ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসনাশীর কাঁটা – ৯

তারের জালতির দু’ধারে দু’জন।

বাসুসাহেব জানতে চান, ওদের কতটা বলেছ?

অনির্বাণ বলে, রামগঙ্গা কিছুই নয়। পুলিশকে বলেছি, আমি আমার সলিসিটারের অনুপস্থিতিতে কোনও কথা বলব না। তাতেই ওরা আপনাকে খবর দিয়ে আনিয়েছে।

—ঠিক আছে। তোমার বিরুদ্ধে পুলিসের হাতে বেশ কিছু এভিডেন্স আছে। কী কী, তা আমি জানি। কিন্তু সেসব কথা তোমাকে বলার আগে আমি শুনতে চাই, তোমার এজাহারটা। পর পর কী ঘটনা ঘটেছিল, কেন তুমি তাতে অংশগ্রহণ করেছিলে, বলে যাও প্রথমে।

—বলার কিছু নেই স্যার। বলুন, কী জানতে চাইছেন?

— গলফ ক্লাবে যে লোকটা খুন হয়েছে তাকে তুমি চিনতে?

—লোকটা যদি কালিপদ কুণ্ডু হয় তবে হ্যাঁ, তার পরিচয় জানতাম, চিনতামই, যদিও কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। বার কয়েক তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছি। এই মাত্র। আর হ্যাঁ, ওর নাম কাকাবাবুর কাছে শুনেছিলাম। প্রথমে সে কাকুর গাড়ির ড্রাইভার ছিল। পরে নাকি ‘কুতুব-টী’ কোম্পানির ক্যাশিয়ার পর্যন্ত হয়েছিল। তহবিল তছরুপের অপরাধে চাকরি যায়; অথচ টাকাটা আদায় হয় না। কাকুর ধারণা ছিল, কালিপদবাবু সম্পূর্ণ নির্দোষ। অন্য কেউ টাকাটা সরিয়ে ওকে ফাঁসিয়েছে। তখন আমার বিশ্বাস হয়নি; কিন্তু এখন মনে হয়, কাকু ঠিক কথাই বলেছিলেন। বিশ হাজার টাকা তহবিল তছরুপ করলে লোকটা বাকি জীবন এমন ভিখারির মতো কাটাতো না।

—ও ঠিক কী করত? মানে গ্রাসাচ্ছাদনের কী ব্যবস্থা ছিল? চাকরি যাবার পর?

—এতদিন কী করেছে জানি না। তবে ইদানীং সে মহেন্দ্রবাবুর এমপ্লয়মেন্টে ছিল। মাস- মাহিনা অথবা কমিশন-বেসিস ঠিক জানি না। মহেন্দ্রনাথ পাল কুতুব টীর ম্যানেজমেন্ট কব্জা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। মাসতিনেক পরে ওঁদের জেনারেল ইলেকশান। মহেন্দ্রবাবু অনেকগুলি এজেন্টকে কমিশন-বেসিসে কাজে লাগিয়েছেন। কালিপদ তাদেরই একজন। কুতুব টীর শেয়ার হোল্ডারদের নাম-ঠিকানার একটি বিরাট লিস্ট তার কাছে ছিল। সে জনে জনে সাক্ষাত করে প্রক্সি ফর্ম যোগাড় করত। কালিবাবু জানত যে, রঘুবীর সেনের কাছে কুতুব টী-র একটা বড় চাংক শেয়ার ছিল। তাই রঘুবীরের একমাত্র কন্যা খুকুর কাছে ও যায়। খুকু বলে, শেয়ার তার কাছে নেই; আছে আমার কাছে ট্রাস্টি হিসাবে প্রক্সিতে আমারই সই নিতে হবে। কালিপদবাবু তারপর আমাকে ফোন করে। সেই প্রথমবার।

—তুমি বোধহয় তার আগেই কুতুব টী-র সব শেয়ার বেচে দিয়েছ? যখন ওর দাম হু হু করে পড়ে যাচ্ছিল? তাই নয়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু সেকথা তো কালিবাবুর কাছে স্বীকার করতে পারি না। কারণ খুকু তা জানে না। আমি ক্রমাগত কালিবাবুকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছিলাম।

—তারপর?

—লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত। ইতিমধ্যে সে আমার নাড়ি-নক্ষত্রের সন্ধান নেয়। রঘুবীরের উইল, ট্রাস্ট, আমার সঙ্গে খুকুর সম্পর্ক এবং খুকুর সঙ্গে কিংশুকের ঘনিষ্ঠতা সম্বন্ধেও সে কী জানি কোন সূত্রে সংবাদ সংগ্রহ করে। ও শুধু টের পায়নি যে, কুতুব-টী’র সব শেয়ার আমি বেচে দিয়েছি। দিনসাতেক আগে ও আমাকে টেলিফোনে জানায়, আমি যদি কুতুব টী-র শেয়ার প্রক্সি ফর্মে ব্ল্যাঙ্ক স্বাক্ষর করে ওকে দিই তাহলে ও এমন ব্যবস্থা করবে যাতে কিংশুক আর ভদ্রসমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। আমি এ কথার ব্যাখ্যা চাই। তখন ও বলে যে, কিংশুক হালদার একটা মারাত্মক অপরাধ করেছে, যেকথা পুলিস জানে না; কিন্তু যার অকাট্য প্রমাণ ওর হাতে আছে। আমি জানতে চাই, অপরাধটা কী জাতের এবং প্রমাণটাই বা কী? ও বলে, অপরাধটা কী তা ও এখন বলবে না, তবে প্রমাণটা হচ্ছে ‘একটা ডেড-ম্যানস ডায়েরি’! আমার বিশ্বাস হয় ওর কথায়। ও আরও জানায় যে, অর্থাভাবে ওকে প্রায় অনাহারে থাকতে হচ্ছে। প্রক্সি ফৰ্ম মহেন্দ্ৰ পালকে পৌঁছে দিলে ও পেমেন্ট পাবে। তাই ‘ডেড-ম্যানস’ ডায়েরিটার বদলে প্রক্সি ফর্ম ছাড়া ও পাঁচ হাজার নগদও দাবি করে। আমি রাজি হয়ে যাই। কিন্তু আমি কয়েকদিন সময় চাই…

বাসুসাহেব জানতে চান, কেন? সময় চাইলে কেন?

—আমি মরিয়া হয়ে পড়েছিলাম ঐ খুকু-কিংশুকের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারটায়। কয়েকদিনের সময় চেয়ে নিয়ে নিজের নামে বিশ হাজার কুতুব টীর শেয়ার কিনে ফেলি। তখন দর খুব পড়ে গেছে। যেদিন আমি আপনার সঙ্গে দেখা করি তার পরের দিন কালিবাবু ফোন করে। বলে, ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সর্দি-কাশিতে। বস্তুত ওর গলার স্বর শুনে আমি বুঝতেই পারিনি যে, কালিবাবু ফোন করছে। কথার মধ্যে ও বারে বারে কাশছিল। ও আমাকে একটা টেলিফোন নম্বর দেয়। বলে, পরদিন সন্ধ্যা সাতটায় ঐ নম্বরে ফোন করতে। তখন ও বলবে, কবে-কখন দেখা হবে।

বাসু বলেন, তুমি সন্ধ্যা সাতটায় ফোন করেছিলে?

—হ্যাঁ।

—কোথা থেকে?

—হাজরা মোড়ে একটা টেলিফোন বুথ থেকে

—তারপর কী হল, বলে যাও?

—টেলিফোন যে ধরল, আমার ধারণা সে কালিবাবুর বাড়ির ঝি। সে আমার নাম জানতে চাইল। আমি বললাম, ‘আমার নামের কী দরকার? আমি তো ঠিক সাতটার সময়েই ফোন করেছি। তাই তো কথা ছিল?’ ও তখন জানতে চাইল, কুতুব টীর ব্যাপারে? আমি ‘হ্যাঁ’ বলায় ও একটা নতুন টেলিফোন নাম্বারে ফোন করতে বলল। যা হোক, আমি দ্বিতীয় নম্বরে ফোন করা মাত্র কালিবাবু ধরল। আমি পাঁচ হাজার নগদে নিয়ে যাচ্ছি কি না জেনে নিয়ে বলল, ‘রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাব চেনেন নিশ্চয়? তারই ‘ফার্স্ট-টী’-তে। রাত দশটার সময়।’

—তোমার সন্দেহ হল না? রয়্যাল ক্যালকাটা গলফ ক্লাবের এক নম্বর টীর অবস্থান ও লোকটা কেমন করে চিনল?

