ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসনাশীর কাঁটা – ১১

১১

বাসুসাহেব টেলিফোন করছিলেন। ওপ্রান্তে ‘হ্যালো’ শুনেই বলেন, অশোক মুখুজ্জে কি অফিস থেকে ফিরেছে?

যে টেলিফোন ধরেছিল সে বিরক্ত হল। হবারই কথা, মিস্টার অশোক মুখোপাধ্যায়, বি ই, টেলিকম্যুনিকেশন সিভিল সেন্টারের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। তাঁর সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে হয় সম্ভ্রমের সঙ্গে। ‘অশোক মুখুজ্যে কি ফিরেছে’— এ আবার কী জাতের প্রশ্ন! ভৃত্যশ্রেণীর লোকটি বিরক্ত হয়ে বললে, হ্যাঁ, সাহেব ফিরেছেন। তাঁকে কী বলব? কে ফোন করছেন?

—বল, বাসুমামা ফোন করছেন। পি. কে. বাসু।

একটু পরেই অশোক ছুটে এল। সোৎসাহে বলল, বলুন মামু, কীভাবে আপনার মিস্ট্রি- সলভিং-এ সাহায্য করতে পারি? এবার অনেকদিন পরে ফোন করছেন।

অশোক ওঁর গুণগ্রাহী।

বাসু বলেন, একটা বিচিত্র রিকোয়েস্ট রাখতে হবে।

—ফরমাইয়ে।

—টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে যেমন সাবস্ক্রাইবারদের নাম অ্যালফাবেটিক্যালি সাজানো থাকে, তেমনি টেলিফোন ভবনে আর একটি রেজিস্টারে নিশ্চয় নিউমেরিক্যালি লিস্ট করা আছে, তাই নয়?

—ঠিক কী জানতে চাইছেন?

—আমি যদি জানতে চাই 475-8464 নম্বরে সাবস্ক্রাইবারের নাম-ঠিকানা কী, তা তোমরা সেই রেজিস্টার দেখে অনায়াসে বলে দিতে পারবে, তাই নয়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ডাইরেক্টরিতেই দেখুন, এজন্য একটা বিশেষ নম্বর লেখা আছে। সেখানে ডায়াল করলে তা জানিয়ে দেওয়া হয়।

—আই নো। আমার প্রবলেমটা একটু অন্যরকম। না হলে তোমাকে বিরক্ত করব কেন?

—বলুন, মামু?

—পুরো নম্বরটা জানি না। শেষের চারটে অঙ্ক শুধু জানি। তুমি সাবস্ক্রাইবারকে ট্রেস করে দিতে পারবে?

—না, মামু, তা হয় না। পুরো নম্বরটা চাই।

—আরে ভাগ্নে, কথাটা তো শোন। ধর, শেষ চারটে সংখ্যা 1234 এমন কতগুলি টেলিফোন আছে শহর কলকাতায়? অসংখ্য নয়, যতগুলি এক্সচেঞ্জ আছে ততগুলিই। তাই নয়?

—হ্যাঁ, তাই। কিন্তু তা ধরে নাম পেলে ‘ঠিকানা’, অথবা ঠিকানা পেলে ‘নাম’ খুঁজে বার করতে একটা লোকের সারাটা দিন লাগবে।

—আই নো, আই নো! তোমার একজন কর্মীর নাম কর যে দক্ষ, পরিশ্রমী, আর জেদী— ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’-টাইপ।

—অপর্ণা দেব। কেন?

—ম্যারেড?

—হ্যাঁ, সম্প্রতি।

—অল রাইট! তাকে একদিন ক্যাজুয়াল লীভ নিতে বল, আর বল : কলকাতায় যতগুলি এক্সচেঞ্জ আছে— আশা করি শতখানেকের কম— তার ভিতর সে খুঁজে দেখুক প্রত্যেকটি এক্সচেঞ্জে কোন কোন সাবস্ক্রাইবারের শেষ চারটে নম্বর হচ্ছে 1836। আমি তথ্যটা তালিকাকারে চাই। এক্সচেঞ্জ-বেসিসে সাবস্ক্রাইবারের নাম ও ঠিকানা সহ। অপর্ণাকে বল : তার এ পরিশ্রমের বিনিময়ে হয়তো একজন নিরাপরাধী ফাঁসির দড়ি থেকে রেহাই পাবে। এজন্য অপর্ণাকে কত অনারেরিয়াম দিতে হবে?

