১২
একাই এসেছেন বাসুসাহেব।
গাড়িটা পার্ক করে লক করলেন। সন্ধ্যা-সঙ্গীতের আসর শুরু হয়ে গেছে। প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রীটের এ অঞ্চল দিয়ে বিশেষ জাতের মানুষ ছাড়া লোকজনের যাতায়াত কমে গেছে। ঠুঠান করে রিকশা চলছে— পর্দা ফেলা। বেলফুলের মালা ফিরি করতে করতে একটা লোক রাস্তার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে চলে গেল। ফুলুরি-পিঁয়াজিওয়ালা উনুনে সবে আগুন দিয়েছে। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া যেন প্রেমচক্রের পাকে-পাকে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটকে অজগর সাপের মতো জড়িয়ে ফেলেছে।
বাসুসাহেব যথারীতির স্যুটেড-বুটেড। দেওয়ালে নম্বর-প্লেট খুঁজে দেখছেন। একটা নম্বরও পড়া যায় না। সামনের একটি দরজার আধখানা ফাঁক করে দু-তিনটি যুবতী ও প্রৌঢ়া মুখ বার করে দেখছে। তাদের প্রসাধন উগ্র, খোঁপায় ফুঁইয়ের মালা। বাসু সেদিকে যেতেই একজন প্রৌঢ়া এগিয়ে এল মহড়া নিতে। বলল, এ বাড়িতে সব ঘর ভর্তি বাবু, লোক বসাবোনি। এগুয়ে দেখুন।
‘লোক-বসানো’— এ পাড়ার একটি বাঁধা লবজ; যোগরূঢ় অর্থে প্রয়োগ হয়। বাসুসাহেব প্রস্টিট্যুট-কোয়ার্টার্সে খুনের মামলা একাধিক করেছেন। অর্থগ্রহণে বাধা হল না তাঁর। বললেন, না, মা! আমি একটা নম্বর খুঁজছি। ‘একশ সাতের তিনের সি’ নম্বরটা কোন দিকে হবে বলতে পারেন, মা?’
‘মা’ এবং ‘আপনি’ সম্বোধনে প্রৌঢ়া বুঝতে পারে এ অন্য জাতের মানুষ। বললে, নম্বর বললি তো চিন্তে পারবনি বাবা, যাঁরে খুঁজছেন, তেঁনার নামটা বলেন?
বাসু বলেন, নামটা তো জানি না মা, তবে মেয়েটি মডেলিং-এর কাজ করে…
—কিসের কাজ করে?
—ঐ ফটোগ্রাফারের সামনে… বিজ্ঞাপনের জন্য.. মানে…
পাশের মেয়েটা আগবাড়িয়ে বলে, বুইচি দাদু, ঐ গা-দেখানো পোজ দিতে হয় আর কি!
বাসু বলেন, সে বাড়িতে একজন বাঈজী গত বছর খুন হয়ে যায়। আর সে বাড়িতে যে তবলচি ছিল তাকেই পুলিসে ….
—বুইচি, বুইচি, কালিখুড়ো তবলচির কতা বুলছেন। ঐ হলুদ রঙের ঝুল বারান্দাবালা ভাঙা বাড়িটে… বাড়িউলি মাসি ঐ ডাঁড়িয়ে আছে। অরে গিয়ে বলুন। গা- দ্যাখানো মাগিটার নাম সৈরভী।
অসতর্কভাবে বাসু অভ্যাসবশে বলে বসেন : থ্যাঙ্কু।
শুনে ওরা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে।
বাড়িউলি মাসি কিন্তু এককথায় ভিতরে ঢুকতে দিল না। বললে, কতক্ষণ বসবে, বাছা? বাড়িউলি ওঁর মেয়ের বয়সী।
‘বাছা’ সম্বোধন বহু দশক শোনেননি। বললেন, তা আধঘণ্টা-খানেক লাগবে। সৌরভী আছে?
