি করেছি তা যেন আমি সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরি।
তাঁরা আমাকে বারবার বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন বটে, কিন্তু কয়েকটা ব্যাপারে আমি তা রক্ষা করতে উৎসাহি হইনি, আপত্তি ছিল। আর সে কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিছকই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, তবে অন্যগুলো তেমন নয়।
আমার আপত্তিগুলোর মধ্যে একটা সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে–আমার অনুপস্থিতিকালের অধিকাংশ সময়েরই দিনলিপি আমি লিখে রাখিনি, কিছুই না। তাই তো সঙ্গত কারণেই আমার আশঙ্কা ছিল, কেবলমাত্র স্মৃতির ওপর ভরসা করে এমন একটা বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে আমি হয়তো গুলিয়ে ফেলব অর্থাৎ আমার পক্ষে সেটা যথাযথভাবে লিখে শেষ করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ আশঙ্কাটাই আমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে কাজ করছিল বলেই আমি মনের দিক থেকে মোটেই সায় পাইনি।
অভিযানের বিবরণী লেখার ব্যাপারে আমার অনীহার দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে– বিবরণীতে যে সব ঘটনার উল্লেখ করতে হবে সেগুলো এতই অত্যাশ্চর্য এবং অবিশ্বাস্য যে কোনো রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া কেবলমাত্র আমার গণ্ডির মধ্যে যারা আছেন, আর আমার বন্ধুজনরাই তাতে আস্থাভাজন হবেন এটুকুই ভরসা করতে পারি। আর অন্যান্যরা সবাই আমার বিবৃতিকে আষাঢ়ে গল্প বলেই উড়িয়ে দেবে। সবাই ধরে নেবে, আমি কাল্পনিক উপন্যাস ফাঁদতে বসেছি। তবে সাক্ষ্য প্রমাণের কথা যা বললাম তাতে মাত্র একজন দো-আঁসলা আদিবাসীর সাক্ষ্য আমার হাতে আছে। ব্যস, এটুকুই। কিন্তু এ-তো মোটেই যথেষ্ট নয়। তাই তো বিবরণী লেখার ব্যাপারে আমার যথেষ্ট ওজর আপত্তি। তবুও আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শ মেনে নিয়ে তাদের অনুরোধ যে আমি রক্ষা করতে পারিনি তার সবচেয়ে বড় কারণটা হচ্ছে–লেখক হিসেবে আমার নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে আস্থার অভাব। এ কাজটা যে আমি যথাযথভাবে সেরে উঠতে পারবই এ বিশ্বাসটুকুর অভাববশতই কাজটা সম্বন্ধে আমি মনের দিক থেকে এতটুকুও উৎসাহ পাচ্ছিলাম না।
আমার অভিযানের বিবরণ, বিশেষ করে বিবরণের যে স্থানে দক্ষিণ মেরু সমুদ্র সম্বন্ধে বক্তব্য রয়েছে এ-বিষয়ে জানার জন্য ভার্জিনিয়ায় যেসব অত্যুৎসাহী ভদ্রলোক রয়েছেন তাঁদের একজনের নাম টমাস ডাব্লু হোয়াইট। বর্তমানে তিনি রিচমন্ড শহরের অধিবাসী। আর তিনি সেখানকার মাসিক পত্রিকা ‘সার্দান লিটারেরি ম্যাসেঞ্জার’-এর সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। আর তিনি এ কাজে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয়ও দিয়েছেন, সন্দেহ নেই।
অন্য সব অত্যুৎসাহীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনি যারপরনাই দৃঢ়তার সঙ্গে আমাকে বলেছেন–অভিযানে বেরোবার পর থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত আমি যা-কিছু চাক্ষুষ করেছি আর যেসব ঘটনার সঙ্গে নিজেকে লিপ্ত করেছি সবকিছু যেন বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করে ফেলি। আর এও বলেছেন, আমি যেন জনগণের প্রখর বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর আস্থা রাখি। তবে তিনি কিন্তু আমাকে আশা ভরসা কম দিলেন না। তিনি খোলাখুলিই বললেন–আমার অভিযানসংক্রান্ত বইটার ছাপা আর বাঁধাই যত নিকৃষ্টমানের হোক না কেন–শেষপর্যন্ত যদি তাই হয়, তবু তা সত্য ঘটনা প্রকাশের সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে উঠবে। আর এ বইটার জন্য যে আমার নাম ডাক যথেষ্টই হবে তাতে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
সত্যি কথা বলতে কি, তাদের কাছ আশাতিরিক্ত আশা ভরসা পাওয়ার পরও কিন্তু আমি ব্যাপারটা সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম না। কেমন যেন একটা অব্যক্ত দ্বিধা আমাকে কাজটা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করল। আমি হাল ছেড়ে না দিয়ে পারলাম না।
ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমার দিক থেকে উৎসাহের লক্ষণ দেখতে না পেয়ে বাধ্য হয়ে তিনিই প্রস্তাব করলেন–আমার অভিযানের প্রথম পর্যায়–আমার পরিবেশিত তথ্য অনুসারেই, তার নিজের ভাষায় লিখে, উপন্যাসের রূপদান করে বহুল প্রচারিত ‘সার্দান লিটারেরি ম্যাসেঞ্জার’-এ ছাপতে পারেন, তার অনুমতি আমি তাঁকে দিই।
আমি তার প্রস্তাবটাকে সহানুভূতির সঙ্গে বিচার বিবেচনা করলাম।
ভেবে দেখলাম, তার প্রস্তাবটা অবশ্যই সাধুবাদ জানানোর উপযোগি। আর এতে আমাকে যখন কোনো ঝুঁকি নিতে হবে না তখন লাভ ছাড়া লোকসানের প্রশ্নই ওঠে না।
আমি সানন্দে আমার অভিযানের বিবরণী প্রকাশের সম্মতি দিয়ে দিলাম। তবে আপত্তির এটুকুই থাকতে পারে, বিবরণীটার গায়ে উপন্যাসের পোশাক-আশাক পরিয়ে তাকে কেতাদুরস্ত করতে হবে। তা হোক গে, আপত্তি কীসের?
কথা প্রসঙ্গে তার কাছে আমি একটা শর্ত আরোপ করলাম, আমার অভিযান সম্বন্ধে যা-ই ছাপা হোক না কেন, তাতে আমার আসল নাম ব্যবহার করতে হবে। তিনি আমার শর্ত মেনে নিলেন।
‘ম্যাসেঞ্জার’ পত্রিকার ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ছদ্মবেশ পরিহিত উপন্যাসটার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব ছাপা হল। আর লেখাটাকে যাতে অবশ্যই উপন্যাস জ্ঞান করা হয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে সূচিপত্রে মি. পো-র নামটাই ছাপা হল। অতএব শর্ত ভঙ্গ হলো না। আমারও আপত্তি বা কোনোরকম অভিযোগের প্রশ্নই ওঠে না।
আমার পাঠকরা এ-প্রবঞ্চনাকে কিভাবে নিলেন তাতেই উৎসাহিত হয়ে পূর্বকথিত অভিযান-কাহিনিকে প্রকাশনার ব্যবস্থা করছি। এরও কারণ অবশ্যই আছে। আমি লক্ষ্য করে এটুকুই উপলব্ধি করেছি আমার অভিযান-বিবরণীর যে অংশটুকু ম্যাসেঞ্জার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাতে উপকথার প্রলেপ বুলিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও পাঠকরা কিন্তু তাকে উপকথার পর্যায়ে ফেলেনি। উপরন্তু মি. পি কে লেখা যে কয়েকটা চিঠি পাওয়া গিয়েছে তার বক্তব্য এর বিপরীত মন্তব্যই প্রকটভাবে লক্ষিত হয়েছে।
তাই আমি চিন্তা ভাবনা করে এ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করলাম যে, আমার অভিযানের বিবরণে যে সব ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো নিজেরাই তাদের সত্যতার যথেষ্ট নজির। অতএব জনগণের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গুরুত্ব দেওয়ার কোনো যুক্তিই নেই। এমনকি তারা যদি ব্যাপারটাকে অবিশ্বাস করে তবুও ভয়ের কোনো কারণই নেই।
অতএব আমার এরকম সরাসরি স্বীকারোক্তি থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে যে এ বিবরণীর কতখানি আমার নিজের বক্তব্য আর কতখানিই বা খাদ মেশানো, রং চড়ানো হয়েছে, আর এও ধরা যাবে, মি. পো গোড়ার দিককার যে কয়েকটা লেখা লিখেছেন তাতেও কোনো ঘটনাকে বাড়িয়ে-কমিয়ে লেখা হয়নি।
আর পাঠকদের মধ্যে যারা কোনোদিন ‘ম্যাসেঞ্জার’ পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ পাননি তাঁদেরও ব্যাপারটা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করার তাগিদেই কোন অবধি তিনি লিখেছেন আর আমার লেখার শুরু হয়েছে ব্যক্ত করেছি। সত্যি কথা বলতে কি, লেখার কায়দা কৌশলের পার্থক্যটা সহজেই ধরা যাবে। অতএব এবার স্বীকার করতেই হয়, এরও দরকার রয়েছে।
এ জি পাম
নিউ ইয়র্ক জুলাই, ১৮৩৮
.
০১. ॥ প্রথম অধ্যায় ॥
আমি এবার নিজের নামটা খোলাখুলিই বলছি–আর্থার গর্ডন পাম আমার নাম।
আমার বাবা ছিলেন একজন নামকরা ব্যবসায়ী। ন্যান্টাকেটের জাহাজি মালপত্রের একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি ও সম্মান লাভ করেছিলেন। আমার জন্মও নান্টাকেটেই হয়েছিল। আমার মাতামহ একজন কৃতী এটর্নি ছিলেন। এ ব্যবসায়ে তিনি মালকড়ি ভালোই কামাতেন। শুধুমাত্র অর্থকড়ির দিক থেকেই নয়, সব দিক থেকেই তার ভাগ্য ছিল খুবই ভালো।
এড গন-নিউ ব্যাংকের কোম্পানির কাগজের কারবার করতে গিয়ে সে আমলে তিনি খুবই সাফল্যলাভ করেছিলেন। এ কারবার তো ছিলই, এছাড়া আরও বিভিন্নভাবে তিনি প্রচুর অর্থকড়ি কামিয়েছিলেন, জমিয়ে ছিলেনও কম নয়।
সারা পৃথিবীতে আপনজন বলতে যে ক’জন আছে তাদের মধ্যে আমিই তার সবচেয়ে বেশি প্রিয়পাত্র ছিলাম, অন্তত আমার বিশ্বাস। এ কথা বিবেচনা করেই আমার প্রত্যাশা ছিল, তার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির একটা বড় ভগ্নাংশের উত্তরাধিকারী হব।
আমার যখন ছয়বছর বয়স তখন তিনি আমাকে বৃদ্ধ রিকেটসের বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।
বৃদ্ধ রিকেটসের একটামাত্র হাত ছিল। তার কথাবার্তা আর চলনবলনে খামখেয়ালি খুবই বেশি মাত্রায় প্রকাশ পেত।
যারা নিউ বেডফোর্ডে গেছে তারা সবাই খুব ভালোভাবেই তাকে চেনে।
আমি তার বিদ্যালয়ে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত পাঠাভ্যাস করি, সেখানকার পাঠ মিটিয়ে মি. ই রোনাল্ডের শিক্ষা নিকেতনে ভর্তি হই। তাঁর প্রতিষ্ঠানটা পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত ছিল।
মি. ই রোনাল্ড-এর শিক্ষায়তনে পড়াশোনা করার সময় নৌ অধিনায়ক মি. বার্নাডের ছেলের সঙ্গে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। আর আমাদের সে বন্ধুত্ব ক্রমে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে।
মি বার্নাড তখন লয়েড অ্যান্ড ড্রেডেনবুর্গের কর্মী ছিলেন। বেডফোর্ডের সবাই মি. বানার্ডকে চেনেন। এ ছাড়া এডগার্টনেও তার বহু আত্মীয়স্বজন বাস করত।
মি. বার্নাডের ছেলের নাম ছিল অগাস্টাস। সে বয়সে আমার চেয়ে দুবছরের বড় ছিল।
অগাস্টাস একবার তার বাবার সঙ্গে জন ডোনাল্ডসন জাহাজে চেপে উত্তাল সমুদ্রে তিমি শিকার করতে গিয়েছিল। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে তখন তাকে বহুদিন কাটাতে হয়। তাই সে প্রায়ই আমাকে দক্ষিণ মহাসাগরের বিভিন্ন অভিযানের গল্প রসিয়ে রসিয়ে শোনাত।
মাঝে মধ্যে আমাকে সে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেত। সারাদিন উভয়ে গল্পগুজব করেই কাটিয়ে দিতাম। কোনো কোনোদিন তাদের বাড়িতে রাতও কাটাতাম। আমরা একই বিছানায়, পাশাপাশি শুতাম।
রাতে বিছানায় শুয়ে সে টিনিয়ার দ্বীপ এবং অভিযান করতে গিয়ে আর যেসব দেশের মাটিতে সে নেমেছে, ঘোরাফেরা করেছে সে সব দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার কথা রীতিমত রসিয়ে রসিয়ে শোনাত। সারা রাত আমাকে সে জাগিয়ে রাখত। আমি কিন্তু এতে রীতিমত উৎসাহই পেতাম।
এভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তার মুখে সমুদ্র-অভিযানের গল্প শুনে শুনে সমুদ্র সম্বন্ধে আমার মনে উৎসাহ উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। আর এরই ফলে আমার মনে সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে আগ্রহ জন্মাল। আর তা ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠল। আমার নিজের একটা জাহাজ ছিল–পালতোলা জাহাজ। আমি সেটার নামকরণ করেছিলাম ‘এরিয়েল’।
নগদ পঁচাত্তর ডলারের বিনিময়ে আমি সাধের ময়ুরপঙ্খী এরিয়েলকে খরিদ করেছিলাম। তাতে ছোট্ট একটা ছাউনির ঘরও ছিল।
আমার জাহাজটা যে কত টন বহনযোগ্য ছিল আজ আর তা মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, দশজন যাত্রী অনায়াসেই তাতে যাতায়াত করতে পারত।
আমার সে জাহাজ এরিয়েলে চেপে আমরা পাগলের মতো কত কাণ্ডই যে করতাম। তা বলে শেষ করা যাবে না। এখন আমি সে সময়কার দিনগুলোর কথা ভাবতে বসলে যারপরনাই অবাক হই, আমি কি করে আজও বেঁচে, বহাল তবিয়তে আছি।
আমার তখনকার অভিযানগুলোর মধ্যে থেকে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের বিবরণ এখানে উল্লেখ করার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না।
উল্লেখযোগ্য সে ঘটনাটা হচ্ছে–সেটা ছিল এক রাতের ঘটনা। সে-রাতে মি. বার্নাডের বাড়িতে একটা ভোজসভার আয়োজন হয়েছিল। আমি আর বন্ধুবর অগাস্টাস সে-নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সেখানে গিয়েছিলাম।
গলা অবধি দামি মদ গিলে আমি আর অগাস্টাস উভয়েই পাড় মাতাল হয়ে পড়েছিলাম। নেশার ঘোরে বাহ্যিক বোধটুকুও হারিয়ে ফেলেছিলাম। মদের নেশা চেপে গেলে অধিকাংশ মানুষ যা করে থাকে আমিও শেষপর্যন্ত তা-ই করলাম। বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত বাতিল করে অগাস্টাসের বাড়ি চলে গেলাম। তার বিছানাতেই শুয়ে পড়লাম। সেও নীরবে আমার পাশে শুয়ে পড়ল।
প্রায় একটা নাগাদ পার্টি ভেঙেছিল। তারপর শোয়া। শুতে শুতে কত রাত হয়ে গিয়েছিল সহজেই অনুমান করতে পারছেন।
যা-ই হোক, আমি আর অগাস্টাস উভয়েই নেশার ঘোরে কুঁদ হয়ে বিছানা আঁকড়ে পড়ে রইলাম। সে তার প্রিয় বিষয়টা সম্বন্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। আধা ঘণ্টা আমরা পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে পড়ে রইলাম।
আমার চোখের পাতা দুটো সবে ঘুমে বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল। অগাস্টাস হঠাৎ ভয়ঙ্কর একটা শপথ করে বলে উঠল–বুঝতে পারছ, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে কেমন মিষ্টি মধুর ঝিরঝিরে বাতাস বইছে?
আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম–হুম।
সে এবার বলল–‘আমার সাফ কথা শোন, খ্রিস্টিয় রাজ্যের কে এক আর্থার পাম-এর খাতিরে এমন অভাবনীয় মনোরম একটা মুহূর্ত আমি ঘুমিয়ে বরবাদ করে দিতে পারব না।
তার কথা শুনে আমি হতচকিত হয়ে চোখ মেলে তাকালাম। অকল্পিত বিস্ময়ে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার জোগাড় হলাম।
তার দিক থেকে সে মুহূর্তে আর কোনো কথাই শুনলাম না।
আমি তার কথাটাকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দিলাম। আসলে তার বক্তব্যটাই তো আমার বোধগুম্য হলো না। আমি নিঃসন্দেহ হলাম, মদের নেশায় সে জ্ঞান-বুদ্ধি খুইয়ে বসেছে। আমিও তাকে না ঘাঁটিয়ে মুখ বুজেই রইলাম।
আমার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেলে কি হবে, সে কিন্তু বেশিক্ষণনির্বাক থাকতে পারল না। মিনিট খানেকের মধ্যেই ধীর-স্থিরভাবে, খুবই শান্তস্বরেই কথা বলতে লাগল।
অগাস্টাস ভালোই জানে যে, আমি ধরেই নিয়েছি সে নেশায় একেবারে কুঁদ হয়ে গেছে। আসলে কিন্তু জীবনে কোনোদিনই সে এমন সুস্থ-স্বাভাবিক থাকেনি। সে আরও বলল–এমন একটা মায়া-কাজল মাখানো মধুর রাত একটা কুকুরের বিছানা আঁকড়ে, কুঁকড়ে শুয়ে কাটিয়ে দিতে নারাজ। কিছুতেই পারব না।’
সে এবার যা বলল তার তাৎপর্য হচ্ছে, বিছানা ছেড়ে উঠে পোশাক পরিচ্ছদ গায়ে চাপিয়ে সে সাধের জাহাজটায় চেপে মজা লুটতে বেরিয়ে পড়বে।
আমার কাঁধে যে কি ভর করেছিল, বলতে পারব না। তার মুখ থেকে প্রস্তাবটা শোনামাত্র আমার মন-প্রাণ আকস্মিক রোমাঞ্চে ভরপুর হয়ে গেল।
আমি যন্ত্রচালিতের মতো পাশ ফিরে তার মুখোমুখি শুলাম। তার এ মুহূর্তে খামখেয়ালি, পাগলামিকেই পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দদায়ক ব্যাপার বলে মনে হল। আর অবশ্যই যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে করতেও দ্বিধা করলাম না।
ইতিমধ্যে ঝড় শুরু হয়েছে। ঘরের বাইরের ঝড়ের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। মাত্রাতিরিক্ত ঠাণ্ডা পড়েছে।
অক্টোবর মাস শেষ হতে চলেছে। অতএব এ-সময়ে অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা পড়েছে। যাকে বলে ঠাণ্ডাটা রীতিমত জাঁকিয়েই পড়েছে। তা সত্ত্বেও আমি এক লাফে উঠে বিছানায় বসে পড়লাম। আসলে আমিও তো নিজেকে বন্ধুবর অগাস্টাসের তুলনায় কম সাহসি মনে করি না। আমিও কুকুরের মতো বিছানায় শুয়ে শুয়ে এমন মধুর রাতটা কাটিয়ে দিতে রাজি নই, কিছুতেই না। তা ছাড়া ন্যান্টকেটের বাসিন্দা অগাস্টাস বার্নাডের মতোই আমিও যে কোনোরকম মজা লুটতে কম উৎসাহি নই। তাই আমিও মনের দিক থেকে তৈরি হয়ে পড়লাম।
মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে আমি কষ্ট করে বিছানায় উঠে বসে পড়লাম। তারপরই এক লাফে বিছানা থেকে লাফিয়ে খাট থেকে নেমেই জাহাজের খোঁজে দৌড়ে গেলাম। জাহাজটা বাধা ছিল কাঠের বড় বড় গুঁড়ির ধারে, প্যাংকি অ্যান্ড কোম্পানির গুদামের গায়ে নোঙর করা।
অগাস্টাসও আমার পিছন পিছন উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে জাহাজটার গায়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে এক লাফে জাহাজে উঠে গেল। ব্যস্ত হাতে তার খোলের সব পানি সেঁচতে আরম্ভ করে দিল।
এবার আমরা দুজনে টানাটানি করে বড় পাল আর তিন কোণা পালটা টাঙিয়ে ফেললাম। অগাস্টাস জাহাজটার ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে হাল ধরল, আর মাস্তুলটার গা ঘেঁষে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম।
আমি তো আগেই বলেছি, দক্ষিণ-পশ্চিম কোণাকুণি থেকে বাতাস বইছে। আর আকাশ পরিষ্কার ও ঠাণ্ডা। আমাদের জাহাজটা বাতাসের কাঁধে ভর করে তরতর করে এগিয়ে চলল। জাহাজটা ঘাট ছেড়ে আসার পর থেকে আমি বা অগাস্টাস কেউ-ই মুখ খুলিনি, টু শব্দটিও করিনি।
আমিই প্রথমে নীরবতা ভঙ্গ করলাম। মাস্তুলটার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েই অমি সঙ্গি অগাস্টাসকে জিজ্ঞেস করলাম–কী হে, জাহাজটাকে তুমি কোন পথে নিয়ে যেতে চাইছ, জানতে পারি কী?
অগাস্টাস আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আমি এবার বললাম ‘অন্তত একটা কথার জবাব দাও, আমরা কবে ফিরতে পারব বলে তুমি মনে করছ?
সে অন্যমনস্কভাবে আরও কয়েক মিনিট ধরে শিস দিতে দিতে এক সময় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল–‘সবে তো রওনা দিয়েছি, এখনই ফেরার চিন্তা?
‘তবু তো জানা দরকার?’
‘আমি সমুদ্রে চলেছি।‘
‘সমুদ্রে! আমরা সমুদ্রে চলেছি!’
‘হ্যাঁ, সমুদ্রে! তোমার আপত্তি থাকলে এখনও সময় আছে, ইচ্ছে করলে তুমি বাড়ি ফিরে যেতে পার। সাফ কথা, এখনও সময় আছে, ভালো না লাগলে ফিরে যাও।’
আমি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম। তার মুখে বে-পরোয়ার ছাপ ফুটে উঠলেও তাকে রীতিমত উত্তেজিতই দেখলাম।
আমি আরও লক্ষ্য করলাম, তার সর্বাঙ্গ থরথরিয়ে কাঁপছে। এমনকি দুহাতে মুঠো করে ধরে রাখা হালটাকে আর আঁকড়ে রাখতে পারছে না। কোনো-না-কোনো একটা গোলমাল যে হয়েছে এটা বুঝতে আমার দেরি হলো না। তখন জাহাজ চালানোর ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা থাকা তো দূরের ব্যাপার সামান্যতম ধারনাও ছিল না।
অজ্ঞতার জন্য জাহাজ চালানোর ব্যাপারে, জাহাজ চালানোর কাজে আমাকে বন্ধুর ওপরই সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে থাকতে হল।
হঠাৎ কেন যেন বাতাসের বেগ বেড়ে গেল। প্রায় দমকা বাতাস শুরু হয়ে গেল। আমাদের জাহাজের পালে বাতাস লাগায় মাটির সঙ্গে আমাদের দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে লাগল। আমরা ক্রমেই পাড় থেকে দূরে চলে যেতে লাগলাম।
আমাদের জাহাজটা গভীর সমুদ্রের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকলেও আমার মধ্যে যাতে কোনোরকম ভয়ের লক্ষণ প্রকাশ না পায় সেদিকে আমাকে সতর্কতা অবলম্বন করতেই হল। নিজেকে ভীত-সন্ত্রস্ত বলে পরিচয় দিতে আমি খুব লজ্জা পেলাম।
প্রায় আধা ঘণ্টা সময় মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে আমি পাথরের মূর্তির মতো নির্বাক-নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। সামান্য নড়তে-চড়তেও ভরসা হলো না। আমি মরিয়া হয়ে চেষ্টা করলে কি হবে, বেশিক্ষণ আমার পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব হলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধুর দিকে তাকালাম। ক্ষীণ কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম– ‘অগাস্টাস একটা কথা–‘
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অগাস্টাস ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল–কথা? কী–কী কথা?
আমি আগের মতোই ক্ষীণকণ্ঠেই এবারও বললাম আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, এবার ফিরে গেলেই ভালো হয়। সে আগের মতোই মিনিটখানেক মৌন হয়েই রইল। কেবলমাত্র মুহূর্তের জন্য নীরব চাহনি মেলে আমার মুখের দিকে তাকাল। পরমূহুর্তেই আবার ঘাড় ঘুরিয়ে উত্তাল জলরাশির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
আমি একটু বেশ অধীরভাবেই এবার বললাম–কী? চুপ করে রইলে যে বড়? আমি বলছি, এখন ফিরে গেলেই ভালো হত নাকি?’
এবার সে আর মুখ বুজে থাকতে পারল না। তবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাকে লক্ষ্য করে কথাটা ছুঁড়ে দিল–‘আরে, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন, বল তো? বাড়ি তো যাবই। তবে বাড়ি ফেরার মতো প্রচুর সময়ই আছে। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। সময় হচ্ছে অবশ্যই
তার কথা শেষ হবার আগেই আমার ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তবে এও মিথ্যা নয় যে, তার দিক থেকে এরকমই জবাবই পাওয়া যাবে, আমি আশা করেছিলাম। কার্যত হলও তা-ই। তবে তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা সুর আমার কানে বাজল যাতে তার বুকের জমাটবাধা আতঙ্কই প্রকাশ পেল। তার কণ্ঠস্বর আমার কানে যেতেই মনটা অস্বাভাবিক বিষিয়ে উঠল।
তার দিকে আবার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালাম। লক্ষ্য করলাম, তার ঠোঁট দুটো রক্তশূন্য–ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আর হাঁটু দুটো এত কাঁপছে যে, তার পক্ষে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে।
বন্ধুর বেহাল অবস্থা দেখে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। গলা। দিয়ে ভয়ার্ত স্বর বেরিয়ে এলো–‘অগাস্টাস, ঈশ্বরের দোহাই, আমার কাছে গোপন কোরো না; তোমার কী সমস্যা আমাকে খোলসা করে বল? কি তোমার কষ্ট
আমি কথাটা শেষ করার আগেই সে কোনোরকমে উচ্চারণ করল–হুম!’
আমি কণ্ঠস্বরে অধিকতর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বললাম–তোমার ব্যাপার স্যাপার তো কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না! ব্যাপারটা কী বল তো?
‘ব্যাপার কিছুই না।
‘আমার কাছে তুমি গোপন করছ। কিছু না কিছু তো ঘটেছেই। তুমি যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা করতে চলেছ। কী? হয়েছে কি, খোলসা করে বল?
‘কি আবার হবে?’ বললামই এমন কোনো ব্যাপারই ঘটেনি যে–‘
‘কিচ্ছু না?
‘না, কিছুই না। বাড়ি চলেছি। তুমি বুঝতে পারছ না, আমরা বাড়ি ফিরছি?
এতক্ষণে আসল ব্যাপারটা আমার কাছে খোলসা হল। আমি এক লাফে এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেললাম। টানাটানি করে তুলে নিলাম। মদের নেশায় সে এক্কেবারে পুঁদ হয়ে পড়েছে, তাই জ্ঞান প্রায় খুইয়ে বসেছে; দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তিটুকুও তার মধ্য থেকে লোপ পেয়েছে। এমনকি কথা বলার মতো সামান্যতম ক্ষমতাও তার নেই। আর চোখেও দেখতে পাচ্ছে না কিছু। চোখের মনি দুটো দিয়ে যেন ঠিকরে আলোকচ্ছটা বেরিয়ে আসছে।
আমি কর্তব্য ঠিক করার আগেই আমাকে একেবারে হতাশ করে দিয়ে জাহাজের খোলে জমে থাকা পানিতে একটা মূলহীন গাছের গুঁড়ির মতো দুম্ করে পড়ে গেল। আমি হাত বাড়িয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম।
ব্যাপারটা আমার কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। সন্ধ্যায় আমি যতখানি অনুমান করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক-অনেক বেশি পরিমাণে মদ সে গলায় ঢেলেছে। তাই সে নেশায় পাঁড় মাতাল হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়েছিল। আর সে সঙ্গে রাতের পানিবাহিত হিমেল বাতাসের ক্রিয়া তো রয়েছেই। এখন সে নেশায় পুরোপুরি বুঁদ হয়ে পড়েছে। আগামী ঘণ্টা কয়েক সে প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই থাকবে। বাহ্যিক ক্ষমতা ফিরে পেতে সময় লাগবে।
আমার আকস্মিক ভীতিটা ক্রমে বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে উঠতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, আমার তখনকার মানসিক পরিস্থিতির কথা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ আগে যে মদটুকু আমি গলা দিয়ে ঢুকিয়েছিলাম তার কাজ অনেকাংশে হালকা হয়ে গেছে। নিজেকে সামলে নিতে পেরেছি। তাই বন্ধু অগাস্টাসের এই পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা করার মতো আমার শরীর ও মন দুইই স্বাভাবিক ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এক অবর্ণনীয় অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসল।
আর যা-ই হোক, আমার নিজের হিম্মৎ সম্বন্ধে আমি তো আর অজ্ঞ নই। জাহাজ চালাবার ক্ষমতা আমার নেই। এ-কাজে আমি একেবারেই অপারগ।
ইতিমধ্যে আচমকা দমকা বাতাস শুরু হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত বাতাস পাওয়ায় পাল দুটো ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে গেছে। এরই ফলে আমাদের জাহাজটি ধ্বংসের দিকে উল্কার বেগে ছুটে চলেছে।
ঠিক সে মুহূর্তেই লক্ষ্য করলাম ভয়ঙ্কর একটা ঝড় আমাদের পিছন থেকে গর্জন করতে করতে ধেয়ে আসছে।
হায় ঈশ্বর! এখন উপায়। আমাদের সঙ্গে কম্পাসও নেই যে পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে কিছুটা অন্তত ধারণা করতে পারব। আবার এক কণা খাবারও নেই যে, বিপদের সময় পিতৃদত্ত জীবনটাকে কোনোরকমে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারত।
বাতাস বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢেউয়ের বেগও অস্বাভাবিক বেড়ে গেল। সমুদ্র উত্তাল উদ্দাম হয়ে উঠল। ছোট্ট জাহাজটা একবার আকাশ ছোঁয়া ঢেউয়ের মাথায় উঠেই পর মুহূর্তেই আবার দুম্ করে আছাড় খেয়ে পড়ে যেতে লাগল। প্রতি মুহূর্তে শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে পড়ে।
আবার কোনো কোনো সময় বিপরীত কাণ্ড ঘটে যেতে লাগল। জাহাজের সম্মুখটা এক একবার ঢেউয়ের ভেতরে ঢুকে গিয়ে পর মুহূর্তেই আবার ঝট করে পানির ওপর ভেসে উঠতে লাগল।
এবার আমি যারপরনাই অবাক হয়ে গেলাম। এমন একটা অদ্ভুত, অত্যাশ্চর্য ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা যেন আমার কল্পনারও অতীত। ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাদের জাহাজটা এবার আর বাতাসের অনুকূলে নয়, সম্পূর্ণ প্রতিকূলে, একেবারে বাতাসের বিপরীত মুখ দিয়ে ছুটে চলেছে। এমন অসম্ভব ব্যাপারের কথা কারো কাছে কেঁদেকেটে বললেও বিশ্বাস করবে না, করা সম্ভবও নয়। ভাগ্য ভালো যে, জাহাজটা এবার ঠিকঠাকই চলছে।
বাতাসের বেগ কিন্তু এতটুকুও কমে তোনি-ই বরং ক্রমেই বেড়ে চলেছে, আর সেই সঙ্গে বুক-কাঁপানো গর্জনও।
ঢেউ! ঢেউ! আর ঢেউ! একটার পিছনে আর একটা আকাশ-ছোঁয়া ঢেউ এসে আমাদের পুরোপুরি ভিজিয়ে দিতে লাগল। একটা ঢেউকে সামাল দিতে না দিতেই আর একটা ঢেউ এসে আমাদের ওপর আছাড় খেয়ে পড়তে লাগল।
আতঙ্ক! আর আতঙ্ক! প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কের মুখোমুখি হতে হতে আমার হাত-পা শিথিল হয়ে পড়তে লাগল। পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়তে লাগল যে, যে কোনো মুহূর্তে আমি সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়তে পারি।
উপায়ান্তর না দেখে দাঁতে দাঁত চেপে, প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে বড় পালটার কাছে কোনোরকমে হাজির হলাম। সেটাকে নামিয়ে ফেললাম।
পালটার দড়িদড়া খোলার সময় যা আশঙ্কা করেছিলাম, কার্যত হলও ঠিক তাই। দড়ির বাঁধন আলগা হতেই সেটা ভিজে ভারী হয়ে যাওয়া পালটা গলুইটা ডিঙিয়ে হুড়মুড় করে মাস্তুলটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিল।
সত্যি কথা বলতে কি সব শেষের দুর্ঘটনাটাই আমাকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল।
এবার হালটাকে হাতে তুলে নিয়ে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
আমার মনের কোণে এবার বেঁচে যাওয়ার একটা ক্ষীণ আশার সঞ্চার হল। হয়তো জীবনটা রক্ষা হলে হতেও পারে।
আমার বন্ধু অগাস্টাস তখন সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই এলিয়ে পড়ে রয়েছে।
