১৩
বুধবার সন্ধ্যারাত্রেই টিভিতে আবহাওয়া খবরে ঘোষণা করা হল যে, বঙ্গোপসাগরের কোথায় বুঝি নিম্নচাপ না ঊর্ধ্বচাপ কী যেন হয়েছে; ফলে এক পাগলা ঘূর্ণী ঝড় প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে। অন্ধ্র উড়িষ্যা না পশ্চিমবঙ্গ, কোনটাকে গিলে খাবে তা এখনো মনস্থির করতে পারেনি, সেই ‘মেহরালি’ মার্কা পাগলা ঝড়!
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই এলোমেলো হাওয়া আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আকাশের বদনখানি যেন পাগলাগারদের উদাসী বাসিন্দার ঘোলাটে চোখের তারা। আকাশের এমন হাল দেখেই বড়-সারেঙ বোধ করি শ্রীকান্তকে বলেছিল, ‘বাবু, আজ ছাইকোলন হতি পারে।’
বাসুসাহেবের সর্দির ধাত। রানু সকাল থেকেই ওঁর গলায় একটা কঙ্কাটার জড়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু তাঁকে রোখা গেল না। বর্ষাতি চড়িয়ে ছাতা মাথায় তিনি গেলেন সরেজমিনে তদারকি করতে। তার ঘণ্টাকয়েক আগেই কৌশিকের ব্যবস্থাপনায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রির দল ভ্যানটা নিয়ে গলফ ক্লাবে চলে গেছে। নিখিল পৌঁছেছে তার আগেই।
বেলা এগারোটার মধ্যেই সব কাজ সারা হয়ে গেল। নিখিল কেয়ারটেকারকে বলল, আজ রাতে প্লেন-ড্রেস পুলিশ সারা মাঠে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবে। আপনি আপনার দরোয়ান আর ওয়াচম্যানদের ছুটি দিয়ে দিন।
—আর আমি নিজে? আমি থাকব না?
—লুকিয়ে বসে দেখতে চান তো থাকুন। কিন্তু গোলাগুলির ব্যাপার। আপনি ছাপোষা মানুষ! কী দরকার?
কেয়ারটেকারের ধারণা এখানে কিছু সমাজবিরোধী উগ্রপন্থীকে কব্জা করার ব্যবস্থা হচ্ছে। সে রাজি হয়ে গেল স্থানত্যাগে। আপনি বাঁচলে পিতাঠাকুরের নাম!
রাত সাড়ে আটটা।
সাইক্লোনটা দিকভ্রষ্ট হয়ে কুমিল্লার দিকে চলে গেছে; কিন্তু তার লেজুড়ের দাপটও বড় কম নয়। গলফ ক্লাব রোডের যাবতীয় বড় বড় গাছ পাগলা হাতির মতো মাথা দোলাচ্ছে। প্রভঞ্জনের বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদ। পথে যান চলাচল সন্ধ্যার আগে থেকেই কমে গেছে। দু- একটি পাবলিক বাস গ্যারেজ-মুখো হবার আগে শেষ খেপ মারছে। তাদের পাদানি ঘরেফেরা মানুষে উপচীয়মান। কখনো বা রেডক্রস ছাপ মারা কোন ডাক্তারবাবু চলেছেন অপ্রতিরোধ্য অন্তিম ‘কল’ পেয়ে। ত্রিসীমানায় জনমানব নেই।
রাত আটটা পঁয়ত্রিশ—
গলফ ক্লাবের গেটে এসে থামল একটা মোপেড। তার কেরিয়ারে একটি প্লাস্টিকে জড়ানো ব্যাগ। আরোহীর মাথায় হেলমেট, চোখে গগলস। পরনে ওয়াটারপ্রুফ। পায়ে গামবুট। গাড়িটা গাছতলায় পার্ক করে দীর্ঘদেহী আরোহী এগিয়ে এল ক্লাবের প্রবেশদ্বারের কাছে। মজবুত নবতাল তালা ঝুলছে অলড্রপ থেকে। লোকটি এদিক-ওদিক দেখে দিয়ে হাঁকাড় পাড়ল : ‘বেয়ারা! …দারোয়ান’!
যেন ওয়ালটার ডি লা মেয়ারের সেই বিখ্যাত কবিতা : ‘দ্য লিনার্স’!