—আছে। এট্টু ডেরী হবে। ওর গা-ধোওয়া হয়নি একনো। আর আধঘণ্টার জন্যি পঞ্চাশ ট্যাকা লাগবে।
বাসু একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে বাড়িউলি মাসির হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রায় ওর কানে-কানে বলেন, সৌরভীকে বলুন, ওকে আমি ছোঁব না। গা ধুয়ে আসার দরকার নেই। মোটামুটি ভদ্র পোশাকে এসে বসুক। আমি একজন উকিল। এসেছি কালি কুণ্ডুর হত্যা মামলার তদন্ত করতে।
মাসি পঞ্চাশ টাকার নোটখানা ফেরত দেবার জন্য বাড়িয়ে ধরে। বলে, এ্যাই লাও গো লাগর, তোমার লোট। সৈরোভী কোর্ট-কাছারির মধ্যি যাতি পারবে না! বাস রে! বাঘে ছুলে আঠারো ঘা।
বাসু জবাব দেবার আগেই ওপাশ থেকে একটি শ্যামবর্ণা সুতনুকা বলে ওঠে : কালিখুড়োর খুনের ব্যাপারে কী জানতি চান আপনি? আমিই সৈরভী। আসেন, ভিতরে আস্যে বসেন।
মাসি চিকুড় পাড়তে থাকে, মরবি তুই, সৈরভী! বাঘে ছুলি আঠারো ঘা, কিন্তুক পুলিশে ছুলি ছত্তিশ!
অভ্যাশবসে সৌরভী তার খদ্দেরকে নিয়ে এসে ঘরে বসিয়ে দোরে আগড় দিল। একটি মাত্র জানলা আছে ঘরে। রাস্তা দেখা যায়। সেটাও বন্ধ করে টাওয়ার-বোল্ট লাগালো। চৌকিতে বসবে-কি-বসবে না ইতস্তত করছিল। বাসু বললেন, বসো মেয়ে। তুমি আমার নাতনির বয়সী। আমাকে সঙ্কোচ কর না। তোমার মাসিকে বলেছি, সেটা তুমি শুনতে পেয়েছ কি না জানি না, আবার বলছি : তোমাকে আমি ছোঁব না। না, না, ঘৃণায় নয়। সে অর্থে ‘ছোঁব না’ বলিনি, তুমি প্রণাম করলে আমি তোমার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করব।
তৎক্ষণাৎ মেয়েটি নত হয়ে বৃদ্ধের পাদস্পর্শ করে প্রণাম করে। বাসু তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, তুই এ-বাড়িতে কতদিন আছিস রে, সৌরভী?
—তা পাঁচ-সাত বছর হবে দাদু। কেন বল তো?
—কালিপদবাবু লোক কেমন ছ্যাল রে?
বাসুসাহেবের খানদানি পোশাকে মেয়েটা এতক্ষণ সিঁটিয়ে ছিল। এবার ওঁর ‘উরুশ্চারণ’ শুনে মেয়েটি আশ্বস্ত হল। বলল- খুব ভাল লোক। কারও সাত-পাঁচে থাকতনি। কারও ঘরে রাত কাটাতে যেতনি। আমারে ‘মা’ ডাকত।
—ও ফৌত হবার পর ওর জিনিসপত্র নিয়ে যেতে কোনও সুম্বুদ্ধির পো আসেনি?
—কালিখুড়োর তিনকুলে কেউ ছ্যাল নাকি যে, নিতি আসবে?
—ওর ট্যাকাপয়সা, জামাকাপড় সব কোথায় থাকত রে?
—ট্যাকাপয়সা তো ঘোড়ার ডিম, জামাকাপড়ও ছ্যাল না। থাকার মধ্যে ছ্যাল এক বান্ডিল দস্তাবেজ। ঐ তো দেখ না কেনে, পড়ি আছে ঐ শুটকেসে।
চৌকির নিচে থেকে সৌরভী টেনে বার করল স্যুটকেসটা। তাতে কালিপদর কিছু গেঞ্জি, শার্ট, পায়জামা আর এক বান্ডিল স্বাক্ষরিত ব্ল্যাঙ্ক প্রক্সি-ফর্ম।
বাসু জানতে চান, এ কাগজগুলো কী করবি?