জাহাজটা মোচার ভোলার মতো অনবরত দোল খেয়েই চলেছে। আমি পা টিপে টিপে অগাস্টাসের কাছে গেলাম। তাকে জাপটে ধরে কিছুটা তুলে প্রায় বসিয়ে দিলাম।
এবার একগাদা দড়ি তার কোমরের সঙ্গে বেঁধে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলাম।
এবার ভাগ্য ঠুকে নিজের কর্তব্য সম্পাদনে মন দিলাম। আমি হালটা মুঠো করে ধরতে না ধরতেই অকস্মাৎ হাজার খানেক দানব যেন একই সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল। সে কী গর্জন। আতঙ্কে আমার ফুসফুস স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।
সে-মুহূর্তে আকস্মিক আতঙ্কের তীব্র যন্ত্রণা আমার সর্বাঙ্গ যেমন শিথিল করে দিচ্ছিল তা আমৃত্যু আমার স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে থাকবে। পরিস্থিতি এমন খারাপ হয়ে পড়ল যে, মনে হলো আমার শরীরের সব রক্ত বুঝি জমাট বেঁধে যাচ্ছে, আর আমার, চুল সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে পড়ছে। হৃদপিণ্ডও বুঝি বা কুঁকড়ে দুমড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
চোখ মেলে তাকানোর মতো মনের জোরও আমি হারিয়ে ফেলেছি। চোখ দুটো বন্ধ রেখেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে বন্ধুর এলিয়ে-পড়া দেহটার ওপর শুয়ে পড়লাম। এতে তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হলো তা বোঝার মতো হুঁসও আমার রইল না।
আমার যখন সংজ্ঞা ফিরে এলো তখন চোখ মেলে তাকিয়েই আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। হায়! আমি কোথায়, বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। বুঝলাম, আমি তিমি-শিকারের জাহাজের কেবিনে একটি চৌপায়ার ওপর শুয়ে। আরও বুঝতে পারলাম, জাহাজটার নাম ‘পেঙ্গুইন’।
আমার চারদিকে অনেক লোক দাঁড়িয়ে। কেউ বা ঝুঁকে আমার পরিস্থিতির ওপর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে নজর রেখে চলেছে। আর অগাস্টাস শিয়রে বসে আমার হাতদুটোকে পর্যায়ক্রমে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে অনবরত ঘষে ঘষে গরম করার চেষ্টা করে চলেছে। আমার সংজ্ঞা ফিরে আসতেই, চোখ মেলে তাকানোমাত্র সে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে রীতিমত লাফালাফি জুড়ে দিল।
বন্ধু অগাস্টাসের রকম সকম দেখে জাহাজের বিদঘুঁটে দর্শণী লোকগুলো কেউ হাসাহাসি শুরু করে দিল, আবার কেউ বা নীরবে চোখের পানি ঝরাতে লাগল। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। আমাদের প্রাণে বেঁচে যাওয়ার, ও তখন অবধি বেঁচে থাকার কারণটা এবার আমার কাছে খোলসা হয়ে গেল।
তিমি শিকারের জাহাজটার ক্যাপ্টেন পালের টানে দ্রুতগতিতে ন্যান্টাকেট যাবার সময় বুঝতে না পেরে আমাদের ছোট জাহাজটাকে আচমকা ধাক্কা মারেন।
জনাকয়েক নাবিক জাহাজটার সামনের দিকে ছিল। গোড়াতে তারাও আমাদের জাহাজটাকে দেখতে পায়নি। কিন্তু যখন নজরে পড়ল তখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আয়ত্বের বাইরে। সংঘর্ষ এড়াবার কোনো পথই খোলা ছিল না। তবু যদি কিছু করা যায় ভেবে তারা চিৎকার চাচামেচি করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ, সাবধান করে দেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করল। তা আমাদের কানে যেতেই আমরা আতঙ্কে মুষড়ে পড়েছিলাম। আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছি, ঠিক সে মুহূর্তেই ঢেউয়ের ঝাপ্টায় অতিকায় জাহাজটা আমাদের ওপর দিয়ে শোলার মতো আলতোভাবে টপকে গেল।
এমন ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড ঘটে গেলেও ছোট জাহাজটার ডেক থেকে সামান্যতম আর্তনাদও উঠল না। কেবলমাত্র ঝড় আর ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া শব্দের সঙ্গে দুটো জাহাজের ঘর্ষণের মৃদু আওয়াজ শোনা গেল। এর বেশি কিছুই নয়।
আমাদের জাহাজটাকে বড়সড় একটা ঝিনুক ভেবে ‘পেঙ্গুইনের ক্যাপ্টেন ইটিভি ব্লক তো জাহাজ নিয়ে চলেই যাচ্ছিলেন।
আমাদের ভাগ্য ভালো যে, পেঙ্গুইনের পর্যবেক্ষক-নাবিকরা বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছিল, একটা লোককে তারা হাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেয়েছিল। তারা ক্যাপ্টেনকে এও বলেছে, চেষ্টা করলে তাকে বাঁচানো যেতে পারে। ক্যাপ্টেনের বিশ্বাস স্থাপন করতে তারা শপথ করতে দ্বিধা করল না।
ক্যাপ্টেন ইটিডি ব্লক কিন্তু তবু ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করতে উৎসাহ পেলেন না।
পর্যবেক্ষক-নাবিকরা তবুও তাদের বক্তব্য থেকে সরে গেল না। শেষপর্যন্ত ক্যাপ্টেন রেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি গর্জে উঠলেন–তোমরা কী দেখেছ তা জেনে আমার দরকার নেই। দেখ হে; এতবড় একটা জাহাজ নিয়ে আমি
তো আর ঝিনুক কুড়াতে বেরোইনি যে, কোথায় কি পড়ে রয়েছে খুঁজে বেড়াব।
নাবিকরা ভয়ে ভয়ে বলল–তবু একটা লোক–
‘চুপ কর তোমরা! এরকম একটা রসিকতার মূল্য দিতে গিয়ে একটা জাহাজকে অহেতুক আটকে রাখতে আমি রাজি নই। আর যদি কেউ নেহাৎই চাপা পড়ে থাকে তার জন্য অবশ্যই আমি দায়ী নই, সম্পূর্ণ তার নিজের দোষ।
‘চোখের সামনে একটা লোক…’ তাদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন রীতিমত খেঁকিয়ে উঠলেন। কেউ যদি ডুবে যায়, মরে যায়–যদি আরও কিছু হয়, হোক গে, আমার কিছু করার নেই।
ক্যাপ্টেন যখন গো ধরেই রইলেন, নিজের বক্তব্য থেকে এতটুকুও সরে দাঁড়াতে রাজি হলেন না তখন নিতান্ত উপায়হীন হয়েই জাহাজের প্রথম মেট হেন্ডারস জেদ ধরলেন, প্রকৃত রহস্যটা না জানা পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে এক পা-ও নড়বেন না। জাহাজের নাবিকরাও তাকে সমর্থন করল। সঙ্গে সঙ্গে সবাই জোট বেঁধে ফেলল।
প্রথম মেট হেন্ডারসন এবার আরও জোর পেলেন। তিনি ক্যাপ্টেনকে স্পষ্টভাষায় জা নিয়ে দিলেন–‘আপনার মধ্যে মানবিকতার লেশমাত্রও নেই। আপনার কথা ও কাজ চরম অমানবিকতার পরিচয় দিচ্ছে।
‘এতবড় কথা আপনি আমাকে বলতে পারলেন মি. হেন্ডারস!’
‘আপনার আচরণই আমাকে এরকম কথা বলতে বাধ্য করছে। আমার তো মনে হয় এর জন্য আপনাকে ফাঁসির দিলে দিলেও আপনার উপযুক্ত শাস্তি হবে না।
মেট হেন্ডারসন কিছুতেই ক্যাপ্টেনের হুকুম তামিল করতে রাজি হলেন না। এর জন্য মাটিতে পা দিতেই তার যদি মৃত্যুদণ্ডও হয় তবুও তিনি পিছপা হবেন না।
জাহাজের নাবিকরা তাঁর পাশে থাকায় তিনি ক্যাপ্টেন ইটিভি ব্লককে জোর করে এক পাশে সরিয়ে দিয়ে নিজেই এক লাফে জাহাজের হালের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। শক্ত হাতে হাল ধরলেন।
মেট ব্লক এবার নাবিকদের অনুরোধের স্বরে নির্দেশ দিলেন ‘তোমরা নিজের নিজের কাজে যাও। এ-দিকটা আমি একাই সামলাতে পারব।’
নাবিকরা এগিয়ে গিয়ে যে যার কাজে হাত দিল। \সবার সমবেত চেষ্টায় বড় জাহাজটাকে এক পাশে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হল।
মাত্র মিনিট পাঁচেকের চেষ্টায় কাজটা সম্পূর্ণ হয়ে গেল। আর আশা করি পাঠকদের আর বলে দেওয়ার দরকার নেই যে, বড় জাহাজটার মেট মি. হেন্ডারসন আর নাবিকদের সহানুভূতির ফলস্বরূপ আমি আর অগাস্টাস নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সেবারের মতো বেঁচে গেলাম।
উদ্ধার-কাৰ্যটার কথা যত সহজে বললাম আসলে কিন্তু এত সহজে সম্ভব হয়নি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তবেই মেট মি. হেন্ডারসন এমন একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন।
মি. হেন্ডারসন বড় জাহাজটাকে তার নিজের জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করে দুজন নাবিককে সঙ্গে নিয়ে ডিঙিটাকে পানিতে নামিয়ে দিলেন। এবার নিজে এক লাফে ডিঙিটায় নামলেন। আমি পেঙ্গুইনের তলায় একটা তামার পাতের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে লটকে ছিলাম। আমাকে এ অবস্থাতেই মি. হেন্ডারসন আবিষ্কার করলেন।
জাহাজটার একটা কাঠের টুকরো অর্ধেক ভেঙে গিয়েছিল। সেটা তামার পাতটাকে ভেদ করে বাইরের দিকে বেরিয়ে পড়ে। আমি বেকায়দায় পড়ে ভেসে যাওয়ার সময় কাঠের টুকরোর মাথাটা হঠাৎ আসার জ্যাকেটের কলারে ঢুকে যায়। ব্যস, আমি ঢেউয়ের মুখে পড়ে ভেসে যাওয়া থেকে বেঁচে গেলাম।
পেঙ্গুইনের নাবিকেরা বহু কসরৎ করে আমাকে তাদের জাহাজের ডেকে তুলে দিল। আমি তখন সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন ও মৃতপ্রায়। সবাই মিলে ধরাধরি করে আমাকে জাহাজের। কেবিনে নিয়ে গেল। আগেই বিছানা পাতাই ছিল। আমাকে সেখানে শুইয়ে দিল।
জাহাজে কোনো ডাক্তার ছিল না। ক্যাপ্টেন ইটিভি ব্লক চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার একটু-আধটু জানতেন। তিনিই নিজের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে আমার চিকিৎসা শুরু করে দিলেন। তাঁর আন্তরিক সেবাযত্ন ও চিকিৎসায় আমি অচিরেই সংজ্ঞা ফিরে পেলাম। এমনও হতে পারে, আমার প্রতি পূর্বকৃত গাফিলতির জন্যই তিনি আমাকে সুস্থ করে তোলার জন্য প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে আমাকে সুস্থ করে তুললেন।
যা-ই হোক, পেঙ্গুইন জাহাজটার কর্মচারী, মেট আর ক্যাপ্টেনের সমবেত চেষ্টায় আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলাম।
আমাকে উদ্ধার করার পর মেট হেল্ডারসন আবার নিচে অবস্থানরত ডিঙিটায় নেমে গেলেন। আমি তখনও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়ে থাকায়, আমার মুখ থেকে আমাদের জাহাজের অন্য কেউ ছিল কি না জানার সুযোগ না পেয়ে নিজেই খুঁজে দেখার জন্য আবার ডিঙিটায় নেমে গেলেন।
দম্কা ঝড় তখন হ্যারিকেনের রূপ নিয়েছে। সে যে কী ভয়ঙ্কর ঝড় তা চাক্ষুষ না করলে কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যা-ই হোক, ডিঙিটায় চাপামাত্র এক ধাক্কায় হেন্ডারসনের ডিঙিটা বেশ কিছুটা পথ ঝট করে এগিয়ে গেল। ঠিক তখনই ডিঙিটার সামনে দিয়ে আমাদের ছোট্ট জাহাজটার ভাঙাচোরা অংশ তিনি ঢেউয়ের তালে তালে ভেসে যেতে দেখতে পেলেন। তাঁর সঙ্গি জনা-দুই নাবিকও ছিল।
নাবিকদের মধ্যে থেকে একজন হেন্ডারসনকে বলল–‘ঝড়ের গর্জন ভেদ করে অন্ধকারের ভেতর থেকে কার যেন আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। ওই–ওই যে, তীব্র, আর্তনাদ করছে–‘বাঁচাও! বাঁচাও।’
এবার হেল্ডারস নতুন উৎসাহ-উদ্যম নিয়ে চারদিকে হন্যে হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। যাকে বলে রীতিমত চিরুনি অভিযান চালাতে লাগলেন। না, আধঘণ্টা ধরে হন্যে হয়ে পানি তোলপাড় করে তল্লাশি চালিয়েও যখন কারো হদিস মিলল না, তখন হেন্ডারসন হতাশ হয়ে বললেন–হয়তো আমাদেরই শোনার ভুল। ঝড় আর ঝড়ের মিলিত তীব্র গর্জনকেই হয়তো আর্তনাদ ভেবে আমরা ভুল করেছি। ভাঙা-জাহাজটায় আর কেউ থাকলে অবশ্যই আমাদের চোখে পড়ত।’
আধ ঘণ্টার কেটে গেলে ক্যাপ্টেন ইটিভি ব্লক জাহাজ থেকে সংকেতের মাধ্যমে মেট হেন্ডারসনসহ সবাইকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
আর এদিকে মেট হেন্ডারসন ও তার সহযোগি নাবিকরাও হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন। ক্যাপ্টেন ব্লকের নির্দেশ পাওয়ার পর তারা ফিরে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই নিয়ে নিলেন।
সবাই যখন ফিরে যাওয়ার জন্য ডিঙিটার মুখ ঘোরাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ঠিক তখনই তাদের পাশ দিয়ে, ডিঙিটাকে প্রায় গা ঘেঁষে কালোমতো কি যেন একটা বস্তুকে ভেসে যেতে দেখলেন। আর সে বস্তুটার ভেতর থেকে একটা চাপা আর্তস্বর কানে এলো। গোড়ার দিকে সবাই ভাবলেন, বুঝি এবারও শোনার ভুল।
মুহূর্তের জন্য উৎকর্ণ হয়ে আর্তস্বরটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার চেষ্টা করলেন। না, এত শোনার ভুল হতে পারে না। পরিষ্কার দুর্বল কণ্ঠের গোঙানি। ব্যাস, আর একটা মুহূর্ত দেরি না করে আমাদের ডিঙিটার মুখ ভেসে-যাওয়া বস্তুটার দিকে ঘুরিয়ে নিল। এবার সাধ্যমত দ্রুততার সঙ্গে সেটাকে এগিয়ে নিয়ে কালো বস্তুটাকে ধরে ফেললেন। কালো বস্তুটা আসলে আমাদের ‘এরিয়েল’ জাহাজটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পুরো ডেকটা। আমার বন্ধু অগাস্টাস ডেকের ভেতরে পড়ে অনবরত গোঙাচ্ছে।
ডেকটা ধরে ফেলার পর মেট হেন্ডারসন আর তার সহযোগি নাবিকেরা ভাসমান ডেকের একটা কাঠের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় তাকে দেখতে পেল। আমার প্রিয় পাঠকরা, আশা করি আপনাদের স্মরণ আছে, আমিই তাকে কাঠটার সঙ্গে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। তা যদি না করতাম তবে বেহুস অবস্থায় ঢেউয়ের টানে কোথায় যে তলিয়ে যেত তার হদিসই মিলত না। যা-ই হোক, আমার বন্ধুর বেহুস দেহটাকে ডিঙিতে তুলে নিল। স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে অগাস্টাসের ঘন্টা খানেক সময় লেগে গেল। তবু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠল না, কেমন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েই গেল।
আমিও ক্রমে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে পেতে লাগলাম।
তারপর পেঙ্গুইন আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করল। ভয়ঙ্কর একটা ঝড়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই চালিয়ে, রীতিমত দাপাদাপি করতে করতে দিন ভোরের আলো ফুটলে বন্দরে ঢুকে নোঙর করল। প্রাতরাশ সারতে যাওয়ার সময় অগাস্টাস আর আমি ঠিক সময় মতোই মি. বার্ণার্ডের বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেলাম। দরজায় কড়া নাড়তেই মি. বার্ণার্ডের পরিচারক দরজা খুলে আমাদের স্বাগত জানাল।
আগের রাতের ভোজসভায় যোগদান করায় সবাই এতই ক্লান্ত যে, অগাস্টাস আর আমার বিধ্বস্ত চেহারার দিকে কারো নজরেই পড়ল না। আমাদের দিকে মন দেওয়ার মতো কারোই দেহ মন সুস্থ নয়।
তারপর থেকে আমরা দুজন ঘটনাটা নিয়ে মাঝে-মধ্যেই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেছি। আমরা যতটাই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলেছি, প্রতিবারই আতঙ্কে আমাদের বুকের ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হয়ে যায়। শরীরের সব কয়টা স্নায়ু যেন এক সঙ্গে শিথিল হয়ে আসতে চায়। আর মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে।
বন্ধুবর অগাস্টাস তো একদিন কথা বলতে গিয়ে দুম করেই বলেই ফেলল, সে রাতে আমাদের ছোট্ট পাল-তোলা জাহাজটায় বসে প্রথম যখন সে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে মাত্রাতিরিক্ত মদ গেলায় সে নেশায় একেবারে পাড় মাতাল হয়ে পড়ে তখন মাথার ভেতরে যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছিল, তিলে তিলে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল, সংজ্ঞা হারিয়ে কোনো এক অন্ধকার গহবরের অতলে তলিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক সে রকম পরিস্থিতিতে জীবনে আর কোনোদিন পড়েনি। তার মতে সে অভিজ্ঞতাটা নাকি বাস্তবিকই অভূতপূর্ব আর একেবারে বর্ণণাতীতও বটে।
.
