ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসনাশীর কাঁটা – ১০

১০

কলবেলের আওয়াজ শুনে করবী এসে দরজা খুলে দিয়েই একেবারে অবাক : আপনি! আপনি নিজেই চলে এসেছেন? আমাকে টেলিফোনে ডেকে পাঠালে আমিই চলে যেতাম। আসুন স্যার, বসুন।

বাসু একাই এসেছিলেন। ভিতরে এসে বসলেন। হেসে বললেন, টেলিফোনে ডাকতে সাহস হল না। কী জানি, তুমি যদি ধরে নাও সপরিবারে নিমন্ত্রণ করছি।

করবীও হাসল। বলল, প্রথমে বলুন, কী খাবেন, গরম না ঠাণ্ডা?

—গরম-ঠাণ্ডা কিছুই নয়। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় আছে তো? কোন কাজে ব্যস্ত নেই? বা বেরুচ্ছ না?

—কী যে বলেন! আমি তো ধন্য বোধ করছি। আপনি নিজে থেকে… ইয়ে, অনিদার কেসটা কি সত্যই খারাপ? শুনলাম জামিন পায়নি?

—হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ, জামিন সে পায়নি। তবে তার কেস নিয়ে আমি শুধু শুনতেই রাজি, কিছু বলতে নয়। জান বোধহয়, আমি অনির্বাণের তরফে অ্যাটর্নি। অনিবার্ণ তোমার ন্যাসরক্ষক, সেই হিসাবে আমার প্রয়োজন হয়েছে তোমার সঙ্গে কিছু আলোচনা করার। তবে আমার পক্ষে জানিয়ে রাখা শোভন যে, আমি তোমার স্বার্থ দেখছি না। দেখছি, শুধু অনির্বাণের স্বার্থ। সে জন্য যদি তুমি আলোচনা করতে না চাও…

—না, না, বলুন না, কী বলবেন?

—তোমার ঐ বুককেসটা সেই মারামারির দিন ভেঙেছে বুঝি?

—মারামারি। না, মারামারি তো হয়নি সেদিন…

বাসুসাহেবের ভ্রূকুঞ্চন হল। এতবড় ঘটনাটা কেন করবী অস্বীকার করতে চাইছে? বললেন, অনিবার্ণ আর কিংশুক …

—আজ্ঞে না। তাকে মারামারি বলে না। বলে, ‘একতরফা ঠ্যাঙানো।’

ঘটনাটা খুকু বিস্তারিত জানায়। কিংশুককে বাসস্ট্যান্ডে তুলে দিয়ে ফিরে এসে সবে ও দরজা বন্ধ করেছে, এমন সময় আবার ডোরবেল বাজল। খুকু এসে খুলে দিয়ে দেখল, দরজার ও প্রান্তে স্যুট-বুট পরা অনির্বাণ দত্ত দাঁড়িয়ে। সে জিজ্ঞেস করল, ভিতরে আসব, খুকু?

করবী একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তোমাকে তো টেলিফোনেই বলেছিলাম অনিদা, বিকেলে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমি ব্যস্ত থাকব।

—ও, আয়াম সরি। আমি ভেবেছি যে, সে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা শেষ হয়ে গেছে।

—তার মানে তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আড়ি পাতছিলে?

—না, না, আড়ি পাতব কেন? স্বচক্ষে দেখলাম, মিস্টার হালদারকে তুমি মিনিবাসে তুলে দিয়ে একা বাড়ি ফিরে এলে। তাই ভাবলাম, …মানে, আমার কথাটা সত্যিই জরুরি।

—কার কাছে জরুরি? তোমার, না আমার?

—দুজনের কাছেই।

করবী তখন ওকে ভিতরে এসে বসতে বলে। দরজাটা খোলাই থাকে। করবী জানতে চায়, তুমি কি চা বা কফি খাবে অনিদা?

অনির্বাণ বলে, না। আমার হাতে সময় কম। একটা টেলিফোন করতে হবে, তারপর আখড়ায় যেতে হবে…

—আখড়া! আখড়া মানে?

