ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসনাশীর কাঁটা – ৪

টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বাসুসাহেব বললেন, বল সুজাতা। কোথা থেকে ফোন করছ?

—কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে। আপনার মক্কেল না-পাত্তা। কাল রাতে মেসে ফেরেনি। আর আজ সকালে সে তার গাড়ি নিয়ে দূরপাল্লার সফরে বেরিয়েছে।

বাসু জানতে চাইলেন, রাতে মেসে ফেরেনি এ তথ্য সংগ্রহ করা সহজ; কিন্তু আজ যে সে দূরপাল্লার সফরে গেছে তার তথ্যসূত্র কী?

সুজাতা কিষেনলালজীর রিপেয়ার শপ থেকে সংগৃহীত তথ্য সরবরাহ করে। অনির্বাণের নির্দেশে গাড়ির গ্রিজ-মবিল বদল করা হয়েছে।

বাসু বলেন, তোমার কর্তাটি কোথায়? তোমার পাশে?

—আজ্ঞে না। ও আমাকে নামিয়ে দিয়ে ভবানীপুর গেল করবীর বাড়ি। সেখান থেকে অনির্বাণের অফিসে যাবে। আমাকে বললে, ট্যাক্সি নিয়ে সময়মতো বাড়ি ফিরতে।

—কেন? তুমি কলেজ স্ট্রিটের বাজারে কী করছ? হাপু গাইছ?

—আজ্ঞে না। হাপু গাইছি না। একটা বুড়োর উপর নজর রাখছি। সে এখনো ঐ মেসবাড়ির উল্টোদিকের রোয়াকে বসে বসে বিড়ি টানছে। ঐ লোকটা নাকি কাল থেকে অনির্বাণ দত্তের খোঁজ করছে। মেস ম্যানেজার বলেছেন, ওকে আগে কখনো দেখেননি। কৌশিকের ধারণা ও আদালতের প্রসেস-সার্ভার।

—আদালতের প্রসেস সার্ভার? সেটা কেমন করে বুঝলে?

—–না মানে, লোকটা মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছে মেসবাড়ির সামনে।

—লোকটার বগলে ছাতা আছে? পায়ে ক্যানভাসের জুতো? কাঁধে ঝোলাব্যাগ?

—না, তিনটের একটাও নেই।

—তাহলে ও আদালতের প্রসেস সার্ভার নয়। স্টেথো না নিয়ে ডাক্তার রোগী দেখতে যায় না। ছাতা না নিয়ে প্রসেস সার্ভারও কাউকে সমন ধরাতে যায় না। তুমি বাড়ি ফিরে এস দিকি। কৌশিকের যেমন কাণ্ড! ঘরের বউকে পথে বসিয়ে সারা কলকাতা চষে বেড়াচ্ছে।

সুজাতা নিউ আলিপুরের বাড়িতে ফিরে এল বেলা এগারোটায়। কৌশিক বেলা একটায়। বেচারি কৌশিক! সে নানান সম্ভাব্যস্থানে অনির্বাণের সন্ধান করেছে। অনির্বাণের একটা ছোট্ট দপ্তর আছে। শেয়ার মার্কেটের কাছাকাছি। শেয়ার কেনাবেচার খুপরি। অফিসে ও একাই বসে। কর্মচারী বলতে, এক মেনিপুরিয়া কম্বাইন্ড হ্যান্ড। গৌতম জানা। চিঠিপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করা, টেলিফোন ধরা এবং মেসেজ লিখে রাখা, ইলেকট্রিক হিটারে চা বানানো, সব কাজেই দক্ষ। সে যথারীতি সকালে দোকানের ঝাঁপ খুলে বসেছে তার টুলে। সাহেব যে কেন বেলা বারোটা পর্যন্ত অফিসে এলেন না, তা সে জানে না। তাঁর যে কলকাতার বাইরে যাবার সম্ভাবনা ছিল সে-কথা গৌতম আদৌ জানে না।… অথচ কিষেনলালজীর খবর : বাবুজী লম্বা পাড়ি জমাবার জন্য তৈয়ারী হয়েছেন। কোথায় গেছেন তা সে’ও জানে না।

