নৃত্যশিল্পীর মৃত্যু-তদন্তে একেনবাবু – ৫

পরের দিন সকালে কাঁটায় কাঁটায় আটটার সময়ে ভাস্কর এল। প্রমথ তখন সেকেন্ড রাউন্ডের কফি বানাচ্ছে। খুশবাইয়ে ঘর ম-ম করছে। 

“বাঃ, সময়মতোই তো এসে পড়েছি,” ভাস্কর সোফায় বসতে বসতে বলল। 

একেনবাবু প্রমথর সঙ্গে ভাস্করের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত লোকদের প্রমথ আবার পছন্দ করে না। তাই আগে থেকেই ভাস্করের আসার কারণটা ওকে বলে রেখেছিলাম, যাতে উলটোপালটা কিছু না বলে। 

ভাস্কর অসম্ভব কথা বলতে ভালোবাসে, অনেক তথ্যই বিতরণ করে। কোনটে বিশ্বাসযোগ্য, কোনটে নয়— সেটা যাচাই করা কঠিন। প্রথমেই একটা বম্বশেল ফাটাল— পারমিতার সত্যিকারের বাবা নাকি রজত মুখার্জী, যাঁকে আমরা ওর মামাবাবু বলে জানি। 

একেনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “তাই নাকি স্যার! ভেরি ইন্টারেস্টিং।”

প্রমথ ধূমায়িত কফি ভাস্করের সামনে রেখে জিজ্ঞেস করল, “এটা কীভাবে জানা গেল, কোনো ডিএনএ টেস্টিং থেকে?”

প্রমথর এই চ্যালেঞ্জে অবশ্য ভাস্কর দমল না। “এটা সবাই সন্দেহ করে। কুমকুম মাসিমা মানে রিঙ্কিদির মা রজতবাবুর বাড়িতেই থাকেন, ওঁর স্বামীকে কেউ দেখেনি…।”

“সে কি, আমি তো শুনেছিলাম, ওঁর স্বামী মারা যাওয়াতে উনি ওঁর দাদার কাছে এসে থাকতেন!”

মুচকি হাসল ভাস্কর, “দাদা! ওসব তো প্রচার।” কথাটা বলে কফিতে চুমুক দিল। 

প্রমথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল… এইভাবে চললে সত্যি-মিথ্যা কোনো তথ্যই মিলবে না। আমি আড়ালে চোখ পাকালাম। একেনবাবুও প্রমথকে উদ্দেশ করে হিন্ট দিলেন, “আমরা স্যার আদার ব্যাপারী, জাহাজের খবর জেনে কী হবে!” তারপর ভাস্করকে বললেন, “ব.5 দরজার ভেতরে ক। ঘটছে না ঘটছে, আমরা তার কতটুকু জানি। সত্যি স্যার, কত কিছুর খোঁজ রাখেন আপনি!”

ভাস্কর খুশি হল, এরকম একজন অ্যাপ্রিশিয়েটিভ শ্রোতা পেয়ে। তবে প্রমথকেও স্বীকৃতি দিল, “সব কিছুই কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, কিছু কিছু প্রশ্ন তো থাকেই। তবে রিঙ্কিদিকে যে পুলিশ আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার জন্য গ্রেফতার করেছিল, সেটা সত্যি। পরে অবশ্য ছেড়ে দেয়। আচ্ছা বলুন তো, কেউ সুইসাইড করার আগে কাউকে দায়ী করে গেলে কেন এই ঝামেলা পোয়াতে হয়! সুইসাইড তো জোর করে কেউ কাউকে করাচ্ছে না। সুইসাইড হল স্বেচ্ছামৃত্যু। 

কার প্রসঙ্গে ভাস্কর এই তথ্যটা দিল, ঠিক বুঝলাম না। তবে এই আইনের পেছনে যে কিছু যুক্তি নেই তা নয়। যেমন, পারিবারিক নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যা। কিন্তু সে নিয়ে কথা বাড়ানো অর্থহীন। 

একেনবাবু অবশ্য কথাটাকে যেতে দিলেন না। “দায়ী করার কোনো কারণ লেখা ছিল স্যার?”