অশোক হেসে বলল, আমি তার হয়ে বলছি, মামু। অপর্ণাও আপনার ‘ফ্যান’। ও একটি পয়সাও নেবে না। কিন্তু এ কেস যদি জেতেন তাহলে আপনাদের চারজনকে আমাদের বাড়ি ডিনারে নিমন্ত্রণ রাখতে আসতে হবে। সকর্তা অপর্ণাও আসবে। গল্পটা ছাপার আগে শোনাতে হবে। রাজি?

—রাজি। শর্তসাপেক্ষে।

—কী শর্ত?

—আমি ডিভিশন-অব-লেবারে বিশ্বাসী। তারিখটা ঠিক করবে তুমি আর তোমার বেটার- হাফ। ভেনুটা ‘তাজবেঙ্গল’। মেনুটা ঠিক করবে একটা কমিটি : অপর্ণা, মিস্টার দেব, সুজাতা, ভারতী আর কৌশিক। গল্পটা শোনাব আমি। আর তোমার মামিমা, মানে আমার বেটার হাফ, শুধু হোটেলের বিলটা মেটাবে। এগ্রীড?

—এগ্রীড!

.

পরদিন বাসুসাহেবের চেম্বারে দেখা করতে এলেন মহেন্দ্রনাথ পাল। বর্ধমানের কানাইনাটশাল থেকে। বেঁটেখাটো মানুষ। বয়স সত্তরের ওপারে। তবে শরীর শক্ত। উনি ছিলেন রঘুবীর সেনের বাল্যবন্ধু। বস্তুত ওঁরা দুজন আর সলিল মৈত্রের পিতৃদেব স্বাধীনতার পর সাহেবদের কাছ থেকে কুতুব টীর স্বত্বাধিকার ক্রয় করে নেন। তখন ওটা ছিল নেহাতই ছোট কোম্পানি। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। ক্রমে স্বাধীনতা-উত্তর ওর শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকে। ‘প্রাইভেট’ শব্দটা উড়িয়ে দিয়ে এঁরা পুরোপুরি কোম্পানিই ফ্লোট করেন। ভারতীয় চায়ের বাজার বিশ্বে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কোম্পানিও বড় হতে থাকে। নতুন নতুন চা-বাগান খরিদ করা হয়। কিন্তু মুশকিল হল অন্য ব্যাপারে। স্ত্রী বিয়োগের পর রঘুবীর হয়ে পড়েন উদাসীন। মহেন্দ্রবাবুর ছিল বর্ধমান অঞ্চলে নামে-বেনামে প্রচুর ধানজমি, কোল্ড স্টোরেজ এবং সিনেমা হল। আর সলিল মৈত্রের পিতৃদেবের ছিল হাইকোর্টে ওকালতি। ফলে তিন কর্তার কেউই সরেজমিনে তত্ত্বতালাশ নিতে যেতে পারতেন না। তাঁরা নির্ভর করতেন ম্যানেজারের রিপোর্টের ওপর। এই সুযোগটাই গ্রহণ করলেন ধূর্ত ব্যবসায়ী জনার্দন সিংঘানিয়া। একবার জেনারেল মিটিং-এ হঠাৎ তিন বন্ধু প্রণিধান করলেন পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। সিংঘানিয়া ভোটের জোরে কুতুব টীর প্রেসিডেন্ট হয়ে বসলেন। ওঁদের সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। নানান ছুতোয় পুরাতন কর্মীদের বিদায় করলেন সিংঘানিয়া, সিংহবিক্রমে! এই সময়েই তহবিল তছরুপের মিথ্যা অজুহাতে চাকরি খোয়ালেন কালিপদ কুণ্ডু। রঘুবীর মারা গেলেন। মৈত্রমশাই তাঁর শেয়ার বেচে দিলেন, রাশিয়ায় প্রতিবিপ্লব সফল হবার মুখে। অর্থাৎ ভারতীয় চা যেদিন রাশিয়ার বাজারটা খোয়ালো।

