৪
এ যাত্রায় প্রমথ যোগ দিল না, আমি আর একেনবাবুই গেলাম। ব্রুকলিনের বন্ড স্ট্রিটে আগে আমি আসিনি। অনুরাধাদের অ্যাপার্টমেন্টটা পাঁচ তলায়। যখন পৌঁছোলাম অনুরাধার বর ভাস্কর অফিস থেকে ফেরেনি। পারমিতার থেকে অনুরাধা কয়েক বছরের ছোটো। নাচ শিখেছিল একই গুরুর কাছে। বোঝাই যায় পারমিতাকে হিরো-ওয়ারশিপ করত। কথাকলি জগতে এটা অপূরণীয় ক্ষতি সজল চোখে বার বার বলল।
“রিঙ্কিদি নিউ ইয়র্কে আসছে শুনেই ফোন করেছিলাম আমাদের কাছে এসে থাকার জন্যে। প্রথমে আসতে পারবে না বলেছিল। পরে নিজের থেকেই এল দিন চারেক থাকবে বলে। কিন্তু দু-দিন যেতে না যেতেই ওর ছেলেবেলার বন্ধু তৃণাদি বার বার ফোন করে প্রায় জোর করেই ওকে নিয়ে গেল। রিঙ্কিদির যাবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু পুরোনো বন্ধু বলে কথা।”
“ম্যাডাম পারমিতার সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয় ম্যাডাম?”
“প্রায় তিন বছর, যে-দিন থেকে গুরুজির ডান্স অ্যাকাডেমিতে ভরতি হই। তার পরেই তো বিয়ে হয়ে এখানে চলে এলাম। কিন্তু আমাকে ‘ম্যাডাম’ বলবেন না প্লিজ। আমি আপনার থেকে অনেক ছোটো, আর তুমি করে বলবেন।”
যে কথা আমি সব সময়ে বলি, সেটাই একটু ঘুরিয়ে কৌতুক করলাম, “ম্যাডাম’ আর ‘স্যার’ হল একেনবাবুর ট্রেড-মার্ক, আর ‘আপনি’টাও— ওগুলো থেকে কিন্তু মুক্তি পাওয়া যায় না।”
এটা বলাতে আর কিছু না হোক, অনুরাধার অস্বস্তি মনে হয় একটু কমল। একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি ম্যাডাম পারমিতার নাচ দেখতে গিয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ। তবে ট্র্যাফিক জ্যামে পড়ায় একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই মেক-আপ লাগানোর অংশটা মিস করেছি।”
“সেটা কী ম্যাডাম?”
“কথাকলিতে লাল, সবুজ, হলুদ, নানান রং মুখে লাগানো হয়। অনেক সময়ে ডান্সাররা নিজেরাই লাগায়। এককালে দর্শকদের সামনে খোলা স্টেজে কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে ঘটা করে রং লাগানোর কাজটা করা হত। এখন লোকেদের অত ধৈর্য নেই, সময়ও নেই। তাই কাজটা গ্রিনরুমেই সারা হয়, স্টেজে উঠে নাচের ঠিক আগে মিনিট পাঁচেক সময় নেওয়া হয় ফাইনাল টাচ-আপ-এর জন্য।”
“বুঝলাম ম্যাডাম, ট্র্যাডিশন রক্ষা হল আবার দর্শকদের ধৈর্যচ্যুতিও ঘটল না।“
“ঠিক। সবাই যে এভাবে করে তা নয়, তবে আমরা গুরুজির ছাত্র-ছাত্রীরা এইভাবেই শিখেছি।”
আমি নাচের ভক্ত নই, কথাকলি আগে দেখিওনি। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আর্টিস্টরা মুখে রং লাগাবে, আর দর্শকদের বসে বসে সেটা দেখতে হবে? টোটাল ননসেন্স!
একেনবাবু অবশ্য বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যাডাম।”
আমার মাথায় তখন একটা প্রশ্ন ঘুরছিল, পারমিতা তার ছেলেবেলার বন্ধুর বাড়িতে না উঠে তিন বছরের পরিচিত অনুরাধার বাড়িতে এসে উঠল কেন। উত্তরটা পেয়ে গেলাম যখন অনুরাধার বর ভাস্কর বাড়িতে ঢুকল। আরে এই ভাস্করই তো গতকাল টিভির ‘মর্নিং আমেরিকা’ প্রোগ্রামে লুইসিয়ানা আর ফ্লোরিডায় বন্যা নিয়ে এক্সপার্ট রিপোর্ট দিচ্ছিল! আমাদের থেকে বয়সে একটু ছোটোই হবে।
একেনবাবু দারুণ উত্তেজিত। ভাস্কর ঘরে ঢোকামাত্র বলে উঠলেন, “আরে স্যার, আপনাকে তো আমি টিভি-তে দেখেছি!”