প্রতিধ্বনিটাই ফিরে এল শুধু। কান পাতলে শোনা যেত রাতচর একটা প্যাঁচা তার চ্যাঁচানি থামিয়েছে। গলফ ক্লাবের অসংখ্য মেম্বারদের অনুপস্থিতিটা যেন সোচ্চার হয়ে উঠল সেই প্রতিধ্বনিতে।
আগন্তুক নিশ্চিন্ত হল : তাহলে ত্রিসীমানায় কেউ নেই।
ফিরে এল সে মোপেডের কাছে। গা দিয়ে তার জল ঝরছে। বৃষ্টিটা থেমেছে; কিন্তু ইলশেগুঁড়ির বিরাম নেই। দীর্ঘদেহী আরোহী মোপেডে উঠে আবার চলল গলফ্ ক্লাব রোড ধরে। প্রায় তিনশ মিটার এগিয়ে এসে সে আবার তার দ্বিচক্রযানকে থামালো। নেমে এল গাড়ি থেকে। পিছনের প্লাস্টিকে জড়ানো ব্যাগ থেকে কী একটা জিনিস ভরে নিল ওয়াটারপ্রুফের পকেটে। গাড়িটা লক করে এগিয়ে গেল গলফ ক্লাবের প্রাচীরের দিকে। এখানে পাঁচিল অনেকটা ভাঙা। চাপ-চাপ ইটের পিণ্ড আর অন্ধকার।
আগন্তুক ইটের ভগ্নস্তূপ ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকল। এ জায়গাটা আলো-আঁধারি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ- সি. ই. এস. সি.-কেও এই দুর্যোগের রাত্রে এ পাড়ায় লোডশেডিং হয়নি। রাস্তায় নিয়ন আলোর স্তিমিত উপস্থিতি। ক্লাবের গলফ কোর্স তাই নিরন্ধ্র অন্ধকার নয়। কিছু দূরে দূরে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে গাছের দল। তারা ওকে দেখছে। ক্লাবঘরের পিছন দিকে টিমটিমে বাতিটার তহবিলে কত ক্যান্ডেল-পাওয়ার মজুত তার হিসাব জানা নেই। কিন্তু মাঠের এপ্রান্তে তার অবদান যৎকিঞ্চিত। কোনক্রমে ইটের ভগ্নস্তূপ ডিঙিয়ে আগন্তুক পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল ক্লাবঘরের পিছনদিকে। মনে হচ্ছে না যে, কলকাতা শহরের চৌহদ্দির ভিতরেই আছে। ও যেন কোন্ শ্রাবস্তী-নালন্দার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এসে পড়েছে। কিছু ঝিঁঝিপোকা আর অকালবর্ষণে উৎফুল্ল দর্দুরোচ্ছ্বাস ব্যতীত প্রাণের কোন স্পন্দন নেই। লালটালির বারান্দাটা ওখান থেকে তিনশ মিটার দূরে, আর ফার্স্ট টী- সেই যেখানে অন্তিমশয়ানে লুটিয়ে পড়েছিল হতভাগ্য কালিপদ কুণ্ডু— সেটা একশ মিটার হয়-কি-না হয়।
আগন্তুকের বর্ষাতির পকেটে আছে তিন ব্যাটারির টর্চ। কিন্তু সেটা জ্বালতে ভরসা হল না। এমন বর্ষণমুখর রাতেই ফুটপাতের বাসিন্দার দল আসে ইট তুলে নিয়ে যেতে। টর্চের আলো দেখলে ওয়াচম্যান হয়তো ছুটে আসবে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ওটা কী?
হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছে! ফার্স্ট টী-র তৃণাচ্ছাদিত প্রত্যাশিত স্থানে কে একজন বসে আছে। একটা টিনের ফোল্ডিং চেয়ার পেতে। তার পরনে বর্ষাতি, মাথায় টুপি। তার উপরে কাঁধে ছাতা। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। আশ্চর্য! লোকটা একেবারে নড়াচড়া করছে না। ধ্যানস্থ। নাকি ঘুমাচ্ছে? ক্লাবঘরের দিকে পিছন ফিরে। অর্থাৎ ওর মুখোমুখি। কিন্তু ছাতার আড়ালে মুখখানা দেখা যাচ্ছে না।
প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে পৌঁছতেই লোকটা সরব হয়ে উঠল :
—আয়েন, আয়েন। ফের্থম্ কিস্তির ট্যাহাটা আছেন? বেবাক খুচরা নোটে তো? ফাঁচ হাজার তো?
