পঞ্চম পরিচ্ছেদ – রৌপ্যসর্পমুখ
আকস্মিক বৈদ্যুতিক আলোকের তীব্র প্রবাহে অন্ধ হয়ে মূর্তিটা সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল—ক্ষণিকের জন্যে। পরমুহূর্তেই জানলার ধার থেকে এক লাফ মেরে সে আলোকরেখার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বিমল তাড়াতাড়ি জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তার তীক্ষ্ন চক্ষু বাইরে শীতার্ত অন্ধকারের ভিতর থেকে কোনও দ্রষ্টব্যই আবিষ্কার করতে পারলে না।
ততক্ষণে বাঘার ঘন ঘন উচ্চ চিৎকারে ঘরের আর সকলের ঘুম ভেঙে গেছে।
কুমার বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে ত্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ব্যাপার কী বিমল?’
বিমল হেসে বললে, ‘এমন কিছু নয়। সেই ‘ব্ল্যাক স্নেকের’ সাপুড়ে আজ আমাদের সঙ্গে গোপনে আলাপ করতে এসেছিল!’
—’বলো কী! কী করে জানলে তুমি?’
—’সে যে আসবে, আমি তা জানতুম। দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের শিখরে যে একটা বৃহৎ গুপ্তরহস্য আছে, এটা আমরা টের পেয়েছি। কাজেই ‘ব্ল্যাক স্নেকের’ অধিকারী যে এখন আমাদের জীবনপ্রদীপের শিখা নিবিয়ে দেবার চেষ্টা করবে, এটা কিছু আশ্চর্য কথা নয়। তাকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলুম। দুঃখের বিষয় এই যে, তাকে আজ ধরতে পারলুম না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কিন্তু তার চেহারা দেখেছ?’
—’দেখেছি বটে, তবে তাকে আবার দেখলে চিনতে পারব না। কারণ সে ঘোমটা দিয়ে এসেছিল।’
—’ঘোমটা দিয়ে?’
—’অর্থাৎ মুখোশ পরে। কিন্তু সে তার একটি চিহ্ন পিছনে ফেলে রেখে গিয়েছে।’
—’কী চিহ্ন?’
জানলার শার্সি টেনে পরীক্ষা করতে করতে বিমল বললে, ‘শার্সির এইখানে সে হাত রেখেছিল। কাচের উপরে তার ডান হাতের আঙুলের ছাপ আছে। জানেন তো বিনয়বাবু, কোনও দুজন লোকের আঙুলের ছাপ একরকম হয় না?’
—’জানি। পুলিশও তাই সমস্ত অপরাধীর আঙুলের ছাপ জমা করে রাখে।’
—’কুমার, খানিকটা ‘গ্রে পাউডার’ আর আঙুলের ছাপ তোলবার অন্যান্য সরঞ্জাম এনে দাও তো।’
কুমার বললে, ‘আসামি যখন পলাতক, তখন আঙুলের ছাপ নিয়ে আমাদের কী লাভ হবে?’
—’অন্তত এ ছাপটা ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে’ পাঠিয়ে দিলে জানা যাবে যে, ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র অধিকারী পুরাতন পাপী কি না! পুরাতন পাপী হলে—অর্থাৎ পুলিশের কাছে তার আঙুলের আর—একটা ছাপ পাওয়া গেলে তাকে খুব সহজেই ধরে ফেলা যাবে!’
—’কিন্তু আজ এখানে যে এসেছিল, সে যদি অন্য লোক হয়? হয়তো ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই—সে একটা সাধারণ চোর মাত্র!’
—’কুমার, তোমার এ অনুমানও সত্য হতে পারে। তবু দেখাই যাক না! জিনিসগুলো এনে দিয়ে আপাতত তোমরা আবার লেপ মুড়ি দিয়ে স্বপ্ন দেখবার চেষ্টা করো—গে যাও!’
পরদিন সকালে বিনয়বাবুকে নিয়ে কুমার ও কমল যখন বেড়াতে বেরুল, বিমল তাদের সঙ্গে গেল না; সে তখন সেই আঙুলের ছাপের ফটোগ্রাফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে।
ঘণ্টাখানেক পরে তারা আবার হোটেলে ফিরে এসে দেখলে, ঘরের মাঝখানে বড়ো টেবিলটার ধারে বিমল চুপ করে বসে বসে কী ভাবছে।
কুমার শুধোলে, ‘কী হে, আঙুলের ছাপের ফোটো তোলা শেষ হল?’
—’হুঁ। এখানে এসে এই ছবিখানি একবার মিলিয়ে দ্যাখো দেখি।’
কুমার এগিয়ে এসে দেখলে, টেবিলের উপর পাশাপাশি দুখানা ফোটো পড়ে রয়েছে। খানিকক্ষণ মন দিয়ে পরীক্ষা করে সে বললে, ‘এ তো দেখছি একই আঙুলের দু—রকম দুখানা ছবি। একখানা ছবি না—হয় তুমিই তুলেছ, কিন্তু আর একখানা ছবি কোথায় পেলে? স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আনলে নাকি?’
—’না, দুখানা ছবিই আমার তোলা। এখন বলো দেখি, এই দুটো ছাপের রেখা অবিকল মিলে যাচ্ছে কি না?’
—’হ্যাঁ, অবিকল মিলে যাচ্ছে বটে!’
অত্যন্ত উৎফুল্ল মুখে ছবিখানা পকেটে পুরে বিমল বললে, ‘কুমার, কাল সকালেই খবরের কাগজে দেখবে, ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র অধিকারী গ্রেপ্তার হয়েছে!’
কুমার বিস্মিত স্বরে বললে, ‘সে কী হে! তোমার এতটা নিশ্চিত হবার কারণ কী? আঙুলের ছাপই না—হয় পেয়েছ, কিন্তু ওতে তো আর কারুর নাম লেখা নেই!’
বিমল কান পেতে কী শুনলে, তারপর চেয়ারের উপরে সিধে হয়ে বসে বললে, ‘ওসব কথা পরে হবে অখন! সিঁড়িতে জুতোর শব্দ হচ্ছে, বোধহয় মিঃ গোমেজ নিয়োগ পত্র নিতে আসছেন! আগে তাঁর মামলা শেষ করে ফেলা যাক—কী বলো?’
গোমেজ ঘরের ভিতরে আসতেই বিমল উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললে, ‘গুড মর্নিং মিঃ গোমেজ, গুড মর্নিং! আমরা আপনারই অপেক্ষায় বসেছিলুম।’
গোমেজ বললে, ‘আমার পরম সৌভাগ্য। কিন্তু শুনলুম, কাল নাকি আপনাদের ঘরে চোর ঢুকেছিল?’
—’এখনই এ—খবরটা কে আপনাকে দিলে?’
—’আপনাদের ভৃত্য!’
—’ও, রামহরি? হ্যাঁ, কাল রাত্রে একটা লোক এই ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করেছিল বটে! কিন্তু আমি জেগে আছি দেখে পালিয়ে গেছে।’
—’বাস্তবিক, আজকাল লন্ডন শহর বড়োই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। চারিদিকে দিন—রাত চোর—ডাকাত—হত্যাকারী ঘুরে বেড়াচ্ছে! সবাই বলে স্কটলান্ড ইয়ার্ডের পুলিশবাহিনীর মতো কর্মী দল পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। কিন্তু আমি এ—কথায় বিশ্বাস করি না। শহরের এত—বড়ো রাস্তার উপরে আপনাদের এই বিখ্যাত হোটেল, অথচ বিলাতি পুলিশ সেখানেও চোরের আনাগোনা বন্ধ করতে পারে না! লজ্জাকর!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘মিঃ গোমেজ, আমিও আপনার মতে সায় দিই। দেখুন না, ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র এই অদ্ভুত রহস্যের কোনও কিনারাই এখনও হল না!’
গোমেজ বললে, ‘কিন্তু ও—জন্যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে বেশি দোষ দিই না। ও রহস্যের কিনারা হওয়া অসম্ভব!’
বিমল বললে, ‘কেন?’
—’জনেন তো, সমুদ্রে আমাদের মতন যারা নাবিকের কাজ করে, তাদের এমন সব সংস্কার থাকে সাধারণের মতে যা কুসংস্কার! আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ‘ব্ল্যাক স্নেক’—রহস্যের মধ্যে কোনও অলৌকিক শক্তি কাজ করছে। অলৌকিক শক্তির সামনে পুলিশ কী করবে।’
বিমল হাসতে হাসতে বললে, ‘কিন্তু এই ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র রহস্যের সঙ্গে যে—শক্তির সম্পর্ক আছে, তাকে আমি অনায়াসেই দমন করতে পারি।’
—’পারেন? কী করে?’
—’আমার এই একটি মাত্র ঘুষির জোরে!’—বলেই বিমল আচম্বিতে গোমেজের মুখের উপরে এমন প্রচণ্ড এক ঘুষি মারলে যে, সে তখনই ঘুরে দড়াম করে মাটির উপরে পড়ে গেল! পরমুহূর্তেই সে গোমেজের দেহের উপরে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে চেঁচিয়ে, ‘কুমার! কমল! শিগগির খানিকটা দড়ি আনো!’
বিনয়বাবু হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন, ‘বিমল, বিমল! তুমি কি হঠাৎ পাগল হয়ে গেলে? মিঃ গোমেজকে খামোকা ঘুষি মারলে কেন?’
বিমল উত্তেজিত স্বরে বললে, ‘আরে মশাই, আগে দড়ি এনে গোমেজ—বাবাজিকে আচ্ছা করে বেঁধে ফেলুন, তারপর অন্য কথা!’
কুমার ও কমল যখন দড়ি এনে গোমেজের হাত—পা বাঁধতে নিযুক্ত হল, বিনয়বাবু তখন বারবার মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন—’এ বড়োই অন্যায়, এ বড়োই অন্যায়!’
বিমল গোমেজকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।
কুমার হতভম্বের মতো বললে, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
বিমল বললে, ‘কাল রাত্রে এই গোমেজই মুখোশ পরে আমাদের ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করেছিল!’
ততক্ষণে গোমেজের আচ্ছন্ন—ভাবটা কেটে গিয়েছে। সে একবার ওঠবার জন্যে ব্যর্থ চেষ্টা করে দাঁত—মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, ‘মিথ্যা কথা!’
বিমল বললে, ‘মিথ্যা কথা নয়। আমার কাছে প্রমাণ আছে।’
—’কী প্রমাণ?’
বিমল হাসিমুখে বললে, ‘বাপু গোমেজ, মনে আছে, কাল যখন আমি বলেছিলুম—হয়তো তুমিই ভারতীয় ‘ব্ল্যাক স্নেক’কে বিলাতে নিয়ে এসেছ, তুমি মহা খাপ্পা হয়ে এই কাচ—ঢাকা টেবিলের উপরে চড় বসিয়ে দিয়েছিলে? কাচের আর পালিশ—করা জিনিসের উপরে চড় মারলেই আঙুলের ছাপ পড়ে জানো তো? আমি গোড়া থেকেই সন্দেহ করেছিলুম, লন্ডনে যে—ব্যক্তি খুশিমতো ‘ব্ল্যাক স্নেক’ খেলিয়ে বেড়াচ্ছে, সে আমাদের বিজ্ঞাপনের উত্তর না দিয়ে পারবে না। এই সন্দেহের কারণ উপস্থিত বন্ধুদের কাছে আগেই বলেছি। বিজ্ঞাপনের ফলে দেখা দিয়েছ তুমি। তাই তোমাকেও আমি সন্দেহ করেছি। কাজেই টেবিলের কাচের উপর থেকে তোমার আঙুলের ছাপের ফটো আমি তুলে রেখেছি। এই দ্যাখো, তোমার সেই আঙুলের ছাপের ফটো! তারপর কাল গভীর রাতে এই ঘরে ঢুকতে এসে তুমি আবার বোকার মতো জানলার শার্সিতে হাত রেখেছিলে—আর, তোমার মরণ হয়েছে সেইখানেই। কারণ শার্সির উপরেও যে আঙুলের ছাপ পেয়েছি তার ফোটোর সঙ্গে আগেকার ফোটো মিলিয়েই আমি তোমাকে আবিষ্কার করে ফেলেছি—বুঝলে? বোকারাম, এখনও নিজের দোষ স্বীকার করো।’
বিনয়বাবু প্রশংসা—ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘বিমল, তোমার সূক্ষ্মবুদ্ধি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি!’
কুমার বললে, ‘গোয়েন্দাগিরিতেও যে বিমলের মাথা এত খেলে, আমিও তা জানতুম না!’
কমল এমনভাবে বিমলের মুখের পানে তাকিয়ে রইল, যেন সে চোখের সামনে কোনও মহামানবকে নিরীক্ষণ করছে!
এতক্ষণে গোমেজ নিজেকে সামলে নিলে। শুকনো হাসি হেসে মনের ভাব লুকিয়ে সে সংযত স্বরে বললে, ‘তোমাদের ওসব তুচ্ছ প্রমাণের স্বপক্ষে বা বিপক্ষে আমি এখন কোনও কথা বলতে চাই না। কিন্তু দেখছি, তোমাদের মতে আমিই হচ্ছি ‘ব্ল্যাক স্নেকের’ মালিক! অর্থাৎ আমিই তিন—তিনটে মানুষ খুন করেছি?’
বিমল মাথা নেড়ে বললে, ‘হ্যাঁ, আমার তো তাই বিশ্বাস। অন্তত ওই তিনটে খুনের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে।’
—’প্রমাণ? বিজ্ঞাপন দেখে আমি এখানে এসেছি, এ প্রমাণ দেখে তো বিচারক আমার ফাঁসির হুকুম দেবেন না! আদালতে এটা প্রমাণ বলেই গ্রাহ্য হবে না!’
