নৃত্যশিল্পীর মৃত্যু-তদন্তে একেনবাবু – ২

পরের দিন খুব ভোরে প্রমথর মোবাইলে একেনবাবুর ফোন। মোবাইলটা একেনবাবুকে এগিয়ে দিল প্রমথ। অন্যদিকে অভীক মিত্র। রজত মুখার্জী ওঁকে পাঁচ হাজার ডলার পাঠাতে বলেছেন। ডলার ট্রান্সফার করার জন্য একেনবাবুর অ্যাকাউন্ট নম্বর দরকার, সেইসঙ্গে ব্যাঙ্কের নাম, ঠিকানা আর ব্যাঙ্কের রাউটিং নম্বর। শুধু একটা অনুরোধ একেনবাবু যেন একটা ইনভয়েস পাঠান। টেররিস্টদের উৎপাত বাড়ার জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর সরকার আজকাল অনেক নজরদারি করে, কাগজপত্রগুলো যেন ঠিকঠাক থাকে। 

একেনবাবু জানালেন, ইনভয়েস পাঠানোর আগে উনি অভীকবাবুর সঙ্গে কথা বলতে চান, কাজটা উনি নেবেন কিনা এখনও মনস্থির করেননি। 

.

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একেবারে চেক নিয়ে অভীক এসে হাজির। হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান, আমাদেরই বয়সি, একটু যেন নার্ভাস। পরিচয়পর্ব শেষ হতেই একেনবাবুকে বলল (আমাদের বয়সি বলে আর ‘করলেন’, ‘বললেন’ ইত্যাদি লিখছি না), “আমাকে কিন্তু স্যার বলে গেছেন রিঙ্কির ব্যাপারে আপনার সঙ্গে ওঁর ফাইনাল কথা হয়ে গেছে। আর ইনভয়েসের ব্যাপার… ওটা পরে একসময় পাঠিয়ে দিলেও চলবে। জাস্ট ফর্মালিটি।”

এবার বুঝলাম অভীকের নার্ভাসনেসের কারণটা। হয়তো ভেবেছে ইনভয়েস পাঠাতে হবে শুনে একেনবাবু বিগড়ে গেছেন। তবে ‘রিঙ্কি’ নামটা খট করে কানে বাজল। হাজার হোক বস-এর ভাগ্নি। 

একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ম্যাডামকে চেনেন স্যার?”

“ম্যাডাম!”

“মানে ম্যাডাম পারমিতাকে।”

“রিঙ্কি হিসেবে চিনি, আমাদের পাড়ার মেয়ে সেই বাচ্চা বয়স থেকে ওকে দেখেছি।”

“আপনার বয়স কত স্যার, আপনিও তো ইয়ং?”

হঠাৎ বয়স কত শুনে একটু হতচকিত হলেও অভীক উত্তর দিল, “থার্টি সিক্স, কেন বলুন তো?”

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল চব্বিশ-পঁচিশ। তা হলে ঠিক আছে স্যার, সাত বছরের তফাত যখন…” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন। 

অভীকের মুখ দেখে মনে হল, এ আবার কার হাতে পড়লাম! চকিতে আমার আর প্রমথর দিকে তাকাল। 

“আপনার কি মনে হয় স্যার, মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়?”

“আমার!”

“হ্যাঁ স্যার, আপনার মতটাই জানতে চাচ্ছি।”

“জানি না, তবে আমাদের এমডি সাহেবের বিশ্বাস এতে কোনো ফাউল প্লে আছে।”

“ইন্টারেস্টিং। আপনার সেই সন্দেহটা হয়নি স্যার, তাই তো?”

“সত্যি কথা বলতে কি হয়নি। তবে এটা ঠিক মৃত্যুটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত।”

“ম্যাডাম খুব হেলদি, মানে সুস্থ-সবল ছিলেন, তাই তো স্যার?”

“একদম। আগের রাত্রে টানা দু-ঘণ্টার প্রোগ্রামে নাচল। পরের দিন সকালে যখন প্লেনে উঠল তখনও ফিট ছিল। মাথাধরা ছিল, তবে ওটা ওর প্রায়ই ধরত।”

“তার মানে স্যার আপনি ম্যাডামকে নিউ ইয়র্ক ছাড়ার দিনও দেখেছিলেন?”

“হ্যাঁ, সি-অফ করতে গিয়েছিলাম স্যারের সঙ্গে!”

“নাচ শেষ হবার পরও ঠিক ছিলেন?”

“একদম। স্যারই বরং খুব টায়ার্ড ছিলেন। রিঙ্কি তাই প্রোগ্রাম শেষ হওয়ামাত্র স্যারকে নিয়ে গেস্ট হাউসে চলে যায়। আমি পরে গ্রিনরুম থেকে তুলে ওর ব্যাগটা গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিই। স্যারকেও তখন এক বার দেখে আসি।”

“গেস্ট হাউসেই রজতবাবু ছিলেন স্যার?”

“হ্যাঁ, উনি এদেশে এলে ওখানেই ওঠেন।”

“আর কেউ ছিলেন?”

“বাকি দুটো রুমে দু-জন অফিস-গেস্ট ছিলেন। আমাদের গেস্ট হাউসে চারটেই রুম।”

“তাহলে তো স্যার খুবই কনফিউজিং।”

“মানে?”