আগন্তুক জবাব দিল না।
তিল তিল করে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল।
দূরত্বটা ক্রমশ কমে আসছে।
— ব্যস, ব্যস! খাড়ান! আর এগুবেন না কিন্তুক!
বলল বটে, কিন্তু নিজে তিলমাত্র বিচলিত হল না। নড়লও না!
আগন্তুক বললে, সে কি খালিচরণ? তুমি না দরদামের আলোচনা করতে চেয়েছিলে? এই নির্জন মাঠে? খাতাখানা কত টাকা পেলে দেবে? ঠিক বল তো সোনা!
চেয়ারে বসা লোকটা গর্জন করে উঠল : আই সে, ডোন্ট প্রসীড ফাদার, অর এলস্…
কথাটা তার শেষ হল না। তার আগেই গর্জে উঠল আগন্তুক : বিফোর দ্যাট টেক দিস, অ্যান্ড দিস, অ্যান্ড দিস…
কথাগুলো ভালো শোনা গেল না। কারণ প্রতিটি দিস’-এর সঙ্গে গর্জে উঠল ওর ডানহাতের মুঠিতে ধরা মারণাস্ত্রটা।
খণ্ডমুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল একাধিক ঘটনা।
প্রথম গুলিটা খেয়েই চেয়ারে বসা লোকটা উল্টে পড়ল চেয়ার সমেত। দ্বিতীয় আর তৃতীয় গুলিটা তার গায়ে লাগল কি না বোঝা গেল না; কিন্তু সামনের অর্জুন গাছটার ডালে ঝোলানো একটা জোরালা সার্চ-লাইট জ্বলে উঠল। আলোর বন্যায় ভেসে গেল গোটা এলাকাটা।
উল্টে-পড়া লোকটা চিৎকার করে বলল, ড্রপ দ্যাট রিভলভার অ্যান্ড পুট য়োর হ্যান্ডস আপ, মিসেস হালদার।
আশ্চর্য! উল্টে-পড়া লোকটা মরেনি!
আগন্তুক জোরালো আলোর ঝলকানিতে দুহাতে চোখ ঢেকেছিল। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল। জনমানবশূন্য গলফ কোর্সে কাউকে দেখতে পেল না।
ভূলুণ্ঠিত ঐ লোকটাই আবার বলল, মিসেস হালদার! আপনাকে চারদিক থেকে সশস্ত্র পুলিশে ঘিরে ফেলেছে। রিভালভার মাটিতে ফেলে দিয়ে দুহাত মাথার ওপর তুলুন। না হলে ফায়ারিং-এর অর্ডার দিতে বাধ্য হব কিন্তু। ওরা আপনার দুটো হাঁটুতে গুলি করবে। আপনার দুটো পা-ই অ্যাম্পুট করতে হবে।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতিটা হৃদয়ঙ্গম করল জয়ন্তী হালদার। তিন-তিনটে বুলেট সমেত আগ্নেয়াস্ত্রটা মাটিতে ফেলে দিয়ে মাথার ওপর হাত তুলল সে। চতুর্দিক থেকে ছায়ামূর্তির দল এগিয়ে এল তৎক্ষণাৎ।
মিসেস হালদারের কৌতূহল তখনো মেটেনি। ঝুঁকে পড়ে ভূলুণ্ঠিত কালিচরণকে দেখতে গেল। ততক্ষণে ইন্সপেক্টর নিখিল দাশ পৌঁছে গেছে অকুস্থলে। সে বললে, ওটা ডামি! ওর তলপেটে লাগানো ছিল একটা লাউড-স্পীকার। লাউড অবশ্য নয়, নর্মাল ভয়েসের জন্য রিয়স্ট্যাটটা অ্যাডজাস্ট করা ছিল। সেটা ওর বুকে লাগাইনি, কারণ আশঙ্কা ছিল আপনি বুকেই গুলিটা মারবেন। দামী যন্ত্রটা খুব বাঁচিয়ে ফায়ার করেছিলেন— থ্যাঙ্কু! যা হোক, এবার আসুন, মিসেস হালদার।
অমায়িক আহ্বান শুনে মনে হতে পারে, নিখিলের হাতে বুঝি কফির কাপ অথবা থামস্ আপ-এর বোতল। আসলে তা নয়। নিখিল বাড়িয়ে ধরেছে একজোড়া স্টেনলেস স্টিলের বালা।