—’ওহো, গোমেজ! তুমি এখনও ল্যাজে খেলছ? তুমি জেনে নিতে চাও, তোমার বিরুদ্ধে আমরা কী কী প্রমাণ সংগ্রহ করেছি? আচ্ছা, সেসব যথাসময়ে জানতে পারবে! এখন প্রথমে আমি তোমাকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করব। তারপর তোমার বাসা খানা—তল্লাশের ব্যবস্থা করব।’
—’কেন?’
—’সেখানে আরও কতগুলো ‘ব্ল্যাক স্নেক’ আছে তা দেখবার জন্যে।’
গোমেজ অট্টহাস্য করে বললে, ‘ওহে অতি—বুদ্ধিবান বাঙালিবাবু! আমার বাসা থেকে তুমি যদি আধখানা ‘ব্ল্যাক স্নেক’ও খুঁজে বার করতে পারো, তা হলে আমি হাজার টাকা বাজি হারব!’
বিমল গোমেজের দেহের দিকে এগিয়ে বললে, ‘কিন্তু তার আগে আমি তোমার জামার পকেটগুলো হাতড়ে দেখতে চাই।’
—’কেন? তুমি কি মনে করো, আমার জামার পকেটগুলো হচ্ছে ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র বাসা?’
বিমল কোনও জবাব না দিয়ে গোমেজের দেহের দিকে হেঁট হল।
ঠিক সেই মুহূর্তেই গোমেজ হঠাৎ তার বাঁধা পা—দুখানা তুলে বিমলের বুকের উপরে জোড়া—পায়ে বিষম এক লাথি বসিয়ে দিলে! বিমল এর জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিল না, সে একেবারে চার—পাঁচ হাত দূরে ঠিকরে গিয়ে ভূতলশায়ী হল।
তারপরেই সকলে সবিস্ময়ে দেখলে, গোমেজের পায়ের বাঁধন কেমন করে খুলে গেল এবং হাত—বাঁধা অবস্থাতেই সে উঠে দাঁড়িয়ে বেগে দরজার দিকে ছুটল!
কিন্তু দরজার কাছে গম্ভীর মুখে বসেছিল বাঘা! সে হঠাৎ গোমেজের কণ্ঠদেশ লক্ষ্য করে মস্ত এক লাফ মারলে!
গোমেজ একপাশে স্যাঁৎ করে সরে গিয়ে বাঘার লক্ষ্য ব্যর্থ করলে বটে, কিন্তু বাঘা মাটিতে পড়েই বিদ্যুৎগতিতে ফিরে তার একখানা পা প্রাণপণে কামড়ে ধরলে এবং কুমার, কমল ও বিনয়বাবু সময় পেয়ে আবার তাকে ধরে মাটির উপরে পেড়ে ফেললে!
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্যে বললে, ‘শাবাশ গোমেজ! ঘরে আমরা এতগুলো মদ্দ রয়েছি, আর তোমার হাত—পা বাঁধা! তবু তুমি আমাকে কুপোকাত করতে পেরেছ! তোকেও বাহাদুরি দিই বাঘা! তুই না থাকলে তো এতক্ষণে আমাদের মণিহারা ফণীর মতো ছুটোছুটি করতে হত। বাঁধো কুমার, গোমেজকে এবারে আষ্টে—পৃষ্ঠে বেঁধে ফ্যালো!’
গোমেজ রাগে ফুলতে ফুলতে বললে, ‘থাকত যদি হাতদুটো খোলা!’
বিমল বললে, ‘কিন্তু সে দুঃখ করে আর কোনওই লাভ নেই! এখন আর বেশি ছটফট কোরো না! পকেটগুলো দেখাতে তোমার এত আপত্তি কেন? এটা তো দেখছি, রিভলভার। তুমি তাহলে সর্বদাই রিভলভার নিয়ে বেড়িয়ে বেড়াও? আইনে এটা যে সাধুতার লক্ষণ নয়, তা জানো তো? এটা বোধহয় ডায়ারি? হুঁ, পাতায় পাতায় অনেক কথাই লেখা রয়েছে। হয়তো পরে আমাদের কাজে লাগতে পারে—কুমার, ডায়ারিখানা আপাতত তোমার জিম্মায় থাক! এটা কী? কার্ডবোর্ডের একটা বাক্স! কিন্তু বাক্সটা এত ভারী কেন?’
গোমেজের মুখ সাদা হয়ে গেছে—ভয়ে কী যাতনায় বোঝা গেল না! সে ক্ষীণ স্বরে বললে, ‘ও কিছু নয়! ওতে একটা খেলনা ছাড়া আর কিছু নেই!’
বিমল মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘খেলনা? হুঁ, শয়তানের খেলনা হচ্ছে মানুষের প্রাণ, বিড়ালের খেলনা হচ্ছে ইঁদুর! তোমারও খেলনা আছে শুনে ভয় হচ্ছে। দেখা যাক এ আবার কীরকম খেলনা!’
বিমল খুব সাবধানে একটু একটু করে বাক্সের ডালাটা খুললে—কিন্তু তার ভিতর থেকে ভয়াবহ কিছুই বেরুল না। খানিকটা তুলোর মাঝখানে রয়েছে একটা রুপোর জিনিস। সেটাকে বার করে তুলে ধরলে।
গোমেজ বললে, ‘আমার কথায় বিশ্বাস হল না, এখন দেখছ তো ওটা একটা খেলনা, আমার এক বন্ধুর মেয়েকে উপহার দেব বলে কিনেছি!’
কুমার জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘রুপো দিয়ে গড়া একটা সাপের মুখ!’
রুপোয় তৈরি সেই নিখুঁত সর্পমুখের দিকে সন্দেহপূর্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বিমল বললে, ‘কুমার, গোমেজের এই অদ্ভুত খেলনা দেখে সত্যিই আমার ভয় হচ্ছে! এটা জ্যান্ত নয়, মরা সাপও নয়, কিন্তু এমন জিনিস গোমেজের পকেটে কেন? এটা কোনও অমঙ্গলের নিদর্শন? অনেক ভারতবাসীর মতন গোমেজও কি সাপ—পুজো করে?’
গোমেজ হঠাৎ হা হা করে বিশ্রী হাসি হেসে বলে উঠল, ‘না, হিন্দুদের মতন আমি সাপ—পুজো করি না—ওটা হচ্ছে খেলনা, আর আমি হচ্ছি ক্রিশ্চান!’
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সব কাকেরই এক ডাক
বিমল জানলার কাছে গিয়ে বাইরের আলোতে অনেকক্ষণ ধরে সেই রুপোর সাপের মুখটা উলটে—পালটে পরীক্ষা করলে। এ—রকম অদ্ভুত জিনিস সে আর কখনও দেখেনি।
এটা গড়েছে কোনও অসাধারণ কারিগর। মুখটা অবিকল একটা প্রমাণ কেউটে সাপের মতন দেখতে।
পরীক্ষা শেষ হলে পর বিমল ফিরে ডাকলে, ‘বিনয়বাবু, আপনারা এদিকে আসুন।’
সকলে গেলে পরে বিমল বললে, ‘এটা কেবল সাপের মুখ নয়, এটা একটা যন্ত্রও বটে!’
—’যন্ত্র?’
—’হুঁ। এই দেখুন, কল টিপলে সাপের মুখটাও হাঁ করে!’
বিমল কল টিপলে, মুখটাও অমনি জ্যান্ত সাপের মতই ফস করে হাঁ করলে!
বিনয়বাবু চমৎকৃত স্বরে বললেন, ‘ওর মুখের ভিতরে যে দাঁতও রয়েছে!’
—’হ্যাঁ, কাচের দাঁত। এমনকি বিষ—দাঁত পর্যন্ত বাদ যায়নি।…কুমার, টেবিলের উপর থেকে ওই ‘পিন—কুশন’টা নিয়ে এসো তো!’
কুমার সেটা নিয়ে এল। বিমল সাপের মুখটা ‘পিন—কুশনে’র উপরে রেখে ‘স্প্রিং’ ছেড়ে দিতেই দাঁত দিয়ে সেই মুখটা ‘কুশন’ কামড়ে ধরলে!
‘স্প্রিং’ টিপে আবার মুখটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিমল ‘পিন—কুশনটা আঙ্গুল বুলিয়ে পরীক্ষা করে বললে, ‘কুশনটা ভিজে গেছে। তার মানে সাপের মুখ থেকে খানিকটা জলীয় পদার্থ কুশনের উপরে গিয়ে পড়েছে!’
কুমার বললে, ‘এই জলীয় পদার্থটি কী হতে পারে?’
বিমল ধীরে ধীরে গোমেজের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বললে, ‘গোমেজের দেহের উপরেই সে পরীক্ষা করা যাক!’
গোমেজের বাঁধা হাতের উপরে সাপের মুখ রেখে বিমল ‘স্প্রিং’টা টিপতেই সদা—প্রস্তুত রৌপ্য—সর্প দন্তবিকাশ করলে!
—সঙ্গে সঙ্গে গোমেজের আশ্চর্য ভাবান্তর! সে কোনওরকমে হড়াৎ করে মেঝের উপরে খানিকটা তফাতে সরে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘রক্ষা করো! রক্ষা করো!’
বিমল বললে, ‘কেন গোমেজ? তোমার মতে এটা তো খেলনা মাত্র।—এর সঙ্গে তোমাকে খেলা করতেই হবে, নইলে কিছুতেই আমি ছাড়ব না!’
বিমল আবার এগিয়ে গেল, গোমেজ তেমনি করে আবার সরে গেল,—বিষম আতঙ্কে তার দুই চক্ষু ঠিকরে তখন কপালে উঠেছে!
বিমল হাঁটু গেড়ে মাটির উপরে বসে পড়ে বাঁ—হাতে গোমেজকে চেপে ধরে কর্কশ কণ্ঠে বললে, ‘বলো তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? নইলে এই রুপোর সাপের কবল থেকে তুমি কিছুতেই নিস্তার পাবে না!’
গোমেজ বিবর্ণ মুখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘বিষ আছে! ওর ফাঁপা কাচের দাঁতে বিষ আছে।’
—’কেউটে সাপের বিষ?’
—’হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেউটে সাপের বিষ। যখন সব ব্যাপারই বুঝতে পেরেছ তখন আমাকে আবার জিজ্ঞাসা করছ কেন?’
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘কুমার, ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র রহস্য এখন বুঝতে পারলে কি? এই সাংঘাতিক যন্ত্রটা একেবারে সাপের মুখের আকারে তৈরি করা হয়েছে—এমনকী এই কলের মুখটা কারুকে কামড়ালে ঠিক সাপে কামড়ানোর মতন দাগ পর্যন্ত হয়! এর ফাঁপা বিষ—দাঁতটা সঙ্গে সঙ্গে বিষ ঢেলে দেয়! এই জন্যেই মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ড ইহলোক থেকে অকালে বিদায় নিয়েছেন।’
বিনয়বাবু বিস্ফারিত নেত্রে সর্পমুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ভয়ানক!’
কুমার বললে, ‘কিন্তু ঘটনাস্থলে একবার একটা সত্যিকার কেউটে সাপও তো পাওয়া গিয়েছে!’
বিমল শুষ্ক হাস্য করে বললে, ‘হ্যাঁ, মরা সাপ! গোমেজ হয়তো তার নকল সাপের মুখের জন্যে আসল বিষ—দাঁত থেকে বিষ সংগ্রহ করেছিল। তারপর তাকে হত্যা করে ঘটনাস্থলে ফেলে গিয়েছিল, পুলিশের চোখে ধাঁধা দেবার জন্যে! আসল সাপ চোখে দেখলে আর নকল সাপের কথা সন্দেহ করবে না কেউ! কেমন গোমেজ, তাই নয় কি?’
গোমেজ রেগে কটমট করে বিমলের দিকে তাকালে, কিন্তু একটাও কথা কইলে না।
বিমল একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে গোমেজের পাশে গিয়ে বসল। তারপর বলল, ‘চুপ করে থাকলে চলবে না। তোমার বক্তব্য কী, বলো।’
গোমেজ বললে, ‘আমার কোনও বক্তব্য নেই। আমি কিছু বলব না।’
—’বলবে না? তাহলে তোমার সাপ তোমাকেই কামড়াবে।’
—’তুমি এখন জেনেছ যে, ওর মুখে বিষ আছে। ও সাপ এখন আমাকে কামড়ালে আমাকে হত্যা করার অপরাধে তুমিই ফাঁসিকাঠে ঝুলবে।’
—’বেশ, তাহলে তোমাকে পুলিশের হাতেই সমর্পণ করব। বিচারে তোমার কী হবে, বুঝতে পারছ তো?’
গোমেজ হা হা করে হেসে বললে, ‘বিচারে আইনের কূটতর্কে আমি খালাস পেলেও পেতে পারি। আমি এখনও অপরাধ স্বীকার করিনি। আমার বিরুদ্ধে কোনও চাক্ষুষ প্রমাণ নেই। ওই রুপোর সাপের বিষেই যে তিনটে লোক মারা পড়েছে, এ—কথা কোনও আইনই জোর করে বলতে পারবে না!’
বিমল খানিকক্ষণ চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে বললে, ‘গোমেজ, তোমার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তুমি যে পাষণ্ড হত্যাকারী, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে আইনের কুটতর্কে তুমি খালাস পেলেও আমি বিস্মিত হব না। যদিও তোমার বিরুদ্ধে আমি যে মামলা খাড়া করেছি, তার ফলে তুমি ফাঁসিকাঠে মরবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু আমার লাভ কী? আমি পুলিশের লোক নই, তোমাকে ধরিয়ে না দিলেও কেউ আমাকে কিছু বলতে পারে না। তবে জেনে—শুনেও তোমার মতন পাপীকে একেবারে ছেড়ে দেওয়াও অপরাধ। অতএব, তোমার সঙ্গে আমি একটা মাঝামাঝি রফা করতে চাই।’
—’কীরকম রফা শুনি?’