—পুরানো কাগজের দরে বেচে দেবে নে। তা দু-ট্যাকা হবেই।
বাসু ওর হাতে একটা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, কাগজগুলো আমি নিয়ে গেলাম রে সৌরভী। তোদের কাছে এর কোন দাম নেই; কিন্তু অন্যলোকের কাছে আছে।
সৌরভী খুশিতে ডগমগ। বলল, বাড়িউলি মাসিরে যেন বলনি। তাইলে এ ট্যাকা কেড়ে নেবে। আর তুমি আমারে যখন এত ট্যাকা দিলে তাইলে তোমারে আর একটা দামী জিনিস দেখাই দাদু। দেখবা?
—কী জিনিস?
এবার আঁচলের চাবি দিয়ে সৌরভী একটা টিনের তোরঙ্গ খুলল। তা থেকে বার করে দিল একটা খাতা।
—কী এটা?
—তা জানিনে, দাদু। কালিখুড়ো বলিছিল, খুব যত্ন করি রাখি দে, সৈরভী। কারেও দেখতে দিস না।
বাসু পাতা উল্টে দেখলেন। একটা দিনপঞ্জিকা! হ্যাঁ, মৃত ব্যক্তির দিনপঞ্জিকাই বটে! যা কালিপদ কুণ্ডু হস্তান্তর করতে চেয়েছিল অনিবার্ণকে। পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে। বাসু বললেন, তুই জানিস না এটা কী?
—তোমার মাতা খারাপ, দাদু! আমি কি নেকাপড়া জানি?
—তাহলে এটাও আমি নিয়ে যাই?
—তা নাও না। একশ টাকা বকসিস দেবার হিম্মৎ কয়জনের হয়? নাও। কালিকাকা তো আর ফিরে আসবেনি। তুমিই নাও।
বাসু বলেন, তাহলে এ পাঁচখানাও রাখ। ভয় নেই রে, বাড়িউলি মাসিকে কিছু বলব না আমি।
পাঁচখানা একশ টাকার নোট হাতে নিয়ে বজ্রাহত হয়ে গেল সৌরভী। আধঘণ্টায় ছয়শো টাকা! বাসুসাহেব উঠে দাঁড়াতে আবার ঢিপ করে প্রণাম করল।
কাগজপত্র দুই পকেটে বোঝাই করে ব্যারিস্টার পি. কে. বাসু যখন পথে নামলেন ততক্ষণে জনপদবধূদের পল্লীটি জমজমাট।
এক মাতাল অপর মাতালকে কনুইয়ের গোঁত্তা মেরে বললে, দ্যাখ রে শালা, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ! সাহেব সেজে বেশ্যাপাড়ায় এসেছে! শাল্লাহ্!
.
রানু বললেন, গাড়ি নিয়ে একাএকা কোথায় গিয়েছিলে? কৌশিক রাগারাগি করছিল।
বাসু বললেন, যে পাড়ায় গেছিলাম সেটা বে-পাড়া। সেখানে কৌশিককে নিয়ে যাওয়া যায় না।
—তার মানে?