—আমি বিকালবেলা একটা ক্লাবে ছেলেদের ক্যারাটে শেখাই।

করবী বলে, টেলিফোনটা তুমি এখান থেকেই করতে পার। আমি তো কিচেনে চা বানাবো। তুমি তোমার বান্ধবীকে ফোনে কী বললে তা আমি শুনতে পাব না।

অনিবার্ণ গম্ভীর হয়ে বলে, বান্ধবীকে নয়। আমার কোনও বান্ধবী নেই। এটা বিজনেস টক।

করবী কটাক্ষপাত করে বলে, কেন, আমি কি তোমার বান্ধবী নই?

অনিবার্ণ দৃঢ়স্বরে বলে, না! তুমি আমার ‘ছোটবোন’ হয়ে থাকতে চেয়েছিলে, বান্ধবী নও।

ঠোঁট উলটিয়ে করবী বলেছিল, তাতে আবার তুমি যে রাজি নও!

—ও প্রসঙ্গ থাক, খুকু। যা বলতে এসেছি, সেটা বলি। কিন্তু তুমি কথা দাও, এ কথা তুমি কিংশুকবাবু বা তার মাকে বলবে না?

—কেন?

কেন, সেটা নিজে থেকে বুঝতে না পারলে, আমি কেমন করে বোঝাব? ওরা তোমার টাকাটার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর কোন উদ্দেশ্য নেই ওদের। ওরা কুচক্রী, অর্থলোভী…

—আর তুই? খুকুর বাপের সম্পত্তিটা কব্জা করে যক্ষের ধন আগলে রেখেছিস! তুই অর্থপিশাচ নস?

ওরা দুজনেই চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে খোলা দ্বারপ্রান্তে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে কিংশুক হালদার, তার দীর্ঘ ছয়ফুট দেহখানা নিয়ে। অনিবার্ণ উঠে আসে ওর কাছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, মিস্টার হালদার। আমরা দুজনে কিছু প্রাইভেট কথা বলছি, আপনি পরে আসবেন।

কিংশুক গর্জে ওঠে, হিম্মৎ থাকে তো বাইরে বেরিয়ে আয়, হারামজাদা! না হলে তোকে ঐ সিঁড়ি দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেব।

আশ্চর্য স্থিরতার সঙ্গে অনির্বাণ বললে, আজ নয়। আজ আমি ব্যস্ত আছি মিস্টার হালদার! তবে তোমার বাসনা আর একদিন পূর্ণ করে দেব আমি… কথা দিচ্ছি…

—অল রাইট! শুয়ারকা বাচ্চা! টেক দিস পাঞ্চ

কথা নেই, বার্তা নেই বুনো মোষের মতো সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিংশুক। কিন্তু অনির্বাণের দেহ স্পর্শ করতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলটার উপর।

অনিবার্ণ ‘ডার্ক’ করেছে!

তারপর কী ঘটেছে, করবী জানে না।

‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ ছবির একটা সিকোয়েন্স অভিনীত হয়ে গেল ওর চোখের সামনে। রক্তাপ্লুত কিংশুক যখন শয্যা নিল কার্পেটের ওপর, তখন একটা পকেট-চিরুনি বার করে চুলটা মেরামত করতে করতে অনির্বাণ বলল, আয়াম এক্সট্রিমলি সরি, খুকু, কথাটা আজ আর বলা হল না। তোমার প্রতিবেশিনী যেভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিক্কুড় পাড়ছেন তাতে এখনি হয়তো পুলিশ এসে পড়বে…

বাসু বললেন, বাকিটা আমি জানি। তুমি এবার বরং রিভলভারটার কথা বল….

—রিভলভার! কোন রিভলভার?

—তোমার বাবার একটা থ্যাবড়া-নাক রিভল্ভার ছিল না? যেটা অনির্বাণ তোমার কাছে রাখতে দিয়েছিল— তুমি একলা বাড়িতে থাক বলে?

—হ্যাঁ, দিয়েছিল, সেটা সম্বন্ধে কী জানতে চান?