—’তুমি কারুকে খুন করেছ কি না সেটা জানবার জন্যে আমার মাথাব্যথা নেই। আমরা কেবল এইটুকুই জানতে চাই, মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ড সেই অজ্ঞাত দ্বীপে গিয়ে কোন রহস্যের সন্ধান পেয়েছিলেন? আর তাঁদের সেই আবিষ্কারের কথা তুমি জানলে কেমন করে?’
গোমেজ উত্তেজিত স্বরে বললে, ‘সে দ্বীপে গিয়ে কেউ কোনও রহস্যের সন্ধান পায়নি। কোনও আবিষ্কারের কথা আমি জানি না। এসব তোমার বাজে কল্পনা!’
—’শোনো গোমেজ! যদি তুমি আমার জিজ্ঞাসার জবাব দাও, তাহলে তোমার উপরে আমি এইটুকু দয়া করতে পারি—তোমার হাত—পায়ের বাঁধন খুলে আমি তোমাকে মুক্তি দেব। তারপর এক মিনিট কাল অপেক্ষা করে ‘ফোনে’ তোমার কথা পুলিশকে জানাব। ইতিমধ্যে তুমি পারো তো যেখানে খুশি অদৃশ্য হয়ে যেয়ো, আমরা কেউ তোমাকে কোনও বাধা দেব না।’
—’আমি কিছু জানি না।’
বিমল উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বললে, ‘গোমেজ তুমি আগুন নিয়ে খেলা করতে চাও? আমার আপত্তি নেই। আমি এখনই তোমার কথা পুলিশকে জানাচ্ছি।’ এই বলে সে টেলিফোনের দিকে অগ্রসর হল!
গোমেজ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আচ্ছা, একটু অপেক্ষা করো।’
বিমল দাঁড়িয়ে পড়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললে, ‘আমাকে আবার ভোলাবার চেষ্টা করলেই আমি পুলিশ ডাকব, পুলিশ তোমার পেট থেকে কথা বার করবার অনেক উপায়ই জানে।’
—’আমার কাছ থেকে সব কথা জেনে নিয়েও তুমি যদি আমাকে ছেড়ে না দাও?’
—’আমরা ভদ্রলোক। আমার কথায় এখন বিশ্বাস করা ছাড়া তোমার আর কোনও উপায় নেই।’
—’বেশ, তাহলে আমার অদৃষ্টকেই পরীক্ষা করা যাক। বাবু, এভাবে আমার কথা কওয়ার সুবিধা হবে না, আমাকে তুলে বসিয়ে দাও।’
কুমার তাকে তুলে বসিয়ে দিলে। গোমেজ বলতে লাগল——
‘বাবু, আমার বলবার কথা বেশি নেই। তবে আমি যেটুকু জেনেছি, তা সামান্য হলেও তোমরা মাঝে পড়ে বাধা না দিলে সেইটেই হয়তো অসামান্য হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু উপায় কী, আমার বরাত নিতান্তই মন্দ!
কেমন করে আমাদের জাহাজ সেই দ্বীপে গিয়ে পড়ল এবং কেন আমরা সেই দ্বীপে গিয়ে নেমেছিলুম, এসব কথা খবরের কাগজে তোমরা নিশ্চয়ই পাঠ করেছ। সুতরাং সেসব কথা নিয়ে আমি আর সময় নষ্ট করব না। দ্বীপের সেই অদ্ভুত পাথরের মূর্তিগুলোর কথাও তোমরা জানো, তাদের নিয়েও কিছু বলবার নেই। কারণ আমরাও তাদের ভালো করে দেখবার সময় পাইনি।
সারাক্ষণই আমরা সেই আটজন হারা সঙ্গীকে খুঁজতেই ব্যস্ত ছিলুম। কিন্তু ওইটুকু একটা ন্যাড়া দ্বীপ তন্ন তন্ন করে দেখেও আমরা একজন সঙ্গীকেও খুঁজে বার করতে পারলুম না। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, একসঙ্গে আট—আটজন মানুষ কেমন করে অদৃশ্য হল।
খুঁজতে বাকি ছিল কেবল পর্বতদ্বীপের শিখরটা। মিঃ মির্টন, মিঃ মরিস ও ম্যাকলিয়ড আমাদের কিছুক্ষণ আগেই শিখরের উপরদিকে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমরা তাঁদের অপেক্ষায় খানিকক্ষণ নীচে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করতে লাগলুম।
পনেরো মিনিট কাটল, তবু তাঁদের দেখা নেই! তখন আমরাও উপরে উঠতে শুরু করলুম।
সকলের আগে উঠছিলুম আমিই। খানিক পরেই মিঃ মর্টনের গলা শুনতে পেলুম। তিনি সবিস্ময়ে বলছিলেন, ‘এ কীরকম বর্শা! এর ডান্ডাটা যে সোনার বলে মনে হচ্ছে!’
তারপরেই মিঃ মর্টনকে দেখতে পেলুম। মিঃ মরিস আর মিঃ ম্যাকলিয়ডের মাঝখানে তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তাঁর হাতে একটা সুদীর্ঘ বর্শা,—কেবল তার ফলাটা বোধহয় ব্রোঞ্জের।
তাঁরা তিনজনেই আমাকে দেখে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেলেন! মিঃ মর্টন তাঁর হাতের বর্শাটা মাটির উপরে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘গোমেজ, তোমাদের আর কষ্ট করে উপরে উঠতে হবে না, নাবিকদের কেউ এখানে নেই। চলো, আমরাও নেমে যাই।’
আমি বললুম, ‘কিন্তু আপনার হাতে ওটা কী দেখলুম যে?’
—’একটা ভাঙা পুরানো বর্শা! কবে কে এখানে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, কাজে লাগবে না বলে আমিও ফেলে দিলুম! চলো!’
কিন্তু বর্শাটা যে ভাঙা নয়, সেটা আমি স্পষ্টই দেখেছিলুম, তার সুদীর্ঘ দণ্ড সূর্যের আলোতে পালিশ—করা সোনার মতো চকচকিয়ে উঠছিল! কিন্তু মিঃ মর্টন আমাদের উপরওয়ালা, কাজেই তাঁর হুকুম অমান্য করতে পারলুম না, নীচে নামতে নামতে কৌতূহলী হয়ে ভাবতে লাগলুম, মিঃ মর্টন আমাকে উপরে উঠতে দিলেন না কেন, আর আমার সঙ্গে মিথ্যা কথাই বা কইলেন কেন?
জাহাজে ফিরে এলুম। কিন্তু মনের ভিতরে একটা বিষম কৌতূহল জেগে রইল। বেশ বুঝলুম, ওঁরা একটা এমন কিছু দেখেছেন যা আমার কাছে প্রকাশ করতে চান না। কিন্তু কেন?
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলুম, যেমন করেই হোক ভিতরের রহস্যটা জানতেই হবে। জাহাজের কারুর কাছে কিছু ভাঙলুম না, কিন্তু সর্বক্ষণই ওঁদের গতিবিধির উপর রাখলুম জাগ্রত তীক্ষ্ন দৃষ্টি!
পরদিনের সন্ধ্যাতেই সুযোগ মিলল। দূর থেকে দেখলুম, মিঃ মরিস ও মিঃ ম্যাকলিয়ডকে নিয়ে মিঃ মর্টন নিজের কামরার ভিতরে গিয়ে ঢুকলেন।
এদিকে—ওদিকে কেউ নেই দেখে আমি পা টিপে টিপে কামরার কাছে গিয়ে দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে রইলুম।
শুনলুম মিঃ মরিস বলছেন, ‘ওটা সোনা না হতেও পারে!’
মিঃ মর্টন দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি, বর্শার ডান্ডাটা সোনায় মোড়া না হয়ে যায় না! ওই একটা ডান্ডায় যতটা সোনা আছে তার দাম হবে কয়েক হাজার টাকা।’
মিঃ ম্যাকলিয়ড বললেন, ‘কিন্তু যদিই বা তাই হয়, তবে ওই সোনার বর্শার সঙ্গে শিখরের সেই আশ্চর্য ‘ব্রোঞ্জে’র দরজার আর আমাদের নাবিকদের অদৃশ্য হওয়ার কী সম্পর্ক থাকতে পারে?’
মিঃ মর্টন বললেন, ‘আমি অনেক ভেবে—চিন্তে যা স্থির করেছি শোনো :—সেই সর্বোচ্চ শিখরের গায়ে আমরা একটা ‘ব্রোঞ্জ’ ধাতুতে গড়া বিরাট দরজা আবিষ্কার করেছি। সে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ কেন? নিশ্চয়ই তার ভিতরে ঘর বা অন্য কোথাও যাবার পথ আছে। সে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করলে কারা? নিশ্চয়ই যারা ঝড়ের রাতে আলো জ্বেলে চলাফেরা করছিল তারাই। তারা যে কারা, তা আমি কল্পনা করতে পারছি না। তবে ওই স্বর্ণময় বর্শা দেখে অনুমান করা যায়, ওটা হচ্ছে তাদেরই অস্ত্র। খুব সম্ভব, তারা আমাদের আটজন নাবিককে আক্রমণ আর বন্দি করেছে। তারপর আমাদের সবাইকে দল বেঁধে দ্বীপের দিকে যেতে দেখে বন্দিদের নিয়ে তারা ওই দরজার পিছনে অদৃশ্য হয়েছে। আর যাবার সময় তাড়াতাড়িতে বর্শাটা ভুলে ফেলে রেখে গিয়েছে। এখন ভেবে দ্যাখো, সাধারণ বর্শা যাদের সুবর্ণময় তাদের কাছে সোনা কত সস্তা! দ্বীপে যখন পানীয় জল নেই, তখন ওখানে নিশ্চয়ই কেউ বেশিদিন বাস করে না। তবে সোনার বর্শা নিয়ে কারা ওখানে বিচরণ করে? হয়তো তারা অন্য কোনও দ্বীপের আদিম বাসিন্দা, ওই দ্বীপে তাদের প্রাচীন দেবতার ধন—ভাণ্ডার বা গুপ্তধন আছে, মাঝে মাঝে তারা তা পরিদর্শন করতে আসে। শুনেছি, দক্ষিণ আমেরিকার আদিম বাসিন্দারা দেবতাদের বিপুল ধনভাণ্ডার এমনি করেই লুকিয়ে রাখত, আর তাদের কাছেও সোনারুপো ছিল এমনি সস্তা। হতভাগা কেলে—ভূত গোমেজটার জন্যে ভালো করে কিছু দেখবার সময় পেলুম না, কিন্তু আমাদের আবার সেখানে যেতেই হবে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ওই দ্বীপে গেলে আমরা ধনকুবের হয়ে ফিরে আসব।’
তারপরেই মরিসের গলা পেলুম—সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম কাদের পায়ের শব্দ, কারা যেন আমার দিকেই আসছে। কাজেই আমার আর কিছু শোনা হল না, ধরা পড়বার ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এলুম!…বাবু, দ্বীপের আর কোনও কথা আমি জানি না, এইবারে আমাকে ছেড়ে দাও।’
গোমেজের কথা শুনে বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
তারপর জিজ্ঞাসা করলে, ‘আচ্ছা গোমেজ, তুমিও বলছ দ্বীপে জল নেই?’
—’না, সে দ্বীপ মরুভূমির চেয়েও শুকনো!’
—’তোমাদের জাহাজ ছাড়া সেখানে আর কোনও জাহাজ বা নৌকা দেখেছিলে?’
—’না।’
—’তাহলে মিঃ মর্টনের অনুমান সত্য নয়। অন্য কোনও দ্বীপের আদিম বাসিন্দারা সেই দ্বীপে এলে তোমরা তাদের জাহাজ বা নৌকা দেখতে পেতে?’
গোমেজ একটু ভেবে বললে, ‘হয়তো আগের রাত্রে ঝড়ে তাদের জাহাজ বা নৌকাগুলো দ্বীপ থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে।’
—’হ্যাঁ, তোমার এ অনুমান অসঙ্গত নয়।’
—’আর কেন, আমাকে মুক্তি দাও।’
—’রোসো, গোমেজ, রোসো। তুমি তো এখনই পাখির মতন উড়ে পালাবে,—তারপর? আমাদের দ্বীপে যাবার পথ বাতলে দেবে কে?’
গোমেজ উৎসাহিত হয়ে বললে, ‘পথ বাতলাবার জন্যে তোমরা আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চাও নাকি?’
—’পাগল! তোমার মতন মূর্তিমান ‘ব্ল্যাক স্নেক’কে আমরা সঙ্গে নিয়ে যাব? Longitude আর Latitude—সুদ্ধ একখানা নকশা আমাকে এঁকে দাও।’
গোমেজ হতাশভাবে বললে, ‘সেসব আমার পকেট—বুকেই তোমরা পাবে।’
কুমারের হাত থেকে গোমেজের পকেট—বুকখানা নিয়ে বিমল আগে সেখানা পরীক্ষা করলে। পরীক্ষার ফল হল সন্তাোষজনক। তখন সে গোমেজের বাঁধন খুলে দিয়ে বললে, ‘পালাও শয়তান, পালাও! মনে রেখো, এক মিনিট পরেই আমি পুলিশকে তোমার কথা জানাব!’
বিমলের মুখের কথা শেষ হবার আগেই গোমেজ ঝড়ের মতন বেগে ঘরের বাহিরে চলে গেল!