০২. ॥ দ্বিতীয় অধ্যায় ।
সবেমাত্র যে ভয়ঙ্কর সমুদ্র-অভিযানের কথা ব্যক্ত করলাম তা বাস্তবিকই অদ্ভুত, নিছকই অত্যাশ্চর্য, আর সে ঘটনার জন্যই সমুদ্রের প্রতি আমার মনে বীতশ্রদ্ধা জাগবে, সমুদ্র অভিযানের প্রতি অনীহা জন্মাবে–পাঠকদের পক্ষে এরকম ধারণা করাই সঙ্গত। আর হবে না-ই বা কেন? এত ঝড়-ঝাঁপটা আর নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে পিতৃদত্ত জীবনটাকে নিয়ে কোনোরকমে ফিরে আসার পর সে আর ভুলেও কোনোদিন ও পথে যাবে না, এটাই তো ভাবা উচিত।
কিন্তু অভাবনীয় উপায়ে প্রাণে বেঁচে যাবার পর এক সপ্তাহ না পেরোতেই সমুদ্রযাত্রারনির্ভীক অভিযানের যে বাঁধ না-মানা ইচ্ছা মনকে চঞ্চল করে তুলল, এমনটা ইতিপূর্বে আর কোনোদিনই দেখা দেয়নি।
আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সে রাতে যে বুক-কাঁপানো অভিজ্ঞতার স্মৃতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে গেঁথে নিয়েছিল তা কয়দিন যেতে না যেতেই নিঃশেষে মুছে যেতে লাগল। আর তার জায়গা দখল করল ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটার যা-কিছু রোমাঞ্চকর, যা-কিছু মনোলোভা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অচিরেই নতুন করে সমুদ্রঅভিযানে পা বাড়াবার জন্য আমি ভেতর থেকে রীতিমত তাগিদ অনুভব করতে লাগলাম।
আমি মানসিক অস্থিরতার শিকার হয়ে বন্ধুবর অগাস্টাসের কাছে যাওয়া বাড়িয়ে দিলাম। ইদানিং তার মুখোমুখি বসে সমুদ্র-অভিযানের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আলোচনা করে যত আনন্দ পাই, অন্য কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার তিলমাত্র উৎসাহই আমি পাই না।
অগাস্টাসের কাছে ঘন ঘন যাতায়াতের ফলে আমাদের মধ্যে আলোচনাও ততই বেড়ে চলল। আর এরই ফলে সমুদ্র অভিযানের প্রতি আমার ইচ্ছাও ক্রমেই প্রবল থেকে প্রবলতর হতে হতে একেবারে তুঙ্গে উঠে যেতে লাগল।
অগাস্টাস সমুদ্র-অভিযানের কাহিনীগুলোকে এমন রসিয়ে রসিয়ে মাত্রাতিরিক্ত খাদ মিশিয়ে এমন আকর্ষণীয় করে আমার কাছে পরিবেশন করত যা শুনেই আমার মন প্রাণ রীতিমত চনম নিয়ে উঠত। সে মুহূর্তে আমি যেন নিজেকে পুরোপরি হারিয়ে ফেলতাম, আর কল্পনার ময়ুরপঙ্খী চেপে অচিন দেশে পাড়ি জমাতাম। এখন অবশ্য আমার মনে হয় তার রোমাঞ্চকর গল্পগুলোর একটা বড় অংশই মনগড়া, আসলের চেয়ে খাদই মেশানো থাকত বেশি।
আরও অবাক হবার মতো কথা, সমুদ্র অভিযানের রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলোর পাশাপাশি সে যখন দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণার মুহূর্তগুলোর কথা আমাকে শোনাত তখনই আমার অস্থির মন ধেয়ে যেত নাবিক-জীবনের দিকে।
আমার মন-প্রাণ জুড়ে থাকত সমুদ্রের প্রলয়ঙ্কর ঝড়-ঝাপ্টা, জাহাজডুবি, অনাহার ও দুর্ভিক্ষ, পথ হারিয়ে অসভ্য জংলী হিংস্র মানুষের পরিবেশে হাজির হওয়া, তাদের কবলে পড়ে নিতান্ত অসহায় অবস্থায় নির্মমভাবে প্রাণ খোয়ানো, বন্দি-জীবন যাপন করা, নাম
-জানা অজানা-অচেনা পরিবেশে, দুর্গম স্থানে বা সমুদ্রের বুকের কোনো নির্জন-নিরালা পার্বত্য অঞ্চলে চোখের পানি ঝরাতে ঝরাতে দিনের পর দিন মৃতপ্রায় অবস্থায় কাটানো প্রভৃতির মতো ভয়ঙ্কর আরও কত দৃশ্য আমার মনে বার বার উঁকি দিত।
এদিকে এরিয়েল নামক জাহাজ দুর্ঘটনার কবলে পড়ার পর প্রায় আঠারো মাস পরের কথা। গ্রামপাস’ নামক দুই মাস্তুলের জাহাজটাকে সারাই করে সমুদ্র যাত্রার উপযোগি করে তোলার জন্য কর্মীদের জোর তৎপরতা শুরু হয়ে গেল। উদ্দেশ্য জাহাজটা সারাই হয়ে গেলেই ‘লয়েড অ্যান্ড ব্লেন্ডেনবার্গ, নামক নবাগত তিমি শিকারের কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা হবে।
জাহাজটা বহু পুরনো। তার ওপর দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে সেটা একেবারে জীর্ণদশাপ্রাপ্ত হয়েছে। এমন একটা জাহাজকে মেরামত করে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা খুবই কঠিন সমস্যা। ফলে সেটাকে মেরামত করতে গিয়ে হাজারো হাঙ্গামা পোহাতে হল। তবু কর্মীরা এত সহজে হাল ছেড়ে দেবার পাত্র নয়।
কর্মীদের কাজের তৎপরতা অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে তারা জাহাজটাকে ব্যবহারের উপযোগি করে তুলতে পারল। তারপর রঙের প্রলেপ দেওয়ায় পর সেটা যেন সদ্য তৈরি একটা জাহাজ পানিতে নামল।
জাহাজটার মেরামতির কাজ মিটে গেলে জাহাজের ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করার ব্যাপারটার দিকে নজর দেওয়া হল। অনেক ভেবে চিন্তে শেষপর্যন্ত মি, বানার্ডকেই ক্যাপ্টেনের পদে বহাল করা হল।
আর এও ঠিক হল, আমার বন্ধুবর অগাস্টাসও তার সঙ্গে জাহাজে উঠবে। অগাস্টাস মাঝে-মধ্যেই আমার সঙ্গে দেখা করে। বিভিন্নভাবে আমাকে বোঝায়, আমার সমুদ্র-অভিযানের এমন অপূর্ব সুযোগ আর আসবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ ছাড়াও সে আমাকে আরও কতভাবে যে প্ররোচিত করতে লাগল তা বলে শেষ করা যাবে না।
সত্যি কথা বলতে কি, আমি তো এমন একটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করার জন্য মনে-প্রাণে আগ্রহী। আরও সহজ ভাষায় বললে, সমুদ্রে পাড়ি জমানোর জন্য আমি তো পা বাড়িয়েই রয়েছি। কিন্তু আসলে ভাবাটা যত সহজ ব্যবস্থা করাটা তো আর এত সহজ নয়।
আমার আন্তরিক ইচ্ছার কথাটা রাতে বাবা-মাকে বললাম। বাবা আমাকে এ কাজে উৎসাহ না দিলেও প্রবল আপত্তি করলেন না। কিন্তু সমস্যা বাঁধালেন আমার গর্ভধারিনী–আমার মা। আমার সমুদ্র-অভিযানের কথা শুনেই তিনি যে কাঁদতে বসলেন সারারাত তার আর কান্না থামল না।
আমার বাবা-মা ছাড়া আরও একজন আমার সমুদ্র-অভিযানের পথে বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি হচ্ছেন আমার অতি বৃদ্ধ দাদা। তার কাছ থেকে আমার। প্রত্যাশা অনেক-অনেক কিছুই তাঁর কাছ থেকে পাব বলে আমি আশা রাখি।
আমার দাদা আমার মুখ থেকে সমুদ্র-অভিযানের প্রস্তাবটা শোনামাত্র রেগে মেগে একেবারে আগুন হয়ে গেলেন। কাঁপতে কাঁপতে তিনি বললেন আমার সাফ কথা, শুনে রাখ, ভবিষ্যতে আর কোনোদিন যদি এমন কথা তোমার মুখে শুনি তবে একটিমাত্র শিলিং তোমার হাতে গুঁজে দিয়ে বাড়ির দরজার বাইরে দিয়ে আসব। কথাটা বলেই তিনি গুম হয়ে বসে রইলেন।
চারদিক থেকে এমন সব আপত্তিকর ঘটনা ও কঠিন-কঠোর কথা আমাকে আমার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও সরাতে পারল না। বরং আমার আগ্রহ আর জেদ হাজারগুণ বেড়েই গেল। আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, বাধা যত কঠিন রূপ নিয়ে আমার আগলে দাঁড়াক না কেন, তোয়াক্কা না করে আমি সমুদ্র অভিযানে যাবই যাব। পৃথিবীতে এখন কোনো শক্তি নেই যা আমাকে এ-পথ থেকে ফেরাতে পারে।
আমার চুড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা অগাস্টাসকে জানালাম। আমার দিক থেকে সম্মতি পেয়েই সে জোর কদমে যাত্রার প্রস্তুতি নিতে মেতে গেল।
আমি ব্যাপারটা নিয়ে মাতামাতি না করে নিজেকে সাধ্যমত সংযত রাখলাম। আমার পরিকল্পনার কথা আত্মীয়-পরিজনের কাছে গোপন রেখে আমি আগের মতোই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলাম। পড়াশোনায় আমার আগ্রহ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে সবাই যাতে মনে করে সমুদ্র-অভিযানের ব্যাপারটাকে আমি মন থেকে মুছে ফেলেছি, এতে আমার আর কোনো ইচ্ছাই নেই।
এদিকে, বন্ধুবর অগাস্টাস, গ্রামপাস’ জাহাজেই সারাটা দিন পড়ে রইল।
অগাস্টাস সারাটা দিন ধরে জাহাজে থেকে কেবিন ও তার লাগোয়া খোলে আমার আর তার নিজের থাকার উপযুক্ত ব্যবস্থাদি সেরে ফেলে।
তবে সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকলেও প্রতি রাতে অগাস্টাস আর আমি মিলিত হয়ে আমাদের একমাত্র ভবিষ্যৎ কাজটার ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করি।
প্রস্তুতিপর্ব সারতে দেখতে দেখতে একটা মাস আমরা কাটিয়ে দিলাম। তবু কার্যকরী করার মতো কোনোরকম ফন্দি ফিকিরই আমাদের মাথায় এলো না।
মি. রস নামে আমার এক আত্মীয়নিউ ফোর্ডে বাস করেন। আমি একটু সময় সুযোগ পেলেই তাঁর কাছে চলে যাই। মাঝে-মধ্যে দু-তিন সপ্তাহও আমি তাঁর সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসি।
১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের জুনের মাঝামাঝি আমাদের জাহাজটা নোঙর তুলবে বলে করা হল।
আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা ছিল, জাহাজটা নোঙর তোলার দু-একদিন আগে মি. রস আমার বাবাকে একটি চিঠি দেবেন। তিনি চিঠিতে বাবাকে অনুরোধ জানাবেন, যে পক্ষ কালের জন্য তিনি যেন আমাকে তার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেন। আমি উক্ত দিনগুলো তার বাড়িতে কাটিয়ে এলে তিনি যারপরনাই খুশি হবেন। কারণ, তার-ই ছেলে এমেট আর রবার্টের বহুদিনের ইচ্ছা আমাকে নিয়ে কিছুদিন আনন্দ-ফুর্তিতে মেতে থাকে। মতলবটা চমৎকারই বটে।
আর আলোচনার মাধ্যমে এও স্থির হয়ে গেল, চিঠিটা লেখা আর সেটা আমার বাবার হাতে পৌঁছে দেবে বন্ধুবর অগাস্টাস। সে স্বেচ্ছায়ই এ গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়েছে।
অগাস্টাসের সঙ্গে এ-কথাও পাকা হয়ে গেল।নিউ বেডফোর্ডে যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েই আমি তাকে খবর দেব। সে আগেভাগেই গ্রাসপাস-এই আমার আত্মগোপন করে থাকার উপযোগি একটা ভালো জায়গা ঠিক করে রাখবে।
জাহাজটা নোঙর তুলে গভীর সমুদ্রের দিকে বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দেবার পর সেখানে থেকে আমাকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তারপর পাড়ি দেবার সময় পথে এমন বহু জাহাজের দেখা মিলবে যাদের মারফৎ আমার বাবাকে অভিযানটির কথা জানিয়ে দিলেই চলবে।
শেষপর্যন্ত জুনের মাঝামাঝি আমাদের নির্ধারিত সেই বিশেষ দিনটা চলে এলো। এদিকে আমাদের পরিকল্পনামাফিক যাবতীয় কাজকর্মও সেরে ফেলা হয়েছে। বাবার কাছে চিঠি লেখার কাজ ও পৌঁছে দেবার ব্যবস্থাদিও মিটিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এক সোমবার সকালে আমি পূর্ব নির্ধারিত নিউ বেডফোর্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। তবে জাহাজঘাটা বা অন্য কোনোখানে না গিয়ে আমি সরাসরি বন্ধু অগাস্টাসের বাড়ির পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। এ রকমই কথা ছিল। তার বাড়ি পর্যন্ত যেতে হলো না। পথের মোড়েই তার দেখা পেয়ে গেলাম। আমার অপেক্ষায়ই। সে দাঁড়িয়ে ছিল।
অগাস্টাস আমাকে নিয়ে জাহাজঘাটার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। আমার আপাদমস্তক আলখাল্লা দিয়ে ঢেকে নিয়েছি যাতে পথচারী কেউ আমাকে চিনে না ফেলে।
প্রথম মোড়টানির্বিঘ্নে পেরিয়ে দ্বিতীয় মোড়টায় পৌঁছাতেই আমাকে থমকে যেতে হল। দেখলাম, এক বৃদ্ধ আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে। পুরু কাঁচের চশমার ফাঁক দিয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি আমাকে নিরীক্ষণ করে চলেছেন। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি অন্য কেউ নন, আমার ঠাকুরদা মি. প্যাটারসন।
আমার মুখের দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে কিছু সময় নীরবে তাকিয়ে থাকার পর এক সময় তিনি ম্লান হেসে বললেন–আরে, কী অবাক কাণ্ড, গর্ডন তুমি!
আমি নীরবে ম্লান হাসলাম।
এ কী করেছ গর্ডন, কার একটা ছেঁড়া-নোংরা ওভারকোট গায়ে চাপিয়েছ বলো
আমি তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে কি বলব, কি বলে ব্যাপারটিকে সামাল দেব, ভাবতে লাগলাম।
ঠাকুরদা কিন্তু থেমে নেই। বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে আমায় আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিয়ে পূর্বস্বর অনুসরণ করেই এবার বললেন ‘বলিহারী তোমার রুচি গর্ডন! নইলে এমন বস্তাপচা একটা ওভারকোট কেউ যে গায়ে চাপাতে পারে, বিশ্বাসই করা যায় না। ছিঃ। ছিঃ। বলিহারী তোমার রুচি, গর্ডন।
আমি দেখলাম, আর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলে নির্ঘাৎ ফেঁসে যেতে হবে। তাই ভেবে চিন্তে বেশ যুতসই একটা জবাব দিলাম–
‘গর্ডন? কাকে আপনার গর্ডন বলছেন ভাই।’
‘তুমি বলছ, তোমার নাম গর্ডন নয়?
