ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসনাশীর কাঁটা – ৭

রাত বাড়তে থাকে।

ডিনার-টাইম হতেই বিশু এসে জানতে চায়, টেবিল সাজাবো?

রানু বাসুসাহেবের দিকে জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকালেন।

উনি বলেন, না রে! কৌশিক বেরিয়ে গেল। ওর ফিরতে দেরি হবে। ও ফিরে এলে আমরা একসঙ্গেই খাব। তুই খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়।

—দাদাবাবু কই গেল?

—সে আর তোর শুনে কাজ নেই।

বিশে বিজ্ঞের মতো বললে, বুঝলাম। শোনেন, বড্ড ঘুম পাচ্ছে। জেগে থাকতে পারবনি। শুয়ে পড়ছি। দাদাবাবু এলে আমারে ডেকে দেবেন। তখন টেবিল সাজাব। নিজেও খেয়ে নেব নে।

বলেই ছুট।

রানু পিছন থেকে ডাকেন, না, না, এই বিশে, শুনে যা…

কে কার কথা শোনে। বিশু ততক্ষণে হাওয়া!

রানু এদিকে ফিরে বাসুসাহেবকে বললেন, তুমিই যত নষ্টের গোড়া। তোমার মক্কেল মাঝরাতে কাকে ব্ল্যাকমেলিং-এর টাকা মেটাতে যাচ্ছে, তাতে তোমার কী? কলকাতা শহরে তুমিই তো একা ক্রিমিনাল-সাইড ব্যারিস্টার নও! কই আর কেউ তো এভাবে বাড়ির শান্তি নষ্ট করে না।

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আই প্লীড গিটি, মিলেডী! অনুমতি দেন তো সেজন্য প্রায়শ্চিত্ত করতেও প্রস্তুত।

—প্রায়শ্চিত্ত! মানে? কীভাবে?

—এখনো সময় আছে। রাত দশটার আগেই ঐ R.C.GC.-র গেটে সশস্ত্র উপস্থিত হতে পারি।

রানুর ছুটে পালানোর উপায় নেই। সবেগে চাকায় পাক দিয়ে তিনি রওনা হয়ে গেলেন অন্দর-মুখো। যাবার আগে বলেও গেলেন : তাহলেই ষোলোকলা পূর্ণ হয়! বয়স কত হল সে খেয়াল আছে?

বাসু জানতে চান, চললে কোথায়?

—শুতে। আমারও শরীরটা ভাল নেই, রাতে খাব না।

—অলরাইট! অলরাইট! কিন্তু আমি তো তোমাদের মতো বুড়ো হয়ে যাইনি। খিদেও আছে। আমার জন্য রাতে কী বানানো হয়েছে? খই দুধ? না সাবু? কে দেবে?

রানুর ইনভ্যালিড চেয়ার ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে। কেউ এ প্রশ্নের জবাব দিল না। বাসু ধীরপদে উঠে গেলেন ড্রিংক কাবার্ডর দিকে।

শিভ্যাস-রিগাল এর বোতলটা বার করলেন। কেউ আজ নেই সাহায্য করতে। নিজেই কিচেনে গিয়ে ফ্রিজ খুলে আইস কিউবের ট্রে-টা নিয়ে এলেন। আর কাজুবাদাম ভর্তি হরলিকসের শিশিটা।

হুইস্কি-অন-রকসই এসব মুহূর্তে ওঁর মন-পসন্দ। এ রোগের দাওয়াই।

কৌশিক যখন ফিরে এল পাড়া তখন নিশুতি। নিউ আলিপুর পাড়ায় দু-একটি ঘরে ছেলে- মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে হয়তো কর্তা-গিন্নি অ্যাডাল্ট মার্কা মিডনাইট শো দেখছেন টিভিতে। কৌশিক আশা করেছিল, ওদের বাড়িও ঘুমে অচেতন থাকবে। দূর থেকে তাই মনেও হয়েছিল। কিন্তু গাড়ি গ্যারাজে তুলবার মুখে বাঁক নেবার সময় যখন হেডলাইটের ধূমকেতুর পুচ্ছ পোর্চের উপর সম্মার্জনী-প্রলেপন বুলিয়ে দিল, তখন দেখা গেল তিন-তিনটি বেতের সোফা দখল করে বসে আছেন তিন উদ্বিগ্ন পরমাত্মীয়।

.

