১
—’কী চায় লোকটা?
—তা কেমন করে জানব? সবাই যা চায় ও-ও তাই চাইছে। তোমার সাক্ষাৎ। কারণটা আমাকে জানাতে রাজি নয়।
—কী নাম? কী করে?
—নাম অনির্বাণ দত্ত, বয়স আন্দাজ উনত্রিশ। সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান, পোশাক-পরিচ্ছদ ভদ্র, কিছু উগ্রও। পেশা কী জানতে চাওয়ায় বলল—’Investment Counsellor’। সেটার বাংলা কী হবে? ‘বিনিয়োগ হিতৈষী?’
—বাংলায় অনুবাদ নাই করলে। অনেক সময় অনুবাদ করতে গিয়েই গোল বাধে। কিন্তু ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে। আমি তো কোথাও কোন অর্থ লগ্নি করতে চাই না, মানে বর্তমানে সক্ষম নই, এ কথাটা ওকে বলেছ?
—না, না, ও এসেছে নিজের ধান্দায়। তোমাকে শেয়ার বেচতে নয়।
—ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও।
রানু তাঁর ইনভ্যালিড চেয়ারে একটা পাক মেরে কক্ষান্তরে চলে গেলেন। অর্থাৎ রিসেপশন কাউন্টারে।
ধরে নেওয়া হচ্ছে : বাসুসাহেব এবং রানুদেবী আপনাদের পরিচিত। অর্থাৎ ইতিপূর্বেই কিছু কণ্টকাকীর্ণ পথে পরিভ্রমণ করার দুর্ভাগ্য আপনাদের হয়েছে। উা না হয়ে থাকলে সংক্ষেপে বলে রাখা দরকার-
পি. কে. বাসু হচ্ছেন কলকাতা বারের একজন সুপ্রসিদ্ধ ক্রিমিনাল-সাইড ব্যারিস্টার। জনশ্রুতি – তিনি নাকি ইতিপূর্বে কোনও কেসে হারেননি। এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বাসুসাহেবকে প্রশ্ন করলে উনি জবাব দেন না, হাসেন।
মিসেস রানু বাসু ওঁর সহধর্মিণী – একাধিক অর্থে। কারণ তিনি ওঁর স্ত্রী, কনফিডেনশিয়াল সেক্রেটারী, স্টেনো এবং ওঁদের জীবনের এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ভাগীদার। মিসেস বাসু চলৎশক্তিহীনা সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায়। একটা হুইলচেয়ারে তিনি সারা বাড়ি ঘোরেন। বাড়ির বাইরে যান কদাচিৎ।
ওঁদের বাড়িটা নিউ আলিপুরে। ইংরেজি ‘U’ অক্ষরের আকার। দ্বিতল বাড়ি। দোতলায় থাকে কৌশিক আর সুজাতা মিত্র। তারা একটা প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ মালিক : ‘সুকৌশলী’। নামকরণটা বাসুসাহেবই করেছিলেন : লেডিজ ফার্স্ট আইনের ধারা মোতাবেক প্রথমে সুজাতার আদ্য অক্ষর ‘সু’, পরে কৌশিকের ‘কৌ’। আর শলী’টা হচ্ছে ‘খলু’, পাদপূরণের প্রয়োজনে।
সংসারে এছাড়া আছে বিশ্বনাথ — বিশু। ওঁদের কম্বাইন্ড হ্যান্ড। তুখোড় মেদনিপুরিয়া।
রানু তাঁর ইনভ্যালিড চেয়ারে পাক মেরে চলে যাবার একটু পরেই দরজাটা আবার খুলে গেল। দ্বারপ্রান্তে একটি সুসজ্জিত যুবকের আবির্ভাব। সিলভার গ্রে রঙের স্যুট, নীল-সাদা এড়াএড়ি স্ট্রাইপ-কাটা টাইয়ে অক্সফোর্ড-নট। দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে পড়েছে। চোখাচোখি হতে যুক্ত করে বললে, মাপ করবেন স্যার, বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে আসতে হয়েছে। নিতান্ত বিপদে পড়ে। ব্যাপারটা ভীষণ জরুরী। আপনি যে দেখা করতে রাজি হয়েছেন এতে….