‘না, অবশ্যই না। এমনকি গর্ডন নামে কাউকে আমি চিনি না, কোনোদিন চিনতাম বলেও মনে পড়ছে না।
‘তুমি–তুমি
তাঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি আবার বলতে শুরু করলাম–‘ তা ছাড়া আমিও আপনাকে চিনি না, কোনোদিন তো দেখিওনি।
ঠাকুরদা ধবধবে সাদা গোঁফের ফাঁক দিয়ে ফিক ফিক করে হেসে উঠলেন।
আমি বলেই চললাম–আপনার সৌজন্যবোধের তারিফ না করে পারছি না ভাই। যাকে আপনি চেনেন না, তার পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে কথা বলা সমালোচনা করা কোনদেশি ভদ্রতা ভেবে পাচ্ছি না।’
আমার মুখে মধুর অকাট্য, যুক্তিটা শোনামাত্র ঠাকুরদা হঠাৎ আরও ভড়কে গেলেন।
তাঁর মুখের আকস্মিক পরিবর্তনটুকু আমার নজর এড়াল না। সে দিকে চোখ পড়তেই আমি হাসি সামলাতে না পেরে হো-হো রবে হেসে উঠলাম।
পরিস্থিতি খারাপ বুঝে ঠাকুরদা পিছনের দিকে দুচার-পা চলে গেলেন।
প্রথমটায় তার মুখের রক্ত যেন নিঃশেষে উধাও হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই সম্পূর্ণ মুখটা একেবারে অবিশ্বাস্য রকম লাল হয়ে উঠল। পুরু কাঁচের চাঁদির চশমাটা চোখ থেকে খুলে বার কয়েক মুছে আবার যথাস্থানে রাখলেন। এবার আগের মতোই অন্যমনষ্কভাবে ছাতাটা খুলে মাথার উপর ধরে প্রায় ছুটতে আরম্ভ করলেন।
সামান্য এগিয়েই কি ভেবে তিনি আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। মুহূর্তের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। অনুচ্চকণ্ঠে প্রায় বিড় বিড় করতে করতে আবার হাঁটা জুড়লেন।
কথাগুলো অনুচ্চকণ্ঠে বললেও তার কথার মমার্থ উদ্ধার করতে আমার তেমন অসুবিধাই হলো না।
রীতিমত রাগতস্বরেই তিনি বলতে লাগলেন–‘আরে ধৎ। আর চালানো যাবে না। এবার চশমাটাকে বাতিল না করলে আর চলছে না। ছেলেটাকে গর্ডন ভেবেছিলাম। কী বে-ইজ্জত কাজ রে বাবা! না, আর চলবে না। এ চশমাটা বাতিল করে নতুন একটা না নিলে কিছুতেই চলবে না দেখছি।
আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাবলাম যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। ঠাকুরদার সাঁড়াশী আক্রমণের কবল থেকে কোনোরকমে ফস্কে যেতে পেরে আবার গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে হাঁটা জুড়লাম।
না, পথে আর নতুন করে কোনো হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে হলো না। আমি নির্বিঘ্নেই জায়গামত পৌঁছে গেলাম।
জাহাজে দু-একজন ছিল বটে তবে তারা সামনের দিকে কাজে মেতে ছিল।
ক্যাপ্টেন বানার্ডও জাহাজে অনুপস্থিত। লয়েড অ্যান্ড ভ্রেডেনবার্গ গেছেন। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। অতএব জাহাজ ফাঁকাই আছে। তাই অগাস্টাস আর আমি নিশ্চিন্তেই জাহাজে ঢুকে গেলাম। আমরা হাঁটতে হাঁটতে কেবিনে হাজির হলাম। কেবিনও ফাঁকা।
আমি গুটি গুটি কেবিনের ভেতরে ঢুকে গেলাম। অনুসন্ধিৎসু নজরে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে সোল্লাসে বলে উঠলাম–‘বাঃ চমৎকার, ব্যবস্থা! সব দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কেবিনটাকে যাবতীয় ব্যবস্থাদিসহ সাজিয়ে তোলা হয়েছে–
সত্যি বলতে কি তিমি শিকারের জাহাজের কেবিনে সাধারণত এমন আরামদায়ক ব্যবস্থাদি থাকে না। থাকলেও আমার অন্তত জানা নেই। কারো নজরে পড়ে যেতে পারি এরকম আশঙ্কায় কেবিনের ভেতরে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হলো না। ইচ্ছে করেই থাকলাম না।
কেবিনের অদূরবর্তী অগাস্টাসের ঘরের ভিতর দিয়ে গুপ্ত একটা দরজা দিয়ে গলিঘুপচি দিয়ে বারবার ডানদিক-বাঁদিকে বাঁক নিতে নিতে এমন একটা জায়গায় হাজির হলাম যেখান থেকে হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি না করে কারো হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। সেখানেই আমাকে আত্মগোপন করে থাকতে হবে।
জাহাজের ভেতরটা যতটুকু দেখার সুযোগ আমি পেয়েছি তাতে তো ভালোই মনে হল। আমার ছোট্ট ঘরটার মেঝেতে একটা মাদুর পেতে অত্যাবশ্যক বহু ছোট বড় সরঞ্জাম সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বই ও কাগজপত্র থেকে শুরু করে মদের বোতল পর্যন্ত সবই সেখানে দেখতে পেলাম।
ব্যস, আর চিন্তা-ভাবনা করতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে আমি কেবিনটার দখল নিয়ে নিলাম। খুশিতে মন-প্রাণ কানায় কানায় ভরপুর। হয়তো বা কোনো রাজা বাদশা প্রথম তার প্রাসাদে ঢুকে আমার মতো খুশিতে এমন উচ্ছ্বসিত হয়নি।
অগাস্টাস কেবিনটা, আমাকে ছেড়ে যাবার সময় কথা দিয়ে গেল, মাঝে মাঝে এসে আমাকে দেখে যাবে। এ পর্যন্ত যা-কিছু ঘটল সেটা ছিল সতেরই জুন।
সেদিনের স্মৃতি যা-কিছু আজও আমার মনে আছে তার ওপর নির্ভর করে বলছি, ওই গুপ্ত স্থানে, ছোট্ট ঘরটায় আমাকে তিন দিন তিন রাত বন্দিদশার মধ্যে কাটাতে হয়েছিল।
উপরোক্ত তিন তিনটি দিন আমি অগাস্টাসের হদিস পাইনি। চতুর্থদিন সকালে কিছুটা মানসিক অস্থিরতার মধ্যে সময় কাটাচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ দরজার বাইরে
অগাস্টাসের গলা শুনতে পেলাম।
অগাস্টাস পা টিপে টিপে ধীর-মন্থর গতিতে আমার ঘরে ঢুকল।
সে সাধ্যমত আমার কানের কাছাকাছি মুখ নিয়ে অনুচ্চকণ্ঠে বলল–সব ঠিক আছে তো?
আমি সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম–‘হুম!’
‘এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
‘অসুবিধা, আরে ধুৎ! অসুবিধা কীসের? দিব্যি–একেবারে তোফা আছি।
সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
আমি আগের মতোই ফিসফিসিয়ে বললাম–জাহাজটা কখন ছাড়বে, বল তো?
‘আধ ঘণ্টার মধ্যেই।
‘শোন, আরও তিন-চারদিন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না। ভেব না। মিছে ভেবে অস্থির হয়ো না। ওপরের যা-কিছু কাজকর্ম সবই ঠিক আছে, পরিকল্পনা অনুযায়ীই চলছে। শুনে রাখ, আজ বিশে জুন। মাত্র তিন দিন তুমি এ কামরাটায় কাটিয়েছে।
‘হ্যাঁ, আমার হিসেবের সঙ্গে তোমার বক্তব্য মিলে যাচ্ছে।’
‘তবে এখন বিদায় নিচ্ছি, কি বল? আমি মুচকি হেসে ঘাড় কাৎ করে তার কথার জবাব দিলাম।
আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে সন্তর্পনে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
অগাস্টাস আমার কামরা থেকে বেরিয়ে যাবার প্রায় ঘণ্টখানেক বাদে লক্ষ্য করলাম জাহাজটা আচমকা দোল খেতে শুরু করেছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না। আমাদের সাধের জলযানটা বন্দর ছেড়ে চলতে শুরু করেছে।
শেষপর্যন্ত বহু আকাঙ্ক্ষিত সমুদ্রযাত্রা শুরু হওয়াতে আমার মন-প্রাণ চনম নিয়ে উঠল। সে যে কী আনন্দ তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।
আপন মনে বলে উঠলাম–‘যতদিন একটা সুসজ্জিত ও আরামদায়ক কেবিনে জায়গা না পাই ততদিন এখানে, এ ছোট্ট কামরাটাতেই কাটিয়ে দেব,
ক্লার্ক আর লুইস-এর লেখা কলম্বিয়ার মোহনা অভিযান বিষয়ক বইটা বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরলাম। বেশি দূর এগোতে পারলাম না। মাত্র কয়েক পাতা পড়তে না পড়তেই ঘুমে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। বইটা বন্ধ করে শিয়রে রেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙতেই হুড়মুড় করে উঠে বিছানায় ওপর বসে পড়লাম। আমার যেন মনে সবকিছু কেমন এলোমেলো, গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
অস্বীকার করব না, বন্ধু অগাস্টাসের উপর খুব রাগ হতে লাগল। তবে অচিরেই একটু একটু করে মনের বিষণ্ণতা কেটে যেতে লাগল।
হাতে-পায়ে কেমন যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলাম। আসলে এতটুকু একটা খাঁচার মতো ঘরে দিনের পর দিন অলসভাবে কাটাতে হচ্ছে। ভালোভাবে আয়েস করে শুয়ে বসে কাটানোর মতো যথেষ্ট জায়গা নেই।
আড়মোড়া ভেঙে শরীরটাকে একটু চাঙা করে নিলাম। পেটে ঠিক জ্বালা না করলেও কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না, ক্ষিদে পেয়েছে। মাংসের বাটিটা টেনে কাছে নিয়ে এলাম। প্রায় বরফের মতো ঠাণ্ডা মাংস।
সে বাটিটাকে নাকের কাছে ধরতেই নিঃসন্দেহ হলাম, পচে গেছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার! আমি তবে কতক্ষণ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি! এত বেশি সময় ঘুমিয়ে কাটিয়েছি যে বাটির মাংস পর্যন্ত পচে গেছে!
মাথাটা কেমন ভারী-ভারী মনে হতে লাগল। চিনচিন ব্যথা করছে। উপায়ান্তর না দেখে আবার শুয়েই পড়লাম। চোখ দুটো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এলো।
এক-দুই-তিন করে আরও চব্বিশটা ঘণ্টা কেটে গেল। কারো টিকির দেখাও পেলাম না। অগাস্টাসের ওপর খুবই রাগ হতে লাগল। আর যা-ই হোক, না কেন, তার তো অবশ্যই একটিবার আমার খোঁজ-খবর নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।
গোদের ওপর বিষফোঁড়া। বিপদ কখনও একা আসে না। পাত্রের পানিও ফুরিয়ে গেছে। তেষ্টায় ছাতি ফাটলেও এক ফোঁটা পানি পাওয়া যাবে না পিতৃদত্ত জীবনটাকে রাখার জন্য।
সত্যি, খুবই তৃষ্ণা পেয়েছে। খুবই অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। এত ঘুমানো সত্ত্বেও কেমন ঘুম ঘুম পেতে লাগল। কিন্তু এ গুমোট কামরাটায় আর ঘুমোতেও ভরসা হলো না। দম বন্ধ হয়ে পরপারের যাত্রী হওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।
এক সময় লক্ষ্য করলাম, জাহাজ অস্বাভাবিক দুলতে শুরু করেছে, বুঝতে অসুবিধা হলো না, জাহাজটা সমুদ্রের অনেক ভেতরে চলে এসেছে।
দূর থেকে অস্পষ্ট গর্জন ভেসে আসতে লাগল। বুঝলাম, প্রবল ঝড় আসছে। মুহূর্তের মধ্যে জাহাজটা অস্বাভাবিক দুলতে শুরু করেছে নির্ঘাৎ ঝড়ের দাপট শুরু হয়েছে।
তবে তো অন্ধকার খুপড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে ডেকে যাবার সময় হয়ে এসেছে। ঢেউ আর ঝড়ের কবলে জাহাজটা কেমন করে বে-সামাল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে চলেছে তা দেখার অপূর্ব সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হচ্ছি। ডেকে দাঁড়িয়ে ভয়ঙ্কর এ পরিস্থিতিটা চাক্ষুষ করতে পারলে কী যে মজা পেতাম তা ভেবেই আমার মন চঞ্চল হয়ে পড়ল।
কিন্তু কী সমস্যায় পড়া গেল! অগাস্টাসের তো দেখাই পাচ্ছি না। তবে? তবে কি বন্ধু কোনো বিপদে পড়েছে? কোনো আকস্মিক কারণে তার মৃত্যু ঘটেনি তো? কোনোক্রমে পা হড়কে জাহাজ থেকে পড়ে যায়নি তো!