ও এগিয়ে আসতেই বাসু বললেন, মামুর দু-দুটো পরামর্শের একটাও গ্রহণ করনি দেখছি। ট্যাক্সিতেও যাওনি। খানদানি বদনখানা আড়াল করার চেষ্টাও করনি।

কৌশিক একটা চেয়ার দখল করে বসল। বলল, কী জানেন মামু? আপনি তো ইদানীং ট্যাক্সি বিশেষ চড়েন না। তাই জানেন না। রাত নয়টার পর ট্যাক্সিওয়ালা তাদের গ্যারেজ-মুখো ছাড়া যেতে চায় না। নেহাত যদি বলেন এয়ারপোর্ট যাবেন আর ফাঁকা গাড়ি ফেরার জন্য ডবল ফেয়ার কবুল করেন….

—বুঝেছি, বুঝেছি। আর মেকআপটা নিলে না কেন?

—একটু আত্মপ্রশংসার মতো শোনাবে, সেটা সুজাতার সামনে বলতে চাই না- কিন্তু আপনি ব্যঙ্গ করে যে কথা বললেন, হেতুটা তাই। এই ‘খানদানি বদনখানি’র জন্য। এটাকে লুকোতে হলে বাবা মুস্তাফার মেক-আপ নিতে হয়। অতটা সময় হাতে ছিল না। আর তাছাড়া অনির্বাণের সঙ্গে আচমকা মুখোমুখি হয়ে পড়লে বলতুম : ‘ওয়াল্ট ডিজনে ঠিকই বলেছেন : It’s a small world! আজ সন্ধ্যারাতেই আপনাকে হাজরা মোড়ে দেখেছি মনে হচ্ছে?’ ছদ্মবেশে ধরা পড়ে যাওয়ার চেয়ে সেটা অনেক নিরাপদ! কী জানেন, মামু— আপনি আজও পড়ে আছেন কনান ডয়েলের যুগে। ক্রিস্টির প্যয়রো কখনো ছদ্মবেশ পরেছেন বলে তো মনে পড়ে না; আর পেরী মেসন…

—হয়েছে। থাক। পণ্ডিত্যেমি অনেক দেখিয়েছ। এবার তোমার অভিজ্ঞতাটা শোনাও।

রানু বাধা দিয়ে বলেন, থাম তো তুমি! বেচারি এই রাত বারোটা পর্যন্ত না খেয়ে আছে। যাও কৌশিক মুখ-হাত ধুয়ে প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে ডাইনিং হলে এসে বস। আমি খাবরটা দিতে বলি।

বাসু ধমকে ওঠেন, আজ তোমার কী হয়েছে রানু? বারে বারে সব গুলিয়ে ফেলছ, রাত বারোটা পর্যন্ত কৌশিক একাই অভুক্ত পড়ে নেই। আমরা সবাই পেটে কিল মেরে পড়ে আছি। সুজাতা, তুমি, বিশে আর হ্যাঁ, আমারও সাবু অথবা খই-দুধ অভুক্ত।

রানু হেসে ফেলেন। বলেন, না। তুমি বাদ! তুমি ইতিমধ্যে তিন পেগ খেয়েছ। আর খাবে না। বোতলটা দাও দিকিনি।

.