—সেটা কোথায়?

—আমার ড্রয়ারে। কেন?

—ড্রয়ারটা কি সব সময় তালাবন্ধ থাকে?

—না তো! কিন্তু এসব কথা কেন?

—তুমি আমাকে নিয়ে চল তো করবী, সেই ড্রয়ারটার কাছে; আমি দেখতে চাই, ড্রয়ারে রিভলভারটা আছে কি না।

—কী আশ্চর্য! থাকবে না কেন? নিশ্চয় আছে।

—লেটস সী! চল।

করবীর ভ্রূকুটি হয়। সে আর আপত্তি করে না। দুজনে চলে আসেন ওর শয়নকক্ষে। মাঝারি ঘর। সিঙ্গলবেড খাট। একটা চেস্ট-অব-ড্রয়ার্স। চাবিবন্ধ নয়। করবী দ্বিতীয় ড্রয়ারটা টেনে খোলে। অবাক হয়। তারপর একে একে সবগুলি পাল্লাই তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখে। অবশেষে বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বলে, স্ট্রেঞ্জ। এর মানে কী?

বাসু বললেন, তোমার ঘরে গোদরেজের লোহার আলমারি আছে। রিভলভারটা ওতে রাখতে না কেন? ওটা কি তালাবন্ধ থাকে না?

এগিয়ে এসে হাতল ঘোরাতেই লোহার আলমারিটা খুলে গেল। বাসু বললেন, আয়াম সরি!

—‘আয়াম সরি’ মানে?

—তোমার সংসারে লোহার আলমারি আর কাঠের পাল্লায় কোনও প্রভেদ নেই। সবই খোলা পড়ে থাকে। এটা আমার আন্দাজের বাইরে ছিল। ফলে, এজন্য একজনকে তো ‘সরি’ হতেই হবে। না-হয় আমিই হলাম! তোমার মনে আছে, রিভলভারটাকে শেষ কবে ঐ ড্রয়ারে দেখেছ?

— না… মানে, দিনসাতেক আগে ওটাকে দেখেছি বোধহয়।

—অনিবার্ণ ওটা তোমার কাছ থেকে ফেরত নিয়ে যায়নি?

—সার্টেনলি নট!

—কথাটাকে অন্যভাবে নিও না করবী। গত সাতদিনের মধ্যে তোমার বেডরুমের ভিতর কে কে এসেছিল? …ওটা যে চুরি গেছে তা নিশ্চয় বুঝতে পারছ। আমি জানতে চাই, সুযোগ ছিল কার কার?

হঠাৎ বাসুসাহেবের চোখে-চোখে তাকিয়ে খুকু জানতে চায়, ঐ রিভলভারের গুলিতেই কি কালিপদবাবু খুন হয়েছেন?

বাসু বললেন, আগেই বলেছি, আমি শুধু শুনতে এসেছি, দেখতে এসেছি, কিছু বলতে নয়। তুমি কাউকে সন্দেহ করতে পারছ? এর আগে তোমাকে আর একটা প্রশ্ন করেছিলাম— আই অ্যাডমিট, কুমারী মেয়ের পক্ষে অত্যন্ত এম্ব্যারাসিং প্রশ্ন। তবু উত্তরটা আমার জানা দরকার।

—আয়াম সরি, স্যার। আপনার প্রশ্নটা কী ছিল তা আমার ঠিক মনে নেই।

—আমি জানতে চেয়েছিলাম : গত সাতদিনের ভিতর তোমার বেডরুমের ভিতর কে কে এসেছিল?

—এটা এম্ব্যারাসিং প্রশ্ন কেন হতে যাবে?

—নয়?

—আমি তো মনে করি না। ডাক্তার আর উকিলের কাছে কিছু গোপন করতে নেই। তাতে ঠকতে হয়।

—ভেরি গুড। তাহলে বল।

—না, স্যার। আমি কাউকে সন্দেহ করতে পারছি না। আমার একজন মেড-সার্ভেন্ট আছে- বাবার আমল থেকে : মোক্ষদামাসী। বিশ্বাসী। সে এ কাজ করবে না। মানে রিভলভার চুরি।

—তোমার বন্ধুবান্ধব বা তাদের আত্মীয়স্বজনেরা নিশ্চয় বেডরুমে আসে না; কিন্তু এ ঘর তো সব সময় খোলাই থাকে?