বিপদের কাঁধে চেপে বিপদ এসে আমার সামনে দাঁড়াচ্ছে। ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন দেখায় আমার মন প্রাণ যারপরনাই বিষিয়ে উঠল। ভয়ঙ্কর হিংস্র দৈত্যরা অতিকায় সব বালিশ দিয়ে আমাকে জোর করে ঠেসে ধরেছে। আমাকে শেষ করে দেবার ধান্দায় আছে।
অতিকায় সব সাপ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দম বন্ধ করে খতম করে দিতে চাইছে। তারা রক্তচক্ষু আর হিংস্র দৃষ্টি মেলে আমার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে। সামনে দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমির মধ্যে আমি একা অবস্থান করছি। যতদূর নজর চলে দেখা যাচ্ছে ডালাপালা আর পাতাহীন মৃতপ্রায় গাছগুলো মানুষের কঙ্কালের মতো অস্থিসর্বস্ব দুর্বল হাত দুটো বাড়িয়ে আমার কাছে পানি ভিক্ষা করছে। পানি! শুধুমাত্র একটু পানি।
মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যান্তর ঘটে গেল। আমি যেন সাহারার প্রজ্বলিত মরুভূমির কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছি। একা–একদম একা আর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। অতিকায় একটা হিংস্র সিংহ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমার পায়ের কাছে শুয়ে রয়েছে। আচমকা ইয়া বড় বড় চোখ মেলে ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকাল। বিশ্রি স্বরে খেঁকিয়ে উঠল। সে ভয়ঙ্কর হুঙ্কার দিয়ে ঝট্ করে উঠে দাঁড়ানো মাত্র ভয়ে আমি আছাড় খেয়ে পড়ে গেলাম।
জমাটবাধা আতঙ্কটুকু কেটে যাওয়ামাত্র আমি নিঃসন্দেহ হলাম, আমি জেগে উঠেছি। এ বিষয়ে আর সন্দেহ রইল না, এতক্ষণ স্বপ্নের ঘোরে যা দেখেছি, যা ভেবেছি, শতকরা একশো ভাগই স্বপ্ন নয়–কিছু না কিছুতেই বাস্তবের ছোঁয়া তো আছেই আছে। ভয়ঙ্কর একটা সত্যিকারের থাবা আমার বুকটাকে সজোরে চেপে ধরেছে। আর ক্রমেই আমার ওপর বল প্রয়োগ করে চলেছে। আর আমার কানে আগুনের মতো গরম নিশ্বাস স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি। আমার সর্বাঙ্গে থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। সেই সঙ্গে আবছা অন্ধকারে দুধের মতো সাদা দাঁতগুলো অস্বাভাবিক চকচক করছে। আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে উঠার উপক্রম। স্নায়ুগুলো যেন ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়তে লাগল। আমি যে কী দুঃসহ মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে অসহায়ভাবে কাত্রাতে লাগলাম তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।
সে মুহূর্তে এক-আধজন নয়, হাজার মানুষের জীবনীশক্তি যদি আমার হাত-পা আর জিভে আশ্রয়নিত তবুও আমার পক্ষে সামান্যতম নড়াচড়া করাও সম্ভব হত না। আমি নিতান্তই অসহায়।
আসলে কিন্তু সিংহটা যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবেই আমার পায়ের কাছে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। আমাকে খতম করে দেবার মতো কোনো মতলবই তার মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এটা বুঝেও আমি আত্মরক্ষা–পালাবার চেষ্টা না করেই অসহায়ভাবে এলিয়ে পড়েই রয়েছি। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য অধীর অপেক্ষায় প্রতিটা মুহূর্ত কাটাচ্ছি।
আমার কেবলই মনে হতে লাগল, আমি মরতে চলেছি। মৃত্যু অবধারিত। শরীর ও মন থেকে শক্তি ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। অচিরেই আমি সম্পূর্ণরূপে শক্তিহীন হয়ে পড়ব। ব্যস, তখনই আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, মৃত্যু আমার শিয়রে মোতায়েন। কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা। নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে আমাকে কেউ অব্যাহতি দিতে পারবে না। কে-ই আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে ছিনিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করবে? ধারে কাছে এমন কেউ নেই যে–
হায় ঈশ্বর! আমি আর ভাবতে পারছি না। একী সর্বনাশা কাণ্ড ঘটতে চলেছে! এমন অসহায় অবস্থায় পড়ে আমাকে কাত্রাতে হবে আমি মুহূর্তের জন্য স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
মাথার ভেতরে কেমন যেন অবর্ণনীয় একটা যন্ত্রণা আমি অনুভব করতে লাগলাম। ঠিক সে মুহূর্তেই আচমকা মাথাটা পাক মেরে উঠল, দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। চোখের মণি দুটোও ঘোলাটে–বিবর্ণ হয়ে আসছে। শরীরের সর্বশক্তি নিয়োগ করে শেষ বারের মতো পরমপিতাকে ডাকলাম। মোদ্দা ব্যাপার হচ্ছে, আমি পৌনে। মরা হয়ে নিতান্ত অসহায়ভাবে হাত-পা ছড়িয়ে আগের মতো এলিয়ে পড়ে রইলাম।
আমার প্রায় অস্ফুট কণ্ঠস্বর–গোঙানি যেন পায়ের কাছে শুয়ে-থাকা হিংস্র পশুটার জিঘাংসাকে অকস্মাৎ চাঙা করে তুলল। সে গা-ঝাড়া দিল। তারপর পা চারটি ছড়িয়ে দিয়ে আমার ওপর শুয়ে পড়ল।
অবাক কাণ্ড! একের পর এক অবাক কাণ্ড ঘটে চলেছে। অবিশ্বাস্য কাণ্ডটা দেখে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। বুকের ভেতরে রীতিমত ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। হিংস্র জানোয়ারটা কেমন বিশি বুক-কাঁপানো করুণ স্বরে ঘোঁৎ-ঘোৎ করতে করতে ইয়া লম্বা লকলকে জিভ বের করে আমার মুখ আর হাত দুটো অনবরত চাটতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে আমার বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা আতঙ্কটুকু একটু একটু করে উবে যেতে লাগল। মনে হলো জানোয়ারটা যেন জিভ দিয়ে চেটে চেটে আমাকে সোহাগ করছে–বুকের স্নেহনিঙড়ে দিচ্ছে। অনাস্বাদিত এক আনন্দানুভূতিতে আমার মন-প্রাণ ভরে উঠল।
আমি বিস্মৃত, বিমূঢ় আর কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়লাম। বুদ্ধি বিবেচনা হারিয়ে বসলে মানুষের যে দশা হয় আমিও যেন ঠিক তেমনটিই হয়ে গেলাম। তবে এও তো সত্য যে, আমার প্রিয় কুকুর বাঘার ঘোঘোৎ শব্দটা যে আমার কানে লেগে রয়েছে, ভুলতে পারি না, পারিও নি কোনোদিন। আর সে যেমন আহ্লাদ গদগদ হয়ে আমার কাছ থেকে আদর পাবার জন্য চঞ্চল হয়ে পড়ে তখন কিভাবে আদর সোহাগ দিয়ে তাকে তুষ্ট করতে হয় তা তো আমার ভালোই জানা আছে।
হ্যাঁ, আমার অনুমান অভ্রান্ত। এ তো সিংহ বা বাঘ কিছুই নয়, আমার প্রিয় বাঘাই তো বটে।
আচমকা আমার মাথায় যেন খুন চেপে গেল। আমি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। মুক্তি আর পুনরুজ্জীবনের অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে যারপরনাই অস্থির করে তুলল। আমি পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম।
আমি যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে উঠে বসে পড়লাম। আমার পরম বিশ্বস্ত এবং অভিন্ন হৃদয় বন্ধু বাঘার গলাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম। আবেগ উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে বুকের সঙ্গে একেবারে মিশিয়ে দিলাম। অভাবনীয় অসহনীয় যন্ত্রণাটাকে চোখের জলে নিঃশেষে ধুয়ে মুছে ফেললাম। বুকটা যেন শোলার মতো হালকা হয়ে গেল। কী যে অব্যক্ত এক শান্তি-স্বস্তি আমার মধ্যে ভর করল তা ভাষায় ব্যাখ্যা করার সাধ্য আমার নেই।
ব্যাপারটা আমাকে খুবই ভাবিয়ে তুলল। বহু ভাবনা চিন্তার দিয়েও আমি সেটার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারলাম না। ব্যাপারটা হচ্ছে, উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্র পেরিয়ে, জাহাজের কর্মীদের চোখে ধূলো দিয়ে বাঘা আমার অন্ধকার খুপড়িটায় কি করে এলো!
আরে ধৎ! কী সব আবোল তাবোল ভেবে আমি অস্থির হচ্ছি। চুলোয় যাক সে ভাবনা চিন্তা। আমার প্রাণের দোসর বাঘাকে যে কাছে পেয়েছি এটাই তো যথেষ্ট। শুধু কি এই? আর সে সঙ্গে তার যে আন্তরিকতা-সেবাযত্নের আশ্বাস পেয়েছি এটাই কি উপরি এ অসহায় পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে পাওয়া নয়? কুকুর তো অনেকেই পোষে; কুকুরকে ভালোবাসে কম নয়। কিন্তু বাঘার ওপর আমার আকর্ষণ অন্য দশজন কুকুরের মালিকের তুলনায় অনেক, অনেক বেশি। তবে এও অস্বীকার করতে পারব না, বাঘা তার যোগ্যতা অনুযায়ীই প্রাপ্য স্নেহ ভালোবাসা পাচ্ছে। অর্থাৎ আমি মোটেই অপাত্রে ভালোবাসা দান করছি না।
বাঘা সাত-সাতটা বছর ধরে আমার কাছে রয়েছে–মাঝে আমরা উভয়ে কাছাকাছি পাশাপাশি অবস্থান করেছি।
অস্বীকার করতে পারব না, একটা কুকুরের মধ্যে যে যে গুণ থাকা দরকার বাঘার মধ্যে তাদের কোনোটারই ঘাটতি নেই। আর তার বহু প্রমাণ বাঘার কাছ থেকে পাওয়া গেছে। সত্যিকারের প্রভুভক্ত বলতে যা বোঝায় বাঘাকে ঠিক অনায়াসেই সেই দলে ফেলা চলে।
ন্যান্টাকেটের এক নচ্ছারের কাছ থেকে আমি কৌশলে বাঘাকে বাগিয়ে নিয়েছিলাম।
আমার কাছে আসার পর তিনটা বছর পেরোতে না পেরোতেই বাঘা আমাকে দুর্ধর্ষ এক ডাকাতের লাঠির আঘাত থেকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। নইলে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আমার ছিল না। আর এভাবেই বাঘা নিজেকে ঋণমুক্ত করেছিল, কোনো ভুল নেই।
আমিনিস্পলক চোখে, সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে প্রিয় কুকুর বাঘার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ছোট্ট কামরাটার মৃদু আলোয় অসময়ের হিতাকাঙ্খীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। সেও-ও আমার দিকে বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। আমরা কেউ, কাউকে চিনতে এতটুকুও ভুল করিনি।
তার সর্বাঙ্গে মমতা-মাখানো দৃষ্টি বুলোতে বুলোতে একসময় আচমকা থমকে গেলাম। তার পেটের কাছে আমার দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল। দেখলাম, তার পেটের লোমের সঙ্গে সুতো দিয়ে একটা ছোট্ট বস্তু জড়িয়ে রাখা হয়েছে। কাৎ হয়ে, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সে দিকে তাকানোমাত্র বুঝতে পারলাম মুড়িয়ে বেঁধে দেওয়া একটা কাগজের টুকরো। কিন্তু কীসের কাগজ ওটা? কিছু লেখা আছে কি? অহেতুক তো ওটাকে এত যত্ন করে ওখানে বেঁধে দেয়নি। কাগজটার গায়ে কিছু না কিছু লেখা তো অবশ্যই আছে। কিন্তু কি লেখা? কে-ই বা কাজটা করেছে?
.
০৩. ॥ তৃতীয় অধ্যায় ॥
বাঘার পেটের সঙ্গে বেঁধে-দেওয়া কাগজটা আমাকে বড়ই ভাবনায় ফেলে দিল। তবে? তবে কি এটা আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু অগাস্টাসের কাজ? সে-ই কোনো-না-কোনো নির্দেশ লিখে বাঘা মারফৎ আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে?
কাজটা যদি অগাস্টাসের দ্বারাই হয়ে থাকে তবে সে নিজে না এসে এ পথ ধরল কেন? সে নিজে আমার কাছে এসে যা-কিছু বক্তব্য খোলসা করে আমাকে বলবে,
এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু তা না করে সে এ পথ বেছে নিতে গেল কেন?
না, ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে বেশিক্ষণ মাথা ঘামাতে হলো না। নিজেই একটা সম্ভাব্য যুক্তি বের করে ফেললাম, হয়তো অজ্ঞাত কোনো দুর্ঘটনার জন্য তার পক্ষে আমার কাছে আসা সম্ভব হয়নি। অথচ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা একান্ত দরকার হয়ে পড়ে। তাই অনন্যেপায় হয়েই তাকে বাঘার সাহায্য নিতেই হয়েছে। আমাকে। অন্ধকার এ কারাগার থেকে বের কওে নিয়ে যেতে না পেরে প্রকৃত ঘটনাটার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অগাস্টাস বাঘা মারফৎ সে বার্তাই আমার কাছে পাঠাক না কেন তা কি করে পড়া সম্ভব? ঘরটা এতই অন্ধকার যে, নিজের খাতাটাকেও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না। আলোর ব্যবস্থা একটা বাতি অবশ্য আছে। কিন্তু সেটাকে। ধরানোর ঝামেলা অনেক।
তবে কামরাটার ওপরের দিককার ফাঁক ফোকর দিয়ে একটু-আধটু আলো আসছে বটে। ব্যস, আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে বাঘার পেটের কাছ থেকে কাগজের চিলতেটা হেঁচকাটান মেরে হাতে নিয়ে নিলাম।
এবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে কাগজের চিলতেটাকে উঁচু করে আলোর রেখাটার সামনে মেলে ধরলাম। প্রথম দিকটায় কেবলমাত্র এটুকুই বুঝতে পারলাম, কাগজটার রঙ সাদা। ব্যস, এটুকুই। তার গায়ে কি লেখা আছে কিছুই উদ্ধার করতে পারলাম না। সত্যি কথা বলতে কি, আদৌ কিছু লেখা আছে কিনা সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম না।
আমি রীতিমতো হকচকিয়ে গেলাম। কাগজটা হাতে রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে বার-কয়েক ঘষাঘষি করতেই সাদা কাগজের ওপর লম্বা কালি দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা কয়েকটা ছত্র আমার চোখের সামনে ফুটে উঠল।
কিন্তু কি লেখা আছে তা উদ্ধার করার আগেই ক্ষীণ আলোর রেখাটা আচমকা সরে গেল। ভাবলাম, একী ভৌতিক কাণ্ডরে বাবা! হায়! একী সমস্যায় পড়া গেল। এমন অত্যুগ্র আগ্রহ আর ব্যস্ততাতেও চিঠিটা ভালো করে পড়া সম্ভব হলো না। তবে ভাগ্য ভালো যে, শেষের কয়েকটা ছত্র কোনোরকমে পড়তে পেরেছি।
আমি ছত্র কয়টার মধ্য থেকে যেটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি তা হচ্ছে–‘রক্ত। কাছাকাছি কোথাও শুয়ে থাকার ওপর তোমার বেঁচে থাকা নির্ভর করছে।’ ব্যস, এর বেশি একটা বর্ণও পড়া সম্ভব হয়নি।
না, বন্ধুবর অগাস্টাসের সতর্কবাণীটার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারলাম না। অবশ্য সম্পূর্ণ লেখাটা পড়তে পারলে হয়তো তার বক্তব্য বুঝতে পারতাম। কিন্তু তা-তো হলই না বরং অজ্ঞাত বিপদাশঙ্কায় মন-প্রাণ অস্থির হয়ে উঠল। আমাকে সবচেয়ে বেশি করে ভাবিয়ে তুলল ওই ‘রক্ত’ শব্দটা।
রক্ত! রক্ত শব্দটার সঙ্গে রহস্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আর এটা চিরকালই মানুষকে আতঙ্কের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে। আমিও ভেতরে ভেতরে কম অন্তহীন অস্থিরতা আর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লাম না।
এমন একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কি যে করণীয় কিছুতে ভেবে উঠতে পারলাম না। সম্ভাব্য ও অজ্ঞাত হাজারো বিপদের আশঙ্কা আমার মাথায় চক্কর মারতে লাগল। আর আকস্মিক ভয়-ভীতিতে শরীর ও মন অবশ হয়ে পড়ল। অভাবনীয় অবসাদ আমাকে পেয়ে বসল। মানসিক অস্থিরতার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে না পেরে, উপায়ান্তর না দেখে শেষপর্যন্ত মাদুরটার ওপর শুয়েই পড়লাম। চোখ দুটো খুলে রাখতেও যেন ভরসা পাচ্ছি না। চোখের পাতা দুটো আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এলো।
কতক্ষণ যে আমি চোখ বুজে পড়েছিলাম, সঠিক বলতে পারব না। হঠাৎ কানের কাছে কীসের যেন কুৎ কুৎ শব্দ শুনতে পেলাম। সচকিত হয়ে চোখ মেলোম।
চোখ মেলতেই বাঘাকে দেখতে পেলাম। আমার শিয়রে, একেবারে মাথা ঘেঁষে সে দাঁড়িয়ে। অবর্ণনীয় একটা অস্থিরতা যেন তার মধ্যে ভর করেছে। তীব্র উত্তেজনা। উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরে অস্বাভাবিক ছটফট করছে আর ইয়া লম্বা জিভটা বের করে অনবরত হাঁপাচ্ছে। অন্ধকারে তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
বাঘাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর সোহাগ করার জন্য হাত বাড়ালাম। কিন্তু সে গলা দিয়ে কেমন একটা বিশ্রি ঘ ঘগ শব্দ করেই চুপ করে একেবারে নির্বাক নিস্পন্দভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
ব্যস, তারপর সে কি ঘটল তা আর আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আসলে কখন যে আমি আবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম বলতে পারব না। আর কতক্ষণই বা আমি সে অবস্থায় কাটিয়েছি তাও আমার জানা নেই।
আগের মতোই বাঘার সেই বিশ্রিরকম ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজে আমার তন্দ্রা কেটে গেল।
বাঘার মুখ থেকে বার বার একই রকম গোঙানি শোনার পর আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। আতঙ্কে বুকের ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।
একবার ভাবলাম, এই অন্ধকার ছোট্ট ঘরটায় দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা এবং পানীয় জলের অভাবে হয়তো তার মাথার দোষ দেখা দিয়েছে। নইলে এমনটা তো করার কথা নয়। আবার এও হতে পারে দম বন্ধ-হওয়া পরিবেশে দীর্ঘ সময় থাকার ফলে তার মনে এমন আকস্মিক এক ভীতির সঞ্চার হয়েছে যা সে কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না।
ব্যাপার যা-ই হোক, না কেন পরিস্থিতিটাকে কি করে যে আমি সামলে উঠব কিছুতেই ভেবে পেলাম না। কি যে আমার করণীয়, কে বলে দেবে?
