নূতন পণ্ডিত
আগে যিনি আমাদের পণ্ডিত ছিলেন, তিনি লোক বড়ো ভালো। মাঝে মাঝে আমাদের যে ধমক-ধামক না করিতেন, তাহা নয়—কিন্তু কখনো কাহাকেও অন্যায় শাস্তি দেন নাই। এমন-কি, ক্লাশে আমরা কত সময় গোল করিতাম; তিনি কেবল মাঝে মাঝে ‘আঃ’ বলিয়া ধমক দিতেন। তাঁহার হাতে একটা ছড়ি থাকিত। খুব বেশি রাগ করিলে সেই ছড়িটাকে টেবিলের উপর আছড়াইতেন—সেটাকে কোনোদিন কাহারো পিঠে পড়িতে দেখি নাই। তাই আমরা কেউ তাঁহাকে মানিতাম না।
আমাদের হেডমাস্টার মশাইটি দেখিতে তাঁর চাইতেও নিরীহ ভালোমানুষ। ছোট্টো বেঁটে মানুষটি, গোঁফদাড়ি কামান গোলগাল মুখ। তাহাতে সর্বদাই যেন হাসি লাগিয়াই আছে। কিন্তু চেহারায় কি হয়? তিনি যদি “শ্যামাচরণ কার নাম?” বলিয়া ক্লাশে আসিয়া আমায় ডাক দিতেন, তবে তাঁহার গলার আওয়াজেই আমার হাত-পা যেন পেটের মধ্যে ঢুকিয়া যাইত। তাঁহার হাতে কোনোদিন বেত দেখি নাই। কারণ বেতের কোনো দরকার হইত না—তাঁহার হুংকারটি যার উপর পড়িত সেই চক্ষে অন্ধকার দেখিত।
একদিন পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “সোমবার থেকে আমি আর পড়াতে আসব না— কিছুদিনের ছুটি নিয়েছি। আমার জায়গায় আর-একজন আসবেন। দেখিস তার ক্লাশে তোরা যেন গোল করিস নে।” শুনিয়া আমাদের ভারি উৎসাহ লাগিল। তার পর যে কয়দিন পণ্ডিতমহাশয় স্কুলে ছিলেন, আমরা ক্লাশে এক মিনিটও পড়ি নাই। একদিন বেহারীলাল পড়ার সময় পড়িয়াছিল, সেইজন্য আমরা পরে চাঁদা করিয়া তাহার কান মলিয়া দিয়াছিলাম। যাহা হউক পণ্ডিতমহাশয় সোমবার আর আসিলেন না-তাহার বদলে যিনি আসিলেন তাঁহার গোল কালো চশমা, মুখভরা গোঁফের জংগল আর বাঘের মতো আওয়াজ শুনিয়া আমাদের উৎসাহ দমিয়া গেল। তিনি ক্লাশে আসিয়াই বলিলেন, “পড়ার সময়ে কথা বলবে না, হাসবে না, যা বলব তাই করবে-রোজকার পড়া রোজ করবে। আর যদি তা না কর, তা হলে তুলে আছাড় দেব।” শুনিয়া আমাদের তো চক্ষুস্থির।
ফকিরচাঁদের, তখন অসুখ ছিল, সে বেচারা কদিন পরে ক্লাশে আসিতেই নুতন পণ্ডিতমহাশয় তাহাকে পড়া জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন। ফকির থতমত খাইয়া ভয়ে অমিতা-আমতা করিয়া বলিল “আজ্ঞে – আমি ইস্কলে আসি নি-” পণ্ডিতমহাশয় রাগিয়া বলিলেন, “ইস্কুলে আসি নি তো কোথায় এসেছ? তোমার মামারবাড়ি?” ফকির বেচারা কাঁদকাঁদ হইয়া বলিল, “সাতদিন স্কুলে আসি নি—কি করে পড়া বলব?” পণ্ডিতমহাশয়, “চোপরাও বেয়াদব-মুখের উপর মুখ” বলিয়া এমন ভয়ানক গর্জন করিয়া উঠিলেন, যে ভয়ে ক্লাশসুদ্ধ ছেলের মুখের তালু শুকাইয়া গেল।
আমাদের হরিপ্রসন্ন অতি ভালো ছেলে। সে একদিন স্কুলের অফিসে গিয়া খবর পাইল—সে নাকি এবার কী একটা প্রাইজ’ পাইবে-খবরটা শুনিয়া বেচারা ভারি খুশি হইয়া ক্লাশে আসিতেছিল—এমন সময় নুতন পণ্ডিতমহাশয় “হাসছ কেন” বলিয়া হঠাৎ এমন ধমক দিয়া উঠিলেন যে মুখের হাসি এক মুহর্তে আকাশে উড়িয়া গেল। তাহার পরদিন আমাদের ক্লাশের বাইরে রাস্তার ধারে কে যেন হো-হো করিয়া হাসিতেছিল। শুনিয়া পণ্ডিতমহাশয় পাশের ঘর হইতে হাঁ-হা করিয়া ছুটিয়া আসিলেন। আসিয়া আর কথাবার্তা নাই—“কেবল হাসি?” বলিয়া হরিপ্রসন্নর গালে ঠাস ঠাস্ করিয়া কয়েক চড় লাগাইয়া আবার হো-হো করিয়া চলিয়া গেলেন। সেই অবধি হরিপ্রসন্নর উপর তিনি বিনা কারণে—যখন তখন খাপ হইয়া উঠিতেন।