করবী এ কথার জবাব দিল না। বললে, লাইসেন্সটা অনিদার নামে। আমার কেরিয়ার- লাইসেন্সও ছিল না। আপনি কী পরামর্শ দেন? পুলিশে ফোন করে জানাব যে, ওটা আমার ঘর থেকে চুরি গেছে?

বাসু বলেন, না। ব্যস্ত হয়ো না। রিভলভারটা বর্তমানে পুলিস-কাস্টডিতেই আছে। চল, আমরা বাইরের ঘরে গিয়ে বসি।

বাইরের ঘরে ফিরে এসে বসলেন, দুজনে অনেকক্ষণ গল্প করলেন। করবী শুনল না, দুকাপ ‘কফি বানিয়ে আনল। বাসুসাহেব তাঁর তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে যান।

না, খুকু ডায়েরি লেখে না। বাপি? হ্যাঁ, লিখতেন। তবে বিস্তারিত কিছু নয়। কাজের কথা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট। খুকুর বন্ধুবান্ধবদের কথা বিস্তারিত জানতে চাইলেন। সুখেন চৌধুরী একটা লিটল ম্যাগাজিন বার করে : ত্রৈমাসিক। ও কবি। সম্পাদকীয়ও লেখে। ওরা দলে চারপাঁচজন আছে। যতীন কর, মীনাক্ষী, শিখা, রবি দাস ইত্যাদি গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করে। ওরা মাঝে মাঝে সবাই দল বেঁধে এখানে রিহার্সাল দিতে আসে। না, না বেডরুমে নয়, বাইরের ঘরে। কিং? হ্যাঁ, সেও আসে। ওর প্রতিভা বহুমুখী। গানের গলা নেই; কিন্তু ক্লাসিকাল গানের সমঝদার। ছবি আঁকে। তেলরঙে। আর স্কেচ। পোট্রেটেই ওর বৈশিষ্ট্য। বিশেষ ধরনের পোর্ট্রেট।

—বিশেষ ধরনের পোর্ট্রেট মানে? কী ধরনের?

করবী মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, সে আপনাকে বোঝাতে পারব না। তাহলে মডার্ন আর্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হয়।

—কর না। আমিও কিছু কিছু বুঝি। গত শতাব্দীর ‘ইম্প্রেশানিজম্’, ‘ডাডাইজম’, সুররিয়ালিজম… পোস্ট-ইম্প্রেশানিজম, পয়েন্টিলিজম, কিউবিজম…

খুকু ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললে, ও প্রসঙ্গ থাক। ওসব ব্যাকডেটেড চিন্তাধারা।

—আই সী। কিংশুক তোমার পোর্ট্রেট এঁকেছে?

—হ্যাঁ, একাধিক।

—একটা দেখাও দেখি।

—সরি। আমার কাছে একটাও নেই।

বাসু হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, আচ্ছা, কালিপদ কুণ্ডু যখন তোমার কাছে শেয়ারের প্রক্সি সংগ্রহ করতে আসে তখন তোমার বাবার একটা মিসিং ডায়েরির কথা বলেছিল কি?

—বাবার মিসিং ডায়েরি? নাতো! হঠাৎ এ কথা কেন?

বাসু হেসে বলেন, এক কথা কতবার বলব করবী? আমি শুধু শুনতে এসেছি; কিছু বলতে নয়। আচ্ছা আজ চলি। কফির জন্য ধন্যবাদ। আর তোমার সহযোগিতার জন্যও।

—অন্তত একটা কথা বলে যান, স্যার?

—কী কথা?

—অনিদাই কি কালিপদবাবুকে …

কথাটা শেষ হল না। বাসু বলেন, আই রিপীট : হি ইজ মাই ক্লায়েন্ট।