—হাড়কাটা গলি।
রানু আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।
বাসু ঢুকে গেলেন স্টাডিতে। ফ্যানটা খুলে দিয়ে এসে বসলেন, তাঁর ঘূর্ণমান চেয়ারে। টেবিল-ল্যাম্পটা জ্বেলে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সেই ‘মৃতব্যক্তির দিনলিপির’ ওপর।
আদালত অঞ্চলে ‘ডেড-পার্সন্স ডায়েরি’-র দারুণ কদর। একটা লোক দু-এক বছর বা দু-পাঁচ মাস আগে তার দিনপঞ্জিকায় কিছু লিখে গেছে। বিশেষত হস্তরেখাবিদ ‘সার্টিফাই’ করছেন যে, সেই দিনলিপিতে প্রক্ষিপ্ত কিছু ঢোকেনি। তা কোন ভাবেই ‘ট্যাম্পার’ করা হয়নি, তা হলে আদালত মহলে তার মূল্য অসীম। কারণ যে লোকটা দিনলিপি লিখে ফৌত হয়েছে সে তো জানতো না ভবিষ্যতে কোনও অপরাধ হবে কি না, কে খুন হবে। কে খুনের অপরাধে ধরা পড়বে।
ডায়েরি পড়তে পড়তে একেবারে তন্ময় হয়ে গেলেন বাসুসাহেব। তাঁর ঠোঁটে থেকে ঝুলছে তামাকঠাশা পাইপ। বাঁ হাতে দেশলাই আর ডানহাতে দেশলাই কাঠি। জ্বালাবার সুযোগ হয়নি। এতই তন্ময়। তিল তিল করে রহস্যজাল ভেদ হয়ে আসছে।
কেন অমন নির্বিরোধী অজাতশত্রু মানুষটা এমন বেমক্কা খুন হল।
আর কেনই বা সে ওটা থানায় গিয়ে জমা দেয়নি। ঘণ্টাখানেক পরে স্টাডি রুম থেকে বার হয়ে এলেন উনি। রানু বসেছিলেন লিভিং রুমে। উলের একটা সোয়েটার বুনছিলেন। বললেন, তন্ময় হয়ে কী পড়ছিলে এতক্ষণ?
—তন্ময় হয়ে? কেমন করে জানলে ‘তন্ময় হয়ে’।
—সহজেই। এর মধ্যে দুবার ও ঘরে গিয়েছি। তোমার খেয়াল হয়নি। তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, চা-কফি কিছু খাবে কি না। তুমি আমার কথা শুনতেই পাওনি।
উনি হাসলেন। পাইপটা এতক্ষণে ধরালেন। বললেন, হ্যাঁ, রানু, আমি ঘণ্টাখানেক খুবই থ্রিলিং একটা কিছু পড়ছিলাম।
—কোন বই?
—না। ‘আ ডেড পার্সনস্ ডায়েরি!’
—যেটা কালিপদ কুণ্ডু পাঁচ হাজার টাকায় অনিবার্ণকে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন?
—নাইন্টি-নাইন পার্সেন্ট চান্স, সেটাই।
—নাইন্টি-নাইন? তাহলে বাকি এক পার্সেন্ট ঠিক কি না কে বলবে?
—অপর্ণা দেব।
—সে আবার কে?
—তুমি টেলিকমিউনিকেশনের অশোক মুখুজ্জেকে একবার ধরতো। রেসিডেন্স নাম্বারে। একটু পরেই টেলিফোনে যোগাযোগ করা গেল।
অশোক বললে, না মামু, অপর্ণা এখনো লিস্টটা শেষ করতে পারেনি। মুশকিল হয়েছে কি, অনেক নাম্বার প্রতি সপ্তাহেই বদলে যাচ্ছে তো। এক্সচেঞ্জগুলো ইলেকট্রনিক সিস্টেমের আওতায় এসে যাচ্ছে বলে। ও প্রায় আধাআধি শেষ করেছে। গোটা পঞ্চাশ নাম-ঠিকানা এ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করতে পেরেছে, যাদের শেষ চারটে ডিজিট হচ্ছে 1836।
—অলরাইট, অলরাইট। সেই ইনকমপ্লিট তালিকাটা কার কাছে আছে?
—অপর্ণার কাছে এক কপি আছে। আমার কাছেও একটা জেরক্স কপি আছে।
—তোমার অফিসে?