বাসু বলেন, নিতান্ত বিপদে না পড়লে কেউ আমার সঙ্গে সৌজন্যসাক্ষাতে আসে না। আসুন, ভিতরে এসে বসুন।
—আমাকে তুমি-ই বলবেন, স্যার। আমার নাম …
—জানি। অনির্বাণ দত্ত। তুমি নিশ্চয় জান অনির্বাণ যে, দেওয়ানী মামলার পরামর্শ আমি দিই না। তোমার প্রফেশনের সঙ্গে আমার কর্মপদ্ধতির যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। আশঙ্কা হচ্ছে, আমারা দুজনেই নিজের-নিজের সময় নষ্ট করছি।
অনির্বাণ গুছিয়ে বসেছে। বললে, ফৌজদারী মামলার আসামীকে আপনি পরামর্শ দেন নিশ্চয়! তাহলেই হল…
—ফৌজদারী মামলা? আসামীটি কে?
অনির্বাণ জবাব দিল না। বামহস্তের তর্জনী দিয়ে নিজের বক্ষস্থল চিহ্নিত করল।
বাসু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সাক্ষাৎপ্রার্থীকে আপাদমস্তক আর একবার দেখে নিয়ে বললেন, তোমাকে অ্যারেস্ট করেছিল কবে? জামিনই বা কবে পেলে?
—আজ্ঞে না। আমাকে পুলিশে অ্যারেস্ট করেনি এখনো। যাতে না করতে পারে তাই তো আপনার পরামর্শ নিতে এসেছি।
—বুঝলাম। কিন্তু কীর্তিটা কী জাতের? এম্বেমেন্ট? তহবিল তছরুপ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছেন।
—কোন হতভাগ্যের তহবিল?
—হতভাগ্য নয় স্যার, হতভাগিনীর। একটি তরুণীর : করবী সেন।
—টাকার অঙ্কটা কত?
—একদিক থেকে হিসেব করলে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।
বাসু ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে পাইপ ধরালেন। বললেন, লুক হিয়ার, ইয়ং ম্যান, প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে আদালত থেকে সুবিচার পাওয়ার। সেজন্য সে যে কোনও আইনজীবীর দ্বারস্থ হতে পারে। তার আশঙ্কা, কৃতকর্ম অথবা অপরাধের কথা সবিস্তারে জানাতে পারে। আইনজীবী কেসটা নিতে পারেন। নিন বা না নিন প্রফেশনাল এথিক্সে তিনি মক্কেলকে সেজন্য পুলিসে ধরিয়ে দিতে পারেন না। অপরপক্ষে প্রতিটি আইনজীবী প্রতিটি অপরাধীকে রক্ষা করতে বাধ্য নয়। তুমি এ পর্যন্ত যেটুকু বলেছ তাতেই আমি বুঝতে পেরেছি তোমার কেসটা আমি নিতে পারব না। এক্ষেত্রে তুমি ঐ করবী সেন নাম্নী হতভাগিনীর অর্থ কীভাবে আত্মসাৎ করেছ তা বিস্তারিত শুনবার আগ্রহ আমার নেই। তোমার এ স্বীকৃতি গোপন থাকবে। তুমি আর কোনও আইনজীবীর দ্বারস্থ হও। আর তুমি যদি ও ঘরে কিছু রিটেইনার দিয়ে এসে থাক তাহলে তা ফেরত নিয়ে যাও। আমি ইন্টারকমে বলে দিচ্ছি…
—কিন্তু আপনি তো, স্যার, আমার সমস্যার কথাটা এখনো শোনেনইনি…
—আর শোনার কী দরকার? তুমি তো নিজেই স্বীকার করছ যে, একটি তরুণীর তহবিল তছরুপ করে তুমি অপরাধী।