“সেটা জানি না, কিন্তু অনুমান করতে পারি প্রেমঘটিত। রিঙ্কিদি সারাজীবনই 

অনেকের সঙ্গে প্রেম করে গেছে— এক জনকে ছেড়ে আরেক জনকে ধরেছে। এই ধরনের নির্বিচার ডাম্পিং সব সময়েই ডিভাস্টেটিং। হয়তো তারই ফল এই আত্মহনন। 

“খুবই দুঃখের কথা স্যার, তবে সেটা না করে রেগে গিয়ে অন্য পার্টিকে খতম করলে ব্যাপারটা আরও বাজে হত… দু-দুটো প্ৰাণ নষ্ট।”

“একদম ঠিক বলেছেন। এটা শুনে মনে পড়ে গেল, এক প্রাক্তন প্রেমিক তো রিঙ্কিদিকে গ্রিনরুমে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিল। সময়মতো সিকিউরিটি লোকটাকে ধরে ফেলেছিল বলে রক্ষা! সেই নিয়ে কেস হয়, বিচারে লোকটার জেলও হয়। বেশ হইচই হয়েছিল কিছুদিন।”

এইটেই আমি কোনো বাংলা পত্রিকায় কোথাও পড়েছিলাম, ক’দিন আগে যেটা মনে করার চেষ্টা করছিলাম! লোকটার সঙ্গে পারমিতার কিছু ঘনিষ্ঠ ছবিও পত্রিকাতে বেরিয়েছিল! 

“আচ্ছা স্যার, যিনি সুইসাইড করেছিলেন, তাঁর কথা কিছু জানেন?”

“না, আমি তখন দিল্লিতে আমার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আর যে খোঁজখবর রাখত, সেই ছোড়দি তখন কলকাতায় থাকত না, বিয়ে করে ইংল্যান্ড চলে গিয়েছিল।”

“আপনি গতকাল বলেছিলেন তৃণা ম্যাডামের ফোন পারমিতা ম্যাডাম ধরতে চাননি, তার কারণটা কিন্তু কালকে আপনি বলেননি স্যার।”

“ও হ্যাঁ, পারমিতাদি আর তৃণাদির মধ্যে ঝগড়া লাগে এক পুরুষবন্ধুকে নিয়ে। এত ঝগড়া যে তৃণাদি নাকি রাগ করে মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিয়েছিল! হয়তো তৃণাদির প্রেমিককে রিঙ্কিদি কবজা করেছিল, কে জানে! তৃণাদি তো আর বিয়েই করেনি।”

“সেই যুক্তিটা বোধহয় টিকবে না স্যার, আপনার পারমিতাদিও তো বিয়ে করেননি।”

“তা ঠিক। আচ্ছা, আপনাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, আপনি তো রিঙ্কিদির মৃত্যু নিয়ে তদন্ত করছেন শুনলাম, পুলিস কি কিছু সন্দেহ করছে?”

“আই হ্যাভ নো ক্লু স্যার।”

“ওয়াইল্ড গুজ চেজ। আপনি এখানে বসে একা কী করতে পারবেন! অভীকদাও ওর বসের খ্যাপামিতে খুবই বিরক্ত। ওকে নাকি বলে গেছেন মানি শুভ নট বি এনি অবজেক্ট, খুনিকে ধরতেই হবে! আমাকে দুঃখ করে বলছিলেন, ‘এদিকে হার্লেমে ব্লাস্টিং চলছে- হান্ড্রেড মিলিয়ন ডলারের প্রোজেক্ট, আর বস বলে গেছেন একেনবাবুর সঙ্গে সঙ্গে যেন থাকি, কী ঝামেলা বল তো!’ সরি, কিছু মনে করবেন না আপনাকে কথাটা বলে ফেললাম!”

“আরে না না স্যার, তাতে কী হয়েছে। বলে ভালো করেছেন, চেষ্টা করব : ওঁকে না জ্বালাতে।”

“তাতে আপনার তদন্তের ক্ষতি হলে কিন্তু ভালোর থেকে ওর মন্দ হবে। এটা আপনাকে বলে দিয়েছি শুনলে অভীকদা আমার ওপর রাগ করবে।”

“কাউকে কিচ্ছু বলব না স্যার।”

এবার আমি প্রশ্ন করলাম ভাস্করকে, “ব্লাস্টিং-এর ব্যাপারটা কী? আমি তো শুনেছিলাম রজতবাবু সফটওয়্যারের বিজনেস করেন এদেশে।”

“তা তো করেনই। এই বছরই অভীকদার পরামর্শে একটা কনস্ট্রাকশন বিজনেসে পার্টনারশিপ নিয়েছেন। আসল টাকা নাকি রিয়েল এস্টেট আর কনস্ট্রাকশনে। হার্লেমে পুরোনো টেনামেন্ট ভাঙা হচ্ছে নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি হবে বলে। তার জন্যই ব্লাস্টিং চলছে।”

“এবার বুঝলাম।”

“আপনি বুঝলেন, কিন্তু আমি বুঝলাম না।” ভাস্কর বলল। 

“মানে?”