—আজ্ঞে না, আমার অ্যাটাচি কেসে।
—থ্যাংক গড! লেটস ট্রাই আওয়ার লাক। কে জানে হয়তো ঐ প্রথম পঞ্চাশটা নামের ভিতরেই আমার ‘ছুপে-রুস্তম’ ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে আছেন। তুমি ঐ পঞ্চাশটা নাম ঠিকানা পড়ে শোনাও দেখি।
—এক মিনিট, স্যার। আমি ওঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসি।
বাসু টেলিফোনটা ধরে অপেক্ষা করলেন। একটু পরেই অশোক ফিরে এল টেলিফোনে।
—হ্যালো?
—হ্যাঁ, বলো?
—আপনি কাগজ পেন্সিল নিয়েছেন?
—না। তার প্রয়োজন নেই। আমি একজনকে সন্দেহ করছি যার টেলিফোনের নম্বরের শেষ চারটি সংখ্যা হচ্ছে 1836; তুমি সেই নামটা উচ্চারণ করলেই আমার উদ্দেশ্য সফল, না করলে আমি বলব, অপর্ণাকে বল তার বাকি গবেষণা চালিয়ে যেতে।
অশোক ধীরে ধীরে একটি দীর্ঘ নামের তালিকা, যে ভাগ্যবান অথবা হতভাগ্যের রেসিডেন্সিয়াল টেলিফোনের শেষ চারটি সংখ্যা 1836- পড়ে যেতে থাকে।
নামটা পড়া হতেই বাসু বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, থ্যাঙ্কস, মুখার্জি। যা খুঁজছি তা পেয়ে গেছি। অপর্ণাকে বল, আর পরিশ্রম করতে হবে না। কবে তাজ-বেঙ্গলে’ আসবে তা পরামর্শ করে স্থির কর। ছুটির দিন হলেই সবার সুবিধা।
অশোক অবাক হয়ে বলে, যাকে খুঁজছেন তাকে পেয়ে গেছেন?
— ইয়েস!
—আমি লাস্ট নেম যা বলেছি— যখন আপনি আমাকে থামতে বললেন, সেই নামটা জে. এম. ঠক্কর। ‘ঠক্কর’ বোধহয় গুজরাতি টাইটল না মামু?
—বোধহয় তাই। ঠিক জানি না। কিন্তু তোমার ও ধারণাটা ভুল। আমি যে নামটা খুঁজছি, প্রত্যাশা করছি, সেটা উচ্চারণ মাত্রেই আমি তোমাকে থামতে বলিনি।
—কেন? সেটাই তো স্বাভাবিক।
—সব সময় স্বাভাবিক কাজটা করতে নেই। তা করলে তুমি অপরাধীকে তৎক্ষণাৎ চিহ্নিত করতে। সেটা আমি চাই না। আমার গোপন কথা আমি আপাতত আস্তিনের তলায় লুকিয়ে রাখতে চাই। এনি ওয়ে, থ্যাংস অ্য লট।
টেলিফোনটা ক্র্যাডেলে নামিয়ে রাখলেন।
রানু জানতে চান, তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে?
—ইয়েস। নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট সংগ্রহ করেছি হাড়কাটা গলিতে; বাকি এক পার্সেন্ট সরবরাহ করল অপর্ণা দেব।
—কালিপদকে গুলিটা কে করেছিল তা জানতে পেরেছ?
—নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমি জানলেই তো হবে না। আমাকে কনভিন্সিং এভিডেন্স যোগাড় করতে হবে। দাঁড়াও একটা ফাঁদ পাতি। দেখি পাখি ধরা পড়ে কি না। তুমি ‘স্যার’কে একবার ধর তো। কানাই সচরাচর টেলিফোন ধরে। তার কাছে আগে জেনে নিও যে, স্যার…
—জানি, বাপু জানি।
বৃদ্ধ পি. কে. বাসু বার আট-ল’র কাছে কলকাতা শহরে প্রণম্য একজনই এখনো জীবিত- তিনি ওঁর ‘স্যার’, ব্যারিস্টার এ. কে. রে। নব্বই ছুঁই ছুঁই। এঁরই অধীনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বাসুসাহেব, জুনিয়র হিসাবে।
রে-সাহেব জেগেই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। বাসু বললেন, একটা ব্যাপারে আপনাকে বিরক্ত করতে বাধ্য হলাম, স্যার!