—আজ্ঞে না। তা তো আমি বলিনি। তহবিল তছরুপ করেছি আইন মোতাবেক। কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধী। আইনের কাছে কি না জানি না, বিবেকের কাছে আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।
বাসুসাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, পাঁচ মিনিট সময় আমি দেব তোমাকে। তার ভিতর তোমার গল্পটা বলতে হবে। যদি আমি ইন্টারেস্টেড হই তাহলে তোমার কেসটা নেব; যদি না হই তাহলে ঐ রিটেইনারটা গচ্চা যাবে- কনসালটেশন ফী বাবদ — আমার পাঁচ মিনিট সময়ের দাম। নাউ স্টার্ট…
অনিবার্ণ তৎক্ষণাৎ শুরু করল তার কাহিনী :
করবী সেনের পিতা স্বর্গত রঘুবীর সেন পিতৃমাতৃহীন অনির্বাণকে মানুষ করেন। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন মিলিটারির ঠিকাদার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আসাম আর বর্মা অঞ্চলে ঠিকাদারী করে বেশ কিছু অর্থ সঞ্চয় করেন। যুদ্ধান্তে তিনি কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে একটি দ্বিতল গৃহ নির্মাণ করে সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ঐ সময় তিনি বিবাহ করেন কিন্তু প্রথম সন্তান প্রসব করতে গিয়েই তাঁর স্ত্রী মারা যান। প্রায় কিশোর বয়স থেকে অনিবার্ণ রঘুবীরের আছে। অনির্বাণের ‘বাবা ছিলেন রঘুবীরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাবার মৃত্যুর পর অনির্বাণ মানুষ হতে থাকে। রঘুবীরকে সে কাকাবাবু ডাকত। পিতৃপ্রতিম শ্রদ্ধাও করত। বিপত্নীক রঘুবীরের সংসার দেখত ঠাকুর চাকর আর বিধবা পিসিমা। পিসিমা কিছুতেই রঘুবীরকে দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহে সম্মত করাতে পারেননি। স্ত্রীবিয়োগের পর রঘুবীর সংসারে বেশ উদাসীন হয়ে পড়েন। উপার্জন বন্ধ। সঞ্চিত অর্থের সুদেই সংসার চলত। গৃহিণীহীন সংসারে মানুষ হতে থাকে রঘুবীরের একমাত্র সন্তান : মাতৃহীনা খুকু। পোশাকী নাম : মিস করবী সেন। ঐ সংসারে থেকেই অনির্বাণ হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে। কলেজে ভর্তি হয়। ক্রমে বি. কম. পাস করে। তারপর আর পড়াশুনা করতে চায় না। রঘুবীরের ইচ্ছা ছিল ও এম. কম -এ ভর্তি হোক। অনিবার্ণ রাজি হয় না। সে বুঝতে পারে রঘুবীরের সঞ্চয় তিলতিল করে নিঃশেষ হয়ে আসছে। বসে খেলে স্বয়ং কুবেরও ভিখারি হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে রঘুবীর তাঁর বসত বাড়িটি বিক্রয় করতে বাধ্য হয়েছেন। শেষ জীবনে সে বাড়িতেই ভাড়াটে হিসাবে বাস করছেন। অনিবার্ণ ‘রিয়্যাল এস্টেট-এর ব্যবসা শুরু করল। ইতিমধ্যে সে হয়ে উঠেছে অপুত্রক রঘুবীর সেনের দক্ষিণ হস্ত। সবচেয়ে বিশ্বস্ত।