করবীর সঙ্গেও কৌশিক দেখা করেছে। হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে। করবী জানে না, অনিবার্ণ কোথায়। তবে সে বলল, টেলিফোন করে আজ সন্ধ্যায় অনিবার্ণ ওর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল, সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ। করবী রাজি হতে পারেনি, তার অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকায়। সে তার অনিদাকে কাল সকাল আটটায় আসতে বলেছে। অনির্বাণ নাকি জবাবে টেলিফোনে বলেছিল, ব্যাপারটা জরুরী। আজ রাতে মিটিয়ে ফেললেই ভাল হয়। করবী তবু রাজি হয়নি। করবীর যে আজ সন্ধ্যায় কী জরুরী কাজ আছে, তা কৌশিক সৌজন্যবোধে জানতে চায়নি। করবীও বলেনি।

কৌশিকের মতে, অনিবার্ণ কলকাতার বাইরে যায়নি। কোন বিশেষ কারণে সে গা-ঢাকা দিয়ে আছে মাত্র। সম্ভবত সে কোনও উকিলের সমন এড়াবার জন্যই মেসে ফিরছে না। ঐ বৃদ্ধ প্রসেস- সার্ভারকে দেখেই এমন অনুমান করছে কৌশিক।

বাসু বললেন, কুতুব টী-র শেয়ার বেচে দেওয়া এবং নিজের নামে আবার কেনা নৈতিক দিক থেকে আপাতদৃষ্টিতে সমর্থনযোগ্য না হলেও অনির্বাণ বেআইনি কাজ কিছু করেনি। সে এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন? আমার মনে হয়, কিছু জটিলতার বিষয়ে অনির্বাণ আমাকে আদৌ জানায়নি।

কৌশিক জানতে চায়, আপনি কি বিকালে কোথাও বেরুবেন, মামু?

—কেন বল তো?

—না হলে সন্ধ্যা-নাগাদ করবীর বাড়ির কাছে-পিঠে একবার হানা দিতাম। অনির্বাণের সনির্বন্ধ অনুরোধ উপেক্ষা করল কেন করবী? আমার আন্দাজ : করবী সন্ধ্যায় তার কোনও প্রেমিকের বাড়ি অভিসারে যাবে। কার সঙ্গে ডেটিং করেছে? কোথায় যাচ্ছে? তা জানার দরকার। ব্যাপারটা ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠছে।

রানু বললেন, না, তোমার মামুর একটু সর্দির মতো হয়েছে। সন্ধ্যার পর আজ আর উনি বার হবেন না। তা সুজাতাকেও নিয়ে যাচ্ছ তো?

কৌশিক বললে, চলুক। বাড়ি বসে থেকেই বা করবেটা কী? তা হলে মামি, আপনারা আহারাদি সেরে নেবেন। আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রাত করবেন না। আমাদের ফিরতে কত দেরি হবে, তার তো ঠিক নেই।

বাসু বললেন, এসব ওয়াইল্ড গুজ চেজ-এর কোনও মানে হয়? শুনছ, করবী মেয়েটির একাধিক পুরুষ বন্ধু! সে কার সঙ্গে সিনেমা যাচ্ছে, কার সঙ্গে থিয়েটার বা রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে তা জেনে কি আমাদের আর দুটো হাত গজাবে? তাছাড়া…

রানু ধমকে ওঠেন, তুমি থাম তো দেখি। হ্যাঁ, কৌশিক, তোমরা গাড়িটা নিয়েই যাও। এক কাজ কর বরং : রাতে বাইরেই কোথাও খেয়ে নিও। তাহলে বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা খাবার খেতে হবে না।

বাসু ঢোক গিললেন।

ওরা দুজনে স্থানত্যাগ করার পর রানু বললেন, কোর্ট-কাছারি করে করে তোমার শুধু বুদ্ধিসুদ্ধি নয়, রসকষও সব লোপ পেয়ে গেছে। দেখছ, ওরা এই ছুতো করে গাড়িটা নিয়ে বিকেলে একটু বেরুতে চায়। চাইনিজ রেস্তোরাঁয় রাতে খাবে বলে আমাদের তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে বলল। আর তুমি…

বাসু সামলে নেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমার জন্য রাত্রে কী বানাতে বলেছ? খই-দুধ?

—না, সাবু!

—আই সী!