বাঘাকে যে আমি মেরে ফেলব, এরকম চিন্তাও তো মাথায় আনতে পারছি না। কিন্তু নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবলে আমার এটাই প্রথম ও প্রধান কর্তব্য।
কিন্তু আমি নিঃসন্দেহ যে, আমার দিকে সে যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তাতে ভয়ঙ্কর একটা হিংস্র শুক্রতার আক্রোশ প্রকাশ পাচ্ছে। চরমতম শত্রুতা। যে কোনো মুহূর্তে তার ঝকঝকে ধারালো দাঁত আর থাবা নিয়ে তীব্র আক্রোশে আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।
বেশিক্ষণ এমন ভয়ঙ্কর একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির মোকাবিলা করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না।
অবর্ণনীয় মানসিক অস্থিরতার মধ্যেই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, যত কষ্ট স্বীকারই করতে হোক, যে কোনোভাবেই হোক খাঁচার মতো অন্ধকার খুপড়িটা থেকে আমাকে বেরোতেই হবে। প্রাণ যায় আর থাক আমি বাইরে বেরোবই বেরোব। একাজ করতে গিয়ে যদি বাঘাকে হত্যা করতেও হয় তাতেও দ্বিধা করব না।
এবার বেরোবার প্রস্তুতি নিতে লেগে গেলাম। নিরাপত্তার জন্য অগাস্টাস যে বাঁকানো তীক্ষ্ণ ছুরিটা দিয়ে গিয়েছিল সেটাকে কোমরে, প্যান্টের সঙ্গে গুঁজে নিলাম। আর কিছু শুয়োরের মাংস আর অবশিষ্ট মদটুকু সমেত বোতলটাকেও সঙ্গে নিতে ভুললাম না।
এবার তৎপরতার সঙ্গে ওভারকোটটা গায়ে জড়িয়ে নিজেকে যথাসম্ভব ঢেকে নিয়ে খাঁচার মতো খুপড়িটায় দরজার দিকে গুটিগুটি এগোতে লাগলাম।
আমি দুপা এগোতেই হতচ্ছাড়া কুকুরটা তীব্র আক্রোশে গর্জে উঠে আমার গলজা লক্ষ্য করে সজোরে এক লাফ দিল। আমাকে কর্তব্য স্থির করার সুযোগ না দিয়েই আচমকা এক লাফে আমার ডান কাঁধটায় চেপে বসল। আমি বে-সামাল হয়ে বাঁ দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। ক্রোধান্মত্ত কুকুরটা ফুঁসতে ফুঁসতে আমার উপর শুয়ে পড়ল। তার তর্জন গর্জন কিন্তু এতটুকুও কমল না।
ভাগ্য ভালো যে, আমার মাথাটা বিছানার ওপর এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা কম্বলের ভেতরে ঢুকে গেল। নইলে কি যে হত তা আর বলার নয়।
ভাগ্যের জোরেই হোক আর যে কোনো কারণেই সে যাত্রায় পিতৃদত্ত প্রাণটা কোনোক্রমে রক্ষা পেল।
প্রচণ্ড ক্রোধটিকে সামলাতে না পেরে বাঘা মুখের সামনে কম্বলটাকে সম্বল করে ঝকঝকে দাঁতগুলো দিয়ে কম্বলটাকে কামড়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিতে লাগল। মোটা ওভারকোট আর কম্বলের ভাজ ভেদ করে তার দাঁত আমার চামড়ার স্পর্শ করতে পারল না।
আমি তখন মৃতপ্রায় অবস্থায় কম্বল আর ওভারকোটটা জড়িয়ে একান্ত অসহায়ভাবে পড়ে কাঁপতে লাগলাম।
আমি এও বুঝতে পারলাম, ওভারকোট আর কম্বলটা আমাকে আর বেশিক্ষণ ক্রোধোন্মত্ত কুকুরটার হিংস্র দাঁত আর নখের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারবে না। অল্প সময়ের মধ্যেই সে আমাকে বে-কায়দায় ফেলে দেবে।
আমি যারপরনাই হতাশ হয়ে পড়লাম। নিদারুণ হতাশার জন্যই আমার মধ্যে নতুন অসুরের শক্তি আর আত্মরক্ষার প্রেরণা জোগাল। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এক ধাক্কা মেরে বাঘাকে হাত কয়েক দূরে ফেলে দিলাম।
বাঘার কবল থেকে নিজেকে কোনোরকমে মুক্ত করে তার গায়ে মোটা কম্বলটা চাপা দিয়ে দিলাম। এক লাফে দরজার কাছে চলে গেলাম।
বাঘা কম্বলের বাধা থেকে নিজেকে মুক্ত করার আগেই আমি ঝট করে দরজাটা খুলে বাইরে চলে গেলাম। সেটাকে আবার বন্ধ করে দিলাম।
শেষ সম্বল মাংসটুকু ফেলে আসতে হলেও ক্রোধোন্মত্ত কুকুরটার কামড়ের হাত থেকে কোনোরকমে নিজেকে বাঁচাতে পারলাম।
এখন খাবার মতো বস্তু বলতে সম্বল কেবলমাত্র বোতলের মদটুকুই রইল।
পেটের জ্বালা সইতে না পেরে বোতলটার শেষ ফোঁটাটা পর্যন্ত গলায় ঢেলে দিলাম।
হাতের খালি বোতলটা বিতৃষ্ণার সঙ্গে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ামাত্র সশব্দে বোতলটা ভেঙে গেল। ভাঙা টুকরোগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বোতল ভাঙার শব্দ মেলাতে না মেলাতেই হঠাৎ শুনতে পেলাম, কে যেন চাপা গলায় আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছে।
উকর্ণ হয়ে ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, আমার নাম ধরেই ডাকছে বটে। কিন্তু কণ্ঠস্বরটায় অভাবনীয় কাণ্ড ঘটায় আমি এতই অভিভূত হয়ে পড়লাম যে, সে ডাকের জবাবটাও দেওয়া সম্ভব হলো না। হয়তো বা এমনও হতে পারে সে মুহূর্তে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
তবে কি বন্ধু অগাস্টাসই আমাকে ডাকাডাকি করছে? তা যদি না হয়, তবে? কিন্তু জাহাজের অন্য কারো পক্ষে তো আমার নাম জানার কথা নয়। বিরাট ধান্দায় পড়ে গেলাম।
ব্যাপারটা আমাকে বড়ই ভাবিয়ে তুলল। আমার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে অগাস্টাস যদি ভাবে আমি মরে হেঁজে গেছি–তবে? তবে সে যদি আমার কাছে আসার চেষ্টা না করে, আমার খোঁজ না করে যদি ফিরে যায় তবে যে সর্বনাশের চূড়ান্ত হয়ে যাবে। এ আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে আমি শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষে নিঙড়ে একটামাত্র শব্দ উচ্চারণ করার জন্য আমি প্রাণান্ত প্রয়াস চালাতে লাগলাম।
হায়! আমার চেষ্টাই সার হল। কার্যত ফল কিছুই হলো না। আমার গলা দিয়ে কোনো স্বরই বেরিয়ে এলো না।
হঠাৎ সচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কান খাড়া করে ব্যাপারটা সম্বন্ধে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, কার যেন পায়ের শব্দ হচ্ছে। আশায় বুক বেঁধে কান খাড়া করেই রইলাম।
পায়ের শব্দটা ক্রমে কাছে–আরও কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে আবার পরমুহূর্তেই দূরে সরে গিয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল। সে মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা সে কেমন হয়ে পড়েছিল তা কারো কাছে ব্যক্ত করা কিছুতেই সম্ভব নয় আর তা জীবনে কোনোদিন মন থেকে মুছে ফেলাও সম্ভব নয়।
হ্যাঁ, আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। আমার বন্ধু, আমার একমাত্র আশা ভরসা বন্ধু অগাস্টাস আমাকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যাচ্ছে। যার কাছ থেকে অনেক, অনেক কিছু পাবার প্রত্যাশা আমি করেছিলাম সে আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছে।
বন্ধু অগাস্টাসের চলে যাওয়ার অর্থই হচ্ছে আমার অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু। একটু একটু করে নির্মম-নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাতে নিজেকে তুলে দেওয়া। উফ! কী মর্মান্তিক পরিস্থিতি আমার জন্য নীরবে অপেক্ষা করছে!
হায় ঈশ্বর! একটামাত্র শব্দ আমাকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা করতে পারে। বহু চেষ্টা করেও আমি কিছুতেই সে শব্দটা গলা থেকে বের করতে পারছি না। আমার জীভটা যেন অবিশ্বাস্য উপায়ে আড়ষ্ট হয়ে গিয়ে আমার কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে দিয়েছে।
এ যে কী শোচনীয়–কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তা মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও দশ হাজার গুণ তীব্র যন্ত্রণা যা আমার বুকটা খান খান করে দিতে লাগল। আমার দুর্বল শরীর অমন বেশিক্ষণ পরিস্থিতিটাকে বরদাস্ত করতে পারল না। আমি হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। যমদুত বুঝি শিয়রে হাজির। মাথার ভিতর ঝিম ঝিম করতে লাগল।
মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সময় অসর্তকতার জন্য আমার কোমর থেকে অগাস্টাসের দেওয়া বাঁকানো ছুরিটা মেঝেতে পড়ে গেল। আমি পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাটা ঘটে। ছুরিটা মেঝেতে পড়ে যাওয়ামাত্র সেটা খট করে আওয়াজ হওয়ামাত্র আমি উকীর্ণ হয়ে থাকি যদি সেটা অগাস্টাসের কানে কোনোক্রমে পৌঁছে গিয়ে থাকে।
ঈশ্বর মুখ তুলে তাকিয়েছেন। আকস্মিক খুশিতে আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় হতে লাগল।
আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে–‘আর্থার আর্থার।
প্রথমটায় ভাবলাম, আমার শোনার ভুল। দীর্ঘ আতঙ্কের জন্যই আমি এরকম বিভ্রান্তির শিকার হয়ে পড়েছি।
উৎকর্ণ হয়ে রইলাম। আবার–আবারও সে ডাক শুনতে পেলাম–‘আর্থার! আর্থার!’ এবার নিঃসন্দেহ হলাম। এটা কিছুতেই শোনার ভুল হতে পারে না। এ তো বন্ধুবর অগাস্টাসেরই কণ্ঠস্বর! তার কণ্ঠস্বর যে আমি পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কেউ যখন ডাকাডাকি করে ঠিক তেমনই শুনেছি।
আশা! আমার ভেতর থেকে হতাশার জমাটবাঁধা মেঘ কেটে যাওয়ায় অতর্কিতে তার স্থান দখল করে বসল আশা, আকাঙ্খ। আমি হৃত কণ্ঠস্বর ফিরে পেলাম। তা ছাড়া জাহাজের আর কারো পক্ষে তো আমার উপস্থিতি জেনে ফেলা সম্ভব হলেও নামটা তো কিছুতেই জানা সম্ভব নয়। তা ছাড়া যেদিন আমি জাহাজটায় প্রথম পা দিয়েছিলাম সেদিন তো অগাস্টাস ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির চিহ্নই নজরে পড়েনি। তাই সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হলাম, অগাস্টাসই আমার নাম ধরে ডাকছে।
আমি বাশক্তি ফিরে পেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় হলেও সাধ্যমত গলা চড়িয়ে সাড়া দিলাম–‘অগাস্টাস’! অগাস্টাস!
বিপরীত দিক থেকে চাপা গলায় জবাব এলো–‘চুপ! চুপ! ঈশ্বরের দোহাই! চুপ কর। আমি এখনই যাচ্ছি।
আমি তার কথামত চুপ করে গেলাম।
পর মুহূর্তেই তার পায়ের শব্দ আমার কানে এলো। আমি ঘাড় ঘোরাতে না ঘোরাতেই তার একটা হাত আলতো করে আমার কাঁধের ওপর পড়ল।
আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই একটা পানির বোতল সে আমার ঠোঁটে ধরল। কী যে পরম তৃপ্তিতে পানিটুকু পান করলাম তা আমার মতো কবরের অন্ধকার গহ্বর ছেড়ে তার জীবনের আলোর জগতে যে উঠে এসেছে সে ছাড়া কারোরই বোঝার কথা নয়। আঃ! পানিটুকু কী যে তৃপ্তিদান করল তা কি করে বুঝিয়ে বলব, ভেবে পাচ্ছি না।
আমি যেন নতুন করে জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করলাম। মরুভূমির তৃষ্ণা মুহূর্তের মধ্যেই মিটে গেল। আমার ঠোঁট থেকে পানির বোতলটা সরিয়ে নিয়ে অগাস্টাস তিন চারটি ঠাণ্ডা আলু এক এক করে আমার মুখে গুঁজে দিল। হাজার বছরের বুভুক্ষার মতো। আমি আলুগুলো উদরস্থ করলাম।
আমি যেন এবার ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। এবার বাস্তব জগৎ সম্বন্ধে ভাববার মতো মানসিকতা ফিরে পেলাম। তাকে বললাম–‘অগাস্টাস, তুমি এতদিন কোথায় বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলে, বল তো?
সে কেবল নীরবে ম্লান হাসল।
আমি ছাড়বার পাত্র নই। আবার কথাটা পাড়লাম–‘তোমার দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণ কি সবকিছু খোলসা করে বলে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত কর।’
সে এবার এক এক করে বলতে লাগল, আমার বিপদের দিনগুলোতে জাহাজে কি কি ঘটেছে। কোনোকিছু গোপন না করে সবকিছু সবিস্তারেই আমার কাছে ব্যক্ত করল।
.