একেনবাবুর উত্তেজনা দেখে ভাস্কর হেসে ফেলল। “তাই নাকি! আপনি?”
“আমি স্যার একেন, একেন্দ্র সেন, আর ইনি অধ্যাপক বাপি দে।”
“বুঝতে পেরেছি, আপনাদের কথাই অভীকদা বলেছে। আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।”
“তাতে কী হয়েছে স্যার, আপনারা টিভি-র লোক…।”
“না, না, আমি ঠিক টিভি-র লোক নই। ক্লুমবার্গ নিউজ ডিভিশনে আছি, রিসার্চ করি গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে।”
“ওরে বাবা, খুবই ইন্টারেস্টিং কাজ স্যার, পরে একদিন ভালো করে শুনতে হবে। আজ এসেছি ম্যাডাম পারমিতার মৃত্যুর ব্যাপারে।”
“সেটাই অভীকদা বলল। কিন্তু বুঝতে পারছি না, কীভাবে আমরা সাহায্য করতে পারি!”
“আমিও জানি না স্যার। শুধু আমাকে বলুন, আপনি ম্যাডাম পারমিতাকে কতদিন চেনেন?”
“তা বেশ কয়েক বছর। পারমিতাদি আমার ছোড়দির বন্ধু, সেই সূত্রেই পরিচয়।”
“ম্যাডাম তৃণাও কি আপনার ছোড়দির বন্ধু?”
“পরিচিত। ওঁর সঙ্গে যাওয়া-আসা তেমন ছিল না, যেটা পারমিতাদির সঙ্গে ছিল। পারমিতাদি আর ছোড়দি প্রায় অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, পারমিতাদির মৃত্যু নিয়ে এত চিন্তা করছেন কেন? কিছু কি সন্দেহ করছেন? “এটা কেন বললেন স্যার, সন্দেহ করার কি কোনো কারণ আছে?”
“না না, তা নয়। আসলে পারমিতাদির জীবন তো নানান ট্র্যাজেডিতে ভরা…।”
“ওসব কথা তুলছ কেন?” অনুরাধা অস্বস্তিভরে বলল।
“কী মুশকিল, পারমিতাদির মৃত্যুর তদন্ত করছেন ওঁরা— ওঁদের তো সব কিছু জানা দরকার, সত্যি-মিথ্যে সব কিছুই। তাই না?” আমাদের দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করল ভাস্কর।
“একদম ঠিক বলেছেন স্যার। পারমিতা ম্যাডাম সম্পর্কে যা যা শুনেছেন সব কিছুই আমাদের বলুন।”
“বলছি। তবে শোনা কথা, অনেক অসত্য, গুজব এর মধ্যে থাকতে পারে। শুধু থাকতে পারে না, আমার বিশ্বাস আছে।” বলে অনুরাধাকে বলল, “একটু চা হবে নাকি?”
“সবার জন্যেই হবে। আপনারা কি চায়ে দুধ-চিনি নেন?” উত্তরটা জেনে অনুরাধা অদৃশ্য হল।
অনুরাধা চলে যেতেই ভাস্কর একটু নীচু গলায় জানাল, “এগুলো বললে, অনু খুব আপসেট হয়। রিঙ্কিদিকে ও অসম্ভব ভালোবাসে। কোনো ভুল বা অন্যায় রিঙ্কিদি করতে পারে, বিশ্বাস করে না। যাক গে, যা বলছিলাম…”
“উনি যদি খুব আপসেট হয়ে যান, তাহলে এখন নাই-বা বললেন। পরে আমাদের বাড়িতে এসে…”
“সেটাই ভালো হবে। অভীকদা বলেছে কোথায় আপনারা থাকেন। আমি বরং কাল কাজে যাবার আগে আপনাদের ওখানে এক বার ঢুঁ মারব। যদি আটটা নাগাদ যাই, অসুবিধা আছে?”
“এতটুকু নয় স্যার। এখন বরং অন্য গল্প করা যাক। ভালোকথা, ম্যাডাম তৃণাকে আপনি কতটা চেনেন?”
“ছোড়দি ভালো চেনে, আমিও চিনি। রিঙ্কিদির সঙ্গে স্কুলে পড়ত। দু-জনের মধ্যে খুব ভাবও ছিল একসময়, তবে বেশ কয়েক বছর যোগাযোগ ছিল না। কয়েক দিন আগে তৃণাদি যখন ফোন করেছিল রিস্কিদি প্রথম বার ফোন ধরেনি। দু-তিন বার করার পর ধরেছিল। তখন অবশ্য অনেকক্ষণ কথা হয়।”
“কারণটা স্যার?”
দেখলাম ভাস্কর একটু ইতস্তত করছে।
“ঠিক আছে, না হয় কালকেই বলবেন।”
এইসব কথাবার্তার মধ্যেই অনুরাধা চা নিয়ে এল। চা না খেয়ে তো আর ওঠা যায় না, কিছুক্ষণ বসলাম।