১
শনিবার সকাল থেকেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। এ বৃষ্টি নাকি দু-দিন চলবে, কাল বিকেলের আগে আকাশ পরিষ্কার হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সকালের খাওয়া শেষ। প্রমথ ভীষণ মনোযোগ দিয়ে উর্দু-টু-ইংলিশ ডিকশনারি পড়ছে। ও হিন্দি গানের কথা একেবারেই বুঝতে পারে না, কিন্তু উলটোপালটা কথা বসিয়ে গাওয়া চাই। সেই নিয়ে গতকাল একটু খোঁচা দিয়েছিলাম। সেটা বোধহয় বুকে লেগেছে।
একেনবাবু একটা ঘিয়ে রঙের শার্ট পরে টিভি দেখছেন, বহুদিন ধরেই শার্টে দুটো বোতাম মিসিং। গুচ্ছের বোতাম বাড়িতে আছে কিন্তু লাগাননি, ও-দুটো নাকি ক্রিটিক্যাল বোতাম নয়! ‘ক্রিটিক্যাল বোতাম’-এর মানে জানতে চাইবেন না, যা শুনেছি রিপোর্ট করছি।
টিভি-তে স্থানীয় সংবাদে একটি বাঙালি ছেলে ঝড়-বৃষ্টি নিয়ে কিছু বলছে। আমি বা প্রমথ কেউই মন দিয়ে শুনছি না।
“বেশ গর্ব হয় না স্যার, লোকাল নিউজ-এ বাঙালি কেমন সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে!”
“বলছে তো ওয়েদার।” প্রমথর বক্রোক্তি।
“কেন স্যার, ওয়েদার প্রেডিক্ট করা তো ভীষণ কঠিন কাজ। শুনেছি পিএইচডি না থাকলে টিভি-তে চান্সই পাওয়া যায় না।”
“পিএইচডি তো বাপিরও আছে।”
প্রমথরও আছে, কিন্তু এটা অ-সম্মানার্থে প্রয়োগ
একেনবাবু আমার সম্পর্কে বোধহয় ইতিবাচক কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ডোর বেল বাজল। আমিই উঠে দরজা খুললাম।
বয়স্ক ভদ্রলোক। কাঁচা-পাকা চুল, চোখে গোল্ড-ফ্রেমের পাতলা চশমা, প্যান্টের নীচটা ভিজে সপসপ করছে। মুখ-চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে অত্যন্ত বিচলিত। বন্ধ করা ফোল্ডিং ছাতার জল যে চুইয়ে চুইয়ে প্যান্টের ওপর দিকেও পড়ছে- খেয়াল করছেন না।
অনাবশ্যক উঁচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “এটাই কি একেনবাবুর বাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
“উনি আছেন?”
“আছেন, ভেতরে আসুন… ছাতাটা ওইখানে রাখুন।” দরজার পাশেই ভেজা ছাতা রাখার প্লাস্টিকের বালতিটা দেখালাম। ইতিমধ্যে একেনবাবু সোফা ছেড়ে উঠে এসেছেন। প্রমথও উঠে দাঁড়িয়েছে।
“নমস্কার স্যার, আমিই একেন্দ্র সেন।”
“আপনি! আপনিই গোয়েন্দা একেনবাবু?”
“হ্যাঁ, স্যার।”
“ও,” বিস্ময়টা সামলে ভদ্রলোক বললেন, “আমি রজত মুখার্জী। আপনার প্রফেশনাল হেল্প লাগবে।”
“আগে তো স্যার ঘরে এসে বসুন। এঁদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি বাপিবাবু, ফিজিক্সের প্রফেসর। আর পেছনে যিনি দাঁড়িয়ে, উনি কেমিস্ট্রির প্রফেসর প্রমথবাবু।”
প্রমথ যে পোস্ট-ডক শেষ করে এখন অধ্যাপনা করছে সেটা বোধহয় আগে লিখিনি।
আমাদের দায়সারা নমস্কার জানিয়ে রজতবাবু ঘরে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। “একটু জল হবে?”
