১৪
পরদিন সন্ধ্যায় বাসুসাহেবের লনে জমায়েত হয়েছে সবাই। অনিবার্ণ মুক্তি পেয়ে এসে জুটেছে। এসেছে করবীও এবং সস্ত্রীক ইন্সপেক্টর নিখিল দাশ।
রানু বললেন, আমি ভেবেছিলাম : কিংশুক।
বাসু বললেন, ঠিকই ধরেছিলে। তবে কালিপদ কুণ্ডুকে নয়। কিন্তু জোড়াখুনের দায়টা তো তারই!
জোড়া খুন! জোড়া খুন আবার হল কোথায়—জানতে চায় সুজাতা।
কৌশিক বলে, আপনে খালিচরণের চিফট্টাংটারেও মার্ডার বলি ধরতি ফার্লেন, মামু?
বাসু হেসে ফেলেন। বলেন, না ভাগ্নে! তা ধরিনি। ওটা বাদ দিয়েও জোড়া খুন। শোন বুঝিয়ে বলি : গোড়ায় গলদ করেছিল অনির্বাণ। কেসটা গুলিয়ে গিয়েছিল ওর একটা অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্ত অনুবাদে। কালিপদ টেলিফোনে ওকে বলেছিল পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে সে একটি ‘মৃতব্যক্তির দিনলিপি হস্তান্তরিত করবে’। অনিবার্ণ তার ভুল অনুবাদ করে সমস্যাটা গুলিয়ে দিল। ‘মৃতব্যক্তির দিনলিপি’ রাতারাতি হয়ে গেল ‘ডেড ম্যানস ডায়েরি’।
কবরী প্রতিবাদ করে, ভুল অনুবাদ কোথায় হল? ‘মৃতব্যক্তির দিনলিপি’ তো ‘ডেড ম্যানস’ ডায়েরি।
বাসু ওর দিকে ফিরে হেসে বললেন, ওভাবে জেন্ডার বদলানো যায় না করবী। বয়েজ কাট চুল কাটলেই কি স্ত্রীলোক পুরুষ হয়ে যায়? ‘ব্যক্তি’ উভলিঙ্গ শব্দ, ‘ম্যান’ পুংলিঙ্গ। ‘ডেড-ম্যান’ শুনে আমরা বারে বারে রঘুবীর সেনের কথা ভেবেছি। তিনি দিনপঞ্জিকা রাখতেন কি না এই খোঁজ করেছি। একবারও খেয়াল হয়নি, কালিপদ যে বাঈজীর আশ্রয়ে থাকত সেই মেয়েটি বেমক্কা খুন হয়ে গিয়েছিল। কালিপদকে পুলিসে ধরে, দীর্ঘদিন তাকে হাজতবাস করতে হয়। কালিপদর বিরুদ্ধে হত্যামামলা শেষ পর্যন্ত টেকেনি। সে মুক্তি পেয়ে ফিরে আসে। আর ঐ বাড়িতেই আশ্রয় পায়। বাঈজীর এক সঙ্গিনী ওকে একই বাড়িতে থাকতে দেয়। বাঈজীর মৃত্যুরহস্যের কোনও কিনারা হয়নি। আমার মনে হল : এমনও তো হতে পারে যে, কালিপদ ঐ বাড়িতে ফিরে এসে মৃতা বাঈজীর একটি দিনপঞ্জিকা উদ্ধার করেছিল। তাহলে সেটাও হবে ‘মৃতব্যক্তির দিনপঞ্জিকা।’ হয়তো তাতে এভিডেন্স আছে : কে বাঈজীকে খুন করেছিল। হয়তো বাঈজী সেই সম্ভাব্য হত্যাকারীর নাম, এবং কেন সে বাঈজীকে হত্যা করতে চাইছিল, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রেখে গেছে দিনলিপিতে।
আমার মনে হল, এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। —তাহলে ধরে নিতে হবে, বাঈজী লেখাপড়া জানা মেয়ে। যে পরিবেশে থাকত সেখানে সবাই অক্ষর পরিচয়হীনা। তাই ঐ দিনপঞ্জিকার প্রকৃতমূল্য কেউ বোঝেনি। হাজত থেকে ফিরে এসে কালিপদ কুণ্ডু সেটা পড়ে নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারে : কে বাঈজীকে খুন করেছিল।