একই বাড়িতে থাকে। ফলে ভাইবোনের মতো বড় হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক। খুকু অনির্বাণের চেয়ে আট বছরের ছোট। মাতৃহীন আদুরে মেয়েটির অনেক-অনেক হোমটাস্কের অঙ্ক কষে দিতে হয়েছে অনিবার্ণদাকে। তবে খুকু সেজন্য কোনও কৃতজ্ঞতা বোধ করত না। বাল্যে আর কৈশোরে তার ধারণা ছিল আশেপাশে যারা আছে তাদের একমাত্র কাজ ওকে খুশি রাখা।
বছর চারেক আগে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হলেন রঘুবীর। পিসিমা তার আগেই সাধনোচিত ধামে পাড়ি দিয়েছেন। খুকুর তখন সবে ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে : সে ষোড়শী। অনির্বাণের বয়স চব্বিশ।
রঘুবীরের মৃত্যুর পর উদ্ধারপ্রাপ্ত হল একটি বিচিত্র উইল। ফিয়াট গাড়িটি বাদে সমস্ত সম্পত্তি তিনি দিয়ে গেছেন একটি ট্রাস্টকে। অনির্বাণ এককভাবে সেই ট্রাস্টি : সম্পত্তির অছি। সে ইচ্ছা মতো সম্পত্তির কেনাবেচা করতে পারবে। পাক্কা ছয় বছরের জন্য অনিবার্ণ খুকুর প্রয়োজন মতো তাকে মাসোহারা জোগাবে। সংসারের যাবতীয় খরচ-খরচা মেটাবে। করবীর বয়স যখন বাইশ বছর হবে তখন সম্পত্তির অধিকার বর্তাবে তার উপর। তার পূর্বে করবীকে ঐ ‘উটকো অছি’ অনির্বাণের কাছে মাসে মাসে হাত পাততে হবে। শুধু তাঁর গাড়িখানা দিয়ে গেছেন পুত্রপ্রতিম অনিবার্ণকে। কেন এমন ব্যবস্থা করে গেলেন সেকথা উইলে সবিস্তারে জানিয়ে গেছেন প্রয়াত রঘুবীর সেন। তার চুম্বকসার দুটি পংক্তিতে বিবৃত করা যায়। এক : তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, মাতৃহীন করবী বয়সের তুলনায় পরিণতবুদ্ধির তরুণী হয়ে ওঠেনি, সে বিশ্বাসপ্রবণ, তাকে সহজেই লোকে ঠকিয়ে নেবে। দুই : অনির্বাণ দত্ত রঘুবীরের মূল্যায়নে খাঁটি মানুষ। তাই তাকেই এককভাবে করে গেলেন ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসরক্ষী।
বাসু বলেন, বুঝলাম। মৃত্যুসময়ে কত টাকা উনি রেখে গেছেন?
—ভাড়াটে বাড়ি, ভূসম্পত্তি নেই, গাড়িটা তো দিয়েছেন আমাকে। তাছাড়া— পেপার ভ্যালু প্রায় এক লক্ষ টাকা মানে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, শেয়ার, ইউনিট ট্রাস্ট, এন.এস. সি. ইত্যাদি।
বাসু বললেন, কিন্তু তুমি যে তখন বললে, ‘তহবিলের তছরুপের পরিমাণটা আড়াই লাখ টাকা?’ —এবার সেই দিকদর্শন যন্ত্রটা তোমার আস্তিনের তলা থেকে বার কর। হিসাবটা কোন দিক থেকে করলে…
অনির্বাণ বাধা দিয়ে বললে, খুকুর বাবা আমাকে শুধু ‘ন্যাসরক্ষক’ বা ট্রাস্টিই করে যাননি, শেয়ার কেনাবেচার নিরঙ্কুশ অধিকারও দিয়ে গিয়েছিলেন। আমি নিজের বুদ্ধিমতো বেচেছি এবং কিনেছি। এখন সেটা বাড়তে বাড়তে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা হয়ে গেছে।
—এ তো আনন্দের কথা। করবী সেনের বাইশ বছর বয়স হতে আর কত দেরি?
