৩
শেষ পর্যন্ত আমরা তিন জনই গেলাম। ভেরিক স্ট্রিটের পুরোনো একটা বিল্ডিং-এ তৃণার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট মানে খাওয়া-বসা-শোওয়া সব একই ঘরে। অ্যাটাচড বাথরুম, একদিকে রান্নার ছোট্ট জায়গা, পাশে সিংক আর রেফ্রিজারেটর। তৃণা বোধহয় একটু আগে গুচ্ছের জামাকাপড় ধুয়ে ড্রায়ারে শুকিয়ে এনেছে, সেগুলো ক্লজেটে ঢোকাচ্ছে। এসব অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এ অনেক সময় বেসমেন্টে কয়েন-অপারেটেড ওয়াশিং মেশিন আর ড্রায়ার থাকে ভাড়াটেদের সুবিধার জন্য।
“কিছু মনে করবেন না, ঘরটা একেবারেই অগোছালো, এক্ষুনি ঘরে ঢুকেছি।”
“না না, আমরাই একটু আগে এসে পড়েছি, সরি।” নিজেদের পরিচয় দিয়ে আমিই বললাম।
“সপ্তাহের এই দিনটাতেই লন্ড্রি করি। আজ ভিড় ছিল বলে দেরি হয়ে গেল। চা খাবেন তো আপনারা?”
“একেবারেই না।” তাড়াহুড়ো করে আমিই উত্তর দিলাম, পাছে একেনবাবু হ্যাংলার মতো “হ্যাঁ” বলে বসেন! ছোট্ট জায়গায় চা বানানো, কাপ-ডিশ ধোয়া, তারপর সেগুলো গুছিয়ে তুলে রাখার ঝামেলা তো কম নয়!
ভালো করে তাকালাম তৃণার দিকে। একমাথা ঘন চুলের গভীরে একদিকে ছোট্ট সিঁথি। অবিন্যস্ত এলোমেলোভাবে চুলগুলো কাঁধের ওপর ঝুলছে।
“বেশি সময় আপনার নষ্ট করব না ম্যাডাম,” একেনবাবু এই প্রথম কথা বললেন।
“না না সময় নষ্ট করার কী আছে! আপনারা প্লিজ বসুন।”
“আসলে ম্যাডাম আমরা এসেছি আপনার বন্ধু মিস পারমিতার মৃত্যুর ব্যাপারে।”
“হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পেরেছি, অভীক বলেছে। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কী সাহায্য করতে পারি!”
“শুধু কয়েকটা প্রশ্ন ম্যাডাম। মিস পারমিতা নিউ ইয়র্কে এসে তো আপনার এখানেই উঠেছিলেন, তাই না?”
“না, এখানে এসে ওঠেনি, চলে যাবার আগে মাত্র এক রাত ছিল।”
“তাহলে কোথায় এসে উঠেছিলেন?”
“উঠেছিল ওদের গেস্ট হাউসে, সেখান থেকে ব্রুকলিন-এ অনুরাধার বাড়িতে… অভীকের কাছে যা শুনেছি।”
“ও হ্যাঁ ঠিক, ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা ম্যাডাম, অভীকবাবুকে কি আপনি অনেকদিন চেনেন?”
“সেই ছেলেবেলা থেকে— দাদার বন্ধু ছিল।”
‘বন্ধু ছিল’ কথাটা কানে বাজল। কিন্তু সে নিয়ে প্রশ্ন করাটা অভদ্রতা। একেনবাবু ওসবের ধার ধারেন না। “বন্ধু ছিল’ বললেন, এখন কি আর নন?
“দাদা বেঁচে নেই।”
“এবার বুঝলাম ম্যাডাম, সরি। আচ্ছা, মিস পারমিতাকে আপনি কতদিন চিনতেন?”
“ক্লাস ওয়ান থেকে একসঙ্গে লা-মার্টস-এ পড়েছি।”
“শুধু স্কুলের বন্ধু?”
“না, পাড়ারও বন্ধু। ও যখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ে ওর বাবা হঠাৎ মারা যান। মাসিমা ওকে নিয়ে চলে আসে আমাদের পাড়ায় ওর মামাবাবুর বাড়িতে।”
“তাহলে তো খুবই বন্ধু। আচ্ছা, যে সময়টা ম্যাডাম পারমিতা আপনার বাড়িতে ছিলেন, ওঁর শরীর ঠিকঠাক ছিল?”
