পাঁচ
পরদিন সকালে, ছেলে-মেয়েরা করালের পাশে জড় হলো।
‘ভাগাভাগি হয়ে শুরু করা যাক,’ বলল কিশোর, ‘রবিন আর আমি এখানকার আশপাশ আর মূর্তিটার কাছে তল্লাশী চালাব।’
‘আমি নেকড়েমানুষের পায়ের ছাপ ফলো করে জঙ্গলে ঢুকব,’ বলল জিনা। ‘হয়তো কোন কু পেয়ে যেতে পারি।’
‘রাফি আর আমি ব্লু খুঁজব কিচেনের চারপাশে,’ বলল মুসা। ‘নেকড়েমানুষটা হয়তো খুব পেটুক। ওখানে হয়তো কোন কু ফেলে গেছে।’
‘উঁহুঁ, তোমরা আমার সাথে যাবে,’ বলল জিনা। ‘অনেক জায়গা কাভার করতে হবে, তোমাদের হেল্প কাজে লাগবে।’
করালের ওপাশে হেঁটে গেল জিনা, ধুলোটে মাটিতে চোখ রেখে। নেকড়ের পায়ের ছাপ খুঁজছে।
‘ওই যে!’ বলে মাটির দিকে আঙুল তাক করল ও। ‘ছাপগুলো ফলো করো!’
জিনা, মুসা আর রাফি ছাপগুলো অনুসরণ করে বনভূমির ভিতরে ঢুকে পড়ল। পাথরগুলো ঘিরে, ডালপালার নীচ দিয়ে হেঁটে বেড়াল ওরা।
‘খাইছে, চারজনের নাস্তা খেয়েছি তাও মনে হচ্ছে যথেষ্ট নয়, ‘ বলল মুসা। ‘কাহিল লাগছে।’ ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিতে লাগল ও। এমনকী রাফিও হাঁফাচ্ছে।
‘তার কারণ আমরা চড়াই বাইছি,’ বলল জিনা। ‘দেখে-শুনে পথ চোলো। নইলে হোঁচট খেয়ে পড়বে।’
‘কীসে হোঁচট খাব?’ প্রশ্ন করল মুসা।
‘উপস!’ জিনা আচমকা ছোট এক পাথরে হোঁচট খেল। ও নরম শেওলার উপর পড়তেই ওর চোখ থেকে চশমাটা উড়ে গেল।
রাফি ঘেউ করে উঠে দৌড়ে এল জিনার কাছে।
‘পাথরটা দেখতে পাইনি,’ বলল জিনা, উঠে বসল। ‘চশমাটা খুঁজতে হবে।’
‘ভেবো না, জিনা,’ বলল মুসা। ‘ওটা এখুনি খুঁজে দিচ্ছি রাফি আর আমি। রাফি, আয়।’
মুসা আর রাফি জিনার চশমা খুঁজতে শুরু করল। জিনা নিজেও মাটি হাতড়াতে লাগল। গুড়ি মেরে ক’ফীট এগিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। মৃদু চাপড় দিল কার যেন লোমশ এক পায়ে।
আলো আঁধারিতে জিনার মনে হলো ওটা রাফি। লোমশ একটা থাবা চেপে ধরল ওর হাত।
‘আমার চশমাটা ঝটপট খুঁজে দিলে দুটো স্ন্যাকস দেব,’ বলল জিনা মুখ তুলে না চেয়েই। উঠে দাঁড়াল।
‘জিনা, তোমার চশমা পাওয়া গেছে,’ এসময় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ও আর রাফি জিনার কাছে হেঁটে এসে ওর হাতে চশমাটা দিল।
জিনা হতচকিত।
‘রাফি যদি তোমার সাথে থাকে,’ বলল মুসাকে, ‘তা হলে আমাকে এইমাত্র হাত ধরে কে ওঠাল?’
জিনা, মুসা আর রাফি সবাই ঘুরে দাঁড়িয়ে পিছন দিকে চাইল। সেই নেকড়েমানুষটা!
‘নেকড়েমানুষ!’ চিৎকার ছাড়ল ওরা। তারপর উল্টো ঘুরে দৌড় দিল।
নেকড়েমানুষটা ভয়ানক শব্দে গর্জে উঠল।
‘গররর!’
জিনা গা ঢাকা দিতে লাফিয়ে পড়ল বড়সড় এক ঝোপের পিছনে। নেকড়েমানুষ থাবা চালাল মুসা আর রাফিকে লক্ষ্য করে। ওরা ঘুরে দৌড় দিল জঙ্গলের দিকে।
‘আরও জোরে, রাফি!’ জরুরি তাগিদ মুসার কণ্ঠে, রাফিকে ঠেলে নিয়ে চলল। ‘আমাদেরকে ধরে ফেলছে!’ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে মুসা আর রাফি, গাছপালার ফাঁকে এঁকেবেঁকে। পাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে পেরোচ্ছে ওরা, মাথা নোয়াচ্ছে ডালপালার নীচে। নেকড়েমানুষ ছুটছে পায়ে-পায়ে। সারা পথ গর্জাচ্ছে।
‘এদিকে, রাফি,’ বলল মুসা। ও আর রাফি আচমকা বাঁক নিয়ে ফাঁকা এক জায়গার উদ্দেশে দৌড় দিল।
‘খাইছে, মনে হয় খসাতে পেরেছি,’ বলল মুসা। ‘তবে আমাদের কোথাও লুকানো দরকার, বলা তো যায় না। দৌড়নোর ফাঁকে লুকানোর জায়গা খুঁজল ওরা। এসময় মুসার চোখে পড়ল মাটিতে পড়ে রয়েছে বিরাট বড় এক ফাঁপা গুঁড়ি।
‘চলে আয়, রাফি,’ বলল মুসা। গুঁড়িটার ভিতরে গা ঢাকা দেয়া যাবে। ওকে আর রাফিকে সটান শুয়ে থাকতে হবে। ‘এখন বুঝতে পারছি সার্ডিনের কেমন লাগে।’
এসময় ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে একটা মর্মরধ্বনি উঠেছে কানে এল ওদের। কে যেন ওদের দিকে হেঁটে আসছে। মুসা থামাতে পারার আগেই গুঁড়ির এক প্রান্ত দিয়ে মাথা বের করে দিল রাফি।
ঘেউ-ঘেউ।
‘গররর!’ নেকড়েমানুষটা গর্জন ছাড়ল।
রাফি ঝট করে মাথা সরাতেই গুঁড়িটা লক্ষ্য করে থাবা চালাল নেকড়েমানুষ।
‘খাইছে, এখন আমাদেরকে ধরবে!’ গুঁড়িটা দুলতে শুরু করল।
‘কী হচ্ছে এসব?’ মুসা প্রশ্ন করল।
মস্ত গর্জন ছেড়ে, গুঁড়িটাকে জোর ঠেলা দিল নেকড়েমানুষ। একটা পাথরের উপর দিয়ে ধীরে-ধীরে গড়িয়ে গেল ওটা। এবার গতি সঞ্চার হলো। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে নামতে লাগল। সোজা রানশের দিকে চলেছে ওরা।
‘আআআ-উউউ!’ গুঁড়ির ভিতর থেকে আর্তচিৎকার ছাড়ল মুসা।
আর রাফি তারস্বরে ঘেউ-ঘেউ করতে লাগল।