“মিস্টার মুখার্জীর তিন কুলে কেউ নেই, এত টাকা কার জন্য রেখে যাবেন! ভাগ্নি বলুন, মেয়ে বলুন সেও তো চলে গেল! আমি জানি রিঙ্কিদিও এর বিরুদ্ধে ছিল।”

“কীসের বিরুদ্ধে স্যার?”

“এই নতুন ব্যাবসা শুরু করার বিরুদ্ধে। রিঙ্কিদির বিজনেস ব্যাপারটাই ভালো লাগে না। নাচ-টাচ নিয়েই মেতে থাকে। আবার আরেকটা ঝামেলায় জড়ানো। এই নিয়ে রিঙ্কিদির সঙ্গে খটাখটিও হয়েছে রজত আঙ্কলের। কিন্তু আঙ্কলের আবার অভীকদার ওপর খুব আস্থা। যাই হোক, এবার আমি উঠি। সাড়ে ন’টায় একটা মিটিং আছে। আর যদি কিছু জানতে চান, আমাকে ফোন করবেন। নম্বরটা সেভ করে রেখেছেন তো?”

“করব স্যার, নম্বরটা আছে আমার কাছে।”

.

ভাস্কর চলে যাবার পর প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “বকবকানিতে আপনার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এই ভাস্কর। ফালতুও বকে বেশ।”

“সব কথা বোধহয় ফালতু নয় স্যার,” একেনবাবু ওঁর ফোনটার দিকে তাকাতে ভাতে বললেন। 

জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলতে চাচ্ছেন?”

“এই যে স্যার,” ফোনটা দেখিয়ে উত্তর দিলেন, “রাখালের পাঠানো ইনফর্মেশনগুলো পড়ছি। ওকে বলেছিলাম পারমিতা ম্যাডাম সম্পর্কে যা যা খবর সংগ্রহ করতে পারে জানাতে। ওখানেও একটা ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে… রাখাল সেটারই চার্জে।”

“আপনি মশাই সামথিং, এসব যে শুরু করেছেন আমাদের তো বলেনওনি!” প্রমথ রাগ দেখাল। 

“কী মুশকিল স্যার, এই তো এখন বলছি!”

“ননসেন্স! কী লিখেছেন রাখালবাবু এখন বলুন। আর ঢেকে-চেপে নয়, যা যা আছে সব।”

“ঢাকব কেন স্যার, সবই বলছি। আত্মহত্যার কেসে মিস পারমিতাকে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারটাও আছে। সুতরাং ভাস্করবাবু ভুল কিছু বলেননি। তবে একটা খবর উনি বলেননি।”

“সেটা কী?” এবার আমি জিজ্ঞেস করলাম। 

“এক বন্ধুর বেবিকে আদর করার সময়, হাত থেকে বেবি পড়ে যায়। ফলে সিভিয়ার পার্মানেন্ট ইনজুরি। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ ঝামেলা এড়াতে পুলিশে রিপোর্ট করেছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অ্যাক্সিডেন্ট বলে আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি। বন্ধুও তার বেবিকে নিয়ে লন্ডনে ফিরে যায়।”

“মাই গড, এই হয়তো ভাস্করের সেই ছোড়দি!” আমি বললাম। “আপনি কি মনে করেন ইচ্ছে করেই এই ঘটনার কথা ভাস্কর বলেনি, না জানার তো কথা নয়।”

“দুম করে একটা কনক্লুশন করে ফেললি!”

প্রমথর মন্তব্যের প্রতিবাদে আমি বললাম, “কেন, ভাস্করের ছোড়দি তো ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল, যায়নি?”

“প্রতিদিনই অনেকের ছোড়দি ইংল্যান্ডে যায়, সো হোয়াট!”

এটা একটা যুক্তি হল! ব্যাটাকে তুলোধোনা করতে যাচ্ছি, তার আগেই প্রমাকে উদ্দেশ করে একেনবাবু বললেন, “আরেক কাপ কফি হলে জমত স্যার, তাই না বাপিবাবু?”

“এত ঘন ঘন কফি পায় কেন আপনার? 

“কারণ স্যার, আপনার কফি হচ্ছে স্বর্গীয়। 

‘এইসব তেল আপনার ‘ফ্রেন্ড দ্য গ্রেট’ বাপিকে মারবেন!” কথাটা বলল বটে, কিন্তু কিচেনে গেল কফি গ্রাইন্ড করতে।