বিমল ঘড়ি ধরে ঠিক এক মিনিট অপেক্ষা করলে। তারপর ‘ফোন’ ধরে বললে, ‘হ্যালো, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড? হ্যাঁ, শুনুন! আমি বিমল! মর্টন, মরিস আর ম্যাকলিয়ডকে খুন করেছে ‘বোহিমিয়া’র কোয়াটারমাস্টার বার্তোলোমিও গোমেজ! সে একমিনিট আগে আমারে হোটেল থেকে বেরিয়েছে! হ্যাঁ, সব প্রমাণই আমার কাছে আছে—এখানে এলেই সমস্ত পাবেন। গোমেজের অপরাধ সম্বন্ধে একতিল সন্দেহ নেই, শীঘ্র তাকে ধরবার ব্যবস্থা করুন। কী বললেন? পাঁচ—মিনিটের মধ্যেই লন্ডনের পথে পথে পুলিশের জাল বিস্তৃত হবে? ডানা থাকলেও ওড়বার সময় পাবে না? আশ্চর্য আপনাদের তৎপরতা। আচ্ছা, বিদায়।’
ফোন ছেড়েই বিমল ফিরে বললে, ‘ব্যাস, এখানকার কাজে ইতি। ডাকো কুমার, ডাকো রামহরিকে। বাঁধো সব জিনিস—পত্তর। আমরা আজকেই জাহাজে চড়ব।’
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, তোমরা হচ্ছ একে বয়সে যুবা, তার উপরে বিষম ডানপিটে। কিন্তু দ্বীপে যাবার আগে আরও কিছু চিন্তা করা উচিত—এই হচ্ছে আমার মত।’
বিমল বললে, ‘আয়োজন করে সর্বদাই চিন্তা করতে বসলে কাজ করবার কোনও ফাঁকই পাওয়া যায় না। যখন চিন্তা করবার সময়, তখন আমি যথেষ্ট চিন্তা করেছি, যার ফলে এত শীঘ্র ‘ব্ল্যাক স্নেকে’র রূপকথা বাস্তব উপন্যাসে পরিণত হল। এখন এসেছে কাজ করবার সময়—চুলোয় যাক এখন ভাবনা—চিন্তা।’
কুমার বললে, ‘এখন আমরা হচ্ছি সেই আরব বেদুইনের মতো, রবীন্দ্রনাথ যাদের স্বপ্ন দেখেছেন! এখন আমাদের চারিদিকে ‘শূন্যতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন’, আর আমাদের মানস—তুরঙ্গ তারই উপর দিয়ে পদাঘাতে বালুকার মেঘ উড়িয়ে ছুটে চলেছে সুদূর বিপদের কোলে বিপুল আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে।’
কমল করতালি দিয়ে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ডাক দাও এখন ভূমিকম্পকে, ধরে আনো উন্মত্ত ঝটিকাকে, জাগিয়ে তোলো ভিসুভিয়াস—এর অগ্নি—উৎসবকে।’
বাঘাও লাফ মেরে টেবিলে চড়ে ও ল্যাজ নেড়ে উঁচু মুখে বললে, ‘ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ!’
বিনয়বাবু ভয়ে ভয়ে রামহরির কাছে গিয়ে বললেন, ‘সব কাকেরই এক ডাক। এসো রামহরি, আমরা ও—ঘরে গিয়ে একটু পরামর্শ করিগে।’
সপ্তম পরিচ্ছেদ – জাহাজ দ্বীপে লাগল
আবার সেই অসীম নীলিমার জগতে! নীলিমার জগৎ—সূর্যালোকের অনন্ত ঐশ্বর্য চতুর্দিকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, দিনের বেলার ছায়া এখানে কোথাও ঠাঁই পায় না! যেদিকে তাকানো যায় কেবল চোখে পড়ে দিগন্তে বিলীন নীল আকাশ আর নীল সাগর পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি করছে গভীর প্রেমে।
এত নীল জল এমন অশ্রান্ত বেগে কোথায় ছুটে যায় এবং ফিরে আসে কেউ তা জানে না। শূন্যে হচ্ছে স্থিরতার রাজ্য, মাটি হচ্ছে স্থিরতার রাজ্য, কিন্তু সমুদ্র কোনওদিন স্থির হতে শেখেনি, তার একমাত্র মহামন্ত্র হচ্ছে—ছুটে চলো, ছুটে চলো, ছুটে চলো!
সেদিন রাত্রে চাঁদ উঠেছে। পৃথিবীর প্রথম রাত্রি থেকে চাঁদ উঠে আসছে, জ্ঞানোদয়ের প্রথম দিন থেকে মানুষ চাঁদ—ওঠা দেখে আসছে, কিন্তু চাঁদের মুখ কখনও পুরানো বা একঘেয়ে মনে হল না। যে সত্যিকার সুন্দর, সে হয় চিরসুন্দর!
সেদিন রাত্রে চাঁদ উঠেছে। জাহাজের ডেকে চেয়ারের উপরে বিনয়বাবুকে ঘিরে বসেছিল বিমল, কুমার ও কমল।
সমুদ্রের অনন্ত জলে জ্যোৎস্না যেন দেয়ালি—খেলা খেলছিল লক্ষ লক্ষ ফুলঝুরি নিয়ে এবং সাগরের ধ্বনিকে মনে হচ্ছিল সেই কৌতুকময়ী জ্যোৎস্নারই কলহাস্য।
কুমার বললে, ‘বিনয়বাবু, পৃথিবীর জন্ম থেকেই সমুদ্র এ কী গান ধরেছে, এতদিনেও যা ফুরিয়ে গেল না!’
বিনয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘না কুমার, পৃথিবী যখন জন্মায় তখন সে সমুদ্রের গান শোনেনি।’
বিমল কৌতূহলী কণ্ঠে বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনি হচ্ছেন বৈজ্ঞানিক, এসব বিষয়ে আপনার জ্ঞান অসাধারণ। সদ্যোজাত পৃথিবীর প্রথম গল্প আপনার কাছে শুনতে চাই।’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তাহলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করি, শোনো।…কোটি কোটি বৎসর আগেকার কথা। মহাশূন্যে তখন আর কোনও গ্রহ—উপগ্রহ বা তারকা ছিল না, আমাদের মাথার উপরকার ওই চাঁদ ছিল না, আমাদের এই জননী পৃথিবীও ছিল না। ছিল কেবল জ্বলন্ত, ঘূর্ণায়মান সুভীষণ সূর্য। তখন সে জ্বলত বিরাট এক অগ্নিকাণ্ডের মতো, তখন তার আকার ছিল আরও বৃহৎ, আর তখন সে ঘুরত আরও—বেশি জোরে—তেমন দ্রুতগতির ধারণাও আমরা করতে পারব না।
খুব জোরে বড়ো আগুন নিয়ে ঘোরালে দেখবে, চারিদিকে টুকরো টুকরো আগুন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। সূর্যের ঘুরুনির চোটেও মাঝে মাঝে তার কতক কতক অংশ এইভাবে শূন্যে ঠিকরে পড়েছে, আর সেই এক—একটা খণ্ডাংশ হয়েছে এক—একটা গ্রহ। আমাদের পৃথিবী হচ্ছে তারই একটি।
প্রত্যেক গ্রহও ঘোরে। পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে একদিন দু—ভাগ হয়ে গেল। তারই বড়ো অংশে অর্থাৎ পৃথিবীতে এখন আমরা বাস করি, আর ছোটো অংশটাকে আমরা আজ চাঁদ বলে ডাকি। এই পৃথিবী, আর ওই চাঁদও আগে এখনকার চেয়ে ঢের বেশি জোরে ঘুরতে পারত।
সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হবার অনেক লক্ষ বৎসর পর পর্যন্ত পৃথিবীও ছিল জ্বলন্ত। তখন তার মধ্যে কোনও জীব বাস করতে পারত না। তখনকার দিন—রাতও ছিল এখনকার চেয়ে ঢের ছোটো। সূর্য আর পৃথিবীর ঘূর্ণির বেগ ক্রমেই কমে আসছে—সঙ্গে সঙ্গে দিন—রাতও ক্রমেই বড়ো হয়ে উঠছে। সুদূর ভবিষ্যতে এমন সময়ও আসবে, যখন সূর্যও ঘুরবে না, পৃথিবীও ঘুরবে না—দিনও থাকবে না রাতও থাকবে না।
অতীতের সেই পৃথিবীর কথা কল্পনা করো। আবহাওয়া এখনকার চেয়ে অনেক বেশি ঘন, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মেঘ প্রায়ই সূর্যকে অস্পষ্ট করে তোলে, ঘন ঘন বিশ্বব্যাপী ঝটিকায় চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে যায়, মাটির গা একেবারে আদুড়—সবুজের আঁচ পর্যন্ত ফোটে না, প্রায় দিবারাত্র ধরে অশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ে।
পৃথিবীর আদিম যুগে সমুদ্রের জন্মই হয়নি, সেই আগুনের মতন গরম পাথুরে পৃথিবীতে জল থাকতে পারত না। জলের বদলে তখন ছিল কেবল বাতাস—মেশানো বাষ্প। খুব গরম কড়ায় খুব অল্প জল ছিটোলে দেখবে, তা তখনই বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। শূন্যে তখন যে পুরু মেঘ জমে থাকত, তা থেকে তপ্ত বৃষ্টি ঝরে পড়ত আগুনের মতো গরম পাথুরে পৃথিবীর উপরে, তারপর আবার তা বাষ্প হয়ে শূন্যে উঠে যেত। সেদিনকার পৃথিবীকে অনায়াসেই একটা বিরাট অগ্নিকুণ্ডরূপে কল্পনা করতে পারো।
ক্রমে পৃথিবী যখন ঠান্ডা হয়ে এল, তখন গরম আবহাওয়ার বাষ্প পৃথিবীর উপরে নেমে এসে তপ্ত নদীর সৃষ্টি করলে। যেখানে সুবৃহৎ গর্ত ছিল সেখানেও জমা হয়ে জলরাশি ধরলে সমুদ্রের আকার। তারপর জল ঠান্ডা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে দেখা দিলে জীবনের প্রথম আভাস।
আজ এই জলের ভিতরে বেশিক্ষণ ডুবে থাকলে অধিকাংশ ডাঙার জীবরাই মারা পড়ে। কিন্তু আদিম কালে জীবনের প্রথম উৎপত্তি হয় এই জলের ভিতরেই বা সমুদ্র—জলসিক্ত স্থানেই। তারপর কত জীব জল ছেড়ে ডাঙার জীব হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেউ কেউ ডাঙা থেকে আবার শূন্যে উড়তে শিখেছে, এমনকী কেউ কেউ মাটিকে ছেড়ে পুনর্বার সমুদ্রে ফিরে গিয়েছে, আজ আর তাদের ইতিহাস দেবার সময় হবে না।’
কুমার বললে, ‘আশ্চর্য এই পৃথিবীর জন্মকাহিনি, উপন্যাসও এমন বিস্ময়কর নয়! আচ্ছা বিনয়বাবু, তাহলে কি ভবিষ্যতে পৃথিবী আরও ঠান্ডা হলে সমুদ্রের জলও আরও বেড়ে উঠবে?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘তাই হওয়াই তো স্বাভাবিক।’
এমনভাবে প্রতি সন্ধ্যায় গল্পগুজব করে তারা সমুদ্র—যাত্রার একঘেয়েমি নিবারণ করে।
জাহাজে গল্প—বলার ভার নিয়েছিলেন বিনয়বাবু। বিমল প্রভৃতির আবদারে কোনও দিন তিনি বলতেন আকাশের গ্রহ—উপগ্রহের গল্প, কোনওদিন নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা, কোনওদিন বা সমুদ্র—তলের রহস্যময় কাহিনি। এই অতল জল—সমুদ্রের উপরে বসে বিনয়বাবুর অগাধ জ্ঞান—সমুদ্রে ডুব দিয়ে বিমলরা নিত্য—নবরত্ন আহরণ করেছে।
একদিন বৈকালে ‘চার্ট’ দেখে বিমল বললে, ‘আমাদের জাহাজ কেনারী দ্বীপপুঞ্জের কাছে এসে পড়েছে। গোমেজের পকেট—বুকের কথা মানলে বলতে হয়, আমরা কালকেই সেই অজানা দ্বীপের কাছে গিয়ে পৌঁছোতে পারি।’
কুমার মহা উৎসাহে বললে, ‘তাহলে আজ রাত্রে আমার ভালো করে ঘুম হবে না দেখছি।’
সাগরে জলের অভাব নেই, তবু হঠাৎ সন্ধ্যার সময়ে আকাশ ঘন মেঘ জমিয়ে জলের উপর জল ঢালতে লাগল। রামহরি তাড়াতাড়ি জাহাজের পাচকের কাছে ছুটল খিচুড়ির ব্যবস্থা করতে। কমল বসল দ্বিতীয়বার চায়ের জল চড়াতে। এবং কুমার আবদার ধরলে, ‘বিনয়বাবু, আজ আর জ্ঞান—বিজ্ঞানের গল্প নয়, আজ একটা ভূতের গল্প বলুন।’
বিমল বললে, ‘কিন্তু এই সামুদ্রিক বাদলায় সামুদ্রিক ভূত না হলে জমবে না।’
বিনয়বাবু সহাস্যে বললেন, ‘বেশ, তাই সই। আমি একটা ভূতের বিলিতি কাহিনি পড়েছিলুম। সেইটেই সংক্ষেপে তোমাদের বলব—কিন্তু স্থান—কাল—পাত্রের নাম বদলে:
ধরে নাও, গল্পের নায়ক হচ্ছি আমি। এবং জাহাজে চড়ে যাচ্ছি কলকাতা থেকে রেঙ্গুনে। ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী।
জাহাজে উঠে ‘বয়’কে বললুম, ‘আমার মোটঘাট সতেরো নম্বর কামরায় নিয়ে চলো। আমি নীচের বিছানায় থাকব।’
বয় চমকে উঠল। বাধো বাধো গলায় বললে, ‘স—তে—রো নম্বর কামরা?’