জল এনে দিতেই ঢক ঢক করে পুরোটা খেলেন।
“এবার বলুন স্যার, কীসের জন্যে এসেছেন। এঁদের সামনেই বলতে পারেন। আমরা সবাই এক টিম-এ, মানে একসঙ্গে কাজ করি।”
“আমার ভাগ্নি রিঙ্কি গতকাল হঠাৎ মারা গেছে! …তিন দিন আগেও ‘স্পাইস অ্যান্ড গ্রিল’ রেস্টুরেন্টে আমার সঙ্গে ডিনার খেয়েছে… অসুখবিসুখ কিচ্ছু নেই— হেলদি একটা মেয়ে! ওর মা একেবারেই চাচ্ছিল না এদেশে আসুক, আমার ওপর ভরসা করেই আসতে দিয়েছিল… আমার মানসিক অবস্থাটা কল্পনা করতে পারছেন?” বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রজতবাবু, গলাটা একটু ভেঙে গেল। বোধহয় প্রেশারের রোগী।
“মনে হয় পারছি স্যার, আপনি শান্ত হোন। তা উনি মারা গেলেন কীভাবে?”
“গত বুধবার রাতে লিঙ্কন সেন্টারে ওর কথাকলি নাচের প্রোগ্রাম ছিল…” নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে চললেন, “প্রোগ্রাম করে পরের দিন সকালেই কলকাতার ফ্লাইট ধরল। কলকাতায় যখন নামল, ভীষণ অসুস্থ। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হাসপাতাল। হাসপাতালে কিছুক্ষণ জ্ঞান ছিল, তারপরই কোমাতে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ!” গলাটা বুজে এল রজতবাবুর। অস্ফুট স্বরে বললেন, “শি ওয়াজ ওনলি টোয়েন্টি নাইন!”
লিঙ্কন সেন্টারে হেঁজিপেঁজি কেউ পারফর্ম করে না। এই বার মনে পড়ল, ক’দিন আগে ইন্ডিয়ান ক্লাসিক্যাল ডান্স ফেস্টিভ্যাল শুরু হবার খবর নিউ ইয়র্ক টাইমসে পড়েছিলাম। ভারতনাট্যম, কথাকলি, ওড়িশি, ইত্যাদি বেশ কয়েকটা নাচের উল্লেখ ছিল। সেই নিয়ে আমাদের মধ্যে কথাও হয়েছিল। কথাকলি প্রোগ্রামে পারমিতা চ্যাটার্জীর নাম দেখে একেনবাবু বলেছিলেন, “খুবই কনফিউজিং স্যার, কথাকলি তো কেরালার ছেলেদের নাচ!”
“আপনার মুণ্ডু!” প্রমথ ধমকে বলেছিল। “কলকাতাতেই বালকৃষ্ণ মেননের কাছে অনেক মেয়ে নাচ শিখত। আমার বড়োপিসিই শিখেছিল।”
“আপনিও এটা জানতেন স্যার?” আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন একেনবাবু। “কেন জানব না! আর কথাকলি-র ফিল্ডে পারমিতা চ্যাটার্জী যথেষ্ট পরিচিত। তেরো বছর বয়স থেকে স্টেজে পারফর্ম করছে।”
পারমিতাকে কেন্দ্র করে একটা স্ক্যান্ডেলও শুনেছিলাম। ঠিক কী, সেটা অবশ্য মনে পড়ল না।
রজতবাবুর কথায় একেনবাবু বলে উঠলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার, ম্যাডাম পারমিতা চ্যাটার্জীর কথাকলির প্রোগ্রাম তো একটা হয়েছিল! আপনার ভাগ্নি কি তাতে ছিলেন স্যার?”
“ওটা আমার ভাগ্নিরই সোলো পারফরমেন্স ছিল। আমি রিঙ্কি বলি, ওর ভালো নাম পারমিতা চ্যাটার্জী।”
“ও মাই গড স্যার, পারমিতা ম্যাডাম আপনার ভাগ্নি! তা মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ডাক্তাররা কী বলছেন স্যার?”
“বুকে জল জমেছিল, শ্বাসকষ্ট, রেস্পিরেটরি ফেইলিওর—এটুকুই শুনলাম। পরিষ্কার করে তো কেউ কিছু বলে না।”
“আগে কি ওগুলো নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল স্যার?”
“না, সেরকম তো কিছু ছিল না। অ্যালার্জিতে খুব ভুগত। সর্দি-কাশি একটু বেশিই হত… বাড়াবাড়ি হলেই ওষুধ খেত। শরীর নিয়ে খুবই কেয়ারফুল ছিল ও। এইভাবে হঠাৎ রিঙ্কির চলে যাওয়া… এটা… এটা কখনোই স্বাভাবিক হতে পারে না। বিশেষ করে…” একটু ইতস্তত করলেন রজত মুখার্জী।
“বিশেষ করে’ কী স্যার?”