—মাসখানেক। ইন ফ্যাক্ট, জুলাইয়ের দশ তারিখ।
—তাহলে সেই সময় টাকাটা ওকে বুঝিয়ে দিও। এক লক্ষ বৃদ্ধি পেয়ে ছয় বছরে আড়াই লক্ষ হওয়াতে সে নিশ্চয় আপত্তি করবে না।
অনির্বাণ সোজা হয়ে বসল। বলল, মুশকিল কি জানেন, স্যার? হিসাব দেখলে খুকু খেপে যাবে। বলবে, কেন আড়াই লক্ষ? কেন নয় দশ লক্ষ?
—আই সী! তাহলে আরও একটু বুঝিয়ে বল। তুমি ‘অছি’ হিসাবে কোন্ ‘ফিনান্সিয়াল ইয়ার’ পর্যন্ত হিসাব ঐ মেয়েটিকে বুঝিয়ে দিয়েছ?
—আমি আজ পর্যন্ত কোনও হিসাবই দিইনি। দেওয়ার উপায় ছিল না। ও প্রথম থেকেই আমাকে শত্রুপক্ষ হিসাবে দেখে এসেছে। ওকে খুব দোষও দেওয়া যায় না। বাপের সম্পত্তিতে তার কোনও অধিকার নেই। প্রতিটি ব্যাপারে আমার কাছে তাকে হাত পাততে হয়। কার ভাল লাগে বলুন?
—তা ঠিক। কিন্তু এমন অদ্ভুত উইল উনি কেন করেছিলেন বলতো, অনিবার্ণ?
—নিঃসন্দেহে কন্যাকে রক্ষা করতে!
—কার কাছ থেকে?
—তাঁর কন্যার অপরিণত বুদ্ধির হাত থেকে।
—আর তোমার হাত থেকে তাকে বাঁচাতে কী ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন সেই ধুরন্ধর ব্যবসায়ী?
—কিছুই নয়। আমাকে তিনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। মুশকিল কী হল জানেন, স্যার, খুকুর বয়স যখন আঠারো, অর্থাৎ আইনত সে যখন সাবালিকা হল, তখন সে আমার বিরুদ্ধে একটা কেস ফাইল করে বসে। যেহেতু সে আইনত সাবালিকা, তাই আমি ঐ উইলের বলে তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য টাকা আটকে রাখতে পারি না। এ মামলা সে স্ব-ইচ্ছায় করেনি আমি জানি, কিন্তু যার পরামর্শেই করে থাকুক, আইনের চোখে সে ছিল বাদী। আমি প্রতিবাদী। মামলায় খুকুর নিরঙ্কুশ হার হল। কাকাবাবু, মানে স্বর্গত রঘুবীর সেন যে উইল করে গিয়েছিলেন তাতে কোনও ফাঁক ছিল না। বিচারক তাঁর রায়ে বললেন, বাইশ বছর বয়স হবার আগে করবী ঐ সম্পত্তিতে হাত দিতে পারবে না। তবে ‘রায়’-এ প্রতিবাদীকেও ‘অ্যাডমনিশ’ করলেন, হিসাব দাখিল না করার জন্য। অবিলম্বে বার্ষিক হিসাব দাখিল করতে বললেন। আমি খুকুকে ডেকে পাঠালাম হিসাব বুঝে নিতে। সে এল না। রাগ করে বসে থাকল।
—আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না, তোমার সমস্যাটা ঠিক কী?