—সেক্ষেত্রে দিনপঞ্জিকাটা কালিপদ থানায় গিয়ে জমা দিল না কেন? বলা কঠিন। অনেকগুলি হেতু হতে পারে। প্রথমত, দু-দুবার মিথ্যা অপরাধে হাজতবাস করে এদেশের বিচার-ব্যবস্থার উপরেই তার আস্থা হারিয়ে গিয়ে থাকতে পারে। তার আশঙ্কা হয়, যেহেতু পুলিস কেসটা ইতিপূর্বেই ডিসমিস করে দিয়েছে, তাই ঐ ডায়েরির মাধ্যমে তাকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে না। মৃত বাঈজীর তরফে থানাকে কেউ বারে বারে তাগাদা দেবে না। উপরন্তু হয়তো থানায় ঐ ডায়েরিটা জমা দিলে কোনও অসাধু পুলিস ওটার সুযোগ নেবে। ওর সাহায্যে দিব্যি একটা ব্ল্যাকমেলিং-এর ব্যবসা ফেঁদে বসবে। দু’দুবার হাজত বাস করা কালিপদ কিছুই করতে পারবে না।
—আমরা প্রমাণ করতে পারব না, কিন্তু আমার বিশ্বাস, এই জাতীয় চিন্তাধারা থেকেই কালিপদ কুণ্ডু প্রথম ব্ল্যাকমেলিং-এর কথা ভাবতে থাকে। সেও ছিল অত্যন্ত ধূর্ত। তাই ব্ল্যাকমেলিং-এর উদ্দেশ্যে সে বাঈজীর হত্যাকারীর দ্বারস্থ না হয়ে
বাধা দিয়ে রানু বলেন, ডায়েরিতে বাঈজী মেয়েটি কী লিখেছিল, সেটা আগে বলে দাও তো— তাহলে ঘটনা পরম্পরা বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।
বাসু বলেন, হতভাগিনীর নাম : বৈশাখী। ভদ্রঘরের এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের আদরের মেয়ে। পিতৃপরিচয়, পৈত্রিক উপাধি সে ডায়েরিতে জানায়নি। তবে যত্ন করে বাবা-মা যে ওকে গান ও নাচ শিখিয়ে ছিলেন সেকথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছে। ফার্স্ট ইয়ারে পড়বার সময় ওর পদস্খলন হয়। অতি পরিচিত— বস্তুত নিষিদ্ধ সম্পর্কের একটি যুবকের হাত ধরে ও ঘর ছাড়ে। বছরখানেক এখানে-ওখানে ঘোরে। সৌভাগ্যক্রমে ওর কোন সন্তানাদি হয়নি। তারপর একদিন রাতারাতি সে অথৈ জলে পড়ে যায়। যার হাত ধরে অকূলে নৌকা ভাসিয়েছিল সেই ছেলেটি ওর সর্বস্ব অপহরণ করে পালায়। ওরা তখন লক্ষ্ণৌতে। লজ্জায় এবং দুরস্ত অভিমানে সে সংসারে ফিরে আসতে পারেনি। গান ও নাচ দুটোই ভাল জানত। স্থানমাহাত্ম্যে লক্ষ্ণৌ-এর মতো শহরে ওর গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতে অসুবিধা হয়নি। তারপর বহু ঘাট ঘুরে বাঈজী— ততদিনে আর সে বৈশাখী নয়, ‘সাকী’ বাঈজী— এসে ঘাঁটি গাড়ল কল্লোলিনী কলকাতা শহরের হাড়কাটা গলিতে। কালিপদ কুণ্ডুর সঙ্গে ওর আলাপ এক গানের আসরে। দুজনের সম্পর্ক অচিরেই নিবিড় হয়ে পড়ে। প্রয়োজনটা দু-তরফা। কালিপদ তখন সবে হাজত থেকে বেরিয়ে এসেছে— পরিচিত পরিবেশে প্রত্যাবর্তন করতে অনিচ্ছুক; তার প্রয়োজন মাথার উপর একটা ছাদ। বাঈজীর প্রয়োজন একজন পুরুষ অভিভাবক- যে ওকে ‘মা’ ডাকে।
তারপর একরাত্রে বৈশাখী বেমক্কা খুন হয়ে গেল। ডায়েরি পড়েই জানতে পারছি, কালিপদ রাত্রে ঘুমাতো নিচের একটি ঘরে। বাঈজী কীভাবে দ্বিতলে খুন হয়ে গেল সে জানতে পারেনি। কিন্তু বাড়িতে উপস্থিত একমাত্র পুরুষ হিসাবে পুলিস তাকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল; বিশেষ করে তহবিল তছরুপের একটা ক্রিমিনাল রেকর্ড তার ছিলই।