—’হ্যাঁ। কিন্তু তুমি চমকে উঠলে কেন?’
—’না হুজুর, চমকে উঠিনি! এই দিকে আসুন।’
সতেরো নম্বর কামরায় গিয়ে ঢুকলুম। এসব জাহাজের প্রথম শ্রেণির কামরা সাধারণত যে—রকম হয়, এটিও তেমনি। উপরে একটি ও নীচে একটি বিছানা। আমি নীচের বিছানা দখল করলুম।
খানিকক্ষণ পরে ঘরের ভিতরে আর একজন লোক এসে ঢুকল। তার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা গেল, সে আমার সহযাত্রী হবে। অতিরিক্ত লম্বা ও অতিরিক্ত রোগা দেহ, টাক—পড়া মাথা, ঝুলে—পড়া গোঁফ। জাতে ফিরিঙ্গি।
তাকে পছন্দ হল না। যে খুব রোগা আর খুব লম্বা, যার মাথায় টাক—পড়া আর গোঁফ ঝুলে—পড়া, তাকে আমার পছন্দ হয় না। আমি বলে একটা মনুষ্য যে এই কামরায় হাজির আছি, সেটা সে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলে না। টপ করে লাফ মেরে সে একেবারে উপরের বিছানায় গিয়ে উঠল। স্থির করলুম, এ—রকম লোকের সঙ্গে বাক্যালাপ না কারই ভালো।
সে—ও বোধহয় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, আমার মতন নেটিভের সঙ্গে কথাবার্তা কইবে না। কারণ সন্ধ্যার পরে একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করেই সে ‘রাগ’ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।
আমিও দিলুম লেপ মুড়ি। এবং ঘুম আসতেও দেরি লাগল না।
কতক্ষণ পরে জানি না, হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। কেন ঘুম ভাঙল তাই ভাবছি, এমন সময়ে উপরের সাহেব দড়াম করে নীচে লাফিয়ে পড়ল! অন্ধকারে শব্দ শুনে বুঝলুম, সে কামরার দরজা খুলে দ্রুতপদে বাইরে ছুটে গেল! ঠিক মনে হল, যেন কেউ তাকে তাড়া করেছে।
তার এই অদ্ভুত আচরণের কারণ বুঝলুম না। কিন্তু এটা অনুভব করলুম যে, আমার কামরার মধ্যে দুর্দান্ত শীতের হাওয়া হু—হু করে প্রবেশ করছে! আর, কীরকম একটা পচা জলের দুর্গন্ধে সমস্ত কামরা পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে!
উঠলুম। ইলেকট্রিক টর্চটা বার করে জ্বেলে চারিদিকে ঘুরিয়ে দেখলুম, জাহাজের পাশের দিকে কামরায় আলো—হাওয়া আসবার জন্যে যে ‘পোর্ট—হোল’ থাকে, সেটা খোলা রয়েছে এবং তার ভিতর দিয়েই হু—হু করে জোলো—হাওয়া আসছে!
তখনই পোর্ট—হোল বন্ধ করে দিয়ে আবার শুয়ে পড়লুম এবং সঙ্গে সঙ্গে শুনলুম, আমার উপরকার বিছানার যাত্রীটির নাক ডেকে উঠল সশব্দে!
আশ্চর্য! সশব্দে লাফিয়ে পড়ে বাইরে ছুটে গিয়ে আবার কখন সে নিঃশব্দে ফিরে এসে একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছে? লোকটা পাগলটাগল নয় তো?
আর সেই বদ্ধ, পচা জলের দুর্গন্ধ। সে কী অসহনীয়! এ কামরাটা নিশ্চয়ই খুব—বেশি স্যাঁতসেঁতে! কালকেই কাপ্তেনের কাছে অভিযোগ করতে হবে……আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম।
সকালে ঘুম ভাঙবার পরেই সর্বপ্রথমে লক্ষ করলুম যে, খোলা পোর্ট—হোলের ভিতর দিয়ে আবার হু—হু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে!
নিশ্চয় ওই সাহেবটার কাজ! আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেল তো।
আর একটা লক্ষ করবার বিষয় এই যে, কামরার মধ্যে সেই বদ্ধ, পচা জলের দুর্গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না!
আস্তে আস্তে বেরিয়ে ডেকের উপরে গিয়ে দাঁড়ালুম। প্রভাতের সূর্যালোক আর স্নিগ্ধ বাতাস ভারী মিষ্ট লাগল।
ডেকের উপরে পায়চারি করতে করতে জাহাজের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হল, তাঁকে আমি অল্পবিস্তর চিনতুম।
ডাক্তার আমাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি সতেরো নম্বর কামরা নিয়েছেন?’
—’হ্যাঁ।’
—’কালকের রাত কেমন কাটল?’
—’মন্দ নয়। কেবল এক পাগল সায়েব কিছু জ্বালাতন করেছে।’
—’কীরকম?’
—’সে মাঝরাতে লাফালাফি করে পরের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়, দুপদুপিয়ে বাইরে ছুটে যায়, কিন্তু পরে পা টিপে টিপে এসে কখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার মাঝে মাঝে পোর্ট—হোল খুলে দেওয়াও তার আর এক বদ—অভ্যাস!’
ডাক্তার গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘কিন্তু ও—কামরার পোর্ট—হোল রাত্রে কেউ বন্ধ করে রাখতে পারে না!’
—’তার মানে!’
—’তার মানে কী, আমি জানি না। তবে এইটুকু জানি, ওই কামরায় যারা যাত্রী হয়, তারা প্রায়ই সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে!’
—’আপনি কি আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টায় আছেন?’
—’মোটেই নয়। আমার উপদেশ, ও—কামরা ছেড়ে দিয়ে আপনি আমার কামরায় আসুন।’
—’এত সহজে ভয় পাবার ছেলে আমি নই। আমি কামরা ছাড়বার কোনও কারণ দেখছি না।’
—’যা ভালো বোঝেন করুন’—এই বলে ডাক্তার চলে গেলেন।
একটু পরেই ‘বয়’ এসে জানালে, কাপ্তেন—সাহেব আমাকে জরুরি সেলাম দিয়েছেন।
কাপ্তেনের কাছে গিয়ে দেখলুম, তিনি অত্যন্ত চিন্তিত মুখে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাবু, আপনার কামরার সাহেবের কোনও খবর রাখেন?’
—’কেন বলুন দেখি?’
—’সারা জাহাজ খুঁজেও তাঁকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।’
—’পাওয়া যাচ্ছে না? কাল রাত্রে তিনি একবার বাইরে বেরিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তারপর আবার তাঁর নাক—ডাকা শুনেছি তো!’
—’আপনি ভুল শুনেছেন! কামরার ভিতরে বা বাইরে তাঁর কোনও চিহ্নই নেই!’
প্রথমটা স্তম্ভিত হয়ে রইলুম। তারপর বললুম, ‘শুনছি সতেরো নম্বর কামরার যাত্রীরা নাকি প্রায়ই সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে?’
কাপ্তেন থতমত খেয়ে বললেন, ‘একথা আপনিও শুনেছেন? দোহাই আপনার, যা শুনেছেন তা আর কারুর কাছে বলবেন না, কারণ তাহলে এ—জাহাজের সর্বনাশ হবে! আপনি বরং এক কাজ করুন। এ—যাত্রা আমার কামরাতেই আপনার মোটঘাট নিয়ে আসুন। সতেরো নম্বরে আজই আমি তালা লাগিয়ে দিচ্ছি!’
—’অকারণে আমার কামরা আমি ছাড়তে রাজি নই। আপনাদের কুসংস্কার আমি মানি না।’
কাপ্তেন খানিকক্ষণ চুপ করে কী ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমারও বিশ্বাস, এসব কুসংস্কার। আচ্ছা, আজ রাত্রে আমি নিজে আপনার কামরায় গিয়ে পাহারা দেব। তাতে আপনার আপত্তি আছে?’
—’না।’
সন্ধ্যার পর কাপ্তেন আমার কামরার মধ্যে এসে ঢুকলেন।
সে—রাত্রে কামরার আলো নেবানো হল না। দরজা বন্ধ করে কাপ্তেন আমার সুটকেসটা টেনে নিয়ে তার উপরে চেপে বসে বললেন, ‘এই আমি জমি নিলুম! এখন আমাকে ঠেলে না সরিয়ে এখান দিয়ে কেউ যেতে আসতে পারবে না। চারিদিক বন্ধ। একটা মাছি কি মশা ঢোকবারও পথ নেই!’
—’কিন্তু আমি শুনেছি, ওই পোর্ট—হোলটা রাত্রে কেউ নাকি বন্ধ করে রাখতে পারে না!’
‘ওই তো ওটা ভিতর থেকে বন্ধ রয়েছে!’—বলতে বলতেই কাপ্তেন—এর দুই চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল এবং তাঁর দৃষ্টির অনুসরণ করে আমিও তাকিয়ে দেখলুম, কামরার পোর্ট—হোলটা ধীরে ধীরে আপনিই খুলে যাচ্ছে!
আমরা দুজনেই লাফ মেরে সেখানে গিয়ে পোর্ট—হোলের আবরণ চেপে ধরলুম—কিন্তু তবু সেটা সজোরে খুলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে কামরার আলো নিবে গেল দপ করে!
হু হু করে একটা তীক্ষ্ন বরফ—মাখা বাতাসের ঝাপটা ভিতরে ছুটে এল এবং তারপরেই নাকে ঢুকল তীব্র, বদ্ধ, পচা জলের বিষম দুর্গন্ধ!
আমি চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘আলো, আলো!’
কাপ্তেন টপ করে দেশলাই বার করে একটা কাঠি জ্বেলে ফেললেন।
বিদ্যুৎবেগে ফিরে উপরের বিছানার দিকে তাকিয়ে সভয়ে দেখলুম, সেখানে একটা মূর্তি সটান শুয়ে রয়েছে!
পাগলের মতন একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়লুম,—কিন্তু কীসের উপরে? বহুকাল আগে জলে—ডোবা একটা ভিজে ঠান্ডা মৃতদেহ, তার সর্বাঙ্গ মাছের মতন পিচ্ছল, তার মাথায় লম্বা লম্বা জল—মাখা রুক্ষ চুল এবং তার মৃত চোখদুটোর আড়ষ্ট দৃষ্টি আমার দিকে স্থির! আমি তাকে স্পর্শ করবামাত্র সে উঠে বসল এবং পরমুহূর্তেই একটা মত্তহস্তী যেন ভীষণ এক ধাক্কা মেরে আমাকে মেঝের উপর ফেলে দিলে,—তারপরই কাপ্তেনও আর্তনাদ করে আমার উপরে আছাড় খেয়ে পড়লেন।
মিনিট—দুয়েক পরে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আবার দেশলাইযের কাঠি জ্বেলে দেখা গেল, উপরের বিছানা খালি, ঘরের ভিতরেও কেউ নেই এবং কামরার দরজা খোলা!
পরদিনেই সতেরো নম্বর কামরার দরজা পেরেক মেরে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হল। আমার কথাও ফুরুল।
রামহরি কখন ফিরে এসে কোণে বসে একমনে গল্প শুনছিল। সে সভয়ে বলে উঠল, ‘ওরে বাবা! সুমুদ্দরে কত লোক ডুবে মরে, সবাই যদি ভূত হয়ে মানুষের বিছানায় শুতে চায়, তাহলে তো আর রক্ষে নেই! আমি বাপু আজ রাত্রে একলা শুতে পারব না!’
কুমার উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘চলো, এইবারে খিচুড়ির সন্ধানে যাত্রা করা যাক!’
বিমলের আন্দাজই সত্য হল। পরদিন খুব ভোরেই দেখা গেল, দূরে সমুদ্রের নীলজলের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে যে দ্বীপটি তাকে দ্বীপ না বলে পাহাড় বলাই ঠিক।
দূরবিনে নজরে পড়ল, নৈবেদ্যের চূড়া—সন্দেশের মতো একটি পর্বত যেন সামুদ্রিক নীলিমাকে ফুটো করে মাথা তুলে আকাশের নীলিমাকে ধরবার জন্যে উপরদিকে উঠে গিয়েছে। দেখলেই বোঝা যায়, সেই পর্বতের অধিকাংশ লুকিয়ে আছে মহাসাগরের সজল বুকের ভিতরে।
তার শিখর—দেশটা একেবারে খাড়া, কিন্তু নীচের দিকটা ঢালু। এবং সেই ঢালু পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বিরাট প্রস্তর—মূর্তি। অনেক মূর্তির পদতলের উপরে বিপুল জলধির প্রকাণ্ড তরঙ্গদল রুদ্ধ আক্রোশে যেন ফেনদন্তমালা বিকাশ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে বারংবার!
সমস্ত পাহাড়টা একেবারে ন্যাড়া—বড়ো বড়ো গাছপালা তো দূরের কথা, ছোটোখাটো ঝোপঝাড়েরও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। যেমন সুবজ রঙের অভাব—তেমনি অভাব জীবন্ত গতির। কোথাও একটিমাত্র পাখিও উড়ছে না।’
বিনয়বাবু ভীত কণ্ঠে বললেন, ‘এ হচ্ছে মৃত্যুর দেশ!’