“যেদিন ওকে নিয়ে আমি খেতে গিয়েছিলাম মনে হয়েছিল কিছু আমাকে বলতে চাইছে। জিজ্ঞেসও করেছিলাম, ‘কিছু বলবি?” এড়িয়ে গিয়েছিল।”
“আপনার কোনো ধারণা আছে কী নিয়ে ম্যাডাম কথা বলতে চেয়েছিলেন?”
“না। প্রথমে ভেবেছিলাম এদেশে আসার ক’দিন আগে দেশে যে মেসেজটা পেয়েছিল সেই ব্যাপারে। ওটা নয় জেনে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, আর ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি।”
“কীসের মেসেজ স্যার?”
“ও হ্যাঁ, সেটা তো বলা হয়নি। সোশ্যাল সিন-এ রিঙ্কির বড়ো রকমের প্রেজেন্স ছিল। ফলোয়ার আর ফ্যান-গোষ্ঠী ছিল প্রচুর…”
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপারটার সঙ্গে একেনবাবু কতটা পরিচিত জানি না। ওঁর নামে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট দেখেছি, যাতে ছবি নেই আর সব কিছু ব্লকড। সে নিয়ে একবার ধরেছিলাম। ‘আছে নাকি স্যার!’ ভাব দেখালেন আকাশ থেকে পড়েছেন!
ওঁর ক্লু-লেস মুখ দেখে রজত মুখার্জীর নিশ্চয় সন্দেহ হল। জিজ্ঞেস করলেন, “বুঝতে পারছেন আশাকরি?”
“খানিকটা বুঝলাম, অনেক অ্যাডমায়ারার ছিল— তাই তো স্যার?”
“এক্স্যাক্টলি। তাদের কেউ কেউ ওকে মেসেজ পাঠিয়ে বিরক্তও করত। বহু ম্যারেজ প্রোপোজালও পেয়েছিল। এছাড়া আসত নোংরা নোংরা মেসেজ, যেগুলো ও পাওয়ামাত্র ডিলিট করত। এসব ওর মা কুমকুমের কাছেই আবছা আবছা শুনেছি, আমাকে কিছু বলত না। এদেশে আসার দিন কয়েক আগে রিঙ্কি একটা মেসেজ পেয়েছিল, যেটা দেখে কুমকুম ভয় পেয়ে ওকে আমেরিকা আসতে বারণ করে। আমিই কুমকুমকে ভরসা দিয়েছিলাম, আমিও তো যাচ্ছি ভয়ের কী আছে!”
“মেসেজটা কী ছিল স্যার?”
“জানি না। তবে কুমকুম ভয় পেলেও রিঙ্কি ওটাকে পাত্তা দেয়নি। ডিলিট করেছিল।”
“তাও ওটা উদ্ধার করা যাবে।” প্রমথ বিজ্ঞের মতো একেনবাবুকে বলল।
রজতবাবুর কথা শুনছিলাম, আর সেইসঙ্গে পারমিতার স্ক্যান্ডেলটা ঠিক কী ছিল মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। শুনলাম একেনবাবু জিজ্ঞেস করছেন, “এই মেসেজটা ছাড়া মৃত্যুর ব্যাপারে আর কাউকে কি সন্দেহ করছেন স্যার?”