দীর্ঘদিন হাজতবাস করে প্রমাণের অভাবে কালিপদ ছাড়া পায়। ঐ হাড়কাটা লেনের বাড়িতেই ফিরে আসে। বাড়িউলি মাসি ইতস্তত করছিল, কিন্তু সৌরভী নামের একটি মেয়ের আগ্রহে শেষ পর্যন্ত ওকে আশ্রয় দেয়। কালিপদ এই মেয়েটির সঙ্গেও মা-ছেলে সম্পর্ক পাতায়। কীভাবে কালিপদ ঐ বৈশাখীর দিনপঞ্জিকাটা উদ্ধার করেছিল তা আমরা জানি না। কিন্তু সেটা পাঠ করে ও সব কিছু বুঝতে পারে। ওদের বাড়িতে যারা খদ্দের হিসাবে আসত তাদের কথা সাকী লিখে রাখত তার দিনপঞ্জিকায়। তাদের মধ্যে ছিল একজন দীর্ঘদেহী আর্টিস্ট। লোকটার দাড়ি ছিল। মাঝে মাঝে ব্যাগে করে রঙ-তুলি-ঈজেল নিয়ে আসত। ন্যুড ছবি আঁকার অজুহাতে। লোকটার নাম ‘কিং’। পুরো নাম না জানত বৈশাখী, না কালিপদ। মত্তাবস্থায় এক রাত্রে ঐ কিং একজন দেহব্যবসায়িনীকে গলা টিপে মেরে ফেলে। দুর্ভাগ্যক্রমে বাঈজী সেটা দেখে ফেলে। সেটাই বাঈজীর মৃত্যুর কারণ। কিংশুক তার অপরাধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীকে জীবিত থাকতে দিতে চায়নি। সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে, বাঈজী তার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাটা, প্রত্যক্ষদর্শনের বীভৎসতার বিবরণ, দিনপঞ্জিকায় সবিস্তারে লিখে রেখে গেছে। কিংশুক বাঈজীর গহনার বান্ডিলটা নিয়ে যায় অর্থলোভে তো বটেই, তাছাড়া হত্যার মূল মোটিভটা চাপা দিতে।
কালিপদ বুঝতে পারে, ঐ দিনপঞ্জিকা কিং-এর বিরুদ্ধে মারাত্মক এভিডেন্স। কালিপদ পুলিসে যায় না। খুঁজতে থাকে নানা সূত্র ধরে। কিং-এর নাম আর ঠিকানা। একদিন তা খুঁজে পায়ও। হাড়কাটা গলির অনেক বাড়িতেই কিং-এর যাতায়াত ছিল ন্যুড ছবি আঁকার বাতিকে। আর জোড়াখুনের কোনও প্রমাণ বা সাক্ষী যে থাকতে পারে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
কালিপদ কিং-এর দেহাকৃতি দেখে ঘাবড়ে যায়। যে লোক দু-দুটো খুন করেছে তার পক্ষে তৃতীয় খুন করা অসম্ভব নয়। সে ডায়েরির খানকতক পৃষ্ঠা জেরক্স করে জয়ন্তীকে পাঠিয়ে দেয়। জয়ন্তী বুঝতে পারেন, ঐ ডায়েরিটা কিংশুকের বিরুদ্ধে জোড়াখুনের অকাট্য এভিডেন্স। মিসেস জয়ন্তী হালদার জেদী, একরোখা, দুর্দান্ত দুঃসাহসী মহিলা। পুত্রকে কিছুই বলেন না। নিজেই ব্যবস্থা নেন। স্থির করেন, নগদ টাকায় ঐ ডায়েরিটা কিনে নেবার লোভ দেখিয়ে কালিপদকে কোনও নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করবেন। কিংশুকের বাবার একটি রিভলভার ছিল। সেটা এখন জয়ন্তীর এক্তিয়ারে। কিন্তু তা দিয়ে কালিপদকে হত্যা করার মধ্যে বিপদ আছে। এই সময় জয়ন্তী একদিন করবীর শয়নকক্ষে একটা রিভলভার দেখতে পান। করবী জানায় সেটা অনির্বাণের। সে একা থাকে বলে অনির্বাণ ওটা তাকে রাখতে দিয়েছে। জয়ন্তী হালদার এক ঢিলে দুই পাখি মারতে উদ্যত হলেন। কালিপদ খুন হবে অনির্বাণের রিভলভারের গুলিতে; আর সেই সময় অকুস্থলে