“একদম ফিট অবস্থায় প্লেনে উঠে বারো-চোদ্দো ঘণ্টার মধ্যে এত অসুস্থ হয়ে অনেকটা আগাথা ক্রিস্টি-র ‘মার্ডার ইন দ্য ক্লাউড’-এর মতো।”

“মার্ডার বলছেন কেন?” অভীক সচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল। 

“আরে না স্যার, গল্পের সঙ্গে ম্যাডামের মৃত্যুর সঙ্গে কোনোই যোগ নেই… প্লেনের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল-সুস্থ অবস্থায় প্লেনে উঠে মৃত্যু। ফেমাস গল্প, আপনিও নিশ্চয় পড়েছেন স্যার?”

“মার্ডার ইন দ্য ক্লাউড’? না, পড়িনি।”

“দারুণ গল্প ছিল স্যার, পুরোটা অবশ্য মনে নেই,” একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন। “তবে খুনি ধরা পড়েছিল এ্যরকুল পরোর কেরামতিতে।”

আমরা একেনবাবুর বকবকানিতে অভ্যস্ত, অভীক নয়। তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার ওপর প্রমথ ঠাট্টা করে বলল, “তাতে কী হয়েছে, আপনি তো আছেন!”

“কী যে বলেন স্যার, কোথায় পরো আর কোথায় আমি! আমার বিদ্যেতে কি এসব কুলায়, তা ছাড়া মার্ডারই হয়তো হয়নি!”

“এই রে! এসব শোনার পর অভীক কিন্তু আপনাকে চেকটা দেবেন না। “ “না না, তা কেন!” অভীক লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে চেকটা 

বার করল। 

“দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি যে চেকটা দিচ্ছেন তার একটা প্রমাণ রেখে দিই, পরে ‘আমি তো আর পহরো নই’ বলে একেনবাবু দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।” বলে মোবাইলে ওদের ছবি তুলল। 

একজনের মৃত্যু নিয়ে এইরকম হালকা কথাবার্তা আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছিল না। অভীকও নিশ্চয় মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু সেই সেন্সিটিভিটি প্রমথর নেই। ভাগ্যিস অভীক পুরো ব্যাপারটা ভালোভাবেই নিল। হেসে বলল, “আমি জানি একেনবাবু অত্যন্ত বিনয়ী। ওঁর কীর্তিকাহিনি কিছু কিছু পড়েছি।”

কীর্তিকাহিনি পড়া মানে আমার লেখা পড়েছেন! গর্বভরে প্রমথর দিকে তাকাতেই ও মুখ বেঁকাল। 

“আচ্ছা স্যার, এখানে যে দু-জনের বাড়িতে পারমিতা ম্যাডাম ছিলেন, তাঁদের আপনি চেনেন?”

“হ্যাঁ, তৃণাকে খুব ভালো করেই চিনি। অনুরাধাদের ততটা নয়।”

“ম্যাডাম তৃণা কোথায় থাকেন?”

“ম্যানহাটানেই- ভেরিক স্ট্রিটে।”

“ওটা তো আমাদের এখান থেকে খুবই কাছে,” আমি বললাম। 

“ওঁর সঙ্গে দেখা করা যাবে?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন। 

“নিশ্চয়। কবে যেতে চান বলুন, আমি বন্দোবস্ত করে দেব। ফোনে ওকে ধরা মুশকিল, অচেনা কারোর ফোন তোলে না, আর মেসেজ বক্স সব সময়েই ফুল। 

“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্যার- দেখা করতে চাই।”

“ঠিক আছে। এক্সকিউজ মি,” বলে অভীক উঠে একটু সরে গিয়ে কাকে জানি মোবাইলে ফোন করল। তারপর এসে বলল, “আজ বিকেল পাঁচটার পর তৃণা বাড়িতে থাকবে। এর মধ্যে না হলে পরে অন্য কোনো একটা দিনও কথা বলতে পারবে, আমাকে শুধু একটু জানিয়ে দেবেন। আচ্ছা, আমাকে কি থাকতে হবে?”

“না স্যার।”

“তাহলে তো কোনো অসুবিধাই নেই।”

একেনবাবু আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, “স্যার, আপনারা আজ ফ্রি?”

“আমি নই। তবে দরকার তো আপনার গাড়িধারী বাপিকে।” প্রমথ বলল।

“কী যে বলেন স্যার!”

“আমার অসুবিধা নেই।” একেনবাবুকে বললাম। 

.

ভেরিক স্ট্রিটের ঠিকানা আর ফোন নম্বর অভীক দিয়ে দিল। ঠিক হল ছ’টা নাগাদ আমরা যাব। 

“আর ম্যাডাম অনুরাধা?”

“অনুরাধা আর ভাস্কর থাকে ব্রুকলিনের বন্ড স্ট্রিট-এ। আমি ওদের ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। আজকেই জানিয়ে দেব আপনারা যোগাযোগ করবেন। একটা কথা, কালকে সারাদিন আমাকে বাইরে থাকতে হবে একটা কাজে। অসুবিধা নেই তো?”

“না স্যার, অসুবিধার কী আছে!”