অতি সম্প্ৰতি মহেন্দ্রনাথ তাঁর হৃত সাম্রাজ্য উদ্ধার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এ কাজে তাঁর দক্ষিণহস্ত ছিলেন কালিপদ কুণ্ডু। মহেন্দ্রনাথের বিশ্বাস, কালিপদ কুণ্ডু খুন হয়েছেন কোন ভাড়াটে খুনীর হাতে। খুনীকে কাজে লাগিয়েছিলেন ঐ সিংহবিক্রম সিংঘানিয়া। তার কারণ ঐ কালিপদ কুণ্ডু ঘুরে ঘুরে গত ছয় মাসে প্রচুর প্রক্সি ফর্ম জোগাড় করেছিলেন। সিংঘানিয়ার লোক যেখানেই প্রক্সি ভোট সংগ্রহ করতে গেছে সেখানেই শুনেছে, সাম মিস্টার কুণ্ডু ইতিপূর্বেই প্ৰক্সি ফর্ম সংগ্রহ করে গেছেন। মজা হচ্ছে এই যে, সচরাচর শেয়ারহোল্ডাররা উপরোধে পড়ে ব্ল্যাঙ্ক ফর্মে স্বাক্ষর করে দেয়। এজেন্ট নামটা বসিয়ে দেয়। ফলে মৃত্যুকালে কালিপদ কুণ্ডুর হেপাজতে সম্ভবত প্রচুর পরিমাণে স্বাক্ষরিত প্রক্সি ফর্ম ছিল, যাতে প্রার্থীর ‘কলমটা’ ছিল ফাঁকা। মহেন্দ্রনাথের মতে, সেটাই কুণ্ডুমশায়ের মৃত্যুর কারণ। মহেন্দ্রনাথ বললেন, কালিপদর তিনকুলে কেউ নেই; কিন্তু সে আমার কাজ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। ফলে তার আত্মা অতৃপ্ত থাকবে যদি না আমি তার বদলা নিই।

ওঁর মতে অনিবার্ণ বেমক্কা ফাঁদে পড়ে গেছে মাত্র।

বাসু বললেন, সবই বুঝলাম। কিন্তু পুলিশ অনিবার্ণকেই আসামী সাজিয়ে কেস খাড়া করতে উদ্যোগী হয়েছে। আর আমি ঐ অনিবার্ণকেই আমার ক্লায়েন্ট বলে স্বীকার করে নিয়েছি। ফলে, প্রথম কাজ হচ্ছে অনিবার্ণকে এ মামলা থেকে মুক্ত করা। তবে আমার কর্মপদ্ধতি আপনি জানেন কি না জানি না। প্রকৃত হত্যাকারীকে চিহ্নিত না করা পর্যন্ত আমি থামতে পারি না। আপনার কথাটা আমার স্মরণ থাকবে। এ কেস মিটলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আপাতত আপনি আমাকে রঘুবীর, সিংঘানিয়া আর কালিপদ কুণ্ডুর ব্যাকগ্রাউন্ড যতটা জানেন, বলুন।

মহেন্দ্রনাথ তিনজনের বিষয়েই অনেক কিছু অতীত কথা শুনিয়ে গেলেন। ওঁর বিশ্বাস, রঘুবীর কোন গোপন ডায়েরি রেখে যাননি। মৃত্যুর তিনচারদিন পূর্বেও মহেন্দ্রনাথের সঙ্গে রঘুবীরের সাক্ষাৎ হয়েছিল। অনির্বাণের বিরুদ্ধে তাঁর কোনও অভিযোগ ছিল না। উনি যে অনিবার্ণকেই ওঁর সম্পত্তির একক ‘ন্যাসপাল’ করে গেছেন তা বাল্যবন্ধু মহেন্দ্রনাথকে পর্যন্ত রঘুবীর বলে যাননি। এতটাই তিনি বিশ্বাস করতেন অনিবার্ণকে। তাছাড়া মহেন্দ্রনাথের বিশ্বাস, ঐ ছেলেটিকে উনি হয়তো জামাতা হিসাবে নির্বাচন করতেন আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে।