ডাইনিং টেবিলে চিলি চিকেন আর পরোটা চিবাতে চিবাতে কৌশিক বললে, মামু আপনি কিন্তু গভীর গাড্ডায় পড়ে গেছেন। আপনার মক্কেল ধোয়া তুলসীপাতাটি নয়।

বাসু বলেন, তোমার কনক্লুশনটা আমি শুনতে চাইনি, কৌশিক। আমি চাই ‘ফ্যাক্টস’; বাস্তবে যা ঘটেছে একের পর এক। ওর দেখা পেলে?

—পেলাম। রাত নয়টা সাতচল্লিশে। আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনার অনুমানটা ঠিকই। রাঁদেভুটা ঐ গলফ-ক্লাবের একনম্বর টী-তেই। ঐ R.C.GC-র গেটের সামনে আমি পৌঁছাই নয়টা একত্রিশে। ছায়া-ছায়া মতো জায়গায় গাড়িটা পার্ক করে অন্ধকারে অপেক্ষা করতে থাকি। ও এল নয়টা সাতচল্লিশে। ডাইনে-বাঁয়ে তাকালো না। কার্ড দেখিয়ে সোজা ভিতরে চলে গলে। পরিধানে সেই সাবেক সিলভার-গ্রে স্যুট। সেই সাদা-নীল স্ট্রাইপড্ টাই। দূর থেকে ওর সাইড-পকেট বা হিপ- পকেট দুটোই ভাল করে লক্ষ্য করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার মনে হয়নি যে, তার ভিতর মারাত্মক কিছু আছে। কোন পকেটই উঁচু হয়ে নেই…

—তোমার কী মনে হল তা আমি জানতে চাইছি না; বাস্তবে কী কী ঘটল…..

রানু ধমকে ওঠেন, কেন? কৌশিক কি কাঠগড়ায় উঠেছে?

সুজাতা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে, তাছাড়া সাক্ষী একজন বিশেষজ্ঞ, মি-লর্ড। একজন এক্সপিরিয়েন্সড ‘জাসুসী’-র অনুমান-নির্ভর এভিডেন্স হুজুরের আদালতে গ্রাহ্য হওয়া উচিত।

বাসুও হেসে ফেলেন, অল রাইট। ধরে নেওয়া গেল- অনির্বাণ কোন রিভলভার নিয়ে ক্লাবের ভিতর ঢোকেনি। তারপর কী হল?

ঠিক তেইশ মিনিট পরে— দশটা বেজে দশ মিনিটে ও ক্লাবঘর থেকে বার হয়ে এল। এবারেও ডাইনে-বাঁয়ে তাকালো না। দ্রুত পায়ে সোজা এসে উঠে বসল ওর ফিয়াট গাড়িতে। স্টার্ট দিল। দ্রুত গিয়ার বদলে…

—আর তোমার ছ্যাকড়া গাড়ি ঝকড়-ঝকড় শুরু করে দিল, এই তো?

—না মামু। ইতিমধ্যে কার্বুরেটারের ট্রাবলটা আমি মেরামত করিয়ে নিয়েছি। আপনার ওল্ড- গোল্ড পুষ্পকরথ একবারেই স্টার্ট নিল। প্রায় চল্লিশ মিটার ব্যবধান রেখে আমরা চলতে থাকি। রাত তখন এমন কিছু বেশি নয়। আনোয়ার শাহ রোডে ট্রাফিক ভালোই আছে। তারপর ও হঠাৎ একটা আট-দশ মিটার চওড়া গলি-মুখ পার হয়েই ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। ব্যাক করে এল চার- পাঁচ মিটার। ঐ গলিতে ঢুকে গেল। ততক্ষণে আমি ঐ গলির মুখটার কাছাকাছি এসে গাড়ি পার্ক করেছি। গাড়ি থেকে নেমে লুকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকি। গলির ভিতর তাকিয়ে দেখি ঘোর অন্ধকার। ঐ অঞ্চলে লোডশেডিং হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ মিটার এগিয়ে অনিবার্ণ গাড়ি থামালো। নেমে এল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল। জনমানবের চিহ্ন দেখতে না পেয়ে সে পকেট থেকে কী-একটা জিনিস বের করল। অতদূর থেকে আমার মনে হল, অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন- বক্স : বাচ্চারা যা নিয়ে স্কুলে যায়। চট করে ডাস্টবিনের ভিতর সেটা ফেলে দিল। শুধু তাই নয়, কোট খুলে, আস্তিন গুটিয়ে, ডাস্টবিনের ভিতর হাত চালিয়ে বস্তুটাকে নিচে ঠেলে দিল। গলির একটা বাড়িতে দ্বিতলে আলো জ্বলছিল। তাতেই গলিপথটা আলো-আঁধারি। তারপর অনির্বাণ ফিরে এল গাড়িতে। কোটটা গায়ে দিল না। গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল।

