নৃত্যশিল্পীর মৃত্যু-তদন্তে একেনবাবু – ৯

ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম! ফ্র্যান্সিস্কার তো বিস্ফারিত চোখ। 

“আপনি কবে সন্দেহ করা শুরু করেছিলেন অভীককে,” আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“খটকাটা স্যার শুরু হয়েছিল যখন গেস্ট হাউসে গিয়ে দুটো জিনিস দেখি।”

“কোন দুটো?”

“এক নম্বর হল বাথরুমের জানলা খোলা আর এগজস্ট ফ্যান চলছে। অর্থাৎ বাথরুমের ভেতরের বাতাস বার করে বাইরের বাতাস ভেতরে আনা হচ্ছে। শুধু কি দুর্গন্ধ দূর করার জন্যে, না বাথরুমের বাতাস কোনো কারণে বিষাক্ত ছিল? 

“দু-নম্বর ক্লজেটে অ্যাক্টিভেটেড চারকোল ফিল্টার লাগানো মাস্ক। দেখামাত্র বুঝেছিলাম ওগুলো কলকাতার পলিউশনের জন্য নয়। ওই ধরনের মাস্ক খানিকক্ষণের জন্য হলেও বিষাক্ত গ্যাস থেকে প্রোটেকশন দিতে পারে। তার ওপর একটা মাস্ক মিসিং! তার মানে ওটা ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু কীসের জন্য? চিন্তাভাবনা শুরু হল আর তখনই ফেসপেইন্ট, রাইসিন এগুলো মাথায় এল। ফেসপেইন্টে রাইসিন থাকলে পারমিতা ম্যাডাম যখন গ্রিনরুমে বা স্টেজে ফেসপেইন্ট লাগাবেন এবং পরে নাচা শুরু করবেন, তখন রঙে মেশানো রাইসিনের কিছু অংশ শ্বাস নেবার সময়ে ফুসফুসে ঢুকবে। তারও বেশি ঢুকবে যখন পারমিতা ম্যাডাম রং তোলার জন্য বাথরুমে গিয়ে গরম জলে মুখ ধোবেন, কারণ রাইসিনের ভাপ তখন নাকে যাবে। এটাই নিশ্চয় অভীকবাবু অনুমান করেছিলেন। আর সেই জন্যেই ম্যাডাম পারমিতা চলে যাবার পর বাথরুমের বাতাস বিষমুক্ত করার জন্য এগজস্ট ফ্যান চালিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা জানি না। তবে মিসিং মাস্কটা যে উনি রাইসিন পাউডার মেশানোর জন্যে ব্যবহার করেছিলেন, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।”

“কী করে আপনি জানলেন অভীকই রাইসিন পাউডার ব্যবহার করেছিল?” প্রমথ প্রশ্ন করল। 

“কী মুশকিল, সেটা তো আপনার দৌলতে স্যার!”

“আমার দৌলতে!”

“হ্যাঁ, মনে আছে স্যার, অভীকবাবু যেদিন আমাকে চেক দিচ্ছিলেন আপনি আমাদের দু-জনের ছবি তুলে হোয়াটস অ্যাপ-এ আমাকে পাঠালেন?”

“মনে থাকবে না কেন!”

“আজ সকালে খাবার আগে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট যখন জানালেন হার্লেমে এক ড্রাগ-অ্যাডিক্ট ধরা পড়েছে রাইসিন বানানোর জন্যে এবং স্বীকার করেছে একজনকে ইতিমধ্যেই খানিকটা বিক্রি করেছে, আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘরে গিয়ে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে হোয়াটস অ্যাপ-এ ওই ছবিটা ফরোয়ার্ড করে দিয়ে অভীকবাবুকে আসতে বললাম। আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম অভীকবাবুই ওটা কিনেছিলেন। ওঁদের কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে হার্লেমে। কনস্ট্রাকশন বিজনেসে নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড কানেকশন কারও কারও থাকে। সেক্ষেত্রে এই ধরনের জিনিস জোগাড় করার ব্যাপারে অল্প-বিস্তর সাহায্য উনি পেতেই পারেন। যাই হোক, ধৃত লোকটি যে অভীকবাবুকে আইডেন্টিফাই করেছে সেই মেসেজটা পেলাম যখন আমরা খাচ্ছি।”

“আপনি আবার হোয়াটস অ্যাপ-এ এত পোক্ত হলেন কবে?”

“কী যে বলেন স্যার, সবই তো আপনাদের শিক্ষা।”

“একটা জিনিস কিন্তু আমার কাছে ক্লিয়ার নয়। মিন্স আর অপরচুনিটি ছিল বুঝতে পারছি, মোটিভটা কী ছিল?” প্রশ্নটা এবার আমিই করলাম। 

“এখন যা বলছি, সেটা আমার অনুমান। কনস্ট্রাকশন বিজনেসে ঢোকা নিয়ে পারমিতা ম্যাডামের শুধু আপত্তি ছিল তাই নয়, উনি বোধহয় সন্দেহ করেছিলেন এর মধ্যে অভীকবাবুর কিছু ব্যক্তিগত লেনদেন ও স্বার্থ জড়িত। দু-দশ ডলারের ব্যাপার নয়, আমি বলছি মিলিয়নস অফ ডলারের কথা। নইলে একজন সফটওয়্যারের ম্যানেজার হঠাৎ করে মালিককে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিশাল কনস্ট্রাকশন বিজনেসে পার্টনারশিপ নেওয়াবেন কেন? অভীকবাবুও নিশ্চয় আঁচ করেছিলেন পারমিতা ম্যাডামের সন্দেহের ব্যাপারটা। হাতেনাতে ধরা পড়ার আগে যত তাড়াতাড়ি ওঁকে সরিয়ে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এগুলো সব ক্লিয়ার হবে পুলিশ যখন কোম্পানির কাগজপত্র পরীক্ষা করা শুরু করবে, ডলার নিয়ে নয়-ছয় করা চোখে পড়বে। আসলে মার্ডারের সবচেয়ে বড়ো মোটিভ হচ্ছে মানি আর…।” পরের কথাটা ফ্র্যান্সিস্কা থাকায় আর বলতে পারলেন না একেনবাবু। লজ্জা-লজ্জা মুখে বসে রইলেন। 

প্রমথ কি ছাড়বে! “আঃ, বলেই ফেলুন না সেক্স।”

“কী যে বলেন স্যার, এখানে তো শুধু মানি।”

ফ্র্যান্সিস্কা এতক্ষণ একেনবাবুর ব্যাখ্যান চুপ করে শুনছিল, শেষ হতে না হতেই একেনবাবুর গালে চকাস করে চুমু দিয়ে বলল, “ডিটেকটিভ, তুমি সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট।”