—’স্টেট-ভার্সেস-অনির্বাণ দত্ত’ কেস সংক্রান্ত?
—আপনি ট্র্যাক এখছেন?
—বাঃ! কেসটা যে তোমার!
—আজ্ঞে হ্যাঁ, ঐ ব্যাপারেই। মনে হচ্ছে আসল ঘুঘুকে চিহ্নিত করতে পেরেছি; কিন্তু কনভিকশন পেতে হলে তাকে লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলতে হবে। তাই…
—মাই সার্ভিস ইজ অ্যা য়োর ডিপোজাল। বল, কী চাও?
—R.C.G.C. ক্লাবের আপনি প্রেসিডেন্ট, আমি খবর নিয়েছি। ঐখানেই কালিপদবাবু খুন হয়েছিল। ঐখানেই ফাঁদটা পাততে হবে আমাকে। পরশু দিন, মানে আগামী বৃহস্পতিবারে। আমার কিছু কর্মী সকালে যাবে, কিছু গ্যাজেট পেতে আসবে। আপনি শুধু কেয়ারটেকারকে টেলিফোনে জানিয়ে রাখুন।
—এ তো সহজেই করা যাবে: কিন্তু বৃহস্পতিবার ক্লাব বন্ধ থাকে তা জান তো? ওটা ড্রাই-ডে।
—সেই জন্যই বৃহস্পতিবারটাকে বেছে নিয়েছি। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া সহজ।
—আমিও সেটা আন্দাজ করেছি। বেস্ট অফ লাক্!
মামীর কাছে খবর পেয়ে দুই লেজুড়ই এসে হাজির : কৌশিক আর সুজাতা। ওদের প্রশ্ন . করতে হল না। বাসু বললেন, হ্যাঁ, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। নিতান্ত ঘটনাচক্রে। অনিবার্ণ যে ‘ডেড-ম্যানস্ ডায়েরি’র কথা বলেছিল, সেটা পেয়ে গেছি।
—কোথায় পেলেন?
—কালিপদ কুণ্ডুর ডেরায়। শোন কৌশিক, কাল সকালে ঐ ডায়েরির খানকতক পৃষ্ঠা আমি নিজে জেরক্স করে আনব। না, সরি! তোমাদের কাউকে দিয়ে হবে না। আমি নিজেই যাব জেরক্স করাতে। তারপর সাড়ে নটা নাগাদ আমি বাড়ি ফিরে আসব। ঐ জেরক্সকরা কখানা পৃষ্ঠা সমেত একটা চিঠি একজনকে লিখব। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টকে বিশ্বাস নেই। তুমি ক্যুরিয়ার সার্ভিসের পিয়ন সেজে নিজে হাতে চিঠিখানা ডেলিভারি দিয়ে আসবে। খাম যার নামে তার হাতে দেওয়া চাই। ঝি-চাকর বা বাড়ির আর কাউকে নয়। ফলো? পার্টি যদি বাড়িতে না থাকে তাহলে অপেক্ষা করবে।
কৌশিক ঘাড় নেড়ে জানালো সে বুঝেছে।
বাসু বললেন, রানু, নিখিলকে ফোনে ধর তো। প্রথমে বাড়িতে। না পেলে লালবাজার হোমিসাইডে। নিখিলের বউ বলতে পারবে ও কোথায় আছে।
নিখিলকেও পাওয়া গেল। বাসু বললেন, নিখিল, তুমি প্রথম সুযোগেই আমার সঙ্গে এসে দেখা কর। কখন আসছ?
—আমি এখনই আসছি, স্যার। আমি এখন অফ ডিউটি। কী ব্যাপার?