—আজ্ঞে না, সে বিষয়ে সন্দেহ হয়নি। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম স্থান নির্বাচনে নয়, সময় নির্বাচনে। আমি ঐ ক্লাব-মাঠের প্রতিটি গাছ, প্রতি ‘হোল’ চিনি। এককালে রঘুবীর কাকার পিছন পিছন স্টিক ঘাড়ে করে আমাকে ঘুরতে হয়েছে : ‘ফার্স্ট-টী’ থেকে ‘এইটিছ-হোল’ পর্যন্ত। ইদানীং সময় পেলে আমি নিজে গিয়েও খেলি। আমি আরও জানতাম, ঐ কালিপদ কুণ্ডু এককালে রঘুকাকার গাড়ি চালাতেন। ফলে, তাঁকেও একই ভাবে ক্লাব-মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে হাঁটতে হয়েছে। বস্তুত স্থান নির্বাচনে আমি মনে মনে নিশ্চিন্তই হলাম। লোকটার কণ্ঠস্বর বিকৃত শোনালেও সেটা সর্দি লাগায়। ও লোকটা নির্ঘাৎ কালিপদ কুণ্ডু। আমার সন্দেহ ছিল, সময়টা নিয়ে। অত গভীর রাত্রে কেন? কিন্তু কালিপদ কুণ্ডু আমার শত্রু নয়, যে বেমক্কা অমন নির্জন স্থানে আমাকে হত্যা করে বসবে…

বাসুসাহেব বাধা দিয়ে বলেন, কিন্তু তোমার সঙ্গে নগদ পাঁচ হাজার টাকা ছিল। লোকটা সেই টাকার লোভেও তোমাকে হত্যা করতে পারত। তাই কি তুমি তোমার রিভলভারটা পকেটে নিয়ে গেলে?

—রিভলভার! না স্যার, কোন রিভলভার তো আমি নিয়ে যাইনি।

—কিন্তু কালিপদ যদি হঠাৎ পকেট থেকে একটা রিভলভার বার করত, তখন তুমি কী করতে?

—আমি ক্যারাটে ‘ব্ল্যাক বেল্ট’। মানে ক্যারাটে বিদ্যায় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিধারী। একাধিক ক্লাবে আমি ক্যারাটে শেখাই। কালিবাবুর মতো একজন বৃদ্ধ যদি পকেট থেকে একটা রিভলভার বার করে আমার দিকে তাক করবার সুযোগ পেত, আর তার আগে ওকে আমি মাটিতে শুইয়ে দিতে না পারতাম তাহলে বাড়ি ফিরে এসে আমি গলায় দড়ি দিতাম।

—ও আচ্ছা। তারপর কী হল বলে যাও।

—যে কথা বলছিলাম স্যার, আমার সন্দেহ হয়নি। তবু জানতে চাইলাম, ‘কিন্তু অমন অদ্ভুত জায়গায় কেন?’ ও প্রান্তের লোকটা বললে, ‘দত্তবাবু, আর. সি. জি. সি.’র ফার্স্ট টী এক কথায় চিনে নেবে এমন মানুষ গোটা কলকাতা শহরে হাতের পাঁচটা আঙুলে গোনা যায়। এতে প্রমাণ হল : টেলিফোনের এ প্রান্তেই বা কে, ও প্রান্তেই বা কে।’ আমি জবাবে বললাম, ‘অলরাইট’। বলে, টেলিফোন রেখে দিলাম।

—তারপর?