অনির্বাণের উপস্থিতিটাও দরকার। কালিপদ যে প্রক্সি ফর্ম সই করাতে করবীর কাছে এসেছিল এ খবর জয়ন্তী পেয়েছিলেন। উনি বুঝলেন, কালিপদ অচিরেই অনির্বাণের দ্বারস্থ হবে। হয়তো কালিপদ অনিবার্ণকে ঐ ডায়েরিটা বেচে দেবে। এ আশঙ্কাও ছিল। তাই উনি প্রথমেই কালিপদ কুণ্ডুকে ফোন করে বললেন, নগদ বিশ হাজারে উনি ডায়েরিটা কিনে নেবেন। রাত নয়টায় গলফ কোর্সে আসতে বললেন। উনি নিজে ঐ ক্লাবের মেম্বার। কালিপদও ফার্স্ট টী-র অবস্থান চেনে। তারপর উনি কালিপদ সেজে অনিবার্ণকে ফোন করেন। বলেন, সর্দিজ্বর হওয়ায় গলাটা বসে গেছে। উনি কথা শুরু করতেই অনির্বাণ হয়তো নিজে থেকে জানতে চেয়েছিল, ‘সেই ডেড ম্যানস ডায়েরিটার কী হল? ওটা বেচবেন?’ জয়ন্তী বুঝতে পারেন, কালিপদ ডায়েরি বিক্রি করার প্রস্তাব দিয়েছে— কিন্তু অনির্বাণ জানে না ডায়েরিটা কার। তাতে কী আছে না হলে ডেড ম্যানস বলবে কেন? জয়ন্তী তৎক্ষণাৎ বলেন, ‘সন্ধ্যা সাতটায় আমাকে ফোন করবেন। নাম্বারটা লিখে নিন।’
—নিজের ফোন নম্বরটাই দেন?
—হ্যাঁ, উপায় ছিল না। কিন্তু উনি নিশ্চিত জানতেন, কালিপদ খুন হলেই অনিবার্ণ ঐ নম্বর লেখা কাগজটা ছিঁড়ে ফেলবে। বাস্তবে ঘটেছিলও তাই।
—তাহলে সন্ধ্যা সাতটায় আমি যখন ফোন করলোম তখন উনি আর একটা ফোন নাম্বার দিলেন কেন? —জানতে চাইল অনির্বাণ।
—কারণ জয়ন্তী কোনও রিস্ক নিতে চাননি। সন্ধ্যা সাতটায় ঐ ঘরে কিংশুক থাকতে পারে বা অন্য কেউ থাকতে পারে। তাই হয়তো কোনও অছিলায় কিংশুককে কিছু কাজে পাঠিয়ে দিলেন। নিজেও বাড়িতে থাকলেন না। ওঁর মেড-সার্ভেন্টকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় কেউ যদি ফোন করে তবে তাঁকে একটা বিশেষ টেলিফোন নাম্বার দিতে। সেটা ওঁর বাড়ির কাছেই একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ। সাতটা বাজতে পাঁচে তিনি ঐ বুথে ঢুকে অপেক্ষা করেন।
করবী বলে, অনিদা ‘মৃতব্যক্তি’-কে ‘ডেড ম্যান’ অনুবাদ করায় আপনি পাঁচ কথা শোনালেন; কিন্তু ও যে ঐ চারটে নম্বর ঠিক ঠিক মনে রাখল সেজন্য ওকে কমপ্লিমেন্টস দিলেন না তো?
বাসু বলেন, কারেক্ট। ঐ ওয়ান এইট থ্রি সিক্স নম্বরটা যদি ও মনে রাখতে না পারত তাহলে এ কেস কিছুতেই সলভ করা যেত না। এ কৃতিত্ব নিশ্চয়ই অনির্বাণের!
করবী বলে, অথবা বলতে পারেন, এটা ঠাকুরের করুণা।
বাসু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলেন, অনির প্রতি ঠাকুরের অপার করুণা তো আছেই, না হলে ফাঁসির দড়ি থেকে এভাবে ফিরে আসত না। কিন্তু বেচারির প্রতি ঠাকুরানীর করুণা কি হবে না, বাইশতম জন্মদিনের পরে?
করবী দুহাতে মুখ ঢাকে।
সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে।
কৌশিক বাদে।
সে গম্ভীর হয়ে বলে ওঠে, ‘ও মা আমি কনে যাব! মামু! এডা কী কইলেন আপনে ঠাকরানের করুণা হবেনি বলি আপনি ভাবতে ফার্লেন? ঐ দ্যাহেন! মাঠান সরমে দুইহাতে তঁইর মুখ ঢাকিসেন!’
***