বাসু বলেন, বুঝলাম। অতঃপর নীরন্ধ্র অন্ধকার মঞ্চে শ্রীমান সুকৌশলীর প্রবেশ এবং পরিত্যক্ত বস্তুটি উদ্ধার। সেটা কোথায়?

—খেয়ে উঠে দেখাচ্ছি।

আহারান্তে কৌশিক উদ্ধারপ্রাপ্ত বস্তুটি দেখালো। রুমালে জড়ানো একটি জার্মান-মেড রিভলভার। শর্ট-নজল। ছোট্ট। রুমালটায় নোংরা লেগেছে। অস্ত্রটায় লাগেনি। বাসু সেটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। নম্বরটা পড়ে শোনালেন KB 173498 1

রানু তৎক্ষণাৎ নম্বরটা টুকে নিলেন খাতায়।

বাসু সামনে ধরে চেম্বারটা খুলে দেখলেন। পাঁচটা চেম্বারে টাটকা বুলেট। শুধু ব্যারেলের সামনের অবস্থানে কোনও বুলেট নেই। সেটা ফাঁকা। গন্ধ শুঁকেও দেখলেন।

রানু জানতে চান, বারুদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে?

—যাচ্ছে। বারুদের নয়! পচা-চিংড়ির! ডাস্টবিনটা বোধহয় বহুদিন সাফা করা হয়নি।

কৌশিক বলে, আমার বোধহয় এখনই পুলিশে রিপোর্ট করা উচিত! এটা একটা এভিডেন্স। আমি গোপন করতে পারি না। সুকৌশলী লাইসেন্সড ডিটেকটিভ এজেন্সি।

বাসু বলেন, এভিডেন্স? মানে? কিসের এভিডেন্স?

—মার্ডারের। ঐ গুলিটায় যে লোকটা খুন হয়েছে।

—আগে খবর পাই, কেউ আদৌ খুন হয়েছে। এখন পর্যন্ত ঘটনাটা এই : তোমার এক্তিয়ারে একটা রিভলভার বেমক্কা এসে গেছে, এজন্য তুমি আমার কাছে আইনত পরামর্শ চাইতে এসেছ। তুমি আমার ক্লায়েন্ট। তোমার আশঙ্কা কেউ তোমাকে হত্যা মামলায় জড়াতে চায়। অথচ কে হত হয়েছে, আদৌ কেউ হত হয়েছে কি না, তা তুমি জান না। তুমি একটা একশ টাকার নোট রানুকে রিটেনার হিসাবে জমা দিয়ে রসিদ নাও। আর এই রিভলভারটার প্রাপ্তিস্বীকারের রসিদ। এবার চল সবাই, শুয়ে পড়ি। কাল সকালে খবরের কাগজে যদি দেখা যায়, যে গলফ ক্লাবে রাত দশটায় কেউ খুন হয়েছে তখন পুলিসে খবর দেবার প্রশ্ন উঠবে। এখন পর্যন্ত আমরা কেন ধরে নেব যে, আদৌ কেউ খুন হয়েছে?