—রাত পৌনে দশটায় আমি ক্লাবে পৌঁছাই। গাড়ি পার্ক করে ভিতরে যাই। ক্লাব ঘরে তখন দশ-পনের জন ছিলেন। আমার পরিচিত কেউ ছিলেন না।

—তুমি ঐ গলফ ক্লাবের মেম্বার?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। কাকাবাবু আমাকে হাতে ধরে খেলাটা শিখিয়েছিলেন। স্টিক নিয়ে ওঁর পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে খেলাটা আমি অবশ্য নিজে থেকেই শিখে গেছিলাম। কাকু আমাকে স্ট্রোক মারা শেখান, গ্রিপ, স্টান্স, ড্রাইভ, ডাউনওয়ার্ড স্যুইং, বাঙ্কার টপকানো ইত্যাদি সবকিছুই শেখান। সে যাই হোক, সেদিন রাত দশটায় যাঁরা ক্লাবে ছিলেন তাঁদের কাউকে আমি চিনতে পারিনি। ঐ রাতের মেম্বাররা খেলতে আসেন না বোধহয়, মদ্যপান করতে আসেন। আমি পিছনের দিকের দরজা দিয়ে মাঠে নেমে যাই। ফার্স্ট টীতে পৌঁছাই। ক্লাবঘর থেকে একশ গজও হবে না। সেখানে মিনিট পাঁচেক বোকার মতো অপেক্ষা করি। জায়গাটা আলো-আঁধারি। এতটা অন্ধকার নয় যে, একজন মানুষ এগিয়ে এলে দেখতে পাব না। আমার ঘড়িতে রেডিয়াম-ডায়াল। দশটা পাঁচ হবার পর আমি অস্থির হয়ে উঠি। পায়চারি শুরু করি। আর তখনই কিসে যেন ঠোক্কর খাই!

—কিসে যেন ঠোক্কর খাও! কী সে?

—একটা নিথর মৃতদেহে! …বোধহয় মিনিট দুই আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর নিচু হয়ে লোকটিকে ‘ফীল’ করি। পুরুষ মানুষ। বৃদ্ধ। রক্ত! আন্দাজ করি : কালিপদ কুণ্ডু! … আমি ঘাসে হাতটা মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়াই। নিঃশব্দে ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে আসি। আমার আশঙ্কা হয়, কেউ একটা মার্ডার করেছে। কালিপদকেই কেন জানি না, কিন্তু আমাকে ফ্রেম-আপ করতে চায়!

—তারপর?

—তারপর আমি ওখান থেকে সোজা বাই-রোড আসানসোলের দিকে রওনা দিই। প্ৰায় সারারাত ড্রাইভ করে…

—জাস্ট এ মিনিট। ড্রাইভ করার সময় তুমি গায়ের কোটটা খুলে রেখেছিলে, নয়? কেন? —কোটটা খুলে রেখেছিলাম! মানে?

—বাঃ! ডাস্টবিনের ভিতর হাত ঢোকানোতে হাতে তো প্রচুর ময়লা লেগে যাবার কথা নয়? হাতটা ধুলে কোথায়?

অনির্বাণ এবার প্রশ্ন করতেও ভুলে যায়।

বাসু বলেন, একটা শর্ট-ব্যারেল জার্মান রিভলভার, যার নম্বর KB 173498 : তুমি কলকাতা ত্যাগ করার আগে একটা অন্ধকার গলিতে ডাস্টবিনের ভিতর ফেলে দিয়ে যাওনি?

অনির্বাণ বজ্রাহতের মতো মিনিটখানেক তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, আপনাকে কে বলল?

—রিভলভারটা আনলাইসেন্সড তা বোঝা যায়। তোমার হেপাজতে এল কখন? কীভাবে?

অনিবার্ণ কোনক্রমে বললে, জানি না আপনি কোন সূত্রে জেনেছেন। হ্যাঁ, স্বীকার করছি ওটা আমি একটা ডাস্টবিনের ভিতর ফেলে যাই। তবে আপনার ঐ আন্দাজটা ভুল। ওটা আনলাইসেন্সড নয়, আমারই নামে লাইসেন্স। আমার রিভলভার।

—তুমি রিভলভারের লাইসেন্স নিয়েছিলে? কেন? কবে?