রামহরি বললে, ‘যারা জলে ডুবে মরে, তারা রোজ রাতে ঘুমোবার জন্যে ওইখানে গিয়ে ওঠে।’
কুমার বললে, ‘এই মৃত্যুর দেশেই এইবারে আমরা জীবন সঞ্চার করব। যদি এখানে মৃত্যুদূত থাকে, আমাদের বন্দুকের গর্জনে এখনই তার নিদ্রাভঙ্গ হবে।’
বিমল বললে, ‘যাও কমল, সেপাইদের প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে আসতে বলো। এইবারে হয়তো তাদের দরকার হবে।’
কমল খবর দিতে ছুটল। খানিক পরেই ডেকের উপরে চারজন করে সার বেঁধে দাঁড়াল শিখ, গুর্খা ও পাঠান সেপাইরা। তাদের চব্বিশটা বন্দুকের বেওনেটের উপরে সূর্যকিরণ চমকে চমকে উঠতে লাগল।
বিমল হেসে বললে, ‘বিনয়বাবু, ওদের আছে চব্বিশটা বন্দুক আর আমাদের কাছে আছে বন্দুক, চারটে রিভলভার। তবু কি আমরা দ্বীপ জয় করতে পারব না?’
অষ্টম পরিচ্ছেদ – অষ্ট নরমুণ্ড
বোটে চড়ে বিমল সঙ্গীদের ও সেপাইদের নিয়ে দ্বীপে গিয়ে উঠল। জাহাজে রইল কেবল নাবিকরা।
কী ভয়াবহ নির্জন দ্বীপ! সূর্যের সোনালি হাসি যেন তার কালো কর্কশ পাথুরে গায়ে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে সমুদ্রের গর্ভের মধ্যে! নানা আকারের বড়ো বড়ো পাথরগুলো চারিদিক থেকে যেন কঠিন ভ্রূকুটি করে ভয় দেখাচ্ছে! যেদিকে তাকানো যায়, ভৌতিক ছমছমে ভাব ও তৃষ্ণাভরা নির্জীব শুষ্কতা!
এরই মধ্যে দিকে দিকে দাঁড়িয়ে আছে প্রেতপুরের দানব—রক্ষীর মতন প্রস্তরমূর্তির পর প্রস্তরমূর্তি! একসঙ্গে এতগুলো এত—উঁচু পাথরের মূর্তি বোধহয় আধুনিক পৃথিবীর কোনও মানুষ কখনও চোখে দেখেনি, কারণ তাদের অধিকাংশই কলকাতার অক্টারলনি মনুমেন্টের মতন উঁচু এবং কোনও কোনওটা তাদেরও ছাড়িয়ে আরও উঁচুতে উঠেছে। মূর্তিগুলোর পায়ের কাছে দাঁড়ালে তাদের মুখ আর দেখা যায় না। পাহাড় কেটে প্রত্যেক মূর্তিকে খুদে বার করা হয়েছে!
খানিকটা তফাতে দাঁড়িয়ে কয়েকটা মূর্তির আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বিমল বললে, ‘এই এক—একটা মূর্তি গড়তে শিল্পীদের নিশ্চয়ই পনেরো—বিশ বছরের কম লাগেনি। সব মূর্তি গড়তে হয়তো এক শতাব্দীরও বেশি সময় লেগেছিল! এইটুকু একটা জলশূন্য দ্বীপে এতকাল ধরে এত যত্ন আর কষ্ট করে এই মূর্তিগুলো গড়বার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না!’
কুমার বললে, ‘হয়তো মর্টন সাহেবেরই অনুমান সত্য! হয়তো এটা কোনও জাতির দেবতার দ্বীপ! হয়তো যাদের দেবতা তারা এখানে মাঝে মাঝে কেবল ঠাকুর পূজা করতে আসে!’
বিনয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘এ মূর্তিগুলো কোনও জাতির দেবতার মূর্তি হতে পারে, কিন্তু একটা সবচেয়ে বড়ো কথা তোমরা ভুলে যেয়ো না। পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের ‘চার্ট’ সাহেবরা তৈরি করে ফেলেছে। কিন্তু কোনও ‘চার্টে’ই এই দ্বীপের উল্লেখ নেই। তার অর্থ হচ্ছে, এই দ্বীপটাকে এতদিন কেউ সমুদ্রের উপরে দেখেনি। মূর্তিগুলোর গায়ে তাজা শেওলার চিহ্ন দেখছ? ওই শেওলা দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কিছুদিন আগেও ওরা জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে ছিল। এখন ভেবে দ্যাখো, জলের তলায় ডুব মেরে কোনও মানুষ—শিল্পীই কি এমন বড়ো মূর্তি গড়তে পারে?’
রামহরি বললে, ‘সমুদ্রের জলে যেসব কারিগর ডুবে মরেছে, এ মূর্তিগুলো গড়েছে তাদেরই প্রেতাত্মা।’
কমল বললে, ‘যে দ্বীপ জলের তলায় অদৃশ্য, সেখানে কেউ পূজা করতে আসবেই বা কেন?’
কুমার বললে, ‘কিন্তু মর্টন সাহেব এখানে কাদের হাতের আলো দেখেছিলেন? দ্বীপের শিখরের কাছে সেই ব্রোঞ্জের দরজাই বা কে তৈরি করেছে?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘দ্বীপটা ভালো করে দেখবার পর হয়তো আমরা ওসব প্রশ্নের সদুত্তর পাব। কিন্তু আপাতত দেখছি, কোনও মূর্তির কোথাও কোনও শিলালিপি বা সাঙ্কেতিক ভাষা খোদাই করাও নেই। ওসব থাকলেও একটা হদিস পাওয়া যেত। কিন্তু মূর্তিগুলোর মুখের ভাব দেখেছ? প্রাচীন মিশর, ভারতবর্ষ, চিন, আসিরিয়া, বাবিলন আর গ্রিস দেশের ইতিহাস—পূর্ব যুগের শিল্পীরা আপন আপন জাতির মুখের আদর্শই মূর্তিতে ফুটিয়েছে। সুতরাং ধরতে হবে এখানকার শিল্পীরাও স্বজাতির মুখের আদর্শ রেখেই এসব মূর্তি গড়েছে। কিন্তু সে কোন জাতি? আধুনিক কোনও দেশেই মানুষের মুখের ভাব এমন ভয়ানক হয় না। এদের মুখের ভাব কীরকম হিংস্র পশুর মতো, যেন এরা দয়া—মায়া কাকে বলে জানে না। বিমল, কুমার! তোমরা প্রাচীন যুগের কিছু কিছু ইতিহাস নিশ্চয়ই পড়েছ? প্রাচীন যুগটাই ছিল নির্দয়তার যুগ। বাবিলন, আসিরিয়া আর মিশর প্রভৃতি দেশের ইতিহাসই হচ্ছে নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। তাদের ঢের পরে জন্মেও রোম দয়ালু হতে পারেনি। খ্রিস্টকে সে ক্রুশে বিঁধে হত্যা করেছিল, বিরাট একটা সভ্যতার জন্মভূমি কার্থেজের সমস্ত মানুষকে দেশসুদ্ধ পৃথিবী থেকে লুপ্ত করে দিয়েছিল। সে যুগের নির্দয়তার লক্ষ লক্ষ কাহিনি শুনলে আধুনিক সভ্যতার হৃৎপিণ্ড মূর্ছিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এই দ্বীপবাসী মূর্তিগুলোর মুখ অধিকতর নৃশংস। তার একমাত্র কারণ এই হতে পারে, যে—পাশবিক সভ্যতা এখানকার মূর্তিগুলো সৃষ্টি করেছে, তার জন্ম হয়তো মিশরেরও অনেক হাজার বছর আগে—সামাজিক বন্ধন, নীতির শাসন ছিল যখন শিথিল, মানুষ ছিল যখন প্রায় হিংস্র জন্তুরই নামান্তর। ভগবান জানেন, আমরা কাদের প্রতিমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছি!’
বিমল বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনার কথাই সত্য বলে মনে হচ্ছে। মূর্তিগুলোর পোশাক দেখুন। এমন সামান্য পোশাক মানুষ সেই যুগেই পরত, যে—যুগে সবে সে কাপড়—চোপড় পরতে শিখেছে।’
এসব আলোচনা রামহরির মাথায় ঢুকছিল না, সে বাঘাকে নিয়ে কিছুদূরে এগিয়ে গেল। এক—জায়গায় প্রায় দুশো ফুট উঁচু একাট মূর্তি ছিল,—তার পদতলে একটা পাথরের বেদি, সেটাও উচ্চতায় দশ—বারো ফুটের কম হবে না। বেদির গা বেয়ে উঠেছে সিঁড়ির মতন কয়েকটা ধাপ!
এ মূর্তিটা আবার একেবারে বীভৎস। চোখদুটো চাকার মতন গোল, নাসারন্ধ্র স্ফীত, জন্তুর মতন দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়েছে এবং দুই ঠোঁটের দুই কোণে ঝুলছে আধাআধি গিলে—ফেলা দুটো মানুষের মূর্তি!
এই মানুষ—খেকো দেবতা ও দানবের মূর্তি দেখে রামহরির পিলে চমকে গেল।
এমন সময়ে বাঘার চিৎকার শুনে রামহরি চোখ নামিয়ে দেখলে, ইতিমধ্যে সে ধাপ দিয়ে বেদির উপরে উঠে পড়েছে এবং সেখানে কী দেখে মহা ঘেউ ঘেউ রব তুলেছে।
ব্যাপার কী দেখবার জন্যে রামহরিও কৌতূহলী হয়ে সেই বেদির উপরে গিয়ে উঠল এবং তারপরেই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেইখানে বসে পড়ে পরিত্রাহি চিৎকার করতে লাগল—’ওরে বাবা রে, গেছি রে। এ কী কাণ্ড রে।’
চিৎকার শুনে সবাই সেখানে ছুটে এল। বেদির উপরে উঠে প্রত্যেকেই স্তম্ভিত!
বেদির উপরে পাশাপাশি সাজানো রয়েছে কতকগুলো মানুষের মুণ্ডু! মানুষের মাথা কেটে কারা সেখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছে, কিন্তু তাদের মাংস ও চামড়া পচে হাড় থেকে খসে পড়েনি। সেই পাথুরে দেশে প্রখর সূর্যের উত্তাপে শুকিয়ে সেগুলো মিশরের মমির মতন দেখতে হয়েছে।
বিমল গুনলে, ‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট।’
কুমার রুদ্ধশ্বাসে বললে, ‘এখানে আটজন নাবিকই হারিয়ে গিয়েছিল!’
বিমল দুঃখিত স্বরে বললে, ‘এগুলো সেই বেচারাদেরই শেষ—চিহ্ন।’ কুমার, এই রাক্ষুসে দেবতাদের পায়ের তলায় কারা নরবলি দিয়েছে! তাহলে বোঝা যাচ্ছে, এই দ্বীপে এমন সব শত্রু আছে যাদের হাতে পড়লে আমাদেরও এমনি দশাই হবে।’
বিনয়বাবু বললেন, ‘নরবলি দেয়, এমন সভ্য জাতি আর পৃথিবীতে নেই। বিমল, আমরা কোনও অসভ্য জাতিরই কীর্তি দেখছি।’
বিমল নীচে নেমে এল। তারপর সেপাইদের সম্বোধন করে বললে, ‘ভাইসব! আমরা সব নিষ্ঠুর শত্রুর দেশে এসে পড়েছি! সকলে খুব হুঁশিয়ার থাকো, কেউ দলছাড়া হয়ো না! এ শত্রু কারুকেই ক্ষমা করবে না, যাকে ধরতে পারবে তাকেই দানব—দেবতার সামনে বলি দেবে, সর্বদাই এই কথা মনে রেখো! এসো আমার সঙ্গে!’—বলে সে আর একবার সেই ভয়ঙ্কর মুণ্ডগুলোর দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখলে,—একদিন যারা জীবন্ত মানুষের কাঁধের উপরে আদরে থেকে এই সুন্দরী ধরণীর সৌন্দর্য দেখত, আতর—ভরা বাতাসের গান শুনত, কত হাসি—খুশির গল্প বলত।
রামহরি তাড়াতাড়ি সেপাইদের মাঝখানে গিয়ে বললে, ‘বাছারা, তোমরা আমার চারপাশে থাকো, এই বুড়ো—বয়সে আমি আর ভূতুড়ে দেবতার ফলার হতে রাজি নই!’
কমল বললে, ‘কিন্তু ওদের ধড়গুলো কোথায় গেল?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘কোথায় আর, ভক্তদের পেটের ভিতরে!’
সকলে শিউরে উঠল।
বিমল গোমেজের পকেট—বুকখানা বার করে দেখে বলল, ‘মর্টন সাহেবরা পশ্চিম দিক দিয়ে শিখরের দিকে উঠেছিলেন। আমরাও এই দিক দিয়েই উঠব। দেখে মনে হচ্ছে, এই দিক দিয়েই উপরে ওঠা সহজ হবে, কারণ এদিকটা অনেকটা সমতল।’
আগে বিমল ও কুমার, তারপর বিনয়বাবু ও কমল এবং তারপর প্রত্যেক সারে দুইজন করে সেপাই পাহাড়ের উপরে উঠতে লাগল। সকলেরই বন্দুকে টোটা ভরা এবং দৃষ্টি কাকের মতন সতর্ক।
কিন্তু প্রায় বিশ মিনিট ধরে উপরে উঠেও তারা সতর্ক থাকবার কোনও কারণ খুঁজে পেলে না। গোরস্থানেও গাছের ছায়া নাচে, পাখির তান শোনা যায়, ঘাসের মখমল—বিছানা পাতা থাকে, কিন্তু এই ছায়াশূন্যতা, বর্ণহীনতা ও অসাড়তার দেশে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গের দেখা নেই—একটা ঝিঁঝি পোকাও বোধহয় এখানে ডাকতে সাহস করে না। এ যেন ঈশ্বরের বিশ্বের বাইরেকার রাজ্য, সর্বত্রই যেন একটা অভিশপ্ত হাহাকার স্তম্ভিত হয়ে অনন্তকাল ধরে নীরবে বিলাপ করছে। কেবল অনেক নীচে সমুদ্রের গম্ভীর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে, সে যেন অন্য কোনও জগতের আর্তনাদ!