“ঠিকই তো ছিল। যেদিন ওর প্রোগ্রাম, তার আগের দিন এসেছিল। রাত্রে মামাবাবু ওকে ডিনার খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। আমি যেতে পারিনি একটা কাজ ছিল বলে। পরের দিন লাঞ্চের পর ওকে লিঙ্কন সেন্টারে নিয়ে গেলাম। প্রোগ্রাম শেষ হতেই মামাবাবুর সঙ্গে চলে গেল।”
“পরের দিন কি ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, তবে খুবই অল্প সময়ের জন্য।”
“তখনও ঠিক ছিলেন?”
“মাথা ধরে আছে বলেছিল। কিন্তু ওটা ওর বহুদিনের রোগ, নতুন কিছু নয়।”
“আই সি, …তার মানে প্লেনে ওঠার আগে পর্যন্ত কিছুই ঘটেনি, যদি কিছু ঘটে থাকে প্লেনেই ঘটেছে।”
“কী ঘটেছে ভাবছেন?” একটু উদবিগ্ন হয়েই তৃণা জিজ্ঞেস করল।
“শরীর তো একটা যন্ত্র ম্যাডাম, কখন কীসে বিগড়ায় কেউ কি কিছু বলতে পারে!” বলতে বলতেই একেনবাবু তৃণার ঘরের চারিদিকটা এক বার দেখে বললেন, “এটা তো স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট ম্যাডাম? একটাই ঘর?”
“হ্যাঁ।”
“আপনারা কি বাড়িতেই রান্না করে খেতেন?”
“না, বাড়িতে আমি রান্না প্রায় করিই না, বড়োজোর ব্রেকফাস্ট আর চা-কফি। মাঝে মাঝে স্যুপ-টুপ বানাই।”
“যেদিন উনি নাচতে গেলেন ব্রেকফাস্ট কোথায় করেছিলেন ম্যাডাম?”
“প্যানকেক খেতে চেয়েছিল বলে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
“আর লাঞ্চ?”
“খুবই লাইট লাঞ্চ, বাড়িতেই একটু স্যুপ বানিয়ে নিয়েছিলাম।”
“বুঝলাম, ম্যাডাম। আর একটা প্রশ্ন, ওঁর সঙ্গে নিশ্চয় অনেক লটবহর ছিল – নাচে তো অনেক কিছু লাগে।”
একেনবাবু কী হিন্ট দিচ্ছেন বুঝতে পারল তৃণা। “না, নাচের সাজপোশাক আর অন্যান্য জিনিস ছিল ওদের গেস্ট হাউসে। এখানে এসেছিল শুধু একটা সুটকেস নিয়ে, রাখার কোনো অসুবিধা হয়নি।”
এর পরে এলোমেলো দুয়েকটা কথাই হল। তৃণার বাড়ি থেকে বেরিয়েই একেনবাবু অনুরাধাকে ফোন করলেন। ঠিক হল পরের দিন বিকেল পাঁচটায় যাবেন।
রাত্রে ডিনার খেতে খেতে প্রমথ একেনবাবুকে বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছেন, তৃণা ওর দাদার বন্ধু অভীককে অভীকদা না বলে অভীক বলছিল?”
“বিগ ডিল,” আমি বললাম,
আমি বললাম, “এদেশে ছেলেরাও অনেক সময় বাবাকে নাম ধরে ডাকে।”
“স্টুপিডের মতো কথা বলিস না, তৃণা মেমসাহেব নয়।”
“এটা বলে কী প্রমাণ করতে চাস?”
“কিছুই না, কানে বাজল তাই বলছি। তবে তৃণা আর অভীকের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক থাকলে আমি অবাক হব না। দেখলি না, কেমন বলামাত্র চট করে তৃণাকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিল। কী বলেন একেনবাবু?”
“তা তো হতেই পারে স্যার, দু-জন অবিবাহিত প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ আর নারী।”
“ঠিক বলেছেন, সবাই তো আর বাপি-টাইপের নয়।”
“তোরা চুপ করবি! যত্ত সব ননসেন্স আলোচনা!”