‘না। ওটা ছিল কাকুর। ফিয়াট গাড়ির সঙ্গে ঐ রিভলভারটাও আমাকে উনি দান করে যান। আমি নিজের নামে লাইসেন্স করিয়ে নিই। খুকু বাড়িতে একলা থাকে বলে তার আঠারো ‘ বছর বয়সে ওটা তাকে দিতে চাই, কিন্তু পুলিশ কমিশনার রাজি হন না। বলেন, নিজের বাবাই যাকে বাইশ বছরের আগে সাবালিকা ভাবতে পারেননি তাকে আমি কোন আক্কেলে ওটার লাইসেন্স দিই? আমাকে বলেন, বছর চার-পাঁচ পরে নতুন করে আবেদন করতে।

—রিভলভারটা থাকত কোথায়? মেসে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। মেসের তিনতলায় আমার ঘরে একটা মজবুত কাঠের গা-আলমারি আছে। তার একটা সিক্রেট ড্রয়ার আমি নিজ-ব্যয়ে বানিয়ে নিয়েছিলাম।

—তাহলে ঘটনার রাত্রে ওটা তুমি পকেটে করে নিয়ে যাও!

—না, স্যার। আমি খালি হাতেই গিয়েছিলাম। গলফ্ ক্লাব মাঠের প্রতিটি বর্গইঞ্চি আমার পরিচিত। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ওখানে খুনোখুনি হতে পারে।

—তাহলে রিভলভারটা তোমার হাতে এল কেমন করে?

—নিচু হয়ে যখন মৃতদেহ পরীক্ষা করছি তখনই আমার হাতে ওটা ঠেকে যায়। হাত বুলিয়ে বুঝতে পারি ওটা আমারই। কারণ ওরকম শর্ট-ব্যারেল জার্মান রিভলভার বাজারে সহজে পাওয়া যায় না। আমার আশঙ্কা হয়, কেউ আমাকে ‘ফ্রেম-আপ’ করতে চাইছে। আমি তৎক্ষণাৎ ওটা রুমালে জড়িয়ে তুলে নিই। পকেটে ফেলি।

—শুঁকে দেখনি?

—দেখেছিলাম। ব্যারেলে বারুদের গন্ধ ছিল।

—তোমার কাছে পকেট-টর্চ ছিল না?

—না! আমি জানতাম, কম্পাউন্ড-ওয়াল ভেঙে রিফিউজিরা ইট চুরি শুরু করার পর রাতে ওখানে টহলদারি দারোয়ানের ব্যবস্থা হয়েছে। মাঠে কোথাও টর্চের আলো জ্বললে দারোয়ান ছুটে আসত।

—মেসের ঐ দেওয়াল আলমারি থেকে কীভাবে বা কতদিন আগে রিভলভারটা চুরি গেছে তা তোমার আন্দাজ নেই?

—বিন্দুমাত্র না।

—রিভলভারটা নিয়ে তুমি আমার কাছে এলে না কেন?

—আমার আশঙ্কা হল, আপনি আমার এজাহারটা বিশ্বাস করবেন না।

—সে তো এখনো করছি না। কিন্তু রাতারাতি কলকাতা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটা খুবই বিশ্রী দেখাচ্ছে না? তার চেয়ে অনেক ভাল হত মৃতদেহ আবিষ্কারের কথা তৎক্ষণাৎ পুলিশে রিপোর্ট করে নিজে থেকেই রিভলভারটা সারেন্ডার করা।

—এখন আপনি আমাকে কী করতে বলেন? গিলটি প্লীড করে আদালতের মার্জনা ভিক্ষা করব?

—তুমিই কালিপদবাবুকে হত্যা করেছ?

—সার্টেনলি নট!

—তাহলে তুমি অহেতুক ‘গিলটি প্লাড’ করতে যাবে কেন?

—আপনি নিজেই যে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।

—না পারছি না, অনিবার্ণ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি কাউকে আড়াল করবার চেষ্টা করছ। মিছে কথা বলে দোষটা নিজের ঘাড়ে টেনে নিচ্ছ।… তুমি আদ্যন্ত সত্যি কথাটা এবার বলবে?