দেখিতে দেখিতে স্কুলসুদ্ধ ছেলে নুতন পণ্ডিতের উপর হাড়ে চটিয়া গেল। একদিন আমাদের অঙ্কের মাস্টার আসেন নাই। হেডমাস্টার রামবাবু বলিয়া গেলেন-তোমরা ক্লাশে বসিয়া পুরাতন পড়া পড়িতে থাক। আমরা পড়িতে লাগিলাম, কিন্তু খানিক বাদেই পণ্ডিতমহাশয় পাশের ঘর হইতে, “পড়ছ না কেন?” বলিয়া টেবিলে প্রকাণ্ড এক ঘুষি মারিলেন। অমির বলিলাম, “আজ্ঞে হ্যা, পড়ছি তো।” তিনি আবার বলিলেন “তবে শুনতে পাচ্ছি না কেন, চেঁচিয়ে পড়।”, যেই বলা অমনি বোকা ফকিরচাঁদ,
“অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড
তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড—”বলিয়া এমন চেঁচাইয়া উঠিল যে পণ্ডিতমহাশয়ের চোখ হইতে হঠাৎ চশমাটা পড়িয়া গেল। মাস্টারমহাশয় গম্ভীরভাবে ঘরের মধ্যে ঢুকিলেন, তার পর কেন জানি না, হরিপ্রসন্নর কানে ধরিয়া তাহাকে সমস্ত স্কুল ঘুরাইয়া আনিলেন, তাহাকে তিনদিন ক্লাশে দাঁড়াইয়া থাকিতে হুকুম দিলেন, একটাকা জরিমানা করিলেন, তাহার কালো কোটের পিঠে খড়ি দিয়া ‘বাদর’ লিখিয়া দিলেন, আর স্কুল হইতে তাড়াইয়া দিবেন বলিয়া শাসাইয়া রাখিলেন।
পরের দিন রামবাবু হরিপ্রসন্নকে ডাকিয়া পাঠাইলেন এবং তাহার কাছে সমস্ত কথা শুনিয়া আমাদের ক্লাশে খোঁজ করিতে আসিলেন। তখন ফকিরচাঁদ বলিল, “আজ্ঞে হরে চেঁচায় নি—আমি চেঁচিয়েছি।” রামবাবু বলিলেন, “পণ্ডিতমহাশয়কে ‘পাতকী’ বলিয়া কি গালাগালি করিয়াছিলে?” ফকির বলিল, “পণ্ডিতমশাইকে কিছুই বলি নি, আমি পড়ছিলাম—
“‘অন্ধকারে চৌরাশিটা নরকের কুণ্ড, তাহাতে ডুবায়ে ধরে পাতকীর মুণ্ড’।” এই সময়ে নূতন পণ্ডিতমহাশয় ক্লাশের পাশ দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি বোধ হয় শেষ কথাটুকু শুনিতে পাইয়াছিলেন এবং ভাবিয়াছিলেন তাঁহাকে লইয়া কিছু ঠাট্টা করা হইতেছে। তিনি রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারাইয়া হাঁ-হাঁ করিয়া ক্লাশের মধ্যে আসিয়া রামবাবুর কালো কোট দেখিয়াই “তবে রে হরিপ্রসন্ন” বলিয়া হেডমাস্টার মহাশয়কে পিটাইতে লাগিলেন। আমরা ভয়ে কাঠ হইয়া রহিলাম। হেডমাস্টার মহাশয় অনেক কষ্টে পণ্ডিতের হাত ছাড়াইয়া তাঁহার দিকে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।
তখন যদি পণ্ডিতের মুখ দেখিতে! বেচারা ভয়ে একেবারে জুজু—তিন-চারবার হাঁ করিয়া আবার মুখ বুজিলেন, তার পর এদিক-ওদিক চাহিয়া এক দৌড়ে সেই যে স্কুল হইতে পলাইয়া গেলেন, আর কোনোদিন তাঁহাকে স্কুলে আসিতে দেখি নাই।
দুইদিন পরে পুরাতন পণ্ডিতমহাশয় আবার ফিরিয়া আসিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া আমাদের যেন ধড়ে প্রাণ আসিল—আমরা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। সকলে প্রতিজ্ঞা করিলাম, আর পণ্ডিতমহাশয়ের ক্লাশে গোলমাল করিব না। যতই পড়া দিন-না কেন, খুব ভালো করিয়া পড়িব।
সন্দেশ-আষাঢ়, ১৩২৩