—শুনুন স্যার, বুঝিয়ে বলি। কাকাবাবুর মৃত্যুর পর আমি ভবানীপুরের বাড়ি ছেড়ে কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে একটা মেসে এসে আশ্রয় নিই। খুকু আমাকে বরদাস্ত করতে পারত না। ও সে বছর মাধ্যমিক দেবে। আমি আড়ালে থেকে ছয় বছর ধরে ওর যাবতীয় খরচ জুগিয়ে গেছি। ও যখন আমার বিরুদ্ধে মামলা করল তখন ও হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছে। শুনতে অদ্ভুত লাগবে, কিন্তু ওর সেই মামলা করার যাবতীয় খরচও আমিই দিয়েছি। মামলায় হেরে যাবার পর ও পড়াশোনা ছেড়ে দিল। একদল ছেলের সঙ্গে তখন ওর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তাদের কেউ গ্রুপ থিয়েটার করে। কেউ লিটল ম্যাগাজিন। কেউ বোহিমিয়ান আর্টিস্ট, কেউ কট্টর রাজনৈতিক পার্টির মস্তান। ও তাদের মধ্যে টম-বয়’। বয়েজ-কাট চুল কেটে, প্যান্ট-শার্ট পরে ও সেই দলের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে। সবাই ওর প্রেমিক। সবাই ওকে বিয়ে করতে চায়! কারণ বেকারের দল জানে, দু-চার বছরের ভিতরেই খুকুর হাতে আসবে অন্তত এক লক্ষ টাকা। আমি তাই খুকুকে জানাতে পারলাম না যে, ওর পৈত্রিক উত্তরাধিকারের অর্থমূল্য এক লাখ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আড়াই লাখ হয়ে গেছে। বরং ওকে মিথ্যা করে এমন ভাব দেখাতাম যে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ওর ভাগে দেড়-দু হাজার টাকা হয়-কি-না হয়! তাছাড়া খুকুর বাবার নামে যত শেয়ার ছিল সব আমি আমার নিজের নামে ট্রান্সফার করিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নাহলে শেয়ার মার্কেটে সকাল-বিকাল কেনাবেচা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। খাতা-কলমে খুকুর প্রাপ্য সত্যিই দেড়-দু হাজার টাকা। কারণ বাকি অংশটা আমার নামে রয়েছে। এটা তহবিল তছরুপ নয়?
—আলবাৎ তহবিল তছরুপ। ট্রাস্টি বা অছি হিসাবে তুমি এভাবে ন্যাসবদ্ধ অর্থ নিজের নামে পরিবর্তন করতে পার না। তা আইনত যাই হোক, টাকাটা যখন তুমি ওকে ফিরিয়ে দিতে রাজি…
—মুশকিল কি জানেন, স্যার, টাকাটা আমি ওকে ওর বাইশতম জন্মদিনে ফিরিয়ে দিতে রাজি নই!
—সে কি! কেন? তুমি সত্যই তহবিলটা তছরুপ করতে চাও? আর সে বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইছ!
—কী মুশকিল! আপনি সমস্যাটা বুঝতে পারছেন না। খুকুর চারপাশে এক ঝাঁক হাঙর! তারা প্রতীক্ষা করে আছে ওর বাইশতম জন্মদিনের জন্য! দেখুন স্যার, কাকাবাবু যা চেয়েছিলেন তা আমি অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছি। ওকে অমিতব্যয়ী হতে দিইনি। হাতে যথেষ্ট টাকা থাকলে ও যে শুধু মদে থামতো, না হেরোইন, এল. এস. ডি.-তে তা খোদায় মালুম। আমি নিশ্চিতভাবে জানি, ওর দু-একটা বন্ধু ড্রাগ অ্যাডিক্ট! তাই ওকে না জানিয়ে আমি ওর বাবার আশীর্বাদটাকে আড়াই গুণ বৃদ্ধি করেছি। ওকে বাঁচিয়েছি ওর নিজের কাছ থেকে। এখন আমি কীভাবে দু-কূল রক্ষা করতে পারি আপনি একটা বুদ্ধি বাংলান।
—ঠিক কার আক্রমণ থেকে ওকে রক্ষা করতে চাও?
—শুধু ওর তথাকথিত প্রেমিক বন্ধুদের আক্রমণ থেকে নয়, ওর নিজের অপরিণত বুদ্ধির হাত থেকে।
—একবার মামলা করে হেরেছে। সে নিশ্চয় খেপে আগুন হয়ে আছে। এবার মামলা করলে সে তোমাকে জেল খাটাতে পারে। তা জান?