—এটাই আদ্যস্ত সত্যি কথা!

—অল রাইট! কেউ নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মারে। কেউ কুড়ুলটা খাড়া করে পেতে তাতে সবলে পদাঘাত করে। এক্ষেত্রে তোমার যেটা অভিরুচি। তবে ফল একই।

—আপনি আমাকে কী করতে বলেন?

—তোমার ঐ আষাঢ়ে গল্পটা বদলে তোমার কাউন্সেলের কাছে আদ্যন্ত সত্যি কথা বলা।

অনির্বাণ কাঁধ ঝাঁকালো নিরুপায় ভঙ্গিতে। বলল, আপনি স্যার একটা উদ্দেশ্য দেখাতে পারেন? একটা ক্ষীণতম মোটিভ, যাতে আমার মতো মানুষ ঐ কালিপদ কুণ্ডুর মতো অদ্যভক্ষ্যধনুর্গুণ একটা মানুষকে খুন করতে চাইবে?

—আমি পারি কি পারি না সেকথা থাক। পুলিশ অসংখ্য মোটিভ খাড়া করতে পারে। করবেও। তার একটা এখনি শোন। তোমার এজাহার শেষ হলে পাবলিক প্রসিকিউটার মাইতি- সাহেব আদালতে দাঁড়িয়ে উঠে বলবেন, ‘ধর্মাবতার! ঐ কালিপদ কুণ্ডু ছিল স্বর্গত রঘুবীর সেনের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। তাকে ডেকে রঘুবীর শেষাবস্থায় বলেছিলেন : এখন আমি উত্থানশক্তিরহিত। আমার মেয়ে নাবালিকা। আমি উইলটা বদলাতে চাই। কিন্তু অনিবার্ণ আমাকে সে সুযোগ দিচ্ছে না। তুমি এককালে আমার গাড়ি চলাতে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে?’ তাতে হুজুর ঐ মৃত কালিপদ কুণ্ডু জানতে চায়, ‘কেন স্যার? অনিবার্ণকে আপনি ট্রাস্টি রাখতে চান না কেন?’ রঘুবীর তখন ওকে একটা ডায়েরি দিয়ে বলেছিলেন, ‘এইটা পড়ে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবে। দু’দিন পরে ডায়েরিটা ফেরত দিয়ে যেও। হুজুর, কালিপদ কুণ্ডু সেই ডায়েরিটা ফেরত দিয়ে যেতে পারেনি। তার আগেই রঘুবীরের বাকরোধ হয়ে যায়। পরদিন তিনি মারা যান। এ সব কথাই আমরা সাকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স থেকে প্রমাণ করব। সেই মারাত্মক ‘ডেড ম্যানস ডায়েরি’র জোরে কালিপদবাবু বিগত কয়েক বছর ধরে ব্ল্যাকমেলিং করে আসছিলেন। ঘটনার রাত্রেও আসামীর কাছে খুচরো নোটে পাঁচ হাজার টাকা ছিল এটা আমরা প্রমাণ করব বলে আশা রাখি। ঐ রকম একটা অন্ধকার নির্জন স্থানে আসামী কালিপদকে টাকার লোভ দেখিয়ে টেনে আনে।’ ….এর পর স্বচক্ষে দেখতে পাবে, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা হলফ নিয়ে কী দারুণ আজগুবি গল্প শুনিয়ে যাবে। সব শেষে অটোন্সি-সার্জেন যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, ফেটাল বুলেটটা KB 173498 থেকে নিক্ষিপ্ত, এবং প্রমাণ হয় সেটা তোমার, তুমি সেটা ডাস্টবিনের ভিতর ফেলে রাতারাতি কলকাতা ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলে, তাহলে আমি তো ছাড়, আমার গুরু এ. কে. রে বার-অ্যাট-ল’ও তোমাকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে পারবেন না।’

অনির্বাণ দুই হাতে নিজের মুখ ঢাকল।

—তুমি কি তোমার আষাঢ়ে গল্পটা এবার বদল করবে, অনিবার্ণ?