—এলে বলব।
নিখিল এবার এল সস্ত্রীক। নিখিলের স্ত্রী কাকলিও একসময়ে খুনের মামলায় ফেঁসেছিল। ‘যাদু এ-তো বড় রঙ্গ’র কাঁটায়। এবাড়ির সবাইকে চেনে। সে সোজা ভিতরে চলে গেল। বাসু নিখিলকে নিয়ে স্টাডিতে গিয়ে বসলেন। বললেন, ঘটনাচক্রে একটা দারুণ এভিডেন্স পেয়ে গেছি। সেটা কী, আমি বলতে পারব না; কিন্তু …
—বাই এনি চান্স, স্যার : সেটা কোন ‘ডেড ম্যানস ডায়েরি’ নয় তো?
বাসু পকেট হাতড়ে পাইপ-পাউচ বার করলেন। বললেন, প্রশ্নটা নেহাত বোকার মতো করে বসলে, ইন্সপেক্টর দাশ!
—কেন স্যার?
—লজিক্যালি ভেবে দেখ। তোমার অনুমান সত্য হলে আমি স্বীকার করতে পারি, অস্বীকারও করতে পারি। স্বীকার করলে, তোমাকে তৎক্ষণাৎ খবরটা উপর মহলে জানাতে হবে। অস্বীকার করলে আমি বে-আইনি কাজ করব। তোমার অনুমান ভ্রান্তও হতে পারে; সেক্ষেত্রে…
—আয়াম সরি! আই উইথড্র। প্রশ্নটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি আমি।
বাসু এতক্ষণে পাইপ ধরিয়েছেন। বললেন, যে কথা বলছিলাম! আমার অনুমান : কালিপদ কুণ্ডুকে কে খুন করেছে, কখন খুন করেছে…
—কখন খুন করেছে?
— ইয়েস! ফর য়োর ইনফরমেশন : কালিপদ কুণ্ডু খুন হয়েছে পৌনে দশটার আগে— তখনো অনিবার্ণ গলফ ক্লাবে পৌঁছায়নি।
নিখিল বলে, আয়াম সরি এগেন। বলে যান, স্যার?
কে খুন করেছে, কখন খুন করেছে, কেন খুন করেছে, তা আমি জেনে গেছি। তোমাকে জানাতে পারছি না দুটো হেতুতে। প্রথম কথা, আমার মক্কেল অনির্বাণ দত্ত যতক্ষণ না বেকসুর খালাস হচ্ছে ততক্ষণ তুমি-আমি ফর্মালি বিপক্ষ শিবিরে। দ্বিতীয় হেতু : অপরাধীকে কনভিক্ট করবার মতো এভিডেন্স আমার হাতে নেই।
—সো?
—আমি একটি ফাঁদ পাতছি। বৃহস্পতিবার রাত নয়টায়। দেড়-দিনের মতো খবরটা তোমাকে ‘ভবম-হাজাম’-এর মতো পেট কোঁচড়ে চেপে রাখতে হবে। আর ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে অপরাধীকে ধরতে হবে।
—আমি রাজি।
বুধবার বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যেই কৌশিক এসে রিপোর্ট করল : ক্যুরিয়ার সার্ভিসের চিঠি ডেলিভারি দিয়ে এলাম মামু।
—তোমাকে সন্দেহ করেনি? আমার বাড়ির লোক বলে?
—আমি নিজে থোড়াই গেছিলাম।
—তাহলে?
—সুকৌশলীরও তো কিছু চ্যালা-চামুণ্ডা আছে।
বাসু কৌশিকের হাতে একটা টেলিফোন নম্বর ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যার হাতে চিঠিখানা দিয়ে এলে এটা তারই ফোন নম্বর। তার কণ্ঠস্বর তুমি চেন। তুমি কনফার্ম করে নিয়ে আমাকে রিসিভারটা দিও। পার্টি যদি বাড়িতে না থাকে তাহলে লাইন কেটে দিও। ওপক্ষ যেন কোনক্রমেই না বুঝতে পারে ফোনটা কোথায় অরিজিনেট করেছে।
কাগজটা হাতে নিয়ে কৌশিক ডায়াল করল। ওপ্রান্তে রিং টোন। তারপরে ওপ্রান্তের লোকটি আত্মঘোষণা করতেই কৌশিক বললে, প্লিজ স্পিক হিয়ার!