০৪. ॥ চতুর্থ অধ্যায় ॥
অগাস্টাস আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটা নির্জন-নিরালা অথচ আলো-বাতাসযুক্ত স্থানে গেল। আমাকে তার মুখোমুখি বসাল। আমি ফুসফুস ভরে মুক্ত বাতাস গ্রহণ করলাম।
অগাস্টাস আমার কৌতূহলনিবৃত্ত করতে গিয়ে বলতে লাগল–নির্ধারিত দিনে ও সময়েই দুই মাস্তুলের জাহাজটা বন্দর ছাড়ার ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যেই সমুদ্রে পড়ল। আমার প্রিয় পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা অন্ধকার খুপরিটার ভেতরে আমি তিনদিন তিনরাত বন্দি ছিলাম।
তখন জাহাজের কর্মীরা এত ছুটোছুটি আর হৈ হট্টগোল করছিল যার ফলে অগাস্টাস আমার সঙ্গে দেখা করার ঝুঁকি নেয়নি। পাছে আমার উপস্থিতির কথা তারা জেনে ফেলে, সে জন্যই সে নিতান্ত অনিচ্ছায় হলেও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমার সংস্রব এড়িয়ে চলেছে।
একইরকমভাবে আর দুতিনটি দিন কাটার পর অগাস্টাস আমার সঙ্গে দেখা করতে উৎসাহি হল। সবার নজর এড়িয়ে, চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সে আমার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য গুটিগুটি নিচে নেমে এলো।
বন্ধু যখন আমার কুঠুরির দরজায় আসে আমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। সে গলা নামিয়ে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করল।
আমার দিক থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে অগাস্টাস কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। গলা ছেড়ে ডাকাডাকিও করতে ভরসা পাচ্ছে না, কেউ শুনে ফেলতে পারে। আবার দীর্ঘ সময় অদর্শনে ক্যাপ্টেন বার্নাড খোঁজাখুঁজি করতে পারেন।
এমন সময় আচমকা কেবিনের দিক থেকে অস্বাভাবিক গোলমাল ভেসে এলো। সে একলাফে খুপরিটা থেকে বেরিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে নিজের ঘরের দরজায় হাজির হল। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলতেই হঠাৎ একটা পিস্তল ঝলমল করে উঠল। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই অতর্কিতে পিছন থেকে একটা লোহার রড তার মাথায় পড়ল।
বিকট আর্তনাদ করে সে জাহাজের পাটাতনের ওপর লুটিয়ে পড়ল। মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।
কাঠের মতো শক্ত এক জোড়া হাত সজোরে তার গলাটা চেপে ধরল। আচমকা ঘাড় ঘোরাতেই তার নজরে পড়ল, তার বাবা পিঠমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় অদূরে, পাটাতনের ওপরে পড়ে রয়েছে। কপালে একটা গভীর ক্ষত। সেটা থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। মেঝের রক্ত দেখে বুঝল, একটু আগেও প্রচুর ঝরেছে।
তার বাবা নির্বাক নিস্তব্ধ–হাত পা ছড়িয়ে এলিয়ে পড়ে রয়েছে। সে বুঝে নিল, অচিরেই তার বাবার মৃত্যু ঘটবে।
ঘাঢ় ফেরাতেই তার নজরে পড়ল, জাহাজের প্রথম মেট চোখে মুখে চরম ঘৃণার ছাপ এঁকে তার দিকে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
মিনিট খানেক নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর লোকটি কোটের পকেটে হাতটা চালান করে দিয়ে একটা ক্ৰণোমিটার আর একটা বেশ বড়সড় টাকার থলে বের করে আনল।
একজননিগ্রো পাচকসহ জাহাজের সাতজন নাবিক কেবিন থেকে খুঁজে অনেকগুলো গাদাবন্দুক আর প্রচুর পরিমাণ বারুদ বের করে আনল।
তারপর তারা আমার বন্ধু অগাস্টাসকে ঝটপট আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। কাঁধে তুলে নিয়ে জনা তিনচার চলে গেল ডেকের উপরে। আর বাকীরা লম্বা লম্বা পায়ে গলুইয়ের দিকে এগিয়ে গেল। চার বিদ্রোহী নাবিক ঝকঝকে কুড়াল হাতে অপেক্ষা করছে।
প্রথম মেট গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন–নিচে যারা রয়েছ তাদের কানে কি আমার কথা যাচ্ছে। কোনোরকম হট্টগোল না করে সবাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওপরে উঠে এসো।
কয়েক মুহূর্ত কারো দেখা মিলল না। এক সময় এক ইংরেজ পা টিপে টিপে সতর্কতার সঙ্গে ওপরে উঠে এলো।
হতভাগা ইংরেজটা সবে জাহাজে পা দিয়েছে। কাতর স্বরে কান্নাকাটি করে সে বার বার প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগল।
কাতর প্রার্থনার জবাবে কপালের ওপর কুড়ালের ওপর কুড়ালের এক কোপ পেল। বেচারা একটা কথাও বলার সুযোগ পেল না। তার রক্তাপুত দেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। ক্ষতস্থানটা থেকে গলগল করে রক্ত ঝরতে লাগল।
আলকাতরার মতো কালোনিগ্রো পাচকটা ইয়া গাট্টাগোট্টা নিগ্রোটা রক্তাপ্লুত ইংরেজটাকে কাঁধে তুলে নিয়ে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
কুড়ালের আঘাতের রক্ত এবং মৃতদেহটা সমুদ্রে আছড়ে পড়ার শব্দটা শোনামাত্র অন্যান্য যারা নিচে অবস্থান করছে তার সক্রোধে সমস্বরে গর্জে উঠল।
তারা কোনোরকম ফো-ফা করার আগেই বাজখাই গলায় সতর্ক করে দেওয়া হল–‘যারা শীঘ্র ওপরে উঠে না আসবে তাদের তোপ মেরে উড়িয়ে দেওয়া হবে।
কথাটা কানে যেতেই সবাই প্রাণের মায়ায় পড়ি কি মরি করে সিঁড়ি-বেয়ে ওপরে উঠে এলো।
সে মুহূর্তে অন্তত মনে হলো জাহাজটা বুঝি অচিরেই বিদ্রোহীদের কজা থেকে মুক্ত হবে। কিন্তু এ ধারণা মুহূর্তে ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়ে গেল। মাত্র ছয়জন হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠামাত্ৰ ওপর থেকে সিঁড়ির দরজাটা দুম্ করে বন্ধ হয়ে গেল।
নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই সে ছয়জন আত্মসমর্পন করল।
অন্য যারা নিচে ছিল তারাও মেটের ডাকাডাকির কথা ভুলে গিয়ে ওপরে উঠে এলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই সবাই বেয়নেটের ঘায়ে রক্তাপুত অবস্থায় আবার নিচে পড়ে যেতে বাধ্য হল।
আগেই যে ছয়জন হুড়মুড় করে ওপরে উঠে এসেছিল তাদেরও বেয়নেট বুকে নিয়ে দুমদুম নিচেই পড়ে যেতে হল।
যে সব নাবিক বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মেলায়নি, বিদ্রোহ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিল তারা সংখ্যায় সাতাশজন। বিদ্রোহীরা তাদের কিছুতেই কজায় আনতে পারেনি।
এবার পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে নৃশংস হত্যালীলা শুরু হয়ে গেল। নিগ্রো পাচকটা পিঠমোড়া করে বাঁধা নাবিকগুলোর মাথায় কুড়াল দিয়ে একটা করে ঘা মারতে লাগল আর বাকিরা রক্তাপ্লুত দেহগুলোর ঠ্যাং ধরে সজোরে ছুঁড়ে সমুদ্রে ফেলতে লাগল।
একের পর এক লোক ঘায়েল করতে করতে বাইশজনকে কমানো হল।
এবার আমার বন্ধু অগাস্টাসকে পরপারে পাঠাতে বাকি। কিন্তু তার প্রতি বিদ্রোহীদের কেমন যেন একটু উদাসীনই দেখলাম। এমনও হতে পারে, তার দশা খুবই খারাপ, মৃতপ্রায় জ্ঞান করে বা দীর্ঘসময় নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নাবিকরা তাদের অমানবিক কাজ থেকে ক্ষান্ত হয়েছে।
যা-ই হোক, অগাস্টাসসহ চারজন নাবিক ভাগ্যগুণে তখনকার মতো প্রাণে বেঁচে গেল।
প্রথম মেট, এবার শুকিয়ে-আসা গলাটাকে ভিজিয়ে নেওয়ার জন্য সিঁড়ি-বেয়ে নিচে নেমে গেল। আর ঘাতক-বিদ্রোহীর দল লাফালাফি দাপাদাপিতে দিনের বাকি সময়টুকু মেতে রইল।
দিনের শেষে তাদের মধ্যে জল্পনা কল্পনা আর শেষমেশ জোর তর্কবিতর্ক শুরু করে দিল। বাকি পাঁচ বন্দির গতি কি করা হবে।
এখন গলা পর্যন্ত মদ গেলায়, মদের মধ্যে জনাকয়েকের প্রভাবে তাদের মন একটু-আধটু দুর্বল হয়ে গেল। তারা টেবিল চাপড়ে প্রস্তাব করল, বন্দিরাই বিদ্রোহে। অংশগ্রহণ করে লুটের মালের বখরা দাবি করবেন–এ শর্তে তাদের খালাস করে দেওয়া হোক।
গাট্টাগোট্টা কালোনিগ্রো পাচকটা মহানচ্ছার! যাকে বলে একেবারে শয়তানের শিরোমণি। আর দলের ওপর তার জোর মেটের চেয়ে কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং বেশিও মনে করলেও ভুল করা হবে না। শয়তানটা গলা ছেড়ে গর্জে উঠল–‘না’, কিছুতেই না, ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বরং যত শীঘ্র সম্ভব বাকিগুলোকেওনিকেশ করে দেওয়া হোক।
ভাগ্য ভালো যে, মদের নেশায় শয়তানটাও ঝুঁদ হয়ে রয়েছে। একমাত্র এজন্যই প্রথম দলের ইচ্ছাই কার্যকরী হল।
জাহাজের যুবক লাইন-ম্যানেজারও তাদের দলভুক্ত। ডার্ক পিটার্স তার নাম। সে আপসারোকা উপজাতিরনিগ্রো। মিসৌরী নদীর উৎসস্থল কৃষ্ণ পর্বতমালার গায়ে তাদের বসতি। তার বাবা নাকি পশুলোমের কারবার বা লিধস নদীর তীরবর্তী কোনো এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কারবারে লিপ্ত।
আমার মতে জীবনে যে সব হিংস্র প্রকৃতির মানুষকে দেখেছি তাদের মধ্যে ডার্ক পিটার্সের তুল্য আর কাউকেই চোখে পড়েনি। ছোটখাট মানুষটার পাগুলো হারকিউলিসের মতো দৃঢ় ও শক্তিসম্পন্ন। কিন্তু একেবারেই অদ্ভুত। এমনভাবে বেঁকে গেছে যে শত চেষ্টা করে কিছুতেই সোজা করাই সম্ভব নয়। আর মাথাটা অস্বাভাবিক বড়। অধিকাংশ নিগ্রোর মাথার কেন্দ্রস্থলে যেমন একটা করে গর্ত থাকে তার মাথায়ও ঠিক সেরকমই একটা গর্ত লক্ষ্য করা যায়। তার ওপর মাথায় এত বড় টাক সে হন্যে হয়ে খুঁজলেও একটা চুল পাওয়া যাবে না। হয় ভালুকের, না হয় স্প্যানিশ কুকুরের লোমের একটা পরচুলা দিয়ে সব সময় ইয়া বড় টাকটাকে ঢেকে রাখে। এতে তার চোখ মুখের হিংস্রতা যেন অনেকাংশে বেড়ে যায়। আর অস্বাভাবিক লম্বা, মুখে মূলার মতো লম্বা দাঁতগুলো কিছুতেই ঠোঁট দিয়ে ঢেকেঢুকে রাখতে পারে না। ফলে সর্বদাই মনে হয় তার মুখে বিকট হাসি লেগেই রয়েছে। তবে এও সত্য যে, একে যদি হাসি আখ্যা দিতেই হয় তবে দৈত্যদানবের হাসি ছাড়া আর কিছুই ভাবা যাবে না।
কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করলে অবিচারই করা হবে যে, আমার বন্ধু অগাস্টাসের জীবন রক্ষার ব্যাপারে ডার্ক পিটার্সের কোনো অবদানই নেই। বরং সত্য গোপন না করলে বলতেই হয়, তারই জন্য আমার বন্ধু নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে। এ-কথা আমৃত্যু আমার স্মৃতির পাতায় গাঁথা হয়ে থাকতে বাধ্য।
আর একটি কথা, ডার্ক পিটার্স প্রায়ই অগাস্টাসকে নিজের কেরানী বলে সম্বোধন করে রসিকতা করে। যে কোনো কারণই থাক না কেন, দীর্ঘ কথা কাটাকাটি ও ঝগড়াঝাটির পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমার বন্ধুটি ছাড়া বাকি সব কয়জন বন্দিকেই সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। আর তা করা হবে তিমি শিকারের ক্ষুদ্রতম নৌকাটায় চাপিয়ে। তারা উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের বুকে ভাসতে ভাসতে যেদিকে যায়। যাক। যদি হিংস্র জলজ প্রাণীর পেটে আশ্রয় নেয় নিক গে।
ক্যাপ্টেন বার্নাড এখন জীবিত আছেন, নাকি ইতিমধ্যেই পরপারের যাত্রী হয়েছেন তা দেখার জন্য প্রথম মেট সিঁড়ি-বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেলেন।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই ক্যাপ্টেন ও প্রথম মেট উভয়েই ধীরপায়ে ওপরের উঠে এলেন। ক্যাপ্টেনের মুখ চকের মতো সাদা, ফ্যাকাশে বিবর্ণ। তবে আঘাতে তার মুখে যে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছিল তা এখন অনেকাংশে মিলিয়ে গেছে।
ক্যাপ্টেন কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে একটু দম নিয়ে বিদ্রোহী নাবিকদের কাছে করজোড়ে কাঁপাকাপা গলায় জানালেন, তাকে যেন সমুদ্রে নিক্ষেপ করে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেয়। আর তাদের প্রতিশ্রুতি দিলেন, তারা যেখানেই তাদের নামিয়ে দিতে বলবে তিনি সেখানেই জাহাজ ভেড়াবেন। সব শেষে এ প্রতিশ্রুতিও দিতে ভুললেন না, তাদের এ কাজের জন্য আইন-আদালতের শরণাপন্ন হবেন না।
কিন্তু হিংস্র পশু প্রবৃত্তির মানুষগুলোর কাছে তার কাতর মিনতি ও প্রতিশ্রুতি কোনো মূল্যই পেল না। তারা ক্রোধান্মত্ত নেকড়ের মতো ক্যাপ্টেনকে জাপ্টে ধরল। তীব্র আক্রোশে তাকে উত্তাল সমুদ্রের বুকে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
ক্যাপ্টেনের নিকেশ করার পর উন্মাদপ্রায় বিদ্রোহীরা এবার বাকি চার বন্দির দিকে নজর দিল। তাদের হাত পায়ের বাধন আলগা করে দেওয়া হল। এবার একজন। শয়তানের মতো খেঁকিয়ে নির্দেশ দিল-সবাই ঝটপট নিচে নেমে যাও।
কোনোরকম ফোঁ-ফাঁ না করে মুখে কলুপ এঁটে বিদ্রোহীদের পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল।
তারা সবাই নৌকায় উঠল। এক পাত্র পানি আর কিছু বিস্কুট তাদের নৌকায় দিয়ে দেওয়া হল। কম্পাস, মাস্তুল, পাল বা বৈঠা কিছুই দেওয়া হলো না।
নৌকার বাঁধন কেটে সেটাকে উত্তাল-উদ্দাম অকূল সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অন্ধকার রাত নেমে এলো সমুদ্রের বুকে। চাঁদ বা তারা কিছুই নেই। যেদিকে তাকানো যায় চারদিক ঢেকে রেখেছে কেবলই অন্ধকার–ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
দেখতে দেখতে ছোট্ট নৌকাটা চোখের আড়ালে, অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল। নৌকারোহীদের বেঁচে থাকার তিলমাত্র আশাও নেই।
অবিশ্বাস্য, ঘটনাটা ঘটেছিল ৩৫.৩০০ উত্তর আর ৬১.২০০ দক্ষিণ অক্ষাংশে! হিসাব মতো দেখাচ্ছে উল্লিখিত স্থানটা বারমুডা দ্বীপপুঞ্জের অদূরে অবস্থিত। তাই অগাস্টাসের মনে দৃঢ় বিশ্বাস, ছোট্ট হলেও নৌকাটা হয়তো কোনো-না-কোনো সময় মাটি স্পর্শ করতে পারবে। তা যদি নাও হয় তবে উপকূলের নিকটবর্তী কোনো জাহাজের নাবিকদের নজরে পড়বে। অতএব আশা ক্ষীণ হলেও তাদের জীবন রক্ষা পাওয়া একেবারে অসম্ভব নয়।
তিমি শিকারের ছোট্ট নৌকাটা চোখের আড়ালে চলে গেলে জাহাজটাকে দক্ষিণ পশ্চিমদিকে চালিয়ে দেওয়া হল।
অগাস্টাসের কি ব্যবস্থা করা হবে তা নিয়ে জাহাজের কারো মাথা ব্যথা নেই।
এক সময় অগাস্টাসের হাত-পায়ের বাধন কেটে দিয়ে তাকে জাহাজের ভেতর যথেচ্ছভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুবিধা করে দেওয়া হল। এত অঘটনের মধ্যেও তার মন থেকে কিন্তু আমার কথা মুছে যায়নি।
অগাস্টাস জাহাজের সবার নজর এড়িয়ে আমার সঙ্গে মিলিত হবার মওকা খুঁজতে লাগল। সর্বক্ষণ তার একটা মাত্রই ধান্দা, কোন ফন্দি-ফিকিরে আমার সঙ্গে মিলিত হবে।
নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার মধ্যে আর দুদুটো দিন আর দুটো রাত কেটে গেল।
শেষপর্যন্ত এলো তৃতীয় দিনের রাত। পূর্ব দিক থেকে প্রলয়ংকর বাতাস ধেয়ে আসতে লাগল। জাহাজের ক্যাপ্টেন আর প্রতিটা নাবিকের মধ্যে দারুণ ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল। সবাই পড়ি কি মরি করে পালের দড়ির কাছে ছুটে গিয়ে তাতে হাত লাগাল।
অগাস্টাস বুঝল এমন মওকা আর পাওয়া যাবে না। সে সবার চোখের আড়ালে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে তাদের ঘরে ঢুকে গেল। অত্যাবশ্যক জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে দড়িদাঁড়া আর ইয়া মোটাসোটা শেকল দিয়ে ঘরটা বোঝাই করা হয়েছে বুঝতে পারল, এসব টানাটানি করে সময় কাটালে নাবিকদের হাতে ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
উপায়ান্তর না দেখে নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অগাস্টাস যেমন দ্রুত এসেছিল তার চেয়ে অনেক দ্রুত পায়ে কামরাটা ছেড়ে বেরিয়ে এলো।
কয়েকপা এগিয়ে যেতে না যেতেই অগাস্টাসকে আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। মেট দুম করে তার গলা টিপে ধরে ক্রোধান্মত্ত বাঘের মতো গর্জে উঠল–‘কী ব্যাপার? এতক্ষণ কেবিনে কী করছিলি, সত্যি করে বল?’।
আমার বন্ধু অগাস্টাসের মুখ সঙ্গে সঙ্গে খড়ির মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা কথাও তার গলা দিয়ে বের হলো না।
তাকে নীরব দেখে মেটের ক্রোধ একেবারে পঞ্চমে চড়ে গেল। তিনি অগাস্টাসকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেবার চেষ্টা করতেই ক্যাপ্টেনের সহৃদয়তা তাকে সে যাত্রার মতো রক্ষা করে দিল। নিতান্ত ভাগ্যের জোর না থাকলে মেটের হিংস্র থাবা থেকে কারো পক্ষে জানে বেঁচে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
যা-ই হোক আমার বন্ধু আবার ফাঁদে আটকে পড়ল। আবার তার হাত-পায়ে বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হল। এবার তাকে ধরাধরি করে জাহাজের হালের কাছে নিয়ে গিয়ে সেটার কাছাকাছি একটা বার্থে শুইয়ে দেওয়া হল। তাকেনিগ্রো পাচকটা বলে দিল–জাহাজটা যখন আর জাহাজ থাকবে না ততদিন সে যেন ভুলেও ডেকে যাওয়ার চেষ্টা না করে।
আসলেনিগ্রোটা যে কি বলতে চাচ্ছে তা বোঝা এত সহজ নয়। কথাটাকে নিছকই একটা হেঁয়ালি ছাড়া কিছু ভাবা যায় না।
তবে এও খুবই সত্য যে, শেষপর্যন্ত এ ব্যবস্থাটাই আমার প্রাণ রক্ষার সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যথায় আমার বরাতে কি যে ছিল তা ভাবলে আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে বিবরণ পরে সময়মত তুলে ধরা যাবে। এ মুহূর্তে তা বলার আবশ্যকও মনে করছি না।