কুমার বললে, ‘পাহাড়ের শিখর তো আর বেশিদূরে নেই, কোথায় সেই সোনার বর্শা আর কোথায় সেই ব্রোঞ্জের দরজা?’
বিমল বললে, ‘সোনার বর্শাটা আর দেখবার আশা কোরো না, কারণ খুব সম্ভব সেটা যাদের জিনিস তাদের হাতেই ফিরে গেছে! আমাদের খুঁজতে হবে কেবল সেই দরজাটা!’
কুমার বললে, ‘আর শ—খানেক ফুট উঠলে আমরা শিখরের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছাব। তারপর দেখছ তো? শিখরের গা একেবারে দেয়ালের মতো খাড়া, টিকটিকি না হলে আমরা আর ওখান দিয়ে ওপরে উঠতে পারব না!’
বিমল বললে, ‘তাহলে দরজা পাব আরও নীচেই। কারণ মর্টন সাহেবরা যে এই পথ দিয়েই এসেছিলেন, সে—বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই দ্যাখো তার প্রমাণ।’—বলেই সে হেঁট হয়ে পাহাড়ের উপর থেকে একটা খালি টোটা কুড়িয়ে নিয়ে তুলে ধরলে।
কুমার বললে, ‘বুঝেছি। সাহেবরা হারানো নাবিকদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে বন্দুক ছুড়েছিল, এটা তারই নিদর্শন।’
বিমল উৎসাহ—ভরে বললে, ‘সুতরাং ‘আগে চলো, আগে চলো ভাই’!’
বিনয়বাবু তখন চোখে দূরবিন লাগিয়ে সমুদ্রের দৃশ্য দেখছিলেন। হঠাৎ তিনি বিস্মিতকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘অনেক দূরে একখানা জাহাজ!’
বিমল দূরবিনটা নিয়ে দেখল, বহু দূরে—সমুদ্র ও আকাশের সীমারেখায় একটা কালো ফোঁটার মতো একখানা জাহাজ দেখা যাচ্ছে।
বিনয়বাবু বললেন,—’লন্ডনে থাকতে শুনেছিলুম, এ—পথ দিয়ে জাহাজ আনাগোনা করে না, তবে ও—জাহাজখানা এখানে কেন?’
বিমল বললে, ‘জাহাজখানা এখনও অনেক তফাতে আছে, দেখছেন না এত ভালো দূরবিনেও কতটুকু দেখাচ্ছে? সম্ভবত ওখানা অন্য পথেই চলে।…কিন্তু ওসব কথা নিয়ে এখন আমাদের মাথা ঘামাবার সময় নেই—’আগে চলো, আগে চলো ভাই’।’
সব আগে চলেছিল বাঘা। তাকে এখন দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ তার সচকিত কণ্ঠের ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল।
বিমল চিৎকার করে বললে, ‘হুঁশিয়ার, সবাই হুঁশিয়ার! বাঘা অকারণে গর্জন করে না।’
তারপরেই দেখা গেল, বাঘা ঝড়ের বেগে নীচের দিকে নেমে আসছে। সে বিমলদের কাছে এসেই আবার ফিরে দাঁড়াল এবং ঘন ঘন ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।
বিমল ও কুমার বন্দুকের মুখ সামনের দিকে নামিয়ে অগ্রসর হল। আচম্বিতে খুব কাছেই উপর থেকে একটা শব্দ এল—যেন প্রকাণ্ড কোনও দরজার কপাট দুড়ুম করে বন্ধ হয়ে গেল।
বিমল ও কুমার এবার ফিরে পিছনদিকে তাকালে। দেখলে, সেপাইরা প্রত্যেকেই বন্দুক প্রস্তুত রেখে সারে সারে উপরে উঠে আসছে—তাদের প্রত্যেকেরই মুখে—চোখে উদ্দীপনার আভাস।
বিমল ও কুমার তখন বেগে শিখরের দিকে উঠতে লাগল।
কিন্তু আর বেশিদূর উঠতে হল না। হঠাৎ তারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের সুমুখেই মস্তবড়ো একটা বন্ধ দরজা এবং আশেপাশে জনপ্রাণীর সাড়া বা দেখা নেই।
তারা অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে দরজাটা দেখতে লগল। এ—রকম গড়নের দরজা তারা আর কখনও দেখেনি—উচ্চতা বেশি না হলেও চওড়ায় তা অসামান্য। খোলা থাকলে তার ভিতর দিয়ে পাশাপাশি ছয়জন লোক একসঙ্গে বাইরে বেরুতে বা ভিতরে ঢুকতে পারে। এবং তার আগাগোড়াই ব্রোঞ্জ ধাতুতে তৈরি।
বিমল এগিয়ে গিয়ে দরজায় সজোরে বারকয়েক ধাক্কা মেরে বললে, ‘কী ভীষণ কঠিন দরজা! আমার এমন ধাক্কায় একটুও কাঁপল না!’
কুমার বললে, ‘কারিগরিও অদ্ভুত। দেখছ, দুই পাল্লার মাঝখানে একটা ছুঁচ গলাবারও ফাঁক নেই।’
বিনয়বাবু বললেন, ‘দরজার গায়ে আর তার চারপাশে শেওলার দাগ দ্যাখো! এর মানে হচ্ছে, এই দরজাটাও এতদিন ছিল সমুদ্রের তলায় অদৃশ্য। এটা এমন মজবুত আর ছিদ্রহীন করে গড়া হয়েছে যে, সমুদ্রের শক্তিও এর কাছে হার মানে!’
কমল হতাশভরে বললে, ‘এখন উপায়? হাতিও তো এ দরজা ভাঙতে পারবে না!’
বিমল বললে, ‘কুমার, নিয়ে এসো তো সেপাইয়ের কাছ থেকে আমাদের ডাইনামাইটের বাক্স। দেখি এ—দরজার শক্তি কত!’
কুমার সিপাইদের দিকে ফিরে চেঁচিয়ে বললে, ‘ডাইনামাইট! ডাইনামাইট!’
তখনই ডাইনামাইটের বাক্স এল। দরজার তলায় সেই ভীষণ বিস্ফোরক পদার্থ সাজিয়ে একটা পলিতায় আগুন দিয়ে বিমল সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আবার নীচের দিকে নেমে গেল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। খানিক পরেই একসঙ্গে যেন অনেকগুলো বজ্র গর্জন করে উঠে সমস্ত পাহাড়টা থরথরিয়ে কাঁপিয়ে দিলে!
বিমল হাত তুলে চিৎকার করে বললে, ‘পথ সাফ! সবাই অগ্রসর হও।’
নবম পরিচ্ছেদ – সত্যিকার প্রথম মানুষ
সবাই বেগে ঘটনাস্থলে গিয়ে উপস্থিত হয়ে দেখলে, কুণ্ডলীকৃত ধূম্রপুঞ্জের মধ্যে পাহাড়ের শিখরটা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে এবং সেই পুরু ব্রোঞ্জের দরজার একখানা পাল্লা ভেঙে একপাশে ঝুলছে ও একখানা পাল্লা একেবারে ভূমিসাৎ হয়েছে।
দরজার হাত দশেক পরেই দেখা যাচ্ছে একটা দেওয়াল বা পাহাড়ের গা। ধোঁয়া মিলিয়ে যাবার জন্যে বিমল ও কুমার আরও কিছুক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করলে। তারপর বন্দুক বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেল।
দরজার পরেই খুব মস্তবড়ো ইঁদারার মতো একটা গহ্বর নীচের দিকে নেমে গিয়েছে এবং তারই গা বয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে সংকীর্ণ পাথরের সিঁড়ির ধাপ!
বিমল হুকুম দিলে, ‘গোটাকয়েক পেট্রোলের লণ্ঠন জ্বালো! নইলে এত অন্ধকারে নীচে নামা যাবে না!’
কুমার কান পেতে শুনে বললে, ‘নীচে থেকে কীরকম একটা আওয়াজ আসছে, শুনছ? যেন অনেক দূরে কোথায় মস্ত একটা মেলা বসেছে, হাজার হাজার অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে!’
সত্যই তাই। নীচে—অনেক দূর থেকে আসছে এমন বিচিত্র ও গম্ভীর সমুদ্রগর্জনের মতন ধ্বনি, যে শুনলে সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে।
বিমল সবিস্ময়ে বললে, ‘নির্জন, নির্জন এই পাহাড়—দ্বীপ, কিন্তু এর লুকানো গর্ভে, চন্দ্র—সূর্যের চোখের আড়ালে কি নতুন একটা মানুষ—জাতি বাস করে? পৃথিবীতে কি কোনও পাতালরাজ্য আছে? তাও কি সম্ভব?’
কুমার বললে, ‘পাতালরাজ্য থাক আর না থাক, কিন্তু আমরা যে হাজার হাজার লোকের গলায় অস্পষ্ট কোলাহল শুনছি, সে—বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘হাজার হাজার কণ্ঠ মানে হাজার হাজার শত্রু। তারা নিশ্চয়ই ডাইনামাইটে দরজা ভাঙার শব্দ শুনতে পেয়েছে—তাই চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে ছুটে আসছে আমাদের টিপে মেরে ফেলবার জন্যে।’
রামহরি কাঁদো কাঁদো গলায় বললে, ‘ও খোকাবাবু! ওরা আমাদের টিপে মেরে ফেলবে না গো, টিপে মেরে ফেলবে না। ওরা খাঁড়া তুলে নরবলি দেবে। আমাদের মুন্ডুগুলো রেঁধে গপ গপ করে খেয়ে ফেলবে। জাহাজে চলো খোকাবাবু, জাহাজে চলো।’
বিমল কোনওদিকে কর্ণপাত না করে বললে, ‘চলো কুমার। আগে তো সিঁড়ি দিয়ে দুর্গা বলে নেমে পড়ি, তারপর যা থাকে কপালে।’
কুমার সর্বাগ্রে অগ্রসর হয়ে বললে, ‘জলে—স্থলে—শূন্যে বহুবার উড়েছে আমাদের বিজয়—পতাকা। বাকি ছিল পাতাল। এইবার হয়তো তার সঙ্গেও পরিচয় হবে! আজ আমাদের—’মাতাল হয়ে পাতাল পানে ধাওয়া।’ ওহো, কী আনন্দ!’
কমল হাততালি দিয়ে বলে উঠল,
‘স্বর্গকথা ঢের শুনেছি,
ঘর তো মোদের মর্ত্যে,
কী আছে ভাই দেখতে হবে
আজ পাতালের গর্তে।’
বিনয়বাবু ধমক দিয়ে বললেন, ‘থামো কমল, থামো। এদের সঙ্গে থেকে তুমিও একটা ক্ষুদ্র দস্যু হয়ে উঠেছ।’
ততক্ষণে কুমার ও বিমলের মূর্তি সিঁড়ির ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
দেখেই রামহরি সব ভয়—ভাবনা ভুলে গেল! উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল, ‘অ্যাঁ, খোকাবাবু নেমে গেছে? আর কি আমরা জাহাজে যেতে পারি—তাহলে খোকাবাবুকে দেখবে কে?’—বলেই সে—ও সিঁড়ির দিকে ছুটল তিরবেগে।
বিনয়বাবু ফিরে সেপাইদের আসবার জন্যে ইঙ্গিত করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন।
পাহাড়ের গা কেটে এই সিঁড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেক ধাপের মাপ উচ্চতায় একহাত, চওড়ায় আধহাত ও লম্বায় কিছু কম, দেড় হাত। এ সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি দুজন লোক নামতে গেলে কষ্ট হয়। বিশেষ সিঁড়ির রেলিং নেই—একদিকে একটা ঘুটঘুটে কালো গর্ত জীবন্ত শিকার ধরবার জন্যে যেন হাঁ করে আছে—একটিবার পা ফসকালেই কোথায় কত নীচে গিয়ে পড়তে হবে তা কেউ জানে না।
বিনয়বাবু বললেন, ‘সকলে একে একে দেওয়াল ঘেঁষে নামো। এ হচ্ছে একেবারে সেকেলে সিঁড়ি। একে সিঁড়ি না বলে পাথরের মই বলাই উচিত।’
ততক্ষণে কুমার ও বিমল গুনে গুনে পঞ্চাশটা ধাপ পার হয়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল যে, অসম্ভব বিস্ময়ে তাদের মুখ—চোখের ভাব হয়ে গেল কেমনধারা। এ—রকম কোনও দৃশ্য দেখবার জন্যে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিল না—পৃথিবীর আর কোথাও এমন দৃশ্য এ—যুগে আর কেউ কখনও দেখেনি।
চতুর্দিকে মাইল—কয়েকব্যাপী একটা উনুনের মতন জায়গা কেউ কল্পনা করতে পারেন? এমনি একটা উনুনেরই মতন জায়গার সুমুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে বিমল ও কুমার হতভম্বের মতন চারিদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগল।
উপর—দিকটা ডোমের খিলানের মতন ক্রমেই সরু হয়ে উঠে গেছে—কিন্তু পুরো ডোম নয়, কারণ তার মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা ফাঁক। সেই গোলাকার ফাঁকটার বেড় অন্তত কয়েক হাজার ফুটের কম নয়। তার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশের নীলিমার অনেকখানি এবং তার ভিতর দিয়ে ঝরে পড়ছে এই অত্যাশ্চর্য উনুনের বিপুল জঠরে সমুজ্জ্বল সূর্য—কিরণ—প্রপাত!