—কী মুশকিল! তাই জানি বলেই তো কলকাতা-বারের সবসেরা ব্যারিস্টারের শরণ নিয়েছি। আপনি স্যার, এমন একটা বুদ্ধি বাৎলান যাতে লাঠিটাও না ভাঙে আর সাপগুলো না মরলেও যেন ভেগে যায়।
—তোমার নামে যে আড়াই লক্ষ টাকার শেয়ার আছে, তা বাস্তবে করবী সেনের প্রাপ্য, এ- কথা কেউ জানে না?
—এই তো আপনি জানলেন।
—ধর যদি তোমার মৃত্যু হত? গত বছর, গত মাসে?
—আমার বয়স ত্রিশ, স্বাস্থ্য ভাল। কলেজে ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম। মরবার কোনও লক্ষণ তো ছিল না স্যার?
—কলকাতা শহরে মোটর অ্যাকসিডেন্টে ত্রিশ বছরের যুবক কোনদিন মরেনি? সেক্ষেত্রে টাকাটা তোমার ওয়ারিশ পেত। করবী সেন জানতেও পারত না যে, তুমি তাকে কীভাবে বঞ্চিত করেছ।
—না, স্যার, তা হত না। প্রথমত, আমার তিনকুলে কেউ নেই। আপনি বলবেন, ‘আড়াই লাখ টাকার সম্পত্তি রেখে যদি কেউ মারা যায় তাহলে লতায়-পাতায় সম্পর্ক ধরে ওয়ারিশ ঠিকই হাজির হয়।’ তা হয়, অস্বীকার করব না। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও সে কিছু পেত না। কারণ আমি একটি উইল করে রেখেছি। তার কপি আমার সলিসিটারের কাছে আছে। যে ব্যাঙ্কভন্টে অরিজিনাল শেয়ারগুলো আছে, সেই ভল্টেও এক কপি রাখা আছে। আমার স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি আমি ওকেই দিয়ে গেছি সেই উইলে।
বাসুসাহেবের পাইপে আর তামাক ছিল না। পোড়া ছাইটা অ্যাশট্রেতে ঝেড়ে ফেলে উনি বললেন, লুক হিয়ার ইয়ং ম্যান, তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিজনেস ভাল বোঝ, এক্ষেত্রে তুমি এতবড় রিস্ক নিতে পার একটিমাত্র হেতুতে। সেটা এবার নিজমুখে স্বীকার কর। আমি মনস্থির করি কেসটা নেব, না নেব না।
অনির্বাণ পুরো দশ সেকেন্ড নির্বাক তাকিয়ে রইল বাসু-সাহেবের দিকে। তারপর বললে, অল রাইট স্যার, আই কনফেস। আপনি যা আন্দাজ করেছেন তাই!
—কথাটা ওকে জানিয়েছ কখনো?
—জানিয়েছিলাম। কাকাবাবু বেঁচে থাকতে। কিন্তু তখন ও প্রায় কিশোরী! আমার সঙ্গে বয়সের ফারাকটা তখন খুবই প্রকট। ও বলেছিল, ‘তা হয় না অনিদা! তোমাকে চিরকাল নিজের দাদার মতো দেখে এসেছি। ওকথা যদি আর কোনদিন বল, তাহলে এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাও থাকবে না। আমি কথাই বলব না তোমার সঙ্গে।… তারপর ওর বাবার মৃত্যুর পর সম্পর্কটা তিক্ত হয়ে পড়ে। ও বুনো ঘোড়ার মতো সর্বদা আমাকে চাট মারবার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত। যে কারণে আমি ওদের বাড়ি ছেড়ে মেসবাড়িতে উঠে আসি। আর মামলার হেরে যাবার পর তো সে আমার সঙ্গে সরাসরি কথাই বলে না। যেটুকু কথাবার্তা হয়— টাকাপয়সা নিয়ে — তা টেলিফোনে।
—তোমার মেসে টেলিফোন আছে?