বাসু যন্ত্রটা বাগিয়ে ধরে তার কথামুখে বিচিত্র দেহাতি গ্রাম্যকণ্ঠে বললেন : হ্যালো! যেন : ‘কাক্কাজীনে কহিন’!
ওপ্রান্ত থেকে প্রশ্ন হল : আপনি কে? কী চান?
—অ্যাই দ্যাহেন! আমারে চিত্তি ফার্লেন না? আমি খালিচরণ! খালিফদ কুণ্ডুর ছুট ভাই আজ্ঞে! আমার হাতচিটি ফৌঁছায়নি এখনো?
—আপনি… আপনি কী চান?
—ওমা, আমি কনে যাব! সে খথা তো চিটিতেই বলিচি! দাদারে যা দিবেন বলিচিলেন…. তাই দেবান্নে… মানে রুজনামচাখান হাতে ফেলি!
—অত টাকা এখন আমার হাতে নেই।
—বেশ তো, বেশ তো! ফরে দিবেন! মাস্-মাস্ দিবেন অখন! জেবনভর দিবেন। তাড়া কী? কাল নখকীবারে বৌনিটা হয়ি যাক! হাজার-ফাঁচেক দ্যান! দাদার ছেরাদ্দটা তো করি।
ও-প্রান্তে নীরবতা।
—কী হল? অ্যাঁ? কাল ফাঁচ হাজার দিতি ফার্বেন? না, ফার্বেন না?
—কালিপদ কুণ্ডুর কোন ছোট ভাই ছিল না। বাজে কথা।
—ওমা আমি কনে যাব! রুজনামচার খাতাখান যে দাদা আমারে দে-গেল! বলি গেল, চরণ, এখন থিকা তুই নিজিই আদায় ফত্তর করিস! আমি যে তেনার ন্যায্য ওয়ারিশ গো! রুজনামচা- কাতার ফাতার জেরক্স ফাননি?
—টাকাটা তুমি কোথায় নেবে?
—বলচি; কিন্তুক লম্বরী লোট নয়! দশ-বিশ ট্যাহার লোটে!
—তাই দেব। কোথায় তোমার দেখা পাব?
—আপনের দয়ায় দাদা যেহানে ফরলোকে গ্যালেন, ঠিক সেই ঠাঁইয়ে!
—তুমি সেখানে ঢুকতে পারবে তো?
—অ্যাই দ্যাহেন। কেন ফাৰ্বনি? ফাঁচিল যে বেবাক ভাঙা গো! কাল নখকীবার আছেন। কেলাবে জনমনিষ্যি আসফেনি। রাত নিয্যস নয়টায়।
—তুমি ডায়েরিটা সঙ্গে নিয়ে আসছ তো?
—ওমা আমি কনে যাব! তাই কি ফারি? মাত্তর ফাঁচ হাজারে? এতো দাদার ছেরাদ্দ বাবদ! রুজনামচার দর-দাম কাল হবেনে! আজ অ্যাই পয্যন্তই থাক। ফেন্নাম হই! ঠিক রাত নয়টায় কিন্তুক!
টেলিফোনটা ক্র্যাডেলে নামিয়ে রাখলেন।
কৌশিক বলল, আশ্চর্য! ও রাজি হয়ে গেল টাকাটা দিতে। বুঝতে পারল না যে, আপনি কালিপদর ছোট ভাই নন?
বাসুসাহেব একগাল হেসে বললেন, ওমা আমি কনে যাব! বুঝতি কেন ফার্বেন না? কিন্তুক ও এটুকুনও বুঝিছেন যে, খালিফদর ব্রেমহাস্তরটা অখন খালিচরণের ফকেটে!