“সেইভাবে সন্দেহ কাউকেই করছি না, তবে এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলেও আমি মেনে নিতে পারছি না। আপনি প্লিজ এর অনুসন্ধানের ভার নিন। আপনার যা প্রাপ্য আমি দেব… ডলারেই দেব। আমার সফটওয়্যার কোম্পানির ব্রাঞ্চ আছে কুইন্সে। ওখানকার ম্যানেজার অভীক মিত্র আপনার ফি আর অন্যান্য খরচা বাবদ যা বিল হবে সব মেটাবে।”
“বুঝলাম স্যার, কিন্তু এভাবে তো ঠিক তদন্ত শুরু করা যায় না, আমার অনেক ইনফর্মেশনের দরকার।”
“তা জানি। এখানে আমাকে পাবেন না, কালকেই দেশে ফিরতে হবে। কিন্তু ইমেল, মোবাইল, হোয়াটসঅ্যাপ— সব কিছুতেই আমাকে ধরতে পারবেন। আপনার মোবাইল নম্বরটা বলুন, আমার কনট্যাক্ট ইনফর্মেশনগুলো এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
বেচারা একেনবাবু। নতুন আই-ফোন নিয়ে মাঝে মাঝে দেখি হিমশিম খান। প্রমথ একেনবাবুকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাল।
“আপনি বরং আমার এই নম্বরে পাঠান, ওঁর ফোনটা গণ্ডগোল করছে। বলে নিজের নম্বরটা দিল।
ভদ্রলোক যখন প্রমথকে নাম-ধাম পাঠাচ্ছেন একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে আপনার ভাগ্নি কোথায় উঠেছিলেন স্যার?”
“উঠেছিল আমাদের অফিসের গেস্ট হাউসে। সেখানে থেকে চলে যায় ওর দুই বন্ধুর কাছে। যাবার আগের রাতে আমার সঙ্গেই গেস্ট হাউসে ছিল।”
“এই বন্ধুদের সঙ্গে কি যোগাযোগ করা যাবে স্যার?”
“নিশ্চয়। দু-জনকেই আমি চিনি, তৃণা আর অনুরাধা। আমার ম্যানেজার অভীকও চেনে, ওর কাছে সব ডিটেলস পাবেন। অভীকের নম্বরটাও মেসেজ করে দিচ্ছি।”
আবার মোবাইলে খুট খুট করে একটা নম্বর পাঠালেন প্রমথকে।
“বন্ধুরা কি সবাই ম্যানহাটানে থাকেন স্যার?”
“এক জন কাছেই থাকে, অন্য জন ব্রুকলিনে। অভীককে আমি বলে যাব নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর সব জানিয়ে দেবে। সেইসঙ্গে কাজের জন্য আপনাকে কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে দেবে। পাঁচ হাজার ডলার হলে চলবে তো?”
“টাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন কেন স্যার, টাকাটা বড়ো কথা নয়, কিন্তু কাজটা আমি করতে পারব কিনা সেটা তো দেখতে হবে।”
“সে কি! রিঙ্কির মৃত্যু নিয়ে আপনি তদন্ত করবেন না!”
“না না, তা নয় স্যার। আসলে তদন্ত করার কিছু আছে কিনা, সেটাই তো জানা নেই স্যার। মৃত্যুটা তো স্বাভাবিকও হতে পারে, মানে কোনো অ্যালার্জিক রিয়্যাকশন।”
“সেটাই তদন্ত করে বলুন!” তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাকে এখন যেতে হবে, দেশে রওনা দেবার আগে বেশ কিছু কাজ বাকি আছে। আপনি কিন্তু ভারটা নিচ্ছেন,” কথাগুলো বলে একেনবাবুর উত্তরের অপেক্ষা না করেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়লেন।
“আপনি একটু বসুন স্যার, আমার দুয়েকটা প্রশ্ন আপনাকে এখনই করার আছে।”
ভদ্রলোক বসলেন না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললেন, “করুন।”
“আপনি কি এখানে ভাগ্নির নাচ দেখতে এসেছিলেন?”
“এইসময়ে আসার একটা কারণ সেটা। তা ছাড়া একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির মালিকানা নিয়েছি, তার কাজকর্ম কীরকম চলছে সেটাও দেখে গেলাম।” বলতে বলতে আবার ইমোশনাল হয়ে পড়লেন রজতবাবু।
“একেনবাবু, ভাগ্নিই ছিল আমার স-অ-ব। আমি চলে গেলে ওকেই এসবের ভার নিতে হত… আর আমাকে ফাঁকি দিয়ে ও-ই আগে চলে গেল!” দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন রজতবাবু
একটু চুপ করে থেকে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানে কবে এসেছিলেন স্যার?”
“দিন তিনেক আগে।”
“ঠিক আছে স্যার, আর আপনাকে বিরক্ত করব না।”
রজত মুখার্জী চলে যেতেই প্রমথ বলল, “এত অনেস্টি দেখান কেন মশাই! টাকাটা তো নিয়ে নেবেন, কাজটা করুন বা না করুন।”
“আপনি না স্যার, সত্যি!”