—না নেই, অফিসে আছে।
বাসু বললেন, অলরাইট! আমি তোমার কেসটা নিলাম। তুমি কি ওঘরে কোনও রিটেইনার’ দিয়ে এসেছ?
— আজ্ঞে না। উনি বললেন, আপনি যদি কেসটা নেন তাহলেই অগ্রিম দেওয়ার প্রশ্ন উঠবে। বাসুসাহেব মনে মনে হাসলেন। নেড়া তাহলে একবারের বেশি বেলতলায় যায় না। বাসুসাহেব সাক্ষাৎপ্রার্থীকে ক্লায়েন্ট হিসাবে মেনে নেওয়ার আগে রানু আর কিছুতেই রিটেইনার গ্রহণ করেননি।* [* ব্যাখ্যা : কৌতূহলী কনের কাঁটায়] বললেন, শোন অনির্বাণ, তোমাকে তিনটি কাজ করতে হবে। এক নম্বর : আমাকে একটা অ্যাকাউন্ট-পেয়ী চেকে ‘রিটেইনার’ মানি দিয়ে যাও, এক হাজার- যাতে আমি তোমাকে আইনত মক্কেল বলে স্বীকার করতে পারি। দু’নম্বর : তোমার লেটারহেডে একটা ঘোষণাপত্র লিখে ফেল টু হুম ইট মে কনসার্ন’—– জাতীয় স্বীকারোক্তি। তাতে লিস্ট করে সাজিয়ে দাও যেসব শেয়ার তোমার নামে বর্তমানে আছে, যা তুমি বিশেষ কারণে নিজের নামে রেখেছ এবং যার মালিক করবী সেন, তুমি যার ন্যাসপাল বা ট্রাস্টি! ওটা আমাকে কাল বিকালের মধ্যে পৌঁছে দিয়ে যেও।
—আপনি, স্যার, তিনটি কাজের কথা বলেছিলেন। তৃতীয়টা?
—তিন নম্বর কাজটা হচ্ছে করবীকে কাল টেলিফোন করে বল যে, সে যেন আমার সেক্রেটারিকে একটা ফোন করে। আমি তার সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে চাই।
—কেন স্যার?
—বাইশতম জন্মদিনে সে কী পরিমাণ উত্তরাধিকার লাভ করবে তার ইঙ্গিত তাকে আগেভাগে জানাতে হবে। তুমি যদি তা বলতে যাও তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমি হয়তো ওকে বুঝিয়ে দিতে পারব ব্যাপারটা। ও তখন তোমার উপর রাগ করতে পারবে না।
—কিন্তু একটা কথা। আপনি যেন কোনক্রমেই ওকে বুঝতে দেবেন না যে, আমি…… মানে….
—পাগলামি কর না। এটা কোন ‘প্রজাপতি মার্কা অফিস নয়। তুমি কাকে ভালবাস, কাকে বিয়ে করবে, তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। সেসব প্রসঙ্গ আদৌ উঠবে না। আমার একটিমাত্র লক্ষ্য : তুমি যে ‘ন্যাসনাশী’ নও, ‘ন্যায়নিষ্ঠ ন্যাসপাল’ এটা প্রমাণ করা। যাতে করবী তার বাপের সম্পত্তিটা সুদে-আসলে পায়। যাতে তোমার হাতে হাতকড়া না পড়ে। তারপর সে কাকে বিয়ে করল তা জানতে আমার কোনও গরজ নেই।
অনিবার্ণ স্থির হয়ে বসে রইল দশ সেকেন্ড। তারপর বললে, অলরাইট! এছাড়া আর কোন পথ নেই যখন…
পকেট থেকে চেকবুকটা বার করল সে।
বাসুও বললেন, অলরাইট! এছাড়া যখন তুমি খুশি মনে বিদায় নেবে না, তখন আরও বলি : সে যাতে হাঙরের পেটে না যায় সে-চেষ্টাও করব আমি।
একগাল হেসে অনির্বাণ চেকটা লিখতে থাকে।