দ্বিতীয়ত, সিংঘানিয়া। অতি ধূর্ত ব্যবসায়ী। মোস্ট আনস্তুপুলাস। ‘পাঁপ হমার কেন হোবে? পাঁপ তো হোবে শালা কাসেম আলির হোবে’– এই দার্শনিক তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাছাড়া প্রতি পূর্ণিমাতে পূজা চড়ান। সারা মাসের পাপ তাতে ধুয়ে-মুছে যায়।

কালিপদ কুণ্ডু গুণী লোক। প্রথমে রঘুবীরের গাড়ির ড্রাইভার হিসাবে চাকরি করতে আসে। ক্রমে কুতুব টীর ক্যাশিয়ার পর্যন্ত হয়। ভাল তবলা, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ বাজাতে জানে। মার্গসঙ্গীত বোঝে। চাকরি যাবার পর অনেকদিন হাজতবাস করে, তহবিল তছরুপের মামলায়। তারপর বেকসুর মুক্তি পেরে বার হয়ে এসে সে কিন্তু পরিচিত দুনিয়ায় কারও কাছে যায় না। বস্তুত নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সম্ভবত মনের দুঃখে, তীব্র অভিমানে। বেশ কয়েক বছর পর মহেন্দ্রনাথ তার সাক্ষাত পান একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির পুত্রের অন্নপ্রাশনে, গানের জলসায়। একটি সুন্দরী মধ্যবয়সী বাঈজী গান গাইছিল আর কালিপদ কুণ্ডু তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করছিলেন। আসর ভাঙলে, মহেন্দ্রনাথ কালিপদকে ডেকে আলাপ করলেন। শুনলেন, তার কোনও আয় নেই, সে ঐ বাঈজীর বাড়িতেই থাকে। বাঈজী তাকে ‘বাবা’ বলে ডাকে। বছর খানেক আগে সংবাদপত্রে দেখতে পান, ঐ বাঈজী বেমক্কা খুন হয়ে গেছে, বাঈজীর সব গহনা চুরি হয়ে গেছে। আর পুলিশ সন্দেহ করে কালিপদকেই গ্রেপ্তার করেছে। তার ‘ক্রিমিনাল রেকর্ড’ ছিলই— যদিও প্রমাণের অভাবে, মহামান্য আদালত তাকে ইতিপূর্বে বেকসুর খালাস দিয়েছিলেন। এবারও প্রমাণাভাবে কালিপদ মুক্তি পান। সোনার গহনার একটি টুকরোও উদ্ধার করা যায়নি। মহেন্দ্রনাথ তারপর কালিপদকে নিজের কাজে নিযুক্ত করেন। প্রথমে সিনেমাহাউসে ‘আশারার’-এর চাকরিতে। পরে কুতুব টীর প্রক্সি সংগ্রহের কাজে।

বাসু জানতে চান, কলকাতায় কালিপদবাবু থাকত কোথায়?

—খুব একটা ভদ্র পল্লীতে নয়। হাড়কাটা লেন যেখানে প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে এসে পড়েছে তার কাছাকাছি একটা ভাঙা ভাড়াবাড়িতে। বাঈজী মারা যাবার পর, অন্য একটি রুপোপজীবিনী বাড়িটার দখল নিয়েছে। সে আগে থেকেই ঐ বাড়িতেই থাকত, কালিপদকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনত। কালিপদকে থাকতে দিতে তার আপত্তি হয়নি। এ মেয়েটি গান জানে না, নিহতা বাঈজীর সঙ্গিনী ছিল। এর দেহসৌষ্ঠব খুব আকর্ষণীয়। দেহব্যবসা ব্যতিরেকে তাই ‘মডেল’ হিসাবে বিভিন্ন অ্যাড- এজেন্সিতে কাজ করে। ফটো তোলায়, আর্টিস্টের মডেল হিসাবেও সিটিং দেয়। এও কালিপদকে ‘বাবা’ বলে ডাকত।

বাসু জানতে চান, বাড়িটা চেনেন?

মহেন্দ্র বললেন, আজ্ঞে না। ও পাড়ায় পদার্পণের সাহস হয়নি, রুচিও হয়নি। তাই বাড়িটা চিনি না। তবে ঠিকানাটা আমার নোটবইয়ে লেখা আছে। প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের ঠিকানা 1 হাড়কাটা গলির নয়। এই নিন।

বাসু বললেন, থ্যাঙ্কু।