পাহাড়ের গা থেকে একটা পনেরো—বিশ ফুট চওড়া জায়গা ‘ব্র্যাকেটে’র মতন বেরিয়ে পড়েছে, বিমল ও কুমার তারই উপরে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের গা ঘেঁয়ে সেই স্বাভাবিক ‘ব্র্যাকেটটা’ অনেক দূরে চলে গিয়েছে এবং যে—সিঁড়ি দিয়ে তারা নেমেছে সোপানের সার এইখানেই শেষ হয়ে যায়নি, ‘ব্র্যাকেট’টা ভেদ করে নেমে গিয়েছে সামনে আরও নীচের দিকে।
বিমল বললে, ‘কুমার! অদ্ভুত কাণ্ড! এই দ্বীপের মতন পাহাড়টা ফাঁপা—শিখরটাও কেবল ফাঁপা নয়, ছ্যাঁদা। তাই ‘স্কাইলাইটে’র কাজ করছে! এমন ব্যাপার কেউ কখনও দেখেছ—পাহাড়ের পেটের ভিতরে মাইলের পর মাইল ধরে গুহা—দেশ।’
কুমার বললে, ‘নীচে জনতার গোলমাল আর চারিদিকে তার ধ্বনি—প্রতিধ্বনি ক্রমেই বেড়ে উঠছে! উপরের মস্ত ছ্যাঁদা দিয়ে প্রখর আলো আসছে—কিন্তু আলো—ধারার বাইরে দূরে ছায়ার ভিতরে নীচে ঝাপসা ঝাপসা নানা আকারের কী ওগুলো দেখা যাচ্ছে বলো দেখি?’—বলতে বলতে সে দুই—এক পা এগুবার পরেই হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতন প্রকাণ্ড একটা মূর্তি যেন শূন্য থেকেই আবির্ভূত হয়ে একেবারে তার ঘাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কুমার কিছু বোঝবার আগেই তাকে ঠিক একটি ছোট্ট খোকার মতো দু—হাতে অতি সহজে তুলে নিয়ে মাটির উপরে আছাড় মারবার উপক্রম করলে।
কিন্তু বিমলের সতর্ক দুই বাহু চোখের পলক পড়বার আগেই প্রস্তুত হয়ে শূন্যে উঠল, সে একলাফে তার কাছে গিয়ে পড়ে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মূর্তিটার মাথায় করলে প্রচণ্ড এক আঘাত।
সে—আঘাতে সাধারণ কোনও মানুষের মাথার খুলি ফেটে নিশ্চয়ই চৌচির হয়ে যেত, কিন্তু মূর্তিটা চিৎকার করে কুমারকে ছেড়ে দিয়ে একবার কেবল টলে পড়ল, তারপরেই টাল সামলে নিয়ে বেগে বিমলকে তেড়ে এল!
বিমল আবার তার মাথা টিপ করে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে আঘাত করতে গেল।
কিন্তু সেই মূর্তিটার গায়ের জোর ও তৎপরতা যে বিমলের চেয়েও বেশি, তৎক্ষণাৎ তার প্রমাণ মিলল!
সে চট করে একপাশে সরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে একটানে বন্দুকটা বিমলের হাত থেকে কেড়ে নিলে। আজ পর্যন্ত কোনও মানুষই কেবল গায়ের জোরে অসম্ভব বলবান বিমলের হাত থেকে এমন সহজে অস্ত্র কেড়ে নিতে পারেনি।
পরমুহূর্তে বিমলের হাল কী যে হত বলা যায় না, কিন্তু ততক্ষণে তাদের দলের আরও কেউ কেউ সেখানে এসে পড়েছে এবং গর্জন করে উঠেছে রামহরির হাতে বন্দুক।
বিকট আর্তনাদ করে মূর্তিটা শূন্যে বিদ্যুৎ—বেগে দুই বাহু ছড়িয়ে সেইখানে আছাড় খেয়ে পড়ল, আর নড়ল না!
কুমার তখন মাটির উপরে দুই হাতে ভর দিয়ে বসে অত্যন্ত হাঁপাচ্ছে!
বিমল আগে তার কাছে দৌড়ে গিয়ে ব্যস্তস্বরে শুধোলে, ‘ভাই, তোমার কি খুব লেগেছে?’
কুমার মাথা নেড়ে বললে, ‘লেগেছে সামান্য, কিন্তু চমকে গেছি বেজায়! ও যেন আকাশ ফুঁড়ে আমার মাথায় লাফিয়ে পড়ল!’
বিমল মুখ তুলে দেখে বললে, ‘আকাশ ফুঁড়ে নয় বন্ধু! ওই দ্যাখো, সিঁড়ির এপাশেই একটা গুহা রয়েছে! ওটা নিশ্চয়ই ওইখানে লুকিয়ে ছিল!’
কুমার উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘কিন্তু কী ভয়ানক ওর চেহারা আর কী ভয়ানক ওর গায়ের জোর! ওকে মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু ও কি মানুষ?’
বিমল বললে, ‘এখনও ওকে ভালো করে দেখবার সময় পাইনি। এসো, এইবারে ওর চেহারা পরীক্ষা করা যাক!’
তারা যখন সেই ভূপতিত মৃত শত্রুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তখন বিনয়বাবু হাঁটু গেড়ে মূর্তিটার পাশে বসে দুই হাতে তার মাথাটি ধরে তীক্ষ্ন—দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
মূর্তিটা লম্বায় ছয়ফুটের কম হবে না—দেখতেও সে সাধারণ মানুষের মতন, আবার মানুষের মতন নয়—ও! কারণ তার সমস্ত অঙ্গ—প্রত্যঙ্গ সাধারণ মানুষের চেয়ে বড়ো ও অধিকতর পেশিবদ্ধ। তার গায়ের রং ফর্সাও নয়, কালোও নয় এবং সর্বাঙ্গে বড়ো বড়ো চুল! তার মুখ ‘মঙ্গোলিয়ান’ না হলেও, খানিকটা সেই রকম বলেই মনে হয়, আবার তার মধ্যে আমেরিকার ‘রেড ইন্ডিয়ান’ মুখেরও আদল পাওয়া যায়। সারা মুখখানায় পশুত্বের বিশ্রী ভাব মাখানো। মুখে দাড়ি—গোঁফ নেই, মাথায় দীর্ঘ কেশ, গায়ে উলকি এবং পরনে কেবল একটি চামড়ার জাঙ্গিয়া!
বিমল বললে, ‘কুমার, এ নিশ্চয়ই মানুষ, তবু একে মানুষের স্বগোত্র বলে তো মনে হচ্ছে না! এর দেহ আর মানুষের দেহের মাঝখানে কোথায় যেন একটা বড়ো ফাঁক আছে!’
বিনয়বাবু হঠাৎ উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ এ মানুষ! পৃথিবীর প্রথম সত্যিকার মানুষ!’
বিমল বিস্মিত কণ্ঠে বললে, ‘পৃথিবীর প্রথম সত্যিকার মানুষ? তার অর্থ?’
—’তার অর্থ? ‘অ্যানথ্রপলজি’ জানা থাকলে আমার কথার অর্থ বুঝতে তোমার কোনওই কষ্ট হত না! প্রথম সত্যিকার মানুষের নাম কি জানো? ‘ক্রো—ম্যাগনন’! আফ্রিকার উত্তর—পশ্চিম অংশ থেকে আন্দাজ বিশ—পঁচিশ হাজার বছর আগে ক্রো—ম্যাগনন মানুষেরা ইউরোপে গিয়ে হাজির হয়েছিল। আমাদের সামনে মরে পড়ে আছে, সেই জাতেরই একটি মানুষ। আমি একে খুব ভালো করে পরীক্ষা করেছি, আমার মনে আর কোনও সন্দেহই নেই।’
বিমল বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনার কথা যতই শুনছি ততই আমার বিস্ময় বেড়ে উঠছে। আমরা তো আপনার মতন পণ্ডিত কী বৈজ্ঞানিক নই, আমাদের আর একটু বুঝিয়ে বলতে হবে।’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আচ্ছা, তাই বলছি। আগে ইউরোপে সত্যিকার মানুষ আসবার আগে শেষ যে জাতের মানুষ বাস করত তার নাম হচ্ছে ‘নিয়ানডের্টাল’ মানুষ—তাদের চেহারা বানরের মতো না হলেও তাদের দেখলে গরিলার মূর্তি মনে পড়ে। তাদের স্বভাব ছিল বনমানুষের মতো, চলাফেরার ভঙ্গিও ছিল বনমানুষের মতো, সেই ভীষণ বন্য হিংস্র প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে আমাদের কিছুই মেলে না। তাদের সভ্যতা বলতে কিছুই ছিল না। ইউরোপে তারা রাজত্ব করেছিল দুই লক্ষ বৎসর ধরে। তারপর ইউরোপে সত্যিকার মানুষের আবির্ভাব হয়—ক্রো—ম্যাগনন মানুষ হচ্ছে সত্যকার মানুষদের একটি জাত। ক্রো—ম্যাগনন মানুষদের গড়ন ছিল মোটামুটি আমাদেরই মতো। তারা সব উন্নত, তাই নিয়ানডের্টাল মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা না করে ইউরোপ থেকে তারা তাদের বিতাড়িত বা লুপ্ত করে। মনুষ্যোচিত অনেক গুণই যে তাদের ছিল, তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তারা জামা—কাপড় পরত, ঘোড়া পোষ মানিয়ে তার পিঠে চড়তে জানত, মৃতদেহকে সম্মানের সঙ্গে গোর গিত, বঁড়শি গেঁথে মাছ ধরত, ছুরি, ছুঁচ, প্রদীপ, বর্শা, তির—ধনুক প্রভৃতি ব্যবহার করত। ক্রমশ তারা যে খুব সভ্য হয়ে উঠেছিল এমন অনুমানও করা যায়। কারণ ফ্রান্স ও স্পেনের একাধিক গুহার দেওয়ালে দেওয়ালে তারা অসংখ্য জীবজন্তুর যেসব ছবি এঁকেছিল, তা এখনও বর্তমান আছে। এখনকার সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকররাও তাদের চেয়ে ভালো ছবি আঁকতে পারেন না—সেসব ছবির লাইন যেমন সূক্ষ্ম তেমনি জোরালো। তাদের মূর্তিশিল্পের—অর্থাৎ ভাস্কর্যেরও কিছু কিছু নমুনা পাওয়া যায়। যাদের আর্ট এমন উন্নত তাদের স্বভাবও যে ‘নিয়ানডের্টাল’ যুগের তুলনায় অনেকটা উন্নত ছিল এমন কল্পনা করলে দোষ হবে না। পরে উত্তর এশিয়া থেকে আর্যজাতির কোনও দল যায় ভারতে, কোনও দল যায় পারস্যে এবং কোনও দল যাত্রা করে ইউরোপে। আর্যরা ভারতের অনার্যদের দাক্ষিণাত্যের দিকে তাড়িয়ে দেন। ইউরোপীয় আর্যজাতির দ্বারা ক্রো—ম্যাগনন প্রভৃতি ইউরোপীয় অনার্য বা আদিম জাতিরাও বিতাড়িত হয়। হয়তো নানাস্থানে ভারতের মতো ইউরোপেও আর্যের সঙ্গে অনার্যের মিলন হয়েছিল। ভারতের অনার্যরা যে অসভ্য ছিল না, দ্রাবিড়ীয় সভ্যতাই তার প্রমাণ। সুতরাং ইউরোপের আদিম অধিবাসী এই ক্রো—ম্যাগননরাও খুব সম্ভব অসভ্য ছিল না, তাই তারা ওখানকার আর্যদের সঙ্গে হয়তো অল্পবিস্তর মিশে যেতে পেরেছিল। মোটকথা, ইউরোপে ক্রো—ম্যাগনন লক্ষণ—বিশিষ্ট মানুষ আজও এখনও দেখা যায়—যদিও সেখানে ‘ক্রো—ম্যাগনন’ মানুষের জাত লুপ্ত হয়েছে। বিমল, আমি এই বিপজ্জনক দেশে এসে পড়ে পদে পদে ভয় পাচ্ছি বটে, কিন্তু আজ এখানে এসে যে অভাবিত আবিষ্কার করলুম, তার মহিমায় আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা সার্থক হয়ে উঠল। খাঁটি ক্রো—ম্যাগনন জাতের মানুষ আজও যে পৃথিবীতে আছে, এ খবর নিয়ে দেশে ফিরতে পারলে আমাদের নাম অমর হবে।’
বিমল, কুমার ও কমল কৌতূহলে প্রদীপ্ত চোখ মেলে সেই সুপ্রাচীন জাতের আধুনিক বংশধরের আড়ষ্ট মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর বিমল বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনার খাঁটি ক্রো—ম্যাগননরা কত বড়ো সভ্য ছিল জানি না, কিন্তু সে—জাতের একটি মাত্র নমুনা দেখেই আমার পিলে চমকে যাচ্ছে। উঃ, মানুষ হলেও এ বোধহয় গরিলার সঙ্গে কুস্তি লড়তে পারত! এ জাতের সঙ্গে ভবিষ্যতে দূর থেকেই কারবার করতে হবে।’
কুমার বললে, ‘এদিকে আমরা যে আসল কথাই ভুলে যাচ্ছি। জনতার কোলাহল ভয়ানক বেড়ে উঠছে, ব্যাপার কী দেখা দরকার।’
কমল সেই সুদীর্ঘ ‘ব্র্যাকেট’ বা বারান্দার মতো জায়গাটার ধারে গিয়ে নীচের দিকে উঁকি মেরে দেখলে। পরমুহূর্তেই অভিভূত স্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘আশ্চর্য, আশ্চর্য! এ কী ব্যাপার!’
বিমল ও কুমার তাড়াতাড়ি সেইখানে গিয়ে দাঁড়াল। নীচের দৃশ্য দেখে তাদেরও চক্ষু স্থির হয়ে গেল।