মুখ থেকে হাত সরল না। অনির্বাণ দু’দিকে মাথা নাড়ল।

—অল রাইট! অ্যাজ য়ু প্লীজ!

হঠাৎ মুখ তুলে তাকালো অনিবার্ণ, আপনি কি আমাকে ত্যাগ করে যাচ্ছেন স্যার?

—সার্টেনলি নট! না হয় একটা কেসে হারব। তাতে কী?

—আমাকে গিলটি প্লীড করতেও বলছেন না?

—নিশ্চয় না। যদি তুমি স্বহস্তে খুনটা না করে থাক।

—থ্যাঙ্কু, স্যার।

দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর বাসুসাহেব হঠাৎ বলে ওঠেন, কাম অন! লেটস স্টার্ট অ্যাফ্রেশ! এস, নতুন করে খেলাটা শুরু করা যাক। তুমি এ পর্যন্ত একটাও অনার্স-কার্ড আমার হাতে দাওনি। সবই দুরি- তিরি, পাঞ্জা-ছক্কা। তা বলে তো খেলার টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়া যায় না। এধবে দু-একটা প্রশ্নের জবাব দাও। প্রথম প্রশ্ন : ‘ডেড ম্যানস ডায়েরি টা কার, তা ও. বলেনি? সেটা তুমি ওর পকেট থেকে উদ্ধার করতে পারনি?

—আজ্ঞে না। আপনার দুটো প্রশ্নের জবাবই : না।

—কিংশুকের বিষয়ে ওর সঙ্গে তোমার যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, সে বিষয়ে কালিপদ কুণ্ডুর কোনও হাতচিঠি, বা কোনও এভিডেন্স কি তোমার কাছে নেই?

—আজ্ঞে না।

—থার্ডলি : হাজরা রোডের মোড়ের পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে তুমি দু-দু’বার ফোন করেছিলে। প্রথমবার একটা কাগজ দেখে-দেখে; দ্বিতীয়বার ও’পক্ষের কথা শুনে একটা কাগজে লিখে নিয়েছিলে। সেই কাগজের টুকরো দুটো কোথায়?

—আমি নষ্ট করে ফেলেছি, যাতে পুলিশ আমার সঙ্গে কালিপদ কুণ্ডুকে ‘কানেক্ট’ করতে না পারে।

—বুঝলাম! নম্বর দুটোর একটাও মনে নেই? অন্তত এক্সচেঞ্জ নাম্বারগুলো?

অনিবার্ণ নতনেত্রে একটু ভেবে নিয়ে বলল, দ্বিতীয় নম্বরটার কথা কিছুই মনে নেই। তবে প্রথমটার কিছুটা মনে আছে। এক্সচেঞ্জ নাম্বারটা দুই-সংখ্যা না তিন-সংখ্যার, তা মনে নেই, কিন্তু শেষ চারটে অঙ্ক ছিল ওয়ান-এইট-থ্রি-সিক্স!

—আশ্চর্য! অ্যাদ্দিন পরেও তা তোমার মনে আছে?

—হ্যাঁ, স্যার। আছে। চেষ্টা করে মনে রাখিনি। তবু ভুলতেও পারিনি।

—চেষ্টা করে মনে রাখনি? তাহলে? তুমি কি হাফ-শ্রুতিধর?

অনিবার্ণ ম্লান হাসল। বলল, আসলে কী জানেন? কালিবাবুর মুখে শুনে তখনই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল, ওটা ঠাকুরের জন্মসাল! 1836 সালটা তো ভোলা যায় না!

মুখফোঁড় বাসুসাহেব মূক হয়ে গেলেন!

অনির্বাণের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বলে, আপনি কি কোনই আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না, স্যার?

বাসু ম্লান হেসে বললেন, এক মিনিট আগেও পাচ্ছিলাম না। আমার হাতে যে শুধুই দুরি- তিরি! কিন্তু শেষ পাতে যে আমার পার্টনার রঙের টেক্কাখানা নামিয়ে দিল, অনিবার্ণ! ঠাকুরের নাম নিয়েছ তুমি! একটা পিঠ তো নির্ঘাৎ আমাদের!